বিতর্ক যখন অনন্ত
দেবাশিস লাহা
বিতর্ক তখনই স্বাস্থ্যকর, ইতিবাচক যখন নিছক নিজ নিজ অবস্থানকে প্রতিষ্ঠিত করা, opinion establish করাই মূল উদ্দেশ্য হয়ে ওঠেনা। জিগীষা অর্থাৎ জানা বোঝার আগ্রহটিও অন্তঃসলিলা ফল্গুর মত প্রবহমান থাকে। প্রকাশ্য না হলেও কিঞ্চিৎ বাক্যালাপেই সেটি বুঝে নেওয়া সম্ভব। কতিপয় মানুষই আলোকিত, সমৃদ্ধ হওয়ার জন্য তর্ক, আলোচনায় অংশগ্রহণ করেন। সিংহভাগের উদ্দেশ্যই ব্যক্তিগত ego কে satisfy করা, যেনতেন প্রকারেণ নিজের মতটিকে প্রতিষ্ঠিত করা। এতে বিস্ময়ের কিছু নেই। গ্রিক পুরাণ বর্ণিত নার্সিসিজম ( আত্মপ্রেম, Narcissus থেকে Narcissism, নদীর দেবতা সেপিসাস এবং জল, অরণ্যদেবী লিরিওপের পুত্র নার্সিসাস) কম বেশি প্রতিটি মানুষকেই চালিত করে। অর্থাৎ নিজের অবস্থান, মতামতকেই সঠিক, কখনও কখনও চূড়ান্ত মনে করা। প্রখ্যাত দার্শনিক হেগেল বর্ণিত মাস্টার স্লেভ ডায়ালেক্টিকের ( Master slave dialectic) মাধ্যমে এই বিষয়টি আরও ভালভাবে বুঝে নেওয়া সম্ভব। প্রতিটিটি মানুষ এক বিশিষ্ট চেতনার অধিকারী, হেগেল যাকে self-consciousness বলে অভিহিত করেছেন। মোদ্দা কথায় চেতনা। এই consciousnesses অবশ্যই সাবজেক্টিভ ( subjective) অর্থাৎ ব্যক্তিনির্ভর। এই ব্যক্তিনির্ভর চেতনা অপর ব্যক্তিনির্ভর চেতনাকে থ্রেট ( threat) অর্থাৎ আশঙ্কা, বিপদ হিসেবে চিহ্নিত করে। শুরু হয় এক মরণপণ দ্বৈরথ! অপর চেতনাটিকে পরাজিত করে নিজেকে মাস্টার (প্রভু, master) অন্যকে স্লেভ ( slave, আত্মসমর্পণকারী দাস) হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করার এই অনিবার্য প্রক্রিয়া, প্রবণতাটিই Master slave dialectic! কেন এমন ঘটে? আমার অকিঞ্চিৎকর বিশ্লেষণে, প্রতিটি মানুষই চেতন/ অবচেতনে প্রভু হয়ে উঠতে চায়। একদিকে অস্তিত্বের বিপন্নতা, ( কারণ অপরের অস্তিত্ব, স্বীকৃতি ব্যতীত তার নিজের অস্তিত্বটিই অর্থহীন হয়ে পড়ে।) অপর দিকে আত্মপ্রতিষ্ঠা করে নিজের প্রভুত্বকে নিশ্চিত করা দুইয়ের টানাপোড়েনে সে প্রায়শই বেপরোয়া, আগ্রাসী হয়ে ওঠে৷ সমস্যাটি কতটা জটিল, সামান্য ভাবলেই বুঝবেন। নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করতে মানুষ চাই। নইলে কার দ্বারা স্বীকৃত হবেন? কার উপর নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করবেন? যার উপর নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করতে চাইবেন, সে কেন ছেড়ে দেবে? তারও তো একই উদ্দেশ্য -- প্রভু হওয়া! ফল কী দাঁড়ায়? সুদীর্ঘ, অনন্ত এক দ্বৈরথ, যতদিন না পর্যন্ত একজন অপরজনের প্রভুত্ব মেনে নিচ্ছে অর্থাৎ স্লেভ হয়ে যাচ্ছে। এজাতীয় দ্বৈরথ অনলাইন, অফলাইন সর্বত্রই পরিলক্ষিত হয়, যা অত্যন্ত স্বাভাবিক। আর্থ সামাজিক সত্য মাত্রেই যেহেতু মানুষের সৃষ্টি, প্রকৃতি সঞ্জাত নয়। (এই যেমন জল, বায়ু ছাড়া প্রাণ বাঁচেনা, প্রাকৃতিক সত্য। এনিয়ে কেউ বিতর্ক করেনা। কিন্তু মার্ক্সবাদ বেশি উত্তম না জাতীয়তাবাদ, ধনতন্ত্র ইত্যাদি নিয়ে অনন্তকাল বিতর্ক চলতে পারে। এক্ষেত্রে সত্য মাত্রেই সাবজেক্টিভ ( subjective) অর্থাৎ ব্যক্তিনির্ভর। তাই একটি নয়, শত সহস্র সত্য চেতনায় চেতনায় আন্দোলিত, সেই ব্যক্তির লালনপালন, শিক্ষা, সংস্কৃতি, আর্থ সামাজিক অবস্থান থেকে জাত। তাই হাতে প্রচুর সময় থাকলেই এই master slave dialectic এ অংশগ্রহণ করুন। এবং চলতে থাকুন, চালিয়ে যেতে থাকুন।