ঈশ্বর ও প্রেমের স্বরূপ
মৌমিতা চ্যাটার্জী
“জীবে প্রেম করে যেই জন
সেই জন সেবিছে ঈশ্বর”
অমোঘ এই উক্তিটির তাৎপর্য সর্বজনবিদিত ও বন্দিত। সংসারের প্রতিটি জীবের প্রতি প্রেমবিতরণ, সমবেদনাই সারসত্য। প্রেমহীন মানব জগতের কোনো অস্তিত্বই নেই। নির্মল প্রেমের সাঁকো ধরেই আমরা পৌঁছতে পারি পরমাত্মার কাছাকাছি।
নিরাকার ব্রহ্মের প্রতি অনুরাগের প্রবণতাই প্রেম।
প্রেম ও কাম, আপাতদৃষ্টিতে তাদের মধ্যে কিছু সম্পর্ক থাকলেও দুটি বিষয় সম্পূর্ণ ভিন্ন।
আমরা শ্রীচৈতন্য চরিতামৃতে দেখে থাকি,
“ আত্মেন্দ্রিয় প্রীতি বাঞ্ছা তারে বলি কাম,
কৃষ্ণেন্দ্রিয় প্রীতি ইচ্ছা ধরে প্রেম নাম”।
অর্থাৎ শ্রীকৃষ্ণের প্রতি অনুরাগ, ভক্তিভাব তাই হল প্রেম।
“ কাম প্রেমে বহুত অন্তর,
কাম অন্ধতম, প্রেম নির্মল ভাস্কর”
কাম হল মানবচিন্তনের অন্ধকারতম স্থান, প্রেম সূর্যের ন্যায় পবিত্র, নির্মল।
অর্থাৎ বলা যায় শ্রীগোবিন্দের প্রতি শুদ্ধ ভালোবাসার সম্পর্কই প্রেম। যা জড়জাগতিক ইচ্ছাপূরণ যা তৃপ্তিনির্ভর তা কখনই প্রেম নয়। স্বতঃস্ফূর্তভাবে, অমল চিত্তে একনিষ্ঠভাবে ইষ্টসাধনাই প্রেমের স্বরূপ। রাধারানী ও শ্রীকৃষ্ণের প্রেমই জগতে শুদ্ধতম প্রেমের উদাহরণ। সে প্রেম সকল স্বার্থরহিত, সেখানে কেবল অনন্ত শান্তির উদ্দেশ্যে একে অপরের প্রতি অনুরক্ত।
শ্রীকৃষ্ণদাস কবিরাজের কথায়,
“ গোপীগণের প্রেমের রূঢ়ভাব নাম,
বিশুদ্ধ নির্মল প্রেম কভু নহে কাম”।
অর্থাৎ ব্রজধামে গোপিনীগণের প্রেমও নির্মল, পবিত্র। সেখানে কামের কোনো অস্তিত্ব নেই।
বিশুদ্ধ প্রেম উপাধিশূন্য, চাহিদাশূন্য নিষ্কাম হয়ে অপরকে সুখী করার আন্তরিক ইচ্ছা। পরমেশ্বরকে লাভ করার প্রবল ইচ্ছাই প্রেম,এখানে কিছু ভক্তিরসও জড়িত।
অনুরাগের জন্য অহেতুক অভিমান, রাগ, দ্বেষ, যা পার্থিব মিথ্যাভাবেরই সমার্থক তাকে ত্যাগ করা উচিত। উদ্বেগহীন হৃদয়েই প্রেমের সঞ্চারণ ঘটে যা জগতের জন্য হিতকর। তাতে আত্মশুদ্ধিও ঘটে। প্রেম ও প্রমাস্পদ একাত্ম হয়ে ভক্ত ও পরমেশ্বরের স্বরূপ লাভ করে। আত্মত্যাগ, আত্মসমর্পণের মধ্যে দিয়েই বিকশিত হয় পবিত্র প্রেমের জ্যোতি। এই ত্যাগই অন্তরের বৈরাগ্যকে আলোকিত করে। অমল হয় দেহ, মন। তখনই প্রেমভাব দিব্যভাব রূপে আনন্দধারায় বইতে থাকে মানবের পবিত্র অন্তরাত্মায়।
হৃদয়কে হরন করেন যিনি, তিনি হরি এবং হৃদয়কে আকর্ষণ করেন যিনি তিনি কৃষ্ণ। হৃদয়কে রমণ করে যিনি, তিনিই রাম অর্থাৎ জীবাত্মা আবর্তিত হয় জগতপালক জগতের নাথকে ঘিরেই।
মানব, ভগবৎ চিন্তায় ব্রতী হও। তার প্রতি একাত্ম হয়ে নিবেদন কর নিজেকে সম্পূর্ণভাবে, তিনি ব্যাতীত এ জগৎ মিথ্যা।
“ব্রহ্ম সত্য জগৎ মিথ্যা”- আদি শঙ্করাচার্য।
অর্থাৎ এ জগতে ব্রহ্মই শেষ কথা। জগত তাতেই সৃষ্টি ও তাতেই বিলীন। সকল সংকীর্ণতার, উর্দ্ধে গিয়ে অকারণ, স্বভাবজাত, স্বার্থহীন প্রেম বিতরণের মধ্য দিয়ে খুঁজে পাওয়া যায় ব্রহ্মকে। বৈরাগ্য ও নিয়মিত সংযমই পারে মানব আত্মাকে পরিশুদ্ধ করতে। সকল মন শুভ সমকল্পযুক্ত হোক।
হরি ওঁ তৎসৎ