ভ্রম
সোনালী মিত্র
অলঙ্করণ : বিশ্বজিৎ মণ্ডল |
না, না কিছুতেই মনের ভুল নয় এই নিয়ে বেশ কয়েকদিন ধরেই তো হচ্ছে। সেই কয়েকটা সুড়সুড়ে পিঁপড়ে একসাথে কামড়ে ওঠা, এ কিছুতেই মনের ভুল নয়। তবে এই কামড়টা ওঠে সেই অলীক স্বপ্নটা দেখার পরেই।
ডাক্তার বারবার জানতে চেয়েছেন, কি কষ্ট হচ্ছে বলুন তো ! কিন্তু এই কথা কি বলা যায়? বুকের কাপড় গুছিয়ে নিয়ে ছেলে অনুপের ঘরে ঢোকে সে। ছেলে, বৌ এখন দু'জনেই অফিসে গেছে। এই তো মৌকা, গুটিসুটি পায়ে সে এসে বড় ড্রেসিংটেবিলের সামনে দাঁড়ায়। নিজেকে আবার দ্যাখে, ঈশ কত বেঢপ হয়ে গেছে দেখতে ! চোখ ধারণ করে স্রোতস্বিনী নদী, কানের মধ্যে উলুধ্বনি কলকল করে বয়ে যায়। যখন বিয়ে হয় তখন সবে ১৭, ননদ খোঁপার ভিতরে রুপোর চাবি গুঁজে বলেছিল, কি সুন্দর দেখতে রে তোকে বৌ ! আরও চাপা স্বরে বলেছিল, হ্যাঁ রে কচি ঘাসের জঙ্গল সাফ্-সুতরো তো ! মাঠে জাগা ধানের শীষের মতো সহেলী হাসি নিয়ে ঢলে পড়েছিল ননদ, নতুন বৌয়ের গায়ে। লজ্জায় তার বৌ– মুখ রাঙা হয়ে উঠেছিল, আসন্ন রাত্রিপ্রবাহের কথা ভেবে। তার পরের দিনগুলো তো টারবাইনের চাকায় গতিময়।
বাঁজা তকমাটা যখন শরীরের উপর ৩৬০ডিগ্রি এঙ্গেলে জাঁকিয়ে বসেছে, ডাক্তার-বৈদ্য গুলে খেয়ে চোঁয়া-ঢেকুরে সেসব হজম প্রায়, তখন চৌকস শ্বাশুড়ীমা কোত্থুকে জলপড়া-তেলপড়া ছেড়ে বংশ রক্ষার্থে আরও পিপাসার্ত হয়ে এক-এক শীতের রাতে চারমাথার মোড়ে পঞ্চমুখী জবাফুল দিয়ে ঠান্ডাজল হড়হড় করে ঢেলে গরুচান করিয়ে দিতেন। ততদিনে অবশ্য ফুলশয্যার গন্ধটা ম্যাড়ম্যাড়ে হয়ে ঋতুদিনের নষ্ট গন্ধের মতো খুশবু ছড়াচ্ছে ছ্যাড়ছ্যাড়ে জীবনে। কোন এক ধুনিবাবার আশকারায় তার মাস্কারা মাখা চোখে রাতজাগা কালিত্বে জমে উঠেছিল কুলকুলে আতঙ্কস্রোত। শুরু হয়েছিল দাম্পত্যের তোলপাড় অন্ধকার মাখামাখি ।রাত্রির ভরা নির্জনতার গায়ে গলির কুকুরের দল যখন চিৎকার করে হেদিয়ে মরে অদৃশ্য বা দৃশ্য-দৃশ্যের প্রতিরোধে, সেই লোকটা যাবতীয় নিরোধকে দূর হঠিয়ে বলেন, ঋতুবস্থায় সন্তান সম্ভবনার সবচেয়ে উত্কৃষ্ট সময় রে পাগলী।লোকটা, ছেলে পাওয়ার চাহিদায় তথৈবচ আঁশটে রক্ত গন্ধের মধ্যে মিশিয়ে দিতো তার বীর্যের উৎসেচক । যন্ত্রণার চাপ চাপ ক্ষরণ নিয়ে এক সময় কোন দেবতার কৃপায় যে মা হল ঠিক বলতে পারেনা মনোরমা। লোকটা ঠোঁটের ভিতর ঠোঁট ভরে নিয়ে গুচ্ছেক লালা জিভের ঢেউয়ে মিশিয়ে দিয়ে বলেছিলো খুশিতে, তুমি তো সেই দাবাই আমার যা চাটতে চাটতে একটা গোটা নরজন্ম, নরকেও ভ্রষ্ট হওয়া যায়। মনোরমার মনে হয় যেন এসব গত জন্মের কথা।
দাবাই-ই বটে ! সবাই ঘুমিয়ে গেলে ওষুধের কাছে সানকিতে ভরা ধূসরতা নিয়ে চুপিচুপি দাঁড়ায় সে। কচি সবুজের দিকে হয়তো তখন উৎসব ! গভীর রাতের টুনিলাইটগুলি নক্ষত্রের চেয়ে বেশি মেধা নিয়ে জ্বলতে থাকে ছেলের ঘরে। সে জানে, এই অবসরে ছেলে অনুপ সিগারেট ঠোঁটে ব্যালকনিতে দাঁড়াবে এসে । সামনের ফুটপাতে রাতজাগা ভিখারীদের চোখে ক্লান্তির অপ্সরা বসেছেন যেন।ফুটপাতের ঘুমন্ত আধা ন্যাংটো মেয়ে-ছেলেদের হাভাতে শরীর চকচকে দৃষ্টি নিয়ে চেটে খায় রাত্রিদানব। আসলে মধ্যরাতের নিশির মধ্যে ঘুমের ওষুধ আছে । প্রলয়কারী ধ্বংস-মানুষদের সেই ওষুধ নিস্তব্ধতার মধ্যে থেকে মুখ বাড়িয়ে ডাকে । সকলের অলক্ষ্যে সেই ঝাঁঝালো ওষুধ খেয়ে চোখ থেকে ঝরে জল ।২৯শে অনুপের বাবা চলে গেলো। লোকে আড়ালে বলল– আহারে কচি বয়সের বৌ, বুড়ো বরের আয়ু বেঁধে রাখতে পারলো না গো ! তারপর তো গল্প বাকি জীবন ! ছেলেকে মানুষ করা, ছেলের চাকরি, ছেলের বিয়ে...কোথা দিয়ে যে কেটে গেলো ! মাঝেমধ্যে সোনাদা আসতো, গুঁড়ো-গুঁড়ো বরফের মতো স্বর্গ বুনে দিতে ঠোঁটে । সে মামার বাড়ির পাড়াতুতো দাদা। আয়-ব্যয়ের সংসারে শ্বাশুড়ী-শ্বশুড়ের মাপা চালের হাড়ায় মাছি ইস্তক সেঁধোতে পারেনা সেখানে সোনাদা কোন ছাড় !
হলুদ জলে সোনা ভিজিয়ে শুকনো কাপড়ে মুছে নিলে দেখবি সোনা চকচকে হবে। এমন সব সাংসারিক টোটকা কানে ঢেলে দেবার মাঝে বীনু বৌদি একসময় বলেছিলো, হ্যাঁ রে উত্তাপ গুলো ধরে রাখিস না ঠাকুরঝি...জলে বইয়ে দে। সেই বীনু বৌদিই আজকাল দেখা হলে শোকের দিকে খুলে বসে নিজস্ব সাম্রাজ্য। আর্থাইটিসে ভোগা হাড় ঝরঝরে শরীর যে ঠিক কোথায় রাখলে দু'দণ্ড মাটি হওয়া যায় সেই সুখ খুঁজে নিতেই বোধহয় ভাঙা পথ পেরিয়ে এসে মনোরমার দরজায় কঁকিয়ে মরে। এক সন্ধ্যায় বান ডাকার মতো ঝপাঝপ করে রক্তবৃষ্টি ঢেলে ৪২ বছর বয়সেই মাসের ওটা বন্ধ হয়ে গ্যালো বীনু বৌয়ের।তার কর্তা বল্লেন, এত তাড়াতাড়ি ! এতো ঠিক নয়। ভাঙনের বীজ বপনের কাজটা তখনই শুরু হলো বোধকরি। কথায় বলে না পুরুষের চিতায় না উঠলে বীর্যের তেজ কমে না ! অথচ তার আর নাভিসমুদ্রে তোলপাড় ঢেউ ওঠেনা, গর্জনশীল চল্লিশায় বেজে ওঠে না গনগনে আগুন রিডের গিমিক। রাতগুলোয় কর্তাপুরুষটি দাঁত নখ মেলে বুড়ো হালুম হয়ে উঠলেই বীনু বৌদি কেন্নোর মতো লেপ- কাঁথার ভিতরে সেঁধিয়ে যেতো উত্তাল ভয়ে। এসব কথাগুলো এক নাগারে বলে হাঁফিয়ে ওঠে বীনু বৌদি। মেনোপজের পরের বাড়তি যন্ত্রণায় সকল নারী চরিত্রই কি অসুখী ! আসলে একটা অতিরিক্ত ভয় গ্রাস করাকে কর্তা আজকাল সন্দেহবাতিক বলে ডাকে। অন্ধকার গুমোট হলে মশারির খাঁজে জমে ওঠা দলা দলা বিতৃষ্ণা, না-ক্ষরণের ব্যথাটুকু। মন অথবা শরীর কোনটাই যে জাগেনা বীনু বৌদির আজকাল।
মদ যত পুরনো হয় তার চাহিদা ততবেশী। কোন মহাপুরুষ যে নারী আর মদকে একাসনে বসিয়ে তেলসিঁদুর লেপে ছিলো খুব জানতে ইচ্ছে করে!কুকুরগুলো ভাদ্দুরের তাপ গায়ে পেলেই দোকান-বাজার লোকজন তোয়াক্কাতেই রাখে না। অনুপমা রাস্তাঘাটে একসময় এসব দেখে ঘরের দোড় বন্ধ করে পুড়ে যেতো দুপুরগুলোয়। ৩০-৩৪ বছর বয়স মেয়েছেলে শরীরে ভরন্ত জোয়ার আসে, বাসন মাজতে মাজতে মালতি ঝি বলেছিলো চোখ সরু করে। ঋতুস্রাবের আগে ও পরের তলপেটের নীচের রাক্ষসগ্রাম খিদেটা চিনচিন করে উঠলেই মনে হতো ছাগল-গরু যা পাই ধ'রে খাই। একটা নধর সাইজের গাজর অথবা লম্বাটে বেগুনের খোঁজে লুকিয়ে ছুটে যেতো হেঁসেলের সব্জীঝুড়ির দিকে। ছেলে অনুপ তখন স্কুলে জীবনবিজ্ঞানে ব্যাঙ ব্যবচ্ছেদ করে খাতায় লিখে রাখছে হয়ত, এই এই হল পৌষ্টিক তন্ত্র,থ্যাম্বপ্যাড,আর এই এই হল জননতন্ত্র...এই জননতন্ত্রর জন্যই মেয়েছেলে-মা হয়ে ওঠে।
নার্স মেয়েটি শুশ্রুষা এগিয়ে দিলে রোগীর ব্যথা কর্পূরের মতো উবে যায় ত্বক থেকে। এই তো হাসপাতাল থেকে ছুটির আগেও রোগা-পাতলা নার্স মেয়েটি একমুখ হাসি নিয়ে মাথার কাছে এসে দাঁড়িয়েছিল টুকরি ভরা আরাম নিয়ে। দম বন্ধ মনোরমার কানেকানে বলেছিল সে, হাসপাতাল একবুক ডেটল আর মধুমেহ গন্ধ নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকে স্বয়ং যমদূত হয়ে। ঘরে ফিরে যাবতীয় ইচ্ছেদের ডানা মেলে দিন আকাশে।হাসপাতাল থেকে গাড়ি করে ফেরার সময় জনলা দিয়ে দেখেছিল মনোরমা, নার্স মেয়েটি ধীরে ধীরে কেমন গাছ হয়ে যাচ্ছে ডালপালা মেলে।
রোগটা হবার পর থেকেই আজকাল নাকে রজনীগন্ধার গন্ধ ফিরে ফিরে আসে মনোরমার। ফিরে আসে ওই নষ্ট রক্তের আঁশটে বমি।২৯ বছর আগের ফুলশয্যার স্বপ্নটাও কেন যে বারবার !! এসব ভাবতে ভাবতেই অনুপমা সেই কাজটা শুরু করলো যেটা সে বাড়ি ফাঁকা হলেই করতে শুরু করে ইদানিং। আয়া মেয়েটা তো মশগুল হয়ে বাংলা সিনেমা দেখে তখন। অনুপমা ড্রেসিংটেবিলের থেকে চটপট তুলে নেয় সুগন্ধির কৌটো, মন ভরে শরীরে ছেঁটায়। লিপস্টিকের প্রলেপ লাগায় ঠোঁটে, চোখে গভীর করে কাজল লাগায়। যদিও ভয় হয়, বৌ বাড়ি ফিরলে দাঁত চেপে ঝগড়া করবে অনুপের সাথে আর বলবে তোমার মা সম্পূর্ণ উনমা ...। ধুর্ এসব ভেবে লাভ নেই, মনোরমা পা টিপে-টিপে নেমে আসে নিজের ঘরে। দাঁড়িয়ে থাকে জানলায়, ওই তো কত মানুষ যাচ্ছে। যেন অনুপের বাবার মত কেউ কেউ...সায়ার ভিতরে হাত ভরে অলীক সুখে চোখ বোজে সে আর নিজের মনেই ফিক করে হেসে ওঠে, চুপিচুপি শুনেছে ডাক্তারকে বলতে, "বাড়ি নিয়ে যান মাকে, স্টেজ টুতে আছেন, সেন্স নেই ওই স্থানে" ।