1 / 7
2 / 7
3 / 7
4 / 7
5 / 7
6 / 7
7 / 7

অতিথি' :: রবীন্দ্রনাথের জীবন-দর্শনের সুন্দর প্রকাশ— লিখেছেন সুমন ব্যানার্জী

'অতিথি' :: রবীন্দ্রনাথের জীবন-দর্শনের সুন্দর প্রকাশ— লিখেছেন সুমন ব্যানার্জী

ছবি ঋণ : ইন্টারনেট


     পৃথিবীর অন্যতম শ্রেষ্ঠ কথাকোবিদ ও ছোটগল্পকার হিসাবে রবীন্দ্রনাথের লেখা যে গল্পগুলি রবীন্দ্রনাথেরই সুগভীর ও সমুন্নত জীবন-দর্শনেরই বার্তাবহ বা প্রমূর্তরূপ হয়ে ওঠে তার মধ্যে 'অতিথি' গল্পটি অন্যতম। এই গল্পের কেন্দ্রীয় চরিত্র তারাপদ নামক একজন কিশোর। যে কোথাও স্থির থাকল না, নিরুদ্দেশের পথে পাড়ি জমাল। কারণ সে উপভোগ করতে চায় প্রবহমান জীবনের সৌন্দর্যকে।

      কিশোর তারাপদর সঙ্গে কাঁঠালিয়া গ্রামের জমিদার মতিলাল বাবুর সাক্ষাৎ ও পরিচয় হয়। তখন তিনি নৌকায় করে যাচ্ছিলেন নিজের গ্রামের উদ্দেশে। লক্ষনীয় যে এখানে নৌকার ইমেজটি। রবীন্দ্রনাথের গান ও কবিতার অন্তর্দৃষ্টি-সম্পন্ন মনস্ক পাঠকরা জানেন যে কবি নৌকার ইমেজকে বারবার ব্যবহার করেছেন। এখানে নৌকা যেন চলমান অনন্ত যাত্রার প্রতীক। পনেরো-ষোল বছরের ব্রাহ্মণ কিশোর তারাপদর অমায়িক ব্যবহার, নিষ্কলুষ সারল্য মুগ্ধ করেছিল জমিদার বাবু ও তাঁর স্ত্রী অন্নপূর্ণাকে। প্রায় পুত্রসম স্নেহ দিয়ে অপুত্রক দম্পতি কাছে টেনে নেয় তাকে। তারাপদ অনুরোধ করেছিল নন্দীগ্রামে নামিয়ে দেবার জন্য সেখানে এক যাত্রা দলের গায়ক হিসাবে সে যুক্ত হবে। কিন্তু হঠাৎ তারাপদকে পেয়ে তার প্রতি দম্পতির স্নেহ, ভালোবাসা এবং তারাপদও এক অদ্ভুত টান অনুভব করল তাঁদের প্রতি---- ফলে ভুলেই গেল কখন নন্দীগ্রাম পেরিয়ে গেছে। বাড়ি থেকে পালিয়ে কখন জিমন্যাস্টিক দল, কখন যাত্রাদলের সঙ্গে কাজ করত তারাপদ। সে চমৎকার বাঁশি বাজাত ও গান গাইত। তারাপদকে জমিদার বাবু বাড়িতে রেখেই পুত্র স্নেহে প্রতিপালন করতে লাগল।

   

       জমিদার বাবুর মেয়ে চারুশশী প্রথমে অত্যন্ত বিদ্বেষ-পরায়ণ ছিল তারাপদর প্রতি। তারাপদকে সে নানাভাবে উত্যক্ত করত। কিন্তু চারুর প্রতি তারাপদর আচরণে কোন অশিষ্টতা ছিল না। চারুশশীর বন্ধু সোনামণির সঙ্গে গভীর বন্ধুত্ব গড়ে ওঠে তারাপদর। আবার এই কারণেই দুই সখীর বন্ধুত্বে ছেদ পড়ে। তখন ধীরে ধীরে চারুর মধ্যে এক আশ্চর্য ভাবান্তর ঘটতে শুরু করে। সে নিজের ভুল বুঝতে পারছিল এবং মনে মনে অনুশোচনায় দগ্ধ হচ্ছিল। এইভাবেই দেখতে দেখতে দু'বছর কেটে গেল। চারুর বিয়ে দেবার জন্য অন্নপূর্ণা সৎ পাত্র হিসাবে তারাপদকেই নির্বাচন করল এবং এতে মতিলাল বাবুরও পূর্ণ সম্মতি ছিল। শুধু কুল-গোত্র যাচাই করার জন্য তারাপদর গ্রামে তার মা'র কাছে খবর পাঠানো হল। বিবাহের আয়োজনে আনন্দিত হয়ে তারাপদর মা ও ভাই সবাই এল। কিন্তু থাকল না শুধু তারাপদ: সে নিরুদ্দেশ হয়ে গেল। এখানেই গল্পের আসল মোড়।


      সেদিন ছিল রথের দিন। এই রথযাত্রার অন্তঃস্থ মূল ব্যঞ্জনা বা দার্শনিক তাৎপর্যটিকে রবীন্দ্রনাথ ব্যক্ত করেছেন এই গল্পের অন্তিমে। রথযাত্রা যেন কালেরই অবিরাম যাত্রা। কোন কিছুতে আটকে থাকা তার স্বভাব নয়। গল্পকার লিখছেন যে---


"সম্মুখে আজ যেন সমস্ত জগতের রথযাত্রা -- চাকা ঘুরিতেছে, ধ্বজা উড়িতেছে, পৃথিবী কাঁপিতেছে; মেঘ উড়িয়াছে, বাতাস ছুটিয়াছে, নদী বহিয়াছে, নৌকা চলিয়াছে, গান উঠিয়াছে; দেখিতে দেখিতে গুরু গুরু শব্দে মেঘ ডাকিয়া উঠিল, বিদ্যুৎ আকাশকে কাটিয়া কাটিয়া ঝলসিয়া উঠিল, সুদুর অন্ধকার হইতে একটা মুষলধারাবর্ষী বৃষ্টির গন্ধ আসিতে লাগিল। কেবল নদীর এক তীরে এক পার্শ্বে কাঁঠালিয়া গ্রাম আপন কুটিরদ্বার বন্ধ করিয়া দীপ নিবাইয়া দিয়া নিঃশব্দে ঘুমাইতে লাগিল।''


     পরদিন কলকাতা থেকে বড় তিনটি নৌকায় করে নানাবিধ সামগ্রী এল, প্রিয় বন্ধু সোনামণি আমসত্ত্ব আর আচার নিয়ে এল। কিন্তু থাকল না শুধু তারাপদ---


"স্নেহ-প্রেম-বন্ধুত্বের ষড়যন্ত্রবন্ধন তাহাকে চারি দিক হইতে সম্পূর্ণরূপে ঘিরিবার পূর্বেই সমস্ত গ্রামের হৃদয়খানি চুরি করিয়া একদা বর্ষার মেঘান্ধকার রাত্রে এই ব্রাহ্মণবালক আসক্তিবিহীন উদাসীন জননী বিশ্বপৃথিবীর নিকট চলিয়া গিয়াছে।"

    ঠিক এই প্রসঙ্গে আমরা রবীন্দ্রনাথের দু'টি বক্তব্যকে উদ্ধৃত করব---

ক) "আমি সত্য বুঝতে পারি নে আমার মনে সুখদুঃখ বিরহ-মিলনপূর্ণ ভালবাসা প্রবল, না সৌন্দর্যের নিরুদ্দেশ আকাঙ্ক্ষা প্রবল। আমার বোধ হয় সৌন্দর্যের আকাঙ্ক্ষা আধ্যাত্মিক জাতীয়, উদাসীন গৃহত্যাগী; নিরাকারের অভিমুখী। আর ভালবাসাটা লৌকিক জাতীয় সাকারে জড়িত। একটা হচ্চে শেলির Skylark আর একটা হচ্চে ওয়ার্ডস্বার্থের Skylark। একজন অনন্ত সুধা প্রার্থনা করচে, আর একজন অনন্ত সুধা দান করচে। সুতরাং স্বভাবতই একজন সম্পূর্ণতার আর একজন অসম্পূর্ণতার অভিমুখী। যে ভালবাসে সে অভাব-দুঃখ-পীড়িত অসম্পূর্ণ মানুষকে ভালবাসে, সুতরাং তার অগাধ ক্ষমা সহিষ্ণুতা প্রেমের আবশ্যক--- আর যে সৌন্দর্যব্যাকুল, সে পরিপূর্ণতার প্রয়াসী, তার অনন্ত তৃষ্ণা। মানুষের মধ্যে দুই অংশই আছে, অপূর্ণ এবং পূর্ণ--- যে যেটা অধিক ক'রে অনুভব করে।''


খ) "আমাদের প্রকৃতির মধ্যে একটি বন্ধন-অসহিষ্ণু স্বেচ্ছাবিহার-প্রিয় পুরুষ এবং গৃহবাসিনী অবরুদ্ধ দৃঢ় অবিচ্ছেদ্য বন্ধনে আবদ্ধ হইয়া আছে। একজন জগতের সমস্ত নূতন নূতন দেশ, ঘটনা এবং অবস্থার মধ্যে নব নব রসাস্বাদ করিয়া আপন অমর শক্তিকে বিচিত্র ভাবে পরিপুষ্ট করিয়া তুলিবার জন্য সর্বদা ব্যাকুল, আর একজন শতসহস্র অভ্যাসে বন্ধনে প্রথার প্রচ্ছন্ন এবং পরিবেষ্টিত। একজন বাহিরের দিকে লইয়া যায়, আর একজন গৃহের দিকে টানে। একজন বনের পাখি, আর একজন খাঁচার পাখি।"


     যিনি স্রষ্টা, সৌন্দর্য সৃষ্টির আকাঙ্ক্ষাকে যিনি লালন করেন তিনি চান বিশ্ব প্রকৃতির অশেষ রূপ-রস-গন্ধ ও স্পর্শকে কানায় কানায় উপভোগ করতে। কোথাও স্থবির হয়ে থাকা তাঁর স্বভাব নয়। রস-সৃষ্টির মধ্যে দিয়ে আনন্দ দানই যাঁর মুখ্য উদ্দেশ্য কোন সমাজ ও সংসারের আরোপিত অনুশাসন তাঁর কাছে অস্বস্তির ও দমবন্ধকর মনে হয়। তারাপদ যেন রবীন্দ্রনাথেরই বিকল্প সত্তা/ অল্টার ইগো। সেও নিরুদ্দেশ হয়ে গেল সমস্ত বন্ধনকে ত্যাগ করে 'আসক্তিবিহীন উদাসীন জননী বিশ্বপ্রকৃতির' কাছে। শিল্পীও তো তাই।কিছুটা 'উদাসীন জাতীয়', 'আধ্যাত্মিক গৃহত্যাগী' কারণ তাঁর সৌন্দর্য-ব্যাকুল মন খোঁজে শুধু পরিপূর্ণতাকে, তাঁর 'অনন্ত তৃষ্ণা'। কবি তাই চমৎকারভাবে 'খাঁচার পাখি' ও 'বনের পাখি'-র ইমেজগুলি তৈরি করেছেন। প্রসঙ্গত কবির সেই বিখ্যাত গানটি মনে পড়ে -- "আমি চঞ্চল হে, / আমি সুদূরের পিয়াসি।" ।।



তথ্যসূত্র :
১. www.tagoreweb.in (short story, 46)

২. সনেটের আলোকে রবীন্দ্রনাথ ও মধুসূদন, জগদীশ ভট্টাচার্য, ভারবি প্রকাশনী, সংস্করণ- দ্বিতীয়, ডিসেম্বর, ১৯৯৬, পৃষ্ঠা- ১৩৪-১৩৫।

৩. গীতবিতান, প্রকাশনী-- সাহিত্যেম্, সংস্করণ- প্রথম, ১৪০৯, পৃষ্ঠা-- ৪৮২।





 

Joydeb Biswas

Poet Joydeb Biswas studied Bengali literature. In 2015, at the age of 22, he published 'Sahitya Chetona' magazine. Currently two editions of the magazine are published. One is the online version and the other is the printed version. He is the founder and editor of the two editions. facebook twitter youtube instagram whatsapp

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

নবীনতর পূর্বতন