• প্রবন্ধ
একজন দ্রষ্টা, একজন মেধাবী কবি : অমিতেশ মাইতি
কবি অমিতেশ মাইতি |
নারী ও পুরুষের মধ্যে গড়ে ওঠে প্রকাশ্যে বা গোপনে কত বোঝাপড়া। তৈরি হয় কত সম্পর্কের সমীকরণ।কত নামে একে অপরকে ডেকে ওঠে।একে অপরের কাছাকাছি থাকতে চায় কখন-বা সচেতন দূরত্বে। প্রায় একই অনুষঙ্গে আমরা পড়ব ''তিমিরবরণ প্রতীক যখন''। একজন প্রেমিক পুরুষ জানেন যে ভেসে যাওয়ার মধ্যে রয়েছে অনিশ্চয়তা কিন্তু রোমাঞ্চ। এই ভেসে যাওয়াই সবচেয়ে সুন্দর। সেই রহস্যময় সৌন্দর্যকে কখন জ্যোৎস্নার মধ্যে কখন নারীর মধ্যে অনুসন্ধান করেন কবি। –লিখেছেন সুমন ব্যানার্জী
১.
ফরাসি কবি Arthur Rimbaud তাঁর অগ্রজ কবি বোদল্যের'র উদ্দেশে বলেছিলেন যে - সত্যের দ্রষ্টা, কবিদের রাজা।কবি আসলে দ্রষ্টাই তো। চর্মচক্ষে দেখা নয়, অন্তর্দৃষ্টি দিয়ে দেখা।একরকমের অন্তহীন আত্মানুসন্ধানই কবিকে পৃথক করে। কবি অমিতেশ মাইতি এমনই একজন কবি যিনি দ্রষ্টা। আর দ্রষ্টা বলেই তো জীবনের শাশ্বত কথাগুলো এত অবলীলায় লিখতে পারেন।কখন তাঁর কাব্যভাষা হয়েছে ছুরির ফালার মত শানিত, তীক্ষ্ণ কখন উতল, নিমগ্ন, কী আশ্চর্য মায়াঘন।এত মেধাবী, মরমী ও নির্মেদ কবিতা ক'জন কবি লিখতে পেরেছেন বাংলায় ! অথচ প্রচারের আলোর বৃত্ত থেকে অনেকটা দূরেই থাকলেন।
২.
কবি জানেন যে জীবন ও মায়াবিশ্বের মূলে রয়েছে বিষাদ। আমৃত্যু মানুষের প্রতিটি কাজ এমনকি যা কিছু সুখের বা আনন্দের তারও মূলে রয়েছে দংশনক্ষত, অপ্রাপ্তি। তিনি জানেন এই পৃথিবীর বাইরে কোন আধিদৈবিক জগত দৃশ্যগোচর নয়।প্রতিটি সৃষ্টিই কম বেশি রক্তাক্ত করে, আবিষ্কারক জানেন প্রতিটি অভিযাত্রাই এক রকমের অনিশ্চয়তা।তবুও তো এগিয়ে যেতে হবে পরিশ্রুত সোনালি আলোর খোঁজে -
" আমার কোন বাণী নেই, মহৎ কোন পথের সন্ধান নেই / নেই কোন দারিদ্র মোচনের গান / শুধু অসহায়তা অন্ধকারে তুচ্ছতম এই জীবনের মূলে জল দিয়ে যাওয়া। /... আসলে তুচ্ছ কিছু পরমায়ু ছাড়া এ জীবনে আর কিছু পাইনি।''
প্রগাঢ় অভিমান বুকে নিয়ে তিনি আরও এগোতে চান।নদী,অরণ্য, সমুদ্র,পর্বত,শ্যামলাদেশ সহ অপার বিস্ময়ের মুখোমুখি হতে চান -
" অবশেষে এক আশ্চর্য দেশে পৌঁছে যাই, জলাভূমির দেশ।/ সেখানে ভারী বাতাস / মৃত্যুর বিষাদ ও অনুরাগ কাঁপছে সেখানকার আকাশে / কখনো অন্ধকার চমকে দিয়ে জ্বলে উঠছে ফসফরাস...এই সংকটেও নারীর শরীর বসন্তের উৎসব ডেকে আনে / তার চোখে ঠোঁটে চুলে কিংবা ঘামের মুকুলে / যে সৌন্দর্য -/ আমি নিমেষের জন্য সন্ন্যাসী হয়ে হারিয়ে যাই তার মেদে ও বারুদে।''
১৯৯৮ খৃঃ -তে প্রকাশিত হয় "ধাত্রীরা লেখে জাতককাহিনি''। কোথাও কোন বন্ধন নেই।একরকম উদাসী,উতল হাওয়া বইছে চারিদিকে।কবি লেখেন - "অস্ত্রের ব্যবহার করতে করতে মানুষই একসময় / অস্ত্রের চেয়ে মারাত্মক হয়ে ওঠে।''
১৯৯৯ খৃঃ -তে প্রকাশিত "এই দাহ এই প্রণয়চিহ্ন'' এক আশ্চর্য সুন্দর কাব্য। নারী ও পুরুষের মধ্যে গড়ে ওঠে প্রকাশ্যে বা গোপনে কত বোঝাপড়া। তৈরি হয় কত সম্পর্কের সমীকরণ।কত নামে একে অপরকে ডেকে ওঠে।একে অপরের কাছাকাছি থাকতে চায় কখন-বা সচেতন দূরত্বে।প্রায় একই অনুষঙ্গে আমরা পড়ব ''তিমিরবরণ প্রতীক যখন''। একজন প্রেমিক পুরুষ জানেন যে ভেসে যাওয়ার মধ্যে রয়েছে অনিশ্চয়তা কিন্তু রোমাঞ্চ।এই ভেসে যাওয়াই সবচেয়ে সুন্দর।সেই রহস্যময় সৌন্দর্যকে কখন জ্যোৎস্নার মধ্যে কখন নারীর মধ্যে অনুসন্ধান করেন কবি।এই যেকোন মুহূর্তেই আসে মৃত্যুর ভ্রূকুটি।তবু সে এগিয়ে যায়।প্রেম ও মৃত্যু দুইই রহস্যময় এবং একে অপরের পরিপূরক ও বটে।সেই অমোঘ পঙক্তি আমরা পাই - 'সেই অসমাপ্ত চুম্বন থেকেই গল্পটা শুরু হতে পারে'।যা কিছু অসমাপ্ত তা থেকেই অপ্রাপ্তিজনিত আক্ষেপ।আর তার জন্যই আজন্ম প্রতীক্ষা। 'আমাদের ভিতরে কথা বলছিলাম আমরাই অপরূপ বেদনার বীজ ঢেলে দিয়েছিল কুসুমে।' নারী ও পুরুষ একে অপরের মধ্যে কত বেদনাকে কত আনন্দকে ঢেলে দেয়।অহরহ চলে এক অব্যক্ত টানাপোড়েন। একজন কবি বা শিল্পীর মনে এই বেদনা থেকেই ফুল ফুটে ওঠে।যার গন্ধ ছড়িয়ে পড়ে অক্ষরে অক্ষরে।
৩.
"মায়াশিকলের গান" যে কাব্যে রয়েছে একজন অভিমানী কিশোর।সে উদাসী গীতল বাউল মনের অধিকারী। ভোররাতে অসুখের নৌকায় চেপে সে চাঁদের পিছু নেয় তীব্র বাঁচার লোভে।তাকে দেখে মনে হয় সে পৃথিবীর কেউ নয়। পৌঁছে যায় জলাভূমির দেশে কারুর জন্য প্রতীক্ষা নিয়ে - ''আবহাওয়ার কথা কিছু বলা যায় না। মেয়েদের কথাও।'' শরীর ও মনে জমে ক্লান্তি।তবু জিভে লেগে থাকে আপেলের স্বাদ।তিনি নিঃসঙ্গ হয়ে পড়েন। মৃত্যু শোক,বিষণ্ণতা, অভিমান তাঁকে গ্রাস করে -
"এই কি জন্মের সুখ ? এই কি হিসেব মতো বুঝে নেওয়া ?/ একটা জনম আলোছায়া খেলা, বিবর্ণ চিঠি, শিশির জমানো ?/ আহা রাত, আহা নিষ্ঠুর প্রপাত, স্বপ্ন নয় -- আগুনের পাহাড় দেখাও / চাঁদ নয় আমি তার পদতলে নৌকা ভেড়াবো, সব খেলার অবশেষ।'' ('পাথর, তাই')
অন্যদিকে এই গ্রন্থে তিনি ধরতে চেয়েছেন ইতিহাস ও সমাজের এক মোড় ফেরি ক্রান্তিকালকে। নব্বইয়ের দশকের মধ্যবর্তী সময়কাল থেকে মুক্ত বা খোলা বাজার অর্থনীতির হাত ধরে সমাজ, সংস্কৃতি ও রাজনীতির খোলনলচেগুলো বদলাতে শুরু করে।'খেলা' কবিতায় লিখছেন - "কোনো পুষ্পবৃষ্টি নয়-ছাই শুধু / ছাই ঝড়ে পড়ে, ধূসর হয় জনগণতন্ত্রের মুখ।''
তিনি আঁকড়ে ধরতে চান ফেলে আসা অতীতের স্মৃতিকে - "বৃষ্টি থেকে তুমি একদিন অক্ষর খুঁজে পেয়েছিলেন / নদী থেকে চিনেছিলেন পঙক্তির বিন্যাস।''। মধ্যবিত্ত বাঙালি জীবনের চেনা ছন্দ তখন ধীরে ধীরে বদলাচ্ছে, বাঙালি জীবন বের হতে চাইছে পুরনো অভ্যাস থেকে।একান্নবর্তী পরিবার,প্রথম যৌবনের প্রেমের উচ্ছ্বাস,প্রকৃতি লগ্নতার নানান ছবি ছড়িয়ে রয়েছে তাঁর কবিতা জুড়ে।এমনই একটি অসামান্য কবিতা 'হারমোনিয়াম' - "তবু হারানো সমস্ত সুর এখনও বুকে করে / কোনোমতে বেঁচে আছে ভাঙা হারমোনিয়াম / তার প্রতিটি রীডে স্তব্ধ উচ্চারণ / এখন অনেক গান অনেক সুর অনেক স্বরলিপি / ভিড় করে আসে / অনেক ধুলো অনেক আরশোলা / এখনও যদি একবার গেয়ে উঠতে পারে, জানি / জলের অতল থেকে বিদ্যুৎবেগে উঠে এসে / তুমিও একইভাবে বেজে উঠবে আবার / তোমার মায়াবী ঘুম ভেঙে যাবে / ডানা মেলে উড়ে যাবে মেঘের সরগমে।''
হারমোনিয়াম একটি সাংস্কৃতিক প্রতীক।সেই ঊনবিংশ শতক থেকে গানের এই সাধারণ যন্ত্রটি আমাদের দেশে আসে ঔপনিবেশিক শাসকদের হাত ধরেই।প্রায় প্রত্যেক মধ্যবিত্ত বাঙালি পরিবারেই গানের জন্য এই বাদ্যযন্ত্রটি থাকত।বিকেল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত গান রেওয়াজের নানান সুর ও স্বর ভেসে আসত পাড়াগুলি থেকে। কিন্তু আজ সেই প্রবণতা ধীরে ধীরে বদলে যাচ্ছে।তার বদলে আসছে বিনোদনের অন্য মাধ্যম।ঘরের এক কোণে পড়ে থাকে সেই হারমোনিয়াম - 'তবু হারানো সমস্ত সুর বুকে করে বেঁচে আছে ভাঙা হারমোনিয়াম।'
৪.
"বাংলা বাজার'' এই পর্বেরই একটি গুরুত্বপূর্ণ কাব্য। মধ্যবিত্ত বাঙালি নাগরিক জীবনের বদলে যাওয়া ও নতুন সময়ের চিহ্নগুলো রয়েছে এই কাব্যেও।জমে যাওয়া ধুলোর আচ্ছাদন সরিয়ে ছুঁয়ে দেখতে ও অনুভব করতে চাইছেন স্মৃতিচিহ্নের তাপকে - " বইতে ধুলো পড়বে, রান্নাঘর নোংরা হবে / আলমারি ও তাকে জমেছে ধুলো - এটাই সংগত। " এই কাব্যের একটি উল্লেখযোগ্য কবিতা হল 'ওয়াশিং মেশিন' -
''আজ একটি পরিচ্ছন্ন সমাজ / প্রশাসন পৃথিবীর স্বপ্ন দেখে / ময়লা মগজ থেকে পাপ ও রক্তের দাগ / সে নিজের মতো করে ধুয়ে মুছে তৃপ্ত হতে চায় / এ স্বপ্ন অনেকেরই অনেক দিনের / সবাই ঘুমোলে নিজের ছায়াকে সাক্ষী রেখে / আমিও ভক্তের প্রণত ভঙ্গিতে / ওয়াশিং মেশিনের কাছে যাই / গিয়ে বসি / কাঁদি।''
আসলে 'ওয়াশিং মেশিন', 'ভ্যাকুয়াম ক্লিনার'-র মত শব্দবন্ধগুলি ঢুকে পড়েছিল বাঙালির গার্হস্থ্য জীবনের অভিধানে।শ্লেষ,বিদ্রুপ মিশে আছে কবিতায়। পুঁজিবাজারে যখন গোটা সমাজকে আচ্ছন্ন করছে,অর্থনীতি ও রাজনীতিকে ক্রমশ গ্রাস করছে তখন তার অনিবার্য অভিঘাত এসে ভেঙে দিচ্ছে সমাজ জীবনের মূল্যবোধের গ্রন্থিকে।একরকমের আপোসকামিতা,অর্থলেলুপতাই যেন জীবনের প্রধান চালিকাশক্তি হয়ে উঠছে।
নারী ও পুরুষের যৌন সম্বন্ধের সমীকরণগুলো অমিতেশ'র কবিতায় এক অনন্য সৌন্দর্য নিয়ে ফুটে উঠেছে।একজন মধ্যবিত্ত মনস্ক যুবকের চোখে প্রেমের ছবি যেভাবে ফুটে ওঠে , মনের মধ্যে স্বপ্ন,অনুরাগ,বিরহবেদনাজাত অভিমান,অপ্রাপ্তি এবং অবশ্যই স্মৃতি মিলে মিশে যেভাবে কল্পনার স্ফুলিঙ্গকে জ্বালিয়ে দেয় অমিতেশের কবিতা ঠিক তেমন। ওঁর কবিতার মধ্যে রয়েছে একরকমের নির্মেদ স্বচ্ছতা ও স্পষ্টতা।পুরোনো স্মৃতির নক্সীকাঁথাকে অবলম্বন করে অথচ তা খুব বেশি মেদুর নয় -
"আমরা খুব ভালো আছি, ভালো আছি এই সংশয়ে।/এই সংশয়ের আবর্তে দাঁড়িয়ে / নদীর জলে আজও তর্পণ, জবাকুসুম ভাসে।''
''এখন হৃদয়ে কোনো শোক নেই খরা নেই / বিরহের ফুল ফোটে একা...''।
''শিয়রের কাছে মেঘ জমে আছে খুব / কখন ও বৃষ্টি হবে দুজনের মধ্যবর্তী শোকে।''
"যে লিখেছে আত্মজীবন / লিখেছে মৃত্যুর প্রতিবেদন।''