কবি-সাহিত্যিক গোবিন্দ পান্তি–বাংলা সাহিত্যের এক দীপ্তিময় নক্ষত্র : ১ম পর্ব
নক্ষত্রের নিজস্ব আলো থাকে। সেই আলোয় সে আলোকিত ক'রে রাখে গোটা ভুবন। কোনো কোনো নক্ষত্রের আলো আমাদের কাছে আসতে লেগে যায় বহু বছর। বাংলা সাহিত্যের অগণিত বস্তুর ভীড়ে অত্যুজ্জ্বল নক্ষত্র কবি গোবিন্দ পান্তি।
– কবিকে নিয়ে লিখেছেন জয়ন্ত মণ্ডল
কবি গোবিন্দ পান্তি |
আধুনিক বাংলা কাব্য-সাহিত্যের কতিপয় যে কবি যুগধর্মকে অস্বীকার না ক'রে বিবর্তনের অবধারিত গতিপ্রবাহে বাংলা সাহিত্য-সাগরের নির্যাস অন্তরে ধারণ ক'রে অসংখ্য মণি-মুক্তো সৃজন করেছেন তার মধ্যে গোবিন্দ পান্তি অন্যতম। পক্ষান্তরে কিটস, গ্যাব্রিয়েল, মিস্ত্রাল, জীবনানন্দ প্রমুখের মতো কবি, যাঁরা স্ব-মহিমায় গোটা জীবনটাই কাব্য-সাধনায় নিয়োজিত ক'রে সম্পূর্ণ নিজস্ব ধারার প্রবর্তন করেও জীবদ্দশায় চূড়ান্তভাবে উপেক্ষিত থেকেছেন তাঁদের সাথেও গোবিন্দ পান্তি সমোচ্চারিত।
নক্ষত্রের নিজস্ব আলো থাকে। সেই আলোয় সে আলোকিত ক'রে রাখে গোটা ভুবন। কোনো কোনো নক্ষত্রের আলো আমাদের কাছে আসতে লেগে যায় বহু বছর। বাংলা সাহিত্যের অগণিত বস্তুর ভীড়ে অত্যুজ্জ্বল নক্ষত্র কবি গোবিন্দ পান্তি। আপামর সাহিত্যানুরাগী মানুষের চোখে যাঁর আলোর রেখা উদ্ভাসিত হতে সময় লাগছে কয়েক দশক অথবা একটা যুগ কিন্তু তিনি যে যুগোত্তীর্ণ কবি, উত্তর-আধুনিকতার প্রচ্ছন্ন রূপকার কোলকাতা-কেন্দ্রিক প্রচার-সর্বস্ব পরিমণ্ডল থেকে বহু দূরে সীমান্ত সংলগ্ন প্রত্যন্ত গ্রামে সাহিত্য-চর্চার কারণে নাকি উগ্র রাজনীতির কাছে আত্মসমর্পিত নাম-করা পত্র-পত্রিকার সম্পাদকের ইচ্ছাকৃত নাক-উঁচু স্বভাব ও ঔদাসীন্যের কারণে এই কালজয়ী স্রষ্টা ও তাঁর মহান সৃষ্টি আজও উপেক্ষিত, আমার কাছে তা রহস্য। তবে ছাই-চাপা আগুন এতো সহজে নেভে না! শুদ্ধসত্ত্ব বসুর বিদগ্ধ চোখে যিনি "বঙ্গ সাহিত্য ভাণ্ডারে কাব্যলক্ষ্মীর যথার্থ সেবক ", বিখ্যাত ঔপন্যাসিক তারাপ্রণব ব্রাম্মচারীর গভীর দৃষ্টিতে যিনি "জীবনানন্দের কাব্যমূল্যের সমান অংশীদার ", লেখক অমলেন্দু দত্তের সুচিন্তিত সিদ্ধান্তে যিনি "সাহিত্য-রূপ ঈশ্বরের অবিচল সাধক "তিনি তো প্রতিকূল পরিস্থিতিতেও হেরে যেতে আসেননি! গোবিন্দ পান্তি গভীর অরণ্যে লুকিয়ে থাকা এক বিরাট মহীরুহ, যাঁর পুষ্টি রবীন্দ্র-নজরুল কাব্য বলয়ে, যাঁর শেকড় প্রোথিত তিরিশের স্বর্ণযুগে, যাঁর শাখা-প্রশাখা সুবিস্তৃত উত্তর-আধুনিকতার বহুরৈখিকতায়, যাঁর মর্মর যুগ-অতিক্রমী সময়ের সাহিত্য-অলিন্দের ছান্দিক স্পন্দনে।
সাহিত্যিক দক্ষতা, উজ্জ্বলতর নিয়ন্ত্রণ, চিন্তার স্বচ্ছ মুক্তি, শৃঙ্খলিত পারম্পর্য, ভাষার জীবন্ত রূপ ও মার্জিত ব্যবহার ও তার সুষ্ঠু পরিবেশনা-সমস্ত দিক পর্যালোচনা করলে তিনি একজন সার্থক প্রাবন্ধিক। ছন্দ, সাবলীল শব্দ প্রয়োগ, চিত্রকল্প, লোক-মানসের বাস্তব প্রতিচ্ছবি প্রভৃতি নানা দিক বিশ্লেষণ করলে তিনি একজন নিখুঁত ছড়াকার। পরিনামমুখিতা, গতিশীলতা, নাটকীয়তা, পরিমিত সংলাপ প্রয়োগ, ব্যঞ্জনাধর্মী ভাষা ও কাহিনীর ওজস্বিতা, বিন্দুতে সিন্ধুর বিশালতা সৃষ্টি ইত্যাদি ক্ষেত্রে তিনি আদর্শ ছোটগল্পকার। নাটকীয় সংলাপ ও শব্দমাধুর্য সৃষ্টি, সুখশ্রাব্য বৌদ্ধিক প্রকাশ, চরিত্রের সংবেদনশীলতা, যুগধর্ম-বোধ প্রভৃতি ক্ষেত্রে তিনি অভিজ্ঞ নাট্যকার। কিন্তু অন্যান্য সব গুণকে অতিক্রম ক'রে উজ্জ্বল হয়ে ওঠে তাঁর কবিত্ব-শক্তি। ব্যক্তি-উপলব্ধি ও ভাবের দ্যোতনা, অন্তর অনুভূতির শৈল্পিক প্রকাশ, শব্দের ছন্দময় বিন্যাস, উপলব্ধি ও চিন্তার প্রসারতা, অলংকার-ব্যঞ্জনা-চিত্রকল্পের সাহায্যে তাকে সুমধুর ও শ্রুতিযোগ্য ক'রে তোলা প্রায় সব ক্ষেত্রে তিনি বারবার নিজেকে অতিক্রম ক'রে হয়ে উঠেছেন উত্তর-আধুনিক যুগের বলিষ্ঠ কবিতা-স্রষ্টা।
আমার ক্ষীণতোয়া ভাবের মোহনায় এই বিশাল মহাসাগরের দু'একটি ঢেউ আমার সীমাবদ্ধ বোধের উপত্যকায় তাঁর জীবনী ও মহান সৃষ্টি-সম্ভারের গবেষণাধর্মী রেখাচিত্র সৃষ্টির স্বপ্ন দেখার সৌভাগ্য বা দুঃসাহস-কোনোটিই আমার ছিলো না। ইংরেজি 2012 সালে কবির সর্ববৃহৎ কবিতা-সংকলন "গন্ধ ছোঁয়া রোদ্দুর "এর প্রকাশ অনুষ্ঠানে প্রায় বিনা নিমন্ত্রণে আমার স্কুলের শিক্ষক মাননীয় ফজের আলি মহাশয়ের সঙ্গে উপস্থিত হই গোবিন্দপুরের গোবিন্দধামে। নিয়তির বোধহয় এটাই পূর্ব-নির্ধারিত ছিলো, তা না হলে কেনো সে'দিন ঐ মহতী অনুষ্ঠানে উপস্থিত হবো আর কেনোই বা মহান কবি গোবিন্দ পান্তির সঙ্গে আত্মীয়তার অমোঘ বন্ধনে আবদ্ধ হবো ! সে'দিন হাজার ঋদ্ধ মানুষের ভীড়ে হারিয়ে যাই আমি। শত চেষ্টা করেও না পেয়েছিলাম কবির সান্নিধ্য, না পেরেছি "গন্ধ ছোঁয়া রোদ্দুর "এর কবিতাগুলির মর্ম বুঝতে। আধুনিক কবিতার কোনো ধারণাই গড়ে ওঠেনি সে'দিন আমার মধ্যে। তবে কী এক অজানা আকর্ষণে আর একদিন যাই তাঁর মানস-প্রতিম'অনুরাগ সাহিত্য সংস্থা'র সাহিত্য-বাসরে। আধুনিক কবিতার প্রাথমিক ধারণা পাই তাঁর কাছে, অনুভব করি দুর্ণিবার আকর্ষণ। ফলস্বরূপ 'অনুরাগ'এর অনুরাগী হয়ে গোবিন্দ-পাদপদ্মে আশ্রয় নেওয়া ছাড়া গত্যন্তর ছিলো না। তারপর সময় থেমে থাকেনি। আধুনিক কাব্য-সাহিত্যের অল্প যা কিছু অর্জন করেছি তার সবটুকু দিয়েছেন আমার কাব্যপিতা গোবিন্দ পান্তি। ছুটি হলেই ছুটে যেতাম তাঁর কাছে। এতটুকু দ্বিধা না রেখে অহংশূন্য মানুষটি আমার মতন আনকোরা যুবককে সবটা দিতেন উজাড় ক'রে, কাছে টেনে নিতেন সন্তান-স্নেহে। তবে মাসীমার(কবিপত্নী)অবদান কোনো অংশে কম ছিলো না। তিনি অসুস্থ শরীরেও নিয়মিত জল-খাবার দিতেন এবং আহারের ব্যবস্থা করতেন। তাঁর পরোক্ষ প্রভাব শুধু গোবিন্দ পান্তি নামের বৃক্ষকাণ্ডকে নয়, আমাদের মতো শাখা-প্রশাখাকে পুষ্ট করেছে।
প্রত্যন্ত গ্রামে থেকেও প্রায় ছয় দশক ধ'রে সাহিত্যচর্চার পাশাপাশি শিক্ষিত যুবক-যুবতীদের নিয়ে সাহিত্য সংগঠন গ'ড়ে তুলেছেন সাফল্যের সঙ্গে। কখনো তিনি মাছের তেলে মাছ ভাজেননি। তাঁর হাতে জন্ম নেওয়া সাইদুর রহমান, সরবত আলি মণ্ডল, দেবদাস মণ্ডল, মাকফুর রহমান, জয়দেব বিশ্বাস, গোকুল মণ্ডল, অপূর্ব মণ্ডল, ধীরাজ রায়, জয়দেব বিশ্বাস, ফিরোজা খাতুন প্রমুখ প্রতিষ্ঠিত কবি, নাট্যকার, গল্পকার ও ছড়াকারের বন্ধুত্বপূর্ণ সান্নিধ্য আমাকে কিছু করতে প্রাণিত করেছে। আজ সকলের ভালোবাসা, আশীর্বাদ আর কাব্যপিতার প্রতি একান্ত দায়বদ্ধতায় আমি বিন্দু হয়েও সিন্ধুর ঢেউ মাপার সৌভাগ্য অর্জন করার দুর্লভ সুযোগ পেয়েছি।
যে মানুষটি গোটা জীবন উৎসর্গ করেছেন সাহিত্য-চর্চায়, যে মানুষটি শুধুমাত্র বাংলা সাহিত্যের স্বার্থে ব্রাত্য থেকেছেন নিজ সমাজ-সংসারে, যে মানুষটির সৃষ্টি এ উত্তর-আধুনিক যুগে বাংলা কাব্য-সাহিত্যের অন্যতম গ্রহণযোগ্য শক্তিশালী গবেষণার রসদ হতে পারে, যে মানুষটি ঋদ্ধজনের চোখে দু'বার এপার বাংলা-ওপার বাংলার সেরা কবি নির্বাচিত হয়েও নিজ স্বার্থ বিসর্জন দিয়ে শুধুমাত্র কাব্য-সাহিত্যের স্বার্থে প্রত্যন্ত গ্রামে সাহিত্য-সংস্থা তৈরি ক'রে সাহিত্য-সাধনা করেছেন এবং বারবার সাহিত্যের পরিমণ্ডলে কিছু আপনজনের নির্মম আঘাত সহ্য করেও সত্যনিষ্ঠার সঙ্গে নিজ লক্ষ্যে অবিচল থেকেছেন, সেই প্রচারবিমুখ স্রষ্টার কোনো জীবন ও সৃষ্টিধর্মী গ্রন্থ লেখা হবে না, আপামর বাঙালির কাছে তিনি চিরকাল অজানা নক্ষত্র হয়েই থাকবেন-তা হতেই পারে না। আজ নব্বই ছুঁইছুঁই কবি প্রায়শ অসুস্থ হচ্ছেন, হয়তো একদিন শেষ হবে গোবিন্দ-যুগ, সমাপ্ত হবে বাংলা-সাহিত্যের এক প্রচ্ছন্ন বিপ্লবের। এগিয়ে এলেন তাঁরই ছাত্র বিধান সরকার। বিধান দা আর 'অনুরাগে'র অনুরাগীদের আর্থিক আনুকূল্যে আমার সীমিত সাধ্যমত লিখলাম গোবিন্দ পান্তির জীবনী ও সৃষ্টি নিয়ে গবেষণাধর্মী গ্রন্থ "তোমাকে ছুঁলাম "। প্রায় ছয়শ' পৃষ্ঠার গ্রন্থটি পর্যায়ক্রমে তুলে ধরবো সম্পাদক জয়দেব বিশ্বাসের অন্যতম জনপ্রিয় ওয়েব পোর্টাল "সাহিত্য চেতনা"য়।বর্তমানের অন্যতম সম্ভাবনাময় কবি জয়দেব বিশ্বাসের ইচ্ছের মান্যতা দিয়ে আমি প্রায় পাঁচ লক্ষ পাঠকের কাছে গোবিন্দ-বিশ্লেষণে ব্রতী হলাম। সকলের ভালোবাসা আমার পাথেয়।