1 / 7
2 / 7
3 / 7
4 / 7
5 / 7
6 / 7
7 / 7

হাংরি ও পরাবাস্তববাদের অবনিবনার অহেতুক চর্চা —লিখেছেন মলয় রায়চৌধুরী

 হাংরি ও পরাবাস্তববাদের অবনিবনার অহেতুক চর্চা —লিখেছেন মলয়  রায়চৌধুরী




এক


হাংরি আন্দোলনকারীদের অবনিবনা নিয়ে যতো খিল্লি হয় তা কিন্তু পরাবাস্তববাদীদের মাঝে অবনিবনা নিয়ে হয় না । অথচ পরাবাস্তববাদীদের পরস্পরের ঝগড়া কতোজনের সঙ্গে যে প্রত্যেকের হয়েছিল তার কোনও হিসেব নেই । ফিদেল কাস্ত্রোর সঙ্গে চে গ্বেভারার অবনিবনা চেপে গিয়ে পালা করে ওই দুজনের টি শার্ট পরে ঘুরে বেড়ান বাঙালি ছোকরা লেখক-কবি। অথচ হাংরি আন্দোলনের আলোচনা শুরু করলেই সবাই  তাঁদের পারস্পরিক অবনিবনা চর্চা করেন ; লেখালিখি বিশ্লেষণের কথা চিন্তা করেন না বা করতে চান না, বিশেষ করে বাঙালি আলোচকরা । নন্দিনী ধর হাংরি আন্দোলন আলোচনা করতে বসে দুম করে লিখে দিলেন যে আমার সংকলিত বই থেকে শৈলেশ্বর ঘোষকে বাদ দিয়েছি ; অথচ আমি হাংরি আন্দোলনকারীদের রচনার কোনো সংকলন প্রকাশ করিনি । নন্দিনী ধর লিখেছেন যে হাংরি আন্দোলনকারীরা নিজেদের ছোটোলোক ঘোষণা করে বিবিক্ততাকে প্রতিষ্ঠা করতে চেয়েছেন ; উনি জানতেন না যে আমি পাটনায় ইমলিতলা নামে এক অন্ত্যজ অধ্যুষিত বস্তিতে থাকতুম, অবনী ধর ছিলেন জাহাজের খালাসি আর পরে ঠেলাগাড়িতে করে কয়লা বেচতেন, শৈলেশ্বর ঘোষ আর সুভাষ ঘোষ এসেছিলেন উদ্বাস্তু পরিবার থেকে, দেবী রায় চায়ের ঠেকে চা বিলি করতেন । এ-থেকে টের পাওয়া যায় যে আলোচকরা কোনও বই পড়ার আগেই ভেবে নেন যে হাংরি আন্দোলনকারীদের রচনা আলোচনার সময়ে কী লিখবেন । হাংরি আন্দোলনকারীদের বিশ্ববীক্ষার তর্ক-বিতর্ক ও লেখালিখি বাদে দিয়ে আলোচকরা ব্যক্তিগত সম্পর্ককে গুরুত্ব দেন ।



অন্য বাঙালি লেখকদের ক্ষেত্রে কিন্তু তাঁরা এমন অডিটরসূলভ বিশ্লেষণ করতে বসেন না । বিদেশি সাহিত্যিকদের মাঝে নিজেদের বিশ্ববীক্ষার সমর্থনে পারস্পরিক বিবাদ-বিতর্কের কথা যেমন শোনা যায় তেমনটা বাঙালি লেখকদের ক্ষেত্রে বড়ো একটা দেখা যায় না । আমরা পড়েছি গোর ভিডাল আর নরম্যান মেইলারের বিবাদ এমনকি হাতাহাতি, সালমান রুশডি - জন আপডাইক বিবাদ, হেনরি জেমস - এইচ জি ওয়েল্স বিবাদ, জোসেফ কনরাড - ডি এইচ লরেন্স বিবাদ, জন কিটস - লর্ড বায়রন বিবাদ, চার্লস ডিকেন্স - হ্যান্স ক্রিশ্চিয়ান অ্যাণ্ডারসন বিবাদ ইত্যাদি । আলোচকরা কিন্তু তাঁদের রচনাবলী বিশ্লেষণের সময়ে সৃজনশীল কাজকেই গুরুত্ব দেন, বিবাদকে নয় ।        


  


বাঙালি সাহিত্যিক শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায় ঈশ্বরে বিশ্বাস করেন, মনে করেন মানুষ ও প্রাণীরা এসেছে অন্য গ্রহ থেকে, অনুকূল ঠাকুরের শিষ্য । ওই একই দপতরে সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় তাঁর পাশের কেবিনেই বসতেন ,যিনি ঈশ্বরে বিশ্বাস করতেন না, ডারউইনের তত্বে বিশ্বাস করতেন, বামপন্হী ছিলেন । অথচ পরপস্পরের লেখা আলোচনার সময়ে এই বিষয়গুলো ওনাদের দৃষ্টি এড়িয়ে যেত, যেন সাহিত্য আলোচনায় লেখকের বিশ্ববীক্ষার কোনো প্রভাব থাকে না । অধিকাংশ বাঙালি সাহিত্যিক এই ধরণের ভাই-ভাই ক্লাবের সদস্য । এদিকে হাংরি আন্দোলনকারীদের রচনা আলোচনা করতে বসে তাদের ব্যক্তিগত অবনিবনায় জোর দেন ।         



এই তো সেদিন ক্লিন্টন বি সিলির জীবনানন্দ বিষয়ক গ্রন্হ ‘এ পোয়েট অ্যাপার্ট, পড়ার সময়ে হাংরি আন্দোলনকারীরা খালাসিটোলায় জীবনানন্দের যে জন্মদিন পালন করেছিল, তার বর্ণনা পড়ছিলুম । উনি ‘দি স্টেটসম্যান’ পত্রিকায় ২৮ ফেব্রুয়ারি ১৯৬৮ তারিখে প্রকাশিত সংবাদ তুলে দিয়ে পরবর্তী প্রজন্মে জীবনানন্দের প্রভাব নিয়ে আলোচনা করেছেন । একই খবর প্রকাশিত হয়েছিল তখনকার সাপ্তাহিক ‘অমৃত’ পত্রিকায় । সেদিন সন্ধ্যায় জীবনানন্দ দাশের জন্মদিন পালনের জন্য  টেবিলে উঠে পড়লেন হাংরি আন্দোলনের গল্পকার অবনী ধর আর নাচের সঙ্গে গাইতে লাগলেন একটা গান, যা তিনি জাহাজে খালসির কাজ করার সময়ে গাইতেন, বিদেশি খালাসিদের সঙ্গে । উপস্হিত সবাই, এমনকি হাংরি আন্দোলনের কয়েকজন ভেবেছিলেন গানটা আবোল-তাবোল, কেননা ইংরেজিতে তো এমনতর শব্দ তাঁদের জানা ছিল না । যে সাংবাদিকরা খবর কভার করতে এসেছিলেন তাঁরাও গানটাকে ভেবেছিলেন হাংরি আন্দোলনকারীদের বজ্জাতি, প্রচার পাবার ধান্দা ।  ‘অমৃত’ পত্রিকায় ‘লস্ট জেনারেশন’ শিরোনামে ঠাট্টা করে দুই পাতা চুটকি লেখা হয়েছিল, অবনী ধরের কার্টুনের সঙ্গে ।  ‘অমৃত’ পত্রিকায় ‘লস্ট জেনারেশন’ তকমাটি যিনি ব্যবহার করেছিলেন তিনি জানতেন না যে এই শব্দবন্ধ তৈরি করেছিলেন গারট্রুড স্টিন এবং বিশ শতকের বিশের দশকে প্যারিসে আশ্রয় নেয়া আর্নেস্ট হেমিংওয়ে, এফ স্কট ফিটজেরাল্ড, টি. এস. এলিয়ট, জন ডস প্যাসস, ই ই কামিংস, আর্চিবল্ড ম্যাকলিশ, হার্ট ক্রেন প্রমুখকে বলা হয়েছিল ‘লস্ট জেনারেশন’-এর সদস্য । অবনী ধর-এর নামের সঙ্গে অনেকেই পরিচিত নন । যাঁরা তাঁর নাম শোনেননি এবং ওনার একমাত্র বই ‘ওয়ান শট’ পড়েননি, তাঁদের জানাই যে ছোটোগল্পের সংজ্ঞাকে মান্যতা দিলে বলতে হয় যে অবনী ধর ছিলেন হাংরি আন্দোলনের সর্বশ্রেষ্ঠ ছোটো গল্পকার । 


গানটা এরকম, মোৎসার্টের একটা বিশেষ সুরে গাওয়া হয়:


জিং গ্যাং গুলি গুলি গুলি গুলি ওয়াচা,

জিং গ্যাং গু, জিং গ্যাং গু ।

জিং গ্যাং গুলি গুলি গুলি গুলি ওয়াচা,

জিং গ্যাং গু, জিং গ্যাং গু ।

হায়লা, ওহ হায়লা শায়লা, হায়লা শায়লা, শায়লা উউউউউহ,

হায়লা, ওহ হায়লা শায়লা, হায়লা শায়লা, শায়লা, উহ

শ্যালি ওয়ালি, শ্যালি ওয়ালি, শ্যালি ওয়ালি, শ্যালি ওয়ালি ।

উউউমপাহ, উউউমপাহ, উউউমপাহ, উউউমপাহ । 


১৯২০ সালে,, প্রথম বিশ্ব স্কাউট জাম্বোরির জন্য, রবার্ট ব্যাডেন-পাওয়েল, প্রথম বারন ব্যাডেন-পাওয়েল (স্কাউটিংয়ের প্রতিষ্ঠাতা) সিদ্ধান্ত নেন যে একটা মজার গান পেলে ভালো হয়, যা সব দেশের স্কাউটরা গাইতে পারবে ; কারোরই কঠিন মনে হবে না । উনি মোৎসার্টের  এক নম্বর সিম্ফনির ইবি মেজরে বাঁধা সুরটি ধার করেছিলেন । গানটা স্কাউটদের মধ্যে তো বটেই সাধারণ স্কুল ছাত্রদের মধ্যেও জনপ্রিয় হয়েছিল । এই স্কাউটদের কেউ-কেউ জাহাজে চাকরি নিয়ে খালাসি এবং অন্যান্য কর্মীদের মধ্যে এটাকে ছড়িয়ে দিতে সফল হন । অবনী ধর বেশ কিছুকাল জাহাজে খালাসির কাজ করেছিলেন এবং তাঁরও ভালো লেগে যায় সমবেতভাবে গাওয়া গানটি । শতভিষা, কৃত্তিবাস, কবিতা, ধ্রুপদি  পত্রিকার কর্নধারদের প্রিয় সঙ্গীত-জগত  থেকে একশো আশি ডিগ্রি ঘুরে যাওয়া এই গান সেসময়ে নিতে পারেননি সাংবাদিক আর বিদ্যায়তনিক আলোচকরা, তার ওপর যেহেতু হাংরি আন্দোলনের ব্যাপার, তাই তাঁরা এটাকে অশিক্ষিত নেশাখোর-মাতালদের কারবার ভেবে হেঁ-হেঁ করে হেসে উড়িয়ে দিয়েছিলেন ।




দুই


উত্তরবঙ্গে হাংরি জেনারেশনের প্রসার সম্পর্কে স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে, হাংরি পত্রিকা ‘কনসেনট্রেশন ক্যাম্প’ এর সম্পাদক অলোক গোস্বামী এই কথাগুলো লিখেছিলেন, তা থেকে অবনিবনার যৎসামান্য আইডিয়া হবে, আর এই অবনিবনার সঙ্গে পরাবাস্তববাদীদের নিজেদের অবনিবনারে যথেষ্ট মিল আছে :-


“নব্বুই দশকে সদ্য প্রকাশিত কনসেন্ট্রেশন ক্যাম্প বগলে নিয়ে এক ঠা ঠা দুপুরে আমি হাজির হয়েছিলাম শৈলেশ্বরের বাড়ির গেটে। একা। ইচ্ছে ছিল শৈলেশ্বরের সঙ্গে মুখোমুখি বসে যাবতীয় ভুল বোঝাবুঝি নিয়ে খোলাখুলি কথা বলবো। যেহেতু স্মরণে ছিল শৈলেশ্বরের সঙ্গে প্রথম পরিচয়ের স্মৃতি তাই আস্থা ছিল শৈলেশ্বরের প্রজ্ঞা,ব্যক্তিত্ব,যুক্তিবোধ তথা ভদ্রতাবোধের ওপর। দৃঢ় বিশ্বাস ছিল শৈলেশ্বর আমাদের ভুলগুলো ধরিয়ে দেবেন এবং যৌথ আলোচনাই পারবে সব ভুল বোঝাবুঝি মিটিয়ে নতুন উদ্যমে একসাথে পথ চলা শুরু করতে। কিন্তু দুভার্গ্য বশতঃ তেমন কিছু ঘটলো না। বেল বাজাতেই গেটের ওপারে শৈলেশ্বর। আমাকে দেখেই ভ্রূ কুঁচকে ফেললেন।


--কী চাই!

মিনমিন করে বললাম, আপনার সঙ্গে কথা বলবো।

--কে আপনি?


এক এবং দুই নম্বর প্রশ্নের ভুল অবস্থান দেখে হাসি পাওয়া সত্বেও চেপে গিয়ে নাম বললাম।


--কি কথা?

--গেটটা না খুললে কথা বলি কিভাবে!

--কোনো কথার প্রয়োজন নেই। চলে যান।

--এভাবে কথা বলছেন কেন?

--যা বলছি ঠিক বলছি। যান। নাহলে কিন্তু প্রতিবেশীদের ডাকতে বাধ্য হবো।


এরপর স্বাভাবিক কারণেই খানিকটা ভয় পেয়েছিলাম কারণ আমার চেহারাটা যেরকম তাতে শৈলেশ্বর যদি একবার ডাকাত, ডাকাত বলে চেঁচিয়ে ওঠেন তাহলে হয়ত জান নিয়ে ফেরার সুযোগ পাবো না। তবে 'ছেলেধরা' বলে চেল্লালে ভয় পেতাম না। সমকামিতার দোষ না থাকায় নির্ঘাত রুখে দাঁড়াতাম।


ভয় পাচ্ছি অথচ চলেও যেতে পারছি না। সিদ্ধান্তে পৌঁছতে গেলে আরও খানিকটা জানা বোঝা জরুরি।

--ঠিক আছে, চলে যাচ্ছি। তবে পত্রিকার নতুন সংখ্যা প্রকাশিত হয়েছে সেটা রাখুন।

এগিয়ে আসতে গিয়েও থমকে দাঁড়ালেন শৈলেশ্বর।

--কোন পত্রিকা?

--কনসেন্ট্রেশন ক্যাম্প।

--নেব না। যান।


এরপর আর দাঁড়াইনি। দাঁড়ানোর প্রয়োজনও ছিল না। ততক্ষণে বুঝে ফেলেছি ব্যক্তি শৈলেশ্বর ঘোষকে চিনতে ভুল হয়নি আমাদের। আর এই সমঝদারি এতটাই তৃপ্তি দিয়েছিল যে অপমানবোধ স্পর্শ করারই সুযোগ পায়নি।”


পরাবাস্তববাদীদের  মতনই, শৈলেশ্বর ঘোষের হয়তো মনে হয়েছিল যে কলকাতায় তিনি হাংরি আন্দোলনের যে কেন্দ্র গড়ে তুলতে চাইছেন তাতে ফাটল ধরাবার চেষ্টা করা হচ্ছে । তাঁর আচরণ ছিল হুবহু আঁদ্রে ব্রেতঁর মতন । পরাবাস্তববাদ আন্দোলনে আঁদ্রে ব্রেতঁর সঙ্গে অনেকের সম্পর্ক ভালো ছিল না, দল বহুবার ভাগাভাগি হয়েছিল, অথচ সেসব নিয়ে বাঙালি আলোচকরা তেমন উৎসাহিত নন, যতোটা হাংরি আন্দোলনের দল-ভাগাভাগি নিয়ে। ইংরেজিতে মৈত্রেয়ী ভট্টাচার্য চৌধুরী হাংরি আন্দোলন নিয়ে ‘দি হাংরিয়ালিস্টস’ নামে একটি বই লিখেছেন, পেঙ্গুইন র‌্যাণ্ডাম হাউস থেকে প্রকাশিত । সেই বইটি বাংলা পত্রপত্রিকায় আলোচিত হল না । 


তিন


আনন্দবাজার পত্রিকায় ১৬ জুন ২০১৩ তারিখে গৌতম চক্রবর্তী হাংরি আন্দোলন সম্পর্কে এই কথাগুলো লিখেছিলেন ; তাতেও রয়েছে টিটকিরি, যা তিনি পরাবাস্তববাদীদের সম্পর্কে কখনও বলেছেন কিনা জানি না । উনি লিখেছিলেন :


“মানুষ, ঈশ্বর, গণতন্ত্র ও বিজ্ঞান পরাজিত হয়ে গেছে। কবিতা এখন একমাত্র আশ্রয়।... এখন কবিতা রচিত হয় অর্গ্যাজমের মতো স্বতঃস্ফূর্তিতে।


১৯৬২ সালে এই ভাষাতেই কলেজ স্ট্রিট কফি হাউস থেকে খালাসিটোলা, বারদুয়ারি অবধি সর্বত্র গোপন বিপ্লবী আন্দোলনের ব্লু প্রিন্টের মতো ছড়িয়ে পড়ে একটি ম্যানিফেস্টো। ২৬৯ নেতাজি সুভাষ রোড, হাওড়া থেকে প্রকাশিত এই ম্যানিফেস্টোর ওপরে লেখা ‘হাংরি জেনারেশন’। নীচের লাইনে তিনটি নাম। ‘স্রষ্টা: মলয় রায়চৌধুরী। নেতৃত্ব: শক্তি চট্টোপাধ্যায়। সম্পাদনা: দেবী রায়।’


তখনও কলেজ স্ট্রিটের বাতাসে আসেনি বারুদের গন্ধ, দেওয়ালে লেখা হয়নি ‘সত্তরের দশক মুক্তির দশক’। কিন্তু পঞ্চাশ পেরিয়ে-যাওয়া এই ম্যানিফেস্টোর গুরুত্ব অন্যত্র। এর আগে ‘ভারতী’, ‘কবিতা’, ‘কৃত্তিবাস’, ‘শতভিষা’ অনেক কবিতার কাগজ ছিল, সেগুলি ঘিরে কবিরা সংঘবদ্ধও হতেন। কিন্তু এই ভাবে সাইক্লোস্টাইল-করা ম্যানিফেস্টো আগে কখনও ছড়ায়নি বাংলা কবিতা।


ওটি হাংরি আন্দোলনের দ্বিতীয় ম্যানিফেস্টো। প্রথম ম্যানিফেস্টোটি বেরিয়েছিল তার কয়েক মাস আগে, ১৯৬১ সালের নভেম্বর মাসে। ইংরেজিতে লেখা সেই ম্যানিফেস্টো জানায়, কবিতা সভ্যতাকে এগিয়ে নিয়ে যায় না, বিভ্রমের বাগানে পুনরায় বৃক্ষরোপণ করে না। ‘Poetry is no more a civilizing manoeuvre, a replanting of bamboozled gardens.’ বিশ্বায়নের ঢের আগে ইংরেজি ভাষাতেই প্রথম ম্যানিফেস্টো লিখেছিলেন হাংরি কবিরা। কারণ, পটনার বাসিন্দা মলয় রায়চৌধুরী ম্যানিফেস্টোটি লিখেছিলেন। পটনায় বাংলা ছাপাখানা ছিল না, ফলে ইংরেজি।


দুটি ম্যানিফেস্টোতেই শেষ হল না ইতিহাস। হাংরি আসলে সেই আন্দোলন, যার কোনও কেন্দ্র নেই। ফলে শহরে, মফস্সলে যে কোনও কবিই বের করতে পারেন তাঁর বুলেটিন। ১৯৬৮ সালে শৈলেশ্বর ঘোষ তাঁর ‘মুক্ত কবিতার ইসতাহার’-এ ছাপিয়ে দিলেন ‘সমস্ত ভন্ডামির চেহারা মেলে ধরা’, ‘শিল্প নামক তথাকথিত ভূষিমালে বিশ্বাস না করা’, ‘প্রতিষ্ঠানকে ঘৃণা করা’, ‘সভ্যতার নোনা পলেস্তারা মুখ থেকে তুলে ফেলা’ ইত্যাদি ২৮টি প্রতিজ্ঞা। পরে বন্ধুদের মধ্যে ঝগড়া বাধবে। মলয় ব্যাংকের চাকরি নিয়ে বাইরে চলে যাবেন। শৈলেশ্বর, সুবো আচার্য এবং প্রদীপ চৌধুরীরা বলবেন, ‘মলয় বুর্জোয়া সুখ ও সিকিয়োরিটির লোভে আন্দোলন ছেড়ে চলে গিয়েছে।’কী রকম লিখতেন হাংরিরা? বছর দুয়েক আগে সৃজিত মুখোপাধ্যায়ের ‘বাইশে শ্রাবণ’ ছবিতে গৌতম ঘোষের চরিত্রটি লেখা হয়েছিল হাংরি কবিদের আদলে।


‘জেগে ওঠে পুরুষাঙ্গ নেশার জন্য হাড় মাস রক্ত ঘিলু শুরু করে কান্নাকাটি


মনের বৃন্দাবনে পাড়াতুতো দিদি বোন বউদিদের সঙ্গে শুরু হয় পরকীয়া প্রেম’,


লিখেছিলেন অকালপ্রয়াত ফালগুনী রায়। র‌্যাঁবো, উইলিয়াম বারোজ এবং হেনরি মিলারের উদাহরণ বারে বারেই টেনেছেন হাংরিরা। ঘটনা, এঁরা যত না ভাল কবিতা লিখেছেন, তার চেয়েও বেশি ঝগড়া করেছেন। এবং তার চেয়েও বেশি বার গাঁজা, এলএসডি, মেস্কালিন আর অ্যাম্ফিটোমাইন ট্রিপে গিয়েছেন।


অতএব, সাররিয়ালিজ্ম বা অন্য শিল্প আন্দোলনের মতো বাঙালি কবিদের ম্যানিফেস্টোটি কোনও দিন গুরুত্বপূর্ণ হয়নি। কিন্তু ‘হাংরি’রা আজও মিথ। এক সময় ‘মুখোশ খুলে ফেলুন’ বলে তৎকালীন মন্ত্রী, আমলা, সম্পাদকদের বাড়িতে ডাকযোগে তাঁরা মুখোশ পাঠিয়ে দিয়েছেন। আবার এক সময় ‘প্রচন্ড বৈদ্যুতিক ছুতার’ কবিতাটি লেখার জন্য অশ্লীলতার মামলা হল মলয় রায়চৌধুরীর বিরুদ্ধে। উৎপলকুমার বসু, সুবিমল বসাকের বিরুদ্ধে জারি হল গ্রেফতারি পরোয়ানা।


রাষ্ট্র ও আদালত কী ভাবে কবিতাকে দেখে, সেই প্রতর্কে ঢুকতে হলে ১৯৬৫ সালে মলয় রায়চৌধুরীর বিরুদ্ধে মামলাটি সম্পর্কে জানা জরুরি। শক্তি চট্টোপাধ্যায় কাঠগড়ায় উঠেছেন মলয়ের বিরুদ্ধে সাক্ষ্য দিতে। পাবলিক প্রসিকিউটরের জিজ্ঞাসা, ‘প্রচন্ড বৈদ্যুতিক ছুতার’ কবিতাটা পড়ে আপনার কী মনে হয়েছে?


শক্তি: ভাল লাগেনি।


প্রসিকিউটর: অবসিন কি? ভাল লাগেনি বলতে আপনি কী বোঝাতে চাইছেন?


শক্তি: ভাল লাগেনি মানে জাস্ট ভাল লাগেনি। কোনও কবিতা পড়তে ভাল লাগে, আবার কোনওটা ভাল লাগে না।


শক্তি সাক্ষ্য দিয়েছিলেন মলয়ের বিরুদ্ধে। কয়েক মাস পরে সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় মলয়ের সমর্থনে...


প্রসিকিউটর: কবিতাটা কি অশ্লীল মনে হচ্ছে?


সুনীল: কই, না তো। আমার তো বেশ ভাল লাগছে। বেশ ভাল লিখেছে।


প্রসিকিউটর: আপনার শরীরে বা মনে খারাপ কিছু ঘটছে?


সুনীল: না, তা কেন হবে? কবিতা পড়লে সে সব কিছু হয় না।


একই মামলায় শক্তি ও সুনীল পরস্পরের বিরুদ্ধে। তার চেয়েও বড় কথা, ’৬৫ সালে এই সাক্ষ্য দেওয়ার আগের বছরই সুনীল আইওয়া থেকে মলয়কে বেশ কড়া একটি চিঠি দিয়েছিলেন, ‘লেখার বদলে আন্দোলন ও হাঙ্গামা করার দিকেই তোমার ঝোঁক বেশি। রাত্রে তোমার ঘুম হয় তো? মনে হয়, খুব একটা শর্টকাট খ্যাতি পাবার লোভ তোমার।’ ব্যক্তিগত চিঠিতে অনুজপ্রতিম মলয়কে ধমকাচ্ছেন, কিন্তু আদালতে তাঁর পাশে গিয়েই দাঁড়াচ্ছেন। সম্ভবত, বন্ধু-শত্রু নির্বিশেষে অনুজ কবিদের কাছে সুনীলের ‘সুনীলদা’ হয়ে ওঠা হাংরি মামলা থেকেই। প্রবাদপ্রতিম কৃত্তিবাসী বন্ধুত্বের নীচে যে কত চোরাবালি ছিল, তা বোঝা যায় উৎপলকুমার বসুকে লেখা সন্দীপন চট্টোপাধ্যায়ের একটি চিঠি থেকে, ‘প্রিয় উৎপল, একদিন আসুন।...আপনি তো আর শক্তির মতো ধান্দায় ঘোরেন না।’


তা হলে কি হাংরি আন্দোলন বাংলা সাহিত্যে প্রভাবহীন, শুধুই কেচ্ছাদার জমজমাট এক পাদটীকা? দুটি কথা। হাংরিদের প্রভাবেই কবিতা-সংক্রান্ত লিট্ল ম্যাগগুলির ‘কৃত্তিবাস’, ‘শতভিষা’ গোছের নাম বদলে যায়। আসে ‘ক্ষুধার্ত’, ‘জেব্রা’, ‘ফুঃ’-এর মতো কাগজ। সেখানে কবিতায় বাঁকাচোরা ইটালিক্স, মোটাদাগের বোল্ড ইত্যাদি হরেক রকমের টাইপোগ্রাফি ব্যবহৃত হত। পরবর্তী কালে সুবিমল মিশ্রের মতো অনেকেই নিজেকে হাংরি বলবেন না, বলবেন ‘শুধুই ছোট কাগজের লেখক’। কিন্তু তাঁদের গল্প, উপন্যাসেও আসবে সেই টাইপোগ্রাফিক বিভিন্নতা। তৈরি হবে শ্রুতি ও শাস্ত্রবিরোধী আন্দোলন। হাংরিরা না এলে কি নব্বইয়ের দশকেও হানা দিতেন পুরন্দর ভাট?


আসলে, ম্যানিফেস্টোর মধ্যেই ছিল মৃত্যুঘণ্টা। ’৬২ সালে হাংরিদের প্রথম বাংলা ম্যানিফেস্টোর শেষ লাইন, ‘কবিতা সতীর মতো চরিত্রহীনা, প্রিয়তমার মতো যোনিহীনা ও ঈশ্বরীর মতো অনুষ্মেষিণী।’ হাংরিরা নিজেদের যত না সাহিত্যবিপ্লবী মনে করেছেন, তার চেয়েও বেশি যৌনবিপ্লবী।”


চার


গৌতম চক্রবর্তী বহু বিদেশি নাম বাদ দিয়ে দিয়েছেন ; সম্ভবত তিনিও লেখার আগেই হাংরি আন্দোলনকারীদের ব্যঙ্গ করবেন বলে ঠিক করে ফেলেছিলেন । হাংরি আন্দোলনকারীরা জানতো যে ব্রিটিশ ঔপন্যাসিক চার্লস ডিকেন্স তিনি মর্গে যেতে ভালোবাসতেন; সেখানে দিনের একটা সময় কাটাতেন।  মর্গে যাওয়া ছাড়াও চার্লস ডিকেন্সের ছিল আফিমে আসক্তি, শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের মতন।  আর্নেস্ট হেমিংওয়ের ছিল মদের প্রতি আসক্তি, কমলকুমার মজুমদারের মতন। মদের ভালোবাসা থেকে তিনি লিখেছেন- যখন আপনি মাতাল, তখন আপনি অনেক বেশি ভদ্র । এটা আপনার মুখ বন্ধ রাখতে সাহায্য করবে। আমেরিকান রোমান্টিক মুভমেন্টের প্রধান ব্যক্তি, অ্যাডগার অ্যালান পো ছিলেন মাদকাসক্ত। হেমিংওয়ের মতো তিনিও দুঃখ-কাতরতা থেকে মুক্ত থাকার জন্য মদ পান শুরু করেন।  ব্রিটিশ কবি, রোমান্টিক মুভমেন্টের অন্যতম প্রবক্তা, কুবলা খান ও দ্য রাইম অব দ্য এনসিয়েন্ট মেরিনার এর কবি স্যমুয়েল টেইলর কোলরিজে  আফিমে আসক্ত ছিলেন। সেই সময় তিনি আফিমখোর হিসেবে ব্রিটেনে পরিচিত ছিলেন এবং এটা নিয়ে তিনি গর্বও বোধ করতেন। তিনি বলেছেন, কুবলা খান লিখতে গিয়ে আফিমের ঘোর তাঁকে সাহায্য করেছিল। ট্রেজার আইল্যান্ড, দ্য স্ট্রেঞ্জ কেস অব ডা. জ্যাকেল অ্যান্ড মি. হাইড-এর স্রষ্টা  স্কটিশ সাহিত্যিক রবার্ট লুইস স্টিভেনসন ছিলেন কোকেনে আসক্ত। তার স্ত্রীর ভাষ্যমতে, তিনি কোকেন নিয়ে করে মাত্র ছয় দিনে  ঘোরগ্রস্ত অবস্থায় ৬০ হাজার শব্দ লিখেছিলেন। এর মধ্যে দ্য স্ট্রেঞ্জ কেস অব ডা. জ্যাকেল অ্যান্ড মি. হাইডও লিখেছেন।


.



    



                                


                                                        


        


                                    


                                                


            


            


    


    


    


        


            


        


            


    



তিন


১৯১৭ সালে গিয়ম অ্যাপলিনেয়ার “সুররিয়ালিজম” অভিধাটি তৈরি করেছিলেন, যার অর্থ ছিল বাস্তবের অতীত। শব্দটি প্রায় লুফে নেন আঁদ্রে ব্রেতঁ, নতুন একটি আন্দোলন আরম্ভ করার পরিকল্পনা নিয়ে, যে আন্দোলনটি হবে পূর্ববর্তী ডাডাবাদী আন্দোলন থেকে ভিন্ন । ত্রিস্তঁ জারা উদ্ভাবিত ডাডা আন্দোলন থেকে সরে আসার কারণ হল ব্রেতঁ সহ্য করতে পারতেন না ত্রিস্তঁ জারাকে, কেননা কবি-শিল্পী মহলে প্রতিশীল্পের জনক হিসাবে ত্রিস্তঁ জারা খ্যাতি পাচ্ছিলেন। আঁদ্রে ব্রেতঁ সুররিয়ালিজম তত্বটির একমাত্র ব্যাখ্যাকারী হিসাবে নিজেকে প্রতিষ্ঠা করতে আরম্ভ করেন। ১৯১৯ সালে ত্রিস্তঁ জারাকে কিন্তু ব্রেতঁ চিঠি লিখে প্যারিসে আসতে বলেছিলেন । একইভাবে ‘হাংরি’ শব্দটি মলয় রায়চৌধুরী পেয়েছিলেন কবি জিওফ্রে চসার থেকে । এই ‘হাংরি’ শব্দটি নেয়ার জন্য মলয় রায়চৌধুরীকে যেভাবে আক্রমণ করা হয়েছে, তেমন কিছুই করা হয়নি আঁদ্রে ব্রেতঁ ও ত্রিস্তঁ জারা সম্পর্কে । মলয় রায়চৌধুরী হাংরি জেনারেশন আন্দোলন ঘোষণা করেন ১৯৬৫ সালের পয়লা নভেম্বর একটি লিফলেট প্রকাশের মাধ্যমে ।


পরাবাস্তববাদী আন্দোলনে, প্রথম থেকেই, আঁদ্রে ব্রেতঁ’র সঙ্গে অনেক পরাবাস্তববাদীর সদ্ভাব ছিল না, কিন্তু পরাবাস্তববাদ বিশ্লেষণের সময়ে আলোচকরা তাকে বিশেষ গুরুত্ব দেন না । আমরা যদি বাঙালি আলোচকদের কথা চিন্তা করি, তাহলে দেখব যে তাঁরা হাংরি জেনারেশন বা ক্ষুধার্ত আন্দোলন বিশ্লেষণ করার সময়ে হাংরি জেনারেশনের সদস্যদের পারস্পরিক সম্পর্ক নিয়ে অত্যধিক চিন্তিত, হাংরি আন্দোলনকারীদের সাহিত্য অবদান নিয়ে নয় । ব্যাপারটা বিস্ময়কর নয় । তার কারণ অধিকাংশ আলোচক হাংরি জেনারেশনের সদস্যদের বইপত্র সহজে সংগ্রহ করতে পারেন না এবং দ্বিতীয়ত সাংবাদিক-আলোচকদের কুৎসাবিলাসী প্রবণতা । 


আঁদ্রে ব্রেতঁ তাঁর বন্ধু পল এলুয়ার, বেনিয়ামিন পেরে, মান রে, জাক বারোঁ, রেনে ক্রেভালl, রোবের দেসনস, গিয়র্গে লিমবোর, রোজের ভিত্রাক, জোসেফ দেলতিল, লুই আরাগঁ ও ফিলিপে সুপোকে নিয়ে ১৯১৯ পরাবাস্তববাদ আন্দোলন আরম্ভ করেছিলেন । কিছু


দুই


যাঁরা কবি ও লেখকদের পারস্পরিক অবনিবনাকে গুরুত্ব দিয়েছেন, তাঁরা লেখক-প্রতিস্ব নির্মাণের ব্যাপারটা ভেবে দ্যাখেননি, বিশেষ করে সমাজটির আর্থসামাজিক পৃষ্ঠপটে ও পূর্বের সাহিত্যিক পঠন-পাঠনের প্রভাবে নির্মিত প্রতিস্ব ।


প্রথম ঔপন্যাসিক বঙ্কিমচন্দ্র ও প্রথম ছোটোগল্পকার পূর্নচন্দ্র থেকে হাল আমলের মফসসলের কথাসাহিত্যিক, প্রান্তিক ও শহুরে গল্পকার কিংবা মেট্রপলিটান ঔপন্যাসিক, তাঁদের লেখক প্রতিস্ব অবিনির্মাণ করলে প্রথম যে উপাদানটি পাওয়া যাবে, তা তাঁদের মাতৃভাষায় এবং অন্যান্য যে ভাষায় তাঁদের দখল আছে, সে ভাষায় পূর্ব প্রজন্মগুলোর সাহত্যিকদের লেখা গল্প-উপন্যাসের পঠন-পাঠনের জমা করা স্মৃতি । ব্যক্তিপ্রতিস্ব নির্মাণে ভাষার অবদান অনস্বীকার্য, কিন্তু লেখক-প্রতিস্ব নির্মাণে ভাষাসাহিত্যের জ্ঞান তথা সাহিত্যের বিশেষ ঝোঁকের প্রতি লেখকের টান, তাঁর লেখনকর্মের আদল আদরা দিশা তাৎপর্য অন্তর্নিহিত-সম্পদ দাপট চৈতন্য অস্তিত্ব আত্ম-উন্মোচন এমনকী তাঁর সাহিত্য চক্রান্তক কলমটির গঠনকারী মূল উপাদান । তাঁদের লেখন-অভিজ্ঞতার মালিকানার বখরা কিন্তু তাঁদের পড়া পূর্বসূরী গল্পকার-ঔপন্যাসিক-দার্শনিকদের প্রাপ্য।


আমি যে প্রতিস্ব-নির্মাণের কথা বলছি তা বাংলা সাহিত্যের এক বিশেষ বাঁকবদলের সময়কার । উল্লেখ্য যে ভারতবর্ষে পঞ্চতন্ত্র, হিতোপদেশ, বেতাল পঞ্চবিংশতি, কথাসরিৎসাগর, বৃহৎকথা, কথামঞ্জরী, দশকুমার চরিত, বাদবদত্তা ইত্যাদি গদ্যে রচিত কথাবস্তুর অতিপ্রাচীন ঐতিহ্য আছে । ইংরেজরা আসার পর, এবং ফলে, বাংলা গদ্যসাহিত্য ও গদ্যে নানা ধরণের সংরূপের উদ্ভব জলবিভাজকের কাজ করেছিল ; আমি সেদিকেই দৃষ্টি আকর্ষণ করতে চাইছি । এক নতুন নন্দনক্ষেত্র তৈরি হয়েছিল সাহিত্যের এলাকায়, যে এলাকায় লেখক নামের নির্মিত-প্রতিস্বের মানুষটির লেখনকর্মকে কৌমনিরপেক্ষ ব্যক্তিলক্ষণ হিসেবে নৈতিকতা আর বৈধতা আরোপের স্বীকৃতি দেয়া হয়েছিল । ফলে লেখনকর্ম বা পাঠবস্তুতে সতত কেন্দ্র দখল করে থাকলেন লেখ-সৃষ্টিকারী ব্যক্তিমালিকটি ।


ইংরেজরা আসার পরই, আর বাংলা কথাসাহিত্যের শুরুতেই যে লেখকরা নির্মিত-প্রতিস্ব নিয়ে লেখন-পরিসরে নেমেছিলেন, তা কিন্তু নয়। লেখন পরিসরে ব্যক্তিনামের লালন, ব্যক্তি-আধিপত্যের ছাপ, ব্যক্তিপ্রসূত রচনাগত মৌলিকতা, ব্যক্তিসৃজনশীলতা ইত্যাদি প্রতর্কগুলো হিন্দু বাঙালির জীবনে প্রবেশ করতে পেরেছিল  সেই সময়কার কলকাতায় ইউরোপীয় আলোকপ্রাপ্তির মননবিশ্বটি পাকাপাকি ভাবে থিতু হয়ে বসার পর । ১৮১৭ সালে হিন্দু কলেজের প্রতিষ্ঠা, ১৮৩৫ থেকে শিক্ষার বাহন হিসেবে ইংরেজি, তারপর ১৮৫৭ সালে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে শিক্ষিত বাঙালির সমাজে ওই মননবিশ্ব প্রবেশ করতে পেরেছিল। বাংলা ভাষার প্রথম উপন্যাস ‘দুর্গেশনন্দিনী’ প্রকাশিত হয় ১৮৬৫ সালে, লেখক হিসেবে বঙ্কিমচন্দ্রের মননবিশ্বটি ওই আদরায় নির্মিত হবার পর এবং ফলে, আর একই কারণে বঙ্কিমচন্দ্রের ভাই পূর্ণচন্দ্র দ্বারা রচিত হলো, ১৮৭৩ সালে, প্রথম বাংলা ছোটোগল্প ‘মধুমতী’ । তার আগে ভবানীচরণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের লেখা এবং ১৮৩১ সালে প্রকাশিত ‘নববাবুবিলাস’ আর ১৮৫৮ সালে প্রকাশিত প্যারীচাঁদ মিত্রের লেখা ‘আলালের ঘরের দুলাল’ পাঠবস্তুগুলোতে ওই মননবিশ্বের ছাপ ছিল না ।


পূর্ণচন্দ্র তাঁর গল্পটিতে নামস্বাক্ষর করেননি । ‘নববাবুবিলাস’ আর ‘আলালের ঘরের দুলাল’ ছদ্মনামে লেখা । নরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তী তাঁর ‘বাংলা ছোটোগল্প — সংক্ষিপ্ত সমালোচনা’ বইতে জানিয়েছেন যে ‘বঙ্গদর্শন’ পত্রিকার সময়কালে ( ১২৮০ থেকে ১৩০৬ বঙ্গাব্দ ) বিভিন্ন পত্রপত্রিকায় একশ ছাব্বিশটি ছোটোগল্প প্রকাশিত হয়েছিল যেগুলোয় লেখকরা নামস্বাক্ষর করেননি, এমনকী ছদ্মনামও নয় । রচনার সঙ্গে লেখকের নাম দেওয়ার প্রথাটি প্রবর্তন করেন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, ব্রাহ্মধর্মের প্রভাবশালী প্রতিনিধি । সেসময়ে ব্রা্‌হ্মধর্ম হয়ে উঠেছিল ওই মননবিশ্বের ধারক ও বাহক । নামস্বাক্ষর না-করার প্রক্রিয়াটি থেকে স্পষ্ট যে কথাবস্তুর রচয়িতারা জানতেন না যে লেখকসত্তা বলে কোনো ব্যাপার হয়, এবং লেখকের নামটি সত্তাটিকে বহন করে । কোনও কথাবস্তু যে মেধাস্বত্ত, সে ধারণাটির প্রতিষ্ঠা হতে সময় লেগেছিল । তার কারণ অস্তিত্বের কেন্দ্রে ব্যক্তিমানুষকে স্হাপনের কর্মকাণ্ডটির প্রভাব, যাকে উনিশ শতকের রেনেসঁস বলা হয়, সেই চিন্তাচেতনাকে ছড়িয়ে দেবার জন্য অজস্র নির্মিত-প্রতিস্বের প্রয়োজন ছিল । ইউরোপীয় চিন্তনতন্ত্রটির বাইরে যে নন্দনক্ষেত্রটি রয়ে গেল, জলবিভাজিকার অন্য দিকে, তাকে বটতলা নামে এইজন্য দোষারোপ করা হল যে সেই এলাকায় ব্যক্তিএককগুলো অনির্মিত। জেমস লঙ বললেন বটতলার বইগুলো অশ্লীল ও অশোভন, যার দরুন বাংলার সংস্কৃতি থেকে লোপাট হয়ে গেল বইগুলো ।


ইউরোপ থেকে আনা সাহিত্য-সংরূপগুলোর সংজ্ঞার স্বামীত্ব, তাদের ব্যাখ্যা করার অধিকার, দেশীয়করণের বৈধতা, সেসব বিধিবিধান তত্বায়নের মালিকানা, কথাবস্তুটির উদ্দেশ্যমূলক স্বীকৃতি, চিন্তনতন্ত্রটির অন্তর্গত সংশ্লেষে স্বতঃঅনুমিত ছিল যে, অনির্মিত লেখকপ্রতিস্বের পক্ষে তা অসম্ভব, নিষিদ্ধ, অপ্রবেশ্য, অনধিকার চর্চা । ব্যাপারটা স্বাভাবিক, কেননা যাঁরা সংজ্ঞাগুলো সরবরাহ করছেন, তাঁরাই তো জানবেন যে সেসব সংজ্ঞার মধ্যে কী মালমশলা আছে, আর তলে-তলে কীইবা তাদের ধান্দা । ফলে, কোনও কথাবস্তু যে সংরূপহীন হতে পারে, লেখক-এককটি চিন্তনতন্ত্রে অনির্মিত হতে পারে, রচনাকার তাঁর পাঠবস্তুকে স্হানাংকমুক্ত সমাজপ্রক্রিয়া মনে করতে পারেন, বা নিজেকে বাংলা সাহিত্যের কালরেখার বাইরে মনে করতে পারেন, এই ধরণের ধারণাকে একেবারেই প্রশ্রয় দেয়নি ওই চিন্তনতন্ত্রটি । বর্তমান কালখণ্ডে, আমরা জানি, একজন লোক লেখেন তার কারণ তিনি ‘লেখক হতে চান’ । অথচ লেখক হতে চান না এরকম লোকও তো লেখালিখি করতে পারেন । তাঁরা সাহিত্যসেবক অর্থে লেখক নন, আবার সাহিত্যচর্চাকারী বিশেষ স্হানাংক নির্ণয়-প্রয়াসী না-লেখকও নন । তাঁদের মনে লেখক হওয়া-হওয়ি বলে কোনও সাহিত্য-প্রক্রিয়া থাকে না ।


...

Joydeb Biswas

Poet Joydeb Biswas studied Bengali literature. In 2015, at the age of 22, he published 'Sahitya Chetona' magazine. Currently two editions of the magazine are published. One is the online version and the other is the printed version. He is the founder and editor of the two editions. facebook twitter youtube instagram whatsapp

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

নবীনতর পূর্বতন