লোটাস পন্ড
ঈশিতা ভাদুড়ী
বিদেশে গিয়ে শুধু কি ট্যাক্সি বা ট্রেনেই চড়েছি আমরা ! বাসেও তো চড়েছি অনেক। সেই সুবাদে কিছু অন্য অভিজ্ঞতাও হয়েছে। সেরকম একটি অভিজ্ঞতা আজ বলবো।
তাইপেই থেকে ৩৫৮ কিলোমিটার দূরত্বে কাওসিয়াং। আমরা তাইপেই থেকে তাইওয়ান হাই স্পিড রেলে করে জুওয়িঙ্গ স্টেশনে নেমে তারপর কে আর টি ট্রেনে করে কাওসিয়াং-এ গিয়েছিলাম, খুব বেশি সময়ের ব্যাপার নয়, সাড়ে তিন থেকে চার ঘন্টা মাত্র। বাসে করেও যাওয়া যায়, সময় কিছুটা বেশি লাগে। হাতে সময় বেশি থাকলে বাসে করে যাওয়াই ভালো, কারণ বাসের ভাড়া ট্রেনের থেকে অনেকটাই কম।
কাওসিয়াং মূলত তাইওয়ানের দক্ষিনে একটি বিশাল বন্দর শহর। এখানে অনেক মাল্টিস্টোরিড বাড়ি আছে, ২৪৮ মিটার লম্বা টিউন্টেক্স স্কাই টাওয়ার এবং পার্কের বৈচিত্র্যের জন্যে বিখ্যাত এই শহর তাইওয়ানের দুটি বড় শহরের মধ্যে একটি। এই শহরের কেন্দ্রবিন্দু হলো লাভ নদী, বারো কিলোমিটার লম্বা এই নদী, তার দু’পাড় ধরে হাঁটার পথ, ক্যাফে, নাইট মার্কেট এবং ক্রুজ নৌকাগুলি খুবই আকর্ষণীয় করেছে ওই জায়গাটি। লন্ডনের টেমস নদীর সঙ্গে লাভ নদীর তুলনা করা হয়।
কাওসিয়াং-এর একটি উল্লেখযোগ্য ট্যুরিস্ট স্পট লোটাস পন্ড, একদিন আমরা সেখানে যাবো ঠিক করলাম। শহরের উত্তর দিকে জুওয়িঙ্গ ডিস্ট্রিক্টে লোটাস পন্ড হলো একটি কৃত্রিম লেক, মনোরম এই ট্যুরিস্ট স্পট পদ্ম গাছের জন্য খুবই বিখ্যাত। লেকের চারপাশে বিভিন্ন মন্দির এবং প্যাভিলিয়ন। বসন্ত এবং শরৎ প্যাভিলিয়ন আর ড্রাগন এবং টাইগার প্যাগোডা। শেষ বিকেলে এই লেকের জলে প্রতিবিম্বিত সূর্যাস্ত জায়গাটি অত্যন্ত মনোরম করে তোলে।
বসন্ত ও শরৎ এই দুটি প্যাভিলিয়ন কুয়ান কুং (যুদ্ধের ঈশ্বর) কে উৎসর্গীকৃত। প্যাভিলিয়নের সামনেই দেবী কুয়ানিন (দয়ার দেবী) এর একটি মূর্তি আছে, ড্রাগনের ওপর চড়ে। পৌরাণিক কাহিনী অনুসারে, কুয়ানিন একটি ড্রাগনের উপরে চড়ে মেঘের উপরে উপস্থিত হয়েছিলেন। এবং এই চিত্রটি ওই দুটি মণ্ডপের মধ্যে চিত্রিত রয়েছে। মণ্ডপদুটি ১৯৫১ সালে শেষ হয়েছিল।
এই প্যাভিলিয়ন গুলির দক্ষিণে ড্রাগন এবং টাইগার প্যাগোডা। ড্রাগনের গলা দিয়ে ঢুকে বাঘের মুখ দিয়ে প্রস্থানের নিয়ম খারাপ ভাগ্যকে সৌভাগ্যের দিকে পরিণত করার প্রতীক। ভেতরে চিত্রগুলিতে চীনের ২৪ জন অনুগত সন্তানের পাশাপাশি স্বর্গ ও নরকের দৃশ্য চিত্রিত করা হয়েছে যেগুলি জনসাধারণকে ভাল কাজ করতে অনুপ্রাণিত করে এবং সেই সঙ্গে অন্যায় কাজের ফলাফল ও শাস্তি কী হতে পারে সেটাও বুঝিয়ে দেয়।
যাইহোক ট্রেন এ করে গিয়ে নেমে বাসস্টপে দাঁড়িয়ে আছি, জুওয়িং হাই স্পিড রেল স্টেশনের বাইরে থেকে ৫১ নম্বর বাসে করে লোটাস পন্ডে যাওয়া যায়। স্টেশনের বাইরে বাসস্টপে দাঁড়িয়ে আছি তো দাঁড়িয়েই আছি, ৫১ নম্বরের বাস আর আসে না। তাইওয়ানের যে কোনো মানুষকে কিছু জিজ্ঞেস করে জেনে নেওয়া অত সহজ নয়। ভাষা বাধা হয়ে দাঁড়িয়ে থাকে। অতএব, জিজ্ঞাসাবাদ না করে দাঁড়িয়ে থাকাই শ্রেয়, তাই আমরা দাঁড়িয়েই রইলাম। শেষমেশ এল ৫১ নম্বরের বাস। আমরাও হৈহৈ করে চেপে বসলাম। অফিস টাইমে আমাদের দেশ অনুযায়ী যথেষ্টই ফাঁকা বাস। আমাদের কম্বাইন্ড টিকিট, আলাদা করে টিকিট কাটার কোনো ব্যাপার নেই, বাসে উঠে যন্ত্রে কার্ড ছুঁয়ে প্যাঁকপ্যাঁক করলেই হবে। আমরা অবশ্য এই জরুরী কাজ করার পরে আমাদের গন্তব্য স্টপে নামিয়ে দেওয়ার জন্য অনেক কিছুই বোঝানোর চেষ্টা করেছিলাম, কিন্তু ড্রাইভার কিচ্ছুটি না বুঝে খুব মিষ্টি হাসি হাসলো। আমরাও নিরুপায় হাসি হেসে দু'জনে দুটো জানলার ধার নিয়ে নিশ্চিন্তে বসে পড়লাম।
বেশ শহর দেখতে দেখতে আমরা চললাম। স্টপ আসার আগে ডিসপ্লে বোর্ডে নাম দিয়ে দিচ্ছে, যদিও সেসবই ওদের লোকাল হরফে। বাস আস্তে আস্তে ফাঁকা হতে হতে একেবারেই ফাঁকা হয়ে গেল একসময়। আমরা দুজন আর বাস-ড্রাইভার। কিছুক্ষণ আরও এইভাবেই চললাম আমরা। তারপর চালক মহাশয়ের কিছু সন্দেহ হল, এক-আধ মিনিট অন্তর অন্তর সে আমাদের কিছু জিজ্ঞাসা করতে লাগল, এবং আমরাও উত্তর দিতে থাকলাম, আমরা কেউ কারুর ভাষা বুঝলাম না। কিছুক্ষণ পরে সোমার বুদ্ধি হল, সে ম্যাপ নিয়ে চলন্ত বাসে দুলে দুলে ড্রাইভারের কাছে গিয়ে হাজির। ম্যাপে লোটাস পন্ডকে দেখাতেই ড্রাইভার খুব চিন্তিত হয়ে পড়ল। সে কিছু বল্ল, যদিও নিজের ভাষাতেই বল্ল, তবু এইবার আমরা বুঝতে পারলাম যে আমরা উল্টোদিকের বাসে উঠেছি। বোঝো কান্ড ! এবার কী হবে !
ড্রাইভার কিন্তু আমাদের নামিয়ে দিল না, বাস চলতেই থাকল। বেশ অনেকক্ষণ এরাস্তা সেরাস্তা আমাদের নিয়ে ঘুরে কারুর সঙ্গে ওয়াকি-টকিতে কথাবার্তা বলে আরও কিছু পথ গিয়ে সে বিপরীত দিকের একটি বাসে আমাদের তুলল। বাসে তুলল মানে বাস দাঁড় করিয়ে নিজে নিচে নেমে আমাদের উঠিয়ে সেই বাসের ড্রাইভারকে আমাদের গন্তব্য বুঝিয়ে আমাদের বিদায় জানিয়ে তবেই সে গেল।
এরপর আমাদের আর কোনো অসুবিধে হলো না, নির্দিষ্ট জায়গায় আমাদের নতুন বাসের ড্রাইভার নামিয়ে দিল। এমন কান্ড কস্মিনকালেও কেউ শুনেছে যে উল্টো দিকের বাসে উঠলে যাত্রীকে হারা উদ্দেশ্যে না নামিয়ে ওয়ান ওয়ে টু ওয়ে রাস্তার চক্কর কাটিয়ে নির্দিষ্ট রুটের বাসে উঠিয়ে তবে ড্রাইভার নিশ্চিন্ত হয় !