ধা রা বা হি ক উ প ন্যা স
বাউল রাজা
প্রদীপ গুপ্ত
দ্বিতীয় খন্ড ( বিংশতি পর্ব )
এ কি হলো হঠাৎ ! হাতদুটো সামনের মাটিতে ভর দেওয়া, আঁচল মাটিতে লুটোচ্ছে, মুখটা মাটির দিকে রেখে বসে আছে বাউলনি। আদৌ বসে আছে কি? যেভাবে আছে, তাকে বুঝি বসে থাকা বলে না। হলো কি কৃষ্ণভামার? এ অভিজ্ঞতা আমার কোনও দিনও হয় নি। শুনেছি মানুষের ব্লাক আউট হয়, তাহলে কি বাউলনির সেটাই হলো? উঁহু, তাহলে তো এভাবে হাতের ওপর ভর করে ---! মৃগীও নয়। তাহলে কী?
ধীরে ধীরে আকাশের দিকে মুখ তুললো বাউলনি। স্থির শূন্য দৃষ্টিতে অবিরল ধারায় জল বয়ে চলেছে। মুখে কোনো কষ্ট বা বিরক্তির চিহ্নমাত্র নেই, আবার হাসির রেখাও নেই। শুধুই এক আবিল দৃষ্টি। জলপ্রপাত আছে, কিন্তু নিঃশব্দ। কোনোরকম শব্দের রোল নেই। এ অবস্থাকেই কি সমাধিস্থ হওয়া বলে? দু'চোখের ওই ধারা কি প্রেমাশ্রু? কিন্তু এখন আমার কর্তব্য কী? ওকে ধরে তোলা? তাহলে যদি ওর এ অবস্থার অন্যায় অযাচিত পরিসমাপ্তি ঘটে?
খুব হালকা উত্তুরে হাওয়ায় গাছের পাতারা তাদের অস্তিত্বকে জানান দিচ্ছে। দূর থেকে ডুগি আর একতারার সাথে অতি ক্ষীণ একটা বাউলিয়া সুর ভেসে আসছে। এর ভেতরেই একটা আওয়াজ ভেসে এলো --" ঠাকুর --"। অতি গভীর পাতকুয়োয় একখন্ড পাথর ফেললে ঠিক যেভাবে পাথরের জলে পড়ার শব্দটা পাক খেতে খেতে কানে এসে পৌঁছোয়, বাউলনির গলার স্বরটাও ঠিক যেন সেভাবেই এসে পৌঁছুলো। আমি ওর দু'হাত ধরে আলগোছে ওকে তুলে দাঁড় করালাম।
--" তুমি কি আমার চোকে কিচু দেকলে গো ঠাকুর ! "
এ কথার কি উত্তর দেবো, ঠিক বুঝে উঠতে পারলাম না। বাউলনি অধোবদন হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। ওর মুখ জুড়ে চাঁদের ষোলকলা খেলা করছে। কখনও অন্ধকার তো পরমুহূর্তেই আলো ঝলমলে।
--" এবাবে যে দরা পইড়ে যাবো, কে জানতো বলো দিনি? "
--" কী ধরা পড়লে গো বাউলদিদি? কবে কী লুকোনো ছিলো, যে আজ ধরা পড়ে গেলে বলে ভাবছো? "
--" ঠাকুর, গোপাল ননী চুরি করে এ কতা মা যশোদার জানা আর চুরি কত্তে গে আতেনাতে দরা পড়ে নজ্জায় মুক পোড়ানো কি এক ওলো বলো দেকি? "
--" বাউলদিদি, চকোর যে জোৎস্না পান করে, সেটা কি আর চাঁদের অজানা থাকে? নাকি জোৎস্না পান করতে গিয়ে চকোর চাঁদের কাছে মুখ লুকোয়? তুমিই না বলেছিলে, যে প্রেমে শারীরিক মিলনের আকুতি নেই সে প্রেমে শরমের কোনো আড়ালের দরকার পড়ে না? "
--" ঠাকুর --"
--" উঁ --"
--" এ কোন্ বাঙনের সব্বোনাশা কেলায় মেতেচি আমরা? "
--" কোনও ভাঙন নয় গো বাউলদিদি, এ এক অদ্ভুত সুন্দর গড়ার খেলা। মেঘ যখন বৃষ্টি হয়ে মাটিতে নেমে আসে, তখন মাটিও পরাণভরে সে সুধা পান করে উর্বরা হয়। সে প্রেমে অন্যায় নেই, সে প্রেম ভাঙনের নয় গো, সে প্রেম সৃষ্টির। অনেক হয়েছে, এবারে চলো দেখি, ওদিকে কানাইদা খিচুড়ি খাবে বলে বসে রয়েছে।
--" শোলা ডুবে পাথর ভাসে
হরি নামের নিশানা
একটা নাগের সাথে নেউলের পীরিত
সুহৃদ হলে যায় জানা।
অষ্টমীতে একাদশী বিধবা রইলো বসি
পূর্ণশশী উদয় আসি
নিত্য করে ছলনা।
খাইলে পাতকী হয়,
না খাইলে পাপের উদয়
বলো বলো ও মহাজন আমারে তাই বলো না।
পতি তার থাকে বিদেশে
নিত্য রমণ করে বসে
সেই নারী নিত্য প্রসবে
সতীর হলো ঘোষণা। "
এ কি রূপ কানাইদার! পুরোদস্তুর বাউলের সাজে সেজেছেন। বহুবর্ণ আলখাল্লা, দু'ফেরতা করে গেরুয়া রঙের ধুতি, মাথার পাগড়িটাও এতো সুন্দর করে বেঁধেছেন! ডানদিকের কানের ওপরে ফুলের মতো করে গিঁট দিয়ে একটা প্রান্তকে ঝুলিয়ে দিয়েছেন প্রায় কোমর পর্যন্ত। বাঁয়ের কাঁখে ডুগি বেঁধেছেন, পায়ে ঘুঙুর, নেচে নেচে দুলে দুলে কি আনন্দেই না গাইছেন গানটা! আমরা উঠোনে পা রাখতেই জোর গলায় ছুটকিকে বলে উঠলেন -- " হ্যাঁরে ছুটকি -- উনুনে আঁচ দইরে দে রে। আজকের ইসপেশাল কিচুড়ি একদম জইমে যাবে রে। লতুন আলোচাল আর সোনামুগির ডালের সাতে পীরিতি মেশানো ঘি দে -- আহা -- তর সইচে না রে --"
( চলবে )