ধা রা বা হি ক উ প ন্যা স
বাউল রাজা
প্রদীপ গুপ্ত
দ্বিতীয় খন্ড ( দ্বাবিংশ পর্ব )
বাতাস ধীরে ধীরে ঝড় হতে শুরু করলে সে ঝড়কে সামলে নেওয়া সহজ, কিন্তু হঠাৎ করে একজন মানুষ যদি সাইক্লোনের মধ্যে এসে পড়ে তাহলে সে বেসামাল হয়ে পড়ে।
কানাইদা একের পর এক বিষয়কে বিস্ময় বিস্ফারিত করে তুলছে। সে ঝড়ের সামনে দাঁড়িয়ে আমি যেন একেবারে বেসামাল হয়ে যাচ্ছি। কৃষ্ণভামার দু'চোখের তারায় আমি যে আমাকে আবিষ্কার করেছি, সেটা তো কানাইদার জানার কথা নয়। কারণ সে তো দৃশ্য, অন্তর্দৃষ্টির একটা স্বপ্নিল ভাব। সে দেখায় কোনো বাক্য উচ্চারিত হয়নি, কোনো শব্দ শব্দায়িত হয় নি, কোনোরকম তরঙ্গেরও সৃষ্টি হয় নি।
না, এটা বোধকরি ঠিক বলা হলো না। কোনো তরঙ্গেরই কি সৃষ্টি হয় নি? ভাবতরঙ্গও তো এক তরঙ্গ, সেই মূহুর্তে যে ভাবের ঢেউ উঠেছিলো আমাদের দুজনের মনের গভীরে, সে ঢেউয়ের আঁচ তো পেতেই পারেন কানাই বাউল। কিন্তু সেজন্য কি ভাবসমাধিতে নিমজ্জিত না হয়েও --
কানাইদা যে কোনও সাধারণ সাধক নন সেটার পরিচয় আগেও অনেকবার পেয়েছি, এবারও ফের একবার পেলাম। কৃষ্ণভামা যে ওর সাধনসঙ্গিনী সেটাই কি বাউলনির একমাত্র পরিচয়? ওদের ভেতর এতো দীর্ঘ যাপনে অন্য কোনও সম্পর্ক, ভাব ভালোবাসা, প্রেম, প্রীতি, নির্ভরতা এসব কি কোনও কিছুই গড়ে ওঠেনি? সেই অর্থে বাউলনির চোখের তারায় কি কানাইদার মুখ কখনও কৃষ্ণ হয়ে ভেসে ওঠেনি? কানাইদা হয়তো বাস্তবার্থে চক্ষুষ্মান নন, কিন্তু অন্তরস্থ নয়নের দীপ্তিতে তিনি যে অসম্ভব রকমের দীপ্যমান সে পরিচয় আমি আর কতোবার পাবো? তাহলে সে দৃশ্য কি তিনি কৃষ্ণভামার চোখে...
আচ্ছা, মানুষ কতোটা সাধক হলে আমি বাউলনির চোখের তারায় কী দেখলাম, সেটা উপলব্ধি করতে পারেন? আমি কি ক্রমেই তাহলে কানাইদার একজন প্রতিপক্ষ হয়ে দাঁড়াচ্ছি?
--" দ্যাকো পদীপদা, আমার মনে অয়, কন্টিবদল অলো গে একটা দারণা। যে দারণা মনে করে যে, এর পলে বুজি একটা মানুষকে অন্য একজন মানুষের সাতে জুইড়ে দেওয়া যায়। সে অয়তোবা কিচুটা যেতিও পারে, কিন্তু মন যেকানে জুড়তি না চায় সেকানে এমন কোন কন্টি আচে বলো দেকিনি, যে দুটো মনেরে দড়িদড়া দে জুড়ি দেপে? "
এটা কি নারীবাদী কথা বলছেন কানাই বাউল? আমি একজন নিমগ্ন শ্রোতার মতো ওর মুখের দিকে চাইলাম।
--" মন যকন আরাদ্য দেবতার কন্টলগ্ন অয়, সেটাই তো আসল কন্টি গো ঠাকুর। যে কন্টিতে বাব নেই, পেম নেই, কোনোরকম নিবেদন নেই সে কন্টি তো শুদুই সুতো আর তুলসীকাটে তৈরি মালা গো পদীপদা। শুদুই দ্যাকনদারি। "
লক্ষ্য করে দেখলাম, কানাইদা যখন ঘরের দাওয়ায়, কালো শিষ ওঠা লম্ফের কম্পমান আলোয় এ কথাগুলো বলছেন, তখন একটু দূরে অন্ধকারের মধ্যে ঠিক যেন একটা ছায়াশরীর হয়ে সোনাঝুরির খুঁটি ধরে পাথরের মূর্তির মতো দাঁড়িয়ে আছে বাউলনি। তার দাঁড়িয়ে থাকা শরীরের বিভঙ্গে যে কাঁপতে থাকা ছায়াটা উঠোনে গিয়ে পড়েছে, সে ছায়ায় কখনো তৈরি হচ্ছে একটা বৃক্ষশরীর, কখনও যেন একটা নদীর অবয়ব, আবার কখনও যেন একটা ভাঙাচোরা একতারা।
---" একটা কতা আজ তোমার কাচে স্বীকার করতে মন খুব চাইচে গো পদীপদা। আমি কিন্তু বাউলিয়া সমাজের কোনো গুরুর কাচে দীক্কিত নই গো। আমার কোনও দীক্কাগুরু নেই। চলার পতের কাঁটা, কাঁকর, কাদা,সবকিচু আমায় একাই পেরিয়ে আসতি অয়েচে গো। জানি না তুমি আমায় কী বাবো, আমার জেবন অনেকটা সেই গানের মতোই -- শিশুকালে মরে গেলেন মা, গভ্যে রেকেই মরলেন পিতা গুরু চোক্কে দেকলাম না -। তবে একজন মহান মানুষের কাচে আমি বড় অয়েচি। এই যে আকড়া দেকতিচো, এসব কিচুর মালিক চিলেন তিনি। তিনি আর দশজনকে দীক্কা দিলেও আমায় দিয়ে যাননি, তিনি বলতেন - তুই অচ্চিস গে ঈশ্বরের সন্তান, তোকে আমার দীক্কা দেওয়ার অদিকার নেই। বাউলের আকড়ায় বড় অয়েচি বলে আমি বাউল। জন্ম বাউল কিনা সে শুদুমাত্তর তিনিই জানতেন, আমায় ককনোও কিচু বইলে যাননি গো। "
আমি বুঝতে পারছি না, কানাইদা একথাগুলো আমায় বলছেন কেন? শুধু কি আমাকেই বললেন, না কি অন্যদেরও বলেছেন, হঠাৎ মনে হলো, কথাগুলো কৃষ্ণভামা জানে?
অন্ধকারে দাঁড়িয়ে থাকা সেই ছায়াশরীর কম্পমান দীপশিখার দিকে এগিয়ে আসছে। এসে হাঁটু গেড়ে বাউলের পাশে বসলো সেই শরীর। কানাইদার মুখ তার দুই পানপাতায় ধরে নিজের মুখটাকে নামিয়ে নিয়ে এলো বাউলের মুখের কাছে। পরম প্রেমে বাউলানি তার ডানদিকের গালটাকে চেপে ধরলো বাউলের বাঁ গালের ওপর। আর এক নদী প্রেমাশ্রু বয়ে যেতে লাগলো বাউলানির চোখের সরোবর থেকে বাউলের তোবড়ানো গালের লবণাক্ত হ্রদ ছাপিয়ে।
( চলবে )