1 / 7
2 / 7
3 / 7
4 / 7
5 / 7
6 / 7
7 / 7

টুলু পণ্ডিত : সমুদ্র বিশ্বাস – সাপ্তাহিক সাহিত্য পাতা

টুলো পন্ডিত

সমুদ্র বিশ্বাস 


অঙ্কন – বিশ্বজিৎ মন্ডল


য়না মান্ডি । সাত ভাই-বোনের মধ্যে সর্ব কনিষ্ঠ। বাবা অভয়। দিন মজুর। নিয়মিত কাজ হয় না। মা ক্যান্সার রোগী। বড্ড টানাটানির সংসার। পড়াশুনার ইচ্ছে থাকলেও উপায় নেই । ময়না পড়া ছেড়ে দিয়েছে, নাকি ধরে আছে; তা ময়না জানে না। দুই দাদা বাবার সঙ্গে মাটি কেটে খেতে খেতে যৎসামান্য আয় করে। দুই দিদি ধান বুনে,কাঠ কুড়িয়ে,শাল পাতা সংগ্রহ করে, সাধ্যমত সহযোগিতা করে। এভাবেই পরিবারের জীবিকা নির্বাহ হয়। অপর দাদা-দিদি বর্ষার জলে ভেসে গেছে । খোঁজ মেলেনি। পাড়ার মাতব্বর থানায় খবর দিয়েছিল। সরকারি পোশাকের কর্মীরা হতাশার নিঃশ্বাস ফেলেছিল। তবু ময়নার দাদা-দিদির হদিস মেলেনি।

 সরকারি ডাক্তার ময়নার মায়ের শরীরে অনেক খোঁজাখুঁজির পর বলল, 'বুঝলি অভয়, তোর বউয়ের ক্যান্সার হয়েছে। ক্যান্সার এখানে চিকিৎসা হয় না। শহরের বড় ডাক্তার দেখা। নইলে বাড়ি নিয়ে যা। এখানে ফেলে রাখিস না । তোর মেয়েরা বড় হয়েছে। তারা সেবা যত্ন করলে বেশি খুশি থাকবে। 'অগত্যা ময়না, মায়ের হাত ধরে মাকে বাড়িতে এনেছিল। ময়না ক্যান্সারে যত না যন্ত্রণা পায়, তার থেকে বেশি বুকে জ্বালা দেয় সন্তান হারানোর। পাড়ার বুড়ি ঠাকুমা প্রায় ময়নাদের বাড়ি আসেন। কথায় কথায় চোখ ছল ছল করে বলে,' জানিস ময়নার মা, আমার বুকের ধন বাটুলকে একটা বড় গাড়ি বেটে দিল ।বাঁচতে দিল না। কতবার বলেছি শহরের কাজ দরকার নেই।বাটুলের শুধু এক কথা- 

মা কাজ না করলে খাব কি? গ্রামে তো কেউ কাজে নেয় না ।বাটুল বাটুল বলে খেপায়। আমার আর পাড়ায় থাকতে ভালো লাগে না।

 বুঝলি ময়নার মা- কাজ সেরে বাড়ি ফেরার পথে ভয়ঙ্কর দুর্ঘটনার শিকার হয়, আমার আদরের ধন বাটুল।' থমথমে মুখে ময়না বলে– ও ঠাকুমা, তুমি যখনই আসো- এক কথা বলো কেন? তুমি তো জানো আমার দাদা- দিদি বানের জলে ভেসে গেছে। মার এমনিতেই কত কষ্ট । আবার এসব কথা শুনলে তাঁর বুকটা ভেঙে যায় না? 'বুড়ি ঠাকুমা একটা বড় নিঃশ্বাস ফেলে বলে,' কিছুতেই আমি ভুলতে পারিনা। ময়নার মায়ের চোখেও জল। সন্তান শোক কি সহজে ভোলা যায়? কোন সান্ত্বনা নেই। হয় না। ময়না জানে, রাতে মাঝে মাঝে মা ঘুম থেকে উঠে  বসে। তারপর বলে শুতে পারছি না। ভীষন শ্বাসকষ্ট । দম বন্ধ হয়ে আসছে। বুঝলি মা ময়না, আমার আর ঘুমের দরকার নেই ।চাই বাতাস। একটু মুক্ত বাতাস । তোর দুটো দিদির বিয়ে দিতে পারলাম না। ভয় লাগে। কখন মরণ আসে, কোন রূপে। আমার প্রতি মুহূর্তে ভীষণ ভয় লাগে। মরনের ভয়।' মা-মেয়ে দুজনে নীরবে কিছুক্ষণ অশ্রু বিসর্জন করে।

এভাবে ভাবনার জালে জড়িয়ে পড়ে ময়না।ময়নার সেদিনের কথা মনে পড়ে-- পড়ন্ত বিকেল। ক্রমশ সন্ধ্যা নামছে। একেই বলে পশ্চিম আকাশে সূর্যাস্তের রংয়ের খেলা।হাট ফিরতি সকলের গল্পে কথায়, সকলের পা চলছিল। ফিরতি পথে অনেকেই গতি বদলেছিল,আপন ঘরের অবস্থানে। মায়ের সঙ্গে ময়না, ময়নার দাদা- দিদিও ছিল। রসিক মাঝির ঘাটে আসতেই অগ্নিকোণে অগ্নিঝড়। দমকা- হাওয়া। হাওয়া বদল। নিকষ কন্ঠে বজ্র-ডাক। আকাশ আর আকাশ রইল না। জানা আকাশ,অজানা -অচেনা হয়ে গেল । সাঁকো পার হতে না হতেই বিদ্যুতের লকলকে জিভ। খল্ খল্  হাসি।আকাশের দিকে তাকালেই মনে হতো- মদমত্ত মাতঙ্গিনী, উলঙ্গিনী নাচে ধায়। ময়না ,ময়নার দাদা-দিদি আর মা ভয়-বিজড়িত পায়ে মাটিতে পা দেয় । একেই বলে, প্রকৃতির অবিরত অসহ্য বিদ্রুপের অট্টহাস্য। শত শত  প্রকট তড়িৎ বেস্টনের ভয়ঙ্কর ফেস্টুন।  নিমেষেই ঘন বরষা। দাঁড়াবার ঠাঁই নেই । মাঠ পার হলেই গা-গ্ৰাম। কারো না কারো বাড়ি, একটু মাথা গোঁজা যাবেই। এজাতীয় একবুক আশা নিয়ে ঘরের পথে মন।মাঝে-মধ্যে উজ্জ্বল ঝলকে আলো , গভীর ধোঁয়াশা কাটায়। নিমেষেই কালোয় মোড়ে পৃথিবী। ময়না এর বেশি ভাবতে পারে না। ময়না এর আগেও শুনেছে,  বরষায় জল বাড়ে, সুযোগে সরকার জল ছাড়ে। আবার বানের জলে বাধ ভেঙে যায়। বিপদের শেষ থাকে না।এবারও কিছু একটা হয়েছে। গায়ের প্রায় সকলেই ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। হাঁস-মুরগি-গরু-ছাগল মরে ছিল অনেক। শুধু গৃহের পশুপাখি নয় ।বানের জলে ভেসে গিয়েছিল। তারা আর ফেরেনি। ময়নার মা মাঝে মাঝেই অন্য কোথাও বলে - 'শুধু প্রকৃতির রোষে মৃত্যু নয়। ভাগ্যের দোহাই এ মৃত্যু নয়। প্রকৃতিকে সামনে রেখে, মানুষ মারে মানুষকে। মৃত্যুর হাত থেকে মুক্তি নেই। মারাংবুরু আমার প্রণাম নাও। মৃত্যু নয়, বন্ধন থেকে মুক্তি দাও।'

আদিবাসী সমাজের ছেলেমেয়েদের বেশিদিন স্কুলে পড়াশোনা করা যায় না। পরিবেশ পক্ষে নেই। পক্ষে নেই সরকার বাহাদুরও। একদিকে আর্থিক অনটন। আর একদিকে সামাজিক অমানবিক চাপ থাকে।যা সহ্য করা যায়না।ময়নার স্কুলে যাবার মত ভালো জামা কাপড় নেই । নেই বইপত্র,খাতা, কলম। স্কুলের মাস্টার মশাইরা সহানুভূতি মূলক ব্যবহার করে না। এইসব কারনেই স্কুলে ভর্তি হয়েও আদিবাসী সমাজের ছেলেমেয়েরা বেশি দিন টিকে থাকতে পারে না। সেই জন্য পড়াশোনা ছেড়ে দিয়ে বাপ-মায়ের পেশায় যুক্ত হয়ে পড়ে । ময়না হার মানতে চায় না। আসলে শিশুকালে ভাগ্যকে মেনে নিলে,বাকি জীবন গাধা থাকা যায়। মনে প্রশ্ন থাকে না। কিন্তু ময়নার গাঁ-গ্ৰামের চাপে শিশুবেলায় স্বপ্ন দেখে। স্বপ্নই স্কুলে নিয়ে যায়।পরিবারের সকলের সাথে ময়নাকেও বেঁচে থাকার সংগ্রাম করতে হয় । জঙ্গলে জঙ্গলে কাঠ কুড়ায়। কলাপাতা তুলে এনে পাড়ায় পাড়ায় ঘুরে বিক্রি করে। প্রচন্ড অসুবিধা ও অমানবিক পরিশ্রম হওয়া সত্বেও ময়না মাঝে মাঝে স্কুলে যায় । স্কুল শিক্ষক মাস্টার বলেছে– সরকার থেকে একটা আদিবাসী লোন করে দেবে। সেই লোন দিয়ে তেমাথায় একটা চা-পান-বিড়ির দোকান করে দেবে।মাসের পর মাস, বছরের পর বছর চলে যায়।কিন্তু লোন পায়না । হাল ছাড়ে না ময়না ।শিক্ষকের সঙ্গে পার্টির মিটিং এ যায় । কত ভালো ভালো কথা শোনে । শুধু সরকারি লোন পায়না।

এই গতবছর নভেম্বর মাসে কলকাতার বিশাল জনসভায় গিয়েছিল। বাস ভাড়া করেছিলেন নবীন মাস্টারের দল । বাসের মধ্যে তুমুল আলোচনা– হাবু মামা । বাচ্চা বুড়ো সকলের মামা । সে বলল,' রাজনৈতিক দলগুলি সুযোগ পেলেই কৃষক দরদী হয়ে ওঠে ।' নবীন মাস্টার বলে,' কেন কৃষক দরদী হবেনা হাবু মামা, ভারতবর্ষের অর্থনীতির ভিত্তি হলো কৃষি।' ভোলা ভাই। সবার ভাই। সে বলে, 'তবে কৃষিকাজকে এখনো অনেক ছোট করে দেখে। গ্রামে দশ- বিশ বিঘা জমির মালিক হলেও শহরে দশ হাজার টাকার চাকরি অনেক নিশ্চয়তা দেয়। সরকার দা । সবার সরকার দা। সে বলে, 'ঠিক বলেছ ভোলা ভাই, কৃষক সমাজকে খুব একটা সম্মান জানানো হয় না । শুধুমাত্র কৃষিকাজ করে জানলে, ছেলের বিয়ে দেওয়া পর্যন্ত মুশকিল হয়। আমাকে দেখলেই তো বোঝা যায় । চুল পেকে সাদা অথচ এখনো বিয়ে হলো না ।সবাই হো হো করে হেসে ওঠে ।গাড়ি চলে হুহু গতিতে। রাস্তায় ভিড়  দেখলে বা রাস্তার ধারে অনেক দোকান লোকজনের সমাগম দেখলে গেটে দাঁড়ানো কয়েকটি যুবক ছেলে স্লোগান শুরু করে ।পাশের সিটে বসা গুটিকয়েক মেয়ে গলা মেলায়। বাসের ভিতরের আলোচনায় ঘাটতি পড়ে না ।তাই সরকার দা কথার রেশ ধরে নবীন মাস্টারকে বলে,' এটা আজ নয় ,স্বাধীনোত্তর ভারতে কোন দিনই কৃষিকাজকে উন্নতি করার জন্য সেভাবে নজর দেওয়া হয়নি । বরাবর সস্তা রাজনীতির পথে হেঁটেছে সবাই।' ফকির চাচা বলে,' শুধু সরকারের উপর দোষ দিলে চলবে না মাস্টের ।সরকার আর কৃষক দু'পক্ষকেই বুঝতে হবে। কৃষিকাজ একটা মস্ত বড় ব্যবসা। পুরনো ধ্যান-ধারণা ছেড়ে আমাদের বেরিয়ে আসতে হবে ।ব্যবসার মূল ভিত্তি হলো বাজারের চাহিদা। চাহিদা অনুযায়ী সিদ্ধান্ত নিতে হবে।' ভোলা ভাই বেশ কৌতুহলী চোখে জিজ্ঞাসা করে ,'সেটা কিরকম ফকির চাচা? 'ফকির চাচা বলে,' কখন কি চাষ করতে হবে ,কিভাবে চাষ করতে হবে,তা পাকাপাকিভাবে মাথায় রাখতে হবে।' নবীন মাস্টার ফকির চাচার কথার রেশ ধরে বলে,'এক্ষেত্রে সরকারকে আগ বাড়িয়ে খোলা মনে হাত বাড়াতে হবে। কৃষকদের প্রশিক্ষণের উন্নত ব্যবস্থা নিতে হবে।' মিহির খুড়ো বলে, 'ঠিক বলেছ মাস্টের ।তবে কি জানো? কৃষক আর বাজারের সবচেয়ে বড় বাধা হল ফড়ে বা দালাল । দেশের কৃষকরা স্বাধীনভাবে ফসল ফলায়। কিন্তু নিজের মতো করে ফসল বিক্রি করতে পারে না। হয় সরকার নয়তো ফড়েদের ওপর নির্ভর করতে হয়। বলা যায়– কৃষকরা  মান্ডিতে তাদের ফসল পাইকারদের মর্জি মতো দামে বিক্রি করতে বাধ্য হয়। ভোলা ভাই বলে, সত্যি কথা বলেছো খুড়ো। মান্ডি থেকে পাইকার, সেখান থেকে ছোট ব্যবসায়ী হয়ে আমজনতার হেঁসেলে পৌঁছায় যে ফসল ,তাতে কৃষকদের কিছু করার থাকেনা। সরকারের পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনা নদীর জলে ভেসে যায় । চাষীদের জন্য পরিকল্পনা হয়েছে। বরাদ্দ হয়েছে। চাষির দুর্দশা কিছুই কমেনি । হঠাৎ ভবা পাগলা বলে, 'আমরা দিনমজুর। আমাদের অবস্থার এই পরিণতি কেন ? একটু বলতো মাস্টর । তখন থেকে শুধু কৃষক দরদী কথাবার্তা শুনছি। আমাদের কথা শুনে মানে রোজ আনি আর রোজ খায় তাদের কথা একটু বল। সরকারদা বলে, 'এই সবাই মনোযোগ দাও । ভবা পাগলা মুখ খুলেছে ।' 

হঠাৎ গাড়ির গতি কমে যায়। গেটের রড ধরে দাঁড়িয়ে থাকা একটি ছেলে স্লোগান দেয়। স্লোগানে স্লোগানে সবাই আগে পিছের গাড়ি দু'টো ভরিয়ে তোলে। বুঝতে পারে ময়না, কলকাতায় আর কিছুক্ষণের মধ্যে ঢুকে যাবে। স্লোগান চলতে থাকে। ময়নার মন পড়ে থাকে ভবা পাগলার কথা শোনার জন্য। দিনমজুরদের কথা শোনার জন্য। গাড়ি চলে হনহন করে। চোখের সামনে ভেসে ওঠে গুড়াবুড়ি । গ্রামের বুড়ি। গুড়াবুড়ির নাম মাহাত্ম্য কেউ জানে না ।জানতেও চায় না। সবাই জানে গুড়াবুড়ি সময়ের সাক্ষী ।গুড়াবুড়ি একদিন ময়নার মায়ের সঙ্গে কথা বলছিল–'ভবা পাগলার মুখের দিকে তাকালে বোঝা যায়, ভবা চরম দারিদ্র্য পীড়িত উপেক্ষিত লাঞ্ছিত সমাজের মানুষ। কেউ কেউ বলে, আদিবাসী জনগোষ্ঠীর মানুষ। পায়ে পায়ে সীমাহীন বাধা বিঘ্ন পার হয়ে, মাথা উঁচু করে দাঁড়াবার স্বপ্ন নিয়ে ঘুরতো; অন্ধকারময় সামাজিক পরিবেশের বুক চিরে।ধীরে ধীরে সমাজের সামনে এসে মাথা তুলে দাঁড়াতে চেয়েছিল। কিন্তু ভবা বেসরাই হয়ে গেল ভবা পাগলা ।কথার মূল্য গেল, মূল্যহীন হয়ে। সবার কাছে হাসির খোরাক হয়ে উঠল। গুড়াবুড়ি আরও বলেছিল– 'ভবা বেসরার লড়াই, মানবতার শত্রুদের বিরুদ্ধে লড়াই। নিজের জীবন বিপন্ন করে লড়াই। ছদ্মবেশী শয়তানদের মনের আসক্তিকে সকলের সামনে খুলে দিয়েছিল। ব্যাস এটাই ভবার অপরাধ। বেঁচে আছে পাগলা পদবীর জন্য। কথায় বলে না পাগলে কিনা বলে, আর ছাগলে কিনা খায়।

গাড়ি থামে । নবীন মাস্টার আর দু'টো ষন্ডামার্কা মেয়ে বাস থেকে নেমে পড়ে। হঠাৎ চমকে যায় ময়না ।ময়না ও চলতি বাস থেকে নেমে পড়ে। নবীন মাস্টার ছুটে এসে বললো– 'কিরে তুই নেমে পড়লি কেন?' ময়না বলে,' আপনার কথায় এসেছি আপনার সঙ্গেই থাকব।'  অগত্যা আর কি করা যায় ।সংঘের একটি মেয়ে বলল-- ও থাক না স্যার। কিচ্ছু হবে না । আগে কফি হাউসে তো চলুন। কফি না খেলে, শরীরে জোস আসছে না ।তারপর শরীরে দু'বার মোচড় দিলো। যা ময়নার কাছে বড্ড অসহ্য মনে হলো। কি আর করা যায়। নবীন মাস্টার এর ডাকাবুকো ছাত্রী বলে কথা। ওকে দেখিয়ে বাকিদের টানে। আর এই ময়নাকে দেখিয়ে, আদিবাসী সমাজের কথা বলে, পার্টিতে পজিশন বাড়ায়। তাছাড়া পার্টিতে সব জাতের লোক থাকা দরকার। তবেই না সাম্যবাদী দল। 

কফি হাউসের ঢুকেই, কোনার দিকে একটা টেবিল দখল করে সংঘের মেয়ে দু'টি ।এক এক করে বাথরুমে যায় ।ফ্রেশ হয়ে আসে। নবীন মাস্টারও ফ্রেস হতে যায় ।ময়না কফি হাউসে প্রথম এসেছে। সে কি করবে ?কাকে কি বলবে? কিছুই বুঝতে পারে না। মুখ গুঁজে বসে থাকে। খোশমেজাজে গল্পে মাতে পাশের টেবিলে এক দল ছেলেমেয়ে । গল্প চলছে পুরোদমে। কি ছেলে, কি মেয়ে সবার হাতেই সিগারেট। চোখে চশমা,গায়ৈ হলুদ জামা পরা ছেলেটি বলছে–' বিদ্যাসাগর নাস্তিক বলতেন নিজেকে। অথচ তার জীবন চর্চায় স্পষ্ট উত্তর মেলে না। তাছাড়া যদি জ্ঞান গুণ বিচার করি তাহলে শ্যামাচরণ সরকার ,কৃষ্ণমোহন বন্দ্যোপাধ্যায় ,রাজেন্দ্রলাল মিত্র ,মদনমোহন তর্কালঙ্কার, তারাশঙ্কর তর্করত্ন, দ্বারকানাথ বিদ্যাভূষণ, হরিনাথ শর্মা এরা বিদ্যাসাগর এর চাইতে কম কিসের ? এরা প্রত্যেকেই বাংলা সাহিত্যের একটি দিকপাল রূপে গণ্য হওয়ার উপযুক্ত। এদের কেউ খোঁজ খবর পর্যন্ত রাখে না ।একা বিদ্যাসাগরের প্রতাপ অক্ষুন্ন রইল। বাঙালির এমনই বিচার বিবেচনা।' হাত কাটা পোশাক পরা মেয়েটি সিগারেটের ধোঁয়া ছেড়ে বলল ,'শোন বিদ্যাসাগরকে নিয়ে ওভাবে বলিস না। বিদ্যাসাগর বিদ্যার সাগর, দয়ার সাগরও বটে। আর একজন কথার সম্মতি জানিয়ে বলে, ছোটবেলা থেকে আমিও শুনে আসছি। দয়া সাগর তো বটেই। ওরকম মানুষ শতাব্দীতে একটা জন্মায়। কিন্তু আল্টিমেট তো মানুষই তাই হয়তো দোষ কিছু ছিল। পূর্বের ছেলেটি আবারো উত্তরে বলে,'তুই যাই বলিস না কেন? বিদ্যাসাগর অনেককেই ঈর্ষা করতেন। শ্যামাচরণ সরকার ইংরেজিতে পন্ডিত ছিলেন। সংস্কৃত কলেজে অধ্যাপনা করতেন। সে সময় আদি শুদ্ধ বাংলা ভাষায় একটি ব্যাকরণ বই লিখলেন। বইটি খুবই ভালো ছিল। অথচ বিদ্যাসাগর একদিন সবার সামনে এমন তুচ্ছ-তাচ্ছিল্য ভাবে সমালোচনা করলেন। যে কারণে সে আর কোনোদিন মাথা তুলে দাঁড়াতে পারলেন না । কৃষ্ণমোহন বন্দ্যোপাধ্যায় এর মহাভারতের ইংরেজি তরজমা পড়ে ঈর্ষায় ফেটে পড়লেন বিদ্যাসাগর । শুধু কি তাই, বিদ্যাসাগর কবি মাইকেল মধুসূদন দত্তকে পর্যন্ত অপছন্দ করতেন। গলা কাটা গেঞ্জি পরা মেয়েটি একরকম তাচ্ছিল্যের স্বরে বলল– চুপ কর । বিদ্যাসাগর নিজে ধার করে কত টাকা মাইকেলকে ধার দিয়েছে তুই জানিস? বলছিস মাইকেলকে পছন্দ করত না ? আচ্ছা তথ্য বল। ছেলেটি বলল, 'পড়তে হয়, পড়তে হয় ,না পড়লে পিছিয়ে পড়তে হয়।' চশমা চোখে স্মার্ট মেয়েটি বলল, 'আর ন্যাকামি করিস না। তুই কৃষ্ণ কমল ভট্টাচার্যের 'স্মৃতিকথা'র কথা বলছিস না তো ? ছেলেটি সম্মতি জানিয়ে বললো, হ্যা, আমি ওই বইটির কথাই বলছি । কৃষ্ণ কমল নিজে বিদ্যাসাগরের ছাত্র। সে কি মিথ্যা গুরু নিন্দা করবে? তবুও আবার বলছি-- বিদ্যাসাগর বাংলা ভাষাকে এগিয়ে দিয়েছেন। আসলে দোষে গুণে মানুষ। ময়নার সম্বিত ফেরে । নবীন মাস্টার হাত ধরে নাড়া দেয়। বলে, কিরে খেয়ে নে  ।পকোড়া গরম গরম ভালো লাগে । এরপর কফি দেবে। মিটিং যেতে হবে। পড়া শেষ করতে না করতেই কফি এসে গেল । ময়না বলল–' আমি কফি খাবো না।' নবীন মাস্টার বললো–' তা বললে হয় ।কফি হাউসে এসে কফি না খেলে তোদের পরিচিতরা কি বলবে ? 'নবীন মাস্টারের কাছে বসা মেয়েটি বলল– তুই কফি হাউস নিয়ে যে গানটা আছে, শুনেছিস? আরে ওই যে কফি হাউসের সেই আড্ডাটা আজ আর নেই। ময়না না শোনায়, মাথা নাড়লো । সকলে একটু বিদ্রুপের দৃষ্টি নিক্ষেপ করল। ময়না কোন উত্তর দিল না ।কফিতে চুমুক দিয়ে মুখ বিকৃত করল ।নবীন মাস্টার বলল --'তোর আর কফি খেয়ে দরকার নেই। নে চল, কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় দেখিয়ে, শহীদ মিনারে পৌঁছাব। দরজা পার হয়ে হাঁটতে থাকে সবাই। ময়না একটু নিঃশব্দ হাসি হাসে। তার গ্রাম, বাসের মধ্যে, এমনকি কফি হাউসেও টুলো পন্ডিত এর ছড়াছড়ি।

সত্যিই শহরের তুলো পণ্ডিতরা কত কিছু জানে ।শহীদ মিনারের নেতারা জানে আরো বেশি ।শহীদ মিনার লোকে-লোকারণ্য। মানুষ দাঁড়ানোর তিল ঠাঁই নেই ।মঞ্চে বলছে মুর্শিদাবাদের রঘুনাথগঞ্জ এলাকার দুর্গা পুজো করতে পারেনা মুচিরা। বাধা দেয় । ঐ পুজোয় কোন ব্রাহ্মণ নেই । পিছিয়ে পড়া সমাজের মানুষরা ব্রাহ্মণ্য সংস্কৃতিকে উৎখাত করার জন্য সংগঠন করেছে। অথচ দুর্গার সংস্কৃতি আঁকড়ে ধরার জন্য দু'পক্ষই মারমুখী। এদিকে মামনি থেকে অমামনি অহরহ নির্যাতিতা। আবেদন-নিবেদন আছে। কিন্তু বিচার মেলেনা। বিচারের বাণী নীরবে কাঁদে। কথার শেষ নেই। তথ্যের শেষ নেই। যত দোষ সব অন্যের। নিজের দল ।তাই সবাইকে সরিয়ে নিজের দলকে ক্ষমতায় প্রতিষ্ঠা করতে হবে। হাততালিতে ফেটে পড়ে দর্শক। ময়না ও হাততালি দেয় । খানিক পরেই ফেরার পালা ।একরকম মনমরা অবস্থায় ঘরে ফেরা ময়নার।

ময়নার মা একটু জোরে ময়নাকে ডাকে, কিরে এই অবেলায় বসে বসে ঘুমোচ্ছিস। যা একটু বুড়ি ঠাকুমাকে এগিয়ে দিয়ে আয়। হন্তদন্ত হয়ে দুজনে পা বাড়ায়।

আজকাল একটু তন্দ্রাভাব হলে ময়না বক্তা হয়ে ওঠে–' শুনুন বাবুমশাইরা, আমি আদিবাসী বটে। আমাদের ঘরে একটি শিশুর জন্মহার মুহূর্ত থেকেই তাকে বাঁচার জন্য লড়াই করে যেতে হয়। শিশুর প্রথম লড়াই হয় প্রকৃতির বিরুদ্ধে। শীত-গ্রীষ্ম-বর্ষা প্রচন্ড শিশুকে আক্রমণ করে । শীতে, হাড় কাঁপানো বাতাসে, খালি গায়ে কাটাতে হয়। ঝরঝরে বর্ষায়, বাড়িতে সবার মত একটু জায়গা পাওয়া যায়না । বানের জলে শুধু গরু-ছাগল নয়, মানুষ ভেসে যায় । আর ফেরে না। অনাহারক্লিষ্ট মা-বাবার অব্যক্ত কান্না কুরে কুরে খায় ।আমি এমনই একটা পরিবারের মানুষ যেসব পরিবারের মায়েদের সন্তান জন্মানোর ২১দিন পর থেকে কাজে বের হতে হয়। ঘরে শিশু কাঁদে ,কাজের বিলে মা কাঁদে। সান্তনা দেওয়ার কেউ নেই । দুজনেই অপুষ্টিতে ভোগে ।কিন্তু বিশ্বাস করুন আপনাদের জাতপাত, ধর্ম নয়, আমি আমরা মাটির গন্ধ শুকি। জল-হাওয়া মাটিকে ভালোবাসি। আপনাদের দাপট সহ্য করে আদিবাসী শিশুরা, কিশোর-কিশোরী হয় ভাতের খবর নেবে বলে।


Joydeb Biswas

Poet Joydeb Biswas studied Bengali literature. In 2015, at the age of 22, he published 'Sahitya Chetona' magazine. Currently two editions of the magazine are published. One is the online version and the other is the printed version. He is the founder and editor of the two editions. facebook twitter youtube instagram whatsapp

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

নবীনতর পূর্বতন