কবি অপর্ণা বসু'র একগুচ্ছ কবিতা
কবি অপর্ণা বসু'র জন্মস্থান দমদম। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে দর্শনে এম.এ। এক সময় আকাশবাণীর সাথে যুক্ত ছিলেন। বিভিন্ন মুদ্রিত ও অনলাইন পত্রিকায় নিয়মিত কবিতা লেখেন। তাঁর প্রিয় কবি রেইনার মারিয়া রিলকে।
কবি অপর্ণা বসু |
কবি অপর্ণা বসু'র একগুচ্ছ কবিতা প্রকাশ করা হল :
শস্যভূমি
***
আলোমাখানো ঐশ্বর্যে ভরপুর শস্যভূমি
ম ম ঘ্রাণে মুগ্ধ নবান্নআকাশ
মাস পোহালে সেই আবার উদাস
নিরাভরণ ধূ ধূ
তখন সমস্ত জুড়ে শূন্য নেই নেই হাহাকার
কোন জন্মগন্ধ নেই
কোন ঢেউ খেলানো স্বপ্ন নেই
শুধু বিলিয়ে দেওয়া শুধু পরিণত হওয়া
এক অবধারিত রূপান্তর সেখানে
তবু সাফল্য আর হাহাকার জড়িয়ে খাঁ খাঁ পড়ে থাকে
একটা ধারাবাহিক সূচনা ও সমাপ্তির গল্প।
প্রতিরোধ
***
প্রতিরোধ শিখে গেলে
জলাশয়ের পাশে খুলে রাখি বিষণ্ণতা
অপবাদ কে আর ভয় পাই না
অকারণে আকাশ ভাল লাগে
মেঘমেদুর বিকেলের স্বপ্ন দেখি
প্রতিরোধ শিখে গেলে
একান্ত যাপনে কেমন নিজস্ব হই
দ্বিচারিতার আড়াল ভেঙ্গে
বেপরোয়া বাতাস হই
ঝোড়ো হাওয়ায় এলোমেলো করি
সমস্ত গোপন না
প্রতিরোধ শিখে গেলে
আবার নতুন করে বেঁচে উঠি।
নদী এবং নারী
***
নদী ও নারী ফেলে আসে
দুই পারের নরম সবুজ মায়া
টুকরো বিষাদ তুলতুলে আদর
গড়িয়ে যাওয়া গল্প কাহিনী
শৈশবের দামাল গন্ধ যৌবনের অবুঝ আবেগ
কূল ছাপানো গানে অসংখ্য দিনরাত্রি পেরিয়ে
জোয়ার ভাঁটার দুলে
নিজস্ব কলনাদে মুখরিত হতে হতে
অজস্র বাঁক পেরিয়ে পরিনত হয়েও
শেষে পারাবারের বুকেই আশ্রয় খোঁজে
নিজের চড়াই উতরাইয়ের উপাখ্যান শোনায়
সেই অকূলপাথারেই হারায় নিজেকে ।
জঙ্গল
***
বরাবরই তুমি আমার কাঁধে বন্দুক রেখে
নৃশংস জঙ্গল পেরিয়েছ
গভীর জঙ্গলের নরখাদকেরা
মুখব্যাদান করে দাঁড়ালে
তুমি সসম্ভ্রমে সরে গিয়ে
আমাকে দাঁড় করিয়েছ ওদের মুখোমুখি
ওরা কামড়েছে চিবিয়েছে
মাংস ফালা করেছে
তুমি নিরাপদ দূরত্বে দাঁড়িয়ে নির্বাক চেয়ে থেকেছো
যন্ত্রণাবিদ্ধ আমি উদ্ধারের আশায়
প্রাণপণ ঈশ্বরকে স্মরণ করেছি
ওরা উল্লাসে মেতেছে
রক্ত চেটেছে লকলকে জিভে
গর্জনে ভরিয়ে তুলেছে চারপাশ
আর ততই তুমি সেঁধিয়েছ আরও অন্ধকারে
বাকি পড়ে থাকা অসহায় আমি
ভেসে গেছি প্রতিবার ।
শপথ
***
গোপন অবসাদ
বিষাদস্তর সরিয়ে ফণা তোলে
তার ঋজু ও অবধারিত দেহ
ঘিরে রাখে আমাকে রাত্রিদিন
আমার দৃষ্টি জুড়ে থৈ থৈ বৃষ্টি
কলসগাত্রে ফুটে ওঠা বুদ বুদের মতো
অসংখ্য অভিমান আমার অলিন্দে
কণ্ঠ ব্যথায় ম্লান ও ছিন্ন
তবু ঝাপসা হতে হতেই
আমি শপথ নিই
এসব কিছু উপেক্ষা করার।
শব্দ
***
শব্দবন্ধের আওয়াজে
পেলব আস্তরণ খসে গেলে
অন্তরালের নির্মম পাথর বেরিয়ে আসে
তখন অন্য পৃথিবী
তখন আকাশের গায়ে ভেসে থাকা চাঁদ
মৃত ও পানসে কাহিনী শোনায়
ধারালো বর্শায় ফালা ফালা হয় সান্ধ্যপদাবলী
অক্ষরসমষ্টির বিন্যাস আঁকে মর্মান্তিক মৃত্যুদৃশ্য
আত্মনিবেদনের শীৎকার মাখা রাতের জমজমে গাঢ় অন্ধকার
বিপ্রলাপে ঘোলাটে হয়ে ওঠে
অতর্কিতে ছোঁড়া শত শত শব্দকুচি
নিমেষেই রক্তাক্ত করে তোলে মল্লিকাবন।
শিকার
***
রাত বাড়ছে ক্রমশঃ
দ্রুত হাঁটতে হাঁটতে আমি পেরিয়ে যাচ্ছি
অন্ধকার ডাঙ্গাপাড়া ধু ধু হেমন্তমাঠ
নির্জন চৌধুরীমোড় বাঁকানদীর কাঠের সেতু
ইদ্রিশচাচার টিনের চালাঘর
কেউ কোত্থাও নেই
শুধু থেকে থেকে ঠাণ্ডা বাতাস বইছে
আর তাতে মিশে যাচ্ছে আমার পায়ের শব্দ
আকাশে অষ্টমীর ফ্যাকাসে চাঁদ
আবছা নির্জন রাত তাকে গিলতে চাইছে
আমি চলছি খুব দ্রুত
আমার আওয়াজ মাড়িয়ে
ভেসে উঠছে আরও শব্দ
এবার আমি ছুটছি প্রাণপণ ছুটছি
শরীর অবসন্ন হয়ে আসছে
পা দুটো জড়িয়ে যাচ্ছে
তবু ছুটে চলেছি ক্লান্ত হরিণীর মতো
শীতের অন্ধকারে নরম মাংসের লোভে
পিছু নিয়েছে একদল হিংস্র পশু।
আঁশটে
***
ভাঙ্গা কাঁচের গন্ধে
অকস্মাৎ জেগে উঠি
আমাকে থরে থরে ঘেরে
যন্ত্রণার হলুদ কণ্ঠনালী
যুগপৎ সেজে ওঠে খড়গ ও হাড়িকাঠ
হাতবদলের শব্দ ভেসে আসে
অপমান ভাসে প্রতি করতলে
তবু নাভিকুণ্ডের জন্মবৃত্তান্তে শিরা বেয়ে নামে রক্তঋণ
সম্পর্ক মরে গেলেও
তার আঁশটে গন্ধ লেগে থাকে।
পালক
***
ওষ্ঠ চুম্বনে আঁকা রক্তদাগে
রাত্রিদিন রক্তাক্ত হতে হতে
বৃষ্টিমাখা অস্পষ্ট দু'চোখে
বিলাসী মিহিন ছায়া ফুরিয়ে গেলে
অকস্মাৎ অন্ধকারের বিহ্বলতা নামে
ঝাপসা হয়ে আসা সকাল গুলো যখন আরও বিষণ্ণ হয়
তুমি তখনও হার মানো না
প্রাণপণে লড়াই কর
বুক দিয়ে আগলাও একমাত্র প্রাণ
এভাবেই বেঁচে ওঠো প্রতিদিন
তোমার ক্যারিশমা দেখে অবাক দুনিয়া
বাধ্য হয়ে পাগড়িতে গুঁজে দেয়
কয়েকটা রংবেরঙের পালক।
শীত
***
শীতকালীন অধিবেশন চলছে
রোদে পিঠ দিয়ে কবিতাপাঠ
বড় বড় টাওয়ারের মাথায় ঝুলন্ত আকাশ
গরম কফির কাপে লম্বা লম্বা সশব্দ চুমুক
ইনডোর প্ল্যান্টের টবে বাদামী মাটির গন্ধ
ডাইনিং টেবিল আলো করে আছে কমলার টুকরি
কিচেন থেকে চমৎকার গন্ধ ভেসে আসছে
রেসিপি বুক অনুযায়ী ওভেনে তৈরি হচ্ছে কেক
সকলেই উপভোগ করছে নিজস্ব শব্দবন্ধ
অনেকদিন পর আবার শহর জুড়ে শীত এসেছে।