বাউল রাজা
প্রদীপ গুপ্ত
দ্বিতীয় খন্ড ( একবিংশ পর্ব )
নতুন আতপের গন্ধে ভুরভুর করছে বাতাস। গন্ধের চোটেই ক্ষিদেটা যেন আরও পেয়ে বসেছে। সোনামুগ আর নতুন গোবিন্দভোগের মিশেলে রসনা তৃপ্তির যে ব্যবস্থা আজ বাউলনি করেছে, সে অমৃত যে আজ কতক্ষণে পাতে পড়বে সে কথা ভেবে কানাইদা অস্থির হয়ে উঠেছে।
--- " বুজলে গো পদীপদা, এর ওপর যদি এট্টু ঘিয়ের স্নেহ মাকানো চোঁওয়া পড়ে, তালে আর দেকতে অপে না। বলি ও কিষ্ণা, তোর আঁচলের খুঁটে কি এট্টুখানিও ঘি বাঁদা নেই রে? "
কৃষ্ণভামা রান্নাঘরের পাতা উনুনে ডালপালার জ্বালে রান্না করতে ব্যস্ত। পায়ের কাছে রাখা একটা বাঁশের পাইপ দিয়ে মাঝেমধ্যে নিভে আসা আগুনের ভেতর ফুঁ দিয়ে আগুন কে উস্কে দিচ্ছে।
--" এই যে ধরো না কেন, এই যে সুবাস তোমার নাকের বেতর দে অন্তরে পবেশ করচে, অতবা যদি অন্যরকম বাবেও বলা যায়, যে তুমি এই সুন্দর গন্দকে নিজের হিদয়ে জায়গা করে দিচ্চো, এটাও কি পেম লয় গো? যদি তাই হয়, তালে পরে এ পেমের জাত কী ? স্বকীয়া না পরকীয়া? "
হঠাৎ করে আমার যে কী হলো, আমি বলে উঠলাম -- " এ যদি প্রেম হয়, যদিই বা কেন, এ তো অবশ্যই প্রেম। তবে আমার কী মনে হয় জানো? এ প্রেমের জাত হয় না। এ প্রেম একদম খাঁটি বাউলিয়াদের প্রেমের মতোই। "
-- " তারে ধরি ধরি মনে করি - ধরতে গেলে আর মেলে না -- দেখেছি রূপসাগরে, মনেরমানুষ কাঁচা সোনা -- পদীপদাদা যা কিচু মনের চাহিদা মেটায় গো, সেটাই পেম। দেকো একেনে যদি এ চাল এ ডাল না অয়ে মোটা চাল পোকায় কাটা ডালও ওতো, তালেও তুমি কেতে, উদর পুন্ন করতে। করতে কিনা বলো? কিন্তু মনের উদর খালিই পড়ে থাকতো। এই যে ফাঁক, একেনেই পেমের বাস। "
সত্যিই তো, আমি তো এভাবে কোনওদিন ভেবে দেখিনি। আর দেখবোই বা কীভাবে, শিশুকাল থেকেই যে দুধে-ভাতে মানুষ হয়েছি। কোনওদিনও কোনো চাহিদা তৈরি হওয়ার মতো বাবা মা কোনো ফাঁক রাখেন নি। কিন্তু ইনি যেটা বললেন, সেটা যে কি মারাত্মক শক্তিশালী দর্শন ---! আচ্ছা, এটা কি মার্ক্সীয় দর্শনের অনুসারী? হয়তো তিনি কথাগুলোকে ঠিক এভাবে বলে যাননি, কিন্তু কথাগুলো তো একেবারেই ভাববাদী বলে মনে হচ্ছে না। বরং চরম বস্তুবাদী কথা।
এসব ভাবনার মাঝেই দুটো কলাইকরা থালায় ধোঁয়ার ডানা মেলে তিনি এলেন। সাথে ডিমভাজা আর কাঁচা লংকা। শাড়ির আঁচলের খুঁটে হাত মুছতে মুছতে কৃষ্ণভামা হাতে একটা ছোট গব্যঘৃতের শিশি নিয়ে এসে দাঁড়ালো।
কানাইদা শুরু না করলে আমি শুরু করতে পারি না। কানাইদা গরম খিচুড়ির বুকে ডান হাতের তালু ছুঁইয়ে বসে আছেন। ধীরে ধীরে অন্ধ বাউলের মুখমণ্ডলে একটা অন্যধরনের আভা দেখা দিলো। আমি কানাইদার সাথে এই প্রথমবারের মতো খেতে বসিনি। কোনোদিনই ওকে এভাবে বসে থাকতে দেখিনি। কৃষ্ণভামার দিকে চাইলাম। সে ঘাড় নেড়ে আমাকে খাওয়া শুরু করতে বললো। কিন্তু --
খাওয়া শেষ করে, হাতমুখ ধুয়ে মুখে বাউলদিদির এগিয়ে দেওয়া পান চিবোতে চিবোতে মুখ খুললেন কানাই বাউল।
--" তোমার সবচে' বড়ো আপন কে বলতি পারো? "
--" সম্ভবত আমি নিজেই। "
--" একদম টিক কতা বইলেচো। সেই যে তোমার আপন পরমাত্মীয়, তেনাকে আমরা জানি পরমাত্মা বইলে। টিক কিনা? "
--" হুমম, --"
--" সেই যে গানটা আচে না, -- তুমিই হে পিতা, মাতা তুমি ওগো, তুমিই হে বন্দু সকা তুমি? আসলে এই সবকিচুর আদার হলো গে' সেই পরমাত্মা। তাঁর বাস ককনো হিদয়ে ককনো মাতায়, ককনো মুকে, নাকে, কানে আবার ককনো উদরে। ভালো কতা শুনলি তুমি সে কতাকে যেমুন মনের তেকে গহণ করো, সুন্দর কিচু দেকলে যেমুন মন আনন্দে মেইতে ওটে, আসলে সেসব কিচু তুমি সেই পরমাত্মীয়কে তার কুশীর জন্য নিবেদন করো। তেমনি বালো কিচু স্বাদ নিতি গেলেও তেনাকে নিবেদন করতি অয় গো পদীপদা। সেটা করলি তবেই তিনি সবটা বালো গহণ কইরে তিপ্ত হন।
আজ যেমুন কিষ্ণভামা তার মনের যা কিচু ভালো সে সবকিচু তোমায় নিবেদন করলো বলেই না তুমি ওর চোকের তারায় --"
সব্বোনাশ, কী বলছেন কি কানাই বাউল! ওর কি কোনোকিছু অগোচরে থাকে না?
--" তোমার মনে বাউলদের কণ্টিবদল নে পশ্ন আচে, তাই না?
( চলবে )