বিভাজনের রাজনীতি ও ভারতবর্ষ –- একটি পুরাণৈতিহাসিক আখ্যান
• আকাশ নীল বিশ্বাস
কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধশেষে অন্ধরাজ তাঁর মৃত পুত্রদের অন্ত্যেষ্টিক্রিয়া সম্পন্ন করার জন্য রণক্ষেত্রে আসেন। প্রিয়পুত্রদের অকালমৃত্যুতে শোকাকুল হওয়ার দরুন ইতিপূর্বেই তাঁর হিতাহিত জ্ঞান লুপ্ত হয়েছিল। দুর্যোধনের সমস্ত প্রকার অনাচার ও অপকর্মকে নির্বিচারে প্রশ্রয়দানের কারণেই যে সংঘটিত হয়েছিল এরূপ ভ্রাতৃঘাতী মহাযুদ্ধ স্বাভাবিকভাবেই অম্বিকাপুত্রের মন থেকে বিস্মৃত হয়েছিলো এই অপ্রিয় সত্যটি। ফলতঃ পঞ্চপাণ্ডবকে বিশেষত পবননন্দনকে আলিঙ্গনের সময়ে তিনি যে শ্বাসরোধ করে তাদের হত্যা করতে পারেন এসম্পর্কে আর কেউ অবগত থাক বা না থাক বাসুদেব কৃষ্ণ তা ঠিকই অনুমান করেছিলেন। তাই ভীমকে আলিঙ্গনের সময়কালে (যেহেতু ভীমসেন তাঁর সর্বাধিক প্রিয় পুত্র দূর্যোধনকে নির্মমভাবে হত্যা করেছিলেন ও দুঃশাসনের বক্ষ বিদীর্ণ করে তার রক্তপান করেছিলেন; শুধু তাই নয় একশো কৌরবভ্রাতাও তাঁর হাতে তাদের প্রাণ দিয়েছিল - সেহেতু সঙ্গত কারণেই ভীমের ওপর ওপর তাঁর রাগ ছিল সর্বাধিক) তিনি ভীমের পরিবর্তে একটি লৌহনির্মিত মূর্তিকে ধৃতরাষ্ট্রের সম্মুখীন করান। আলিঙ্গনরত অবস্থায় ধৃতরাষ্ট্র তার সর্বশক্তি দিয়ে মূর্তিটিকে পেষণ করলে মূর্তিটি সেই প্রচন্ড চাপে চূর্ণ-বিচূর্ণ হয়ে যায়। অবশ্য কিছুক্ষণের মধ্যেই ক্রোধবশতঃ তিনি যে একটি মহাভূল করে বসেছেন - সে কথা উপলব্ধি করে তিনি শোকে মুহ্যমান হয়ে পড়েন। তখন বাসুদেব লৌহনির্মিত মূর্তির কথাটি বলে ধৃতরাষ্ট্রকে আশ্বস্ত করেন এবং তারপর পরিস্থিতি স্বাভাবিক হয়ে যায়।
ঘটনাটি ক্ষুদ্র হলেও একটি বিষয় আমাদের মনকে নাড়া দিয়ে যায়। বাস্তবিক ক্ষেত্রেও সাময়িক উত্তেজনা কিংবা ক্রোধের বশবর্তী হয়ে এমন অনেক কিছুই আমরা করে ফেলি যার জন্য পরে আমাদের আফশোসের অন্ত থাকেনা। কিন্তু দুর্ভাগ্যের বিষয় আমাদের জীবনের যাবতীয় দুঃখ-দুর্দশা-সংকট মোচনের জন্য এমনই কোনো দুঃখহারী, করুণানিধান, বিপদত্রাতা কৃষ্ণ বাসুদেবের আবির্ভাব ঘটেনা। অনিবার্য পরিনামস্বরূপ ভবিষ্যতে হয়তো এরই জন্য আমাদের সম্মুখীন হতে হয় সীমাহীন দুঃখ-দুর্দশার; কিন্তু পরিস্থিতিকে স্বাভাবিক করে তোলা তখন আর কারোর পক্ষেই সম্ভবপর হয়ে ওঠেনা। আজকের এই চরম সংকটকালীন মুহূর্তের মূর্খ জনসাধারনই তার আদর্শ উদাহরণ, যারা সমস্ত রকম সতর্কবার্তা উপেক্ষা করে সজ্ঞানে বা অজ্ঞানে উদ্দেশ্যহীনভাবে ঘোরাঘুরি করছেন আর মানবসমাজে রোপন করে যাচ্ছেন এক ভয়ংকর মারণজীবাণুর বীজ; আর ক্রমাগত নিজেদের অজ্ঞতার বারিসিঞ্চন করে যাচ্ছেন তাতে। ফলে বিপদ কমার বদলে ঘনীভূত হয়ে উঠছে ক্রমশ, আর মানবকুলকে সম্মুখীন হতে হচ্ছে এক ভয়ঙ্কর মারণব্যাধির, জাতি-ধর্ম-বর্ণ-নাগরিকত্ব নির্বিশেষে আবালবৃদ্ধবনিতা একনাগাড়ে যার শিকার হয়ে চলেছেন। এযেন গ্রিকপুরাণের সর্পদানবী হাইড্রা, যার বিষ একবার শরীরে প্রবেশ করলে মৃত্যু অবধারিত, পৃথিবীর কোন ঔষধি যা নিরাময়ে অক্ষম, যার একটা মাথা কাটলে সেই ক্ষতস্থান থেকে উৎপন্ন হয় আরো হাজারটা ফণা, যা কিনা অজর-অমর-অক্ষয়। মহাবীর হারকিউলিস স্বয়ং সম্মুখযুদ্ধে এই বিভীষণ সর্পদানবীকে পরাজিত করলেও শেষপর্যন্ত সম্পূর্ণভাবে নিধন করে উঠতে পারেননি। এই হাইড্রার বিষেই আক্রান্ত হয়ে পরবর্তীকালে মৃত্যুবরণ করেছিলেন তাঁর শ্রদ্ধেয় শিক্ষাগুরু 'চিরণ'। শতচেষ্টা সত্ত্বেও হারকিউলিস ফিরে পাননি তাঁর পরম প্রিয় শিক্ষাগুরুকে। বর্তমান মানব সভ্যতাকেও যেন হাঁ করে গিলে খেতে আসছে এরূপ কোনো উদ্যত বহুফণাধারী সর্প - যার মৃত্যু নেই, যার মারণবিষের হাত থেকে আমাদের কোনো নিস্তারও নেই, কোনো মহাষৌধিই যেন এ রোগ নিরাময়ে সক্ষম নয়, কোন মহাস্ত্রই যেন এই দানব নিধনে সমর্থ নয়!
আমাদের চিরন্তন স্নেহ-ভালোবাসাময় সম্পর্কগুলিও যেন ধীরে ধীরে ফিকে হয়ে আসছে এই অদৃশ্যমান আতঙ্কের কাছে। এক বন্ধু তার আরেক বন্ধুর সাথে, এক ভাই আরেক ভাইয়ের সাথে, প্রেমিক তার প্রেমিকার সাথে, স্বামী তার স্ত্রী'র সাথে, মা তার সন্তানের সাথে আলিঙ্গনাবদ্ধ হতেও আজ পরান্মুখ; নিজদেহে এই মারণব্যাধির সংক্রমণের আশঙ্কায়। সাময়িক ক্রোধবশত অম্বিকাসূতের আলিঙ্গনে বৃকোদর যেমন নিষ্পেষিত হয়ে মৃত্যুবরণ করতে পারতেন, তেমনভাবেই মুহূর্তের অসতর্কতায় একজনের শরীর থেকে আরেকজনের দেহে সংক্রামিত হতে পারে এই মারণরোগ, যার পরিণাম হতে পারে মৃত্যুর মতোই ভয়াবহ। হিন্দুপুরাণে বর্ণিত অসুর রক্তবীজের ন্যায় এই রোগবাহী জীবাণুও যেন ক্রমাগতই নিজের বংশবৃদ্ধি করে চলেছে এক দেহ থেকে আরেক দেহে - পাল্লা দিয়ে বেড়ে চলেছে রোগাক্রান্ত ব্যক্তি এবং মৃত মানুষের সংখ্যা। প্রকৃতি যেন আজ মানুষে মানুষে বিভেদ সৃষ্টির এক নতুন খেলায় মত্ত। এতদিন ধর্ম, জাতি, নাগরিকত্ব, রাজনৈতিক পরিচয়ের মধ্যে দিয়ে যে বিভেদ সৃষ্টির ঘৃণ্য ষড়যন্ত্রে লিপ্ত ছিল একশ্রেণীর হীন মানসিকতাসম্পন্ন স্বার্থান্বেষী মানবগোষ্ঠী, আজ প্রকৃতি যেন স্বয়ং সেই ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়েছে।
বিভেদনীতির প্রয়োগ ও বিভাজনের রাজনীতি সেই মহাকাব্যিক যুগ থেকেই ভারতীয় উপমহাদেশে বিদ্যমান। হিন্দুদের আদি মহাকাব্য রামায়ণ থেকেই এসত্য দৃশ্যমান হয় যে ভ্রাতৃদ্বন্দ্ব কোনো রাজ্যের স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্বকে কত বড় প্রশ্নচিহ্নের সম্মুখীন করতে পারে। আবার সর্ববৃহৎ ভারতীয় মহাকাব্য মহাভারতও এক সুবিশাল পারিবারিক ভ্রাতৃঘাতী মারণযজ্ঞের সাক্ষী। রামায়ণের রাম-রাবণের দ্বন্দ্ব(আর্য-অনার্যের দ্বন্দ্ব নাকি বহিরাগত আক্রমণকারীর সঙ্গে মূলনিবাসীর অধিকারগত বিরোধ)ই হোক কিংবা মহাভারতের কৌরব-পান্ডবের মধ্যেকার ভাতৃঘাতী (অন্যায়ের বিরুদ্ধে ন্যায় প্রতিষ্ঠার লড়াই নাকি রাজসিংহাসনের অধিকার পেতে একই বংশজাত সৎ ভাইদের মধ্যেকার নিষ্ঠুর নীতিহীন হত্যালীলা)ই হোক, সময়ের অগ্রগতির সঙ্গে সঙ্গে সেগুলির সঙ্গে অনিবার্যভাবেই জুড়ে গেছে বিভিন্ন আনুষঙ্গিক কার্যকলাপ ও ঘটনাবলী। এই দুই মহাকাব্যই যেন রাজনৈতিক, ধর্মীয় এবং আর্থ-সামাজিক স্বার্থরক্ষার উদ্দেশ্যে সমস্ত প্রকার বিশ্বাসঘাতকতা, ছলনা, চাতুরী এবং কূটযুক্তি ও কুটকৌশলের এক অনবদ্য, অভূতপূর্ব ও জীবন্ত দলিল। মানুষ নিজ স্বার্থরক্ষার্থে তার আপনজনকে হত্যা করতে সাময়িকভাবে দ্বিধান্বিত হয়ে পড়লেও শেষাবধি যে পিছপা হয়না - দুই মহাকাব্যই যেন আমাদের এই শিক্ষা দিয়ে যায়। কাব্যরসের অনাবিল মাধুর্য থেকে আমাদের পপাত ধরণীতল ঘটে নিষ্ঠুর বাস্তবের পঙ্কিলতায়।
কালের অমোঘ নিয়মে মহাকাব্যিক যুগ থেকে আমাদের উত্তরণ ঘটে ঐতিহাসিক যুগে। প্রথমে পারস্য এবং পরবর্তীকালে গ্রিসের তরবারি যখন আর্যাবর্তকে ছিন্নভিন্ন করে তুলেছিল তখনো অনুরূপ বিশ্বাসঘাতকতার নজির স্থাপনের কমতি ঘটেনি এদেশে। পৌরব রাজ্য আক্রমণের সময় আলেকজান্ডারের পক্ষাবলম্বন করেছিলেন এদেশেরই দুই কুসন্তান তক্ষশীলার রাজা অম্ভি ও সেনাধ্যক্ষ শশীগুপ্ত (গ্রিক ঐতিহাসিকদের রচনায় যথাক্রমে 'ওম্ফিস' ও 'সিসিকোটাস' নামে পরিচিত)। পরবর্তী সময়পর্ব ভারতের ইতিহাসে কেন্দ্রীকরণের যুগ - এযুগের আর্যাবর্তে মৌর্য ও গুপ্ত এবং দাক্ষিণাত্যে চোল, পল্লব, রাষ্ট্রকুট নামক বেশ কয়েকটি মহাশক্তিধর সাম্রাজ্যের উদ্ভব হয়। পরবর্তী সময়ে থানেশ্বরের পুষ্যভূতি বংশজাত হর্ষবর্ধন ভারতকে পুনরায় একছত্রের তলদেশে আনবার চেষ্টা করলেও বিশেষ সাফল্য পাননি। তৎকালীন যুগে পূর্ব ভারতে শশাঙ্ক ও দাক্ষিণাত্যে দ্বিতীয় পুলকেশীর মতো সার্বভৌম ও শক্তিধর নৃপতিবর্গ সগৌরবে তাদের নিজস্ব স্বাধীন অস্তিত্ব বজায় রেখেছিলেন। অর্থাৎ সমগ্র দেশব্যাপী এক চরম ও চূড়ান্ত ঐক্যবদ্ধতার ঐক্যবদ্ধতার নজির পরবর্তী সময়ে (ইসলামের আগমনের পূর্বকাল পর্যন্ত) সেভাবে পুনঃস্থাপিত হয়নি। বরঞ্চ আঞ্চলিক শক্তিগুলি ক্ষমতা দখল ও নিজ স্বার্থরক্ষার জন্য পরস্পরের বিরুদ্ধে নিরন্তর লড়াইয়ের মধ্যে দিয়ে প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে ভারতবর্ষের জাতীয় ঐক্যকে ক্রমশ দুর্বল করে গেছে। অনিবার্য পরিণতিস্বরূপ এদেশের প্রাদেশিক শক্তিগুলি কোনোদিনই বহিরাগত আক্রমণকারীদের বিরুদ্ধে ঐক্যবদ্ধ হতে পারেনি। বরং সংকীর্ণ স্বার্থরক্ষার্থে কখনো বা বিদেশি শক্তির সঙ্গে মিলিত হয়ে প্রতিবেশী রাজ্যের সর্বনাশ করার প্রচেষ্টা চালিয়েছে নতুবা প্রতিবেশী রাজ্য আক্রান্ত হলে নিষ্ক্রিয় হয়ে বসে থেকেছে। স্বদেশের চরম সংকটকালে দেশীয় শক্তিগুলির এই অনৈক্য, অদূরদর্শিতা ও অপরিণামদর্শিতার সুযোগ নিয়েই মধ্যযুগের ভারতবর্ষে প্রথমে ইসলামের বিজয় পতাকা উড্ডীন হয়েছে, পরবর্তীকালে অনুপ্রবেশ ঘটেছে ব্রিটিশ সিংহের। যথেষ্ঠ প্রতিরোধক শক্তি থাকা সত্বেও এই উভয় মহাশক্তির বিরুদ্ধেই ভারতবাসী আত্মরক্ষা করতে ব্যর্থ হয়েছে।
তবে ভারতবাসীর মধ্যে বিভেদ সৃষ্টির এই ইতিহাস বহু প্রাচীন হলেও তা সর্বপ্রথম প্রাতিষ্ঠানিক রূপ লাভ করে এদেশে ব্রিটিশ শক্তির আগমনের পর। কোনো জাতির ওপর নিজেদের আধিপত্য কায়েম করার জন্য সবার আগে প্রয়োজন তাদের মনকে শাসন করা, তাদের স্বাধীন চিন্তা-চেতনা-মননশীলতা ও বোধির জগতে পরাধীনতার শৃঙ্খল আরোপ করা, তাদের সমৃদ্ধিশালী ও গৌরবময় ইতিহাসকে বিকৃত করে ফেলা এবং অতীতের গৌরবোজ্জ্বল অধ্যায়কে বিস্মৃত করে দেওয়া। এভাবেই কোনো একটি জাতির উপর অত্যন্ত সূক্ষ্ম অথচ নিখুঁতভাবে বিভাজন সৃষ্টি করে তাদের নিষ্ক্রিয়, কর্মবিমুখ ও দুর্বল করে ফেলা সম্ভব। সম্ভব তাদের মধ্যেকার ঐক্যবদ্ধতা ও সম্প্রীতি বিনষ্ট করে সাম্প্রদায়িকতার বিষবাষ্প ছড়ানো। ভারতবর্ষের মতো সুবিশাল ও সাংস্কৃতিক বৈচিত্র্যময়তাপূর্ণ দেশে এভাবেই সাম্প্রদায়িকতার বিষবাষ্প ছড়িয়ে, জাতিগত সম্প্রীতি নষ্ট করে, তাদের অতীত ইতিহাসের গৌরবোজ্জ্বল অধ্যায়কে বিস্মিত করে দিয়ে, তাদের উপর দীর্ঘকাল আধিপত্য কায়েম করে রেখেছিল ব্রিটিশরা। এভাবেই সীমিত শক্তির অধিকারী হয়েও একদা সভ্যতার সূতিকাগার ভারতবর্ষের মতো জ্ঞান-বিজ্ঞান-দর্শন-সাহিত্য-স্থাপত্য-শিল্পকলা ও সম্পদে পরিপূর্ণ একটি দেশে সুদীর্ঘকালব্যাপী আর্থিক শোষণ চালাতে সক্ষম হয়েছিল তারা।
যখন একের পর এক দেশীয় আঞ্চলিক শক্তিগুলিকে পদানত করে এদেশে ব্রিটিশরা তাদের ঔপনিবেশিক সাম্রাজ্যের বিস্তার ঘটাতে থাকে। তখন নিজেদের ক্ষুদ্র ও সংকীর্ণ স্বার্থকে রক্ষা করতে এদেশের নৃপতিবর্গের একাংশ তাদের প্রতি হয় সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দিয়েছিল নতুবা নিজ প্রতিবেশীদের বিপদকালীন মুহূর্তে 'না-হস্তক্ষেপ'মূলক নিষ্ক্রিয়তার নীতি গ্রহণ করেছিল। বস্তুত দেশপ্রেম, জাতীয়তাবাদ, সাম্য, জাতিগত একতা'র মতো বিষয়গুলির সঙ্গে এদেশের হিন্দু, মুসলমান কিংবা অন্য কোনো সম্প্রদায়ের মানুষেরই পরিচিতি ছিলোনা। সুপ্রাচীন কাল থেকেই ভারতবর্ষের শাসকগণ নিজেদের দেশ বলতে নিজ অধিকৃত এলাকাটিকেই বুঝতেন। ফলতঃ খুব স্বাভাবিকভাবেই 'জাতি-রাষ্ট্র'(Nation-State)-এর ধারণা এদেশে তার সঠিক রূপ পরিগ্রহ করেনি। শুধু তাই নয়, জনসংখ্যার ক্রমবৃদ্ধি ও সেই অনুপাতে জমি ও খাদ্যের অভাবজনিত সংকট মোকাবিলায় এদেশের শাসক সম্প্রদায় কিংবা সাধারণ মানুষের মধ্যে কোনোপ্রকার উদ্যোগ দেখা যায়নি। যেরূপ ধর্মীয়, রাজনৈতিক, আর্থসামাজিক ক্রান্তিলগ্নে মূলত পশ্চিম ইউরোপের দেশগুলিতে মানুষের ধর্মীয়, রাজনৈতিক, সাংস্কৃতিক, সামাজিক, অর্থনৈতিক চিন্তাধারা ও নীতি-প্রকৃতির জগতে এক সুবিশাল পরিবর্তন সূচিত হয় এবং পূর্বোল্লিখিত প্রত্যেকটি ক্ষেত্রে যথাযথ সংস্কার সাধিত হয় - এর সূত্র ধরেই পাশ্চাত্যের বিজ্ঞান, শিল্প, প্রযুক্তি, অর্থনীতি ও রাজনৈতিক চেতনার জগতে এক বিপ্লব ঘটে; অনুরূপ কোনো পরিবর্তন কিংবা সংস্কারসাধন পৃথিবীর অন্যত্র দেখা যায়নি। ভারতবর্ষও এর ব্যতিক্রম ছিলোনা। বহু সম্পদে সমৃদ্ধ হলেও এদেশের আর্থ-সামাজিক ও রাজনৈতিক কাঠামোটি যুগের নিয়ম মেনে আধুনিক ও কালোপযোগী হয়ে উঠতে পারেনি। ইউরোপের মতো আধুনিক রাষ্ট্রনীতি ও সমাজ ব্যবস্থার প্রবর্তন, অত্যাধুনিক প্রযুক্তি ও কলাকৌশলের প্রয়োগ ঘটিয়ে কৃষি ও শিল্পক্ষেত্রে বৈপ্লবিক অগ্রগতি কিংবা পরিবহন ও যোগাযোগ ব্যবস্থা উন্নয়ন ঘটিয়ে ব্যবসা-বাণিজ্য ও বিভিন্ন প্রকার অর্থনৈতিক কর্মকান্ডের উন্নতিসাধন - কোনোটাই এদেশে ঘটেনি। অনিবার্য পরিণাম স্বরূপ অত্যন্ত সমৃদ্ধিশালী এবং ঐতিহ্যমন্ডিত সুপ্রাচীন সভ্যতা ও সংস্কৃতির ধারক ও বাহক হয়েও ব্রিটিশ তথা ইউরোপীয় শক্তির কূটনৈতিক প্রজ্ঞা, ভেদনীতি এবং উন্নত সমরাস্ত্রের বিরুদ্ধে দেশীয় আঞ্চলিক শক্তিগুলি নিজেদের স্বাধীন অস্তিত্ব রক্ষা করতে ব্যর্থ হয়েছিল।
ভারতবর্ষে নিজেদের ঔপনিবেশিক সাম্রাজ্য এক দৃঢ় ভিত্তিমূলের ওপর প্রতিষ্ঠিত হলে ইংল্যান্ডের সরকারি উদ্যোগে এদেশের ইতিহাস সংকলনের কাজ শুরু হয়। এই উদ্দেশ্য সাধনের জন্য ব্রিটেন থেকে রীতিমত অভিজ্ঞ ও কৌশলী সেনাধ্যক্ষদের এদেশে আমদানি করার কাজ শুরু হয়। তবে এই মহাযুদ্ধে অসির পরিবর্তে মসি'কেই তারা নিজেদের আয়ুধ হিসেবে নির্বাচন করেন। শুরু হয় অত্যন্ত পরিকল্পিতভাবে ভারতীয়দের সমৃদ্ধিশালী, ঐতিহ্যময় ও গৌরবোজ্জ্বল অতীতকে বিকৃতকরণের এক মহাযজ্ঞ। এই সুপরিকল্পিত অতীত বিকৃতির লিখিতভাবে সংকলিত রূপেরই পোশাকি নামকরণ করা হয় - 'ইতিহাস'। এখন ভারতবর্ষের ইতিহাস বিকৃতির প্রক্রিয়াটি ব্রিটিশ শক্তি কর্তৃক কিভাবে শুরু হয় এবং কিভাবেই বা স্বাধীনতা পরবর্তী সময়ে এই প্রক্রিয়ার সমাপ্তিকরণের পরিবর্তে তৎকালীন সময়ে ভারতবর্ষের শাসনক্ষমতায় অধিষ্ঠিত সরকার বেশ কিছু সহযোগীর সাহায্যে তাকে আরো পরিপূর্ণতা দান করতে রীতিমতো কোমর বেঁধে উঠে পড়ে লাগে সেকথা পরবর্তী আলোচনার জন্য তোলা থাক। তবে মোটামুটি ভাবে একথা বলাই যায় যে, প্রাক ঔপনিবেশিক যুগের ভারতবর্ষে দীর্ঘকালব্যাপী মুসলিম শাসন বলবৎ থাকার কারণে মুসলিম জনসমাজের মধ্যে স্বভাবতই একপ্রকার শাসনতান্ত্রিক ঐতিহ্য, রাজনৈতিক আধিপত্যবাদ এবং বৌদ্ধিক ও সাংস্কৃতিক শ্রেষ্ঠত্বের গর্ববোধ দানা বেঁধেছিল। ব্রিটিশ শক্তির ভারতবর্ষে আগমন কালে একমাত্র উত্তর-পশ্চিম ভারতের শিখ শক্তি এবং ভারতের এক বিস্তীর্ণ অঞ্চলব্যাপী প্রাধান্য প্রতিষ্ঠাকারী ক্রমহ্রাসমান ক্ষমতা সম্পন্ন মারাঠা শক্তি ব্যতীত অন্যান্য সকল শাসক শক্তিগুলিই ছিল মূলত মুসলিম। তা সে হায়দ্রাবাদের নিজাম, সুবে বাংলা(পূর্ববঙ্গ পশ্চিমবঙ্গ বিহার ও উড়িষ্যার সমাহারে গঠিত)-র নবাব, অযোধ্যার নবাব, দাক্ষিণাত্যের হায়দার আলির নেতৃত্বে উত্থানকারী মহীশূর (সম্ভবত ভারতবর্ষে প্রাধান্য বিস্তারে ব্রিটিশদের সবচেয়ে কঠিন প্রতিপক্ষ) কিংবা মুঘল বাদশা (যদিও বহুদিনই ক্ষমতাহীন তবুও কাগজে-কলমে তখনো ভারতবর্ষের প্রধানতম শাসক) যেই হোক না কেন। সুতরাং খুব স্বাভাবিক ভাবেই মুসলিমদের ক্ষমতাচ্যুতকারী ব্রিটিশ সরকার ও তাদের শিক্ষা-সংস্কৃতি গ্রহণ করার বিষয়ে ভারতীয় প্রভাবশালী মুসলিম সমাজের মধ্যে একপ্রকার সহজাত অনীহা ছিল। এছাড়া সুলতানি ও মুঘল যুগের ভারতবর্ষে মুসলিমগণ বিভিন্ন প্রকারের শাসনতান্ত্রিক ও আনুষঙ্গিক সুযোগ-সুবিধা ভোগ করত যেগুলির অধিকাংশই ব্রিটিশ শাসনে তাদের হাতছাড়া হয়ে যায়। ফলত প্রভাবশালী মুসলিম সমাজের পাশ্চাত্য শিক্ষা ও সংস্কৃতি গ্রহণে বিরূপতার প্রভাব এদের উপর নির্ভরশীল গ্রামীন সাধারণ মুসলমানদেরকেও অনেকাংশে প্রভাবিত করে। তাই ব্রিটিশ শাসনে ইংরেজি ভাষার মাধ্যমে পাশ্চাত্য শিক্ষা-দীক্ষার সুযোগ গ্রহণ করে ভারতীয় হিন্দু সমাজ রাজনৈতিক, আর্থসামাজিক ও শিক্ষাগত ক্ষেত্রে যেভাবে এগিয়ে যেতে থাকে, ভারতীয় মুসলমানরা সেক্ষেত্রে বিপরীতমুখী প্রতিক্রিয়া দেখিয়ে সমাজের মূল স্রোত থেকে ক্রমশ পিছিয়ে পড়তে থাকে।
তবে সীমিতভাবে হলেও ঊনবিংশ শতকে হিন্দুদের পাশাপাশি মুসলমান সমাজেও সংস্কার আন্দোলনের সূচনা হয়। তবে হিন্দুদের ধর্ম ও সমাজ সংস্কারের ধারা এবং গতির তুলনায় মুসলিম সমাজের পরিবর্তনের ধারা ছিল স্বতন্ত্র। ব্রিটিশ শাসনাধীন ভারতে মুসলমান সমাজের আর্থিক-সামাজিক-রাজনৈতিক-বৌদ্ধিক-সাংস্কৃতিক সকল ক্ষেত্রেই অনগ্রসরতার সমাধানকল্পে এগিয়ে আসেন সৈয়দ আহমেদ খান। হিন্দু সমাজের উন্নতিকল্পে রাজা রামমোহন রায় যেরূপ অবদান রেখেছিলেন, মুসলিম সমাজের অগ্রগতি সাধনে সৈয়দ আহমেদ খানও অনুরূপ ভূমিকা পালন করেছিলেন বলে বিশিষ্ট ঐতিহাসিক রমেশচন্দ্র মজুমদার মন্তব্য করেছেন। ভারতীয় মুসলমান সমাজের উন্নতিসাধনে স্যার সৈয়দ আহমেদ খান তাদের মধ্যে আধুনিক ও প্রগতিশীল চিন্তাধারার প্রসার ঘটান। ইসলাম ধর্ম সম্পর্কেও তিনি নিজের যুক্তিবাদী ও যুগোপযোগী মতামত ব্যক্ত করেন। অজ্ঞতা, প্রাচীন ও কুসংস্কারাচ্ছন্ন ধ্যানধারণার উপর অন্ধ নির্ভরশীলতা ও আনুগত্য পরিহার করে তিনি স্বচ্ছ ও উদার দৃষ্টিভঙ্গি দ্বারা মুসলিম সমাজকে ইসলাম ধর্মের মূল আদর্শ অনুসরণের আহ্বান জানান। এর পাশাপাশি তাদেরকে ইংরেজদের শত্রু না ভেবে মিত্র হিসেবে গ্রহণ করবার পরামর্শও দেন। শিক্ষায় ও সংখ্যায় হিন্দুদের আধিপত্য স্বচক্ষে পর্যবেক্ষণ করে তিনি রাজনীতি না করে মুসলমান সমাজকে পাশ্চাত্য শিক্ষা গ্রহণ করে নিজের পায়ে দাঁড়ানোর পরামর্শ দেন। আর্থসামাজিক, রাজনৈতিক ও শিক্ষাগত ক্ষেত্রে হিন্দুদের অগ্রগতি ও প্রাধান্য মুসলমান সমাজের মধ্যে যে হতাশার জন্ম দিয়েছিল তার থেকে মুক্তি পেতে তিনি ইংরেজ সরকারের প্রতি অখন্ড আনুগত্য এবং হিন্দু প্রাধান্য বিশিষ্ট জাতীয় কংগ্রেসের রাজনীতি থেকে দূরত্ব বজায় রাখার নীতি গ্রহণ করেন। কারণ তাঁর প্রধান আশঙ্কা ছিল যে এমতাবস্থায় ব্রিটিশ শাসনের অবসান ঘটলে মুসলমানরা হিন্দুদের সমমর্যাদা পাবেনা। যদিও ভারতবর্ষে হিন্দু ও মুসলমানের স্বার্থ পরস্পরবিরোধী, এহেন চিন্তাভাবনার পিছনে আলিগড় কলেজের ইংরেজি অধ্যক্ষ ও সৈয়দ আহমেদের ব্যক্তিগত সুহৃদ থিওডোর বেকের ব্রিটিশ ব্যক্তিবর্গের প্রভাব অনস্বীকার্য। অনেকে অবশ্য মনে করেন যে সৈয়দ আহমেদ ব্যক্তিগতভাবে হিন্দু বিরোধী ছিলেন না; কিন্তু তিনি ছিলেন মুসলমানদের প্রাধান্যের স্বপক্ষে এবং হিন্দু প্রধান জাতীয় কংগ্রেসের বিরুদ্ধে। তবে এ বিষয়ে ঐতিহাসিক মহলে যতই মতপার্থক্য থাকনা কেন একথা সত্যি যে সাংস্কৃতিক ও রাজনৈতিক ক্ষেত্রে মুসলমানদের প্রতিপক্ষ হিসেবে হিন্দুদের চিহ্নিত করে তিনি পরোক্ষভাবে ভারতবাসীর সাম্প্রদায়িক ঐক্যবোধকেই দুর্বল করেছিলেন। ভারতবর্ষে হিন্দু-মুসলিমের বিরোধের নজির অনেক আগে থেকে বিদ্যমান হলেও সৈয়দ আহমেদ ও তার নেতৃত্বাধীন আলিগড় আন্দোলনের মধ্যে দিয়েই তা প্রাতিষ্ঠানিক রূপ পায়। তাঁর মৃত্যুর পর মহম্মদ আলি ও সৌকত আলির মতো তরুণ মুসলিম নেতারা ইসলামের স্বতন্ত্রীকরণের মধ্যেই নিজেদের অস্তিত্ব রক্ষা ও বিকাশের পথ আবিষ্কার করেন। এভাবেই ধীরে ধীরে ভারতবর্ষে "মুসলিম রাজনীতির ইসলামীকরণ" ঘটে। ব্রিটিশ শক্তির প্রত্যক্ষ মদতে ভারতবর্ষে হিন্দু ও মুসলমান সম্প্রদায়ের মধ্যে সাম্প্রদায়িক বিরোধ ও স্বার্থগত সংঘাত এক দৃঢ় ভিত্তিমূলের উপর প্রতিষ্ঠিত হয়। শুরু হয় সাম্প্রদায়িক ক্রমসংঘাতের এক কলঙ্কময় অধ্যায় যার হলাহল আজও ভারতবাসীকে সমানভাবে জর্জরিত করে চলেছে।
ঐক্যহীনতা ও বিচ্ছিনতাবোধের এই নিদর্শন ভারতবর্ষের অতীত বর্তমান ও ভবিষ্যৎ চারণার এক অতি গুরুত্বপূর্ণ উপাদান হিসেবে বিবেচিত হতে পারে এ যেন অনেকটাই দুর্যোধনের কোমল ঊরু কিংবা 'অ্যাকিলিস হিল'(Achilles Heel)-এর মতো। বিষয়টা ঠিক পরিষ্কার হচ্ছেনা তাইতো? চলুন একটু খোলসা করা যাক। কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধের শেষপর্বে দ্বৈপায়ন হ্রদে লুক্কায়িত দূর্যোধন(প্রথম জীবনে নাম ছিল 'সুয়োধন' বা মহান যোদ্ধা পরবর্তীকালে নাম হয় 'দূর্যোধন' অর্থাৎ যুদ্ধে যাকে জয় করা দুষ্কর বা দুঃসাধ্য)কে গদাযুদ্ধে পরাস্ত করা প্রায় অসম্ভব হয়ে পড়ছিল মধ্যম পান্ডব ভীমসেনের পক্ষে, ধারে ও ভারে দুর্যোধনের থেকে বারেবারেই পিছিয়ে পড়ছিলেন তিনি। দৈত্য ও দানবদের অনুরোধে মহাদেব নিজে বজ্র দিয়ে দুর্যোধনের শরীরের ঊর্ধাংশ তৈরি করেছিলেন। আর দুর্যোধনের শরীরের নিম্নাংশ তৈরির দায়ভার গ্রহণ করেছিলেন মহাদেবের স্ত্রী, কিন্তু বজ্রের পরিবর্তে তিনি ব্যবহার করেছিলেন ফুল। ফলে দুর্যোধনের শরীরের ঊর্ধাংশ ছিল অত্যন্ত শক্ত, কিন্তু নিম্নাংশ ছিল অত্যন্ত কোমল (অপর একটি মতে, পুণ্যবতী গান্ধারীর দৃষ্টির মধ্যে এক অসামান্য তেজ ও ক্ষমতা ছিল। এই কারণেই যুদ্ধশেষে নিজ পুত্রদের সৎকারকার্যে কুরুক্ষেত্রের রণভূমিতে তাঁর আগমন ঘটলে ধর্মপরায়ণ যুধিষ্ঠির যখন নিজের উদারতাবশতঃ সমস্ত প্রকার হত্যাকাণ্ডের দায়ভার নিজের কাঁধে তুলে তুলে নিয়ে গান্ধারীর কাছে শাস্তিভিক্ষা করেন, তখন যুধিষ্ঠিরসহ অন্যান্য পাণ্ডবভ্রাতাদেরকে ক্ষমা করলেও ক্ষণকালের জন্য তাঁর দৃষ্টি একবার যুধিষ্ঠিরের হাতের নয়নাভিরাম আঙ্গুলের দিকে পড়ে। তাঁর দৃষ্টির তেজে ওই অঙ্গুলিসকল কদর্য রূপ নেয়। তাঁর এই ক্ষমতার বহিঃপ্রকাশ আরো একবার দেখতে পাওয়া যায় যখন তিনি দুর্যোধনকে প্রাতঃকালে স্নানসিক্ত অবস্থায় সম্পূর্ণ নগ্ন দেহে তাঁর সামনে আসতে বলেন। নিজের চক্ষাবরণ উন্মোচন করে জ্যেষ্ঠপুত্রের শরীরের দিকে পূর্ণ দৃষ্টিতে একবার তাকালেই তাঁর বরে দুর্যোধনের দেহের উক্ত অংশগুলি বজ্রদৃঢ় হয়ে উঠতো। কিন্তু বাসুদেব কৃষ্ণের প্ররোচনায় দূর্যোধন লজ্জাবশত একটি কৌপিন পরিধান করে গান্ধারীর সামনে আসেন। ফলতঃ খুব স্বাভাবিকভাবেই নিম্নাঙ্গ আবৃত রাখার কারণে দুর্যোধনের দেহের ওই অংশটি গান্ধারীর দৃষ্টির অগোচরে চলে যায়। অনিবার্য পরিণাম স্বরূপ দুর্যোধনের দেহের ওই অংশটি পূর্বের ন্যায় কোমল থেকে যায়, দেহের ওই নিম্নাংশ আর দুর্ভেদ্য হয়ে উঠতে পারেনা। এই ঘটনায় গান্ধারী অত্যন্ত হতাশ ও মর্মাহত হলেও তাঁর পক্ষে আর কিছুই করা সম্ভব ছিলনা। কারণ একাজ তিনি কেবলমাত্র একবারই করতে পারতেন) - যা ত্রিকালদর্শী কৃষ্ণের অজানা ছিলনা। শ্রীকৃষ্ণ বারবার নিজের উরুর ওপর চাপড় মেরে ভীমকে উৎসাহিত করে চলেছিলেন। আসলে এই ইঙ্গিত নিছকই কোনোপ্রকার উৎসাহদান ছিলনা। এটি ছিল দুর্যোধনের লৌহকঠিন দেহের একমাত্র দুর্বল অংশ তার দুই উরুর উপর আঘাত করার নির্দেশ - যা গদাযুদ্ধে পারদর্শী ও অভিজ্ঞ যোদ্ধা ভীমের বুঝতে একেবারেই অসুবিধা হয়নি। যদিও কটিদেহের নিম্নাংশে আঘাত মহারথী মোটেই প্রথার নিয়মানুসারী নয় তবুও আসন্ন পরাজয়ের হাত থেকে অব্যাহতি, দুর্যোধনের পূর্বকৃত সমস্ত প্রকার অনাচার ও পান্ডবভ্রাতাদের গুপ্তহত্যার ষড়যন্ত্র এবং নিজের পূর্ব প্রতিজ্ঞার কথা স্মরণ করে ভীমসেন একাজ করতে মোটেই পিছপা হননি। যুদ্ধজয়ে ভীমের এই অন্যায় পথ অবলম্বনকে মোটেই সমর্থন করতে পারেননি শ্রীকৃষ্ণের জ্যেষ্ঠভ্রাতা বলরাম। প্রচন্ড ক্রোধে তিনি ভীমকে আঘাত করতে উদ্যত হলেও কৃষ্ণ তাকে একাজ হতে নিবৃত্ত করেন এবং বোঝান যে অন্যায়ের বিরুদ্ধে জয়লাভের জন্য অন্যায় পন্থা অবলম্বন কখনোই অন্যায্য নয়। ভারতবর্ষীয়দের বর্তমান ও ঐতিহাসিক পরিস্থিতির সঙ্গেও দুর্যোধনের এই অবস্থার কিছু হাস্যকর সাদৃশ্য খুঁজে পাওয়া যায়। চিরকালই এদেশের রাজন্যবর্গের একাংশ নিজেদের জীবন বাঁচাবার জন্য সম্ভাব্য যত প্রকারের পন্থা অবলম্বন করা যায় তা করেছে; নিজেদের নীতিজ্ঞান, বিবেকবোধ, ন্যায়-অন্যায়ের বিচার করেনি; ফলস্বরূপ সমগ্র ভারতবাসীকে হতে হয়েছে অপরিসীম দুঃখ-যন্ত্রণার ভাগীদার। বর্তমানে আমাদের মধ্যেও বসবাস করছে ঠিক এইরকম চিন্তাধারা ও প্রকৃতিসম্পন্ন কিছু মানুষ যারা নিজেদের ক্ষণিকের সুখ নিবৃত্তির জন্য সজ্ঞানে বা অজ্ঞানে এমন সমস্ত মুর্খামিপূর্ণ, অপরিণামদর্শী কর্মকাণ্ডের অংশীদার হয়ে পড়ছে - যার ফলে ভুক্তভোগী হতে হচ্ছে আমাদের সকলকে; ব্যর্থ হচ্ছে সমাজের শুভবুদ্ধি সম্পন্ন মানুষদের সংকটমোচনের জন্য চালিয়ে যাওয়া আপ্রাণ সম্মিলিত প্রচেষ্টা। অবশ্য শুধু ভারতভূমিই নয়, পৃথিবীর সর্বত্রই জনসমাজের একটি ক্ষুদ্র বা বৃহৎ অংশের মধ্যে এরূপ মানসিকতা সম্পন্ন ব্যক্তিদের ব্যক্তিদের দেখতে পাওয়া যায়। কোনো দেশ তথা সমাজের ধর্মীয়-জাতিগত-ভাষাগত ঐক্য, উন্নতি-সুখ-সমৃদ্ধির ধবংস সাধনে এই বিশেষ শ্রেণিভুক্ত মানুষরা অনেকটাই দুর্যোধনের উরু'র অনুরূপ ভূমিকা পালন করেন।
অনুরূপ ঘটনার উদাহরণ পাওয়া যায় গ্রিক গাথার মধ্যেও। গ্রিক মহাকাব্য ইলিয়াড(Iliad)-এ বর্ণিত মহাবীর অ্যাকিলিসের দেহের দুর্বলতম অংশটি ছিল তার গোড়ালি (Heel)। 'অ্যাকিলিস' শব্দটিকে 'অ্যাকস' বা দুঃখ এবং 'লাওস' অর্থাৎ জনগণ, গোষ্ঠী বা জাতি'র মিলন হিসাবে বিশ্লেষণ করা যায়। যুদ্ধপ্রিয় অ্যাকিলিস যখন সঠিক কাজ করতেন তখন তার শত্রুপক্ষের লোকেরা দুর্দশা ভোগ করতো করতো আর যখন বেঠিক কাজ করতেন তখন তার নিজের দলের লোকেরাই হতো দুঃখ-কষ্টের শিকার; তাই তিনি ছিলেন মানবজাতির বা মানবগোষ্ঠীর দুঃখের প্রতীক। মহাভারতে দুর্যোধনের মা গান্ধারী ন্যায় একিলিসের জন্মদাত্রী থেটিসও চাইতেন যে তার সন্তান যেন যুদ্ধবিদ্যায় অজেয় অপরাজেয় হয়ে ওঠে। এই উদ্দেশ্য সাধনের জন্যই নিজ পুত্রের গোড়ালি ধরে ধরে তাকে স্টিক্স নদীর জলে ডুবিয়ে ছিলেন। প্রচলিত বিশ্বাস অনুযায়ী এই নদীর জল নাকি অলৌকিক ক্ষমতা সম্পন্ন ছিল ছিল, ফলস্বরূপ এই নদীর পবিত্র জলের স্পর্শ পেয়ে পেয়ে অ্যাকিলিসের দেহ বজ্রকঠিন ও দুর্ভেদ্য হয়ে ওঠে। কিন্তু দুর্ভাগ্যবশত অ্যাকিলিসের গোড়ালি ধরে মা থেটিস এই কাজটি সম্পন্ন করেছিলেন বলে তাঁর গোড়ালিটি জলের স্পর্শ পায়না। পরিণামে তা আর দশজন সাধারণ মানুষের মতোই দুর্বল থেকে যায় যায়। মহামহিম ট্রয় নগরীর বিরুদ্ধে গ্রিসের মরণপণ যুদ্ধের সময় তাই ট্রয়ের শ্রেষ্ঠ বীর যোদ্ধা যুবরাজ হেক্টর কিংবা ইথিওপিয়ার পরাক্রমশালী রাজা মেমননকে পরাজিত ও হত্যা করতে সক্ষম হলেও হেক্টরের কনিষ্ঠ ভ্রাতা প্যারিস(যিনি ছিলেন এঁদের তুলনায় একেবারেই সাধারণ মানের দ্বিতীয় বা তৃতীয় সারির এক যোদ্ধা)-এর নিক্ষেপ করা প্রাণঘাতী এক বিষময় শরাঘাতে (যেটি সরাসরি বিদ্ধ করেছিল তাঁর গোড়ালিকে - অনেকেই মনে করেন দেবতা অ্যাপোলো ধূর্ততার মাধ্যমে প্যারিসের দ্বারা নিক্ষিপ্ত ওই তিরের গতিপথ অ্যাকিলিসের গোড়ালির দিকে ঘুরিয়ে দেন) এই মহাবীরের মৃত্যু হয়। তাই 'অ্যাকিলিস হিল' - এই বাগধারাটি নির্দেশ করে কোনো প্রাণী, ব্যক্তি, বস্তু বা প্রতিষ্ঠানের এমন কোনো দুর্বল দিক, অবস্থা বা অংশকে, যেখানে আঘাত হানলে তা হয়ে উঠতে পারে প্রাণঘাতী; যেখানে আঘাত করলে তার মৃত্যু বা পতন হয়ে ওঠে অবধারিত। ভারতবাসীর ঐক্যবদ্ধতার পথে তাদের সংকীর্ণ স্বার্থসিদ্ধির বাসনা এবং ক্ষুদ্র ব্যক্তিগত ও আঞ্চলিক স্বার্থরক্ষার উদ্দেশ্যে জাতীয় স্বার্থের প্রতি অবহেলার এই ইতিহাস কিন্তু ধারাবাহিক ও চিরন্তন - এটিই তাদের সবথেকে বড়ো weakness বা 'vulnerable point'। ভারতনিবাসীর এই চিরকালীন ঐক্যহীনতা ও বিশ্বাসঘাতকতা তাই আমাকে সবসময়ই 'দুর্যোধনের উরু' কিংবা 'Achilles Heel' নামক Idiom-টির কথা মনে করিয়ে দেয়।
বিভেদকামীতার এই ভয়াবহতা আজ আমাদের মাঝে যেন নবরূপে বিদ্যমান। বহিরাগত এক মারণজীবাণু মানবদেহে সংক্রমণের মহাভয় দেখিয়ে আজ যেন ভারতবাসীর মধ্যে সম্পূর্ণ নতুনভাবে একপ্রকার বিভাজন সৃষ্টি করতে চাইছে। মানবজাতির সামনে আজ এক ঘোরতর বিপদ উপস্থিত। সব জেনেবুঝেও অস্তিত্ব রক্ষার সংকটমোচনের কোনো আয়ুধ এখনো আমাদের হাতে নেই। সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখাকেই এই মুহূর্তে জীবন রক্ষার একমাত্র দাওয়াই বলে মনে করা হচ্ছে (যদিও মহামারীর আকার নেওয়া সংক্রমণশীল রোগ প্রতিবিধানের নিমিত্ত সামাজিক দূরত্ব রক্ষা, অন্য সকলের থেকে বিচ্ছিন্ন করে নিজেকে গৃহবন্দি রাখা, বারংবার হস্ত ধৌতকরণ, জীবাণুনাশক সহযোগে উষ্ণ জলে স্নান প্রভৃতি সবকিছুই খ্রিস্টপূর্ব যুগের প্রাচীন ভারতে রচিত 'চরক সংহিতা' এবং 'অষ্টাঙ্গহৃদয়'-এর মতো আয়ুর্বেদ শাস্ত্রগুলিতে উল্লিখিত হয়েছে)। কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে এটাই - আমরা কি ইতিহাস থেকে শিক্ষা নিচ্ছি? নাকি প্রাচীনকাল থেকে প্রচলিত আমাদের ধারাবাহিক মূর্খামিরই পুনরাবৃত্তি ঘটতে চলেছে আরও একবার? প্রাচীন যুগে প্রথমে পারস্য এবং পরবর্তীকালে গ্রিক শক্তির, মধ্যযুগে ইসলামের এবং আধুনিক যুগে ব্রিটিশ শক্তির আক্রমণকালে যেভাবে আমাদের স্বদেশীয় নৃপতিগণ নিজেদের সংকীর্ণ স্বার্থ পরিত্যাগ করে বহিরাগত আক্রমণকারীদের বিরুদ্ধে ঐক্যবদ্ধ হতে পারেননি, আজ এই মারণজীবাণুর করাল গ্রাসের হাত থেকে মুক্তিলাভের জন্য আমরাও কি জাতি-ধর্ম-বর্ণ-বিত্তের ভেদাভেদ ভুলে ঐক্যবদ্ধভাবে এর মোকাবিলা করতে পারছি ? নাকি আবারো নিজেদের সংকীর্ণ স্বার্থ ও ক্ষুদ্র নিরাপত্তা রক্ষা করার জন্য প্রকৃতপক্ষে নিজেদেরকে আরো ভয়াবহ ও বিধ্বংসী বিপদের দিকে নিয়ে যাচ্ছি ? প্রশ্ন একটা, উত্তর কিন্তু অনেক। সুধী পাঠক ও বন্ধুগণ, আপনারা কি মনে করেন?
কৈফিয়ৎ ও তথ্যসূত্র : উপরিউক্ত সন্দর্ভটি রচনাকালে তথ্য সংগ্রহের জন্য আমি 'অন্তর্জাল' (Internet) অন্বেষণ ছাড়াও পুরাণ, মহাকাব্য ও ইতিহাস বিষয়ক বেশ কয়েকটি বইয়ের সাহায্য নিয়েছি। তবে রচনার 'কেন্দ্রীয় ধারণা' (Central Concept) ও 'মূল বিষয়বস্তু' (Subject Matter) সম্পূর্ণতই আমার নিজস্ব - এক্ষেত্রে অন্য কারো দাবি আমি কোনোমতেই স্বীকার করিনা। ব্যাপকহারে অন্তর্জালের সহায়তা গ্রহণ ছাড়াও নিম্নোক্ত গ্রন্থাবলী ও লেখনীসমূহও তথ্যাদী আহরণের জন্য গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে -
(১) গ্রিক বীরদের আখ্যান - রজার ল্যান্সেলিন গ্রীন;
(২) কৃষ্ণ দ্বৈপায়ন ব্যাস কৃত মহাভারতের সারানুবাদ - রাজশেখর বসু;
(৩) হারকিউলিস - সুকুমার রায়;
(৪) ঐতিহাসিক সমগ্র - হেমেন্দ্রকুমার রায়;
(৫) আধুনিক ভারত চর্চা - গোপালকৃষ্ণ পাহাড়ী;
(৬) আধুনিক ভারতবর্ষের ইতিহাস - সিদ্ধার্থ গুহ রায় ও সুরঞ্জন চট্টোপাধ্যায়;
(৭) পলাশী থেকে পার্টিশন ও তারপর - শেখর বন্দ্যোপাধ্যায়;
(৮) মধ্যযুগের ভারত (প্রথম ও দ্বিতীয় খন্ড) - সতীশ চন্দ্র;
(৯) ধর্মের সহিংস ইতিহাস - গোলাম আহমেদ মোর্তাজা;
(১০) রেনেসাঁস : বিশ্বায়নের শুরু - সুরজিৎ দাশগুপ্ত।
∆ প্রবন্ধের বক্তব্য লেখকের নিজস্ব । 'সাহিত্য চেতনা' কোনো বক্তব্যের দায় স্বীকার করে না ।