ছোটদের উপন্যাস –
দুষ্টুলোকদের ক্ষপ্পড়ে
প্রীতম সরকার
কালিপূজোর দিন দুপুরে খাওয়ার টেবিলে মেসো বললেন, ‘চলুন শংকরদা, আগামীকাল আপনাদের গৌড় ঘুরিয়ে নিয়ে আসি।’ ইতিহাসের বইতে বাংলার প্রাচীন রাজধানী হিসাবে গৌড়ের নাম পড়েছিল টিপু। সে কলকাতার একটি ইংরেজি স্কুলের ক্লাস ফাইভের ছাত্র। ভাইফোঁটায় ওঁরা বেড়াতে এসেছে মাসির বাড়ি মালদায়। টিপুর মেসো উত্তম দাস মালদার এক গ্রামের হাইস্কুলের ইতিহাসের শিক্ষক। পূজোর সময় মাসি মেসোর সঙ্গে মাসতুতো বোন মৌ কলকাতায় টিপুদের বাড়িতে বেড়াতে গিয়েছিল। তখনই ঠিক হয়, কালিপূজোর সময় টিপুরা মালদায় ঘুরতে আসবে। মৌ সায়নকে ভাইফোঁটা দেবে।
ভোরের ট্রেনে বাবা মার সঙ্গে টিপু মালদায় এসে পৌঁছেছে। খুব ছোটবেলায় কয়েকবার মালদায় মাসির বাড়ি এলেও সেই কথা এখন মনে নেই টিপুর। মাসতুতো বোন মৌ টিপুর এক বছরের ছোট। মালদার একটি কিন্ডার গার্টেন স্কুলের ক্লাস ফোরের ছাত্রী। বেশ কয়েক বছর বাদে টিপুর সাথে মৌ এর দেখা হয়েছিল কলকাতায়। এবার পূজোর সময়। তখন থেকে দুজনের বন্ধুত্ব জমে ওঠে। পূজোয় বড়দের সঙ্গে থেকেও মৌ আর টিপু আনন্দে মেতে উঠেছিল নিজেদের মতো করে। মৌ সেসময় নিজেই টিপুকে প্রস্তাব দিয়েছিল, ‘দাদা, তোকে ভাইফোটা দেব এবার। তোরা মালদায় আমাদের বাড়িতে আসবি?’
টিপু এই কথা দূর্গাপূজোর নবমীর সকালে তুলেছিল মাসি, সেসো , মৌ এর সামনেই নিজের বাবা মার কাছে। মৌ এর জেদ, আর মাসি মেসোর অনুরোধ টিপুর বাবা শংকর চৌধুরি ফেলতে পারেননি। বলেছিলেন, ‘আমি তো ব্যবসায়ী। আমার তো আর অফিসের ছুটি নেওয়ার ব্যাপার নেই। কিন্তু টিপুর স্কুল তো খুলে যাবে !’
ভাইফোটার রাতে মালদা থেকে কলকাতা ফেরার ট্রেনে চাপলে যে টিপুর স্কুল কামাই হবেনা, সেটা আলোচনায় উঠে এলে শংকরবাবু শেষে রাজি হয়েছিলেন।
মালদায় কালিপূজোর রাতে মৌদের বাড়িতে বেড়াতে এসেছিলেন উত্তমবাবুর স্কুলের কলিগ সমীরবাবু। পরের দিন ওঁদের গৌড় ঘুরতে যাওয়ার পরিকল্পনা শুনে তিনি তাঁর বাড়িতে দুপুরের খাওয়ার নেমন্তন্নও করে গেলেন। তাঁর বাড়ি মালদা থেকে গৌড় যাওয়ার পথেই পড়ে আর সেই জায়গা গৌড়ের খুব কাছেই এবং প্রায় বাংলাদেশের বর্ডার লাগোয়া। ওখানে গেলে গৌড়ের সাথে ওঁরা বাংলাদেশের বর্ডারও দেখে নিতে পারবে বলে কেউ আর আপত্তি করলো না।
।। ২।।
কালীপুজোর পরদিন খুব সকালে ভাড়া করা স্করপিও গাড়িতে চেপে ঘুরতে বেড়িয়েছিল টিপুরা। মালদার কিছুদূরের আদিনার ডিয়ার পার্কের হরিণ, পরিযায়ী পাখি, পান্ডুয়ার পুরানো মসজিদ দেখে এগারোটা নাগাদ টিপুরা পৌঁছেছিল গৌড় এ। গতরাতে মালদার কিছু কালিপুজোর প্যান্ডেল ঘুরে দেখেছিল টিপুরা। তার আগে মাসির বাড়ির সামনের খোলা জায়গাতে মৌ আর টিপু যথেষ্ট বাজি পুড়িয়েছে।
সকালে যখন ভাড়া গাড়িতে বেড়াতে যাওয়ার জন্য রওনা হচ্ছিল, টিপুকে ড্রাইভারের পাশে উত্তমবাবুর সঙ্গে বসতে বলেছিলেন বাবা। কিন্তু টিপু রাজি হয়নি। সে গাড়ির পিছন দিকে মৌ এর মুখোমুখি বসেছে। সারা রাস্তা গল্প করেছে দু-জনে। মাঝের সিটে বসেছেন টিপুর মা অমিতাদেবী, মাসি সুমিত্রা দেবী আর বাবা শংকরবাবু।
টিপুর মেসো উত্তমবাবু ইতিহাসের শিক্ষক হওয়ার কারনে মালদার পুরানো দিনের নানা কাহিনী বলছিলেন। সবই ঐতিহাসিক নানা ঘটনা। অমিতাদেবী আর সুমিত্রাদেবী ব্যস্ত নিজেদের সাংসারিক আলোচনায়। টিপুর মেসো বলে জাচ্ছিলেন, ‘জানেন তো, গৌড় অঞ্চলের প্রাচীন নাম ছিল পুন্ড্রবর্ধন রাজ্য। ৬০২ খ্রীষ্টাব্দে রাজা শশাঙ্ক এই রাজ্য তৈরি করেন। সেসময় তার রাজধানী ছিল কর্নসুবর্নে’। উত্তমবাবুর কথা কতটা মন দিয়ে শংকরবাবু শুনছেন, সেটা বুঝতে বারবার পিছনে মাথা ঘুরিয়ে দেখে দেখে বললেন, ‘বুঝলেন তো শংকরদা, শশাঙ্কের মৃত্যুর অনেক পরে গোপালদেব রাজধানী তৈরি করেন গৌড়ে। ধর্মপাল, দেবপালের পরে ১১২০ খ্রীষ্টাব্দে রাজা রামপালের মৃত্যুর পরে গৌড়ের দখল যায় সেনবংশের হাতে। ১২০২ সালে শেষ হিন্দু রাজা লক্ষন সেনের আমলে এই গৌড়ের দখল নেন বখতিয়ার খিলজি। হিন্দু রাজের অবসান হয়।’ উত্তমবাবু জানালেন, ‘এখন গৌড়ে যে স্থাপত্য নিদর্শংনগুলি দেখা যায় তা সবই নবাবদের আমলের।’
গৌড় পৌঁছনোর গাড়িটিকে একটি পুকুরের ধারে থামাতে বললেন উত্তমবাবু। এবার সবাইকে গাড়ি থেকে নীচে নামার কথা বলে শুরু করলেন, ‘চলুন, নেমে দেখে নিন জায়গাটা। এই পুকুর আগে ছিল একটি বড় দিঘী। এর নাম ছিল পিয়াসবারি’। গাড়ির সবার সঙ্গে নীচে নেমে এলো মৌ, টিপু। মেসো টিপুকে বললেন, ‘বুঝলে টিপুবাবু এই গৌড়ের এক সম্রাট ছিলেন, তাঁর নাম ছিল নসরৎ শাহ। তিনি ছিলেন ভয়ংকর রকমের নিষ্টুর। এই দিঘীর ধারে একটি বাড়ি ছিল। সেখানে বন্দি করে রাখতেন অপরাধী বা রাজদ্রোহীদের। যেসব বন্দিকে তিনি মৃত্যুদন্ড দিতেন, তাদেরকে অদ্ভুতভাবে সাজা দেওয়া হতো।’
টিপু কৌতুহলে জানতে চাইলো, ‘তাঁদের হত্যা করে কি দিঘীর জলে ভাসিয়ে দেওয়া হতো, না জলে ডুবিয়ে হিত্যা করা হতো ?’
‘না, না, মৃত্যুদন্ড ছিল অদ্ভুত রকমের।’
‘কি রকম ?’
উত্তমবাবু টিপুর কৌতুহল দেখে একটু খুশিই হলেন। বললেন, ‘যাঁকে সম্রাট মৃত্যুদন্ড দিতেন, তাঁকে আকন্ঠ মিষ্টি খাওয়ানো হতো। কিন্তু কখনই এক ফোঁটা জল বন্দিকে দেওয়া হতোনা। তারপর বন্দি করে রাখা হতো সেই বাড়ির একটি ঘরে। সেই ঘর থেকে খুব কাছেই ছিল দিঘীর জল। আকন্ঠ মিষ্টি খেয়ে বন্দি জল পিপাসায় কাতরাতো। চোখের সামনে এক দিঘীর টলটলে জল দেখতে পেলেও সেই জলের নাগাল পাওয়া দুঃসাধ্যের ব্যাপার ছিল। জলের পিপাসায় কষ্ট পেয়ে অবশেষে মারা যেত সেই বন্দি।’
গল্পটা শুনে টিপুর মা অমিতাদেবী মন্তব্য করলেন, ‘বড় অদ্ভুত তো ঘটনাটি !!’
উত্তমবাবু বললেন, ‘ তা হলে আর বলছি কি দিদি ! গৌড়ের ইতিহাস কিন্তু বেশ রহস্যময় ! এখানে মুসলিম শাসন যেমন ছিল, তেমনই বৈষ্ণব ধর্মের প্রভাবও ভালো ছিল। স্বয়ং চৈতন্যদেব ১৫০৬ সালে বৃন্দাবন যাওয়ার পথে এই গৌড়ে এসেছিলেন। এখনও রামকেলি গ্রামে সেই চিহ্ন রয়েছে। গৌড় থেকে মালদায় বাড়ি ফেরার পথে আমরা রামকেলির সেই জায়গা হয়েই না হয় ফিরবো।’
।। ৩।।
মেসোর স্কুলের সহকর্মী সমীর দাস বেশ মিশুকে মানুষ। তাঁর ছেলে অর্ক টিপুর বয়সী। ওঁর সঙ্গে বন্ধুত্ব হয়ে উঠতে সময় লাগেনি টিপুর। মৌএর সাথে তো আগে থেকেই চেনাজানা ছিল অর্কর। দুপুরে সমীরবাবু নিজের বাড়িতেই ওঁদের জন্য অপেক্ষা করছিলেন।
দুপুরে জম্পেশ খাবারের আয়োজন করেছিলেন সমীরবাবু। মুরগির মাংস, সোনা মুগের ডালের সঙ্গে তুলাইপাঞ্জি চালের ভাত থেয়ে তৃপ্তি পেয়েছিল টিপু।সকাল থেকে একটানা বিভিন্ন জায়গাতে ঘোরার সঙ্গে সেভাবে ভারি কিছু পেটে না পড়ায় খিদেও পেয়েছিল বেশ। সমীরবাবুর বাড়ি পৌঁছনোর আগে টিপুরা ঘুরে দেখেছে গৌড়ের দাখিল দরওয়াজা, ফিরোজ মিনার, চিকা মসজিদ, গুমটি দরওয়াজা, লুকোচুরি গেট – এই সব জায়গাগুলি। মেসোই টিপুদের গাইডের দায়িত্বটা সামলেছেন। এসব পুরাকীর্তির ইতিহাস আওড়েছেন। সমীরবাবুর বাড়ি যাওয়ার আগে উত্তমবাবু বললেন, ‘ দুপুরে কিছুক্ষন বিশ্রামের পরে ফেরার পথে আমরা দেখবো লোটন মসজিদ, তাঁতিপাড়া মসজিদ, চাককাটি মসজিদগুলি।’ সমীরবাবু হাইস্কুলের শিক্ষক হলেও গ্রামে নিজের বাড়িতে মেঝেতে আসন পেতেই খাওয়ার আয়োজন করেছিলেন। গৌড় থেকেই প্রতিদিন মালদার স্কুলে যাতায়াত করেন সমীরবাবু।
দুপুরে খাওয়ার খেতে বসে সমীরবাবু আক্ষেপের সঙ্গে বললেন, ‘গরমের সময় এলে আপনাদের মালদার বিখ্যাত ফজলি আম খাওয়াতে পারতাম। ফজলি আমের ইতিহাসটা এঁনাদের বলেছেন তো,’ মেসোর দিকে তাকিয়ে প্রশ্ন করলেন সমীরবাবু।
খেতে খেতে হঠাৎ থেমে মেসো উত্তর দিলেন, ‘সত্যি তো, খুব ভুল হয়ে গিয়েছে। মালদায় এলেন। তাও আবার প্রাচীন বাংলার রাজধানী গৌড়ে। আর মালদার বিখ্যাত ফজলি আম সম্পর্কে কিছুই জানবেন না, সেটা তো খুব অন্যায় হবে! আসার পথে এত আম গাছ দেখলাম, অথচ একবারের জন্যেও ফজলি আমের কথা উঠলো না ! তবে শুনুন এই ফজলি আমের ইতিহাস।’ ইতিহাসের শিক্ষক হওয়ায় একটু বেশি কথা, বিশেষ করে যেখানে ইতিহাস জড়িত রয়েছে, তা বলতে অতি উৎসাহী উত্তমবাবু।
টিপু, মৌ আর সমীরবাবুর ছেলে অর্কের খাওয়া বড়দের আগেই হয়ে গিয়েছিল। পাশের ঘর থেকে ওঁদেরকে খাওয়ার জায়গায় ডেকে নিয়ে উত্তমবাবু বলতে শুরু করলেন, ‘ ফজলি আম আসলে গৌড় এলাকার ফসল। গৌড়ের সুলতান ইউসুফের প্রিয় নর্তকী ছিলেন ফজল বিবি।। সুলতান নর্তকীর জন্য আম বাগানের মধ্যে একটি বড় বাড়ি তৈরি করে দিয়েছিলেন। সেই বাগানের আমের আকার এবং স্বাদ ছিল আলাদা রকমের। ফজল বিবির নামেই ফজলি আমের নাম হয়। এখন সেই ফজলি আম মালদার গর্ব।’
বড়রা আরও নানা ধরনের গল্পে আলোচোনায় মেতে ঊঠলেন। খাওয়ার শেষেও চলতে থাকলো গল্প-গুজব। টিপুর সেই গল্প শুনতে ভালো লাগছিল না। সে অর্ককে বললো, ‘চলো অর্ক, আমরা আম বাগানে ঘুরে আসি।’
ওদের বাইরে যেতে দেখে মৌও সঙ্গে যেতে চাইলো। তিনজন বাড়ি থেকে বের হয়ে চলে এলো কিছুদূরের আমবাগানে। আম বাগানের গল্প, স্কুলের গল্প, ঝড়ের সময় আম কুড়ানোর গল্প অর্কের কাছে শুনছিল টিপু। গল্প করতে করতে ওঁরা চলে এসেছে বাড়ির থেকে বেশ অনেকটাই দূরে। এই আম বাগান এখানেই শেষ। দূরে মাটির ঢিবি। পাশের ধানের গাছের পরেই আবার শুরু হয়েছে অন্য একটি আম বাগান।
অর্ক বললো, ‘এখান থেকে বাংলাদেশের বর্ডার খুব কাছে। এদিকে তেমন লোকজন আসে না। আমাদেরও বাড়ি থেকে আসতে দেওয়া হয়না। আজ তোমরা এসেছো, তাই চলে এলাম। তবে বাবা জানতে পারলে বকবে’।
টিপু আগে কোন দিন দেশের বর্ডার দেখে নি। বাংলাদেশের বর্ডারের কথা শুনে এবং সেটা খুব কাছে জেনে, টিপুর কৌতুহল হচ্ছিল। সে বললো, ‘চলো না, বাংলাদেশ বর্ডার দেখে আসি !’
আৎকে উঠলো অর্ক, ‘না না, আমি যাবো না। তোমরাও যেও না। তার চেয়ে ভালো, চলো বাড়ি ফিরে যাই।’
মৌ বললো, ‘ধ্যাৎ, তোমাদের বাড়ি এখন ফিরে কি হবে ! শুধু বাবার বকবকানি শুনতে হবে। বকবকানি শুনে শুনে আমার তো মাথা ব্যাথা হয়ে গিয়েছে।’
টিপু প্রস্তাব দেয়, ‘তার চেয়ে চলো ওই মাটির ঢিবির উপরে উঠে বসে গল্প করি। কি রে, মৌ যাবি ?’
‘তাই চলো,’ বলে মৌ হাটতে শুরু করলো অর্ক আর টিপুর সঙ্গে।
।। ৪।।
অক্টোবর মাস শেষ হতে চললেও রোদের তাপ কমেনি। তবে ঢিবির একধারে কিছুটা রোদ কম রয়েছে। ছায়ায় বসে গল্প করার জন্য ওঁরা ঢিবির উপরে উঠেছিল। সামনে অর্ক, তার পিছনে টিপু। তারপরে মৌ। ঢিবিটা বেশ উঁচু। অর্ক অনর্গল কথা বলতে পারে। আম বাগানে ঝড়ের পরে কিভাবে আম কুড়ানো যায়, দুবছর আগে আম কুড়াতে গিয়ে অর্ককে সাপে কেটেছিল, কিভাবে সেই বিপদ থেকে উদ্ধার হয়েছে, সেই গল্প অর্ক বলে হাঁটতে হাঁটতে বলে চলেছিল। টিপু শুনতে শুনতে ঢিবির উপরে উঠছিল। ওঁদের কারোই নজর ছিল না মৌ এর দিকে। হঠৎ একটা আর্তনাদ শনে অর্ক আর টিপু পিছনে ফিরে দেখলো মৌ নেই। তবে আর্তনাদ যে মৌ এর ছিল তা বুঝতে পেরে ওঁরা ছুটে এলো নীচের দিকে।
তখনই গর্তটা নজরে পড়লো টিপুর। পাতলা মুলিবাঁশের জাল দিয়ে তার উপরে মাটি বিছিয়ে রাখা হয়েছিল। যাঁরা একাজ করেছিল, তাঁরা যে সাধারন মানুষের চোখের আড়াল তৈরি করতে চেয়েছিল, সেটা বুঝতে অসুবিধ হয়নি টিপুর। মৌ এই নরম মাটিতে পা দিতেই যে গর্তে পড়ে গিয়েছে, টিপু অর্ক দুজনেই বুঝতে পারল। দুজনে মিলে হাল্কা করে দেওয়া মাটি হাত দিয়ে সরিয়ে নীচের দিকে ঝুঁকে তাকানোর চেষ্টা করলো। গর্তটা কিছুটা সোজা কুয়োর মতো নেমে নীচের দিকে বেঁকে যাওয়ায় অন্ধকারে মৌকে দেখা যাচ্ছেনা। তবে ওঁরা নিশ্চিত যে, এই গর্তেই মৌ পড়েছে।
টিপু সিদ্ধান্ত নিলো, সে গর্তে নামবে। তবে গর্তটা কতটা গভীর সেটা আন্দাজ করতে পারছিল না। কিন্তু মৌ কে তো উদ্ধার করতে হবে! চাই ‘যা থাকে কপালে’ ভেবে নিয়ে অর্ক কিছু ভেবে ওঠার আগে নিজেই গর্তের মধ্যে লাফ দিল টিপু। যতটা গভীর ভেবেছিল টিপু, গর্তটা ততটা গভীর নয়। কয়েক সেকেন্ডের মধ্যেই পা এর নীচে মাটির স্পর্শ পেল সে। তবে নীচের দিকে গর্তের বেড় অনেক চওড়া। কিছুক্ষন পরে পাশে ধুপ শব্দের আওয়াজ পেয়ে টিপু বুঝতে পারলো, অর্ক নীচে নেমে এসেছে।
মাথার উপরে তাকিয়ে টিপু দেখলো আকাশ দেখা যাচ্ছে। এক চিলতে আলো এসে ঢুকেছে গর্তটার মধ্যে। সেই আলোতে দেখা যাচ্ছে, গর্তের নীচ থেকে নারকেলের ছোবড়ার দড়ির তৈরি ঝুলন্ত মই উঠে গিয়েছে উপরের দিকে। টিপু নিজের মনে বললো, ‘তারমানে এখানে নিয়মিত কেউ ওঠানামা করে।’ টিপু ফিসফিস করে অর্ককে বললো, ‘খবরদার অর্ক, জোরে কোন শব্দ করবে না। তোমার কোন কথা বলারও প্রয়োজন নেই।’
গর্তের পাশে আবছা অন্ধকারে একটি সুরঙ্গের মতো জায়গা নজরে এলো টিপুর। অন্ধকার এখন অনেকটা চোখ সয়ে গিয়েছে। অর্ককে ওখানেই অপেক্ষা করতে বলে টিপু হামাগুড়ি দিয়ে এগিয়ে গেলো সুরঙ্গের মধ্যে।
সুরঙ্গের মতো পথে ডানদিকে গিয়ে টিপুর নজরে এলো জায়গাটি বেশ চওড়া। অন্ধকার অখন অনেকটাই চোখ সয়ে গিয়েছে। অন্ধকারে নজরে এলো সেখানে কয়েকটি ছোট ছোট পিচবোর্ডের বাক্স একধারে সাজানো রয়েছে। সুরঙ্গের উচ্চতা এখানে এতটাই, যে একজন প্রমান মাপের মানুষ এই পথ দিয়ে অনায়াসে যাতায়াত করতে পারে। সামান্য আলোতেই টিপু দেখলো,কিছু দূরে একটা ছোট মাপের কাঠের দরজা ভেজানো রয়েছে। দরজাটি সামান্য ফাঁকা। নিশ্চই ঘরের দরজা এটা। কারন ঘরের ভিতরে আলো জ্বলছে, সেটা টিপু বুঝতে পারছে।
টিপু এবার ভালো করে নজর দিতে দেখতে পেলো, মৌ দরজার ফাঁকা দিয়ে ঘরের ভিতরে উঁকি দিচ্ছে। মৌকে দেখে আশ্বস্ত্ব হয়ে টিপু দরজার দিকে এগিয়ে মৌকে নিয়ে উপরে উঠে পালিয়ে যাবে, ভেবে মৌএর দিকে এগিয়ে গেলো। মৌ অবশ্য এখনও টিপুকে দেখতে পায়নি। মৌ একমনে মাটিতে বসে ঘরের ভিতরের দৃশ্য দেখছিল। টিপু এগিয়ে গিয়ে মৌএর মাথার উপর দিয়ে ঘরের ভিতরে নজর দিতেই দেখতে পেলো, তিনজন লোক ঘরের ভিতরে বসে দুটো চামড়ার ব্যাগের ভিতরে টাকার বান্ডিল ভরছে। ছাদ নীচু ঘরের একধারে দুটি কালো রঙের বড় ব্যাটারির থেকে তার লাগানো থাকায় জ্বলছে একটি টিউব লাইট।
লোক দুজন একমনে দুটো ব্যাগে টাকা ভরে চলেছে। অন্যজন অনেক টাকা থেকে বান্ডিল করে ব্যাগে ঢোকানোর জন্য ওঁদের হাতে দিচ্ছে। মাটির নীচে এই সুরঙ্গের ঘরে এত টাকা এবং এতটা গোপনের সঙ্গে এঁরা কেন ভরছে, সেটা ভেবে পাচ্ছিলনা টিপু। নিজের হৃদপৃন্ডের আওয়াজ যেন নিজের কানে শুনতে পারছিল টিপু। উত্তেজনায় টিপুর খেয়ালই ছিলনা তাঁর পায়ের কাছে মৌ বসে রয়েছে। মালদায় যে জালনোট প্রায়ই ধরা পড়ছে, টিপু সেখবর কলকাতায় বাড়িতে থাকতে টেলিভিশনে দেখেছে। এগুলো কি তবে জালনোট ! বিষয়টি ভালো করে দেখতে যেতেই টিপুর পা গিয়ে ঠেকলো মৌ এর শরীরে। আর তখনই ঘটলো যত বিপত্তি !
মৌ শরীরে কিছু ঠেকতে ভয়ে চিৎকার করে উঠে হুড়মুড় করে গিয়ে ঢুকে পড়লো ঘরের ভিতরে। আচমকা ঘরে এক অচেনা বাচ্চা মেয়েকে ঢুকতে দেখে হকচকিয়ে গেলো ঘরের ভিতরে থাকা তিনজনই। টিপু তখনও দরজার বাইরে দাঁড়িয়ে রয়েছে। নিজের এই আচরনে এই দূর্ঘটনা ঘটায় টিপুর মাথা তখন কাজ করছে না! তবে তাঁর মনে হলো, যেভাবেই হোক, এই সুরঙ্গ থেকে পালাতে হবে। যাঁরা মাটির নীচে বসে বান্ডিল বান্ডিল টাকার নোট ব্যাগে ভরছে, তারা আর যাইহোক, ভালো মানুষ হতে পারেনা ! ওদিকে সুরঙ্গের নীচে এসে দাঁড়িয়ে রয়েছে অর্কও। তাঁর মন বললো, যেকোন উপায়ে এখান থেকে পালাতে হবে !
যে দুজন টাকার বান্ডিল ব্যাগের মধ্যে ভরছিল, তাদের একজন মৌকে ধরে নিতেই, টিপু সুরঙ্গের পথ দিয়ে ছুটলো উলটো দিকে। তাঁর মনে তখন একটাই চিন্তা, যেভাবে হোক, বাড়ি পৌঁছে মৌএর খবর বাড়ির লোকজনকে দিতে হবে !
ঘরের ভিতর থেকে তিনজন লোকের চাপা হুঙ্কার শুনতে পেলো টিপু। সঙ্গে মৌএর চিৎকারও। লোকগুলোর ভাষা পরিস্কার বুঝতে না পারলেও, মৌ চিৎকার করে চলেছে, ‘আমাকে ছেড়ে দাও, আমাকে ছেড়ে দাও’। এবার অন্য একজনের গলা পরিস্কার শুনলো টিপু। সে বলছে, ‘এই বাচ্চা মেয়েটা তো এই এলাকার নয়। এ একা আসেনি। সঙ্গে আরও কেউ নিশ্চই আছে। তোরা বস্কে ফোন কর। আমি বাকিটা দেখছি।’
টিপু বুঝতে পারলো একজন তাঁর পিছু নিয়েছে। সে আঁধো অন্ধকারের মধ্যে খুব তাড়াতাড়ি দৌঁড়তে পারছিল না। এদিকে যে পিছু নিয়েছে, সে যে আরও কাছে চলে এসেছে, সেটা বুঝতে অসুবিধা হয়নি টিপুর। প্রানপনে সুরঙ্গের মুখের দিকে এসিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করছিল সে। যেখান থেকে সুরঙ্গ শুরু হয়েছে, সেখানে এসে টিপু দেখলো, অর্ক সেখানেই দাঁড়িয়ে রয়েছে। এত ঘটনার সে তো কিছুই জানেনা। একটু দেরি হলেই পিছনে আসা লোকটির কাছে ধরা পড়বে দুজনেই। কাকুতি মিনতি করে টিপু বেশ জোরেই অর্ককে বলে ফেললো, ‘আমরা ধরা পড়ে গিয়েছি। তাড়াতাড়ি আমাদের এখান থেকে পালাতে হবে। দড়ির মই দিয়ে উপরে ওঠো।’ কথাটি বলেই টিপু নিজেই আগে দড়ির মই বেয়ে উপরে উঠতে শুরু করলো।
গোটা ঘটনায় অর্কা এতটাই ঘাবড়ে গিয়েছিল, যে টিপুর ‘ধরা পড়ে যাওয়া’, ‘পালাতে হবে’ এসব কথায় ঘাবড়ে গিয়ে অর্ক দড়ির মই বেয়ে উপড়ে উঠতে গিয়ে পা হড়্কে মাটিতে মুখ থুবড়ে পড়ে গেলো। টিপু তখন মই বেয়ে অনেকটা উপরে উঠে এসেছে। নীচের দিকে তাকিয়ে টিপু দেখলো, অর্ক মাটিতে পড়ে রয়েছে, তাঁকে ধাওয়া করে আসা লুঙ্গি পড়া খালি গায়ের লোকটি ক্রুর দৃষ্টিতে তাঁর দিকে দেখছে।
টিপু কোন মতনে দড়ির মই দিয়ে ঢিবির উপরে উঠে ঢিবির মাটির ঢালের জন্য দ্রুত নেমে যাচ্ছিল আম বাগানের দিকে। পিছনে ফিরে টিপু দেখলো, তাঁকে ধাওয়া করা লোকটিও উপরে উঠে এসেছে। বিকালের সূর্যের আলোয় তাঁর হাতে চক্চক করছে কালো রঙের পিস্তল। মুহুর্তে টিপুর কান ফাটানো আওয়াজের সঙ্গে পাশের আম গাছের গুড়িতে কি যেন এসে লাগলো। টিপু বুঝতে পারলো, তাঁকে ধাওয়া করা লোকটি হাতের পিস্তল থেকে গুলি ছুঁড়ছে। টিপু দৌঁড়ের স্প্রিড আরও বাড়িয়ে দিল।
।। ৫ ।।
সমীরবাবুর বাড়ির ল্যান্ড ফোনটি বেজে উঠলো সন্ধ্যা ঘন হওয়ার ঠিক আগে। টিপুর মুখে ততক্ষনে সমস্ত ঘটনা শুনে নিয়েছেন বাড়ির লোকেরা। সমীরবাবুর স্ত্রী- অর্কের মা ছেলের জন্য দুঃশ্চিন্তা শুরু করে দিয়েছেন। টিপুকে সঙ্গে নিয়ে সমীরবাবু, শংকরবাবু আর উত্তমবাবু ওই ঢিবির দিকে রওনা হয়েছেন কিছুক্ষন আগেই। সমীরবাবুর বাড়ি জুড়ে উদ্বেগের ঝড় চলছে। টিপুর মা বারবার শুধু বলে চলেছেন, ‘কেন যে মালদায় ঘুরতে এলাম। আমাদের জন্যই আজ ছেলে মেয়ে দুটো এই ঝামেলায় পড়লো’, এই ধরনের কথা।
টিপুর মুখে সমস্ত ঘটনা শুনে, এমনকি ওঁকে লক্ষ্য করে যে গুলি ছোড়া হয়েছে, সব জানতে পেরেই সমীরবাবু প্রথমে ফোন করেছিলেন স্থানীয় থানাতে। টিপুর সঙ্গে ওঁনারা সেই আম বাগানের ঢিবির দিকে রওনা হওয়ার আগে সমীরবাবু তাঁর স্ত্রীকে বলে গিয়েছিলেন, থানা থেকে পুলিশ এলে জানিয়ে দিতে যে তাঁরা টিপুকে সঙ্গে করে মা বাগানের পিছনের ঢিবির দিকে গিয়েছেন। পুলিশও যেন সেখানেই যায়।
বাড়ির ল্যান্ড ফোন বাজতেই সমীরবাবুর স্ত্রীর পরামর্শে ফোন ধরলেন, টিপুর মা আমিতাদেবী। তিনি কিছু জিজ্ঞাসা করার আগেই অপর দিক থেকে শুনতে পেলেন হাড় হিম করা ওপাড়ের কর্কশ কন্ঠশ্বর। এক পুরুষ আওয়াজ বললো, ‘তাহলে পুলিশে খবরও দেওয়া হয়ে গিয়েছে! কিন্তু কোন লাভ যে হবেনা। বেশি বাড়াবাড়ি করলে ফল হবে মারাত্মক ! ছেলে মেয়ে দুটোই আমাদের কব্জায় আছে। ওঁদের ছাড়িয়ে বাড়িতে নিয়ে যেতে দশ লক্ষ টাকা কোথায়, কিভাবে দিতে হবে, পরে সেটা আমরাই জানাচ্ছি !’ অমিতাদেবী ‘আপনি কে, কোথা থেকে বলছেন’ বললেও সেকথা শোনার আগেই ওপাড়ে সশব্দে ফোন কেটে দেওয়া হয়েছে। অমিতাদেবী সঙ্গের দুই মহিলাকে বললেন, ‘মনে হয় কিডন্যাপারদের ফোন ছিল ! অর্ক আর মৌ এর জন্য দশ লক্ষ টাকা মুক্তিপন দাবি করছে। আবারও ফোন করবে বলেছে। আমরা যে ইতিমধ্যেই পুলিশকে জানিয়েছি, শুনলাম সেই খবরও ওদের জানা !’
অমিতাদেবীর কথা শুনে ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠলেন অর্কের মা। সুমিত্রাদেবীও এবার মেয়ের কথা ভেবে চোখের জল ধরে রাখতে পারলেন না। সুমিত্রাদেবী তবুও চোখের জল মুছে অর্কের মাকে সান্তনা দিলেন, ‘আপনি কিছু ভাববেন না দিদি ! কিছু একটা ব্যবস্থা নিশ্চয়ই হবে !’
অর্কের মা প্রলাপের মতো বকে চলেছেন, ‘আমার ছেলেকে যদি বদমাশ লোকগুলো খুন করেতবে কি হবে ! ও মা গো ! এ কি সর্বনাশ হলো গো ! আমাকে এই বিপদ থেকে উদ্ধার করো ভগবান !
পুলিশের জিপের স্টিয়ারিং ঘোরাতে ঘোরাতে থানার ওসি পরেশ দেবনাথ জিজ্ঞাসা করলেন, ‘ওঁদের কি কোন ফোন এসেছিল ! কোন টাকা পয়সার কথা কি বলেছে ? কিছু কি জানতে পেরেছেন !’
পুলিশের গাড়িতে চেপে বাড়ি ফিরছিলেন শংকরবাবুরা। সঙ্গে টিপুও ছিল। মাটির সেই ঢিবির নীচে জাল নোট কারবারিদের গোপন আস্তানার হদিশ পেলেও পাওয়া যায়নি মৌ বা অর্ককে। বাড়ি থেকে পাওয়া মোবাইল ফোনে সমীরবাবু কিছুক্ষন আগেই কিডন্যাপারদের কথা শুনেছেন। কিন্তু পুলিশের ওসি পরেশ দেবনাথ নিজের কাজে ব্যস্ত থাকার কারনে সেই কথা এখনও বলে ওঠার সুযোগ করতে পারেননি সমীরবাবু। এমনিতে যত বিপদই হোক, পেশায় হাইস্কুলের শিক্ষকরা পুলিশের বিষয় পারতপক্ষে এড়িয়ে চলেন, সমীরবাবু তার ব্যতিক্রম নন।
।। ৬ ।।
সন্ধ্যার আগেই আম বাগানের পিছনের ঢিবির কাছে পৌঁছনোর কিছুক্ষনের মধ্যেই থানা থেকে বিশাল পুলিশের দল নিয়ে হাজির হয়েছিলেন পরেশবাবু। বিকালের আলোতে ঢিবির চারদিক ঘুরে পুলিশের দল আবিস্কার করলো এক জায়গায় আলগাভাবে ঘাসের চাঁপ দিয়ে গর্ত বন্ধ করা রয়েছে। সেগুলি খুব সহজেই পুলিশ কর্মীরা সরিয়ে দেওয়ার পরে দেখা গেল আরও একটি কাঠের দরজা। দরজাটি পুরানো দিনের। তবে আকারে অনেকটাই ছোট এবং শক্তপোক্ত ধরনের। টিপু বুঝতে পারলো, ওই সুরঙ্গ ছাড়াও আরও একটি আলাদা পথ রয়েছে ঐ মাটির নীচের ঘরে ঢোকার। তবে পুলিশ কর্মীরা পরেশবাবুকে জানালেন, দরজাটি ভিতরের দিক থেকে বন্ধ করা রয়েছে। ওসি পরেশবাবু বললেন, ‘সদর থেকে ডি এস পি সাহেব আসছেন। তার আগেই আমরা ভিতরে ঢুকে তল্লাসীর কাজ শুরু করে দেই। তবে আপনারা দরজা ভেঙ্গে ভিতরে ঢুকুন। সবাই সরতর্ক থাকবেন। আমিও আসছি আপনাদের সঙ্গে।’
পরেশবাবুর নির্দেশ পাওয়া মাত্রই পুলিশ কর্মীরা দরজায় ধাক্কা দিতে শুরু করার কিছুক্ষনের মধ্যেই সেটা ভেঙে গেল। টিপুর সঙ্গে পুলিশ বাহিনী সহ সবাই ভিতরে ঢুকলেন। সেই ঘর এখন একদম অন্ধকার। কারো কোন সাড়া শব্দ নেই। পরেশবাবু সহ তিনজন পুলিশ কর্মী ইলেক্ট্রিক চার্জারের বড় টর্চ জ্বাললেন। আলোয় নজরে এলো কালো কালো সেই ব্যাটারি, যার সাহায্য তখন এখানে টিউব লাইট জ্বলছিল। টর্চের আলোয় সবার নজরে এলো, ঘরের ভিতরে তিনটি চামড়ার ব্যাগ রয়েছে। যেগু্লো দেখেই বোঝা যাচ্ছে, এগুলোর ঠেসে কিছু ভর্তি করা হয়েছে। একটি ব্যাগের চেন খুলতেই পরেশবাবু বলে উঠলেন, ‘সর্বনাশ ! এ যে সব দু-হাজার টাকার নোটের বান্ডিলে ভর্তি !’
তাঁর কথা শুনে বাকি পুলিশ কর্মী, অফিসাররা এগিয়ে গেলেন সেদিকে। অন্য সহকর্মীদের আলোর সাহায্য নিয়ে নিজের টর্চটা নিবিয়ে দুহাতে সব ক’টি ব্যাগ খুলে টাকার বান্ডিল গুলি ব্যাগের ভিতর থেকে বের করে আনলেন। একটি ব্যাগে পাওয়া গেল দু হাজার টাকার নোটের বান্ডিল, বাকি দুটোতে পাঁচশো টাকার নোটের বান্ডিল। পরেশবাবু টর্চের আলোয় দু ধরনের টাকা গুলিই মিলিয়ে দেখলেন, সব নোটের নম্বর এক। সেটার দিকে নজর যাওয়ায় পরেশবাবু নিজেই খুব ধীরে ধীরে বললেন, ‘এগুলো তো জাল নোট বলে মনে হচ্ছে ! এটা কি তবে জাল নোট মজুদ করার ডেরা !’
এখানে যে জাল নোট মজুদ রয়েছে, টিপু সেটা আগেই আন্দাজ করেছিল। সে বাড়িতে ফিরে সেকথা জানালেও সমীরবাবু পুলিশকে খবর দেওয়ার সময় মৌ আর অর্ককে আটকে রাখার কথাটাকেই শুধু জানিয়েছিলেন। এখন পুলিশ এসে জাল নোটের বিষয়টা জানতে পেরেছে।
পরেশবাবু পুলিশের নিজস্ব কথা বলার মাধ্যম থেকে সাংকেতিক ভাষায় সমস্ত বিষয়টি জেলা পুলিশের উপর মহলে জানালেন। সেই কথা শেষ করে পরেশবাবু বললেন, ‘ বড় সাহেব আরও ফোর্স নিয়ে এখানে কিছুক্ষনের মধ্যেই এসে পৌঁছবেন।’
ঢিবির ভিতরের ঘরটি এবং সুরঙ্গ ভালোভাবে তল্লাসী চালালো পুলিশের টিম। ঢিবির যে গর্ত দিয়ে টিপু ভিতরে নেমেছিল, সেখানেও হাজির হলেন থানার ওসি পরেশবাবু। টিপু তাঁকে উত্তেজিতভাবে জানালো, ‘এখানে নারকেলের দড়ির তৈরি দড়ির মই ঝোলানো ছিল। এখন নেই। নিশ্চয়ই ওঁরা খুলে নিয়ে গিয়েছে।’
এই খোঁজ খবরের মধ্যেই জেলার পুলিশ সুপার ঘটনাস্থলে এসে হাজির হলেন। এস পির কাছে দুজন বাচ্চা ছেলে মেয়েকে কিডন্যাপ যেমন বড় বিষয়, তার চেয়েও বড় বিষয় হলো গৌড়ের মতো এলাকায় জাল নোট জমা করার আখরার হদিশ খুঁজে পাওয়ার ঘটনা। এসপি থানার ওসি পরেশ বাবুকে বললেন, ‘ওঁনাদের বলে দিয়েছেন তো, বাড়িতে যদি মুক্তিপন দাবি করে কোন ফোন আসে যেন তখনই পুলিশকে ইনর্ফম করেন !’ কথাগুলি হচ্ছিল সমীরবাবুর সামনেই। তিনি মুক্তিপন চেয়ে ফোন আসার কথা বেমালুম চেপে গিয়ে এস পিকে শুধু অনুরোধ করলেন, ‘যেভাবেই হোক স্যর, ছেলেমেয়ে দুটোকে উদ্ধারের ব্যবস্থা করে দিন।’ এস পি একটু বিরক্ত হয়েই সমীরবাবুর দিকে তাকিয়ে গম্ভীর গলায় বললেন, ‘পুলিশ তো তদন্ত করছে। তদন্তে আপনাদের সহযোগীতা প্রয়োজন। পুলিশের তদন্তে সাহায্য করুন।’
যেভাবে মাটির ঢিবির নীচে সুরঙ্গ কেটে লোকের চোখের আড়ালে ঘর বানিয়ে সেখান থেকে জাল নোটের কারবার ফেঁদে বসেছিল দুস্কৃতিরা, এস পি দেখে অবাক হলেন। তিনি নিজের সঙ্গে আনা পুলিশ নিয়ে ফের মাটির নীচের সব ঘর ঘুরে দেখার ইচ্ছে প্রকাশ করতেই, থানার ওসি ব্যস্ত হয়ে পড়লেন। তার আগে টিপুর কথা ওসির কাছে শুনে ওঁর সঙ্গেও কথা বলেছেন এস পি। টিপুও সব কথা জানিয়েছে। কিভাবে এখানে তাঁরা এসেছিল, কিভাবে সুরঙ্গ আবিস্কার করেছিল, কিভাবে মৌ আর অর্ক ওই লোকগুলোর কাছে ধরা পড়েছে – কোন কথাই গোপন করেনি সে। এস পি আরও টর্চের আলো নিয়ে ফের ঘরে ঢুকে তাজ্জব হয়ে গেলেন। এই মাটির নীচের কৃত্রিমভাবে তৈরি করা ঘরে যে দুস্কৃতিদের নিয়মিত যাতায়াত ছিল, সেটা বুঝতে পারলেন। কারন তাঁদের ব্যবহার করা বেশ কিছু জামা কাপড়, ব্যবহার করা জিনিষ, জুতো সেখানে রাখা রয়েছে। এস পি ঘরের ভিতরে মজুদ করা জামা কাপড়ের দিকে টর্চের আলো ফেলে ভালো করে দেখতে লাগলেন। হঠাৎ তাঁর নজরে এলো, জামা কাপড়ের নীচে কিছু একটা পাতলা মতো জিনিষ চকচক করছে। তিনি সেদিকে এগিয়ে গিয়ে কাপড় সরাতেই দেখতে পেলেন একটি ল্যাপটপ। ল্যাপটপটিকে হাতে তুলে আরও কিছু খোঁজার চেষ্টা করেও পেলেন না। এক হাতে ধরে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে ল্যাপটপটির সুইচ অন্ করতেই সেটি চালু হয়ে গেলো। ল্যাপটপটির সঙ্গে চার্জারের তার লাগানোই রয়েছে। উৎসাহে এস পির চোখ চক্চক করে উঠলো। আর কিছু ক্লু না পেয়ে ঘরের ভিতরে থাকা জামা-জুতোগুলিকে থানায় নিয়ে যাওয়ার নির্দেশ ও সিকে দিইয়ে ল্যাপটপটি সঙ্গে করে নিয়ে গাড়ির দিকে এগিয়ে গেলেন এস পি। গাড়িতে চেপে বসার আগে ও সি পরেশবাবুকে এখানে কয়েকজন পুলিশ দিন-রাত পোষ্টিং করার নির্দেশ দিতে ভুললেন না। এস পি রওনা দিতেই টিপুদের সঙ্গে নিয়ে সমীরবাবুর বাড়ির দিকে নিজেই জিপ চালিয়ে রওনা হলেন পরেশবাবু। পথে সমীরবাবুর মোবাইল ফোন বেজে উঠতেই,নম্বর দেখেই সমিরবাবু ভয়ে ভয়ে ও সিকে জানালেন, ‘স্যর, বাড়ি থেকে ফোন করেছে !’
‘ধরুন, ধরুন, কি বলছে বাড়ির লোক সেটা শুনে আমাকে জানান !’
সমীরবাবু ফোনে কথা বলেই বললেন, ‘স্যর, ওঁরা টাকার অংক প্রচুর বাড়িয়ে দিয়েছে। ওত টাকা কোন দিন চোখেই দেখিনি ! কিভাবে দেবো ! ওঁরা যে আমাদের ছেলে আর মেয়েটাকে প্রানে মেরে দেওয়ার হুমকি দিয়েছে !’
‘টাকার অংক বাড়িয়েছে ! মানে ?’ ও সি পরেশবাবু জানতে চাইলেন বেশ অবাক হয়েই।
‘মানে স্যর,’ সামান্য তোত্লালেন সমীরবাবু, ‘এর আগেও ওরা ফোন করেছিল। তখন দশ লক্ষ টাকা চেয়েছিল। টেনশনে আর জাল নোটের চক্করে আপনাকে বিরক্ত করতে চাইনি বলে ভেবেছিলাম, পরে বলবো ! কিন্তু আবার ফোন করেছিল। এখন তো বিশ লক্ষ দাবি করছে স্যর !’
‘ আপনি এস পি সাহেবকে জানালেন না ব্যাপারটা ! আমাকেও এখন বলছেন !! সত্যি, আপনাদের লোকদের জন্যই পুলিশ ঠিক মতো কাজ করতে পারে না ! আগে জানলে যে কত উপকার হতো সেটা আপনাকে বোঝাবো কি ভাবে !’ পরেশবাবু রেগে গিয়ে বললেন। এতসব ঘটনা ঘটে গিয়েছে, সঙ্গে থেকেও নিজেদের টেনশনে জানতেই পারেননি টিপুর বাবা মেসোরা। এমনকি টিপুও একবার সমীরবাবুকে মোবাইল ফোনে কথা বলতে দেখেছে। কিন্তু জালনোটের ঘাঁটি আবিস্কারের উৎসাহে বিশেষ গুরুত্ব দেয়নি।
।। ৭ ।।
ঘুলঘুলি দিয়ে আলো দেখেই অর্ক বুঝেছিল পাশের ঘরে লোক রয়েছে। এই ঘরের একপাশে মৌ হাত বাঁধা অবস্থায় বসে রয়েছে। অর্কর হাত পিছন মুড়ে দড়ি দিয়ে বেঁধে দিয়েছে হরিয়া নামের লোকটি। বাইরে যে অন্ধকার হয়ে গিয়েছে, অর্ক সেটা আন্দাজ করতে পেরেছে। এতক্ষনে অর্ক, মৌ ওঁদের যাঁরা বন্দি করে রেখেছে, সেই তিনজনের নাম জেনে গিয়েছে। মৌকে যে ঘরের ভিতরে ধরেছিল, তাঁর নাম হারুন। টিপুর পিছনে ঢিবির উপরে উঠে যে ধাওয়া করতে গিয়েও ধরতে পারেনি, তাঁকে দুলাল নামে ডাকতে শুনেছে অন্যজনের নাম সুলতান।
দুপুরে ওই সুরঙ্গ থেকে দড়ির মই বেয়ে উপরে ওঠার চেষ্টা করেও পারেনি অর্ক। সুলতান তাঁর ডান হাত চেপে ধরে টেনে ওই কৃত্রিম ঘরের ভিতরে টেনে নিয়ে বন্দি করেছিল। তখন দুলালকে উদ্দেশ্যে বলেছিল, ‘ওই ব্যাটা পালিয়ে গেলো। এটাকে ধরতে পারলাম। ছেলে মেয়ে দুটোকে বেঁধে রাখ।’ দুজনকে বেঁধে রেখে অন্যদিকে গিয়ে দুলাল টেলিফোনে কোন কথা বলে ফিরে এসে হারুনকে জানিয়েছে, ‘বস্কে সব ঘটনা ফোন করে জানিয়েছি। বস্ বলেছে, দুজনকেই ডেরায় নিয়ে যেতে।’
হারুন বললো, ‘পাশের আম বাগানের পিছনের জঙ্গলে গাড়ি রাখা আছে। আমাদের বেশি সময় এখানে নষ্ট করা ঠিক হবেনা। আমাদের এখুনি বেরিয়ে যাওয়া উচিত।’
ততক্ষনে দুলাল ফিরে এসেছে। টিপুকে যে সে ধরতে পারেনি, সেটা নিয়ে আফসোস করছিল। তিনজন তাড়াতাড়ি ওঁদের কাপড় জামা দিয়ে অর্ক আর মৌ এর চোখ আর মুখ বেঁধে দিল। সুলতান বাকি দুজনকে নির্দেশ দিল, ‘এখানে বাইরের দরজা বন্ধ করে দড়ির মই দিয়ে উপরে উঠে মই তুলে নেবো। আর গর্তের মুখ ফের মাটি চাপা দিয়ে চলে যাবো।’
প্রথমে ওঁদের কেউ একজন মৌকে কাঁধে তুলে নিয়েছিল। অর্কর চোখ বাঁধা থাকায় দেখতে পারছিল না। মৌ এর গলার চিৎকারে আন্দাজ করেছিল। মৌ অস্পষ্টভাবে বলছিল, ‘আমাকে কাঁধ থেকে নামিয়ে দাও। আমার ব্যাথা লাগছে।’ এরপরেই হারুনের ধমক শুনেছিল অর্ক।
‘এই মেয়ে চুপ কর। বেশি জোরে কথা বললে কিন্তু আরও শক্ত করে মুখ বেঁধে দেবো,’ গলাটা যে দুলালের ছিল, সেটা আন্দাজ করতে পেরেছিল অর্ক। এরপরে অর্ককে ধরে কেউ শুন্যে তুলে নিলেও সে কোন কথা বলেনি। সে টের পেয়েছিল, দড়ির মই দিয়ে তাঁকে নিয়ে উপরে উঠছে সুলতান। হারুন দড়ি দিইয়ে উঠতে উঠতে বললো, ‘গাড়িটা সামনের দিকে নিয়ে এসেছিস তো !’
গাড়ি চালিয়ে ওঁদেরকে দূরের কোথাও নিয়ে এসেছে ওঁরা তিনজন। অনেকক্ষন গাড়ি চলার পরে ওঁদের নামিয়ে হাঁটিয়ে একটা বাড়ির ভিতরের ঘরে নিয়ে এলো সুলতান আর দুলাল। সুলতান আর দুলালই ওঁদের চোখ, মুখের বাঁধন খুলে দেয়। হারুন তখনই এসে খবর দিল, ‘বস্ এসেছে !’
অর্ক দেখলো, চেক লুঙ্গি পরে মোটা কালো চেহারার একজন এসে ঘরে ঢুকেছে। অর্কের দিকে তাকিয়ে কালো চেহারা নির্দেশ দিলো, ‘তোদের বাড়িতে কি ফোন আছে ? থাকলে ফোন নম্বর বল্ !’ বিকট চেহারার সঙ্গে কর্কশ গলার স্বর শুনে ঘাবড়ে গিয়ে অর্ক বাড়ির ল্যান্ড নম্বরটা বলে দিল।
ফোন নম্বরটা লিখে নিয়ে ‘বস্’ বাইরে বেরিয়ে যাওয়ার সময় তিন সাকরেদকে বলো, ‘এদের আটকে রাখা। খেতে দিস। এঁদের নিয়ে অন্য প্ল্যান মাথায় এসেছে। দেখিস যেন কোনভাবে পালাতে না পারে !’ ওদেরকে ঘরের ভিতরে বসিয়ে রেখে চারজনই বাইরে বেরিয়ে যাওয়ার সময় দরজা বন্ধ করে দিল। আবার ঘর বন্দি হয়ে পড়লো মৌ আর অর্ক। এবার আবার অচেনা আজানা নতুন জায়গাতে। ঘরের ভিতরে এক কোনে একটা মোটা কাঠের ডান্ডা র্যেছে। শেটা নজর এড়ায়নি অর্কর।
এই ঘরের ভিতরে যে ইলেক্ট্রিকের আলো টিমটিম করে জ্বলছিল, সেটাও ওঁরা চলে যাওয়ার পরে নিবে গেলো। ওঁরাই নিবিয়ে দিল। দরজাও বাইরে থেকে বন্ধ। শুধু ঘুলঘুলি দিয়ে পাশের ঘরের যেটুকু আলো আসছিল, তাতে মৌ – অর্ক নিজেদেরকে ছায়ার মতো দেখতে পাচ্ছে শুধু।
।। ৯ ।।
কালিয়াচক এলাকার এই ঘরটি বেশ বড়সর। আধুনিক সব আসবাব দিয়ে সাজানো। দেওয়ালের একদিকে লাগানো রয়েছে বস বড় আকারের এলসিডি টেলিভিশন। ঘরের একদিকে এক পেল্লাই সাইজের টেবিলের ওপাশে রিভলবিং চেয়ারে বসে রয়েছেন সুলতানদের ‘বস্’ ইসমাইল হক। জাল নোতের কারবার, স্মাগ্লিং, ড্রাগস্ এর ব্যবসা করে ফুলে ফেঁপে উঠেছেন তিনি। সেই টেবিলের অন্যদিকে চেয়ারে বসে রয়েছে, তিনজন। দুলাল, হারুন আর সুলতান। এই তিন জনকেই তাঁদের বস্ ইসমাইল হক ডেকে পাঠিয়েছেন। গৌড়ের মতো শান্ত সীমান্তের ধারের এলাকায় বস্ এর জাল নোট মজুদ করার ঠিকানা এই তিনজন বাচ্চা কিভাবে জানলো আর তাঁদের মধ্যে থেকে একজন কিভাবে তিনজনের ক্ষপ্পড় থেকে পালিয়ে বেঁচে পালালো, তা নিয়ে আলোচনা চলছে। সবারই মুখ ভার। বস্ কিছুতেই মানতে চাইছে না, এই ঘটনায় দুলাল, হারুন বা সুলতানের কোন গাফিলতি ছিলনা। বসে্র বিশ্বাস, এই তিনজনের কোন গাফিলতিতেই তাঁর বহুদিনের নিরাপদ গোপন ডেরার খবর শেষ পর্যন্ত পুলিশের নজরে এলো। তার উপরে বস্ আরও ক্ষেপেছেন, যখন জানতে পেরেছেন, সব ‘নকলি্’ নোট সেখানেই রেখে এঁরা ওই দুই বাচ্চাকে নিয়ে কালিয়াচকে এসেছে।
‘বিশ্বাস করো বস্, আমাদের কোন দোষই নেই। কিভাবে যে তিনজন ওই সুরঙ্গের ভিতরে ঢুকে এলো, আমরা নিজেরাও বুঝতে পারছি না,’ বললো দুলাল।
সুলতান সঙ্গে বলে উঠলো, ‘আমরা তখন এতটাই নার্ভাস হয়ে গিয়েছিলাম, এমনকি যে ছেলেটা পালিয়ে গেলো, তাঁকে ধরতে পিস্তল থেকে এক রাউন্ড গুলিও চালানো হয়েছিল। তারমধ্যেও ছেলেটা ভেগে গেলো।’
দুলালের কথাকে সমর্থন করে হারুন বললো, ‘বস্, আমি নিজে দু নম্বর গর্তের উপর মুলিবাঁশের বেড়া দিয়ে উপরে মাটি চাপা দিয়েছিলাম। কিন্তু তা সত্বেও ওঁরা কিভাবে ভিতরে ঢুকলো, এখনও ঘটনাটা ভাবতে অবাক লাগছে।’
ইসমাইল হক ক্রুদ্ধ চোখে তিনজনের দিকেই ঘুরে ঘুরে তাকাচ্ছেন। দুলাল- হারুনের পরে সুলতান বস্কে খুশি করতেই বলে উঠলো, ‘তবে বস্, এটা মানতেই হবে, যে আমরা দুজনকে ধরে ফেলেছি। যেটা পালিয়েছে, সেটা এতটাই ভয় পেয়েছে, যে মুখ খুলবে বলে মনে হয়না। তাছাড়া বস্, তোমার কথা মতো দুজনকে কালিয়াচকের অন্য ডেরায় যে সরিয়ে এসেছি, তা তো নিজের চোখেই দেখে আসলে। ওঁদের পাহারায় ইকবাল আর মইনুদ্দিনকে রেখেছি। তুমি কোন চিন্তা করোনা। কোন ঝামেলা হবে না।’
এতক্ষন চুপচাপ সব শুনছিলেন ইসমাইল হক। এবার ক্ষেপে দাঁড়িয়ে উঠে চিৎকার করে বললেন, ‘খুব বড় কাম করেছিস তোরা ! মাল ওখানেই রেখে এসেছিস। যদি পুলিশ নিয়ে ঐ ছেলেটা ফের যায়, কি হবে তোদের ধারনা আছে ! তোদের ওইদিন যে ল্যাপটপটা দিলাম, সেটা কোথায় ! ফেলে এসেছিল তো ! ওতে কি আছে জানিস। পুলিশ যদি ওটার খোঁজ পায়, তবে তোদের সাথে আমাকেও ভিতরে যেতে হবে। আর এই যা কেস দেবে না, বিশেষ করে কেস যদি ইডি নেয়, তাহলে তো আর কথাই নেই, আর বলছিস, বেফিকর থাকবো আমি !’
এবার কিছুটা শান্ত হয়ে ইসমাইল বলে ওঠে, ‘তার চেয়ে এক কাজ কর, যে টাকা ওঁই বাচ্চাদের বাড়িতে চেয়েছিস, সেটা দ্বিগুন বাড়িয়ে দে। একদিকের লোকসান অন্যভাবে তো পোষাতে হবে আমাকে ! আর পুলিশের থানাগুলোও হয়েছে এখন এক চিড়িয়াখানা ! আগে কোথাও কিছু করতে যাওয়ার আগে খবর দিত। এখন আর দেয় না। নকলি্ নোটের বিষয় নাকি এখন সব দিল্লি না কলকাতার অফিসাররা দেখভাল করে।’
দুলাল এবার আমতা আমতা করে বললো, ‘ কিন্তু বস্, ছেলে মেয়ে দুটোই মহা বিচ্ছু। ওঁদের নিয়ে কি করবো সেটা তো বলবে !’
ইসমাইল ভেবে বলে, ‘আজ রাতটা আটকে রাখ্। দেখছি কি হচ্ছে !!’
এবার কথা বললো সুলতান। দীর্ঘদিন বিহারের জেলে থাকার পরে ছাড়া পেয়ে কিছুদিন আগে মালদায় এসেছে ইসমাইলের হয়ে কাজ করতে। ও দুলালকে বললো, ‘ বস্এর কাছে তো ওদের বাড়ির টেলিফোন নম্বর আছে। এখান থেকেই আবার ফোন করে কুড়ি লাখকে চল্লিশ লাখ বলে চাপ দে। তবেই খেল জমবে। আমরাও কয়েকদিনের জন্য গা-ঢাকা দিতে পারবো। এদিকে নকলি্ নোটের কিসসা ঠান্ডা হতেই আবার ফিরে আসবো বসে্র কাছে।’
ওঁদের গা ঢাকা দেওয়ার বিষয়টা মনপুতঃ না হলেও ইসমাইল হক পাঞ্জাবির পকেট থেকে নম্বর লেখা কাগজটা দুলালের দিকে এগিয়ে দিলেন। বস্ টেবিলের ফোন সাধারনত ওঁরা ব্যবহার করেনা, কিন্তু এই বিষয়টা আলাদা বলে বস্ বিশেষ আপত্তি তুললেন না।
দুলাল টেলিফোনের নম্বর ডায়াল করলো। ততক্ষনে গৌড়ের সমীরবাবুর গ্রামের বাড়িতে ফিরে এসেছে টিপুরা। ফোনের রিং হতেই ফোন তুললেন সমীরবাবু। আসলে সবাই টেলিফোনকে ঘিরেই এতক্ষন বসেছিলেন। যদি কোন খবর পাওয়া যায় পুলিশের পক্ষ থেকে ! দুলাল যতটা কঠিন গলা তাঁর পক্ষে করা সম্ভব, সেভাবে ‘বস্’এর শিখিয়ে দেওয়া কথাগুলি আওড়ে গেল। কথা শুনে, শুধু ‘দেখছি’ বলে টেলিফোনের রিসিভারটাকে ক্রেডেলে রেখে দিলেন। ঘরে উপস্থিত সবাই তখন উদ্বিগ্নভাবে তাকিয়ে রয়েছেন সমীরবাবুর দিকে। ‘আবার কি ওঁরা’, ‘কি বলছে আবার’- প্রায় একসঙ্গে জিজ্ঞাসা করলেন ঘরে থাকা সবাই। সমীরবাবু এই ঘটনা গ্রামের আর পাঁচজনকে বলেননি। তাঁর মনে হয়েছিল, সেটায় বিপদ আরও বাড়বে। সমীরবাবু ঘরে উপস্থিত সকলের সামনে ফোনের ওপাড় থেকে শোনা কথাগুলো বলতেই ঘরে ফের গুঞ্জন শুরু হয়ে গেলো। ডুকরে কেঁদে উঠলেন অমিতাদেবী। সমীরবাবু সেই অবস্থাতেও মাথা ঠান্ডা করে নিজের বুক পকেট থেকে মোবাইল ফোন বের করে থানার ও সি পরেশবাবুর নম্বরটা ডায়াল করলেন। বিকালেই থানার ও সি পরেশবাবু তাঁকে নিজের ফেলফোন নম্বরটি দিয়েছিলেন। এখন সেটা কাজে লাগলো।
ওপাড়ে দুবার রিং হতেই পরেশবাবুর গলা পেলেন সমীরবাবু। প্রায় এক নিঃশ্বাসে মুক্তিপনের টাকা বেড়ে যাওয়ার সমস্ত ঘটনা বিস্তারিত জানিয়ে জিজ্ঞাসা করলেন, ‘এখন আমরা কি করবো ! এতটাকা এভাবে এখুনি জোগাড় করা আমাদের কারোর পক্ষেই সম্ভব না। কি করবো কিছুই বুঝতে পারছি না !’ পরেশবাবু সমীরবাবুকে আস্বস্ত করে বললেন, ‘একটু ধৈর্য্য ধরুন। পুলিশের উপরে একটু ভরসা রাখুন। আশাকরি,আমরা কিছু একটা করতে পারবো। আমি কিছুক্ষন পরে আপনাকে রিংব্যাক করছি।’
।। ১০ ।।
থানার ওসি পরেশবাবু সব শুনে সমীরবাবুকে বললেন, ‘এবার ফোন করলে কিন্তু আপনি ছেলেমেয়ে দুটোর সঙ্গে কথা বলতে চাইবেন। ওদিকে আমি দেখছি, ফোনের লাইন ট্যাপ করে কোন লোকেশনের হদিশ করতে পারি কি না!’ এরমধ্যেই ওসির মোবাইলে একটা ফোন ঢুকছিল। তিনি দেখলেন, এস পি সাহেব ফোন করছেন। তিনি তাড়াতাড়ি সমীরবাবুর ফোনটা ছাড়ার জন্য বললেন, ‘বড় সাহেব কোন কারনে ফোন করছেন। আমি পরে আবার কথা বলছি।’ ফোন ছেড়েই পরেশবাবু ঘুরিয়ে এস পি কে ফোন করতেই, ‘কোন খবর পাওয়া গেল! তোমার সব সোর্স কি বলছে!’ পরেশবাবুর কাছে এস পি সব শুনে বললেন, ‘এদিকে তো সাংঘাতিক ব্যাপার জানা গিয়েছে। ওঁরা যে বাচ্চা দুটোর জন্য একটা এরকম কিছু চাইবে, সেটা আমি আন্দাজ করতে পেরেছিলাম। তুমি একবার আমার অফিসে এসো তো!’
বড় সাহেবের জরুরী তলব পেয়ে তড়িঘড়ি পরেশবাবু ছুটলেন এস পি অফিসের দিকে। সেখানে পৌঁছে দেখলেন, কনফারেন্স রুমে মিটিঙএ রয়েছেন এস পি সাহেব। পরেশবাবুর কথা বোধহয় আগে থেকেই বলা ছিল দরজার সামনে পাহারায় দাঁড়ানো সিপাইটিকে। তাই সে পরেশবাবুকে সোজা কনফারেন্স রুমে ঢুকে যেতে পরামর্শ দিল। ঘরে এস পি ছাড়াও বসে রয়েছে আরও দুজন ডি এস পি পদমর্যাদার অফিসার আর সাইবার ক্রাইম বিশেষজ্ঞ এক অফিসার। তাঁদের সামনে খোলা রয়েছে বিকালে গৌড়ের ওই মাটির নীচের ঘর থেকে পাওয়া ল্যাপটপটি। ল্যাপটপটি রীতিমতো চলছে। এস পি পরেশবাবুর দিকে তাকিয়ে বললেন, ‘এদিকে তো বিরাট কান্ড! ওই যেখানে রেড করতে গিয়ে আমরা এই ল্যাপটপ কম্পিউটারটি পেয়েছিলাম, সেটা চালু করতেই মেল বক্স খুলে যায়। আমাদের বেশি কসরত করতের হয়নি। ইমেল গুলো দেখে জানা যাচ্ছে, ওখানে মালদা এজেন্ট থেকে মেল গিয়েছে, আজ রাতেই বড়মাপের জালনোট পাচারের কথা রয়েছে। হয়তো আমরা সেই জালনোট কিছুটা উদ্ধার করতে পেরেছে। কিন্তু এই চক্রের কিং পিন কে তো ধরতে হবে! তোমার সোর্স তো কিছুই বলতে পারছে না!’ সাইবার ক্রাইম থানার অফিসার এবার এস পির দিকে তাকিয়ে বললেন, ‘যদি একটা কোন ফোন নম্বর পাওয়া যেত, তবে আমি ঠিক ট্র্যাক করে নিতে পারতাম সেই ফোন কোথা থেকে করা হচ্ছে বা আসছে!’
পরিতোষবাবু এতক্ষন বড় সাহেবের ঝাড় খাচ্ছিলেন। এই সুযোগ হাতছাড়া করতে চাইলেন না। নিজেই বলে উঠলেন, ‘স্যার, কিছুক্ষন আগেই ওঁদের গৌড়ের বাড়িতে ফোন এসেছিল কিডন্যাপারদের। আমার কাছে ছেলেটির বাবার মোবাইল ফোনের নম্বর রয়েছে। আমি এক্ষুনি ওদের বাড়ির ল্যান্ড লাইনের নম্বর জেনে নিতে পারবো!’
‘তবে সেটাই করুন!’
পরেশবাবুর হাতে ততক্ষনে সমীরবাবুকে ফোন করার জন্য মোবাইল ফোন উঠে গিয়েছে। পরেশবাবু ফোন নম্বর জেনে বলতেই সেটা নোট করে নিলেন সাইবার ক্রাইম থানার ঐ অফিসার। এস পি কে কিছু বলে উঠে গেলেন বাইরে কোথাও।
এস পি বললেন, ‘আজ একটা বড় কাজ হয়েছে। তোমার থানার লোকজনেরা কোন খবর রাখে না! ওই তিনটি বাচ্চা ছেলেমেয়ে আজ পুলিশের কাজে খুব উপকার করে দিয়েছে, যে করেই হোক, ওঁদের উদ্ধার করতেই হবে। সেই দায়িত্ব তোমার একার উপর ছাড়ার ভরসা আমি করতে পারছি না! তোমাকে আরও অফিসার দিচ্ছি।’ এস পি’র কথা শেষ হতেই ঘরে ফের এসে ঢুকলেন সাইবার ক্রাইম থানার ওই অফিসার। ঢুকেই এস পি’কে একটা চিরকুট দেখিয়ে জানালেন, ‘স্যার, ওই ল্যান্ড লাইনে শেষ ফোনটা এসেছিল কালিয়াচক থেকে। নম্বরটাও আমি লিখে এনেছি।’
‘ওই নম্বরে একবার ফোন করে দেখবো স্যার!’ পরেশবাবু কথাটা বলা মাত্র রেগে উঠলেন এস পি।
‘আপনাকে পুলিশে চাকরিটা কে দিয়েছে বলুন তো! ওখানে কেউ এই সময় ফোন করে! সামান্য বুদ্ধিটুকু কি আপনার নেই!’
পরেশবাবু বুঝতে পারলেন, তিনি ভুল সময়ে ভুল কথা বলে ফেলেছেন! মাথা নীচু করে দাঁড়িয়ে থাকলেন!
এতক্ষন প্রায় চুপ করেছিলেন দুজন ডি এস পিই। তাঁদের থেকে একজন বললেন, ‘স্যার, আমি তো কালিয়াচক এলাকাটা নিয়ে কাজ করি, আমি একবার আমার সোর্স লাগিয়ে দেখবো! এই কাজ কে করতে পারে, সে সম্পর্কে যদি কোন খবর নিতে পারি!’
‘দেখুন তো চেষ্টা করে,’ এস পি পরেশবাবুর সামনেই ডি এস পিকে দায়িত্ব দিলেন।
।। ১১ ।।
আবার ল্যান্ড লাইনের টেলিফোনটি বেজে উঠেছে সমীরবাবুর বাড়িতে। এখন রাত প্রায় আটটা। টেলিফোনের রিং টোন এত কর্কশ এর আগে কখনো লাগেনি! সবাই উগ্রিব হয়ে উঠেছেন টেলিফোনের আওয়াজ শুনেই। জানাই যাচ্ছে, আবার সেই কিডন্যাপারদের ফোন! এবার অর্ক আর মৌএর সঙ্গে কথা বলতে হবে। সেই মতোই বলে রেখেছেন থানার ওসি।
সমীরবাবু ফোনের ক্রেডেল তুলতেই সেই আবার একই গলার স্বর। টাকাটা নিয়ে আসতে বলছে ফারাক্কা ব্রিজের পরে একটা লাইন হোটেলে। নিজের নার্ভ ঠিক রেখে এবার পালটা প্রশ্ন করলেন সমীরবাবু, ‘বাচ্চা দুটো কেমন আছে, আগে সেটা আমাদের জানতে হবে! তারপরে টাকার কথা আপনারা ওঁদেরকে কিভাবে রেখেছেন, সেটা আমাদের জানা দরকার!’
‘ঠিক আছে! কোন রকম চালাকি করার চেষ্টা করলে কিন্তু বিপদ বাড়বে! আমি কিছুক্ষন পরেই আবার ফোন করছি। খবরদার! পুলিশ লাগিয়ে যেন ফোন ট্র্যাপ করানোর চেষ্টা না করা হয়!’
ফোনটা কেটে গেলো।
এবার কথা বললেন উত্তমবাবু, ‘কি বললো, কথা বলাবে ওঁদের সাথে! অন্তত জানতে তো পারবো, ছেলে মেয়ে দুটো কেমন আছে!’
ওদিকে সুলতানকে সঙ্গে নিয়ে ফের ফিরে গেলো সেই ডেরায়, যেখানে অর্ক আর মৌকে ওঁরা আটকে রেখেছে। দুটো বাচ্চাকে এভাবে শুধুমাত্র বাড়ির লোকের সঙ্গে কথা বলানোর জন্যে বস্ এর অফিসে নিয়ে আসা ঠিক হবেনা! তাই সঙ্গে মোবাইল নিয়ে ওঁরা গাড়িতে চেপে গেল কালিয়াচকের সেই বাড়িটাতে। সেখানে ছুকেই মইনুদ্দিনকে সুলতান জিজ্ঞাসা করলো, ‘বাচ্চা দুটো এখনও ওই ঘরেই ঠিকঠাক আছে তো!’
‘জি সুলতান,’ মইনুদ্দিন জবাব দেয়।
‘খেতে দিয়েছিস কিছু!’
‘তুই তো সেটা বলে যাসনি, আমিও তাই ও ঘরে ঢুকিনি।’
‘ঠিক আছে, ঠিক আছে। আমি সামনের এই ঘরটাতে বসছি। তুই ঘরের তালা খুলে নিয়ে আয় তো মেয়েটাকে! বলবি, ওঁর বাড়ির লোকের সাথে কথা বলাবো’ সুলতান জবাব দেয়।
দুলাল এখন ঘরে এসে ঢুকলো। মইনুদ্দিন একা ছেলেটাকে তালা খুলে নিয়ে আসবে, সেই বিষয়টা ওঁর পছন্দ তেমন হলো না। সে সুলতানকে বললো, ‘ছেলেটাকে দিয়েই তো কথা বলাতে পারতিস। শুধু শুধু ছলেটাকে এভাবে একা ঘরে রেখে দেওয়া কি ঠিক হচ্ছে! কিছু যদি আবার হয়ে যায়, বস্ কিন্তু আমাদেরকে ছাড়বে না!’
‘কিচ্ছু হবেনা! মেয়ের গলা শুনলে বাড়ির লোকের প্যানিক বাড়বে। এটাও কি বুঝিস না!’
‘যাই বলিস সুলতান, আমাদের নক্লি নোটের ধান্ধাই কিন্তু অনেক ভালো ছিল। একটা ফালতু ঝামেলায় গিয়ে এভাবে ফিরৌতির ধান্ধাটা আমার ভালো লাগছে না!!’ দুলাল বললো।
‘আরে বা! ফিরৌতি ভাষাটা তুই কোথায় শিখলি রে দুলাল! এটা তো বিহার ইউপি তে লোকে বলে! তুইও তবে খুব কম জলের মছলি না!’ সুলতান হাসতে হাসতে বলে।
‘শিখেছি কোথাও! তুই কি একাই ভিতরে ছিলি নাকি! আমার অভিজ্ঞতা কম না!’ দুলাল বলে, ‘যাই একটু বাইরে থেকে বিড়ি খেয়ে আসি!’
দুলাল বাইরে বেরিয়ে যেতেই সুলতান শুনতে পেলো, বাড়ির ভিতরে ধ্বস্তাদ্বস্তির শব্দ হচ্ছে। এই বাড়িতে তো ওই দুটো বাচ্চা ছাড়া আর মইনুদ্দিন ছাড়া কেউ নেই। তবে কি মইনুদ্দিনের সঙ্গে পাঙ্গা নিচ্ছে নাকি, ওই ছেলেমেয়ে দুটো! হঠাৎ সুলতানের কানে এলো মইনুদ্দিনের চিৎকারের আওয়াজ। শব্দ পাওয়া মাত্র সুলতান ছুটে বাড়ির ভিতর দিকে ওই ঘরের দিকে যেতে যেতে নিজের পকেট থেকে পিস্তলটা হাতে নিয়েছে। কিন্তু ঘর অন্ধকার থাকায় ভিতরে ঢুকে কিছু বুঝে ওঠার আগেই মাথায় একটা আঘাত পেয়ে চোখে বিদ্যুৎ চমকানোর মতো আলো দেখে অজ্ঞান হয়ে পড়তে পড়তে বুঝতে পারলো, তাঁর হাতের পিস্তলটা ছিটকে মেঝেতে কোথাও পড়ে গিয়েছে আর নিজেও মাটিতে পড়েছে।
এতক্ষন এই সুযোগের অপেক্ষাতেই ছিল অর্ক। ওঁদেরকে বয়সে ছোট ভেবে আগে থেকেই হাত পা সব খুলে বাঁধন মুক্ত করে রেখেছিল ওঁরা। সেসময়ই অর্ক আর মৌ গোটা ঘরে হাতড়ে হাতড়ে মোটা কাঠের বাটামটা পেয়েছিল। কেউ ঘর খুলতে আসলে সেই বাটামে দিয়েই আঘাতের সিদ্ধান্ত নিয়ে রেখেছিল অর্ক আর মৌ। এটাই একমাত্র শেষ চেষ্টা এখান থেকে পালানোর! যেমন ভাবনা, তেমনই কাজ। সুযোগও পেয়ে গেলো আর অর্ক আর মৌ সেই সুযোগের সদ্ব্যবহার করতে কসুর রাখলো না!
বাটামের মোক্ষম আঘাতে সুলতান অজ্ঞান হয়ে পড়ে যেতেই অর্ক মৌ এর হাত ধরে টেনে সোজা দৌঁড়ে রাস্তায় হাজির হলো। রাস্তায় বেশ লোকজনের চলাচল রয়েছে। কিন্তু ওঁরা কাউকে কিছু না বলে জোরে হাঁটতে লাগলো সামনের রাস্তার দিকে, যেখান থেকে অনেকক্ষন ধরেই অঁরা গাড়ি চলাচলের আওয়াজ পাচ্ছিল। তখনই দু’জনে আলোচনা করে রেখেছিল, যেখানে ওঁদের আটকে রাখা হয়েছে, তার কাছেই বড় রাস্তা রয়েছে।
রাস্তায় এসে দাঁড়াতেই ওঁদের চোখে পড়লো, পুলিশের পোষাক গায়ে দুজন রাস্তার গাড়ি চলাচল স্বাভাবিক রাখার চেষ্টা করছে। মৌ বুঝতে পারলো, এঁরা ট্রাফিক পুলিশ। অর্কের চোখে পড়লো, কিছু দূরে দুলাল নামের ওই লোকটি দাঁড়িয়ে তাঁদের অবাক হয়ে দেখছে। মৌ একছুটে ট্রাফিক পুলিশকে গিয়ে বললো, ‘পুলিশ কাকু, আমাদের তিনজন দুষ্টু লোক ওই বাড়িটাতে অন্ধকার ঘরের মধ্যে তালা বন্ধ করে আটকে রেখেছিল। আমরা কোন মতনে পালিয়ে এসেছি। আমাদের দুজনকে তোমরা বাঁচাও!’
অন্যদিকে, ততক্ষনে পুলিশের নিজের নেট ওয়ার্কে কিডন্যাপের ঘটনা জেলাজুড়েই ছড়িয়ে পড়েছে। তবে মালদার এস পি বিষয়টি নিয়ে সংবাদমাধ্যমকে এড়িয়ে থেকেছেন। এমন কি, জালনোট উদ্ধারের ঘটনাও চেপে গিয়েছেন, শুধুমাত্র এই দুটি বাচ্চার কথা ভেবে। তাই সাধারন মানুষ কিছুই না জানতে পারলেও, পুলিশ মহলে বেশ ভালো রকমই হেলদোল পড়েছে। সেই কারনে কালিয়াচকের মোড়ের ডিউটিতে থাকা দুজন ট্রাফিক পুলিশও জানতো কিডন্যাপের ঘটনা একটা ঘটেছে। তবে সেটা যে এখানেই সেটা তাঁদের অজানা ছিল।
দুজন ট্রাফিক পুলিশ অর্ক আর মৌকে সঙ্গে নিয়ে নিজেদের উদ্যোগে কালিয়াচক থানায় খবর দেওয়ার প্রায় সঙ্গে সঙ্গে থানা থেকে বিশাল পুলিশের টিম সঙ্গে নিয়ে হাজির হলেন সেই ডি এস পি। সঙ্গে অবশ্য গৌড় থানার ওসি পরেশবাবুও চিলেন। অর্ক আর মৌ এর কাছ থেকে সেই বাড়িটার হদিস জেনে সেখান থেকে মইনুদ্দিন আর সুলতানকে আহত অবস্থায় গ্রেফতার করে একসঙ্গে কালিয়াচক থানায় গেলেন।
সুলতান আর মইনুদ্দিনের, দুজনেরই মাথা ফেটে যাওয়ায় পুলিশের একটা দল তাদের নিয়ে মালদা মেডিক্যাল কলেজে গেল। মৌ আর অর্ক বসেছিল থানার ঘরের বেঞ্চিতে। পরেশবাবু ওঁদের টিফিন খাওয়ানোর আয়োজন করতে করতেই সমীরবাবুর বাড়ি থেকে সবাই মিলে হাজির হলেন কালিয়াচক থানাতে। প্রায় কয়েক ঘন্টার রুদ্ধশ্বাস অবস্থার শেষে বাবা মাকে সামনে পেয়ে অর্ক আর মৌ দুজনেই মা এর কোলে ঝাঁপিয়ে পড়েছে।
সমীরবাবুর বাড়িতেই সেরাতে সবাই ফিরে এসেছিল। একটু রাত হলেও বাড়িতে এসে আবার টিপুর সঙ্গে অর্ক আর মৌ এর খুব ভালো লাগছিল। সারাদিনের এত ধকলের পরেও টিপু কিভাবে গুলির নিশানা থেকে পালিয়ে আসতে পেরেছে, সেই কথা শুনতে একটুও কম আগ্রহ দেখালো না দু’জনেই।
আজ ভাইফোঁটা। ভাইফোঁটার আয়োজন করা হয়েছে অর্কদের বাড়িতেই। ওত রাতে ঘুমিয়েও ভোরে ঘুম থেকে উঠে বাড়ির সামনের ঘাষ থেকে শিশিরের ফোঁটা সংগ্রহ করে জমিয়ে এনে চন্দন বেঁটেছে। টিপুর সঙ্গ অর্ককেও আজ ভাইফোঁটা দেবে মৌ। আজ রাতের ট্রেনেই টিপুদের কলকাতা ফিরে যাওয়ার টিকিট কাটা রয়েছে। কথা হয়েছে, ভাইফোঁটার অনুষ্টানের পরে দুপুরের খাবার খেয়েই মৌদের বাড়ি মালদায় ফিরে যাবে টিপুরা।
টিপু অর্ক তাড়াতাড়ি স্নান সেরে সকালে কিনে আনা জামা কাপড় পড়ে ফোঁটা নেওয়ার জন্য তৈরি হয়ে রয়েছে। বাড়ির মহিলারা রান্না ঘরে লুচি তরকারির সঙ্গে দুপুরের রান্না তৈরি করতেই ব্যস্ত। এমন সময় হঠাৎ বাড়ির সদর দরজার কলিং বেল বেজে উঠলো!
অর্ক সদর দরজা খুলতেই ভিতরে ঢুকলেন থানার ওসি পরেশবাবু। তাঁকে দেখে বাড়ির সবাই হইহই করে উঠলেন। টিপুর মা পরেশবাবুকে ঘরে বসিয়ে চা জলখাবার এনে দিলেন।
পরেশবাবু উত্তমবাবু, সমীরবাবুদের সাথে গল্প করতে করতে বললেন, ‘ জানেন, আপনাদের এই তিনজন ছেলেমেয়ে কি উপকার করেছে সারা দেশের! আমাদের পুলিশ সুপার তো এঁদের প্রশংসায় পঞ্চমুখ! মালদার মাধ্যমে জালনোট সারা দেশে ছড়িয়ে যাচ্ছে, সে খবর আমাদের সবার কাছেই ছিল। মাঝে মাঝে দু একজন আড়কাঠি ধরা পড়েছে। কিন্তু গতকাল এঁরা জালনোটের মূল চাঁইকে ধরে দিয়েছে। কিডন্যাপ হওয়ার পরেও এঁরা যে স্বভাবিকভাবে ঘাবড়ে যায়নি, সেটা সত্যি প্রশংসার যোগ্য।’
টিপুর মা এবার সবাইকে তাড়া দিলেন। ‘দ্বিতীয়ার সময় তো চলে যাচ্ছে। কি রে মৌ, ভাইফোঁটা দিবি না!’
ঘরের মেঝেতে দুটি আসনে পাশাপাশি বসেছে অর্ক আর টিপু। তাঁদের সামনে লুচি, তরকারি আর মিষ্টির প্লেট। পাশে পিলসুচে জ্বলছে ঘি এর প্রদীপ। মৌ তাঁর বাম হাতের কড়ি আঙ্গুলে চন্দন নিয়ে আগে অর্কের কপালে ও পরে টিপুর কপালে ছুঁইয়ে বললো, ‘ভাই এর কপালে দিলাম ফোঁটা, যমের দুয়ারে পড়লো কাঁটা............।।