জ য় দী প চ ট্টো পা ধ্যা য়
দড়ির ওপর ব্যালেন্সিং অ্যাক্ট করতে করতে বিপজ্জনক ভাবে এগিয়ে যাওয়ার মতই বাঁশের সাঁকো ধরে এগিয়ে যাচ্ছে সে। অনভ্যস্ত, অথচ আত্মবিশ্বাসী পদক্ষেপ। কিছুতেই পিছিয়ে আসতে চাইছে না, শুধু মাঝে মাঝে পেছন ফিরে তাকাচ্ছে গোলাপী হাসি মেখে। মচমচ করছে... দুলে উঠছে সাঁকো। এক হাতে চটি-জোড়া নিয়ে ব্যালেন্স করতে করতে পা বাড়িয়ে এগিয়ে যাচ্ছে সে। পূর্ণিমার একটা নির্দিষ্ট তিথি হয়, পঞ্জিকা মতে সে এক ঘটিকায় লাগে, আর এক ঘটিকায় ছেড়ে চলে যায়। অথচ তার আগের আর পরের রাতের চাঁদও প্রায় একই রকম সুন্দর লাগে আমার। সন্ধের কপালে ভরাট টিপের মত উজ্জ্বল। কখনও তামাটে, কখনও হালকা সোনালী ভাব। আজ বোধহয় তেমনই কোনো রাত। আজ যদি পূর্ণিমা নাও হয়... হয়ত গতকাল পূর্ণিমা ছিল, কিংবা আগামীকাল আছে। ইচ্ছে করছে আঁকা ছবি কিংবা অ্যানিমেশন ফিল্মের দৃশ্যের মত ওই চাঁদকে সাঁকোর কাছাকাছি টেনে নিয়ে আসি... আরও অনেকটা বড়ো করে দিই।
সুবিশাল তামাটে চাঁদকে চালচিত্রের মত প্রেক্ষাপটে রেখে সাঁকো ধরে সে এগিয়ে চলেছে। মনের লেন্সে ধরা সেই সব চমৎকার আলোকচিত্র ডেভেলপ করা গেলে সেই ছবি বড়ো করে বাঁধিয়ে রাখতাম... অনেক বছর পরেও সবাই দেখত এই বিস্ময়কর মুহূর্ত। অবশ্য, সে সামর্থ্য বা উপায় থাকলে আরও অনেক ছবি ডেভেলপ করতাম। হলুদ আর সাদা শাড়ীর ডানায় ভর দিয়ে দুপুরবেলা ছাদ থেকে উড়ে যাওয়ার দৃশ্য। কাঁধ, পিঠ আর কপালে জমে থাকা বৃষ্টির এক একটা ফোঁটার দর্পন হয়ে ওঠার দৃশ্য। পালা করে কুকুর, বেড়াল আর কেতকীফুলের গাছকে চুমু খাওয়ার দৃশ্য। রাস্তার জমা জলে নিজের মুখ দেখে চুল ঠিক করে নেওয়ার দৃশ্য। একটা পরিযায়ী বিকেলকে চায়ের পেয়ালার মত ঠোঁটে ছুঁয়ে বিদায় জানানোর দৃশ্য। সিগারেটের ধোঁয়ায় এক রাশ ড্যান্ডেলিয়ন ভাসিয়ে দেওয়ার দৃশ্য। সত্যিই আফসোস হয়... কিছুই ডেভেলপ করা গেল না!
আমার চমক ভাঙে শঙ্খধ্বনি কানে আসতে। এদিকে গৃহস্থ বাড়িতে এখনও শাঁখ বাজে। দেখলাম আমাকে ফাঁকি দিয়ে তামাটে চাঁদটা আবার নিজের জায়গায় পালিয়ে গেছে। সাঁকোর নীচের কচুরি-পানা ঢাকা জল আঁধারে হারিয়ে গেছে। আর সাঁকোটা খালি। সে ওপারে দাঁড়িয়ে তাকিয়ে আছে একটা জানলার দিকে। হয়ত ওখান থেকেই শাঁখ বেজে উঠল। আরও কাছে গেলে ধূপের সুবাসও পাওয়া যাবে। জানলার একটা পাল্লা খোলা, ভেতরের হলুদ আলো এসে পড়েছে বাইরে। সেই আলোরই সামান্য আভা এসে পড়েছে ওর মুখে। জোনাকিরা সাঁকোর কাছাকাছি উড়ে বেড়াচ্ছে। একটা জোনাকি এসে বসেছে ওর ঠোঁটের ওপর। আমি স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছি, অথচ ও তাড়াল না। জোনাকির আলোয় ওর হাসিটা কুলুঙ্গির প্রদীপ হয়ে গেল। আর একটা জোনাকী এসে বসল আমার হাতঘড়ির গালে।
আমি হাত দুটো একবার চাঁদ আর একবার সাঁকোর ওপারে বাড়ানোর চেষ্টা করে দেখলাম... কী ভীষণ বামন হয়ে যাচ্ছি! বুকটা ছ্যাঁৎ করে উঠল। মনে হ'ল কোনও করুণ নয়না মরালী তার ধূসর ডানা মেলে এবারে উড়ে যাবে। শুধু একটা চাঁদরঙা পালক রেখে যাবে মানুষের অসহায়তাকে সান্ত্বনা দেওয়ার জন্য। একটু সাহস করে গলা ঝাড়ার শব্দ করে স্বাভাবিক হ'তে চাইলাম। গলা বুঁজে এসেছিল হঠাৎ। ডাক দিয়ে বললাম— সন্ধে হয়ে গেছে, এবারে আয়... ফিরতে হবে। মনে হ'ল— এই আঁধারে কি আবার সাঁকো পেরিয়ে এপারে আসতে পারবে? সাঁকোর ওপর দু-পা এগিয়ে বুঝলাম আমার দ্বারা হচ্ছে না। আর আমার ওপারে গিয়েও সুবিধে নেই... ফিরতে গেলে দুজনকেই আবার এপারে আসতে হবে। ও এমন ভাবে সাদা সুতোয় নকশা তোলা ওড়নাটা হাওয়ায় ভাসিয়ে দিল... যেন ওড়নার সেতু বেঁধে এপারে চলে আসবে। এবারে একটু কড়া ভাবেই বললাম এপারে আসার কথা। ও আরও স্পষ্ট করে বুঝিয়ে দিলো— 'ফিরতে চাইলে তবেই আমি ফিরি'।
"তুমি তো এসে নিয়ে যেতে পারবে না... সেই অসহায়ের মতই বসে থাকবে, কখন আমি আবার ওপারে পৌঁছব... তোমার কাছে... ব্যালেন্স করতে করতে।"
--- --- ---
'তোমায় দিলাম' গানটায় একের পর এক এনটিটির উল্লেখ করে বলা হচ্ছে 'আর কী বা দিতে পারি?'। শহুরে নস্টালজিয়া আর আধুনিকতার সব রকম এলিমেন্টের মাঝেই শেষে মিশে গেছে কীর্তন, বার বার বলা হচ্ছে 'তোমায় দিলাম... তোমায় দিলাম... তোমায় দিলাম"।
এমন টাইমলেস আবেদন, ভীষণ রকম ব্লু একটা গান... বার বার কারও কথা মনে পড়ে কেউ না কেউ নিজের মনেই গেয়ে উঠবে 'আর কী বা দিতে পারি?'।
নিঃশেষিত কর্পূর অথবা জ্বলতে জ্বলতে ভস্মে হারিয়ে যাওয়া ধূপের পরও যে লেশমাত্র থেকে যায়... তার সুবাস আর স্মৃতিতে; তেমনই সেইসব বিগত নৈসর্গিক রজনীর অলীক সুখ। সেই নীল ধোঁয়া হাতড়ে আদৌ কি সুখ পুনরায় অনুভূত হয়? নাকি আত্মপীড়নের নেশায় স্যাডিস্টিক আমিটাকে কিছুক্ষণ বুঁদ করে ভুলিয়ে রাখা? ক্ষরণ আভ্যন্তরীন, হলাহলে গলা জ্বলে যাওয়ার পর তুরীয় অনুভূতি আসে। এই তো সে... ব্যালেন্স করে করে ফিরে আসছে! জোনাকীর আলোয় আলোয়। তখনো চাকরি, ভাড়া-বাড়ি অথবা পদবীর হিসেব থাকবে? পরে যেভাবেই বিদ্ধ হোক দ্যুতি, সেই মুহূর্তটুকু কি অজড় সত্য নয়? আমি যে দেখতে পাই, অধরের সেই উজ্জ্বল জোনাকী মথের মত বড়ো হয়ে উঠছে। মোক্ষপথে প্রজ্ঞার মত।
মোবাইল ফোনের মত জাগতিক আরো অনেক কিছু সুইচ অফ করে বিচ্ছিন্ন করতে করতে নগরের এক নির্জন প্রান্তে অখ্যাত বৌদ্ধ উপাসনা গৃহসম পবিত্রতা নির্মাণ করা গেছিল। সেখানেই এক কাঠগোলাপ গাছের ছায়ায় সমাধীও থেকে গেছে। এখনো জ্যোৎস্নালোকে গোলাপী আভায় উজ্জ্বল হয়ে ওঠে সেই ফলকের অন্তিম চুম্বনরেখা। জোনাকীরা মাঝে মাঝে দুদণ্ড আলো দিয়ে যায়। চাঁদও নেমে আসা কাছাকাছি। চেষ্টা করে অতিক্ষুদ্র লিপিতে লেখা কথাগুলোর মর্মোদ্ধার করতে। চুমুর ছাপও আঙুলের ছাপের মত, শনাক্ত করে... অনাবৃত করে দেয় কিছু কথা। আমরা চাইনি... সেও না, আমিও না। চাঁদ ফিরে যায়, হতাশ এবং ব্যর্থ সত্যান্বেষীর দীর্ঘশ্বাস রেখে।
আমি কেঁপে উঠি জ্বরে, অথবা নেশাভাঙা জাগতিক ধাক্কায়।
ঠোঁটে ঠোঁট রাখার আগে, আড়ালে বা নিভৃতে কতবার কত স্পর্শ-চিহ্ন অথবা স্মৃতিচিহ্ন ছুঁতে চায় কারও ঠোঁট। অনেক বছর পরেও, পুরনো আসবাব, সুটকেস, ফাইলপত্র, বই-খাতা, সন্তানের খেলার সামগ্রী... গোছাতে গোছাতে হঠাৎই কেউ চলে আসে ঠোঁটের কাছাকাছি। এই ঠোঁট অবচেতনে স্পর্শ করে ফিসফিস করে বলে— আর কী বা দিতে পারি?
গন্ধর্ব সন্ধ্যায় যে ঠোঁট পেয়েছিল চন্দ্র-শিশির, আজ টিস্যু পেপারে বিলাসী লিপস্টিকের ছাপ রেখে চলে যাবে! কিন্তু তারপর?
You must remember this
A kiss is just a kiss
A sigh is just a sigh...