1 / 7
2 / 7
3 / 7
4 / 7
5 / 7
6 / 7
7 / 7

প্রদীপ গুপ্তের ধারাবাহিক উপন্যাস 'বাউল রাজা | পঞ্চবিংশতি পর্ব

 বাউল রাজা 

প্রদীপ গুপ্ত

দ্বিতীয় খন্ড  ( পঞ্চবিংশ পর্ব ) 

দিককার মাটির বাড়িগুলোতে জানালা নেই বললেই চলে। ছোট্ট একটা খোলা জায়গায় বাঁশের কঞ্চি গেঁথে রাখা আছে। জানালায় কোনো পাল্লা নেই। ভেতরের দিকে, যাতে বৃষ্টির ছাঁট না আসে, এক টুকরো প্লাস্টিকের চাদর দিয়ে সেই জানালাটাকে ঢেকে রাখা আছে। মোটা মাটির দেওয়ালে ওইটুকু ফাঁক গলে সূর্যের আলোই ঢুকতে পারে না, চাঁদের তো একেবারেই নয়। 

ঘুম আসছে না কিছুতেই। দু'চোখের পাতা বন্ধ করলেই সারাটাদিনের ঘটনাগুলো এক এক করে ভেসে উঠছে। জীবনে এরকম ঘটনাবহুল দিন বুঝি এর আগে কখনো আসে নি। 

অন্ধকারময় ঘরের একমাত্র প্রাণস্পন্দন বলতে যা বোঝায়, সেটা দরজা। দিনের বেলা ওই দরজাই এ ঘরের সাথে আলোর পরিচয় করিয়ে দেয়। বাইরেকার আবছায়া আলো এসে কৃপাপ্রার্থীর মতো আঁচল বিছিয়ে দাঁড়িয়ে আছে।


 আকাশে শুক্লা অষ্টমীর  চাঁদ জানান দিচ্ছে যে, এ রাত বড়ো মোহময়। নিঃশব্দে বিছানা ছেড়ে উঠে দাঁড়ালাম। কারো ঘুম না ভাঙে এভাবে পা টিপে টিপে উঠোনের সিঁড়ি যেখানে দাওয়ায় এসে মিশেছে, সেখানে আকাশের দিকে মুখ তুলে বসলাম।


শীত আর কুয়াশার ভেতর একটা অদ্ভুত সুন্দর প্রেমের সম্পর্ক আছে। এই মুহূর্তে পশমিনা চাদরের মতো হালকা একটা শীতের আমেজে ছেয়ে আছে পৃথিবী। সে পশমিনা চাদরের রঙ যদি হয় দুধনীল তাহলে গাছের মাথায়, সবজি ক্ষেতে বা সীমানার চৌহদ্দির বাঁশের বেড়ায় যে কুয়াশা চাদরের মতো জড়িয়ে আছে, তারও রঙ মায়াবী নীল। সে কুয়াশার গায়ে চাঁদের আলো এসে পড়ায় সে নীলে বেশ একটা সূক্ষ্ম সূক্তির ঘোর লেগেছে যেন। 

এ পাড়ার অলিতে গলিতে বাউলের বাস। ছোটোবেলার একটা স্মৃতি মনে এলো। তখন আমি সবেমাত্র বালক। পুজোর পর পাশের পাড়ায় জলসা হচ্ছে, দাদা দিদিরা সবাই সেই জলসা শুনতে গেছে। সেটাও সম্ভবত কার্তিক মাস। বেশ রাত। মায়ের কোল ঘেঁষে বারান্দার সিঁড়িতে বসে আছি।  উঠোনের কুল, পেয়ারা, কামিনী, বাতাবীর পাতায় পাতায় জড়িয়ে আছে এরকমই হাল্কা পশমিনা কুয়াশা, আর দূর থেকে হাল্কা ভেসে আসছে সেই জলসার গান। 

কোনও বাউল একা একা দোতারার তারে তার ব্যাকুলতা ছড়িয়ে দিয়েছে সেই কুয়াশার শরীরে। কাঁদছেন কি? এত আকুলতা, এ বুঝি একমাত্র বাউল গানেই সম্ভব। দূর থেকে ভেসে আসা সুরে, যেখানে কথা এসে পৌঁছোচ্ছে না, শুধুমাত্র ধ্বনির অস্পষ্ট অবয়ব, সে মূর্ছনায় কান্না মেশে কীভাবে? সে সুরধ্বনির সুতো ধরে বাউলনি যেন এসে সামনে দাঁড়ালো। তার দুচোখ ভরা সেই কাতর দৃষ্টি। --" তুমি একেনে আর এসো নি গো ঠাকুর --- " কতোটা ভালোবাসার বাঁধনে বাঁধা পড়লে মানুষ তার ভালোবাসাকে এভাবে বলতে পারে ! আমি কি সত্যি ছেলেমানুষ? প্রেমের যে চোরা স্রোত, সে স্রোতে ভেসে চলেছি? এ কি সাবধানবাণী?  না কি এক ভীত, সন্ত্রস্ত প্রেমিকের আকুল দীর্ঘশ্বাসের কাতরতা! 

কখন যে আমি সেই ভেসে আসা সুরকে লক্ষ্য করে হাঁটতে শুরু করেছি, কখন যে বাড়ির চৌহদ্দি ছাড়িয়ে রাস্তায় পা রেখেছি, আমি জানি না। না জানা এক উদাসী সুর যেন আমার আমিকে যাদুমন্ত্রে বশ করেছে। 

--" তোমাকে কি নিশিতে পেলো নাকি গো ঠাকুর, বিচানা চেড়ে একা একা রাস্তায় গুরে বেড়াচ্চো কেনে গো? "

আমার গায়ে একটা কাঁথা জড়িয়ে দিয়ে বাউলনি এসে আমার পাশে দাঁড়ালো।

নারী আর আকাশ দুইই নিজেকে ক্ষণে ক্ষণে আশ্চর্যজনক ভাবে বদল করে ফেলতে জানে। বাড়ি থেকে বেরোবার পূর্বমুহূর্তে বাউলনির চোখে যে ছায়া দেখেছিলাম, সে ছায়ার যেন এই মুহূর্তে আর কোনও অস্তিত্ব নেই। কুহকিনী নারী এখন পরম মমতাময়ী। একদম ঠিক যেন মায়ের প্রতিরূপ। 

--" চাদ্দিকে ওষ পড়চে। এরকম শীতভেজা রাত্তিরে গুরে বেড়ানো তোমার ওব্যেস নেই কো। টান্ডা লেইগে জ্বর ওয়ে গেলে কষ্ট অপে। তার চে' গরে চলো। শোবে চলো কেনে গো। "

যে বাউলের গানের সুরে এতোক্ষণ যেন কান্না ঝরে পড়ছিলো, সে সুরটাও যেন নিমেষে পালটে গেছে। এখন আর শুধু সুর নয়, অস্পষ্ট করে কথাও ভেসে আসছে কর্ণকুহরে। লালনের একটা গান ধরেছেন তিনি। এক দুর্বোধ্য হেয়ালির মধ্য দিয়ে কী যে প্রশ্ন রেখেছেন লালন --!

--" আপন ঘরের খপর হয় না

বাঞ্ছা করি পরকে চেনা

লালন বলে কে বা পর ----"


"--- দুবদাদা --"

হঠাৎ করে ধ্রুবদার উল্লেখ করায় চমকে উঠলাম। 

--" কী? ধ্রুবদার কি কিছু --?"

--" সে তো টেরেনে চাইপবার সুময় টিকিটবাবু দইরেচিলো। "

সে কি? এ'রকমটা যে হতে পারে, সে কথা আমার বিলক্ষণ জানা ছিলো। আসার সময় ধ্রুবদার হাতে টাকা দিয়ে আমি পই পই করে বলে এসেছিলাম, যেন টিকিট কেটে ট্রেনে ওঠে। আমি জানতাম, মানে ধারণা ছিলো যে তিনি কিছুতেই টিকিট কাটবেন না। বিনা টিকিটে --

--" ঠাকুর --"

হঠাৎ একটা মন কেমন করা ডাকে ভাবনার সুতো ছিঁড়ল। 

--" দুবদাদা এলি পর তোমাকে আর --" 

--" আমাকে আর কী,  বাউলদিদি? "

--" নাঃ, কিচুই না গো, ও এমনি এমনিই বলে পেলেচি। "


ফের বদলে গেলো বাউলনির মুখ, থমথমে আকাশ। এখুনি যেন বৃষ্টি নামবে। মাথা নীচু করে দাঁড়িয়ে রইলো। 

--- " একটা দিন পুরো তোমার সঙ্গ পেলাম গো ঠাকুর, একটা দিন তো না, যেন একটা বচর। কোত্তেকে যে কীবাবে যে --- "

--" কথা কয় সে প্রাণপাখি

শুনে চুপে চাপে থাকি

জল কি হুতাশন, মাটি কি পবন

কেউ বলে না তারে নির্ণয় করি--


ও আমার ঘরখানাতে কে বিরাজ করে

আমি একদিনও না নাথ দেখলেম তারে

জনম ভরে নাথ না দেখলাম তারে -- "


ঝরঝর করে বৃষ্টি নামলো বাউলনির সর্বাঙ্গ জুড়ে। 

--" আমি সত্যি বলতিচি টাকুর, তুমি আর এ টাঁয়ে এসো না। বরো দুব্বল ওয়ে যাই, মনে লয় তোমার নদী বুজি সাঁতরে পার ওতে পারপো না। তোমার মনের যে কোনও টাঁই কুঁজে পাই না গো, ডুপে যাই, তইলে যাই -- তোমার কাচে এলে মনটা কেন যে বে আব্রু ওয়ে পড়ে আমি -- আমার -- তুমি -- তুমি --"


( চলবে )


Joydeb Biswas

Poet Joydeb Biswas studied Bengali literature. In 2015, at the age of 22, he published 'Sahitya Chetona' magazine. Currently two editions of the magazine are published. One is the online version and the other is the printed version. He is the founder and editor of the two editions. facebook twitter youtube instagram whatsapp

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

নবীনতর পূর্বতন