কোনি
—মতি নন্দী
১. বারুণী কী? বারুণির দিনে গঙ্গার ঘাটে কোন দৃশ্য দেখা গিয়েছিল ?
অথবা,
‘আজ বারুণী গঙ্গায় আজ কাঁচা আমের ছড়াছড়ি।”—বারুণী কি? গঙ্গায় কাঁচা আমের ছড়াছড়ি কেন? বারুণীর গঙ্গা তীরের বর্ণনা দাও।
বারুণী : বাংলা কথা সাহিত্যের অন্যতম জনপ্রিয় লেখক মতি নন্দীর কোনি উপন্যাসের প্রথম পরিচ্ছেদ থেকে আলােচ্য অংশটি নেওয়া হয়েছে। বারুণী হল। শতভিষা নক্ষত্রযুক্ত কৃষ্ণ চতুর্দশী তিথিতে পুণ্যস্নান দ্বারা পালনীর পর্ব বিশেষ। বর্তমানে এটি লৌকিক উৎসবের মর্যাদা পেয়েছে।
কাঁচা আমের ছড়াছড়ির কারণ : বারুণী উপলক্ষ্যে পুণ্য সঞ্চয়ের আশায় অনেকে গঙ্গা স্নান করতে আসে। গঙ্গা স্নানের সময় মানুষজন গঙ্গার ঘাটে আম দিয়ে স্নান করার ফলে সেখানে কাঁচা আমের ছড়াছড়ি হয়।
গঙ্গা তীরের বর্ণনা : বারুণী তিথিতে জল থেকে আম তুলে বাজারে কম দামে বিক্রির লােভে ছােটো ছােটো দলে ছেলেমেয়েরা ঘাটে ভিড় করে আছে। ছেলের দল কেউ গঙ্গার জলে দাঁড়িয়ে, কেউ বা জলে ভেসে রয়েছে একটু দূরে। একটা আম জলে পড়লেই তাদের মধ্যে হুড়ােহুড়ি, কাড়াকাড়ি পড়ে যায়। আম পেলে পকেটে ঢুকিয়ে রাখে আর পকেট ভরে এলে ঘাটের কোথাও রেখে আসে। পুণ্য সঞ্চয়কারী মানুষরা স্নান করে। কাদা মেখে ঘাটে উঠে এসে কেউ কেউ যায় ঘাটের মাথায় বসে থাকা বামুনদের দিকে। যারা পয়সা নিয়ে জামা-কাপড় রাখে। গায়ে মাখার জন্য নারকেল তেল বা সরষের তেল নেয়। কপালে আঁকে চন্দনের ফোঁটা কেউ কেউ আবার পথের ভিখারিদের উপেক্ষা করে চলে যায়। কেউ আবার করে না। পথের দু’ধারে নানান জিনিসের দোকান বসে। কেউ কেউ আবার বাজার থেকে ওল বা থাের বা কমলালেবু কিনে আনে। রােদে তেতে ওঠা রাস্তায় তাড়াতাড়ি পা চালিয়ে বিরক্তির মেজাজে বাড়ি ফিরতে থাকে।
২. ‘ওরা জুপিটারের শত্র, কতকগুলাে স্বার্থপর লােভী, মুখ আমায় দল পাকিয়ে। জড়িয়েছে বলে, শত্রুর ঘরে গিয়ে উঠব”—ওরা বলতে কারা, প্রসঙ্গ উল্লেখ করে উক্তিটির তাৎপর্য বিশ্লেষণ কর।
ওরা : বাংলা কথাসাহিত্যের জনপ্রিয় লেখক মতি নন্দীর 'কোনি' উপন্যাস থেকে আলােচ্য অংশটি নেওয়া হয়েছে। 'ওরা' বলতে অ্যাপােলােকে বােঝানাে হয়েছে। প্রসঙ্গ : আলােচ্য অংশটির বক্তা হলেন ক্ষিতীশ সিংহ। দীর্ঘদিন ধ'রে জুপিটারের সঙ্গে তার সম্পর্ক ছিল তাই তার পক্ষে অন্য কোথাও যাওয়া অসম্ভব ছিল, তাই এমন মন্তব্য।
তাৎপর্য : ক্ষিতীশবাবু সর্বক্ষণের সঙ্গী ভেলাে। তিনি যখন শুনেছিলেন ক্ষিতীশকে জুপিটার থেকে বের করে দেওয়া হয়েছে তখন কষ্ট পেয়েছেন। তিনি অনুরােধ করেছিলেন ক্ষিতীশবাবু যেন সমস্ত অভিমান ত্যাগ করে অ্যাপােলােতে যােগ দেন। ক্ষিতীশবাবু অবশ্য তা চায়নি কারণ তার সঙ্গে জুপিটারের সম্পর্ক—তা ছিন্ন করা সম্ভব নয়। লেখক জানিয়েছেন জুপিটারের সঙ্গে তার নাড়ীর সম্পর্ক। যদিও সাঁতারু তৈরি করা ক্ষীতিশবাবুর জীবনের একমাত্র লক্ষ্য। সুতরাং, লেখক জানান। লক্ষ্য পূরণ করতে হলে নাড়ীর বন্ধন ছিন্ন করতে হবে। ক্ষীতিশবাবুর এই বক্তব্যের মধ্য দিয়ে প্রমাণিত হয়—
(ক) ক্ষিতীশ মানুষ হিসেবে অনেকখানি উদার ও মহৎ ।
(খ) সে সুযােগ সন্ধানী নয়।
(গ) তার মধ্যে একজন ট্রেনারের সমস্ত গুণ রয়েছে।
৩. কোনি উপন্যাসে কোনি চরিত্রের পরিচয় দাও।
ভূমিকা : বাংলা কথা সাহিত্যের অন্যতম জনপ্রিয় লেখক মতি নন্দীর কোনি। নামাঙ্কিত কিশাের উপন্যাসের প্রধান চরিত্র কোনি। এই চরিত্রের বিশ্লেষণ করলে কতকগুলি বৈশিষ্ট্য পাওয়া যায়।
(ক) কঠোর জীবনসংগ্রাম : কোনি অর্থাৎ কনকাচাঁপা পাল অতি দারিদ্র্য পীড়িত সংসারের মেয়ে। চেহারা ছেলেদের মতাে, মেয়ে মদ্দানি। কোনাে কিছুতেই সে ভয় পেয়ে পিছিয়ে যায় না। সে অবিরাম ২০ ঘণ্টার ভ্রমণ প্রতিযােগিতা হােক বা সাঁতরে আমের অধিকার রক্ষায় হােক বা নামজাদা সাঁতারুদের সঙ্গে সাঁতার প্রতিযােগিতায় হােক, সবেতেই সে এগিয়ে থাকে।
(খ) পরিবারের প্রতি দায়বদ্ধতা : দাদার মৃত্যুর পর পরিবারের খাবারের জোগানের জন্য যখন সে প্রজাপতিতে কাজ করে তখন দেখা যায় ট্রেনিং-এর পর শত কষ্ট হলেও ছুটে যায় প্রজাপতিতে। পরিবারের প্রতি মমত্ববােধ আছে বলে ক্ষিতীশ তার জন্য যে পুষ্টিকর সুষম খাদ্যের বরাদ্দ করেছিল, সেই বাবদ পাওয়া টাকা সে বাড়ি নিয়ে যেতে চায়। যাতে তা দিয়ে পরিবারের প্রত্যেকের খাবারের চালটুকু সে কিনতে পারে।
(গ) প্রখর আত্মসম্মান বােধ : কোনির আত্মসম্মান বােধ প্রখর। চিড়িয়াখানায় বেড়াতে গিয়ে বড়াে স্কুলের দিদিমণির কাছে জল চেয়ে না পেলে সে প্রতিহিংসায় জ্বলে ওঠে। সেই জল যখন স্কুলের ছাত্রী হিয়া মিত্র দিতে আসে, তখন সে প্রবল আঘাতে ফিরিয়ে দেয়।
(ঘ) কঠোর পরিশ্রমী : কোনির সৎ সাহস, কঠোর পরিশ্রম, নিষ্ঠা, জমে থাকা দুঃখ অভিমান শেষ পর্যন্ত তার গলায় জয়মাল্য পরিয়ে দিয়েছে।
মূল্যায়ন : কোনি উপন্যাসে কোনি প্রধান চরিত্র। সৎ পথে যে সাফল্য আসবে তা কোনি জীবন দিয়ে প্রমাণ করে। মতি নন্দীর কোনি কিশাের উপন্যাসের অন্যতম শ্রেষ্ঠ চরিত্র।
৪. ‘হঠাৎ কোনির দুচোখে জলে ভরে এল’—কোনির দুচোখে জলে ভরে ওঠার কারণ কী, এরপর কী ঘটেছিল ?
দু'চোখে জলে ভরে ওঠার কারণ : মতি নন্দীর কোনি উপন্যাস থেকে আলােচ্য অংশটি নেওয়া হয়েছে। রবীন্দ্র সরােবরে অনুষ্ঠিত এক মাইল সাঁতার প্রতিযােগিতায় যে ২৫ জন প্রতিযােগী অংশগ্রহণ করেছিল তার মধ্যে একদিকে যেমন ছিল বালিগঞ্জের হিয়া মিত্র, অন্যদিকে তেমনই ছিল শ্যামপুকুর বস্তির কোনি। সাধারণ সাঁতারু কোনি নিজেকে উজাড় করেও টেকনিক জানা হিয়া মিত্রের সঙ্গে পেরে ওঠেনি। কিন্তু দাদা কমলকে কথা দিয়েছিল মেয়েদের মধ্যে প্রথম হবে। সেই জন্য দাদা ধার করে ১২ টাকা দিয়ে কোনিকে সাঁতারের পােশাক কিনে দিয়েছিল। কোনি নিজের এই পরাজয় ও দাদাকে দেওয়া কথা না রাখতে পারার বেদনা মেনে নিতে পারেনি । সেই সময় ক্ষিতীশের কণ্ঠস্বর ও সাঁতার শেখানাের প্রস্তাব তাকে দুর্বল করে দিয়েছিল। সেই মুহূর্তে দুঃখ অভিমানে কোনির চোখে জল দেখা দিয়েছিল।
পরবর্তী ঘটনা : এরপর যে ঘটনা ঘটেছিল, তা কোনির জীবনের সব থেকে দিশা পরিবর্তনকারী ঘটনা। সাধারণ পরিবারের কোনি খুব ভালাে সাঁতার জানলেও সে কোনােদিন কোনাে প্রশিক্ষকের কাছে সাঁতার শেখার কথা ভাবেনি। সম্ভবত সাঁতার প্রশিক্ষণ বিষয়ে তেমন কিছু জানাও তার ছিল না। কিন্তু তার জীবনের এই পর্বে ক্ষিতীশের মতাে একজন প্রশিক্ষককে পেয়ে সে ধীরে ধীরে সাফল্যের শীর্ষে পৌঁছায়।
৫. কমলের স্বর অদ্ভূত করুণ একটা আবেদনের মতাে শােনাল”—কমল কে? তার স্বর করুণ কেন?
কমল : বাংলা কথাসাহিত্যের অন্যতম জনপ্রিয় লেখক মতি নন্দী রচিত কোনি উপন্যাস থেকে আলােচ্য অংশটি গৃহীত হয়েছে। দারিদ্র পীড়িত কোনিদের সুবিশাল সংসারে বড়াে ছেলে কোনির বড়দা কমল। যার নিজের স্বপ্ন ছিল সাঁতারু হওয়ার, অ্যাপােলােতে সাঁতার কাটত। কিন্তু বাবার মৃত্যুর পর তার কঠোর বাস্তব উপস্থিত হয়, সব স্বপ্ন ভেঙে চুরমার হয়ে যায়।
কমলের করুণ স্বর : ছােটো বােন কোনির খেলাধুলার প্রতি প্রবল আগ্রহ দেখে ক্ষিতীশ কোনির দায়িত্ব নেয়। দায়িত্ব নেওয়ার পর আবার নতুন করে কোনির মধ্য দিয়ে স্বপ্ন পূরণের আশা জাগে কমলের। কিন্তু আবার বিধি বাম। শরীর অসুস্থ হওয়াতে, কমল কাজ করতে পারে না। তাই সংসারে খাবার জোগানের জন্য কোনিকে সুতাের কারখানায় ৬০ টাকা বেতনে কাজে লাগানাের কথা ভাবতে হয়। তাই অসুস্থ কমলের সাথে ক্ষিতীশ দেখা করতে এলে, স্বপ্ন আর বাস্তবের টানাপােড়েন কমলের স্বর করুণ আর্তনাদের মতাে শােনায়।