সমর সেন-এর কবিতা : কয়েকটি কথা
• সুমন ব্যানার্জী
সহজ জীবনের পর মৃত্যু --- / সে তো বটের উপরে চাঁদের আলো, / কিম্বা শূন্য পাহাড়ে কুয়াশা।/ ও ধ্রুপদী শান্তি আমাদের নয়; / অনিদ্রা থেকে দুঃস্বপ্নে আমাদের যাত্রায়...।(জন্মদিনে)
১
সমর সেন'র কবিতা নিয়ে এযাবৎ প্রচুর চর্চা হয়েছে। তাকে বরাবরই 'নাগরিক কবি' এই তকমায় বিশেষত, বা ইংরেজিতে যাকে বলে কম্পার্টমেন্টালাইজড্ করা হয়েছে। বস্তুত যে- কোন বিশেষণের মধ্যেই এক রকমের অতিশয়োক্তি থাকে : এক্ষেত্রেও তাই আছে।
সমর সেন যে-সময় কবিতা লিখছেন সেই সময়কালটিকে একটু তলিয়ে ভাবা দরকার। মোটামুটিভাবে তিরিশের দশকের প্রারম্ভিক কাল থেকে চল্লিশের দশকের শেষ
-- এই হল তার সৃজনশীল সাহিত্যের অর্থাৎ কবিতার জগতে বিচরণের সময়। দুই মহাযুদ্ধের মাঝামাঝি এই কালখণ্ডটি ছিল এক রকম ক্রান্তিকালের মত। এই সময় গোটা বিশ্বের আর্থ-সামাজিক রাজনৈতিক পট পরিবর্তন ঘটছে দ্রুত লয়ে ( এবং যার অনিবার্য অভিঘাত এসে পড়ে সাংস্কৃতিক জগতেও ) যা যুগান্তকারী এবং একই সঙ্গে যার প্রভাব সমকালীন প্রেক্ষিতেও বিদ্যমান।গোটা সময়কাল জুড়ে চলছে প্রবল রাজনৈতিক বিক্ষোভ ও যুদ্ধ। একদিকে গোটা বিশ্বে রাজনৈতিক শিবির ও নানাবিধ সমীকরণ তৈরি হচ্ছে তেমনি ভাবে দেশীয় রাজনীতিতেও তৈরি হচ্ছে গোষ্ঠী, প্রতিষ্ঠান ও দল। এদের প্রত্যেকেরই উদ্দেশ্য একচেটিয়া ক্ষমতা দখল। এবং প্রত্যেকেরই পশ্চাতে রয়েছে পুঁজির বিপুল সমর্থন। দ্ব্যর্থহীনভাবে বললে একদিকে পুঁজি ও অন্যদিকে ক্ষমতা -- এই দুইয়ের ভয়াল ও আধিপত্যকামী রূপ ফুটে উঠছে।
২
সমর সেন'র পতাকাস্থানীয় কবিতা 'নিঃশব্দতার ছন্দ'-তে রোম্যান্টিক মেদুরতার সঙ্গে মিশে যায় এক রকমের উদাস হাহাকার, ফুটে ওঠে এক রকমের অ্যাগোনি বা যন্ত্রণার স্বর --
" স্তব্ধরাত্রে কেন তুমি বাইরে যাও / আকাশে চাঁদ নেই, আকাশ অন্ধকার, / বিশাল অন্ধকার শুধু একটি তারা কাঁপে, / হাওয়ায় কাঁপে শুধু একটি তারা।''
চারিদিকে ঘনীভূত নিঃশব্দতার মধ্যেও , যেখানে সবাই যেন সবার থেকে দূরে, সেখানে এক রকমের সুষমা, ছন্দকে খুঁজে পান।সেটাই কবির কাছে তৈরি করে কবিতার পটভূমি।এই কবিতায় বিরহ আছে কিন্তু ব্যাকুলতা বা আকুলতা নেই, প্রতীক্ষা হয়তো আছে কিন্তু আশা বা উত্তেজনা ক্ষীণ হয়ে গেছে।
ঠিক তার পরের কবিতা 'একটি রাত্রির সুর'-তে পাই গন্ধ -স্নিগ্ধ হাওয়ার মধ্যেও এক রকমের হাহাকার, অস্ফুট -শীর্ণ এক আর্তনাদ ভেসে আসছে দূর থেকে ---
'' ধূসর সন্ধ্যায় বাইরে আসি। / বাতাসে ফুলের গন্ধ ; / বাতাসে ফুলের গন্ধ, / আর কিসের হাহাকার।''
কবি নিঃসঙ্গতাকে বিশেষিত করছেন 'সুকঠিন' বলে -- ''ঘনায়মান অন্ধকারে / করুণ আর্তনাদে আমাকে সহসা অতিক্রম করল / দীর্ঘ, দ্রুত যান --- / বিদ্যুতের মতো : / কঠিন আর ভারি চাকা, আর মুখর --- / অন্ধকারের মতো সুন্দর, / অন্ধকারের মতো ভারি।''
৩
আরও দু'টি কবিতার উল্লেখ আমরা করব --- 'নাগরিকা' ও 'মেঘদূত'।
নাগরিকায় যে মেয়েটির ছবি কবি অঙ্কিত করছেন তার ''চোখে নেই নীলার আভাস, নেই সমুদ্রের গভীরতা, / শুধু কিসের ক্ষুধার্ত দীপ্তি, কঠিন ইশারা, / কিসের হিংস্র হাহাকার সে চোখে।''
কবির এ যুগের মেঘদূত আর কালিদাসের মেঘদূত নয়।বিরহী যক্ষ আর মেঘকে বার্তাবহ করে প্রেরণ করে না চিরমিলনের জন্য যক্ষবধূর কাছে।এ যুগে মানুষ ক্লান্ত, বিধ্বস্ত, তার নিজেরই তৈরি করা চাকায় সে অহরহ আবর্তিত হচ্ছে, আশা-প্রত্যাশা-চাহিদা তাকে কুড়ে কুড়ে খাচ্ছে।একজন মেয়ে ছেলে ভুলানো ছড়ার গান গাইছে ক্লান্ত সুরে।সেই সুর যেন হাওয়ায় ভাসছে।কবি দেখছেন 'আগুন জ্বলছে অন্ধকার আকাশের বনে।' কবি মনশ্চক্ষে দেখছেন যে, বৃষ্টির পর শহর জুড়ে বন্যা হবে সবাই ভেসে যাবে সেই বন্যায়, দুর্ভিক্ষে মানুষ হাহাকার করবে আর তখন তোমার মনে জাগবে 'মিলনের বিলাস' --- '' ফিরে তুমি যাবে বিবাহিত প্রেমিকের কাছে। / হে ম্লান মেয়ে, প্রেমে কী আনন্দ পাও, / কী আনন্দ পাও সন্তানধারণে ?''
এক রকমের বক্রোক্তি করেছেন নারীর স্বাভাবিক ও সর্বোত্তম জৈবিক ক্ষমতা নিয়ে।একজন নারী যে সহানুভূতি, যে প্রেম আদায় করে নিতে পারে তা কি একজন পুরুষ পারে ? এই কবিতায় নারীর প্রতি বিদ্বেষ নেই, রয়েছে সিস্টেমের প্রতি : যেখানে নারী বা পুরুষ যে কেউ যে কারুর হাতে যন্ত্র হয়ে যেতে পারে।তাঁর নিজের আশা-আকাঙ্ক্ষা অতৃপ্ত থেকে যাবে উল্টে সমাজ তার মতো করে তাকে গড়েপিটে নেবে।কারণ, পুঁজিবাদী সমাজে সে একটি পণ্য।একজন প্রেমিক পুরুষের বুকের ভিতরে পুঞ্জীভূত চাপা কষ্ট আর হতাশার বহিঃপ্রকাশ।
বণিক সভ্যতার শূন্য মরুভূমিতে বাস করা একজন 'একটি বেকার প্রেমিক' কবিতায় একজন বেকার প্রেমিক চোরাবাজারে ঘুরে বেড়ায়, গণিকাদের কোলাহল থেকে খিদিরপুর ডকে রাত্রে জাহাজের শব্দ তার কানে আসে।অবসন্ন মনে সে বলে --- " হে প্রেমের দেবতা, ঘুম যে আসে না, সিগারেট টানি ; / আর শহরের রাস্তায় কখনো বা প্রাণপণে দেখি / ফিরিঙ্গি মেয়ের উদ্ধত নরম বুক। / আর মদির মধ্যরাত্রে মাঝে মাঝে বলি : / মৃত্যুহীন প্রেম থেকে মুক্তি দাও, / পৃথিবীতে নতুন পৃথিবী আনো / হানো ইস্পাতের মতো উদ্যত দিন।''
৪
টি.এস.এলিয়টের বিখ্যাত দ্য ওয়েস্ট ল্যান্ড কবিতার অনুসরণে তাঁর লেখা 'পোড়া মাটি'।এই কবিতায় শুধু নিরাশা নয়, এক সুদূর স্বপ্ন ও সম্ভাবনার রূপরেখা ---
"সত্তার খনিতে তবু আসন্ন ফসলের সোনা জ্বলে ; / সকালে আপন বলে / গভীর কুয়ো থেকে জল তুলে, মজুরানী চলে কলসী কাঁখে। / জানি জানি / আমার রক্তের ছন্দে আজো বাজে জাতির ধমনী, আমাকে ডাকে / অসংখ্য সহোদর সেখানে প্রাণ দেয় লাগে লাখে / ফসলহীন শকুনের মাঠে।''
কবির চোখে সময়ের বা যুগের যে দৃশ্যকল্প ভেসে উঠছে তা ঠিক স্বপ্নের মত সুন্দর, মায়াময় নয়।যা আপাতভাবে সুন্দর হলেও অনেক রুক্ষ ও যান্ত্রিক। মানুষের সঙ্গে মানুষের সহজ স্বাভাবিক সম্পর্কের ছবি বদলে যাচ্ছে ,চারিদিকে চলছে শুধু ক্ষমতার জন্য লড়াই ; কোথাও কোন তৃপ্তি নেই, শান্তি নেই, রয়েছে শুধুই দীর্ঘশ্বাস, হতাশা।প্রতি মুহূর্তে তৈরি হচ্ছে একটা নিঃসঙ্গতা বোধ।এই যন্ত্রমুখী নাগরিক জীবনের বেষ্টনী কাটিয়ে নির্ভেজাল আনন্দের জন্য ছুটে যেতে চাইছেন 'মহুয়ার দেশে' ---
"অনেক, অনেক দূরে আছে মেঘ-মদির মহুয়ার দেশ, / সমস্তক্ষণ সেখানে পথের দুধারে ছায়া ফেলে / দেবদারুর দীর্ঘ রহস্য, / আর দূর সমুদ্রের দীর্ঘশ্বাস / রাত্রের নির্জন নিঃসঙ্গতাকে আলোড়িত করে। / আমার ক্লান্তির উপরে ঝরুক মহুয়া-ফুল, / নামুক মহুয়ার গন্ধ।" ('মহুয়ার দেশ')
কবির দ্বিতীয় কাব্য গ্রহণে'ই কিন্তু তার দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তনের পরিচয় পাওয়া যায়। এখানে এসে তিনি প্রথম রক্তপতাকা'র সন্ধান পেয়েছে। এই নবজাত আশ্বাসেই তিনি উচ্চারণ করেন-
"তবু জানি, / জটিল অন্ধকার একদিন জীর্ণ হবে চূর্ণ হবে জন্ম হবে / আকাশগঙ্গা আবার পৃথিবীতে নামবে।”
তবু এ কথা অনস্বীকার্য যে, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের করাল ছায়া দেখে পৃথিবীর আসন্ন ভবিষ্যৎ কবিকে সংশয়ী করে তুলেছে। 'নানা কথায়' পর্বে কবি আশাবাদী, কারণ, সম্ভবত বিশ্বযুদ্ধে সােভিয়েত রাশিয়াও যুক্ত হবার ফলে কবি ভরসা করেছেন।কিছুটা রোম্যান্টিক ভাববাদী জীবনবোধ থেকে বেরিয়ে ১৯৪০'র পর থেকে গভীর ভাবে সমাজ ও রাজনৈতিকতা একথায় সমকালীন বাস্তবতা তাঁর কবিতায় ভীষণভাবে প্রোজ্জ্বল হয়ে উঠছে দু'টি কবিতার উল্লেখ আমরা করব ---
"মৃত্যু হয়তো মিতালি আনে : / ভবলীলা সাঙ্গ হলে সবাই সমান --- / বিহারের হিন্দু আর নোয়াখালির মুসলমান / নোয়াখালির হিন্দু আর বিহারের মুসলমান।'' (জন্মদিনে)
" কারখানায় কলে যারা দধীচির হাড়ে সভ্যতার বনিয়াদ গড়ে / শহরে শহরে।/ দেশে বিদেশে, বন্যার মুখে জাঙাল বেঁধে / তারা বলে, দুনিয়ার দুশমনের প্রতিরোধে / দুনিয়াকো কিষাণ মজদুর মজদুর কিষাণ এক হো।'' (খোলা চিঠি)
আসলে ফ্যাসিবাদ বিরোধী উদার মানবদর্শন, যা কমিউনিস্ট আন্দোলনের হাত ধরে গড়ে উঠেছিল তার প্রতি গভীরভাবে প্রণোদিত হয়েছেন কবি। তাঁর লেখায় উঠে আসছে শ্রমিক, কৃষক, ফসল আর সংগ্রামের কথা ---
"হঠাৎ সূর্য ওঠে, বলিষ্ঠ প্রহারে / কুয়াশার নদীর জল ঝলকায় --- শাণিত হাতিয়ার ! / মাঝে মাঝে বালুচর, কাদাখোঁচা জলে নামে, / ধানক্ষেতে কাস্তেহাতে কিষাণ, / হাতুড়ি বাজে কামারশালে, / সবুজ আগুন জ্বলে অনেক মাঠে।" (ইতিহাস)
পরবর্তী বৎসরই ৭টি মাত্র কবিতা নিয়ে প্রকাশিত হয় 'খােলাচিঠি'। সমকালের বিশ্ব ইতিহাসে যে ধ্বংসাত্মক অবস্থার সৃষ্টি হয়েছিল, তার প্রতিফলন ঘটে কাব্যের কবিতা কয়টিতে।
৫
বাংলা কবিতার প্রথাগত তিন রকম ছন্দের বাইরে বেরিয়ে মূলত গদ্য ছন্দেই সিংহভাগ কবিতা লিখেছেন সমর সেন।আসলে গদ্য ছন্দে লেখার পশ্চাতেও কাজ করেছে সমাজ মনস্তত্ত্ব।তিনি যে সময়ের প্রতিনিধিত্ব করছেন, সেই সময়টিকে ছন্দ, মিল, সুষমায় ধরা যাচ্ছে না। পেলব লাবণ্যময় গীতিকবিতা লেখার যুগ সেটা নয়। আরও স্পষ্ট করে বললে সেই সময়ের মানব মনস্তত্ত্ব, নাগরিক জীবনকে আর গীতিকবিতা বা ছন্দময় কবিতা দিয়ে প্রকাশ করা ও ধরা যাবে না।গদ্যের মতোই তা রুক্ষ।
কাজেই তাঁর কবিতা স্বচ্ছন্দে ও সাবলীল ছন্দে বয়ে যাবার পরিপূর্ণ অবকাশ লাভ করে গদ্যছন্দেই। এটি নিঃসন্দেহে বাংলা কবিতায় একটি নতুন পরিসর নির্মাণ করেছিল।
তথ্যসূত্র :: (আকর গ্রন্থ)
১. সমর সেনের কবিতা, সিগনেট প্রেস, প্রথম সংস্করণ - জুলাই, ২০১২, পৃষ্ঠা -- ১১, ১২, ১৫, ১৬, ২৮, ৪০, ১০১, ১০২, ১০৫,১৪১, ১৪২।