1 / 7
2 / 7
3 / 7
4 / 7
5 / 7
6 / 7
7 / 7

আজকের কবি অজিত বাইরী : সাহিত্য চেতনা

 

কবি অজিত বাইরী



সির্জন নদীর তীরবর্তী হুগলি জেলার কনকপুর গ্রামে আমার জন্ম ১৯৪৮ সালে। বাল্যেই মাতৃবিয়োগ। প্রতিপালিত দিদিমার স্নেহচ্ছায়ায়। কল্যাণী বিশ্ববিদ্যালয় থেকে কৃষিতে সাম্মানিক স্নাতক। পশ্চিমবঙ্গ সরকারের কৃষি দপ্তর থেকে উপ- প্রকল্প অধিকর্তার পদে  অবসর গ্রহণ ২০০৮ সালে।

প্রকাশিত গ্রন্থ ৪০টি। কাব্যগ্রন্থ এবং কাব্যসংকলন ৩৪টি, গদ্যগ্রন্থ  ৬টি।

পুরস্কার : ভূপর্যটক রামনাথ বিশ্বাস স্মৃতি সাহিত্য পুরস্কার ( মুম্বাই ) , বাংলাদেশ এবং পশ্চিমবঙ্গ থেকে আরও কিছু পুরস্কার ও সম্মাননা। 


উল্লেখ্য গ্রন্থ: শ্রেষ্ঠ কবিতা, স্বনির্বাচিত কবিতা, আমার আবৃত্তির কবিতা, ভালোবাসার মুখ ( অণু-কবিতার সংকলন ) ও শ্রুতিসন্ধ্যার নক্ষত্র।


কবি অজিত বাইরী'র একগুচ্ছ কবিতা প্রকাশ করা হল :



মঞ্জরির ঘ্রাণ 
      ***



দাঁড়িয়ে  আছো আদিগন্ত শস্যক্ষেতের ভেতর;

মাথার উপর হৈমন্তিক আকাশ

অকাতর বিলিয়ে দিচ্ছে বেলাশেষের আলো।


দাঁড়িয়ে  আছো হরিৎবর্ণ শস্যক্ষেতের ভেতর;

চতুর্দিকে সুপক্ক মঞ্জরির ঘ্রাণ;

অন্নপূর্ণা আঁচল থেকে ভরে দেবেন শূন্য করতল।




পাতা ভাঙার শব্দে  
           ***



পায়ের নিচে ভাঙে শুকনো পাতা,

বহুদিন আসিনি উত্তরবঙ্গে---

এই শাল-পিয়াশালের আবাসভূমিতে।

জঙ্গলের এক অসহ্য মাদকতা আছে,

আছে ভেতরে ভেতরে তীব্র টান; যেমন

চোরাবালি টানে, নিঃশব্দে পায়ের নিচ

থেকে সরে যায় বালি; জঙ্গলের

টানের মধ্যে আছে সেই সম্মোহন,

ক্রমাগত টেনে নেয় অন্ধকার বুকের বিবরে।


রোমাঞ্চ আছে, আতঙ্কও আছে, মাঝে মাঝে

মনে হয়, পিছন থেকে অনুসরণ করছে

কোন ভয়াল জন্তু; সতর্ক হই, শব্দ যেন

না-হয় এ বনভূমে, পাশে নদী, উদম

নারীর মতো শুয়ে আছে, নুড়িতে পা

রেখে পার হই; এই নদীতেই পানের

নিমিত্ত আসে বন্যপ্রাণী, জঙ্গলের পথ

পাতা বিছানো, পা রাখি সন্তর্পণে;

পাতা ভাঙার শব্দে যেন না-ভাঙে নৈশব্দের ঘুম।



বর্ষপঞ্জি  
    ***


নতুন বছর আসে, ভাঁজ খোলে

নবীন কিশলয়ের মতো;

জীবনবৃক্ষ থেকে ঝরে যায় প্রবীণ পাতা---

বুকে নিয়ে স্মৃতির কোরক।


অনন্ত সময়ের খণ্ডমাত্র কাল একটি বছর

মানবেতিহাসে একটি বছরের গুরুত্ব

হয়তো তেমন কিছু নয়; কিন্তু

মহাকালের নিরিখে অতিক্ষুদ্র সময়কালেও

কত বদলে যায় পৃথিবী!


নদীর মতো বাঁক নেয় ইতিহাস;

সমকাল সে বাঁকের পায় না হদিশ

অপেক্ষায় থাকে অনাগত কালের।


বছর আসে, বছর যায়, এভাবেই 

কালের খেয়ায় পার হয় দশক, শতক, সহস্রাব্দ।

মানুষের  আয়ু তো যৎসামান্য

ক্ষণপ্রভা জোনাকির আলোর মতো।


মানুষ  আসে, মানুষ  যায়, ক্রমান্বয় আসা-যাওয়া;

মহাকাল লিখে রাখে বর্ষপঞ্জি

শেষের এবং  শুরুর।



বাড়ি  
 ***


জীবন যখন প্রান্তসীমায়, মনে পড়ে, 

সেই ছায়াবৃত বাড়িটাকে।

বড় উঠোন, দু'দিকে প্রাচীর, প্রাচীর ঘেঁষা ঘোড়ানিম।

একান্নবর্তী পরিবারের  আচ্ছাদন–

এখন পরিত্যক্ত, পোড়োবাড়ি।

বাসিন্দারা যে যার মতো বদল করেছে বাসা।


বাড়িটা কিছুতেই স্মৃতিকে ছাড়ছে না;

ঘোড়ানিমের মাথায়

দেখি আজও তারা ফোটে রাতের।

শুক্লপক্ষে জ্যোৎস্নার বান ডাকে উঠোনে,

হঠাৎ কোন রাতপাখির ডাক

রাত্রিকে করে দেয় উন্মনা।


যা-কিছু করেছি অর্জন জীবনে, স্মৃতিই

শ্রেষ্ঠ অর্জন, আর সব পুরোনো হয়, জীর্ণ হয়---

স্মৃতির জরা নেই; সে আমাকে  চেনায়

জানলার বাইরে একচিলতে আকাশ,

দুপুরের চিল, সির্জনের বুকে পালতোলা নৌকো

আর কামরাঙার মতো ঘন সবুজ পৃথিবী।

 


এ এক আশ্চর্য দেশ  
             ***


এ এক আশ্চর্য দেশ---তস্কর আর লুঠেরাদের

যাদের হাতে লুঠ হয়ে যাচ্ছে

খেত-খামার, বাগান-বাগিচা, বাস্তু

পার্বত্যভূমি, অরণ্য আর কালো হিরের খনি।


লুঠেরাদের জাত ধর্ম আলাদা হয় না;

একটাই জাত, একটাই ধর্ম ওদের।

ছারখার হোক ঘরবাড়ি, হৃদয় হোক পদপৃষ্ট

কী যায় আসে নরাধমদের?


ওরা জানে, পৃথিবী বশীভূত পেশীর আস্ফালনে

যদি রক্ত লাগে, ধুয়ে ফেলবে হাত নদীজলে;

যদি আগুন লাগাতে গিয়ে দু'একটি স্ফুলিঙ্গ

উড়ে আসে, ঝেড়ে ফেলবে গা থেকে।


কারা যেন প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল, সোনায় মুড়ে 

দেবে দেশটাকে; আজ তারা স্বার্থলোভী ধনকুবের।

যত দিন গেল, অপুষ্ট হলো লক্ষ লক্ষ শিশু;

মায়েরা হলো রুগ্ন, চর্মসার,রক্তশূন্য।

গ্রামগুলো ডুবে গেল নিদারুণ দারিদ্রে,

নিরক্ষরতা গ্রাস করলো চন্দ্রভুক রাহুর মতো।


হাঃ, আমার দেশ, তবু আমরা ধরে আছি

গণতন্ত্রের ধ্বজা, পেটে মারুক না লাথি

কেড়ে নিক মাথার উপর ছাউনি আর

কলাইয়ের ডিসে বাসি ঠাণ্ডা দু'মুঠি ভাত।




অজিত বাইরী-র শ্রদ্ধা  নিবেদন প্রয়াত  অভিনেতা এবং কবি সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়কে।


যত দূরে যাও
        ***


যত দূরে যাও, স্মৃতির টান লঘু

হয় না কখনো; আরো আরো জড়িয়ে ধরে।

আজ এসে দাঁড়ালাম সেই পিপুলগাছটির নিচে,

একদিন যার ছায়া জড়িয়ে নিয়েছিল দু'জনকে।


পরিচিত রাস্তাটা আজ খুব  নির্জন মনে হচ্ছে;

সুগভীর শূন্যতা নিয়ে  দাঁড়িয়ে  আছে বাড়িটা---

দূর থেকে দেখি।

বাড়িটাও কী পর হয়ে গেল!


ঝরা-পাতার উপর পা ফেলে কেউ

গেছে এই পথে, চারিদিকে অবিমিশ্র শূন্যতা।

এই যাওয়া কি প্রকৃত যাওয়া?

না কি স্মৃতির আগল দিয়ে অতীত-বর্তমানকে

আষ্টেপৃষ্ঠে আগলে রাখা?


সব যাওয়া, যাওয়া নয়, কারো কারো ফেরা;

পার্থিব জীবন থেকে বৃহত্তর জীবনের কাছে।



বোঝা  
   ***


ঘামে ভেজা মুখ, কুচোকাঠের বোঝা

মাথায়; জঙ্গলের ভেতর থেকে

হাঁটা পথ ধরেছে গ্রামের দিকে,

পায়ে পায়ে ফিরবে অনেকটা পথ।


মাথার উপর গনগন করছে সূর্য

পায়ের নিচে তেতে আছে মাটি,

কপাল চুইয়ে ঝরছে ফোঁটা ফোঁটা ঘাম।

কুচোকাঠে উনুন জ্বলবে, উনুনে সেদ্ধ

হবে জঙ্গল থেকে সংগৃহীত কন্দের মূল।


মেয়েটি হাঁটছে, বোঝার ভারে ন্যুব্জ

ঘাড় ফেরাবার ফুরসত নেই।

কুচোকাঠে উনুন জ্বলে, সঙ্গে সঙ্গে

জ্বলে তার বুকের উনুন, সে উনুনে

ছাই হয়ে যায় স্বপ্ন, ইচ্ছে,কামনা।


সে ভালবাসা, প্রেম-পিরিতি জানে না;

জানে শুধু ভোর ভোর বেরিয়ে

কুচোকাঠের বোঝা নিয়ে বাড়ি ফেরা।

ফেরার পথে যে মরদের সঙ্গে দেখা,

শুধোয়, কি গো মেয়ে, ঘাড় ঘুরিয়ে

দেখছো না কেন, কেমন সুন্দর

পশ্চিম আকাশে লেগেছে রঙের ছটা?


মেয়েটি ক্লিষ্ট হেসে বলে, মাথার

বোঝাটা নামিয়ে দাও যদি,

তবে একবার আকাশটাকে দেখি।



তির  
 ***


বিদ্ধ কর, বিদ্ধ কর আমাকে তির;

ক্ষরিত হোক রক্ত, ক্ষরিত রক্ত

দুই করপুটে নিয়ে দেখি,

রক্তে কতখানি মিশে আছে বিষ!


গরল করেছি পান; কিন্তু নীলকণ্ঠ

হতে পারিনি, বরং সে-বিষের দহন

চারিয়ে গিয়েছে সময়ের শিরায় শিরায়।

মানুষে মানুষে এত রেষারেষি, হিংসা, দ্বেষ---

পশুর সামরাজ্যেও বিরল, দুষ্কর।


কোন্ ক্লেদময় নরকে নামছি আমরা?

শব ঘিরে শিবা নয়, নরের উল্লাস!

আমাকে বিদ্ধ কর, বিদ্ধ কর তির;

একবার শির তুলে বলি, বাঁচতে চাই

মানুষের  মতো, আমাকে বাঁচতে দাও;

আমার  দু'হাতে দাও বিশল্যকরণী।


তার আগে নিষ্কাশিত হোক কলুষ-রক্ত;

বিদ্ধ কর, বিদ্ধ কর আমাকে তির।




এক জীবন  
     ***


কাগজ কলম সঙ্গী করে কাটিয়ে দিলাম

একটি একটি করে পঞ্চাশটি বছর।

সম্পদ বলতে মাথা গোঁজার মধ্যবিত্ত ঠাঁই 

আর খান দুই আলমারি ভর্তি বই।


ভাবি, আমার অবর্তমানে বইগুলি কী

প্রয়োজনে লাগবে কারো? নইলে নিছক জঞ্জাল;

ধুলো পড়ে, মাকড়শার জালে জড়িয়ে 

আলমারি বোঝাই হয়ে থাকবে অহেতুক।


যাবার আগে নিজের হাতেই তাকগুলি 

খালি করে যাব? এত বছর ধরে, এত যত্নে

জঞ্জালই জমিয়েছি শুধু?

ভবিষ্যৎ প্রজন্মের উদাসীনতা থেকে বাঁচাতে

তাক হতে একটি একটি বই নামাই,

স্নেহপরবশ হয়ে ভাঁজ করে রাখি আবার।


ক্রেতা সানন্দে নিয়ে  যায় পুরোনো সঞ্চয়;

দেখি, তাকগুলি তাকিয়ে  আছে শূন্য দৃষ্টিতে;

সেখানে জমাট বেঁধে আছে বহু যুগের অন্ধকার।


মনে মনে ভাবি একদিন ছিল মহার্ঘ, নশ্বর

জীবনে সবই মূল্যহীন।

কাদের ভরসায় রেখে যাব এইসব গ্রন্থরাজি?

না কি নিজেই করে যাব অগ্নিতে সৎকার?

একদিন অক্ষরে চোখ রেখে জীবন হয়েছিল ধন্য;

আজ যাবার সময় নিতান্তই বাতিল ময়লা কাগজ।



কবি  
 ***


এইখানে  শায়িত আছেন তিনি;

দীর্ঘ ক্লান্তি আর অবসাদের পর

চিরনিদ্রায়; ক্ষুধা ছিল, দারিদ্র ছিল

দারিদ্রের পীড়ন ছিল জীবনভর; তবু

সহ্য করেছিলেন সবকিছু, শুধু

কবিতার জন্য, শুধু কবিতাকে ভালবেসে

উপেক্ষা  আর বঞ্চনাকে ধারণ

করেছিলেন বুকে; সেই তিনি শায়িত

আছেন এইখানে, শান্ত, নির্বিবাদ।

সব ক্ষতিকে অন্তরে ধারণ করেও

নিরভিমান, অভিযোগহীন, তাঁর 

ছিল বাৎসল্য, স্নেহ ছিল, প্রেম ছিল;

আর ছিল এই দেশ, এই সমাজের পক্ষে

বড্ড বেমানান ধরণের বড় হৃদয়।

Joydeb Biswas

Poet Joydeb Biswas studied Bengali literature. In 2015, at the age of 22, he published 'Sahitya Chetona' magazine. Currently two editions of the magazine are published. One is the online version and the other is the printed version. He is the founder and editor of the two editions. facebook twitter youtube instagram whatsapp

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

নবীনতর পূর্বতন