1 / 7
2 / 7
3 / 7
4 / 7
5 / 7
6 / 7
7 / 7

প্রদীপ গুপ্তের ধারাবাহিক উপন্যাস 'বাউল রাজা' | চতুর্দশ পর্ব

   ধা রা বা হি ক    উ প ন্যা স 

বাউল রাজা

     • প্রদীপ গুপ্ত

 দ্বিতীয় খন্ড ( চতুর্দশ পর্ব ) 

সারাটা আকাশ জুড়ে টগরফুলের মতো তারারা ফুটে আছে, চাঁদের নৌকোটা তখন পুবের দিক থেকে একটু দক্ষিণ দিকে হেলেছে। ধীরে ধীরে ওটা পাল তুলে দক্ষিণ পশ্চিম দিকে দাঁড় বাইবে। 

আধো আলো আধো আঁধারে গাছগুলোর বুক জুড়ে থোকা থোকা জোনাকি, জোনাকিরা ছড়িয়ে আছে ভুঁই থেকে মাথা তোলা কণ্টিকারির ঝোপগুলোর বুকে। মনে হচ্ছে যেন, আকাশময় ছড়িয়ে থাকা তারারা বুঝি মাটির প্রেমে নীচে নেমে এসেছে। রাতের আকাশকে আমি বুঝি এভাবে উপলব্ধি করিনি কখনও। 

ছাতিমফুলের মৌতাতের সুবাস আর রাতের আকাশ সবকিছুই যেন এক অপরূপ বাউলিয়া রূপ নিয়ে আমার সামনে দাঁড়িয়ে। 

--" ঠাকুর --"

ফিসফিস করে একটা শব্দ আমার চৈতন্যর মধ্যে যেন একটা গোপনীয় বার্তা পৌঁছে দিতে চাইছে। 

-- " আজকের আকাশের মতো এতো রূপসী আকাশ আমি কোনোদিনও দেকিনি গো।  আসলে আমার মনে লয় ঠাকুর, মনের মতো সঙ্গী পেলি পরে পিথিবিটাই বুজি আয়নার সামনে বইসে সাজতি শুরু করে। "

--" ঘাসে ঘাসে পা ফেলেছি বনের পথে যেতে

ফুলের গন্ধে চমক লেগে উঠেছে মন মেতে

ছড়িয়ে আছে আনন্দেরই দান, 

কান পেতেছি, চোখ মেলেছি, ধরার বুকে প্রাণ ঢেলেছি, 

জানার মাঝে অজানারে করেছি সন্ধান।

বিস্ময়ে তাই জাগে -- জাগে আমার প্রাণ --

আকাশ ভরা --"

-- " ঠাকুর, এ প্রাণের খোঁজ কীভাবে পাওয়া যায় -"

দূর থেকে যেন একটা আকুতি ভেসে আসছে। আমি শুনতে পাচ্ছি, কিন্তু ঠাহর করতে পারছি না। কে যেন আমার হাত ধরে তারায় তারায় নেচে বেড়াচ্ছে -

" অসীম কালের যে হিল্লোলে জোয়ার ভাঁটায় ভুবন দোলে -- নাড়িতে মোর রক্তধারায় লেগেছে তার টান -- বিস্ময়ে তাই জাগে, জাগে আমার গান -- আকাশভরা --"

--" তোমার কাছে এলিই আমার জানাগুলো কেমন বেবভুল হয়ে যায়, আমি কোতায় যেন হাইরে যাই, কোন্ নক্ষত্তের পত ধইরে কে যেন একটা একতারার সুরে আমায় ঘুইরে নে বেড়ায়। আমি কিচুতেই পত খুঁজে পাই না --"

সেই সদ্য শিশিরপাতে ভিজে যাওয়া বাতাসে আমি আমার গালে কার যেন করতলের শীতল স্নিগ্ধ স্পর্শ পেলাম। ধীরে ধীরে আমি উপলব্ধির জগতে ফিরে আসছি। বাউলনি তার দু'হাতের তালু দিয়ে আমার দু'গালকে ধরে আছে। তার দুচোখের পাতায় টলমল করছে সদ্য পড়া মুক্তোবিন্দু। আমি সেই আধো আলো আঁধারিয়ায় কৃষ্ণভামার চোখে কী দেখলাম, তার মানে আমি আজও বুঝে উঠতে পারি নি। সেটা কি রাধাভাবের বিভোরতা, নাকি এক অসহায় নারীর আত্মসমর্পণ অথবা -

--" বন্দে মায়া লাগাইছে, পিরিতি শিখাইছে

দিওয়ানা বানাইছে ---

কী জাদু করিয়া বন্দে মায়া লাগাইছে --


আমি কী বলিবো আর - বিচ্ছেদের আগুনে পুড়ে

কলিজা অঙ্গার --

ওরে পরাণবঁধুর পিরিতে আমার কুল হারাইছে--

দিওয়ানা বানাইছে আমায় --


বসে ভাবি নিরালায় --

আগে তো জানি না বন্দের পিরিতির জ্বালা, 

ওরে --কুল নাশা পিরিতির নেশায় 

কুল মান গেছে -- দিওয়ানা বানাইছে --"


দোতারার তারের সুরের সঙ্গতের সাথে ইনি কোন্ মহান, পথের পাশে সামান্য একটু ঢালের শেষে একটা অপ্রশস্ত উঠোনের পর একটা মাটির দাওয়ায় বসে এ কোন্ গান ধরেছেন? 

তখন কৃষ্ণভামার হাতের ভেতরে আমার হাত। আমরা মুখোমুখি দাঁড়িয়ে। হঠাৎ করে দু'ফোঁটা উষ্ণ জলবিন্দু আমার হাতের ওপর ঝরে পড়লো।


ঘন অন্ধকারেও যদি কোনও কিছু ঠাহর করার চেষ্টা করা যায়, তাহলে অন্ধকারকে দূরে ঠেলে সে বস্তু  প্রতীয়মান হয়ে ওঠে। আসল বিষয়টা হচ্ছে তুমি তাকে দেখার জন্য কতোটা উদগ্র হয়ে আছো। তোমার আকাঙ্খাই তোমার চাওয়াকে অস্পষ্ট থেকে স্পষ্ট করে তোলে। আলোর বুকে অন্ধকার বসত করে কিনা জানি না, তবে অন্ধকারের বুকে আলোর বসত আমি স্পষ্ট উপলব্ধি করলাম। ঘন কৃষ্ণ অন্ধকারে আমি পরিষ্কার দেখতে পেলাম কৃষ্ণভামার ঘন কৃষ্ণ নয়নতারার মধ্যে আমার মুখচ্ছবি। 

--" ঠাকুর --"

আবার সেই কন্ঠস্বর। যেন সমুদ্রের গভীর তলদেশ থেকে একটা বুদবুদ জলের উপরিতলে এসে অস্ফুটে ফেটে গেলো। 

--" গোঁসাই বলেন, অন্দত্ব চোখে লয় গো, আসল অন্দত্ব ঠাঁই গেড়ে নেয় মনের বেতরে। সমুদ্দ চায় বলেই দেকো সেই কোন গবিরে আলো গে সেঁদোয়। যারা জাত ডুবুরি তারা দেকো গবিরে ডুব দে ঠিক মুক্তো তুইলে নে আসেন। অন্দ চোকেও গোঁসাই যে আলোর সন্দান করেন, সেটাই আসলে খোঁজ গো ঠাকুর। মনের মদ্যি আকুলতা না থাকলি কেউ কারো নয়নতারায় নিজেরে পত্তক্ষ কইরতে পারে না গো। "

সে কি ? আমি যে ওর চোখের মণিতে আমায় দেখলাম, সেটা ওকে কে জানান দিলো? এই আদিগন্ত আঁধারিয়ায় নক্ষত্র আলোকে আলোকিত পৃথিবীর বুকে কিছুক্ষণ আগে শোনা গানটা যেন জীবন্ত হয়ে উঠছে। --" কি জাদু করিয়া বন্দে মায়া লাগাইছে -- দিওয়ানা বানাইছে , পিরিতি শিখাইছে -- "

গানটা কি তাহলে কেউ গাইছিলেন না, তাহলে এই গানটাও কি গোটা কুহকেরই অঙ্গ মাত্র? 

কৃষ্ণভামার হাতের মুঠোয় আমার হাত। পথের সেই ঢাল বেয়ে আমরা এসে সেই গায়কের উঠোনে দাঁড়ালাম। 

--" ঠাকুর, ইনি হলেন আব্দুল ফকির। লালন সাঁইএর সাগরেদ। যে গানটা ইনি গাইচিলেন, সেটার পদকত্তা লালন গো -- লালন ফকির।  "


কালো লুঙ্গি, কালো আলখাল্লা আর মাথায় একটুকরো কালো কাপড় ফেট্টির মতো করে বাঁধা একজন দীর্ঘদেহী মানুষ, হাতের দোতারাটা রেখে প্রণামের মুদ্রায় আসন ছেড়ে উঠে দাঁড়ালেন।


           ( চলবে )

Joydeb Biswas

Poet Joydeb Biswas studied Bengali literature. In 2015, at the age of 22, he published 'Sahitya Chetona' magazine. Currently two editions of the magazine are published. One is the online version and the other is the printed version. He is the founder and editor of the two editions. facebook twitter youtube instagram whatsapp

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

নবীনতর পূর্বতন