1 / 7
2 / 7
3 / 7
4 / 7
5 / 7
6 / 7
7 / 7

আত্মনিরীক্ষার ভিন্নস্বরের কবি স্বদেশ সেন : তৈমুর খান

আত্মনিরীক্ষার ভিন্নস্বরের কবি স্বদেশ সেন
তৈমুর খান




ত্মমগ্ন সংবেদনায় নিরন্তর হেঁটে যাওয়া যে কবিকে আমরা চিনতাম না, তিনি হলেন কবি স্বদেশ সেন। ৭০ দশকে কবি স্বদেশ সেন (১৯৩৫-২০১৪) বাংলা কবিতায় নতুন করে আত্মপ্রকাশ করেন। যদিও পঞ্চাশ দশকের কবি হিসেবেই তাঁর পরিচিতি।  ‘কৌরব’ পত্রিকার সঙ্গে যুক্ত বাংলা নয়,  বিহারের জামশেদপুরে থেকেই কাব্যচর্চা করেছেন। জন্মভূমি পূর্বপাকিস্তানের বরিশাল ছেড়ে চলে আসেন খুব ছোট বয়সেই। বাংলা কবিতার ধারায় তাঁর স্বর যে একেবারেই অচেনা তা আমার মতো বহু পাঠকই তাঁর মত্যুর পর জানতে পারলাম। এখনও যে তাঁর কাব্যগুলি পাওয়া বেশ কঠিন তাও টের পেলাম। ‘কৌরব’ পত্রিকার সৌজন্যে যে কাব্যগুলির নাম জানতে পারলাম সেগুলি হল- ‘রাখা হয়েছে কমলালেবু’ (১৯৮২), ‘মাটিতে দুধের কাপ’ (১৯৯২), ‘ছায়ায় আসিও’ (১৯৯৮), ‘স্বদেশ সেনের স্বদেশ’ (২০০৬) প্রভৃতি। তবে বেশি লেখালেখি না করেও যে স্বতন্ত্র এক পথের সন্ধান দেয়া যায় তা প্রমাণ করেছেন স্বদেশ সেন।


যে আত্মগত অভিক্ষেপ বিষাদের, যন্ত্রণার, অনিশ্চয়তার তারই অনুচ্চ তরঙ্গগুলি তিনি শব্দের প্রবল ধারায় ধারণ করেছেন। কবিতাকে কখনোই দার্শনিকের ভাষণ করে তোলেননি, কিংবা রাষ্ট্রিক বা সামাজিক প্রতিফলনে তা গতানুগতিক বিবৃতির আধার হয়ে ওঠেনি। জীবনের শূন্যতা যা অদৃশ্যবাদেরই নিরন্তর প্রতিধ্বনি তোলে, যা বাস্তবের সীমানায় বেড়ে ওঠে, যাকে উপলব্ধি করা যেতে পারে, আবার তা বুঝতেও অসুবিধা হয় না —সেই জীবনপ্রবাহকেই তুলে আনেন। যে জল বেদনার, সেই জল তৃষ্ণারও, আবার তা আনন্দেরও হতে পারে। বহুমাত্রিক এই অন্বয়কে তিনি অনন্বয় হিসেবেও দেখেছেন।


সময়ের প্রভাব অবশ্যই পড়েছে, কিন্তু নিজস্ব শব্দচালের ভেতর অনুভব ও মননের এক সুদৃঢ় সহাবস্থান যে চেতনাকল্প বা The image of Consciousness তিনি তা নির্মাণ করেছেন। বাংলা সাহিত্যে আর কোনো কবি করেছেন বলে মনে হয় না।


নদী, জলকাদার দেশ ময়মনসিং-এর ছেলে নিজেকে যখন বিহারের শুষ্ক আবহাওয়ায় এসে জীবনযুদ্ধ ছেড়ে দেন, তখন কী অনুভূতি আর মনন উঠে আসে কবির চেতনায় তা ‘রাখা হয়েছে কমলালেবু’ কাব্যগ্রন্থেই বুঝে নিতে পারি —


“ওই দেখো ময়মনসিং-এর ছেলে চলে যাচ্ছে

গরম বালি যেন টেনে নিচ্ছে গায়ে পড়া জল

ওর হেরে যাবার স্টাইল — ওর হারিকেনের মুখ এখন ময়লা


উত্তরে হেলে আলো দিচ্ছে দক্ষিণে।


যে নদীর পরে নদী সাঁতরে যায় সে যে হারে না এজীবনে


এ আগুনে পোড়ে না দুধ

তোমার জন্য এই কথাই লিখছি এখন।”

(পিছুডাক)


এই ‘পিছুডাক’ কবির শেকড় চিনিয়ে দেয়। কবি Rootlessness হয়েও তাঁর সত্তাকে অনুধাবন করতে পারেন। যে সত্তা এক সংগ্রামী আত্মচেতনায় বহু পথ অতিক্রম করে ফিরে এসেছে। খোকন একটা বাতাবিফল, তার ফিকা রঙের জামা, মাসকালাইয়ের ক্ষেতে নেমে গেছে আর কেমন একটা ডাক শুনেছে, যে ডাক পোষা বাদাম গাছটার। জীবনের পথ আঁকা আছে তাঁর কবিতায়। গাছের কণ্ঠস্বর, আকাশ, মেঘের বাড়িঘর, মাটি ও বাতাস প্রকৃতির উপমা শুধু উপমা হয়ে থাকে না, প্রাণের মরমি ছায়ায় তা গভীর সংরাগে আলো পায়। কণ্ঠস্বর হয়ে বেজে ওঠে। আর একটি কবিতায় দেখতে পাই —


“ব্রীজ পার হয়ে যাবো —সুদূর অক্ষরে কাঁপা পথ

ঝুমকা থামো, আমি সাইকেলে চড়েছি

দূরে যাবো বলে। দুষ্টু পাতা কেন

ডাকো? কী কারণে জল তুমি শিশিরের মতো

নীরবতা! আকাশের কোণে কোণে পাখি নিয়ে খেলা

আকাশের। মেঘের মতন যাওয়া —এই যাওয়া

ভালো।

(ব্রীজ পার হয়ে)


কবির কাছে ‘ডাক’ আসে। নীরবতাও আসে। যাওয়াও আসে। সব ক্রিয়াগুলিতে আত্মক্ষরণের প্রবাহ লুকিয়ে থাকে। আর্ত ও নিবেদিত উপলব্ধির প্রজ্ঞায় সেই ক্ষরণ মথিত হয়। বিচ্ছিন্নতা থেকে একাগ্রতা এবং সনির্বন্ধ বিস্তারে কবিকে মগ্ন হতে দেখি —


“ডাকছে কত মেঘ

গরম বুকের দুধ কার যেন

প্রসব প্রয়াসী ডাক কার যেন

এবং কোথায় যেন বুলবুল বুলবুল শব্দে

দুধ ফেটে যায়।”

(একদা ডালিম গাছ)


গরম বুকের দুধ, প্রসবপ্রয়াসী ডাক, বুলবুল বুলবুল শব্দ —চেতনাকল্পের ভাষা থেকে জাত বোধের অনুজ্ঞা, যা কবির একান্ত নিজস্ব অনুবার্তায় স্বয়ংক্রিয়তা পেয়েছে। তেমনি আপেলের ঘুম, উপোসীলতা, দুধের মুকুল এবং “অনুকে কে ডেকে গেল অনুপম” পড়তে পড়তে প্রকৃতির দ্রবণের মতো বেঁচে থাকার আয়ুও এক ছটাক রোদ্দুর হয়ে যায়। কবি তখন লেখেন —


“এসেছি জলের কাছে কথা নিয়ে।”


“জীবন পরজন্ত স্নান যেখানে, সেখানে গা রেখে / জলের ওপরে এক জাঙ্গিয়া রঙের সূর্য দেখেছি।” কবির চোখ দিয়ে এই দেখার মধ্যে কোনো মোহ নেই, বরং প্রাত্যহিকেরই সম্পর্ক আছে। সূর্য স্নানের মুহূর্তে জাঙ্গিয়া রঙের হতে পারে। অর্থ্যাৎ যে বিশেষণটি আমাদের কাঙ্ক্ষিত ছিল, তা পাল্টে গেল। জৈববৃত্তীয় মাত্রায় তা ক্ষুদ্র একটি ইন্দ্রিয়জ পোশাকের রূপ লাভ করল। এখানেই কবির অনন্যতা।


‘মাটিতে দুধের কাপ’ কাব্যেও কবি বলেছেন, “সাদা-সাপ্টা কথার জোরই আমার জোর।” – এই কথা যে সকল মানুষেরই জীবনের কথা তা বলাই বাহুল্য। কারণ মাত্রাহীন অসীম কবির কাছে কোনো বিষয়ই নয়। মৃত্যু যেমন একটা বিষয় হতে পারে। অবাস্তব স্বপ্ন বা মহাকালের আশাকে কবি কখনোই লালন করেননি। তবু কবির দেখার মধ্যে একটা তীক্ষ্ণ মেধা আছে। মননের এমন সূক্ষ্ম বিনুনি খুব সহজ নয় —


“পায়রা পিছলে যাবে

এমনি হয়েছে আকাশ

রোদ এমন

যে কাগজে ছাপানো যায়।

যত ছোট বড় করেই তাকাও

আর ধরে রাখো নিজেকে

মনে হবে

এই ছড়িয়ে গেল

এই কেঁপে উঠল বুক।”

(অস্থায়ী)


সমস্ত দিকের টানের মধ্যেই “পদার্থে ও প্রকৃতিতে মিলিয়ে যে মাঝামাঝি ফোটা অতো সোজা নয়।” কিংবা “আসল ঘিয়ের রঙ মেরে আনা এখনো কঠিন।” – কবি তা জানেন আর জানেন বলেই কবিতাকে সদর্থক ব্যঞ্জনায় আত্মপ্রকাশের বাহন করে তোলেননি। সবকিছু মনের মতো হবে, পাঠকের কাঙ্ক্ষিত লক্ষ্য পূরণ হবে —এমনটি হয়নি। ‘অক্ষর নেবে না কিছু’ কবিতায় লিখেছেন সে কথা —


“তোমার খাবার ঠিক পাতের মাঝখানে দিতে

পারবো না এ বিষাদ জেনে বলে রাখি

হাঁপিয়ে ওঠার এই অতি-চিহ্নগুলি দেখো 

জেনো একজন গেছে, খুবই সে হাঁপিয়ে গেছে।”


কবিতা সেই আত্মনিরীক্ষায় সত্যের অভ্যাস থেকেই বেরিয়ে এসেছে শেষ পর্যন্ত। দীর্ঘশ্বাস নেই, তথাকথিত হা-হুতাশের উগ্রতাও নেই। এক বিষণ্ণ প্রহরের নিরাবয়ব দীক্ষা আছে। দুর্নিবার ভাঙনের প্রক্ষিপ্ততা, সুচারু শব্দবিন্যাসের মূলতত্ত্বে সংগৃহীত হয়েছে উপলব্ধির তরঙ্গ-স্পন্দন। সত্তর দশকের আবহাওয়ায় এরকম কবিতা লিখেও  নিজেকে আলাদা করে এভাবে উপস্থাপন করা এবং কবিখ্যাতিকে তাচ্ছিল্য করে সম্পূর্ণ আড়ালে থাকা আজ তাঁকে আবিষ্কার বলেই মনে হয়। এই দশকেও তিনি সম্পূর্ণ নতুন পথের দিশারী। আমেরিকান কবি ই. ই. কামিংস বলেছেন, “Unbeing dead isn’t being alive.” কবি স্বদেশ সেন-এর মধ্যে এ কথাই প্রমাণ পাই। আজ তিনি বাংলা কবিতায় এক প্রাণবন্ত মিথ হিসেবেই সঞ্চারিত হবেন।








Joydeb Biswas

Poet Joydeb Biswas studied Bengali literature. In 2015, at the age of 22, he published 'Sahitya Chetona' magazine. Currently two editions of the magazine are published. One is the online version and the other is the printed version. He is the founder and editor of the two editions. facebook twitter youtube instagram whatsapp

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

নবীনতর পূর্বতন