গীতোক্ত জ্ঞানযোগ
প্রোজ্জ্বল মন্ডল
প্রথমেই ব্রহ্মজ্ঞান সম্পর্কে ধারণা প্রয়োজন। যার দ্বারা অব্যক্ত হইতে স্থাবর পর্যন্ত বহুধাবিভক্ত সর্বভূতে এক অবিভক্ত অক্ষর আত্মবস্তু দৃষ্ট হয় ,যার দ্বারা বিনাশশীল,সর্বভূতে নির্বিশেষ ভাবে অবস্থিত অবিনাশী পরমাত্মাকে দর্শন করা যায় এবং যার দ্বারা জীব ব্রহ্মের অভেদতত্ব প্রকাশিত হয় তাই হলো ব্রহ্মজ্ঞান।ব্রহ্মজ্ঞান থেকে মোক্ষলাভ হয়।অর্থাৎ ব্রহ্মজ্ঞানী জন্ম মৃত্যুর বন্ধন থেকে মুক্ত হন।জ্ঞানী সম্যগদর্শী ব্যক্তি সমস্ত প্রাণীতে পরমাত্মার দর্শন করেন।এককথায় যা দ্বারা আত্মতত্ব উপলব্ধি করা যায় তাই হল ব্রহ্মজ্ঞান।গীতায় জ্ঞান বলতে ব্রহ্মজ্ঞানকেই বোঝানো হয়েছে।
▪️জ্ঞানমার্গ সম্পর্কে ভগবান শ্রীকৃষ্ণ বলেছেন --
'যে ত্বক্ষরমনির্দেশ্যমব্যক্তং পর্যুপাসতে ।
সর্বত্রগমচিন্ত্যঞ্চ কূটস্থমচলং ধ্রুবম্ ॥
সংনিয়ম্যেন্দ্রিয়গ্রামং সৰ্বত্ৰ সমবুদ্ধয়ঃ ।
তে প্ৰাপ্নুবন্তি মামেব সর্বভূতহিতে রতাঃ ॥'
—সর্বত্র সমবুদ্ধি, সকলেরই কল্যাণে নিরত, যাঁরা ইন্দ্রিয়গুলিকে সংযত করে শব্দাদির অগোচর, অব্যক্ত, সর্বব্যাপী,অচিন্ত্য,নির্বিকার, অচল ও শাশ্বত নির্গুণব্রহ্মকে উপাসনা করেন, তাঁরা আমাকেই প্রাপ্ত হন।
এখানে শ্রীভগবান জ্ঞানীর লক্ষ্য নির্গুণব্রহ্ম সম্বন্ধেও বললেন,আবার ‘সংনিয়ম্য ইন্দ্রিয়গ্রামম্’, ‘সৰ্বত্ৰ সমবুদ্ধয়ঃ’, ‘সর্বভূতহিতে রতাঃ' বলে জ্ঞানমার্গের সাধনপদ্ধতিরও উল্লেখ করলেন।
জ্ঞান সম্পর্কে যেমন তিনি বলছেন, ‘ন হি জ্ঞানেন সদৃশং পবিত্রমিহ বিদ্যতে’–‘জ্ঞানের সদৃশ পবিত্র আর কিছুই এ জগতে নেই।' এখানে জ্ঞান মানে ব্রহ্মজ্ঞান। ‘জ্ঞানাগ্নিঃ সর্বকর্মাণি ভস্মসাৎ কুরুতেহর্জুন।' ‘জ্ঞানাগ্নি সমস্ত কর্মকে পুড়িয়ে শেষ করে দেয়।' আবার তিনি বলছেন,‘ক্লেশোঽধিকতরস্তেষাম-ব্ যক্তাসক্তচেতসাম্’–‘অব্যক্তের যাঁরা চিন্তা করেন, জ্ঞানের অনুশীলন যাঁরা করেন তাঁদের অত্যন্ত ক্লেশ হয়।করেন তাঁরা দেহবান।দেহ এবং জগতের সবকিছুকে উপেক্ষা করে নির্গুণ অব্যক্তকে লাভ করা অত্যন্ত ক্লেশকর।এই অব্যক্তই হচ্ছে পরমতত্ত্ব,নির্গুণব্রহ্ম।
▪️শঙ্করাচার্যের মতে --‘তস্মাৎ গীতাসু কেবলাদেব তত্ত্বজ্ঞানাৎ
মোক্ষপ্রাপ্তিঃ, ন কর্মসমুচ্চয়াৎ।' অর্থাৎ গীতার সিদ্ধান্ত এই যে,কেবলমাত্র তত্ত্বজ্ঞানেই মুক্তিলাভ হয়, জ্ঞান ও কর্মের সমুচ্চয়ের ফলে নহে। তাঁহার মতে, ব্রহ্মাত্মৈক্যদর্শনরূপ জ্ঞান দ্বারা অজ্ঞান বিনাশপূর্বক নৈষ্কর্ম্যসিদ্ধি, ব্রাহ্মীস্থিতি বা ব্রহ্মনির্বাণলাভই গীতার উপদেশ। অজ্ঞানই দ্বৈতভাব-উৎপাদক। এই দ্বৈতভাব হইতেই সকল কর্ম হয়। দ্বৈতভাব-নাশান্তে নিষ্ক্রিয় আত্মায় প্রতিষ্ঠিত হইলেই সর্ব-কর্মসন্ন্যাস হয়। নিষ্কাম কর্ম, ভক্তি বা যোগ দ্বারা চিত্ত শুদ্ধ হইলে মানুষ মুমুক্ষু হয়।আত্মজ্ঞানলাভ না হইলে নৈষ্কর্ম্যসিদ্ধি অসম্ভব।
▪️রামানুজাচার্যের মতে জীব (চিৎ), জগৎ (অচিৎ) ও ব্রহ্ম—এই তিনটি তত্ত্ব স্বতন্ত্র হইলেও ব্রহ্ম জগৎ ও জীববিশিষ্ট। তাঁহার মতে,ব্রহ্মের সঙ্গে জীব ও জগতের স্বজাতীয় ও বিজাতীয় ভেদ না থাকিলেও স্বগতোভেদ অবশ্য স্বীকার্য। তাঁহার দার্শনিক মত বিশিষ্টাদ্বৈতবাদ ও তিনি ভক্তিধর্মের প্রচারক। তিনি বলেন,‘বর্ণাশ্রমধর্ম অবশ্য পালনীয়।' কারণ সকল শাস্ত্র এই বিষয়ে একমত —‘একশাস্ত্রার্থতয়ানুষ্ঠেয়ম্' ।এছাড়া তিনি বলেছেন
—‘অনভিসংহিত-ফলেন কেবল-পরম-পুরুষারাধনরূপেণানুষ্ ঠিতেন কর্মণা বিধ্বস্ত-মনো-মলব্যাকুলেন্দ্রি য়ো
জ্ঞাননিষ্ঠায়াম্ অধিকরোতি।'
অর্থাৎ ফলাকাঙ্ক্ষা বিসর্জন করিয়া ঈশ্বরকে প্রসন্ন করিবার জন্য বর্ণাশ্রমধর্ম অনুষ্ঠিত হইলে ‘ভাবসংশুদ্ধি’ হয় এবং মানুষ জ্ঞানের অধিকারী হয়।