শীতের ছুটিতে
নারায়ণী দত্ত
বিরাট কারুকার্য করা পালঙ্ক , পরিপাটি করে গোছানো বিছানা ৷ নায়েব মশাই মশারিটা টাঙিয়ে দিয়ে গেছে ৷ একটু তন্দ্রা এসেছিল কিন্তু মাঝ রাতে হঠাৎ নীচের ঘর থেকে ছমছম নূপুরের শব্দ শোনা গেল তার সাথে হারমোনিয়াম বাজিয়ে কে যেন গাইছে ৷ মনে হচ্ছে নীচের বৈঠকখানা থেকে আওয়াজ আসছে ৷ ঘুম ভেঙে গেল ওদের ৷ কে যেন লাঠি ঠকঠক করে ওদের ঘরের সামনে দিয়ে চলে গেল ৷ তিনজন ভয়ে জড়সড় হয়ে বসে পড়ল ৷ হঠাৎ দুম করে একটা আওয়াজে ওরা আঁতকে উঠল ৷
অলঙ্করণ : বিশ্বজিৎ মণ্ডল |
হরি, অশোক আর রাজা প্রাণের তিন বন্ধু ৷ একসাথে কলেজে পড়ে ৷ একবার শীতের ছুটিতে ওরা ঠিক করল রাজার মামারবাড়ি (জমিদার বাড়ি ) ঘুরতে যাবে দেবগ্রামে ৷ রাজার মা গত হবার পর আর মামারবাড়ি যায়নি ৷ খোঁজ খবর ও রাখে না ৷ মামারবাড়িতে দাদু দিদা ছাড়া আর কেউ নেই ৷ নায়েবমশাই সব দেখাশোনা করেন ৷ তাই নায়েবকে রাজা চিঠি লিখে জানিয়ে দিল ওরা তিনজন যাবে কয়েকদিন থাকবে ৷ তখন গ্রামে ফোনের চল ছিল না ৷
নির্দিষ্ট দিনে তিন বন্ধু ট্রেনে চেপে বসল ৷ দেবগ্রামে যখন ওরা পৌঁছাল তখন রাত প্রায় ১০ টা ৷ ট্রেন ৩ ঘন্টা লেট ছিল ৷ স্টেশনে নেমে ওরা এদিক ওদিক তাকালো কাউকে দেখতে পেল না ৷ পাড়াগাঁয় সন্ধ্যে হলেই সব ঘরে ঢুকে যায় তার ওপর মাঘ মাসের কনকনে ঠান্ডা ৷ তিনজন মাফলারটা ভালো করে কান গলায় জড়িয়ে কাঁপতে কাঁপতে টর্চ হাতে নিয়ে এগিয়ে চলল ৷ কিছুটা হাঁটার পর দেখল একটা গরুর গাড়ি ক্যাঁচ ক্যাঁচ শব্দে এগিয়ে আসছে ৷ গাড়িটা ধীরে ধীরে ওদের সামনে এসে দাঁড়াল ৷ একজন বৃদ্ধ লোক জোরে ডেকে বল্ল ... ও নাতি উঠে এস তোমরা ... ৷ রাজা বলল ..কে নায়েব দাদু ? লোকটা বলল ..হ্যাঁ গো ৷ তিনজন উঠে বসল গাড়িতে ৷ রাজা বলল ... তুমি আমায় ঠিক চিনতে পেরেছো তো ? লোকটা ... হাহা হা হা করে বিকট হেসে উঠল ৷ তিন বন্ধু চমকে উঠল ৷
গাড়ি এগিয়ে চলল ক্যাঁচ ক্যাঁচ শব্দে ৷ খানিকবাদে একটা বিশাল পোড়ো বাড়ির সামনে এসে থামল ৷
সবাই নেমে বাড়ির ভেতর ঢুকল বিশাল বড় গেট দিয়ে ৷ সামনে বড় বাগান সেখানে লন্ঠনের আলোতে অস্পষ্টভাবে দেখা গেল বড় বড় মার্বেলের মূর্তি ৷ সদর দরজা দিয়ে ঢুকে নায়েব ওদের দোতলায় নিয়ে গেল ৷ রাজা অধীর আগ্রহে বলল ... দিদা , দাদু কোথায় ?
পাশের একটা ঘর থেকে ঘোমটা দিয়ে মুখ ঢাকা একজন বৃদ্ধা এসে কাঁপা কাঁপা গলায় বললেন ...এই তো আমি দাদুভাই ৷ এতকাল পর এই বুড়ো বুড়িদের মনে পড়ল ? রাজা হেসে উত্তর দিল ... পড়ার ভীষণ চাপ তো তাই আসা হয় না ৷ দিদা বললেন ...ও .. বুজেছি .. বুজেছি ৷ রাজা দিদাকে প্রণাম করতে গেল করার সময় দিদার পা-টা মনে হল ঠান্ডা কনকনে , কারেন্টের মত লাগল ৷ অশোক, হরি ওদের ও প্রণাম করার সময় একই অবস্হা ৷ দাদু ও এসে দাঁড়ালেন ৷ দাদুর পায়ে প্রণাম করতে গিয়ে অস্পষ্ট আলোয় মনে হল পা-টা উল্টো ৷ ওরা চমকে উঠল ৷ ভয়ে বুক শুকিয়ে গেল তিনজনের ৷ ঘরে গিয়ে এ ব্যাপারে আলোচনা করতে যাচ্ছিল ঠিক সেইসময় বড় থালা চাপা দিয়ে খাবার নিয়ে হাজির নায়েব মশাই আর দিদা ৷ রাজা কৌতুহল চাপতে না পেরে বলল ... দিদা তোমার মুখটা দেখাবে না ? দিদা চুপ করে রইল ৷ নায়েব বলল ... আগে খেয়ে নাও তোমরা খোঁকাবাবু ৷ বড্ড খিদেও পেয়েছিল ওদের তাই ওরা সব ভুলে তাড়াতাড়ি হাত ধুয়ে খেতে বসে গেল ৷ পেট ভরে খেয়ে ঘুমোতে গেল কিন্তু কেন জানিনা কারো আর ঘুম আসলো না ৷ অশোক বলল ... রাজা আমার খুব ভয় লাগছে রে ৷ হরি বলল ... হ্যাঁ রে রাজা ৷ বাড়িটা কেমন যেন ৷ গা ছমছমে ৷ চল ফিরে যাই আমরা ৷ গ্রামে থাকার সাধ আমার মিটে গেছে ৷ রাজা বলল ... আরে ভয় কিসের ? এখন ঘুমা কাল সকালে গ্রামটা ভালো করে ঘুরবো ৷ কথা শেষ করে তিনজন কম্বল চাপা দিয়ে খাটে শুয়ে পরল তিনজন ৷ বিরাট কারুকার্য করা পালঙ্ক , পরিপাটি করে গোছানো বিছানা ৷ নায়েব মশাই মশারিটা টাঙিয়ে দিয়ে গেছে ৷ একটু তন্দ্রা এসেছিল কিন্তু মাঝ রাতে হঠাৎ নীচের ঘর থেকে ছমছম নূপুরের শব্দ শোনা গেল তার সাথে হারমোনিয়াম বাজিয়ে কে যেন গাইছে ৷ মনে হচ্ছে নীচের বৈঠকখানা থেকে আওয়াজ আসছে ৷ ঘুম ভেঙে গেল ওদের ৷ কে যেন লাঠি ঠকঠক করে ওদের ঘরের সামনে দিয়ে চলে গেল ৷ তিনজন ভয়ে জড়সড় হয়ে বসে পড়ল ৷ হঠাৎ দুম করে একটা আওয়াজে ওরা আঁতকে উঠল ৷ একটা কালো বেড়াল চোখ দুটো জ্বল জ্বল করছে , ঘরের টেবিল থেকে লাফ দিয়ে নেমে দরজার ফাঁক দিয়ে বেরিয়ে গেল ওদের আরও ভয় লেগে গেল কারণ ওদের বেশ মনে আছে ওরা দরজায় ছিটকিনি দিয়ে শুয়েছিল ৷ হরি কাঁদো কাঁদো সুরে বলল ... রাজা তোর মামারবাড়িতে কি ভূত আছে ? রাজার গলাও শুকিয়ে গেছে এসব দেখে ৷ বলল ... কি জানি ! অশোক বলল .. ভাই আমি কাল ভোরেই বাড়ি চলে যাব ৷ কথাটা শেষ হতে না হতে লণ্ঠনের আলোটা দপ্ করে নিভে গেল ৷ মনে হল ঘরের ভেতর কে যেন বিকট শব্দে হা হা হা হা করে হাসছে আর নাকেসুরে বলছে .. এ বাড়িতে কেউ আসলে আর যেতে পারে না রে ৷ এদিকে বাইরে তখন মুষলধারায় বৃষ্টি পড়ছে ৷ রাজা দুই বন্ধুকে বলল .. চল এখনই আমাদের পালাতে হবে ৷ হরি বলল ...এতবৃষ্টিতে কোথায় যাব ? ভাই ঠিক বাড়িতেই এসেছি তো আমরা ? রাজা বলল ..আর কথা না বাড়িয়ে চল দৌড়ে পালাই এ বাড়ি থেকে এখনই বেরাতে হবে ৷ এই বলে তিনজন ছুটতে লাগল ৷ অন্ধকার বাড়িটায় মনে হল কারা ওদের পেছনে তাড়া করছে ৷ অশোক হুমড়ি খেয়ে পড়ে গেল , হরি অশোককে টেনে তুলে আবার ছুটতে লাগল ৷ ছুটতে ছুটতে তিনজন একটা বড় শক্ত কাঠে হোঁচট খেয়ে পড়ে জ্ঞান হারাল ৷ ভোরবেলা কিছু লোকজন জমিদার বাড়ির বাইরে ওদের পড়ে থাকতে দেখে ,ওদের চোখে মুখে জল ছিটিয়ে জ্ঞান ফেরাল ৷ তারপর ওদের থেকে সব ঘটনা শুনে বলল ... রাজা তোমার দাদু দিদা ও নায়েব তিন জন বছর দুয়েক আগেই মারা গেছেন কলেরায় ৷ তোমাদের কোন ঠিকানা খুঁজে পাই নি আমরা তাই জানাতে পারিনি ৷ তারপর থেকে ওটা ভূতের বাড়ি হয়ে আছে ৷ বিকেলের পর থেকে এমন সব বিকট শব্দ শোনা যায় , ভৌতিক কান্ড হয় তাই ভয়ে কেউ যেতে পারেনা ৷ তোমাদের ভাগ্য ভাল প্রাণে বেঁচে গেছো ৷ রাজা তুমি এ বাড়ির নাতি বলে হয়তো প্রাণে মারেনি তোমাদের কাউকে ৷ বেঁচে গেছো ৷ গ্রামের মোড়ল বললেন ... আমার বাড়িতে খাওয়া দাওয়া করে তোমরা বাড়ি ফিরে যাও এখানে আর থেকো না ৷৷