নাহ, পৃথিবীটা এখনও রসাতলে যায়নি
সমাদৃত দাস (অষ্টম শ্রেণি)
কালাচাঁদ বাবু দেখতে দেখতে রিটায়ার করে গেলেন। তিনি ব্যাংকে কর্মরত একজন অফিসার ছিলেন। তিনি কলকাতায় সল্টলেকের একটি ফ্ল্যাটে বসবাস করতেন। কিন্তু ব্যক্তিগত ও পারিবারিক কিছু অসুবিধার কারণে তাঁকে ফ্ল্যাট বদল করতে হয়। তবে সৌভাগ্য যে কলকাতার মধ্যেই একটি জায়গায় তিনি ফ্ল্যাটটি কিনেছেন। এখনকার দিনে তো আবার আকাশ ছোঁয়া ফ্ল্যাটের আকাশ ছোঁয়া দাম। অগ্নি মূল্য যেন। হাত দিলেই ছ্যাঁকা লাগে। তবে উনি জীবনে যা টাকা সঞ্চয় করে রেখেছেন তাতে করে বাকি জীবনটা অনায়াসেই কেটে যাবে। আর তারপরে তো পেনশন রয়েছেন। তাই জন্য তো কালাচাঁদ বাবু প্রায়শই তাঁর স্ত্রী কে বলেন,"আমার কাছে আছে পেনশন, বাকি জীবনটা নো টেনশন"— বলার পরে অবশ্য তিনি এবং তাঁর স্ত্রী দু-জনেই বেশ হেসে ফেলেন। যাইহোক এইভাবেই দিন ক্রমাগত এগিয়ে চলল তার গতিতে কিন্তু কালাচাঁদ বাবুর জীবনে এমন এক ঘটনা ঘটল যা তাঁকে বড্ড নাড়া দিল, কিছুদিন পরেই সরস্বতী পুজো। পাড়ার কিছু গুন্ডা-বদমাশ ছেলে সরস্বতী পুজোর নাম করে চাঁদা তোলে কিন্তু সরস্বতী পুজো তো দূর অস্ত ঠাকুরের একটা ছবিও আনে না। আর বলতে গেলে রীতিমতো থ্রেট করে। তার জন্য আর কেউ ভয়ে মুখ খোলে না। আর চুপচাপ চাঁদার অ্যামাউন্ট দিয়ে দেয়। আর পুলিশকে বলতে যাওয়ার কথা বললে বা ওদেরকে ভয় দেখালে ওরা মোবাইল থেকে একখানি ছবি বার করে দেখিয়ে দেয়। ছবিতে স্পষ্ট দেখা যায় পুলিশের সঙ্গে ওদের গলায় গলায় ভাব। অনেকের মনে হয়, ছবিটা বোধহয় এডিটিং করা। কিন্তু তা নয়, বাস্তবেও দেখা গিয়েছে তাই। তো যাইহোক দুটো মধ্যবয়স্ক ছেলে ওদের ফ্ল্যাটে চাঁদা চাইতে গেল। সিকিউরিটির ওদেরকে কিছু বলার কোনো ক্ষমতা নেই। ওরা সোজা চার তলায় চলে গেল। তারপরে ফোর-বি তে কলিংবেল প্রেস করল। কালাচাঁদ বাবু এখন সর্বক্ষণ বাড়িতে থাকেন।আগে অফিসে যেতেন। রিটায়ার করার পর বাড়ি থেকে দরকারের বাইরে আর বেরোন না। তিনি আইহোলের সাহায্যে দেখলেন, বাড়িতে থুড়ি ফ্ল্যাটে কে এসেছে? মধ্যবয়স্ক দুটো ছেলেকে এইভাবে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে কালাচাঁদ বাবুর মনে সন্দেহের দানা বাঁধল। কালাচাঁদ কয়েকক্ষণ ভেবে দরজাটা খুললেন। দরজাটা খুলেই গম্ভীর গলাতে বললেন,"কী চাই?"
ওদের দুই জনের মধ্যে থেকে একজন বিনীত সুরে বলল,"সরস্বতী পুজোর চাঁদা নিতে এসেছি।"
কালাচাঁদ বাবু এইবার স্বাভাবিক গলাতে বললেন,"তা কত দিতে হবে? পঞ্চাশ টাকার বেশি কিন্তু এক পয়সাও দিতে পারব না।"
ওই ছেলেটি একটু হেসে বলল— ৮০১/- টাকা।
কালাচাঁদ বাবু প্রথমে টাকার অ্যামাউন্টটা শুনে একটু বিষম খেয়ে গিয়েছিলেন। তারপরে কিছুক্ষণ নির্বাক দৃষ্টিতে ওদের দিকে চেয়ে বললেন,"তোমাদের মাথাটা কি সত্যি সত্যিই খারাপ হয়ে গিয়েছে? ৮০১/- টাকা? আমি মরে গেও অত টাকা দিতে পারব না। এটা কি বাঁদরামি হচ্ছে?"
ওদের একজন একটু দাদাগিরির মতো করে বলল,"আসলে তো তুই এই পাড়ার লোক না, তাই আমাদের ডিম্যান্ড জানিস না। বেশি কথা বললে বাইরে দিয়ে দরজা বন্ধ করে আগুন লাগিয়ে দিয়ে চলে যাব। তখন বুঝবি ঠেলা। কেউ বাঁচাতে আসবে না।"
ভেতর থেকে খুব সম্ভবত কালাচাঁদ বাবুর স্ত্রী সব কথা মন দিয়ে শুনছিলেন। তারপরে বললেন,"থাক না, ওদের সাথে বেকার ঝামেলা করে কোনো লাভ নেই। কী করতে কী হয়ে যায়? তুমি বরং ওদের টাকাটা দিয়েই দাও। এক প্রকার বাধ্য হয়েই সমস্ত টাকা মিটিয়ে দিলেন কালাচাঁদ বাবু। তারপরে সরস্বতী পুজোর দিন রাস্তা দিয়ে একটা কাজ করে ফিরছিলেন কালাচাঁদ বাবু। যেখানে সরস্বতী পুজো হওয়ার কথা সেইখানে রীতিমতো ডি.জে বাজছে। প্রকাশ্যে মদ্যপান চলছে। এই দৃশ্য দেখে কালাচাঁদ বাবু প্রতিবাদী কন্ঠে বলে উঠলেন,"এইসব কী বাঁদরামি হচ্ছে? মায়ের পুজোর নাম করে এইসব কী হচ্ছে?" বাকিটা আর শেষ হল না। ওদের কিছু ছেলেপিলে মদ্যপান করা অবস্থায় দৌড়ে এসে বলল,"তবে রে বুড়ো, এই দেখ।" বলে ধুতি টেনে খুলে দিলেন অত ছেলের সামনে। নিজেকে এই রূপে দেখে রীতিমতো লজ্জায় মাথা নীচু করে বাড়ি ফিরে এলেন কালাচাঁদ বাবু। এই ঘটনার বেশ কিছু দিন পর, একদিন সকালে যখন ধোঁয়া ওঠা গরম চায়ের কাপ নিয়ে কালাচাঁদ বাবু ফ্ল্যাটের জানালায় বসলেন তখন দেখতে পেলেন ওই বদমাশ দুটো প্রাণ হাতে নিয়ে ছুটছে উলঙ্গ অবস্থায়। পিছনে তিন-চারটে সারমেয়ও
ওদের পেছনে দাঁত মুখ খিঁচিয়ে ছুটছে। এই দৃশ্য দেখে কালাচাঁদ বাবুর মুখে একটা গাঢ় হাসির রেখা ফুটে উঠল। নাহ, পৃথিবীটা এখনও পর্যন্ত রসাতলে যায়নি। বাপেরও বাপ আছে। তাঁর ঘটনার প্রতিশোধ আজ অবশেষে জনসমক্ষে ঘটল।