শুদ্ধসত্ত্ব বসুর সঙ্গে আত্মীয়তার বন্ধনে আবদ্ধ হওয়া গোবিন্দ পান্তির চলমান কবি-জীবনের অন্যতম এক আশীর্বাদ। এরপর দীর্ঘ প্রায় দু'দশক ধ'রে গোবিন্দ পান্তির কাছে কখনো তিনি শিক্ষক, কখনো সমালোচক আবার কখনো বা স্নেহের প্রতিমূর্তি হয়ে তাঁকে আগলে রেখেছেন। পক্ষান্তরে আমরা পেয়েছি আজকের বলিষ্ঠ আধুনিক কবি গোবিন্দ পান্তিকে। সুতরাং আমরা সকলে ড. বসুর কাছে কৃতজ্ঞ। – কবি গোবিন্দ পান্তিকে নিয়ে লিখেছেন জয়ন্ত মণ্ডল
পঞ্চাশের দশকে ছাত্র-জীবনে তাঁর কাঁচা হাতের লেখা কবিতাগুলোর মধ্যে আদর্শ আধুনিক কবিতার অনেক বৈশিষ্ট্য অনুপস্থিত থাকলেও কৈশোরেই তাঁর মধ্যে যে একটা ভাবানুসারী কাব্য-জগৎ তৈরী হয় তা কবিতাগুলি পড়লেই অনুমিত হয়। পঞ্চাশের দশকের শুরুতে রচিত এমনই এক অপ্রকাশিত কবিতা ‘যদি ছবি হ'তে।
"তুমি যদি ছবি হ’তে ভালো হতো
বারবার দেখা হতো। তবু ভাবতাম
চেতনাহীনকে ভালোবাসা অনেক সহজ।
বাধা বিপত্তির কোনো গন্ডী নেই।
মনের সমস্ত মাধুরী ঢেলে বলতাম
যা আজ বলতে পারছি না সংকোচে।
কিন্তু তুমি ছবি নও তাই ভয়।
তোমার চুলের রাজ্যে মৃদু হাওয়া হ'য়ে
দোলা দিতে সাধ হয়।
আলতোভাবে ছুঁয়ে যেতে ইচ্ছে হয়
আঙুলগুলোর মায়াকে।
যতবার নিজেকে সরিয়ে নিতে চাই
ততবার তুমি এসে ভীড় করো মনের প্রান্তদেশে।
ভয়ে-ভয়ে ভাবি তুমি যদি ছবি হ'তে
তবে শোনাতাম আমার কথাগুলো
যা বলাই হবে না কোনোদিন।”
স্বল্প খরচে এই পোর্টালে বিজ্ঞাপনের জন্য যোগাযোগ করুন । হোয়াটস্অ্যাপ : 6295 934 919 নম্বরে ।
আগেই উল্লেখ করেছি কলেজ-জীবনে অজানা প্রেমিকাকে উদ্দেশ্য ক'রে কবি নিয়মিত চিঠি লিখতেন। তখনই একটি রোম্যান্টিক ভাবাবেগের জন্ম হয় তাঁর মধ্যে। তিনি সাহিত্যের ছাত্র, তাই সেই ভাবের সর্বোৎকৃষ্ট বহিঃপ্রকাশের মাধ্যমরূপে কবিতাকেই নির্বাচন করেন তিনি। জীবনানন্দ দাসের সুর-রিয়েলিজম, শক্তি চট্টোপাধ্যায় ও বিষ্ণু দে-র ব্যঞ্জনা তাঁকে প্রবলভাবে প্রভাবিত করে। কবিতার প্রতি অনুরাগ আর একনিষ্ঠ অধ্যবসায়ের প্রতিফলন ঘটতে থাকে তাঁর কবিতায়। ব্যঞ্জনা আর উপমা সৃষ্টিতে বৈপ্লবিক পরিবর্তন আসে তাঁর ষাটের দশকের লেখা কবিতায়। তারই পুরস্কার-স্বরূপ তৎকালীন বিখ্যাত মাসিক পত্রিকা 'শিক্ষক'-এ তাঁর কবিতা 'ডেকো না' প্রথম প্রকাশ পায়।
“কঠোরের অশনি আঘাতে
ধ্বংস হোক্ তোমার উদ্যানবীথি
থেমে যাক ক্লান্ত জীবনের মৃদু শ্বাস।
হে কবি, যদি ভেবে থাকো
কোনো এক মৌনী-প্রদোষে তুমি সার্থক -
ভুল করেছে। রাত্রির নিস্তব্ধতায় শুধু স্বপ্ন আনে।
সন্ধ্যার মোহনীয় লগ্নে চুপি-চুপি যা ভাবা
দিনের আলোয় তা মলিন।
যদি কিছু গান শুনিয়ে থাকো,
যদি ভেবে থাকো সে কোন এক কায়াকে
ভুল করেছে। বাস্তবের ঘোমটা খোলো -
যা দেখবে সে কায়া নয়, অশরীরী।
যে রঙ দেখেছো পলাশে-শিমুলে
সে বিভ্রান্তি।
তোমার মনের রঙে যাকে নিয়ে রচনা করেছো
স্বর্ণ-ধুলির পাহাড় -
সে রঙ কোনো প্রজ্জ্বলিত অগ্নি-শিখার প্রতিফলন,
সে পাহাড় অন্ধকারের রাশ।
শুনেছো কল-কল্লোল; ভেবেছো সাগর ডাকছে -
মোহাবিষ্ট হ'য়ে সাড়া দিয়েছো
কি পেয়েছো ? ধ্বংসমুখী পাহাড়ের ধস নামছে।
তবু সান্ত্বনা পেতে চাও!!
ভাঙা পাঁজরের ব্যথাকে জিজ্ঞাসা করো
সে ফুরিয়ে যেতে চায়।
ক্লান্ত রাত্রি শেষ হ'য়ে আসে
তাকে আর ডেকো না।”
ষাটের দশকের শেষ ও সত্তরের দশকের শুরুতে বালকী হাইস্কুলে শিক্ষকতার সুবাদে পান্তি পরিবারের আর্থিক অবস্থার কিছুটা উন্নতি ঘটে। সে সময় গোবিন্দবাবু নিয়মিতভাবে 'দেশ পত্রিকা’র গ্রাহক ছিলেন। তখনকার স্বনামধন্য আধুনিক কবিদের কবিতা রুটিন-মাফিক পড়তেন তিনি। এলাকার নানা সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে ডাক পেতেন। অন্যান্য কবি ও সাহিত্যিকদের সাথে প্রতিনিয়ত ভাব-বিনিময়ের সুযোগ আসতো। আজীবন শিক্ষানবিশ থাকার অদম্য ইচ্ছে অহংশূন্য মানুষটির কবিত্বশক্তির সামগ্রিক বিকাশের সহায়ক ছিলো । এ সময়েই তাঁর কবিতাগুলো প্রকৃত অর্থে গতানুগতিক নির্মোক ছেড়ে আধুনিকতার পথে অগ্রসর হয়। তাঁর লেখনী আপেক্ষিকতার প্যাঁচে না জড়িয়ে সর্বজনীন শিল্প সৃষ্টিতে উৎসাহিত হয়। তিনি কবিতায় ব্যক্তি-স্বাতন্ত্র্যের মধ্যে ভিন্ন-ভিন্ন আবেদনের সংমিশ্রণ ঘটিয়ে আঙ্গিক বৈচিত্র্যের স্বতন্ত্র ধারাবাহিকতা আনতে সক্ষম হন। জ্ঞাননিষ্ঠ কবি সত্তরের দশকেই শক্তিশালী শিল্প-স্রষ্টাতে উন্নীত হলেন, কেননা শিল্পের মধ্যে সবকিছুকে প্রকাশ করতে পারাই একজন আধুনিক কবির যথার্থ কাজ। এসময়ে গোবিন্দ পান্তির কবিতাগুলো উপমা-ব্যঞ্জনা প্রয়োগে সার্থকতার প্রথম সাক্ষী হ'য়ে থাকবে। অতি কথনের রাশ টেনে ধ'রে, মনের ভাবকে সর্বজনীনতায় প্রসারিত ক'রে, সুললিত কাব্যিক শব্দবন্ধে অতি উচ্চমার্গের আধুনিক কবিতা উপহার দিতে থাকেন তিনি। সত্তরের দশকের বিখ্যাত 'টলিউড' সিনেমা-পত্রিকায় প্রকাশিত তাঁর একটি নিটোল কবিতা 'আহত অভিজ্ঞা' কে দৃষ্টান্ত-স্বরূপ তুলে ধরা যায়
"একটি সাগর অনেক নদীর আশ্রয়,
একটি আকাশে অনেক তারার ঝিলমিল,
একটি হৃদয়ে অনেক সবুজ মৃত্যু।
ক্ষণিকা! তোমার স্পর্ধিত শপথ নির্মম-নিথর।
অতীতের জন্য অনুতাপ নেই -
নেই ভবিষ্যতের জন্য উজ্জ্বল অভিজ্ঞা,
নির্ভরতার অভ্যস্ত-আকাশে উত্তরের হিমগুঁড়ি
আর মরু-হাওয়ার ঢেউ।
উৎসর্জিত হৃদয়ে আশ্বাসের অপমৃত্যু ।
ভাবনার দীনতা দিয়ে নয় -
এ যেন নিটোল বীজের মতো দীপ্ত নির্বাচন।
পৃথিবীর ফুলন্ত যৌবন,
শুভ্র রাতের কণিকা,
সব যেন থিতিয়ে পড়েছে -
মাটি কাঁকর আর ঝরাপাতার বুকের নীচে।
তবু মনে হয়, সোনালী বিকেল থেকে
ধুলোর কলঙ্ক মুছে দিই,
ঘুমন্ত তপোবন ভরিয়ে তুলি উদ্দাম-নৃত্যে,
অসীম শূন্যতায় ছড়িয়ে দিই -
অন্তহীন শব্দের কাকলী।"
কবি গোবিন্দ পান্তি আট ও নয়ের দশকে প্রতিষ্ঠিত কিছু ব্যক্তিত্বের প্রসাদকণা পেয়েছেন। শুকতারা' নামে শিশু মাসিক-পত্রিকার সম্পাদক মধুসূদন মজুমদারের সাহিত্য- চর্চা বিষয়ক উপদেশ, 'শিক্ষক' পত্রিকার সম্পাদক অধ্যাপক মহীতোষ রায় চৌধুরীর জীবনের বহু ক্ষেত্রে বাধা লঙ্ঘন আন্তরিক সাহায্য, বাংলা সাহিত্যের খ্যাতনামা ব্যক্তিত্ব ড. শুদ্ধসত্ত্ববসুর অকৃত্রিম স্নেহ এবং তাঁর সাহিত্য-আলোচনার বিদগ্ধ বাণীর সারবত্তায় গোবিন্দবাবু সমৃদ্ধ হয়েছেন। তাঁর নিজের কথায় - "ড. বসু তো আমার বর্তমান সাহিত্য সৃষ্টির নিঃসন্দিগ্ধ দিগদর্শন।"
নয়ের দশক : আধুনিক কবিতা তার অধিকাংশ মৌলিক সম্পদ নিয়ে গোবিন্দবাবুর লেখনীতে ধরা দিয়েছে। তিনি কোলকাতার মুক্তপত্র', 'সোনারতরী, 'শিক্ষক', 'ভগ্নদূত', কফিহাউস', আগামীকাল', 'ব্রাত্যবার্তা', 'বসুধা', 'টলিউড", 'সাহিত্যরূপা', 'বঙ্গভাষা ও সংস্কৃতি", 'নবহিল্লোল', 'বিপ্লবতীর্থ", 'একজোট", 'প্রান্তিক', 'একক', 'পূরবী' প্রভৃতি শতাধিক পত্র-পত্রিকায় নিয়মিত লিখে চলেছেন। বাংলাদেশ, সুইডেন,আমেরিকা প্রভৃতি দেশে প্রবাসী ভারতীয় সম্পাদক নিয়মিতভাবে তাঁদের পত্রিকায় তাঁর লেখা কবিতা প্রকাশ করেছেন তবু তার মধ্যে আধুনিক উন্নততর কাব্য সম্পর্কে আরও শেখার খিদে এতটুকু কমেনি। আগেই বলেছি, আজীবন নিজেকে শিক্ষানবিশ মনে করতেন তিনি। নিজের দক্ষতাকে আরও বেশি পরিমার্জিত করার লক্ষ্যে ১৯৮৮ সালের ২১শে নভেম্বর তিনি ড. শুদ্ধসত্ত্ববসুর কাছে চিঠি লিখলেন। তিনি আধুনিক কবিতা কি বা কেমন হওয়া উচিৎ ইত্যাদি বিষয়ে জানবার অনুরোধ নিয়ে ড. বসুর মূল্যবান সান্নিধ্যলাভের ইচ্ছে প্রকাশ করলেন। প্রকৃত জুহুরী সোনাকে ঠিকই চিনতে পারেন তা সিন্ধুকে থাকুক বা কয়লার স্তূপে। হ্যাঁ, প্রত্যন্ত গ্রাম গোবিন্দপুরের এই ছেলেটার অদম্য আগ্রহ তাঁকে বিস্মিত করে। ড. বসু শুধুমাত্র বিখ্যাত সাহিত্যিক ও সমালোচক নন, তিনি বড়ো মননের মানুষ, তাই ভবিষ্যতের সম্ভাব্য এই-প্রতিভাকে চিনে নিতে বিন্দুমাত্র ভুল হয়নি তাঁর। ড. বসু প্রতি ইংরেজি মাসের দ্বিতীয় রবিবার নিজ বাড়িতে আয়োজিত সাহিত্যের আসরে গোবিন্দবাবুকে ডেকে পাঠালেন। সেই সঙ্গে কিছু কবিতাও নিয়ে যেতে বললেন।
শুদ্ধসত্ত্ব বসুর সঙ্গে আত্মীয়তার বন্ধনে আবদ্ধ হওয়া গোবিন্দ পান্তির চলমান কবি-জীবনের অন্যতম এক আশীর্বাদ। এরপর দীর্ঘ প্রায় দু'দশক ধ'রে গোবিন্দ পান্তির কাছে কখনো তিনি শিক্ষক, কখনো সমালোচক আবার কখনো বা স্নেহের প্রতিমূর্তি হয়ে তাঁকে আগলে রেখেছেন। পক্ষান্তরে আমরা পেয়েছি আজকের বলিষ্ঠ আধুনিক কবি গোবিন্দ পান্তিকে। সুতরাং আমরা সকলে ড. বসুর কাছে কৃতজ্ঞ।
স্বল্প খরচে এই পোর্টালে বিজ্ঞাপনের জন্য যোগাযোগ করুন । হোয়াটস্অ্যাপ : 6295 934 919 নম্বরে ।
গোবিন্দ পান্তির কাব্য-সাগর স্পর্শ করার পূর্বে পরবর্তী কালে ড. শুদ্ধসত্ত্ব বসু গোবিন্দ পান্তির প্রথম কাব্যগ্রন্থ 'পাহাড়ে আগুন' এর ভূমিকায় সন্তানতুল্য কবিকে যেভাবে মূল্যায়ন করলেন তা তুলে ধরলাম-
"গোবিন্দ পান্তির সম্ভবত; এটি প্রথম কবিতার বই। কিছুকাল যাবৎ ছোটো-বড়ো মাঝারি ধরনের পত্র-পত্রিকায় তাঁর লেখা প্রকাশিত হচ্ছে এবং পাঠক-সমাজে সেসব লেখার সমাদরও হয়েছে। আজকের জটিল জীবনাবর্তে যে ঘূর্ণি চলছে এ গ্রন্থের বহু কবিতায় সেই বিপন্নতার সংকেত আছে। এমনকি প্রেমের মাধুর্যের কথা বলতে গিয়েও কবির মনে অসহ এক বেদনার স্পন্দন অনুভূত হয়েছে। এদিক থেকে গোবিন্দ পান্তি আধুনিক কবি। প্রকরণে যিনি নিজস্ব একটি ভঙ্গি বজায় রেখেছেন যে ভঙ্গিটি প্রচলিত নয়, বা অন্য কোনো দেখানো পথ নয়। শব্দ ব্যবহারে কবির নিজস্বতা পাঠক মাত্রেই লক্ষ্য করবেন। তৎসম ও তদ্ভবের তুল্যমূল্য সমাবেশে কবিতার পঙক্তিগুলি যেনো বাড়তি জোর পেয়েছে। অলংকার ব্যবহারে কবি অকৃপণ ও অকুণ্ঠিত হতে না পারলেও প্রায় প্রতি কবিতায় ইঙ্গিতময়তার দুরাবগাহ ভাব-সম্মোহ সৃষ্টি করেছেন। সহজেই বলা যায়; এ কবি অনুশীলনের মাধ্যমে কালক্রমে বঙ্গ-সাহিত্যের ভাণ্ডারে কাব্যলক্ষ্মীর সেবক হবেন। "
( চলবে....)