1 / 7
2 / 7
3 / 7
4 / 7
5 / 7
6 / 7
7 / 7

প্রদীপ গুপ্তের ধারাবাহিক উপন্যাস 'বাউল রাজা' | ঊনবিংশ পর্ব

ধা রা বা হি ক   উ প ন্যা স

 বাউল রাজা 

• প্রদীপ গুপ্ত

দ্বিতীয় খন্ড ( উনবিংশ পর্ব ) 



দিনের আলোর মধ্যে কোনো মিথ্যার জারিজুরি নেই, অন্ধকারের বুকে সত্যর। আর আলো আঁধারিয়ার চৌখুপিতেই যত রাজ্যের সত্য-মিথ্যার বসবাস। যত কল্পনা, যত ধারণা, যত কুহক সবই এই আলোর ঘোমটায় ঢাকা পড়ে থাকা আঁধারের অথবা আঁধারের অবগুন্ঠনে উঁকি মারা আলোর রহস্যময়তায়। 

নববধূর নয়নঠারের মতোই সে রহস্য অলঙ্ঘনীয়। ওষ্ঠের থরথরানির মতোই আকর্ষণীয় সে রহস্য। 

এখন যে রাস্তাটা দিয়ে আমরা হাঁটছি, সে রাস্তার আকাশটা ঢেকে আছে শুধু বিভিন্ন প্রজাতির গাছপালার শাখায়। কোনো কোনো গাছ নিষ্পত্র, কোনোটা আবার পাতায় পাতায় ঝাপসা হয়ে আছে। কৃষ্ণভামা বুঝি এই একবছর ধরে আজকের রাতটার জন্যই অপেক্ষায় ছিলো। গতবারের কৃষ্ণভামার সাথে এবারের বাউলনির বেশ কিছুটা পার্থক্য দেখছি। এবারে ও যেন একটু বেশী প্রগলভ, একটু বেশী উচ্ছ্বলিত, যেন একটু বেশী বাঁধনহারা। 

--" ঠাকুর --"

--" উঁ --"

-- " আমাকে তুমি বুল বাবচো না তো? "

--" মানে? "

--" না, মানে আর কি? তুমি হয়তো আমাকে --"

এখন চাঁদ ঠিক মাথার ওপর। গাছপালার ডালপালার জানালা দিয়ে চাঁদটা বুঝি প্রাণপণ চেষ্টা করে চলেছে তার বক্ষ নিঃসৃত দুধগোলা আলো দিয়ে পৃথিবীকে স্নান করাতে, সে আশাকে নিষ্ঠুরভাবে আটকে দিচ্ছে ডাল-পাতাগুলো। ফের সেই আলোকে ফেরত পাঠিয়ে দিচ্ছে অন্য কোথাও। আর পৃথিবীকে মুড়ে দিচ্ছে এক অপার রহস্যময়তায়।

--" না, আমি যে তোমাকে আমার নাগর বলনু, এতে তুমি হয়তো --"

বাউলনির মুখে কি এক লহমার জন্য একটা কপট হাসি দেখলাম! নাকি সত্যি একটা দুশ্চিন্তার কালো ছায়া, বুঝতে পারছি না। এর জন্য এই আলো আঁধারিই দায়ী।

--" নাগর মানে কী গো বাউলদিদি? "

একটা চাপা হাসির রোল উঠলো যেন। মনে হলো এই হাসির সাথে বয়ে যাওয়া নদীর একটা আশ্চর্যরকমের মিল আছে। ছোটো ছোটো নুড়িতে ধাক্কা খেয়ে জলের বুকে যে শব্দের রোল ওঠে, এ হাসি অনেকটাই যেন সেরকমের। 

-- " নাগর মানে জানো না বুজি? তুমি এক্কেবারেই চেলেমানুষ গো পদীপদাদা। "

আবার সেই চাপা হাসির দমক। এবার বুঝি আমারও কিছু বলা দরকার। 

--" আচ্ছা বাউলদিদি, তুমি তো এতোকিছু জানো, বলো দেখি --"

কিছু একটা বলতে যাবো, বাউলনি ওর হাতের তালু দিয়ে আমার মুখ চেপে ধরলো। 

--" ছি ছি, তোমার কতো জ্ঞানগম্যি, সে আমি বিলক্কণ জানি গো ঠাকুর।  আমি যে একজন অশিক্কিত গেঁয়ো মেইয়েমানুষ। এবাবে বলাটা আমার উচিত অয় নি কো। কিচু মনে কোরো না ঠাকুর, আমারে ক্কমা --"

--" এ আবার কীরকম কথা বাউলদিদি! আমি যা জানি সে তো বইয়ের জ্ঞান, আর তুমি যা জানো, সে যে জীবন থেকে ছেঁচে তোলা মুক্তোর মতো খাঁটি। আমি অতদূর থেকে কীজন্য ছুটে আসি, তুমি কি বুঝতে পারো না? তোমার কাছে, কানাইদার কাছে, গুরুপদবাবার কাছে, এখানকার সমস্ত মানুষ, নদী, গাছপালা, আকাশ, পাখি সবার থেকেই যে আমি প্রকৃত জীবনের পাঠ নিই গো। "

-- কি সুন্দর কইরে কতা বলো গো তুমি পদীপদাদা, মনে অয় তোমার কতার মদ্দে আমি পজাপতির ডানায় বেসে আসা সুর শুনতে পাই।"


এ কথার উত্তর দেওয়ার কোনো মানে হয় না। এখানটায় গাছপালার আবডালটা কম।  আকাশের তারাগুলো যেন অনেকটা নীচে নেমে এসেছে। সেই কখন বাউলনি তার হাতের তালু আমার ঠোঁটের ওপর থেকে সরিয়ে নিয়েছে, এতোক্ষণে সে তালুর গন্ধ আমার ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য হলো। সেই ছিঁড়ে ফেলা কাঁচা আমের বোঁটায় লেগে থাকা কষের মতো একটা বুনো অথচ মিষ্টি গন্ধ। 

---" নাগর মানে পেমিক গো। যে পেমিকের সাতে শুদুই মনের কতা বলা, শরীলের সাতে লয়।  এটা ভাবের পিরিতি গো, কতো নারী যে কিষ্ণকে মনের আসনে বইসে তার সাতে পিরিতে মজে, তার কোনো গোনাগুনতি নেই গো। পিরিতে যার কাচে মন মজে, সেই অলোগে পিরিতের নাগর। "


কথা কটা বলেই কৃষ্ণভামা ওর দুবাহু আমার কাঁধের ওপর রাখলো। 

--" তুমি যে আমার মন চুরি করে নেচো গো ঠাকুর, আমার পিরিতির কানাই, আমার দুচোকের তারায় বাস করা কেষ্টঠাকুর গো।"

এখানে আলোছায়ার সেরকম কোনো অবগুণ্ঠন নেই , বাউলনির দু'চোখের মধ্যে আমি এ কি দেখছি? মানুষের মধ্যে এরকম ভাবের প্রকাশ আমি কোনোদিনও দেখিনি তো বটেই, আর কোনোদিনও দেখবো কিনা সেও জানা নেই। সেদিন আমি এক ঝলকে মনশ্চক্ষে বাউলনির বস্ত্রহীন শরীরকে নিমেষে পদ্মফুলে মিলিয়ে যেতে দেখেছিলাম, আজ এখন এই শুক্লা অষ্টমীর চাঁদের আলোয় ওর দু'চোখে যেন চূড়ো করা চুলে শিখিপাখায় নীলাম্বর বংশীবাদক কৃষ্ণকে দেখতে পাচ্ছি। শুধু মুখের আদলটা যেন আমার মতো। অবিকল আমারই মতো। কয়েক লহমা। কৃষ্ণভামার শরীরটা যেন একটা লতানে গাছের মতো মাটিতে লুটিয়ে পড়লো। আমি হতবাক হয়ে তাকিয়ে রইলাম সে পুষ্পভারমথিত শরীরলতার দিকে। 


( চলবে )

Joydeb Biswas

Poet Joydeb Biswas studied Bengali literature. In 2015, at the age of 22, he published 'Sahitya Chetona' magazine. Currently two editions of the magazine are published. One is the online version and the other is the printed version. He is the founder and editor of the two editions. facebook twitter youtube instagram whatsapp

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

নবীনতর পূর্বতন