সত্যিকারের ভূতের ব্যাটা
মৃণাল বন্দ্যোপাধ্যায়
ভূতনাথ বাবুর একমাত্র আদরের ছেলে বুদ্ধিনাথের বতর্মান বয়স কত আর হবে, খুব বেশি হলে ধরুন একুশ কি বাইশ। খুবই আশা করে অনেক ভেবে চিন্তেই নাম রেখেছিলেন ছেলের। ভেবেছিলেন ছেলেকে বিলেত ফেরত করাবেন। ছেলে নিশ্চই বিদ্যা বুদ্ধিতে যাকে বলে এক্কেবারে গ্রামের সেরা ছেলে হবে, কিন্তু বিধি বাম। ঐ যে, সুকুমার বাবুর কবিতাতে আছে না? “ উনিশটিবার ম্যাট্রিকে সে, ঘায়েল হয়ে থামলো শেষে”, অনেকটা ঐরকম। তবে উনিশটি বার নয়, কারণ অত বার চেষ্টা করার সুযোগ তার বাড়ির থেকে সে আর পায়নি, তবে সর্বসাকুল্যে মোট পাঁচবার। লেখাপড়ায় খারাপ মাথা নয় মোটেই। বাংলা কিংবা ইংরেজি থেকে প্রশ্ন করুন, দিব্যি চটপট উত্তর দিয়ে দেবে। জিজ্ঞেস করুন, পানিপথের দ্বিতীয় যুদ্ধ কবে হয়েছিল? না ভেবেই এক্কেবারে সঠিক উত্তর। কিন্তু ঐ যে, অঙ্ক। ঐ একটা আপদের জন্যই পরপর পাঁচবার। লাষ্টের আগের দুবার পরপর তাও তিন নম্বর করে বাড়তে বাড়তে তেইশ পযর্ন্ত পৌঁছেছিল। সবাই ভেবেছিল পঞ্চমবারে এই গতিতে উন্নতি ঘটলে অঙ্কে ছাব্বিশ নম্বর পেয়ে ঠিক উতরে যাবে। কিন্তু তেইশ থেকে যে একেবারে রসগোল্লা হয়ে যাবে, সেটা দুঃস্বপ্নেও কেউ ভাবতেই পারেনি। বেচারা !! দীর্ঘদিনের এই অক্লান্ত পরিশ্রম, সবটাই মাটি। আর সেইথেকেই তো ভূতনাথ বাবু কেমন যেন একটা হয়ে গেলেন। দশটা প্রশ্ন করলে একটার উত্তর দেন, তাও ভুলে ভরা। হবে না? ছেলে ছেলে করে তিন তিনটে মেয়ের পর বংশের একমাত্র চিরাগের সলতে ঐ বুদ্ধিনাথ। ভূতনাথ বাবুও আজ আর নেই। রক্ষিত’দের স্নান পুকুরে এইতো সেদিন, মাত্র মাস চারেক আগে, স্নান করতে নেমে সেই যে ডুব দিলেন আর উঠলেন না। সবাই মিলে খোঁজ খোঁজ কিন্তু পাক্কা দুদিন বাদে ফুলে ঢোল হয়ে ভেসে উঠলেন। সেই থেকে ঐ পুকুরে গ্রামের কেউ আর স্নান করেনা। ভয়ে বা বলতে পারেন আতঙ্কে। সবারই বিশ্বাস পুকুরের জলের তলায় এমন কিছু আছে যেটা ভূতনাথ বাবুকে জলের গভীরে টেনে নিয়ে গেছে, শরীরটাকে ছেড়েছে প্রাণহীন অবস্থায় দু'দিন বাদে।
আরে বুদ্ধিনাথকে আপনিও চেনেন। এক ঝাঁকড়া মাথা ভর্তি এলোমেলো চুল। পরনে সাদা ঢলা পাজামা, বড় করে দড়ি বাধা। আর গায়ে হলদে ছোপ ছোপ সাদা গেঞ্জি। দেখলে মনে হবে বোধহয় গত বেশ কয়েকদিন স্নান খাওয়া করেনি। না না, ওদের অবস্থা খারাপ নয়। বাড়িতে দু-দুটো তাঁত আছে। শাড়ি, লুঙ্গি, গামছা প্রভৃতি তৈরি হয়। তিনজন কর্মচারী ও আছে। তারাই সব কাজকর্ম দেখাশোনা করে। বড় মেয়ের দু ক্রোশ দূরে শিউলিপুর গ্রামে বিয়ে হয়েছে বছর চারেক আগে। ছেলের বাড়ির অবস্থা বেশ ভালোই। বিঘা বিশেক ধানি জমি, গোটা দুয়েক পুকুর, একটা বাঁশ বাগান। বড় জামাই-ই এখন শশুর বাড়ির ব্যবসা দেখাশোনা করে। আগে ভূতনাথ বাবুই একা হাতে সব দেখভাল করতেন। বুদ্ধিনাথের বিষয় আশয়ে কোনদিনই মন নেই। সে আছে তার আপন ভোলা জগৎ নিয়ে। প্রকৃতি প্রেমিক সে। সারাদিন আশেপাশের দু-তিনটে গ্রামের মাঠে ঘাটে, বনে বাদাড়ে সে ঘুরে বেড়ায়। কিসের খোঁজে? সে শুধু সেই জানে। জিজ্ঞেস করলে একগাল হেসে সে কি উত্তর দেয় জানেন? “ আমার তো বুদ্ধি নেই, তাই বুদ্ধি খুঁজে বেড়াচ্ছি।
“একদিন জিজ্ঞেস করলাম, “কিরে বুদ্ধিনাথ, খুঁজে পেলি তোর বুদ্ধি?” উত্তরে এক গাল নির্মল হেসে জবাব দিল, “ না গো, পরাণ কাকু, এখনো পাইনি। তবে দেখবে খুব শীঘ্রই পেয়ে যাবো। কথাটা মিলিয়ে নিও।“
আমার মুখে ওকে বলার মতো আর কিছু খুঁজে পেলাম না। ওর পিঠে, মাথায় হাত বুলিয়ে শুধু বললাম, “কখনো খুঁজে পেলে আমাকে অবশ্যই এনে দেখাবি তোর ঐ বুদ্ধি। আমিও দেখতে চাই তোর বুদ্ধি ঠিক কেমন দেখতে।
“ বাবার মৃত্যুর দিন কুড়ি পর থেকেই প্রায় প্রত্যেক দিন সন্ধ্যের পর যখন আশেপাশে কেউ থাকেনা তখন বুদ্ধিনাথ রক্ষিতদের স্নান পুকুরের বাঁধানো সিঁড়িতে একলা এসে বসে। পুকুরের শান্ত কালো জলের দিকে একদৃষ্টে চেয়ে থাকে। বাবাকে খোঁজে। কারণ মৃত্যু ব্যাপারটা তার বোধগম্য নয়। সে বিশ্বাস করে এই পুকুরের জলের ভেতরে তার বাবাও তার দিকে তাকিয়ে বসে আছে। তাকে দেখছে। মেজদি ‘কে সে জিজ্ঞেস করেছিল দুদিন আগেই--”
বাবা কোথায় গেছে রে দিদি? বাবা আবার কবে ফিরে আসবে ? বাবাকে খুব দেখতে ইচ্ছা করে।”
দিদি সত্যিটা না বলে, জানে ভাই বুঝবে না, বলেছিল,” ঐ পুকুরের জলের ভেতরে একটা রাজপ্রাসাদ আছে, যাকে বলে স্বর্গ। বাবা ওখানে তোর জন্যে বুদ্ধি চাইতে গেছে ভগবানের কাছে। যেদিন পেয়ে যাবে সেদিন দেখবি বাবা ঠিক তোর জন্যে অনেকটা বুদ্ধি নিয়ে তোর কাছে ফিরে আসবে। আর সেই বুদ্ধি মাথায় মেখে তুই এই গ্রামের সেরা বুদ্ধিমান ছেলে হয়ে যাবি। কেউ তোর সাথে মজা করবে না, উল্টে তোর কাছ থেকে বুদ্ধি ধার করে নিজেদের বুদ্ধির গোড়ায় শান দেবে।
“দিন গড়িয়ে মাস যায় কিন্তু বাবা আর ফেরত আসেনা বুদ্ধি নিয়ে। সে অস্থির হয়ে তার বাবাকে নিজের মতো করে জোড় গলায় ডাকে, “ও বাবা, বাবা, বুদ্ধি কি খুঁজে পেলে? আর কতদিন সময় লাগবে? আমি যে আর অপেক্ষা করতে পারছি না। গ্রামের সবাই আমাকে নিয়ে কতরকম মজা, ব্যঙ্গ করে। ও বাবা, বাবা গো, তুমি কি আমার গলা শুনতে পাচ্ছো না”
নিজের মনেই কাঁদতে থাকে বুদ্ধিনাথ। স্বর্গের দেবতাদের ওপরে ভীষণ রাগ হয় বুদ্ধিনাথের। সে দেবতাদের উদ্দেশ্যেও চিৎকার করে বলতে থাকে, “তোমরা এতো হিংসুটে আর কৃপণ কেনো গো? আমার বাবাকে আমার জন্য একটু বুদ্ধি ধার দিতে পারছো না? আমি তোমাদের কথা দিচ্ছি, আমার যখন অনেক অনেক বুদ্ধি হয়ে যাবে তখন আমি তোমাদের দেওয়া বুদ্ধি সবটা হিসেব করে শোধ করে দেব।“
আকাশের সমস্ত উজ্জ্বল তারারা বুদ্ধিনাথের কান্না শোনে আর ভাবে,” সত্যিই তো, ঈশ্বরের ক্রিয়াকলাপ এতো বিচিত্র কেন? কাউকে প্রয়োজনের বেশি বুদ্ধি দিচ্ছেন আবার কারোর জন্যে ছিটে ফোটা বুদ্ধিও তার ঝুলি থেকে বের হচ্ছেনা!! অথচ সবাইকে তো তিনিই নিজের ইচ্ছায় নিজের হাতে তৈরি করছেন। তবে তার সৃষ্টি বৈচিত্রে এ কিসের ইঙ্গিত? আসলে তিনি ভালোমতোই জানেন যে বুদ্ধিমানেরা তাকে মাথায় তুলে নাচবে না। কারণ তারা সত্যতা যাচাই করে সন্তুষ্ট হলে তবেই ঈশ্বরের উপস্থিতিকে মান্যতা দেবে। কিন্তু বুদ্ধিনাথের মতো বোকা কম বুদ্ধির মানুষেরাই কোন কিছুর পেছনে যথার্থ কারণ খুঁজবে না। উল্টে ভালো মন্দ সবকিছুর জন্যেই ঈশ্বরের শরণাপন্ন হবে। তাকেই শয়নে জাগরণে স্মরণ করবে, আকুল হয়ে ডাকবে। আর স্বাভাবিকভাবে ঈশ্বর তো এটাই চাইবেন।
“এবং এরকমই একটা দিনে হঠাৎ করেই পুকুরের জলটা চারদিক থেকে একটা স্নিগ্ধ আলোয় ভরে উঠলো। মনে হচ্ছে যেন পুকুরের জলের ভেতর থেকে পূর্ণিমার চাঁদ ভেসে উঠছে। কিন্তু সত্যি সত্যিই যেটি উঠে এলো সেটি অনেকটা চ্যাপটা এবং গোলাকার আকৃতির একটি উজ্জ্বল মহাকাশ যান। মহাকাশ যানটি পুকুরের জলের তলের থেকে দু-ফুট উঁচুতে স্থির হয়ে দাড়ালো এবং তার সম্মুখ থেকে একটি আলোকিত পথ বুদ্ধিনাথের পায়ের কাছে এসে থামলো এবং বুদ্ধিনাথকে অবাক করে দিয়ে সেই পথ ধরে হেটে এগিয়ে এলেন স্বয়ং ভূতনাথ। ভূতনাথ কাছে এসে বুদ্ধিনাথের মাথায় আশীর্বাদ করার ভঙ্গিতে ক্ষণিকের জন্য তার দুই হাত রাখলেন এবং ঘুরপথে সেই মহাকাশ যানে উঠে আকাশপথে দূরের অন্ধকারে মিলিয়ে গেলেন। বুদ্ধিনাথের জিহ্বা সেই সময় টুকুর জন্যে বিস্ময়ে অবশ হয়ে গিয়েছিল।
সে বাড়িতে ফিরে এসে চুপচাপ সোজা তার ঘরে গিয়ে ভেতর থেকে দরজা বন্ধ করে আলো নিভিয়ে দিয়ে শুয়ে পরলো। মেজদি পারুলের কেমন যেন অবাক ঠেকলো। ভাইতো এইধরণের আচরণ আগে কখনও করেনি। দেখে মনে হলো যেন সম্পূর্ণ এক অন্য জগতের মানুষ।পারুল মনে মনে ভাবলো যাকগে, হতে পারে শরীর ক্লান্ত লাগছে তাই হয়তো ঘরের আলো নিভিয়ে তাড়াতাড়ি শুয়ে পরেছে। ঠিক আছে। কালকে সকালেই না হয় কথা বলে নেওয়া যাবে।
পরের দিন অনেক সকালে উঠে বুদ্ধিনাথ চোখ মুখ ধুয়ে ভালো করে মুছে সোজা ওর বাবার দেওয়ালে টাঙানো ছবির নীচে দাড়িয়ে হাত জোড় করে প্রণামের ভঙ্গিমায় নিজের মনেই বলতে শুরু করলো--
“বাবা, তুমি কালকে আমাকে তোমার বুদ্ধির যে অংশ দিয়ে গেলে তাতে করে আমার মনের সমস্ত অন্ধকার দূর হয়ে গিয়ে আমি এক নতুন মানুষ হয়ে উঠেছি। গতকাল রাতে আমার যেন দ্বিতীয় জন্মলাভ হয়েছে। আমি এইটুকু বুঝতে সক্ষম হয়েছি যে, আমাদের জানা জগতে এই মুহূর্তে ঈশ্বর বলে কিছু নেই কারণ তিনি আমাদের পৃথিবীতে প্রথম আদম ও ইভকে জন্ম দেওয়ার পরে আমাদের এই ব্রহ্মান্ড ছেড়ে অন্য কোনো তারামন্ডলে অন্য কোনো নতুন প্রাণময় জগত সৃষ্টিতে মননিবেশ করেছেন, আমাদেরই আদিম সৃষ্টির হাতে আমাদের পরবর্তী প্রজন্মের দায়ভার চাপিয়ে দিয়ে। অর্থাৎ, আমাদের পূবপুরুষ বা পিতা মাতাই হচ্ছেন আমাদের প্রকৃত ঈশ্বর। আর তাই মন্দির বা মসজিদে গিয়ে ঈশ্বর বা আল্লাহর উপাসনা না করে আমাদের উচিত বাড়ির চার দেওয়ালের গন্ডির মধ্যে নিজেদের পিতা মাতা’ কেই ঈশ্বর রূপে পুজো করে তাদের কাছ থেকে আশীর্বাদ প্রাপ্ত হওয়া।