1 / 7
2 / 7
3 / 7
4 / 7
5 / 7
6 / 7
7 / 7

গল্প : বাইনারি শহর– সুব্রত মজুমদার

 বাইনারি শহর 

সুব্রত মজুমদার 


আমার বন্ধু আর্থার কোলিন, একাধিক্রমে একজন গণিতবিদ ও সফটওয়্যার ইঞ্জিনিয়ার। লোকে ওর সম্মন্ধে আনেকরকম ভালোমন্দ বললেও আমার সঙ্গে ওর ব্যবহার খুবই বন্ধুসুলভ ও হার্দিক। আমি ওর ওখানে রওনা হচ্ছি জানুয়ারির তেরো তারিখ, আর কাকতালিয়ভাবে আর্থারের জন্ম তারিখও তেরো। আর এজন্যই বগলার আপত্তি।


অলঙ্করণ : বিশ্বজিৎ মণ্ডল


তেরো যে অপয়া হয় তা শুনেছি, কিন্তু বিশ্বাস ছিল না। আজ হাড়ে হাড়ে বিশ্বাস হল । আমার বাল্যবন্ধু বগলা ভটচায আমাকে আর্থারের কাছে যেতে নিষেধ করেছিল। আমি শুনিনি। উল্টে বলেছিলাম,"তুই তান্ত্রিক মানুষ, ভুত প্রেত পয়া অপয়া নিয়ে কারবার তোর, কিন্তু একজন বিজ্ঞানসেবক হিসেবে ওসবে দৃকপাত না করাই উচিত আমার।"

বগলা নির্লিপ্ত গলায় বলেছিল, "যা তাহলে।"


আমার বন্ধু আর্থার কোলিন, একাধিক্রমে একজন গণিতবিদ ও সফটওয়্যার ইঞ্জিনিয়ার। লোকে ওর সম্মন্ধে আনেকরকম ভালোমন্দ বললেও আমার সঙ্গে ওর ব্যবহার খুবই বন্ধুসুলভ ও হার্দিক। আমি ওর ওখানে রওনা হচ্ছি জানুয়ারির তেরো তারিখ, আর কাকতালিয়ভাবে আর্থারের জন্ম তারিখও তেরো। আর এজন্যই বগলার আপত্তি।

আর্থার থাকে আমেরিকার কানসাস্ জেলার ম্যাক-আর্থার লেকের কাছাকাছি। ফাঁকার ভেতরে একটা দোতলা বাড়ি। বাড়ির ছাদে সোলার প্লেট দূষণমুক্ত বিদ্যুতের চাহিদা মেটাচ্ছে। দোতলার কোণার দিকে একটা ঘরে আমার থাকার জায়গা হল। পাশেই আর্থারের ল্যাব। ল্যাব বলতে কতগুলো কম্পিউটার, বিভিন্ন যন্ত্র আর সিডি পেনড্রাইভের স্তুপ।

আর্থার বলল, "এস লোমহর্ষণ, আমি অধীর আগ্রহে তোমার অপেক্ষা করছি। যে যুগান্তকারী আবিষ্কার আমি করেছি তা নিজের চোখে না দেখলে বুঝতেই পারবে না। আমি তৈরি করেছি এমন একটা ডিজিটাল জগৎ যেখানে চলে শুধু নিয়ম। নিয়মের ব্যতিক্রম হওয়ার জায়গা নেই। আর বাইরের জগতের কিছু ঢুকলে তার বেরিয়ে আসা কার্যত অসম্ভব। শত শত অ্যান্টিভাইরাস প্রহরী তাকে বন্দি করবে জন্মের মত।"

বললাম,"সব সিস্টেমকেই দুর্ভেদ্য লাগে, কিন্তু কোনও সিস্টেমই বাগশূন্য নয় । যতই চক্রব্যূহ তৈরি কর বন্ধু ফাঁক তার থাকবেই।"

-"তাহলে পরীক্ষাই হয়ে যাক। " বলল আর্থার। 

বললাম,"কিভাবে ?"

আর্থার বলল, "আমি তোমাকে ভার্চুয়ালি পাঠিয়ে দেব ওই বাইনারি শহরে। বেরিয়ে আসতে হবে। চব্বিশ ঘণ্টার ভেতর না বেরিয়ে আসতে পারলে সংযোগ বিচ্ছিন্ন করে দেব। অটোমেটিক চলে আসবে এই জগতে।"

আমি রাজি হতেই ও আমাকে নিয়ে গেল ওর ল্যাবের একটা বিশাল কম্পিউটার মনিটরের সামনে। মনিটরটি যে সিপিইউ এর সাথে যুক্ত আছে সেটা হতে বেরিয়ে আছে অনেকরকম তার ও ডাটা কেবল। তার মধ্যেই কতগুলো তারের সাথে সেন্সর লাগানো। আমাকে চেয়ারে বসিয়ে কপাল ও বুকের নানাস্থানে লাগিয়ে দিল সেইসব সেন্সর। তারপর প্রোগ্রাম অন করতেই আমার চোখ ঘোলাটে হয়ে এল। তারপর আস্তে আস্তে সব অন্ধকার।

যখন চোখ খুললাম তখন আমি দাঁড়িয়ে আছি একটা আলোকময় সুরঙ্গে। হাঁটতে শুরু করলাম। যত হাঁটছি ততই যেন বেড়ে যাচ্ছে এই সুরঙ্গ। এই পথ কি কোনোদিন শেষ হবে না ?

পথ শেষ হল। পথের শেষে যেখানে পৌঁছলাম সেটা একটা চেকপোস্ট জাতীয়। তবে চারদিকে যত সচল সত্তা দেখতে পাচ্ছি সন্দেহ হয় তাদের কেউই রক্ত মাংসের জীব কিনা । সবাই চলেছে শূন্য আর একের বাইনারি নির্দেশমালার শাসনে । যান্ত্রিকতা যেন গ্রাস করেছে এদের। 

আমি যেতেই একসঙ্গ একাধিক যান্ত্রিক স্বর বলে উঠল, "অপবস্তু পাওয়া গেছে। অপবস্তু পাওয়া গেছে। অভিসংরক্ষিত কর... অভিসংরক্ষিত কর.....।

এখানে আমি একটা অপবস্তু অর্থাৎ ম্যালওয়্যার। তাই পাওয়া মাত্রই অভিসংরক্ষিত অর্থাৎ কোয়ারেন্টিন করবে আমাকে। এরপর ম্যালওয়্যারদের সঙ্গে যা যা হয় আমার সঙ্গে তাই হবে। বুদ্ধি না খাটালে অস্তিত্বসংকট দেখা দিতে পারে। অতএব সাধু সাবধান। 

আমার আশঙ্কাই ষোলোআনা সত্যি। আমাকে নিয়ে অপবস্তু সাব্যস্ত করে নিয়ে যাওয়া হল একটা বাইনারি সেলে। যেতে যেতে দেখলাম এই অদ্ভুত দুনিয়ার না দেখা চেহারা। সব জায়গাতেই সিস্টেম। কেউ নিজের ইচ্ছায় চলে না। মাদার-প্রোগ্রামিং যা নির্দেশ দেবে তাই মেনে চলতে হবে। নচেৎ জায়গা আমার মতোই কোনও বাইনারি সেলে, তারপর হয়তো ধ্বংস করে দেওয়া হবে চিরতরে।

সর্বত্রই খেলে বেড়াচ্ছে বিদ্যুৎ। খুব কম ভোল্টেজের এই বিদ্যুতই সেন্সরের কাজ করে। এই বিদ্যুতবাহিত সেন্সরই এই শহরের একমাত্র চালিকাশক্তি। এই বিদ্যুতের লহর হতে শক্তি নিয়ে অনবরত ছুটে বেড়াচ্ছে রাশি রাশি শূন্য আর একেরা। আর তারাই শাসন করছে এই শহর। আর্থার যেটা তৈরি করেছে সেটা ভার্চুয়াল না আসল সেটাই বুঝে উঠতে পারছি না। তবে এটা বুঝছি যে আমাকেও এই বাইনারি নিয়মের দাস হয়ে থাকতে হবে। 

আপাতত আমি বন্দি। যতক্ষণ এদের মাদার-সিস্টেম আমাকে বিশ্বাস না করছে ততক্ষণ আমি একটা ম্যালওয়্যার ছাড়া কিচ্ছুই না। সিস্টেম যখন আছে তখন বাগ থাকবেই। ব্যবস্থা যেখানে সেখানেই অব্যবস্থা। আমাকে সেই অব্যবস্থার সাহায্য নিয়ে ফিরে যেতে হবে সময়ের আগেই। 

যেতে যেতে একটা দৃশ্য দেখলাম। রাস্তায় কয়েকটা ছেলে সাইকেল চালাচ্ছিল, হঠাৎ একটা গাড়ি এসে ছেলেটাকে ধাক্কা মারল। পুলিশ এসে গাড়ি আর গাড়ির মালিকের সাথে সাথে আহত ছেলেটাকেও তুলে নিয়ে গেল। এই নিয়মটা খুব ভালো এদের। দূর্ঘটনায় আহতদের চিকিৎসায় দেরি হয় না এখানে। অর্থাৎ সব খারাপেরই একটা ভালো আছে। 

আমাকে নিয়ে রাখা হল একটা দশ বাই দশ লকআপে। দেওয়ালের গায়ে দু'দিকে পরপর তিনটে করে মোট ছ'টা রেক। অনেকটা স্লিপার রেলের মতো। নিচের দিকের একটা রেকে গা এলিয়ে দিলাম। ঘুম আসছে খুব। 

চোখ প্রায় বুজেই এসেছে, এমনসময় একটা ফিসফিসে গলা পেয়ে চোখ খুললাম। 

-"ও মশাই, মশাই...." 

-"হ্যাঁ বলুন, শুনতে পাচ্ছি। কিন্তু কোথা হতে বলছেন বলুন তো ?" 

-"এপাশে, এপাশে, উপরের দিকে দেখুন।" 

দেখলাম আমার অপজিটের রেকগুলোর একদম উপরেরটাতে একটা টাঁকমাথা মোটকু টাইপের লোক আমাকে ডাকছে। বললাম, "কে আপনি ? আমার মতোই..?" 

-"বিলক্ষণ । একই ফল যখন হয়েছে তখন একই যাত্রা হবে এটা চোখ বুজে বলা যায়। তা আপনি বুঝি ইঞ্জিনিয়ার ?" 

-"না। আমি প্রফেসর লোমহর্ষণ, সাধারণ একজন বিজ্ঞানসেবক।"

-"হেঁ হেঁ হেঁ...." একটা ব্যঙ্গের হাসি হেসে লোকটা বলল, "আমি চক্রবাল চক্রধর, এই শহরের প্রধান আর্কিটেক্ট। সফটওয়্যার আর সিভিল এই দুটোতেই আমার মাষ্টারি। আমার যদি এমন অবস্থা হয় তবে আপনার কি হবে সেটাই ভাবছি।"

লোকটা আর যাই হোক মনের দিক হতে ভালো নয়। ওর কথাবার্তা, ওর আচার আচরণ, দাম্ভিকসুলভ।

বললাম, " তাহলে আপনিই এই শহরটা তৈরি করেছেন। কিন্তু এখানে কেন ?"

লোকটা দেঁতো হাসি হেসে বলল,"আর্থার। ওই আর্থারই আমাকে এখানে এনে বন্দি করেছে। তোমাকেও নিশ্চয়... "

-"একদমই না। আমি এসেছি ওর দেওয়া চ্যালেঞ্জ নিয়ে। ওর সিস্টেমে যে বাগ আছে তা প্রমাণ করে দিতে।"

এবার হো হো করে হেসে উঠল চক্রবাল । বলল,"এই সিস্টেম ও তৈরি করেনি করেছি আমি। এখানে কোথাও কোনও অসঙ্গতি নেই। ওই আর্থার আমার কাছ হতে কন্ট্রোল প্যানেলের চাবি  হাতিয়ে নিয়ে আমাকে এখানে পাঠিয়ে দিয়েছে।"

ভীষণ চিন্তায় পড়ে গেলাম। চক্রবালের কথা যদি সত্যি হয় তবে বিরাট বিপদে পড়ে গেছি আমি। কিন্তু আর্থারের সঙ্গে তো আমার কোনও শত্রুতা নেই, ও কেন আমাকে এভাবে বন্দি করে রাখবে ? উত্তরটা যাই হোক আমাকে বেরোতেই হবে এই চক্রব্যূহ হতে। চক্রবাল রচিত চক্রব্যূহে বন্দি থাকলে চলবে না।

বললাম, "এই কারাগার হতে মুক্তির কিছু উপায় আছে কি ?"

একটা বেদনার্ত স্বরে চক্রবাল বলল, "না। উপায় থাকলে কি আমি বসে বসে জেলের ভাত খাই ! অনেক ভেবেছি মশাই, কিন্তু কিচ্ছুটি খুঁজে পাইনি।"

যা করতে হবে আমাকেই। বিছানায় শুয়ে পড়ে ছটফট করতে লাগলাম। 

-"মরে গেলাম ! উঃ.... মাগো.... শেষ হয়ে গেলাম গো..... " পেটেব্যাথার নিখুঁত অভিনয়। 

কেউ এল না। দীর্ঘদিন পনেরো বিশ মিনিটের অভিনয় বিফলে গেল আমার। ফিকফিক করে হাসতে লাগল চক্রবাল । 

"এ পাঁয়তারা কি আমি জানি না মশাই ? আপনি সারাজীবন কেঁদে মরে গেলেও ফিরে তাকাতে না এরা। মানবতার কোনও ভ্যালু নেই এখানে। শুধু নিয়ম আর নিয়ম। নিয়ম মানতেই হবে।" 

"ও আচ্ছা..." বলে এক ঘুষি লাগালাম চক্রধরের গালে। চক্রবাল উল্টে পড়ল। ওর আর্তনাদ ছড়িয়ে পড়ল কারাকক্ষের আনাচে কানাচে। আর সঙ্গে সঙ্গেই বেজে উঠল সাইরেন। পাগলাঘন্টি। দুটো ষণ্ডামতো লোক এসে ঢুকল। 

আমি প্রস্তুতই ছিলাম, রেকের একটা ডান্ডা আলগা হয়েছিল, ওটাকে খুলে  নিয়ে আচমকা আক্রমণ করতেই দুটো লোকই ধরাশায়ী হয়ে গেল। আর সেই সূযোগে খোলা দরজা দিয়ে বেরিয়ে পড়লাম। 

বাইরেটাও খুব একটা নিরাপদ নয়। জায়গায় জায়গায় সেন্সর। ধরা পড়ে যাওয়ার সম্ভাবনা প্রবল। কিন্তু ধরা পড়লে চলবে না। যে বাইনারি নিয়মে এই শহর চলছে সেই নিয়মের মধ্যেই আছে সূক্ষ্ম কোনও গাফিলতি, আর সেটাকেই হাতিয়ার করে ফিরে যেতে হবে নিজের জগতে। 

সেন্সর বাঁচিয়ে খুব সাবধানে এগোচ্ছি। এ কাজ খুবই কঠিন। যে কোনও মূহুর্তেই ধরা পড়ে যেতে পারি। বড় রাস্তা ছাড়িয়ে একটা গলিতে গিয়ে উঠলাম। ঘর গুলোতে আলো জ্বলছে। তার মানে ঘরগুলোর একটাও আমার জন্য নিরাপদ নয়। আমাকে এমন একটা ঘর খুঁজতে হবে যেখানে এই বাইনারি নিয়মের ব্যতিক্রম ঘটেছে। অবশ্য সে সম্ভাবনা খুবই ক্ষীণ। 

কপাল আমার ভালো, গলির একেবারে শেষের দিকে একটা অন্ধকারে ডুবে থাকা ঘর পেলাম। তড়িঘড়ি ঢুকে পড়লাম সেই ঘরে। গোটা ঘরে ঘুরঘুট্টি অন্ধকার। আমি ঘরে ঢুকতেই কি যেন একটা সরে গেল ঘরের এপ্রান্ত হতে ওপ্রান্তে। মানুষ না জন্তু ? 

কিন্তু আমি যতদূর দেখেছি এই বাইনারি শহরে একটাও তো জীবজন্তু নেই। তাহলে.... 

এই তাহলের উত্তর পেলাম একটু পরেই। একটা ক্ষীণ গলা বলে উঠল, "আমি কোনও অন্যায় করিনি। আমার ছেলে বেশ ভালোমতোই সাইকেল চালানো জানত। তাছাড়া অ্যাক্সিডেন্ট তো আর ও করেনি, করেছে গাড়িওয়ালা ছেলেটা।" 

বুঝলাম আমার দেখা সেই অ্যাক্সিডেন্টার কথা বলছে লোকটা। ও নিশ্চয়ই আহত ছেলেটার কেউ হয়। আশ্বাস দিয়ে বললাম, "ভয় নেই, আমি আপনাদের বাইনারি পুলিশ নই। এমনকি আপনাদের শহরেরও কেউ নই।  বেরিয়ে আসতে পারেন ।"

লোকটা কিছুক্ষণ ইতস্তত করে বেরিয়ে এল। একটা লিকলিকে রোগা লোক। পরনের কাপড়চোপড় দেখে গরীব বলে মনে হয় না। ধড়টাই এরকম। বা কোনও রোগ ব্যাধি আছে। 

হাতের টর্চটা জ্বালিয়ে আমাকে ভালোকরে দেখে নিয়ে লোকটা বলল,"আমার সঙ্গে আসুন। সাবধানে।"

লোকটা এগিয়ে চলল ঘরের আরও ভেতরের দিকে। ঘরের একদম শেষ কক্ষের মেঝের উপর দেওয়ালের ধারে একটা আলমারি। আলমারির দরজাটা খুলতেই দেখা গেল একটা গর্ত । গর্তটার উপর টর্চের আলো ফেলে লোকটা বলল, "নামুন।" 

আমি একটা পাথরের সিঁড়ি দিয়ে নেমে এলাম। আমার পেছন পেছন লোকটা নেমে এল। নিচে একটা বেশ বড় মাপের ঘর। আলো জ্বালল লোকটা। কার্বাইড ল্যাম্প। গোটা ঘরটায় ইতস্তত ছড়িয়ে রয়েছে তার, সির্কিটবোর্ড আর যন্ত্রপাতি। একপাশে একটা বিছানা। যা বুঝলাম বর্তমানে এটাই লোকটার নিভৃতবাস। 

বিছানায় বসলাম। লোকটাও বসল। এবার মুখ খুলল লোকটা। 

"আপনি তাহলে বাইনারি পুলিশের হাত হতে পালিয়েছেন। কি করেছিলেন ?" 

ইতিপূর্ব সমস্ত ঘটনা খুলে বললাম। সব শোনার পর একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলল লোকটা। বলল, "ওহ্, এই ব্যাপার। কিন্তু এই শহর হতে বেরোবেন কিভাবে ? কিছু ভেবেছেন ?"

বললাম, "সিস্টেমের মধ্যে কোনও একটা বাগ পেলে একবার চেষ্টা করে দেখতে পারি। কিন্তু নিশ্ছদ্র এই ব্যবস্থা।"

লোকটা কি যেন ভাবতে লাগল। কি একটা জটিল হিসেব করে বলল, "আচ্ছা প্রফেসর, আপনি তো ফিজিক্সের অধ্যাপক, তাই না ?"

-"ফিজিক্স, কেমিস্ট্রি আর আয়ুর্বেদ। তিনটি বিষয়েই পিএইচডি আছে আমার।"

-"আচ্ছা বলুন তো গোটা শহরে আলো থাকলেও আমার বাড়িতে নেই কেন ?"

-"সিস্টেম ফল্ট।"

-"ঠিক। সিস্টেম ফল্ট। তবে কোনও দূর্ঘটনাবশত নয়, এটা আমার দীর্ঘ সাধনার ফল। তবে সমস্তটা বুঝতে গেলে গোটা ঘটনাটা শুনতে হবে। "

বললাম,"বলুন, আমি শুনতে চাই।"

লোকটা শুরু করল।

"আজ হতে বছর চারেক আগের ঘটনা। আমি তখন হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের সফটওয়্যার ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের অ্যাসোসিয়েট প্রফেসর। খুব শীঘ্রই পদোন্নতি হয়ে প্রফেসর হয়ে যাওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে । আর তখন ডঃ সিলভার ম্যাকার্থির নাম ছাত্র-ছাত্রী হতে সফটওয়্যার জগতের সবার কাছেই একটা ঊজ্জ্বল নাম। কিন্তু কখনও একচুলও দাম্ভিকতা আমাকে পেয়ে বসেনি । 

সংসারে আমার স্ত্রী ক্যাথরিন আর একছেলে রবার্ট। বেশ কেটে যাচ্ছিল দিনগুলো। কিন্তু সে সুখ বেশিদিন সইল না। একদিন একটা বিজ্ঞাপন দেখলাম। সোসাল নেটওয়ার্কিং সাইটে বিজ্ঞাপন দিয়েছেন জনৈক চক্রবাল চক্রধর। একটা সফটওয়্যার প্রজেক্টের জন্য সফটওয়্যার ইঞ্জিনিয়ার দরকার।"

ডঃ ম্যাকার্থিকে থামিয়ে দিয়ে বললাম,"এ কি সেই চক্রবাল চক্রধর যে এই শহরটার ডিজাইন করেছে ? যদি তাই হয় তবে ভদ্রলোকের সঙ্গে আমার মুলাকাত হয়েছে। তাও আবার জেলখানাতে।"

ডঃ ম্যাকার্থির মুখে একটা হাসির রেখা খেলে গেল। বললেন,"উচিত শাস্তি পেয়েছে চক্রবাল। সমস্ত পরিকল্পনাটা ওরই। আমি শুধু বাস্তবায়িত করেছি মাত্র। আর করবই না বা কেন, টাকার প্রয়োজন ছিল আমার। বড়লোক হওয়ার একটা সুপ্ত ইচ্ছা আমার মধ্যে ছিল। তাই সহজেই প্রলুব্ধ হলাম। বেশ মোটা টাকার কাজ। ওরা যে পরিমাণ টাকা দেবে তা আমি সারাজীবন চাকরি করেও ইনকাম করতে পারব না। সুতরাং গিয়ে হাজির হলাম ভদ্রলোকের কাছে।

চক্রবালের পরিকল্পনা শুনে খানিকটা অবাক হয়েই গিয়েছিলাম। কিন্তু একজন সফটওয়্যার ইঞ্জিনিয়ার হিসেবে এই কাজে আমার আপত্তি থাকার কথা নয়। একটা নতুন কিছু করতে পারব ভেবে উত্তেজনায় ছটফট করছিলাম।

কিছুদিনের মধ্যেই বুঝলাম চক্রবাল লোকটা সুবিধার নয়। যেখানে যেখানে আমার আপত্তি সেখানেই হুইপ জারি করে সে। আমার আপত্তি টেকে না। আমি চেয়েছিলাম সিস্টেমের মধ্যে কিছু বাগ রাখতে, যাতে সিস্টেম যদি নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যায় তাহলে তাকে ওই পথেই কন্ট্রোল করা যাবে। কিন্তু তাতেও আপত্তি চক্রবালের । সে স্পষ্ট করেই বলল, "তুমি নিজের মতো যা খুশি করতে পার না। প্রজেক্টটা তোমার নয়। এটা আমার প্রজেক্ট। আমি টাকা ঢেলেছি এতে।"

আমি চক্রবালকে উপেক্ষা করেই কিছু বাগ ভরে দিলাম সিস্টেমে। কিন্তু চক্রবালও এ বিষয়ে একজন দক্ষ লোক, সে সহজেই সনাক্ত করে ফেলল বাগগুলোকে। আমাকে বলল ওই ডিবাগিং করতে। আমি রাজি হলাম না।

কিন্তু রাজি করানোর অনেকরম  কৌশলই চক্রবালের জানা। সে আমার ছেলে রবার্টকে অপহরণ করল। আমি তবুও রাজি হলাম না। তখন সে শুরু করল নিজের মতো করে। ডিবাগিং করতে শুরু করল। আর এদিকে আমি আর রবার্ট বন্দি হলাম এই জগতে। তবে চক্রবাল আমাকে সম্মান দিয়েছে। বন্দি জীবন যাপন করতে হয়নি। সে আমাকে রেখেছে গৃহবন্দি করে। কারন এই সিস্টেমের কিছু হলে মেরামত করার মতো লোক একমাত্র আমিই আছি।"

ডঃ ম্যাকার্থির কথায় একটা আশার আলো খুঁজে পেলাম। বললাম,"যে বাগগুলো আপনি রেখেছিলেন তাদের আইডেন্টিফাই করতে পারবেন ? মানে তাদের মধ্যে এক আধটা যদি এখনও থাকে।"

একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে ডঃ ম্যাকার্থি বললেন,"খুব কঠিন কাজ। প্রথমত ওগুলোকে খুঁজে বের করতে হলে 'মাস্টার কি' আর ইউজার আইডি দরকার। এতদিনের পরিশ্রমে আমি ইজার আইডিটা বের করতে সক্ষম হয়েছি। 'binarytown'। কিন্তু মাস্টার-কি এখনো পাইনি। কিছু ক্রিটিকাল বাগ আমি ফিজিকালি ইনপুট করেছি। সফলও, তবে বেশিক্ষণ টিকবে বলে মনে হয় না। আমারই তৈরি 'ক্রিটিকাল ইঞ্জিনিয়ার' রা খুঁজে বেড়াচ্ছে বাগটিকে।"

-"হুমম্... ওরা কিছু করার আগেই আমাদের একটা কিছু করতে হবে। আসুন একটু হেল্প করুন।"

আমি এগিয়ে গেলাম কম্পিউটারের যুগে। ডঃ ম্যাকার্থি কতগুলো পেনড্রাইভ নিয়ে এল। বলল,"এগুলোতে আমার তৈরি কিছু হ্যাকিং প্রোগ্রাম আছে। আশাকরি এগুলো আপনার কাজে লাগবে।"

প্রায় দশঘন্টা কেটে গেল। দশঘন্টার অক্লান্ত পরিশ্রমে উদ্ধার করলাম বাইনারি শহরের মাস্টার-কি। ডঃ ম্যাকার্থি জড়িয়ে ধরলেন আমাকে। বললেন, "আপনি করে দেখিয়েছেন প্রফেসর। এতদিন কেবল প্রফেসর লোমহর্ষণের নামই শুনে এসেছি, আজ বাস্তবে দেখলাম আপনার প্রতিভা। এবার দেখুন আমি কি করি।"

ডঃ ম্যাকার্থি বসলেন কম্পিউটারে। তার প্রথম কাজই হল মাস্টার-কি বদল। কিন্তু সেখানেই বাধল সমস্যা। পরপর তিনখানা সিকিউরিটি প্রশ্ন। ম্যাকার্থি ঘেমে নেয়ে প্রায় অস্থির।

প্রথম প্রশ্ন হল, সিস্টেমের নিরাপত্তার পক্ষে সবচেয়ে বিপজ্জনক কে ?

বললাম,"আমরা যারা বন্দি বা গৃহবন্দি আছি তারাই সিস্টেমের পক্ষে বিপজ্জনক। এটা না হলে কখনোই আমাদের বন্দি করা হত না।"

ডঃ ম্যাকার্থি বললেন, "ঠিক। আমি পর আমাদের নামগুলো দিয়ে দেখছি।"

প্রথমেই ডঃ ম্যাকার্থি নিজের নামটা ইনপুট করলেন। কিচ্ছু হল না। চক্রবালের নামটাও বিপজ্জনক নয়। এরপর ম্যাকার্থি ইনপুট করল আমার নাম। সঙ্গে সঙ্গে সিস্টেম জানান দিল যে উত্তর সঠিক। মানে এই সিস্টেমের পক্ষে সবচেয়ে বিপজ্জনক আমি।

এরপর দ্বিতীয় প্রশ্ন, বাইনারি সিস্টেমে কি ভৌতিক কিছুকে বন্দি করা যায় ?

আমি বললাম, "কখনোই সম্ভব না।"

ম্যাকার্থি বললেন, "সম্ভব। কারন আমরা সবাই রক্তমাংসের। এতক্ষণ ধরে ভাবছেন যে আপনি একটা সত্তা মাত্র, তা কিন্তু নয়। আপনি সশরীরেই এসেছেন।"

ম্যাকার্থি 'হ্যাঁ' লিখলেন। আর উত্তর সঠিকও হল। আমি যথেষ্টই অবাক হলাম। আর্থার তো বলেছিল যে সে আমার সত্তাকে নিয়ে যাচ্ছে ওর বাইনারি দুনিয়ায়।

তৃতীয় প্রশ্ন, সিস্টেমের প্রশাসক মারা গেলে কি হবে ?"

হেসে বললাম, "যার মাথায় এমন দুর্বুদ্ধি আসে সে কি সহজে মরতে চায়। ওর 'সিউডো কপি' এই বাইনারি শহরে আসবে সম্রাট হয়ে।"

আমার উত্তরই সত্যি হল। ডঃ ম্যাকার্থি পেরিয়ে গেলেন সিকিউরিটি ওয়াল। খুব সহজেই পরিবর্তন মাস্টার-কি।

এরপর শুরু হল আমাদের খেলা। একে একে মুক্ত করা হল সব লোককে। বাইনারি শহরের নিয়মের বেড়াজাল হতে। রবার্টকেও পাওয়া গেল। চক্রবালকে বেঁধে নিয়ে চললাম আমাদের পৃথিবীতে।

আমাকে দেখেই অবাক হয়ে গেল আর্থার। বলল, "লোমহর্ষণ, তুমি এখানে ?"

-"কেন আমি ফিরে না এলে কি খুশি হতে ?" আমি ব্যঙ্গের স্বরে বললাম।

আর্থার আমতা আমতা করে বলল, "আসলে সিস্টেমটা ঠিকঠাক কাজ করছে না। তাই ভাবলাম ওখানে যদি কোনও অসুবিধা হচ্ছে তোমার... সারারাত ঘুমোতে পারিনি।"

-"তোমার ঘুম আমি হারাম করে দেব শয়তান !" চেঁচিয়ে উঠল চক্রবাল। "তুমি আমাকে দিয়ে নিজের কার্যসিদ্ধি করে আজ সাধু সেজে বসে আছ !"

চক্রবালের দিকে তাকিয়ে নির্লিপ্তমুখে আর্থার বলল,"কি আবোল তাবোল বলছেন আপনি ! কস্মিনকালেও চিনি না আপনাকে। বিশ্বাস কর লোমহর্ষণ। মিথ্যে কথা বলছে এই চক্রবাল।"

আমি কিছু বলার আগেই বাঁধন ছিঁড়ে আর্থারের উপর লাফিয়ে পড়ল চক্রবাল। গলা টিপে ধরল আর্থারের। সহসা এই আক্রমণে কিছুক্ষণের জন্য হকচকিয়ে গিয়েছিল আর্থার, কিন্তু সম্বিত ফিরে পেতেই এক ঝটকায় চক্রবালকে মাটিতে ফেলে দিয়ে পিস্তল বের করল সে। চক্রবালের মাথায় পিস্তল ঠেকিয়ে বলল, "যা করেছি বেশ করেছি। তোকে আর এই তোর দলবলকে আমি পিঁপড়ের মতো টিপে মারব।"

ও ট্রিগারে চাপ দিতেই আমি ঝাঁপিয়ে পড়লাম। লক্ষ্যভ্রষ্ট হয়ে গুলি গিয়ে লাগল দেওয়ালে টাঙানো আর্থারের প্রতিকৃতিতে । আর আমার ধাক্কায় আর্থার গিয়ে পড়ল ম্যাগনেটিক রিসিভারের উপর।  সঙ্গে সঙ্গে ডঃ ম্যাকার্থি ছুটে গেল কম্পিউটারের দিকে। কিবোর্ডের একটা বাটন চাপতেই আর্থারের দেহখানা চলে গেল গুঁড়ো গুঁড়ো হয়ে ঢুকে যেতে লাগল রিসিভারে। আর্থার চলে গেল বাইনারি শহরে। যেখানে রয়েছে শূন্য আর একের অমোঘ সব নিয়ম, যা মানবিকতার ধার ধারে না।

                  -----

Joydeb Biswas

Poet Joydeb Biswas studied Bengali literature. In 2015, at the age of 22, he published 'Sahitya Chetona' magazine. Currently two editions of the magazine are published. One is the online version and the other is the printed version. He is the founder and editor of the two editions. facebook twitter youtube instagram whatsapp

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

নবীনতর পূর্বতন