1 / 7
2 / 7
3 / 7
4 / 7
5 / 7
6 / 7
7 / 7

প্রদীপ গুপ্তের ধারাবাহিক উপন্যাস 'বাউল রাজা' | পঞ্চদশ পর্ব

   ধা রা বা হি ক    উ প ন্যা স   

 বাউল রাজা 

• প্রদীপ গুপ্ত

    দ্বিতীয় খন্ড  ( পঞ্চদশ পর্ব)   

-- " ইনি কে গো কিষ্ণা মা! এনাকে তো এ ঠাঁয়ে দেকিনি ককনও? লতুন এলেন বুজি? "

--" হ্যাঁ গো ঠাকুর, ইনি লতুনই বটেন। গেল বচর অমাবস্যায় পেথম এয়েচিলেন গুরুপদবাবার আচ্ছমে। তা পেথমবার এসেই একতারার ভক্ত হয়ে গেচেন গো। "

--" আহা -- কি ভাব গো! দু-চোখি যেন ভাবসমুদ্দ ঘাঁটি গেড়ে আচে। তা তোমার ঘর কুনঠে গো গোঁসাই? "

আমি ভদ্রলোককে দেখে যাচ্ছি। আবক্ষলম্বিত শ্মশ্রুহীন নূর, মাথার কালো পাগড়ি ছাড়িয়ে বাবরি চুল কাঁধ ছাড়িয়েছে। কালো আলখাল্লায় সর্বশরীর আবৃত, গলায় গোটা দশেক নানা বর্ণের পুঁতির মালা, সাথে দু'তিনটে রুদ্রাক্ষমালাও আছে। কব্জিতে বেশ কিছু তুলসির মালা।

আমি দু-হাত জোড় করে প্রণাম করলাম। 

--" আজ্ঞে আমি কলকাতা থেকে আসছি। "

ভদ্রলোক হো হো করে হেসে উঠলেন। 

--" এ এক আজব নগর কলকাতা। নদের মানুষও বলেন কলকাতা তেকে এয়েচি, হুগলিও তাই। তা ঠাকুর কোলকাতার কোতায়, সেটা না বললি বুজি কীবাবে বলো দেকি! "

আমি ওর হাসির অর্থটা বুঝলাম। বিনীতভাবে বললাম -- " আজ্ঞে কলকাতার টালিগঞ্জ থেকে। "

এবারে যেন দু'নয়ন বিস্ফারিত হলো, 

--" টালিগঞ্জ! সেই যেকেনে উত্তম সুচিত্তার ছপি তৈরি হয় গো? তালে আপনি তো যে সে মুনিষ্যি নও গো ঠাকুর, ফিলিমএর দেশের মানুষ। "

-- " আমাদের ঠাকুরও খুব ভালো গান গাইতে জানেন গো গোঁসাই, রাজা বাউলের গান। "

--" রাজা বাউলের গান? সে আবার কোন বাউল গো? আগে তো ককনো... "

--" আরে রবিঠাকুর গো গোঁসাই, রবিঠাকুরকেই আমি রাজা বাউল বলি গো। "

--" তাই নাকি! তাহলে তো তোমার গান না শুনলিই --- এই দ্যাকো দিনি, আপনারে আবার মনের ভুলে তুমি বইলে ফেললাম -- এতো বেবভুল মন আমার, কিচুতেই শাসন কত্তি পারি না। "

--" ভুলের কী হয়েছে? আপনি তো আমায় তুমি বলেই বলবেন। "

--" এই দেকো দিকি, সেই তকন থে ঠায় দেঁইড়ে আচো। একটু বসো কেনে গরিবের মেহফিলখানায় --"

বলেই একটা তালপাতার চাটাই পেতে দিলেন মাটির দাওয়ায়। আন্তরিকতার কাছে শুনেছি প্রেমের বশ্যতা স্বীকার করা আছে। অগত্যা পেতে দেওয়া চাটাইতে বসতেই হলো।

--" শুনলাম আপনি লালন সাঁইয়ের --"

--" ওর গান আমার ভালো লাগে গো, ওর গানের ভেতর জীবনের আলো খুঁজে পাই। "

-- " কিন্তু আপনি যে গানটা... "

--" শাহ আবদুল করিমের গান। "

একটুক্ষণ চুপ হয়ে বসে রইলেন। বাউলনিও এসে আমার পাশেই আসন নিয়েছিলো। সে যে গানটা লালনের গান বলে আমায় বলেছিলো, সে ভুলটা বুঝতে পেরে আমার দিকে কাতর দৃষ্টিতে চাইলো। 

--" আপনার নাম শুদোনো হয় নি গো ঠাকুর। তা এটটা কতা বলি -- ধরো না কেনে - " নাম ", বাবা মা কত ভেইবে চিন্তা কইরে এট্টা নাম দিলেন, যতোদিন হামাগুড়ি ততোদিন সেই নাম বাপ মায়ের। কিন্তুক শিশু যখন ডাগর হইয়ে গেলো, তকন কিন্তুক সে নাম আর বাবা মায়ের রইলো না গো, সারা পাড়াময় মানুষ তাকে সেই নাম ধইরে ডাইকতে নাগলো। গানও ঠিক তেমনি গো ঠাকুর।  পদকত্তা যকন পদ রচনা কইরে বিভোর হইয়ে কতার বেতর সুর নাগাচ্ছেন, তকন সে পদ, সে সুর পদকত্তার। যেকুনি সুর দেওয়া সাঙ্গ হলো, বাদ্যযন্ত হাতে নে তিনি সেই গান গেইয়ে মাদুকরীতে বেরোলেন, তকন সেই গান আর তার রইলো না, সে তা শাহ করিমেরই হোক কি লালন সাঁইয়ের। "


এক নিঃশ্বাসে বলে গেলেন কথাগুলো। খাস কলকাতার মানুষ বলে একটা আত্ম অহম ছিলো। কলকাতায় বসে গাঁয়ের মানুষদের অশিক্ষিত ভাবতে এতোটুকুও কুন্ঠা বোধ করিনি, কিন্তু এখানে এসে আমার সেই অহংকারে জল ঢেলে দিচ্ছেন মানুষগুলো! কি অবলীলায় যে কতটা গভীরে গিয়ে একটা একটা করে শুক্তিকে তুলে এনে তার ভেতর ঘুমিয়ে থাকা মুক্তোকে  হাতের তালুতে করে আমার অহংকারের গোড়ায় ঢেলে দিচ্ছেন! 

--" আসলে কি জানো পদীপবাবু, শাহ আব্দুল করিম, লালন ফকির, এনারা হচ্ছেন গে এক একটা আলোর বিত্ত গো। আলোকে কিন্তুক তোমায় আলোই বইলতে অবে গো। নেহাৎ বলতি পারো কোনোটা হয়তো একটু বেশি উজ্জ্বল, কোনোটা হয়তো কম। কিন্তুক আলো তো আলোই, বলো কেনে? এনারা যদি একবার গে তোমার হিদয়ে সেদোন, তালি পর যে আনন্দস্বরূপ আলোয় হিদয় ছেয়ে যাবে, অত আলো বুজি সুয্য চন্দেরও নি গো। "

আনন্দস্বরূপ আলো! কথাটায় চমকে উঠলাম। সত্যিই তো তাই, আলোই তো জ্ঞান, আলোই তো চেতনা, আলোই তো পিপাসা, আলোই তো প্রেম, আলোই তো আনন্দ। হৃদয়ের যে প্রকোষ্ঠেই আলোর আগমন ঘটে, সেখানেই তো চেতনায় প্রবেশাধিকার পায় আনন্দ। রবিঠাকুর কতোভাবেই না এই আলো আর আনন্দের সহাবস্থানের কথা বলে গেছেন !  বুঝলাম, দর্শন আর দার্শনিক -- দু'য়ের মেলবন্ধনেরই অন্য নাম আলো আর আনন্দ। 


( চলবে )

Joydeb Biswas

Poet Joydeb Biswas studied Bengali literature. In 2015, at the age of 22, he published 'Sahitya Chetona' magazine. Currently two editions of the magazine are published. One is the online version and the other is the printed version. He is the founder and editor of the two editions. facebook twitter youtube instagram whatsapp

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

নবীনতর পূর্বতন