আমাদের ডান পাশে ধ্বস
আমাদের বাঁয়ে গিরিখাদ
আমাদের মাথায় বোমারু
পায়ে পায়ে হিমানীর বাঁধ
আমাদের পথ নেই কোনো
আমাদের ঘর গেছে উড়ে
আমাদের শিশুদের শব
ছড়ানো রয়েছে কাছে দূরে !
আমরাও তবে এইভাবে
এ-মুহূর্তে মরে যাব না কি ?
আমাদের পথ নেই আর
আয় আরো বেঁধে বেঁধে থাকি ।
আমাদের ইতিহাস নেই
অথবা এমন ইতিহাস
আমাদের চোখমুখ ঢাকা
আমরা ভিখারি বারোমাস
পৃথিবী হয়তো বেঁচে আছে
পৃথিবী হয়তো গেছে মরে
আমাদের কথা কে-বা জানে
আমরা ফিরেছি দোরে দোরে ।
কিছুই কোথাও যদি নেই
তবু তো কজন আছি বাকি
আয আরো হাতে হাত রেখে
আয় আরো বেঁধে বেঁধে থাকি ।
{tocify} $title={গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন}
কবি পরিচিতি :
কবি শঙ্খ ঘোষ |
বর্তমান সময়ের অন্যতম প্রখ্যাত কবি ‘চিত্তপ্রিয় ঘোষ’ আমাদের কাছে শঙ্খ ঘোষ নামে বহুল পরিচিত। কর্মজীবনে তিনি বঙ্গবাসী কলেজ, সিটি কলেজ, যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়, দিল্লি বিশ্ববিদ্যালয় এবং বিশ্বভারতী বিশ্ববিদ্যালয়ে দীর্ঘকাল অধ্যাপনা করেছেন। তার সুদীর্ঘ সাহিত্য জীবনে তিনি অসংখ্য কাব্যগ্রন্থ রচনা করেন। ‘এখন সময় নয়’, ‘আদিম লতা গুল্মময়’, ‘মূর্খ বড়ো সামাজিক নয়’, ‘বাবরের প্রার্থনা’ ইত্যাদি কাব্যগ্রন্থ বিশেষ ভাবে উল্লেখযোগ্য।
কাব্যগ্রন্থ ছাড়াও প্রবন্ধ – গদ্যে তাঁর সাবলীল বিচরণ লক্ষ্য করা যায়। সাহিত্যে অসামান্য ছাপের জন্য তিনি বহু পুরস্কারে ভূষিত হয়েছেন, এদের মধ্যে ‘পদ্মভূষণ’, ‘সরস্বতী পুরস্কার’, ‘সাহিত্য আকাডেমী’ পুরস্কার এবং ভারত সরকারের সর্বোচ্চ সাহিত্য পুরষ্কার ‘জ্ঞানপীঠ’ বিশেষ ভাবে উল্লেখ্য।
কবিতার উৎস :
আলোচ্য ‘আয় আরো বেঁধে বেঁধে থাকি’ কবিতাটি ‘জলই পাষাণ হয়ে আছে’ কাব্যগ্রন্থ থেকে নেওয়া হয়েছে।
‘আয় আরো বেঁধে বেঁধে থাকি’ কবিতাটির সারাংশ :
মানব সভ্যতা গড়ে ওঠার সাথে সাথে জন্ম নিয়েছে সাম্রাজ্যবাদী শক্তি। সেই প্রাচীন কাল থেকে মানব সভ্যতাকে বার বার ধ্বংসের মুখে নিয়ে এসেছে এই শক্তি।
কিন্তু সাম্রাজ্যবাদী কারা ?
যারা নিজেদের স্বার্থের অর্থাৎ সাম্রাজ্যবৃদ্ধির দিকে লক্ষ্য রেখে একে একে সভ্যতাকে গ্রাস করে তারাই সাম্রাজ্যবাদী। সাম্রাজ্যবাদী গ্রাস কোন বিচ্ছিন্ন ঘটনা নয়, আমরা ইতিহাসের পাতায় চোখ রাখলে দেখতে পাবো এই ঘটনা ঘটছে দীর্ঘকাল ধরে। প্রাচীন ইনকা সভ্যতার উপর স্প্যানিশদের আক্রমণ, ভারতবর্ষের উপর শক্, হুন, মুঘল বা ব্রিটিশদের আক্রমণ -এইগুলি কয়েকটি উদারহণ মাত্র। হাজার – হাজার বছর ধরে এর পুনরাবৃত্তি ঘটেছে এবং আজও প্রতিনিয়ত ঘটে চলেছে।
একটা সাম্রাজ্যবাদী শক্তি যখন আক্রমণ করে, তখন কাদের স্বার্থ ক্ষুণ্ণ হয় ?
সবচয়ে বেশি ক্ষতি হয় সাধারণ মানুষের, তারা লুন্ঠিত হয়, ধ্বংস হয়, সভ্যতা লাঞ্চিত হয়, কৃষ্টি- সংস্কৃতি দলিত হয়। কবির ভাষায় ‘আমরা’ হল সাধারণ মানুষ। সাধারণ মানুষের সর্বত্র বিপদ, ডান পাশে ‘ধ্বস’, বাম পাশে ‘গিরিখাদ’, মাথায় উপর ‘বোমারু বিমান’ আর পায়ে ‘হিমানী’ অর্থাৎ বরফের বাধ। অর্থাৎ ‘আমাদের’ আর কোথাও যাবার জায়গা নেই।
কিন্তু এর থেকে মুক্তির উপায় বা কবির ভাষায় ‘পথ’ কি আছে ?
এর উত্তর কবি দিয়েছেন, ‘আয় আরো বেঁধে বেঁধে থাকি…’ কথার মধ্যে দিয়ে। ‘বেঁধে’ থাকার অর্থ সঙ্ঘবদ্ধ থাকা।
কিন্তু ‘বেঁধে – বেঁধে’ থাকলে কি হবে ?
‘আমরা’ আজ বেঁচে আছি ধ্বংসের মাঝে, আমাদের ভবিষ্যৎ প্রজন্ম বা ‘শিশুরা’ ক্রমশ ‘শবে’ বা মৃতদেহে পরিণত হচ্ছে। সাধারণ মানুষের কোন ইতিহাস হয় না, কারণ ‘চোখ – মুখ’ ঢাকা ইতিহাস শুধুমাত্র ‘রাষ্ট্রনায়ক’ দের জন্য রক্ষিত। সাধারণ মানুষের বাঁচা মরার হিসাব সে ইতিহাস রাখে না। তাই আমাদের কিন্তু হারাবার আর কিছুই নেই, আমরা হয় মরে যাবো বা দল বাঁধবো।
কিন্তু আমাদের মধ্যেও কিছু মানুষ আছেন যারা মনুষ্যত্ব, একতা ও সম্প্রীতির কথা বলেন। তাই আমরা যারা ‘কজন বাকি আছি’ তারা দল বেঁধে ‘হাতে হাত রেখে’ সঙ্ঘবদ্ধ ভাবে ভবিষ্যতের পথ খুঁজবো।
কবিতার সরলার্থ :
“আমাদের পথ নেই কোনো …”
আমরা অর্থাৎ ‘সাধারণ মানুষ’ এক অদ্ভুৎ ধ্বংসের মাঝে বাস করছি। সাম্রাজ্যবাদী শক্তির গ্রাস, ধার্মিক ও সামাজিক অস্থিরতা ইত্যাদির মধ্যে ক্রমশ অস্তিত্ব হারাচ্ছে সাধারণ মানুষ। আজকের সময়ে এই অস্থিরতাকে অগ্রাহ্য করে চোখ বুঝে বসে থাকা সম্ভব নয়। তাই আমাদের সামনে এই ধ্বংসের তাণ্ডব অগ্রাহ্য করার আজ আর কোন ‘পথ’ খোলা নেই।
“আমাদের শিশুদের শব / ছাড়ানো রয়েছে কাছে দূরে…”
‘শিশু’ অর্থে এখানে ভবিষ্যতকে ইঙ্গিত করা হয়েছে। আমরা জানি সাধারণ মানুষেরা তাদের ভবিষ্যতের ছাপ রেখে যায় তাদের ভবিষ্যৎ প্রজন্মের মধ্য দিয়ে। কিন্তু আজকের এই ধ্বংসের দাবানলে সেই ভবিষ্যতও অন্ধকার, তাদের ভবিষ্যত সম্ভবনা আজ মৃতপ্রায় (শব) হয়ে ছড়িয়ে আছে আমাদের অর্থাৎ বর্তমান সভ্যতার সামনে ।
“আমদের ইতিহাস নেই…”
সেই সাধারণ মানুষেরা যারা সর্বদা সাম্রাজ্যবাদী শক্তির সামনে শোষিত হয়, যাদের কৃষ্টি – সংস্কৃতি নষ্ট হয়, ইতিহাসের পাতায় তাদের কথা লেখা হয় না। ইতিহাস তৈরি হয় রাষ্ট্রনায়কদের নিয়ে, সাধারণ মানুষ সেখানে বঞ্চিত। তাদের অত্যাচারে সাধারণ মানুষেরা নিজেদের অস্তিত্ব ভুলে, চাপিয়ে দেওয়া ইতিহাস মেনে নিতে বাধ্য হয়। তাই তাদের কোন ইতিহাস থাকে না।
“আমরা ভিখারি বারো মাস…”
ভিখারির কিছু সঞ্চয় থাকে না, ভিক্ষাবৃত্তি করে তার যা জোটে তা দিয়েই সে গ্রাসাচ্ছাদন করে, জীবন যুদ্ধে বেঁচে থাকে। কবি ‘আমরা’ অর্থাৎ সাধারণ মানুষকে ‘ভিখারির’ সঙ্গে তুলনা করেছেন আর ‘বারো মাস’ কথাটি সবসময় বোঝাতে ব্যবহার করা হয়েছে। কারণ, সাম্রাজ্যবাদী ও ধ্বংসাত্মক উগ্র শক্তির সামনে আক্রান্ত হতে হতে আমদের ‘সঞ্চয়’ অর্থাৎ ‘অতীতের গর্বের কথা’ লুণ্ঠিত হয়। আর তার পরিবর্তে আমাদের উপর চাপিয়ে দেওয়া হয় পরিবর্তিত নিয়ম – পট পরিবর্তন হয় কিন্তু অবস্থার পরিবর্তন হয় না। ‘আমরা’ সেই নতুন সময়কেই সর্বদা ‘ভিখারির’ মত মেনে নিই, তা দিয়েই বেঁচে থাকার চেষ্টা করি।
আলোচনা :
রবীন্দ্রোত্তর বাংলা সাহিত্যের একজন সেরা তারকা হলেন কবি শঙ্খ ঘোষ ,তাঁর একটি স্বরণীয় কবিতা "আয় আরো বেঁধে বেঁধে থাকি ",যেখানে প্রধান হয়ে উঠেছে মানুষের অস্তিত্বের সঙ্কট ।
কবিতার প্রথম স্তবকের প্রথম চারটি চরণে কবি মানুষের অসহয়তার রূপকল্প ফুটিয়ে তুলেছেন । প্রকৃতির কাছে মানুষ কত অসহায় তা বোঝাতে গিয়ে কবি লিখছেন - "আমাদের ডানপাশে ধ্বস / আমাদের বাঁয়ে গিরিখাত", তবে শুধু নেচার নয়; তার সঙ্গে যুক্ত হয়েছে যুদ্ধোন্মাদ মানুষের ভয়াল রক্তচক্ষু, তাই মাথার উপর দিয়ে উড়ে যায় যুদ্ধজাহাজ; সেখান থেকে নেমে আসে মৃত্যুর করালগ্রাস ।
কবিতার দ্বিতীয় স্তবকে কবি যুদ্ধপীড়িত মানুষের পথহীনতার ছবি ফুটিয়ে তুলেছেন ;দেখিয়েছেন ধ্বংশের ভয়ংকর রূপ ।কবির ভাষায় - "আমাদের শিশুদের শব /ছড়ানো রয়েছে কাছে দুরে ।"
কবিতার তৃতীয় স্তবকে প্রকাশ পেয়েছে মানুষের মৃত্যু ভয় ,হৃদয়ে জেগে উঠছে শঙ্কা :আমরাও এভাবে মরে যাবো না তো !তাই বড় হয়ে উঠেছে পরস্পর এর সঙ্গে জোট বেঁধে থাকবার বাসনা । বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ বিসর্জন নাটকের একজায়গায় বলেছিলেন– "আয় ভাই........./ আরো কাছাকাছি সবে বেঁধে বেঁধে থাকি "
আসলে, সমস্ত রকম দুঃখ -কষ্ট -বিপদ মুক্তির সেরা উপায় জোটবদ্ধতা ।
কবিতার চতুর্থ স্তবকে প্রকাশ হয়েছে, মানব সভ্যতার নেপথ্যে থাকা সাধারন মানুষের ভূমিকার কথা, তাদের প্রতি সভ্য মানুষ বিমুখ, কেননা "পৃথিবীর গভীর গভীরতর অসুখ এখন ", তাই বিপন্ন মানুষ বলে ওঠে —
"আমাদের ইতিহাস নেই /অথবা এমনই ইতিহাস /আমাদের চোখ মুখ ঢাকা" : পীড়িত মানুষের নিজস্ব কোন ইতিহাস নেই, থাকলেও তা স্পষ্ট নয় ।
কবিতার পঞ্চম স্তবকে কবি মানুষের পথহীনতার রূপ আরো প্রকট করে তুলেছেন । মানুষের মধ্যে বেঁচে থাকা এবং মরা সম্পকে আতঙ্ক ভাবের সঞ্চারন ঘটেছে ।তাই মানবতাবাদী কবি কবিতার এক্কেবারে শেষতম স্তবকে এসে সমাধানের পথ পাঠকের দরবারে উন্মোচিত করে দিয়েছেন -"আয় আরো হাতে হাত রেখে / আয় আরো বেঁধে বেঁধে থাকি ":সমস্ত বিপদ থেকে বাঁচবার এটায় সেরা পথ ।
প্রশ্নোত্তর পর্ব :
সঠিক বিকল্পটি নির্বাচন করো :
১. 'আয় আরো বেঁধে বেঁধে থাকি' — কবিতাটি কবির কোন কাব্যগ্রন্থের অন্তর্গত ? [মাধ্যমিক - ২০১৮]
(ক) 'নিহিত পাতাল ছায়া' (খ) 'পাঁজরে দাঁড়ের শব্দ'
(গ) 'দিনগুলি রাতগুলি' (ঘ) 'জলই পাষাণ হয়ে আছে' ।
উত্তর : (ঘ) 'জলই পাষাণ হয়ে আছে' ।
২. 'ছড়ানো রয়েছে কাছে দুরে !'— কী ছড়ানো রয়েছে ?
(ক) আমাদের শিশুদের শব (খ) সৈন্যদের শব
(গ) লালরঙের ফুল (ঘ) বৃদ্ধ বৃদ্ধাদের শব ।
উত্তর:(ক) আমাদের শিশুদের শব
৩. 'আমাদের পথ নেই কোনো / আমাদের _____ গেছে উড়ে' । — শুন্যস্থান পূরণ করো ।
(ক) বাড়ি (খ) বাড়িঘর
(গ) ঘরবাড়ি (ঘ) ঘর
উত্তর: (ঘ) ঘর
৪. 'পায়ে পায়ে হিমানীর বাঁধ' — 'হিমানী' শব্দের আক্ষরিক অর্থ কী ?
(ক) জল (খ) আগুন (গ) তুষার (ঘ) পর্বত ।
উত্তর: (গ) তুষার
৫. গিরিখাদ রয়েছে — কবিতায় গিরিখাদ কোন দিকে রয়েছে ?
(ক) আমাদের বাঁয়ে (খ) আমাদের উত্তরে
(গ) আমাদের দক্ষিনে (ঘ) আমাদের ডান পাশে ।
উত্তর : (ক) আমাদের বাঁয়ে
৬. 'আমাদের শিশুদের শব / ছড়ানো রয়েছে' —
(ক) কাছে দূরে (খ) কাছে কাছে
(গ) দূরে দূরে (ঘ) বহুদূরে ।
উত্তর : (ক) আমাদের বাঁয়ে
৭. শঙ্খ ঘোষের প্রকৃত নাম কী ? —
(ক) প্রিয়দর্শী ঘোষ (খ) নিত্যপ্রিয় দত্ত
(গ) নিত্যগোপাল ঘোষ (ঘ) চিত্তপ্রিয় ঘোষ ।
উত্তর: (ঘ) চিত্তপ্রিয় ঘোষ ।
৮. 'আমাদের ডান পাশে _____' শুন্যস্থান পূরণ করো ।
(ক) ধ্বস (খ) প্রান্তর
(গ) বন (ঘ) গিরিখাদ ।
উত্তর: (ক) ধ্বস
অতি সংক্ষিপ্ত প্রশ্নোত্তর: (প্রশ্নের মান-১)
১. "আমাদের পথ নেই আর"— তাহলে আমাদের করণীয় কী ? [মাধ্যমিক-২০১৭]
উঃ- পথ না থাকার দরুন আমাদের আজ একতাবদ্ধ হয়ে 'আরো বেঁধে বেঁধে' থাকতে হবে ।
২."আমাদের পথ নেই কোনো "-একথা মনে হয়েছে কেন?
উত্তর: একথা মনে হওয়ার কারণ সম্পূর্ণ প্রতিকূল ও অস্থির পরিবেশ।
৩. "আয় আরো বেঁধে বেঁধে থাকি"- বেঁধে বেঁধে থাকার উদ্দেশ্য কী?
উত্তর: বিপদকে সম্মিলিতভাবে প্রতিহত করার শক্তি সংগ্রহ করাই বেঁধে বেঁধে থাকার উদ্দেশ্য।
সংক্ষিপ্ত প্রশ্নোত্তর: ( প্রশ্নের মান-৩)
১. 'আমরা ভিখারি বারোমাস' — এই উপলব্ধির মর্মার্থ লেখ ।
উত্তর:- কবি শঙ্খ ঘোষ রচিত 'আয় আরো বেঁধে বেঁধে থাকি' কবিতা থেকে উদ্ধৃত লাইনটি নেওয়া হয়েছে । কবিতায় কবি বারোমেসে ভিখারী জীবনের যে স্বরূপটি তুলে ধরেছেন, তা হল- আত্মসর্বস্ব মানুষের শুধু নিজের স্বার্থ পূরণের এক প্রবল মনোবাসনা বা আকাঙ্খা পূরণ । সমাজ ও রাষ্ট্রের নরঘাতী স্বরূপটিকে বুঝেও আজ আমরা নির্বিকার । বেঁচে থাকার জন্য আজ আমাদের চোখ মুখ ঢাকা । আমরা নির্বিবাদে সব কিছু সহ্য করে পরমুখাপেক্ষী কোনোক্রমে জীবন ধারণের ভিক্ষুকদশা গ্রহণ করেছি । এইভাবে পারিপার্শ্বিক জগৎ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে আত্মকেন্দ্রিক ও গৃহসুখী মানসিকতাকেই কবি ভিখারির মতো দিন অতিবাহিত করা বলতে চেয়েছেন । আসলে আমরা মেরুদন্ডহীন হওয়ায় প্রতিনিয়ত ঘটে চলা বিপর্যয় ও বিশৃঙ্খলা গা বাঁচিয়ে এড়িয়ে চলি । আমাদের এই হীন মনোবৃত্তিকে তুলে ধরার জন্য কবি আধুনিক জীবনকে ভিখারি বারো মাস বলেছেন ।
২. "আমরাও তবে এইভাবে / এ মুহূর্তে মরে যাব না কি ?" — এমনটা মনে হচ্ছে কেন ? [মাধ্যমিক-২০১৮]
উঃ- প্রশ্নোদ্ধৃতাংশ মন্তব্যটি কবি শঙ্খ ঘোষ রচিত "আয় আরো বেঁধে বেঁধে থাকি" কবিতায় উল্লেখ করেছেন ।
চারপাশের অরাজকতা, ধর্ম কিংবা রাজনীতি —প্রতিটি ক্ষেত্রেই অসহিষ্ণুতা, সাম্রাজ্যবাদের সীমাহীন লোভ পৃথিবী জুড়ে হত্যা আর ধ্বংসলীলা চালাচ্ছে । বেঁচে থাকাটাই যেন এক বিস্ময় হয়ে উঠেছে । শিশুরা পর্যন্ত এই ধ্বংসলীলা থেকে রেহাই পাছে না । এই অবস্থায় প্রতিটি মানুষই যেন বেঁচে থাকার অনিশ্চয়তায় ভুগছে । সর্বোপরি, এই পরিজনহীন অবস্থাতে বেঁচে থাকা যেন মৃত্যুর মতো যন্ত্রনাদায়ক । এ কারণেই কবি প্রশ্নে উল্লিখিত মন্তব্যটি করেছেন ।
৩. "আমাদের ইতিহাস নেই" — কে, কেন এ কথা বলেছেন ? [মাধ্যমিক-২০১৮]
উঃ- কবি শঙ্খ ঘোষ তাঁর রচিত "আয় আরো বেঁধে বেঁধে থাকি" কবিতায় প্রশ্নের উদ্ধৃত অংশটির কথা বলেছেন ।
ইতিহাস হল কোনো জাতির এবং সভ্যতার আত্মবিকাশের পথ ও পর্যায়ের কাহিনি । কিন্তু যখন সেই ইতিহাস নিয়ন্ত্রিত হয় কোনো ক্ষমতাবান গোষ্ঠী, ধর্মসম্প্রদায় কিংবা রাজনীতির দ্বারা, তখন ইতিহাসের বিকৃতি ঘটে । ক্ষমতাবানরা নিজেদের স্বার্থে ইতিহাসকে নিজেদের মতো করে গড়ে তোলে । মানুষ একসময় ভুলে যায় তার প্রকৃত ইতিহাস, আর চাপিয়ে দেওয়া ইতিহাসকেই নিজের বলে মেনে নেয় । এই পরিপ্রেক্ষিতেই এখানে কবি বলেছেন আমাদের ইতিহাস নেই ।
রচনাধর্মী প্রশ্ন : (প্রশ্নের মান—৫)
১. আয় আরো বেঁধে বেঁধে থাকি' কবিতার ভাববস্তু নিজের ভাষায় লেখো।
আধুনিক বাংলার অন্যতম শ্রেষ্ঠ কবি শঙ্খ ঘোষের লেখা 'আয় আরো বেঁধে বেঁধে থাকি' কবিতায় বর্তমান পৃথিবীর সাধারণ মানুষের বিপন্নতার কথা তুলে ধরা হয়েছে। পৃথিবী জুড়ে অস্ত্রের প্রতিযোগিতা ও রাষ্ট্রনেতাদের স্বার্থ-সংঘাতের বলি হতে হচ্ছে সাধারণ নিরীহ মানুষকে। বিপন্ন মানুষকে বেঁচে থাকতে হচ্ছে যুদ্ধের আশঙ্কা নিয়ে। অথচ আমাদের কোনোদিকেই যাওয়ার পথ নেই। আমাদের "ডান পাশে ধস" আর "বাঁয়ে গিরিখাত"।
যুদ্ধের অনিবার্য পরিণতিতে পৃথিবী জুড়ে মৃত্যু হচ্ছে মানুষের, মৃত্যু হচ্ছে শিশুদের। এই পৃথিবীর কোথাও আমাদের জন্য নিরাপদ আশ্রয় নেই। ইতিহাস আমাদের কথা বলে না। ইতিহাসের পাতায় সাধারণ মানুষের কোনো অস্তিত্ব নেই। দরিদ্র, বিপন্ন মানুষকে দোরে দোরে ঘুরতে হয় সাহায্যের প্রত্যাশায়।
এমন এক বিপন্ন সময়েও আশাবাদী কবি হতাশার কথা বলেননি। মানুষকে তিনি ঘুরে দাঁড়াতে বলেছেন। সাধারণ মানুষের ঐক্যই পারে অশুভ শক্তিকে পরাজিত করে পৃথিবীতে শান্তির বাতাবরণ গড়ে তুলতে। তার জন্য প্রয়োজন মানুষের ঐক্য। পারস্পরিক সহযোগিতা ও সহমর্মিতার ভিত্তিতে হাতে হাত রেখে গড়ে তুলতে হবে শুভবুদ্ধিসম্পন্ন মানুষের জোট। মানব সমাজকে সুস্থ ও সুন্দর করে গড়ে তোলার এটাই একমাত্র পথ।
২. আয় আরো বেঁধে বেঁধে থাকি 'কবিতার নামকরণ কতটা স্বার্থক তা আলোচনা করো।
অথবা, 'আয় আরো বেঁধে বেঁধে থাকি' কবিতায় কবি কাদের বেঁধে বেঁধে থাকতে বলেছেন? কেনো বেঁধে বেঁধে থাকতে বলেছেন।
অথবা, 'আয় আরো বেঁধে বেঁধে থাকি 'কবিতায় কবির সমাজ চেতনার যে পরিচয় পাওয়া যায় তা সংক্ষেপে লেখো।
অথবা, "আমাদের পথ নেই আর"-কাদের পথ নেই? এই পরিস্থিতি থেকে রেহাই পেতে কোন ব্যবস্থার কথা বলেছেন কবি।
উঃ >> শঙ্খ ঘোষ তাঁর 'আয় আরো বেঁধে বেঁধে থাকি 'কবিতায় সামাজিক, রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক অবক্ষয়ের মধ্যে টিঁকে থাকা মানুষদের বেঁধে বেঁধে থাকতে বলেছেন।
•• কবি শঙ্খ ঘোষ তাঁর আয় আরো বেঁধে বেঁধে থাকি' কবিতায়—যাদের পথ নেই বলে উল্লে করেছেন তারা হলেন —সামাজিক, রাজনৈতিক, ও অর্থনৈতিক অবক্ষয়ের মধ্যে টিঁকে থাকা মানুষ।
••• (নাম করণের নানা রূপ নানা রীতি। কখনও নামকরণ হয় চরিত্র কেন্দ্রিক, কখনও বিষয়বস্তু কেন্দ্রিক, আবার কখনও হয় ব্যঞ্জনাধর্মী।) সমাজ সচেতন কবি শঙ্খ ঘোষ তাঁর 'আয় আরো বেঁধে বেঁধে থাকি ' কবিতায় খুব সুন্দরভাবে অবক্ষয়ী এক সমাজের চিত্র যেমন তুলে ধরেছেন তেমনি তা থেকে উত্তোরণের উপায়টিও বাতলে দিয়েছেন। অবক্ষয়ী এক প্রেক্ষাপটে আমরা দেখি করালগ্রস্থ মানুষগুলির বাঁচার কোনো পথই আর অবশিষ্ট নেই। তাই তাদের ডানপাশে ধ্বস, বামে গীরিখাত, মাথায় বোমারু, আর পায়ে পায়ে হিমানীর দূরতীক্রম্য বাঁধা। এরকম পরিস্থিতিতে বিপন্ন মানুষগুলি দেখেন তাদের আশা-স্থল ভবিষ্যৎ প্রজন্মের অকাল মৃত্যু ও তাদের লাশের এদিক ওদিক ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকায় স্পষ্ট হয় ভবিষ্যৎ প্রজন্মও বিপন্ন সুতরাং বাঁচার আর্তীই তখন মানুষের মধ্যে প্রকট হয়ে ওঠে প্রকট হয়ে ওঠে নিজেদের রক্ষার সংকল্প।
কিন্তু যে কোনো সংক্ল্প কে রূপ দেওয়া বেশ কঠিন। পদে পদে সেখানে অনেক বাঁধা। অবক্ষয়ময় প্রেক্ষাপটে সমাজের নির্যাতিত লাঞ্ছিত মানুষগুলি ইতিহাসেও হন বঞ্চিত। বঞ্চনার ইতিহাসে তাদের রিক্ততা, নৈরাশ্ম ধরা পড়েনা, ধরা পড়েনা তাদের দিন বদলের প্রচেষ্টা। কবির তাই মনে হয় "আমাদের কথা কে বা জানে/আমরা ফিরেছি দোরে দোরে।"
তবুওআশাবাদী কবি হতাশায় নিমজ্জিত হননা, তিনি স্বপ্ন দেখেন দিন বদলের। তাই তখনও অবশিষ্ট থাকা মানুষ গুলোকে একতা বদ্ধ হওয়ার ডাক দেন। তাঁর বিশ্বাস সমবেত প্রচেষ্টাতেই একদিন সব ঠিক হয়ে যাবে। কবির কন্ঠে তাই উচ্চারিত হয়–
কিছুই কোথাও যদি নেই
তবুও তো কজন আছি বাঁকি
আয় আরো হাতে হাত রেখে
আয় আরো বেঁধে বেঁধে থাকি ।
***(সমবেত হওয়ার আকাঙ্ক্ষাই যেহেতু কবিতার মূল আহ্বান সেদিক থেকে নামকরণ স্বার্থক)