1 / 7
2 / 7
3 / 7
4 / 7
5 / 7
6 / 7
7 / 7

অপরিণত শ্রাবণ : বিদ্যুৎ ভৌমিক – সাপ্তাহিক সাহিত্য পাতা

অপরিণত শ্রাবণ 

 বিদ্যুৎ ভৌমিক 

অলঙ্করণ : বিশ্বজিৎ মণ্ডল

কটা ঘুড়ি মধ্য গগন ছাড়িয়ে উড়তে উড়তে অকস্মাৎ বৃষ্টিতে গোত্তা খেতে খেতে মুখ থুবড়ে পড়লো ! ওদিকের বর্ণনীল আকাশটার দিকে তাকিয়ে অবিশ্রান্ত হঠাৎ বর্ষণে ভিজে উঠছিল ফড়িং ! ক'দিন আগে হসপিটাল থেকে করোনা মুক্ত হয়ে ফিরেছে ফড়িং ! পাড়া থেকে নিষেধাজ্ঞা জারি করেছে , ফড়িঙ  যেন বাড়ির বাহিরে পা না রাখে । অষ্টম শ্রেণীর ছাত্র ফড়িঙ  । বইপত্র কগোজ কলম সমস্ত কিছুই আলমারিতে তুলে রেখেছেন প্রবীর বাবু , কেননা ডক্টর দিবাকর চৌধুরী বারংবার ফড়িঙ –এর বাবাকে বলেছেন এই সময় ওর মাথায় কোন রকম পড়াশোনা নিয়ে চাপ না দেওয়া হয়  । তাই মোবাইলে গেম, আর ছাদে দুপুর বেলায় ঘুড়ি  লাটাই– এসবই এখন ফড়িঙের সময় কাটানোর একমাত্র উপাদান ! কিন্তু কে জানে এই মধ্যদুপুরে একা নিঃশব্দে চুপি চুপি পা টিপে টিপে  সিঁড়ি ভেঙে দোতলার ছাদে ঘুড়ি লাটাই নিয়ে চলে এসেছে ফড়িঙ, তাও আবার অথই বৃষ্টিতে ঘুড়ি হারিয়ে একলা মন খারাপ ভরা মন নিয়ে  ভিজেই চলেছে !          

    কিছুদিন আগে প্রবীর বাবুকে ফড়িঙ  এর গৃহ শিক্ষক ফোন করে জানিয়ে  দিয়েছেন– এই মুহূর্মুতে   তিনি ফড়িঙ '-কে পড়াতে  আসতে পারবেন না ! কারণ–করোনা ভাইরাস ! এদিকে স্কুল,  কলেজ' বিশ্ববিদ্যালয়– সমস্তই বন্ধ ! তার মধ্যে ঘন-ঘন লক ডাঊন ! ভীষণ চিন্তায় রয়েছেন   ছেলের ভবিষ্যতের কথা মনে করে । একটা বেসরকারি অফিসের  বেতন  ভুক কর্মচারী প্রবীর বাবু । ফড়িঙ এর মা অচলা দেবী, এই বসু পরিবারের গৃহবধু । সংসারের পান থেকে চুন তিনি খসতে দেন না । শ্বশুর শাশুড়ির মৃত্যুর পর পাহাড় প্রমাণ দায়িত্ব তার মাথার উপর চেপে বসেছে ! এই বসু        বাড়ির গৃহকর্তা উদয়ন বসু অর্থাৎ প্রবীর বাবুর বাবা মধ্য কলকাতার একটা বেসরকারি নামী   কোম্পানির কর্মচারী ছিলেন । বছর উনিশ আগে উনি কর্ম জীবন থেকে  অবসর নেন । ওনার সেই    সময়ের যাবতীয় সঞ্চয় এই বাড়ির তৈরির পেছনে লাগিয়ে দিয়েছিলেন ! মায়ের মৃত্যু প্রবীর বাবুর   বাবার মৃত্যুর বছর তিনেকের ভেতর হয়েছিল । হঠাৎ ম্যাসিভএটাক ! হসপিটালে নিয়ে যেতে যেতে  পথেই বাসন্তী দেবী নিঃশ্বাস বন্ধ হয়ে যায় ! এতবড় বাড়ি এই সামান্য কটা রোজগারের টাকায় রক্ষনা-বেক্ষণ করতে  গিয়ে প্রবীর বাবু হীমশীম খেয়ে যাচ্ছেন ! বাড়ির একতলাটা  ভাড়া দিয়েছেন,    তাই হয়তো সংসার খরচের  কিছুটা অংশ  ওই ভাড়ার টাকায় চলে যায় । প্রবীর বাবু হয়তো সারা মাসের টাকা এনে দিলেও স্ত্রী অচলা দেবী স্বামীর ওই অল্প বেতনে এবং বাড়ি ভাড়ার টাকায় সুন্দর পরিপাটি করে সংসারটাকে চালিয়ে নিয়ে যাচ্ছেন ! প্রবীর  বাবুকে এই ব্যাপারে কোন রকম ঝুঁকি  নিতে হয়না, অচলা দেবী সব সামলে নেন ।                                                                        গতকাল দুপুরে ছাদে ঘুড়ি ওড়াতে গিয়ে বৃষ্টিতে ভিজে ফড়িঙের আবার জ্বর সর্দি কাশি হয়েছে ! এই      বাড়িটায় মনের দিক দিয়ে সম্পূর্ণ একা ! এখন প্রবীর বাবুর অফিস যাওয়া বন্ধ । বাড়িতেই তার  টিভি  দেখে খবরের কাগজ, বই-পত্র  পড়ে, সন্ধ্যে বেলায় পাড়ার ক্লাবে তাস-ক্যারাম পিটে দিব্বি সময় কেটে যাচ্ছে । আর সংসারের যাবতীয় দিক সামলাতে হচ্ছে অচলা দেবীকে । তাই সারাদিনের সমস্ত ক্লান্তি দূর করতে দুপুরে একটু ভাত ঘুম দিতেই হয় শ্রীমতী অচলা দেবীকে ।  ছেলেকে তিনি পাশে নিয়েই শোন । স্বামী পাশের ঘরে ওই সময় প্রতিদিন  অফিসের কাজ অন লাইনে ল্যাপটপে করেন । তাই ছেলে দুপুর বেলায় কি  করছে , সে হদিশ প্রবীর বাবুর নেই  বললেই চলে ! অচলা ঘুমিয়ে পড়ার পর নিঃশব্দে বিছানা ছেড়ে উঠে ঘুড়ি লাটাই নিয়ে পা  টিপেটিপে ছাদে ছাদে চলে গিয়েছিল ফড়িঙ ! এতবড় একটা রোগ থেকে সেরে ওঠার পর আবার যদি জ্বরটা ফের দেখা দেয় ! চিন্তায় চিন্তায় আদখানা হয়ে যাচ্ছেন প্রবীর  বাবু অচলা দেবী ।  সন্ধ্যায় ডক্টর জয়ন্ত দেবনাথের কাছে ফড়িঙ-কে দেখিয়ে নিয়ে এসেছেন, বেশ কিছু টেস্ট করতে        দিয়েছেন ডক্টর দেবনাথ ! গতকাল মাঝরাতে কাঁপুনি দিয়ে জ্বর এসেছিল ফড়িঙের ! ঘুমের ঘোরে  ভুল বকছিল ! একশ, দু'-আড়াই শরীরে টেম্পারেচার ছিল ! আইশ ব্যাগ মাথায় দিয়ে , জল পট্টি    দিয়েও জ্বরটা সেই মুহূর্তে যায়নি । অবশেষে অতরাতে ডক্টর দেবনাথ-কে ফোন করে সব খুলে বলতে, অর্ধেক প্যারাসিটামল ফড়িঙকে দিতে বলেছেন । ওটা দেওয়াতে-ই জ্বরটা কিছুটা নেমেছে । তবুও টেম্পারেচার একশোর মধ্যে থাকছে নামছে !                        

     কিছুদিন থেকেই রাতে ভালো ঘুম হচ্ছিল না অচলা দেবীর , রক্ত চাপ জনিত ব্যাপার । সংসারের এতটা চাপ ওকে একাই নিতে হয় , তাই হয়তো হাই প্রেশারের      মতো ব্যাধি     অচলা দেবীকে প্রতিদিন নির্ঘুম রেখেছে ! নিজের জন্য একটুও ভাবেন না । ভাবলেই যে            সংসার খরচের থেকে টাকা টান  পড়বে । প্রবীর বাবু অচলা দেবীকে ডক্টর দেবনাথের কাছে এ  কবার যেতে বলেছেন , কিন্তু অচলা দেবী  জানেন ডাক্তারের কাছে যাওয়া মানেই একগাদা টেস্ট, তারপর হাজারটা ওষুধ ! একপ্রকার পয়সার শ্রাদ্ধ ! সংসারটাকে ভালো বেসেছেন, তাই হয়তো নিজের ভালো মন্দ নিয়ে সে চিন্তা করতে ভুলেই গেছেন শ্রীমতী অচলা দেবী ! এদিকে আবার অমাবস্যা ও পূর্ণিমাতে হাঁটুর ব্যথাটা প্রকোট হয়ে দেখা দেয় । স্বামীকে কিছুই বলেন না, রাতে  পাশ ফিরে দাঁতে দাঁত চেপে শুয়ে থাকেন ! শরীর খারাপ মেনে নেওয়া  যায়, কিন্তু মন খারাপের ওষুধ  কে তাকে এনে দেবে ? বুকটা মধ্যে মধ্যে মোচড় দিয়ে উঠছিল অচলার । লোকলজ্জার ভয়ে  স্বামীর এই অস্বাভাবিক আচরণ ইচ্ছা থাকলেও জানাজানি হতে দেন নি ! এখন অচলা বেয়াল্লিশের কোঠায় । এই বয়েসেই শরীরের নানান রোগের সাথে উড়ে এসে জুড়ে বসেছে এই মন খারাপের রোগ ! ঘুমের ভেতর কতবার যে দেখে নেন তার পাশে শোওয়া স্বামী নামক পুরুষটা আছেন তো বিছানায়  ! কিছুদিন ধরে, কিছুদিন নয় প্রায় ছ'মাস হবে ওদের একতলার ভাড়াটে  বৌটার সাথে প্রবীর বাবুর একটা চাপা সম্পর্ক তৈরি হয়েছে । প্রথম প্রথম অচলা অনুধাবন করতে  পারতো না, পরে সেটা জানতে পেরে  না বোঝার গ্লানি ওকে অক্ষমতার শিকলে আশটে পৃষ্ঠে বেঁধে  রেখেছে ! অপরূপা– প্রবীর বাবুর ভাড়াটে । ছাব্বিশ সাতাশ বছরের যুবতী স্ত্রী । স্বামী একটা বিদেশী জাহাজ কোম্পানিতে কাজ করেন । সেই লোক ডাঊনের আগে দিবাকর অর্থাৎ অপরূপার স্বামী মাস খানেকের জন্য এখানে এসেছিল । দিবাকর সেই চলে যাবার পর থেকে অপরূপা ভীষণ নিঃসঙ্গ হয়ে পড়ে । একতলায় সারাদিন সারারাত একাই কাটায় । মাঝেমধ্যে দোতলায় অচলার কাছে নতুন রান্নার রেসিপি নিয়ে আলোচনা করতে আসতো, আর ফড়িঙের সাথে  দু'দান ক্যারাম পিটেও যেতো । আর ফড়িঙ'-ও অপরূপা মাসির কাছে অঙ্কটঙ্ক দেখিয়ে নিতে একতলায় যেতো । এভাবেই বেশ কিছুদিন চলছিল । ফেব্রুয়ারি মাসের প্রথম দিকে অচলা ওর বাপের বাড়ি ফড়িঙ'-    কে সঙ্গে নিয়ে দিন সাতেকের জন্য গিয়েছিলেন । প্রবীর বাবু বাড়িতে একাই ছিলেন । স্বামীর দু'বেলা খাবার কাজের একটা বয়স্ক বিধবা বৌ এসে রান্না করে ঘর পুঁছে বাসন মেজে দিয়ে চলে যেতো । একদিন ঘোটে গেল অঘটন ! সেদিন বিকেল পাঁচটা পাঁচ দশ হবে– প্রবীর বাবু ছাদে রেলিং ধরে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে এক কাপ চা নিজের হাতে বানিয়ে খাচ্ছিলেন । হঠাৎ অপরূপা এসে মৃদু হাসি দিয়ে ব'লল ; কি মশাই বৌদি নেই একাএকা চা বানিয়ে খাচ্ছেন ? প্রবীর বাবু সহাস্যে  অপরূপার কথার জবাব দিয়েছিল–  কি আর করবো, তোমার মতো একজন সুন্দরী শ্যালিকা  থাকতে আমাকেই চা বানিয়ে খেতে হচ্ছে ! এই একটা দু'টো কথা হতে হতে হঠাৎ আকাশ কালো হ'য়ে এলো ! বিশাল বিকট আওয়াজে বিদ্যুৎ চমকের সাথে মেঘ ডেকে উঠলো ! অপরূপা ওই  ভয়ে শিউড়ে উঠলো ! প্রবীর বাবুর এক হাত দূরে দাঁড়িয়ে অপরূপা ওর শুকনো শাড়ি-সায়া-ব্রা-ব্লাঊজ ছাদের রেলিং থেকে তৎপর হয়ে তুলছিল । হঠাৎ বাজ পড়ার বিকট শব্দে নিজেকে  আর ঠিক রাখতে পারেনি অপরূপা ! ভয়ে আতঙ্কে প্রবীর বাবুকে জড়িয়ে ধরেছিল ! এদিকে ওই মুহূর্তে প্রবীর বাবু হাতে চাঁদ পেয়ে গেলেন । একদিকে স্ত্রী ছেলে ফড়িঙ'কে নিয়ে বাপের বাড়ি গেছেন,          অন্যদিকে ভাড়াটে যুবতী সুন্দরী এক পরস্ত্রী'-কে একলা এভাবে কাছে পেয়ে নিজেকে ঠিক রাখতে পারেন নি ! অপরূপা, ওর মুখ খানা প্রবীর বাবুর বুকের মধ্যে গুজে ওকে জড়িয়ে ধরেছে, আর   প্রবীর বাবু সমস্ত ন্যায় অন্যায় পাপ তাপ ভুল নির্ভুল দোষ গুন সব নিমেষেই চুলোয় দিয়ে অপরূপাকে সোহাগ মাখা দুহাতে জাপটে ধরলো ! ওদের দোতলার ছাদে একটা ছোট্ট ঘর, অপরূপাকে সঙ্গে   নিয়ে প্রবীর বাবু প্রবেশ করলেন সেই ঘরে ! তখন অবিশ্রান্ত বর্ষণে দু'জনের জামা কাপড় ভিজে গেছে ! অপরূপার কমলা লেবুর কোয়ার মতো ঠোট দুটো তির-তির করে কাঁপছিল ! ওর নরম ওষ্ঠে   পৃথিবীর যাবতীয় উষ্ণতা মাখা পুরুষ ঠোট এসে মিশেছে ! নারীর সর্পিল নগ্ন  শরীর নানান ঢেউয়ের  শৈল্পিক সুষমা আঁকছিল প্রবীর বাবুর ছাদের ছোট্ট ঘরের মধ্যে ! এই এবার লক্ষ্মীটি ছাড়ো, আমি  আর সহ্য করতে পারছি না । প্লিজ ছাড়ো আমায় ! অপরূপার কামনা ভরা মৃদু কণ্ঠস্বরে এক সমুদ্র   ভালোবাসা মেখে ছিল । প্রবীর বাবু অপরূপাকে কিছুতেই ছাড়তে চাইছিল না ! কি এক স্বর্গীয় সোহাগ  তার শরীর ও মন'-কে ওই সময় আদ্যোপান্ত ঢেকে রেখেছিল ! কতক্ষণ ওরা ওই ঘরে কাটিয়ে ছিল, ওরা নিজেরাই জানেন না ! একটা অমোঘ ভালোলাগার আবেশে ওরা কাম প্রবাহে ডুবে ছিল ! এভাবেই গোটা সাত আট দিন ওরা দু'জন সময় অসময়ে পরস্পর শরীরে শরীর মিলিয়ে সেই অবৈধ উত্তেজনাকে উপভোগ করেছিল ! 

     অচলা দেবী বাপের বাড়ি থেকে ফড়িঙকে সঙ্গে  নিয়ে দশ দিন বাদে ফিরেছিল ! প্রবীর বাবু অচলার বাড়ি ফিরে আসাতে মনে মনে সন্তুষ্ট হননি ! উপরে উপরে দেখিয়েছে, অচলা নিজের বাড়িতে ফিরে আসা-তে তিনি খুবই খুশি ! গোটা দশ দিন স্বামীর ভিটে ছেড়ে থাকতে অচলা দেবীর একটুও ভালো লাগেনি, একমাত্র ফড়িঙের বায়নার কারণে তাকে প্রাইভেট কার ভাড়া করে গুশকরা গিয়েছিল ! এই তিন জনের সংসারে বাড়তি ঝামেলা ব'লতে কিছুই নেই । তবে দিনেদিনে ফড়িঙ ভীষণ দুরন্ত হয়ে চলেছে । পড়াশুনায় একটুও তাকে মন বসাতে পারা যায় না । খালি ছুতো পেলেই বাবার মোবাইল নিয়ে ভিডিও গেম, আর দুপুরে বাবা -মা ভাত ঘুম দিলে চুপিচুপি নিঃশব্দে ছাদে ঘুড়ি লাটাই নিয়ে আকাশ পাড়ের নীল সীমানায় ঘুড়ি গুলোকে একটার পর একটা উড়িয়ে চলে, সেই যে চোখ মুখ লাল করে দোতলার ছাদ থেকে অচলা দেবী যতক্ষণ না চিৎকার করে ডাকেন– ওরে এবার নেমে আয় সন্ধ্যে ছ'টা বেজে গেছে ! ইচ্ছা না  থাকলেও মায়ের চিৎকার আর বকা ঝোকায় শেষমেশ ছাদ থেকে নিচে নেমে আসে ! অনেকদিন পর বাড়িতে ফিরে ফড়িঙ অনেকটাই চুপচাপ ! এই অস্বাভাবিক ফড়িঙের পরিবর্তন দেখে অচলা দেবীর মন ব্যাকুল হয়ে ওঠে ! এই শান্ত শিষ্ট হাবভাব দেখে অবাকই হচ্ছিলেন অচলা দেবী ! ছেলের এই শান্ত শিষ্ট ভাবমূর্তি  মায়ের মনকে ভীষণ ভাবে চিন্তায় ফেলে দিচ্ছিল ! কি হোল ! কি হলো–  ব্যাপার ! অবশ্য প্রবীর বাবু, তিনি তো অন্য চিন্তায় অহর্নিশ বিভোর ! কি-রে, চুপ করে ঘরের ভেতর একা বসে আছিস যে ? কি হয়েছে সোনা, আমায় খুলে বল ! কিছু না, তুমি ঘর থেকে যাও দেখি । ইতিহাস বইটা হাত থেকে খাটের উপর ছুড়ে ফেলে দিয়ে ফড়িঙ বেশ বিরক্তির সঙ্গে ওর মা'র প্রত্যুত্তরে কথাটা ব'লল ! বাবা সোনা অমন করেনা, বাবা তোর কি হয়েছে বল আমায় ? মামা বাড়ি থেকে চলে আসাতে ছেলের বুঝি মন খারাপ মন খারাপ ? ঠিক আছে বাবা এর পর যখন গুশকরা যাব একমাস থেকে আসবো, এবার খুশি তো ? ফড়িঙ ওর মায়ের  কথায় কোন উত্তর দেয় না, কেবল নিজের মনে বিড়বিড় করে ! এই শোন, আজ সন্ধ্যাবেলা নিচে অপরূপা কাকিমার ঘরে তোর নিমন্ত্রণ ! আজ অপরূপার জন্মদিন ! ফড়িঙ চুপ করে ওর মা'র কথা শোনে, কোন ভালোমন্দ উত্তর দেয় না  ! কি-রে যাবি তো, তখন আবার ঢঙ করে ঘরে বসে নীরবতা পালন করিস না । আমি চললাম, ব্রেক ফাস্ট করতে আয় । তোকে আর তোর বাবাকে খেতে দিয়ে একতাল জামা কাপড় সার্ফে ভেজানো আছে, অনেক কাছাকাছি আছে । শিগগীর করে টেবিলে  এসে বোস । অচলা দেবী ঘর থেকে চলে যাবার পর ফড়িঙ খাট থেকে উঠে ঘর থেকে বেড়িয়ে মাথা নিচু করে ঢুকলো, বারান্দায় ডাইনিং টেবিলে গিয়ে বসলো । আজ রবিবার ! ছুটির দিন । অথচ প্রতিদিনের মতো এই বিশেষ দিনটা অন্য দিনগুলোর সাথে মিলেমিশে একেকার ! এখন ঘরে ঘরে ছুটি–ই ! ফড়িঙের বাবারও ছুটি ! কিরে সোনা , আর দুটো লুচি দেই ? পাশের চেয়ারে খবরের হেড লাইন দেখতে দেখতে লুচি ও আলুর দমে কামড় মারছিলেন ফড়িঙের বাবা শ্রীমান প্রবীর বাবু ! মায়ের কথায় আচমকা সম্বিত ফিরে পেয়ে ফড়িঙ কিছু একটা বলতে গিয়ে না বলা কথায় অচলা দেবীর দিকে  তাকালো ! কিরে দু'চারটে আরও লুচি দেই, নে বাবা খেয়ে নে । আজ একটু বেলাই হবে খেতে দিতে । তোর বাবা ইলিশ আর খাসীর মাংস এনেছে, তার ওপর নিচে তোর কাকিমাকে সন্ধ্যে থেকে রান্নায় একটু সাহায্য করতে হবে । অচলা তার কথা গুলো এক নিঃশ্বাসে বলে গেলেন, কিন্তু ফড়িঙ তার মায়ের কথায় নিরুৎসাহ দেখিয়ে আলুর দম মাখা ডান হাতের আঙুল গুলো চাটতে চাটতে টেবিল ছেড়ে উঠে সোজা বেসিনে গিয়ে হাত  মুখ ধুয়ে নীরবে নিজের ঘরে গিয়ে দু'হাতে মোবাইলটা নিয়ে পা ছড়িয়ে খাটে বসে ভিডিও গেম খেলতে লাগলো !                                

   অনেক দিন হলো ফড়িঙ ওদের ছদে ওঠে না ! ঘুড়ি-ও ওড়ায় না ! খুব একটা প্রয়োজন ছাড়া কারোর সাথে কথাও বলে না ! এহেন ছেলের আচমকা পরিবর্তন অচলা দেবীকে ভীষণ রকম দুশ্চিন্তায় ফেলে দিয়েছে ! কি যে হয়েছে ফড়িঙের, সেটা অনুধাবন করতে পারছিলেন না অচলা দেবী । মনের মধ্যে এক অদৃশ্য এক ভয় ওকে অহর্নিশ শঙ্কিত করছিল । উঠতে ব'সতে সারাক্ষণ ছেলের চিন্তায় চিন্তায় তার জীবন ও অন্তর  ছন্দহীন বিষাদে ছেয়ে রইলো । কি হয়েছে ওর, নিজের মনকে প্রশ্ন করেও উত্তর পাচ্ছিলেন না অচলা দেবী ! স্বামীর পাশে শুয়ে মাঝরাত পর্যন্ত জেগে থাকেন অচলা দেবী ! কোথাকার এক মহাভয় শূন্যতা ওর মনের চার পাশটাকে ছায়াচ্ছন্ন নীরবতায় ঢেকে রেখে ছিল ! এতটুকু বয়স ওর ছেলের, এই বয়সে কোথায় হাসবে খেলবে দৌড়াবে, বায়না করবে বাবা মার কাছে– তা না একা একা নিজের ঘরে সাড়াশব্দহীন নীরবতা নিয়ে সকাল থেকে রাতে শুতে যাওয়া পর্যন্ত এভাবেই সময় কাটায় ফড়িঙ ! আর কটা দিন পড়ই দুর্গাপুজো ! প্রতি বছর পুজো আসার এক মাস আগে থেকেই নতুন জামা জুতো নিয়ে ফড়িঙের নানান বায়না, কিন্তু এখনো পর্যন্ত সমস্ত বন্ধুদের নতুন  জামা কাপোড় কেনা হয়ে যাবার পরেও ওর কোন তাপ উত্তাপ বলতে নেই ! একটা কঠিন ও কঠোর বিষাদিত যন্ত্রণাদায়ক চিন্তা রাতদিন ফড়িঙকে ভেতরে গভীরে অস্থির করে মারছে !  ওপাশ থেকে কে  কি বলছিল শোনা যাচ্ছিল না, বারান্দায় দাঁড়িয়ে মোবাইলে খুবই চাপা কণ্ঠে কথা বলছিলেন প্রবীর বাবু । পাশে বসার ঘরে অনীক বাবুর দেওয়া হোম টাস্ক করছিল ফড়িঙ । অচলা দেবী তার স্বামীর মোবাইলে কথা বলা অনেকক্ষণ ধরে লক্ষ করছিলেন, কিন্তু প্রতিদিন এক কথা বলতে-বলতে অচলা দেবীর মনে ও মুখে অরুচি ধরে গেছে, তাই তিনি তার স্বামী দেবতাটিকে বারংবার প্রশ্ন করার ইচ্ছা নিয়ে এগিয়ে গিয়েও পিছিয়ে গেছেন ! এক সময় বছর আঠেরো  কি উনিশ হবে, বিয়ের প্রথম প্রথম অচলার ভরন্ত যৌবনের দিকে শ্বশুর বাড়ির আশে পাশের পাড়ায় কম শেয়াল শকুন নজর দিত ! লোভী ও ক্ষুধার্ত চোখগুলোর থেকে নিজেকে বাঁচিয়ে রাখতে তাকে কত লড়াই করতে হয়েছে, সাবধানে থাকতে হয়েছে ! সেকথা প্রবীর বাবু জানতেন, আর জানতেন ব'লেই রাতে অবুঝের মতো অচলাকে বিনা কারণে চরিত্রের দোষ দিয়ে অশান্তি করতেন ! তখনো ফড়িঙ অচলার পেটে আসে নি । কিন্তু এতো ঘটনার পরও সে কথনো তার বাপের বাড়িতে জানান নি । মনে মনে ভেবেছিলেন সব ঠিক হয়ে যাবে । এর বছর দুয়েক পর ফড়িঙ ওর কোল আলো করে এলো !                                                                                       

  প্রতিদিন সময় অসময়ে আসা টেলিফোন অচলাকে আদ্যোপান্ত ভাবে বিভ্রান্তিতে ফেলে চলেছে ! কার এই ফোন ? অনেকবার স্বামীকে প্রশ্ন ক'রেও উত্তর সে  পায় নি, বরং তিরস্কার ছাড়া ! এদিকে ফড়িঙ বড় হচ্ছে ! ও সব বুঝতে পারে ! এইসব সাত-পাঁচ চিন্তা করে অচলা তার মনটাকে একপ্রকার মেরেই ফেলেছেন ! কিছুদিন এভাবেই কেটে যায় সময় । একদিন চোখের সামনে আয়নার মতো পরিষ্কার হয়ে গেল গোটা ব্যাপারটা ! গত তিন চার দিন আগে সকাল সাড়ে দশটার সময় ভেজা জামা কাপড় ছাদের  রোদ্দুরে মেলতে গিয়ে অচলা তার স্বামীর কুকীর্তি দেখে চমকে ওঠেন ! নিজের চোখ দু'টোকে তখন বিশ্বাস করতে পারছিলেন না ! মনে মনে ভাবছিলেন– আমি কি ভুল দেখছি ? ছাদের সিঁড়ি ঘরের ভেতর প্রবীর বাবু তাদের ভাড়াটে অপরূপাকে জড়িয়ে ধরে আদর করছেন ! এই দৃশ্য অচলার কাছে একজন পতিব্রতা স্ত্রী হিসাবে লজ্জা ও অপমানের ! প্রবীর বাবুর ঠোট গিয়ে মিশেছিল অপরূপার ঠোটে । হাত দু'টো খেলছিল অপরূপার নরম শরীরে ! অচলা অপলক থাকিয়ে দেখছিল ওর স্বামীর নির্ভীক সেজে থাকা পুরুষত্ব ! ওদের তখন খেয়েলই ছিলোনা, ওদের ঠিক পিছনেই অচলা দু'চোখ ভরা জল নিয়ে দাঁড়িয়ে আছেন ! বুকের মধ্যে অচলার পাথর চেপে বসে ছিল ! যে মানুষটাকে নিয়ে এতদিন ঘর করলেন, মনের অনেকখানি জায়গা জুড়ে আসন পেতে বসালেন , বিশ্বাস করলেন– সে কিনা  তার সরলতার সুযোগ নিয়ে কোন এক পরস্ত্রীর সাথে শারীরিক সম্পর্কে লিপ্ত হতে পারে ? এই ছিল তার কপালে ! অচলার মনের মধ্যে অবিশ্বাসের অন্ধকার ঘনীভূত হতে হতে এক খাঁ খাঁ শূন্যতা ওকে গ্রাস করতে লাগলো ! এ কথা কাকেই বা সে বলবে ? এটা তো স্ত্রী হিসাবে ওর কাছে লজ্জা ! স্তব্ধ ও এক মন নীরবতা নিয়ে দোতলার বারান্দায় দাঁড়িয়েছিলেন অচলা । পাশের ঘরে ফড়িঙ অন লাইনে অঙ্কের ক্লাস করছে । পাসে সোফাতে বসে প্রবীর বাবু ল্যাপটপে অফিসের কাজ করছিলেন । অন্য দিনের মতো আজকের সকালটা একেবারে অন্যরকম মনে হচ্ছিলো অচলার ! ঘুম থেকে অনেক আগেই সাত সকালে সে উঠে পড়েছে । প্রবীর বাবু বিছানায় শরীরটাকে দ-এর আকৃতি করে ঘুমিয়ে আছেন । গত বৃহস্পতি বার থেকে রাতে চোখের পাতা এক করেন নি অচলা ! একমাত্র ফড়িঙের মুখের দিকে তাকিয়ে সে না মরে বেঁচে আছেন ! স্বামীকে সেদিনের সেই ঘটনা নিয়ে কোন প্রশ্ন সে করেননি, কোন অভাব অভিযোগ তার হাবভাবে প্রকাশ পায়নি, কেবল তার মনের মধ্যে  একদলা  কষ্ট নিয়ে এক একটা রাত এক বিছানায় একজন পরিচিত অবিশ্বাসী মানুষের পাশে নির্ঘুম যাপন করে চলেছিলেন ! কে জানতো তার এতো দিনের পরিষ্কার আকাশটায় অপরিণত শ্রাবণ'-এর মেঘ এসে ঢেকে দেবে বহতা বর্তমানের অদেখা ভবিষ্যৎ ! এখন এভাবেই অচলা ভিতরে গভীরে স্তব্ধ হয়ে আছেন !!    

                                    

Joydeb Biswas

Poet Joydeb Biswas studied Bengali literature. In 2015, at the age of 22, he published 'Sahitya Chetona' magazine. Currently two editions of the magazine are published. One is the online version and the other is the printed version. He is the founder and editor of the two editions. facebook twitter youtube instagram whatsapp

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

নবীনতর পূর্বতন