1 / 7
2 / 7
3 / 7
4 / 7
5 / 7
6 / 7
7 / 7

গল্প • রূপোলী সময়– নন্দিতা পাল

 • ছোট গল্প


রুপোলী সময়

 নন্দিতা পাল


আমরা ক'জন মেয়ে ঘর খুঁজতে গিয়ে হাড়েহাড়ে উপলব্ধি করলাম, সেই খবরের কাগজে পড়া ‘কেন শুধু মেয়েরা বাড়িভাড়া পাবে না’ সেই অসহ্য উক্তি গুলো। একের পর এক খারিজ করে দিচ্ছে ঐ শিবের মত বাড়িওয়ালারা। রেগে তখন ফেটে পড়ছে মন, কিন্তু উপায় তো বার করতে হবে।


অলঙ্করণ : বিশ্বজিৎ মণ্ডল



সেদিন স্বপ্নে দেখলাম আমার সেই রুপোলী ঝকঝকে দিনগুলো উড়িষ্যার। একঝাক প্রজাপতি দেশের বিভিন্ন জায়গা থেকে যেন একসাথে। তারুণ্যের অফুরান শক্তি,  স্বপ্নে তাজমহল গড়ি আমরা তখন, আর পৃথিবী বদলে দেওয়া যেতেই পারে এই বিশ্বাস তো রয়েইছে। সেই পাঁচমাথার পাহাড়ে গিয়ে দেখলাম সে এক কর্মকাণ্ড। সেই  পাহাড়্গুলোর মাটির নীচে একের পর এক পরত, একী ! সাদা রুপোর খোঁজ রয়েছে মাটি থেকে তিন নম্বর পরতে। ঐ ঠাণ্ডা হাওয়ায়, পাহাড় জুড়ে সেই অবাককাণ্ড দেখলাম আর বুঝলাম ‘মাটি টাকা আর টাকা মাটি’ যেন সত্যি মাটিতে। সন্ধ্যের হাত ধরেই প্রায় রাত চলে আসত ঐ পাহাড়ে। একটু অসুবিধা হলেও ধীরে ধীরে এই শান্ত, সুন্দর আর ঠান্ডা জায়গাটা ভারী প্রিয় হয়ে গেলো। এখনো মনে আছে একদিন রাতে লোডশেডিং, একে ঠান্ডা তাতে বৃষ্টি। আমরা দলবেঁধে ভুতের গল্প শুনে শুয়েছি, আর মাঝ রাতে টুকটাক খুটখাট শব্দ। আমাদের কিছুতেই ঘুম আসছে না। সারারাত ভয়ে কাঁটা হয়ে ছিলাম আমরা ঘরে তিনজন। সকালে যখন জানলাম নাইট ডিউটিতে মিস্ত্রি জলের কাজ করছিল, তখন অবশ্য আমাদের ভীষণ বীরপুরুষের মত হাবভাব।


এরপর আমরা গেলাম একটি আশ্চর্য জায়গায় সেখানে বিশাল পটে ভর্তি ভর্তি গলা সাদা রূপো তৈরি হয় ! এই জায়গাটা একদম চড়া মেজাজের, দিনরাতের মাথা সবসময় গরম! সেবার মনে আছে এক দুদিন প্রায় ৫০ ডিগ্রি ছিল। উড়িষ্যার একটি দারুণ খাবার হল পক্ষারো, গরম ভাতকে পান্তা করে দই দিয়ে একটা খাবার আর ঐ চড়া মেজাজের দিনগুলোতে খাবার পর, চোখ খুলে রাখা যে কি কঠিন। সেইখানে  প্রথম থাকলাম অফিস কলোনিতে। অফিসের কাজের অনুসারে থাকার কোয়ার্টার গুলো সাজানো। শহরটির প্রায় পুরোটাই ছিল এই কলোনি, খুব সুন্দর করে সাজানো। অফিসার লেন একদিকে, ম্যনেজার রা একদিকে আর বাকীরা অন্যদিকে। পরে মনে হত, এই চোখে আঙ্গুল দিয়ে ভাগাভগি টা না থাকলেই বোধহয় ভালো হত। কারণ কিছু কিছু লোকেরা এই ভাগ গুলোকে ঠিক মত নিতে পারে না। অনেক কাজ শিখেছি এখানে, বিজ্ঞান কি করে মাটি থেকে চকচকে রুপো বানাচ্ছে সেই পুরো পদ্ধতি। পুরো শরীর ঢাকা মোটা জিনসের জামা পরে, মাথা আর মুখ হেলমেটে ঢেকে, ঐ বিশাল পটের পেটের মধ্যে ঢুকেছি, দেখেছি কি জাদু আছে ওর মধ্যে যে এই অসাধ্য কাজ করে চলেছে। সাদা রুপো তো হল, এবার তাদের মান কতটা, সেই বুঝে তাদের বিভিন্ন প্রক্রিয়া শুরু হবে। ল্যাবে  মান বের করা সেও এক অদ্ভুদ শেখা। কোথায় কোন দেশে, বিদেশে এত এত সাদা রুপো যাবে, কিভাবে যাবে তার জন্য শিখলাম প্রোগ্রাম, শিখলাম সাপ্লাই চেন, পরিচয় হল লজিস্টিকসের সাথে প্রথম। এসব অভিজ্ঞতা এ জীবনে ভুলব না। যেমনি প্রচুর কাজ করেছি, শিখেছি অনেক।


আর তেমনি ছুটির দিনের আনন্দ ছিল অনেক। একবার এক অনুস্থানে, যার সাথে ডুয়েট গাইব, তার যেমনি মেজাজ তেমন চড়া সি শার্প, আর আমি টেনেটুনে বি ফ্ল্যাট। সেই রিহার্সাল, সাথে বড়সড় গানের যন্ত্র, আর এই সি শার্প আর বি ফ্ল্যাটের টানাটানি। ছাড়ার পাত্রী নই, টানাটানির চলল বেশ কদিন। প্রোগ্রামের আগের দিন গলা আর পারল না, একদম ক্লান্ত হয়ে বসে পড়ল। মাথায় হাত আমাদের দলের, একে হাতে গোনা মেয়ে স্বর দলে! মনে আছে, সেই বিকেল থেকে আমার গারগেল, গরম জল খাওয়া,  গলা পেঁচিয়ে রাখা। একটু পর পর দলের বন্ধুরা খবর নিয়ে যাচ্ছে আর ইশারায় উত্তর দিছি। তারপর সেই সন্ধ্যায়, দুরুদুরু বুকে বি ফ্ল্যাট শুরু করল, সি শার্প তখন একটু যত্নে বি ফ্ল্যাটকে সাহায্য করতে লাগল, সবাই দেখল গানে গানে একটা সুন্দর সন্ধ্যা, সেদিন একটি ওড়িয়া গান ও গেয়েছিলাম ‘রুপা সগরীরে সুনহা কনিয়া’ যার অর্থ হল, রুপার সাগরে সোনার মেয়ে।


একটু একটু করে আমরা এগিয়ে গেলাম আর একটি ধাপ। ট্রেনিং শেষ হয়ে এল, এবার প্রজাপতির দল আলাদা হবার পালা। কেউ পাহাড়ে, কেউ সেই চড়া মেজাজের জায়গায় আর আমরা কজন এলাম শিবের দেশ ভুবনেশ্বরে। আমরা ক'জন মেয়ে ঘর খুঁজতে গিয়ে হাড়েহাড়ে উপলব্ধি করলাম, সেই খবরের কাগজে পড়া ‘কেন শুধু মেয়েরা বাড়িভাড়া পাবে না’ সেই অসহ্য উক্তি গুলো। একের পর এক খারিজ করে দিচ্ছে ঐ শিবের মত বাড়িওয়ালারা। রেগে তখন ফেটে পড়ছে মন, কিন্তু উপায় তো বার করতে হবে।  একজন আমাদের দলের স্থানীয় মেয়ে, ওর মা দুর্গার মত এলেন আমাকে সঙ্গে করে নিয়ে গেলেন বাড়িওয়ালার কাছে। বললেন আমি দায়িত্ব নিচ্ছি এই মেয়েদের, এরা সব এই রুপোর অফিসে কাজ করে। সুরসুর করে রাজী হয়ে গেল শিব বাড়িওয়ালা। এরপর আর এক নতুন অধ্যায় শুরু হল কাজের। ম্যনেজমেন্ট কথাটা তখন বইতে পড়েছি, কাছ থেকে বুঝতে আরম্ভ করলাম, তার কত রকম ব্যপার। সাদা রুপো তৈরি হবার পর বছরের পর বছর বিক্রি কিভাবে হবে, কিভাবে আগে থেকে বোঝা যাবে কত রুপো তৈরি করতে হবে। কাজ করতে করতে আরও জানার ইচ্ছে তৈরি হল যা এগিয়ে নিয়ে গেল আমায় আর এক শহরে।


সময়ের ফাঁকে বেশ ক'বার গিয়েছি মহাসমুদ্রের কাছে, সাদা ফেনার অবিরাম ঢেউ  যেন শ্রী জগন্নাথদেবের পায়ের কাছে এসে যেন প্রণাম করছে। তাঁর আশীর্বাদে আমার পথ চলা, তাই বারেবারে গিয়েছি তাঁর কাছে সেই ঝকঝকে রুপোলী দিনের টানে।

Joydeb Biswas

Poet Joydeb Biswas studied Bengali literature. In 2015, at the age of 22, he published 'Sahitya Chetona' magazine. Currently two editions of the magazine are published. One is the online version and the other is the printed version. He is the founder and editor of the two editions. facebook twitter youtube instagram whatsapp

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

নবীনতর পূর্বতন