1 / 7
2 / 7
3 / 7
4 / 7
5 / 7
6 / 7
7 / 7

আজকের কবি লক্ষ্মীকান্ত মণ্ডল | সাহিত্য চেতনা

 

কবি লক্ষ্মীকান্ত মণ্ডল

কবি লক্ষ্মীকান্ত মণ্ডল

১৯৬৯ সালের জুন মাসে পশ্চিম মেদিনীপুর জেলার

 বরদা গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন । পিতা– গোরাচাঁদ মণ্ডল ও  মাতা – গীতা রাণী মণ্ডল । কবি পেশায় প্রাথমিক শিক্ষক । কবিতা সম্পন্ধে কবি মনে  করেন

"কবিতা মানে জন্ম , কবিতা মানে প্রেম , কবিতা মানে জীবন ,  কবিতা মানে মৃত্যু , এররকম বলা যেতেই পারে । সে কারণে জীবন , জীবিকা ও মানবিকতার একটি পূর্ণ অবয়ব হল কবিতা । কোন অবসর নয়,  কোন সময় কাটানো নয় ,  তার জন্য চাই একাগ্রতা , ধ্যান । তখনই নীরব মননে বেজে ওঠে মন্ত্র , সুর ।  শিহরিত ইন্দ্রিয়ের অঙ্গ উপাঙ্গ । এর নামই মগ্নতা। এর মাঝেই হেঁটে চলেছেন আমার দাদু ঠাকুমা  - সেই বৃক্ষের ছায়ায়  বিস্তারিত কবিতা ।"


 কবির প্রকাশিত কবিতার বইগুলিঃ 

হঠাৎ হঠাৎই  (১৯৯৮),মানুষের নদী (২০০০), খরানদীর বৃষ্টি সম্ভব (২০১০ ), সজনেফুল ও নিঃশর্ত সমর্পণ  ( ২০১১ ), আঁধারের পাঁজর (২০১২), কালো নৌকার তৃষ্ণা (২০১৩ ), তিলক জন্মের ছায়া (২০১৫), হরিত প্রাণের কম্পাঙ্ক  (২০১৮ ), জাম রঙের পুরুষ  (২০১৯)


• কবি লক্ষ্মীকান্ত মণ্ডলের একগুচ্ছ কবিতা প্রকাশ করা হল :


ভাসতে চাই না কখনো

              ***


শূন্যতা  বাড়ছে খুব ,  ভীরু রাত থেকে ভেজা ভেজা চোখ নিয়ে 

তৈরি করেছি কয়েকটা জানালা ,  অন্ধকার গড়িয়ে যায়  - 

কালো পাতার উপর  থেকে পাল্টে ফেলছি  নিঃসঙ্গ দহন   

থরথর কাঁপনের ধমনী দিয়ে উর্বরতা আসে অস্থাবর বাতাসে 


ভেজামাটির শিহরণে নামছে উদাস চাঁদের জল 

অপেক্ষার সীমানায় ধোঁয়া কুণ্ডলী  ; মেঘের মুখে কথা নেই     

সব ঈর্ষায় খড়বিচালির আবেগ  আর চোখের পিচুঁটি 

মহাশূন্যবোধে এক  জোনাকি ইহকাল 


জলের গভীরে ডুব দিতেই আবছা আলোর কষ্টফোঁটাগুলি 

সমুদ্র পেরিয়ে যায় ,   সব চুপচাপ নীল  - 

ভাসতে চাইনা কখনো  সেখানে শূন্যের চোখ  

গাছ ছায়া পাখিরপালক সরিয়ে  শুধু  আজন্ম আকাশ 


জমানো কথায় যুগান্তের ঝরাপাতা 

নিরাশ্রয় গোত্রের মাঝে উড়তে থাকে বুনোহাঁস     

আমাদের পথটি এঁকেবেঁকে আঁতুড় ঘরের কাছ দিয়ে চলে যায়  




শীত শীত নিয়তির পুব আকাশ   

                ***

ঝাপসা এক মেঘের তলায় দাঁড়িয়ে প্রাতঃভ্রমণের সঙ্গী খুঁজি      

কাছের বটগাছটি তখনও অন্ধকারের ভিতর কাঙাল হৃদয় 

তখনও শীত শীত নিয়তির পুব আকাশে কুয়াশার গুনগুন 

ছটফটে উদাত্ত পিপাসায় পৌঁছোতে পারে না নিজের চোখ  


সেই শুকতারা আকাশে অনাবৃষ্টির দৃশ্য ঘটে রোজ 

 অথবা মাথার উপর  কদম্বের গন্ধ ছড়ানো  পথ 

অন্ধকার মন্থনে জানিয়ে দেয় অস্তিত্বের সংকট 

আর বটগাছের আশ্রয় থেকে পাখি বেরিয়ে আসে       


ক্ষুধা ও তৃষ্ণার চুপকথার মাঝে  লুকানো শ্বাসকষ্টে  ধূ ধূ ফাটল 

এত জীর্ণ যে  - বেরিয়ে আসে বহুজন্ম আগের সেই নীরব মায়া 

আমার শরীর ঢেকে আছে  যাবতীয় কাম ক্রোধ মোহ 

এসব নিয়েই যিনি দান করবেন গোত্র,  মহাশূন্য অন্ধকার সত্যে  - 



 

এক মুক্তির পথ 

       ***


ফুল হাতে নিইনি কখনো 

শুধু ফুলের ইচ্ছায় মাটিতে দিয়েছি সুর 

সবুজ গাছের অনুরাগে দিয়েছি ঔরস আর ঘাম 

নিঃশব্দে গড়েছি নির্বেদ পৌরুষ 


আকাশ জড়িয়ে ধরে আমার দুহাত 

বলে ,  ফুল দাও  ;  সে তখন শুক্লপক্ষ 

তার কপালে চাঁদের অস্থিরতা  

এই আসে এই যায় ,  পরতে পরতে ডাহুক ডাকের ঊষাকাল 

সে এক পাগলামো  - সেও এক মুক্তির পথ  


 আলোকিত বিষ্ময়ে ভুলিনি কেউ বাতাসের  আমন্ত্রণ 

ভেসে যাই আত্মরমণ জ্যোৎস্নায়  



অন্ধকার শুষে নেয় নিঝুম

               ***


উত্তমকে সঙ্গে নিয়ে চলেছি সন্ধে থেকে রাতের দিকে  

সাইকেলের শব্দে ডানা পায় রাতের ধুলো,  লেপটে যায় বাতাসে  

কিরকির শব্দে সাপশিশু সেঁধিয়ে যায়  দূর্বাঘাসের শিকড়ে  

অন্ধকার শুষে নেয় নিঝুম  আকন্দ  

আমাদের আলাপচারিতায় আকাশ চোঁয়ানো আলো      

মোলায়েম বাতাসে শুকনো ঘামের গন্ধ, আর কালো কালো 

স্নান যাত্রায় পালতোলা নৌকার এক টইটুম্বুর নদী  


জোনাকি বুকে ধরার কষ্ট অনেক 

মাঝে মাঝে বুকের ধাক্কা খেয়ে ছিটকে পড়ে মাটিতে 

পড়ে যাচ্ছি আমরাও  -  চোখে ছায়াশীতল চাঁদ         

কিভাবে পার হবো সাঁকো ? 

ভাবতে ভাবতে খুলে ফেলেছি জামা  ;   প্রশ্বাস 

জেগে ওঠে প্রান্তর জলাশয় মাঠ 


পথের দুপাশে জ্বলতে থাকে শ্মশান আর নির্জনতা   



লাউলতার ভগ্নপথ 

           ***


নিখিল মরে যাওয়ার পর একটা  ঘাট তৈরি  হয়েছে পূর্ব দিকে  

তার সিড়িগুলো তুলসীবন কেতকীঝাড় লাউলতার ভগ্নপথ 

বিবস্ত্র দিনের পাশ দিয়ে নেমে গেছে  রোদ খেলার জলে  - 

সেই জলে চাষ দেয় বলরাম , লাঙলের ফলায় মাটিতে মিশিয়ে দেয় 

বুকের রশ্মি , মজা খালের শরীরে যৌবন ভাসে  

আবদ্ধ  রাতের দরজা ভেঙে পেরিয়ে যেতে চায় সাঁকো  


রোজ সকালে চান সারে নিখিলের বউ, খোলা পিঠে তখন সূর্যের শৈশব 

ছিঁড়ে দেয় সব গাঁদাফুলের মালা–পাতার নৌকায় ক্রমশ ঘন তরঙ্গ সুখ 

আকাশ এত নিচে নেমে আসে যে–মেঘে আঙুল ডুবিয়ে গালে মাখে 

নোনা জলের সারস–

 

 

ঘাম গন্ধে ক্ষিদে পায় ভীষণ  

              ***

আলপথ চোখে দরজা হাট করে বসে থাকে রাত  

এক'পা দু'পা আদরে উড়তে থাকে পরাগের নেশা 

উড়তে থাকে শিশিরের গন্ধে ভিজতে থাকা জোনাকির বিষ 

পথ বেসামাল ভাবে কালো নারীর পুরুষ 

আর পুরুষের অন্ধকার গহ্বর    

জীবন আর মরণের নিঝুম সমর্পণ  


পালিয়ে গিয়ে কোন লাভ নেই 

যে ঘটনার জন্য একটা চাঁদ বাঁচে উলঙ্গ 

একটা শূন্যমাঠ খুঁজে নিশ্চিত আলোর হরফ

অবিরাম ঘাম গন্ধে  ক্ষিদে পায় ভীষণ রক্তপাত   

তারই চোখের সম্মুখে মেলে ধরে রূপান্তর খবরের কাগজ  

কিছু ত্রান আর তার উপর বসে থাকে প্রজাপতির লোভ 


আক্রান্ত ক্লোরোফিলে শুধু হিম বাতাস বয়ে যায়  - 

  

এ জীবন মহাভারত  

           ***

ঢেউয়ের ভাঁজ ধরে হাঁটতে থাকে রোদ 

এ হাঁটায় মন খারাপের নোনা জল 

কাঁপতে কাঁপতে হয়ে যাচ্ছে পথ , সঙ্গে নীরব  

ঝলক সইতে সময় লাগে ঝিমলাগা সম্পর্কের ধ্বনি 

তবু তাকিয়ে থাকি  সুখ সুখ উচ্চারণে 

হাঁটার কথা ভাবতে ভাবতে আটকে যাই ধুলোর লিরিকে 

দেহতাপ ছায়াহীন ;  বিপন্ন ঈশ্বর  

সাগর জীবন ছুঁয়ে লিখে রাখি সকাল মহিমায় 

সীমানার বাইরে থাকে আলপথ, বটতলার ভাষা 

জলের অভ্যাসে ভাসে এ জীবন মহাভারত 

প্রচ্ছদের নীল নদী , অম্বার কাঁচুলি ওড়ে   

নিশ্বাসের বুকে বিঁধে তীর  


তবুও সমুদ্র নেই আমার শরশয্যার কাছে   


 

চোখের জল ফুরিয়ে যায়  

               ***

সূর্যের কাছে চোখ চাইতেই 

আমাকে দেখিয়ে দিল ঝলমলে মাঠ  

সেখানে পোকাকাটা শ্যামাঘাসের সাথে 

যৌবন পোহায় ধানগাছ 

                            ঘুরে বেড়ায় বাতাসের আদর  

আমি তাকিয়ে থাকি- আমার দাদু, কানাই জেঠা 

হরি কাকু , জগন্নাথ দা  তাদের পাওয়া চাষকথাকে 

ছড়িয়ে  দেয়  মাটির আশ্রয়ে        

যদিও চোখের জল ফুরিয়ে যায় ,  পাতালেরও -

মদনদাদুর মেয়ে মৌসুমী পিসি হারিয়ে গেছে গাজিয়াবাদে  

 

সমস্ত নার্ভের যন্ত্রনা কোমরে জড়িয়ে তিলোত্তমা 

বছরের পর বছর প্রদীপ জ্বালাচ্ছেন তুলসিতলায়  -      

  


স্বপ্ন মনে পড়ে 

       ***


আত্মরক্ষা দিয়ে ঘিরে রেখেছি অন্ধকার ,  মাঝে মাঝে 

বাতাস এসে উড়িয়ে দেয় পর্দা  :  পিঁপড়ে সারি,  কুনোব্যাঙের 

লাফ, ইঁদুর গর্তের গন্ধরা হঠাৎ মুক্ত হয়ে মুখোমুখি তাকায় - 

দেখেনি কোনোদিন ভিটে ভরাটের দৃশ্যগুলি - এখানে ওখানে 

ভাঙা দেয়াল আর ভোরের বাতিক 

ভেজা মেঘ অথবা ঠাকুমার আঁচল থেকে ভেসে আসা রূপকথার 

দীর্ঘশ্বাসগুলি  ঢুকে পড়ে  অন্ধকারে  


তখন স্বপ্ন মনে পড়ে 

প্রতিটি ছিদ্র দিয়ে সূর্য  প্রবেশ চায়  

সেই ছিদ্রের কাছাকাছি আমার চোখ  

আলোর দ্বিপ্রহরে পাতা আরও সবুজ আরও পাখিময় 


পতনকালের চুম্বন লোফালুফি খেলছে বাতাসে বাতাসে  -       



তিনি হাঁটতে থাকেন

         ***


আলোর সিঁড়িতে  যে বেহাগ বেজে ওঠে , সেখানেই চেতনার হাতছানি। ভোরের সামনে ক্ষীণ হয়ে আসে শোক। লজ্জ্বার চরাচর জুড়ে পথ ,  কালো কাঁপনের শিরায় শিরায় দীর্ঘতর সম্পর্কের শীত  - 

দূরত্ব জড়িয়ে যায়  রোদ্দুরের আয়োজনে  

অথচ তার পাশ দিয়ে নয়ানজুলির মাঠ , দুপা ছাড়িয়ে ছাতিমগাছের পাতায় ঢেকেছি মুখ,  ডাঁই করা নগ্নতায় নিভে যায় দীন আলাপের মোম ।  

তিনি হাঁটতে থাকেন অমৃতযোগের রাজপথ ধরে  -   


সমর্পণের  স্নিগ্ধতায় বিশ্বাস চিরদিনই ,  ভাসন্ত নৌকার দূরের টান - অজস্র  শালুকফুলের সে পথ  - ঋতুময় গাছের  সে ছায়ায়  আঁকতে থাকেন নিখাদ রোদ 

পাখির নরম বুকে  আমার মাটিগন্ধ ভরে আমাকেই উপহার দিলেন তিনি,  বীজের প্রাণে পুঁতে দিলেন হৃদয় ; জ্ঞান।      

ক্রমাগত গোমুখ কথায় তিনি ঢুকে যাচ্ছেন আমার  জ্যোৎস্নার আশ্রমে  - 



 *****  ***** 





Joydeb Biswas

Poet Joydeb Biswas studied Bengali literature. In 2015, at the age of 22, he published 'Sahitya Chetona' magazine. Currently two editions of the magazine are published. One is the online version and the other is the printed version. He is the founder and editor of the two editions. facebook twitter youtube instagram whatsapp

2 মন্তব্যসমূহ

  1. লক্ষীকান্ত মণ্ডলের কবিতায় আত্মযাপনের এক নিবিড় সংশ্লেষ গভীরভাবে স্পর্শ করে। যেন নিজের সঙ্গেই নিজেরই কথা বলা। ক্রিয়াগুলি প্রাত্যহিক জীবনের উন্মুখ বিভিন্ন পর্যায়কে তুলে আনে। কী সহজ অথচ কী দারুণ এক অনপনেয় বেদনায় মাথা নুয়ে আসে:
    "পালিয়ে গিয়ে কোন লাভ নেই

    যে ঘটনার জন্য একটা চাঁদ বাঁচে উলঙ্গ

    একটা শূন্যমাঠ খুঁজে নিশ্চিত আলোর হরফ

    অবিরাম ঘাম গন্ধে ক্ষিদে পায় ভীষণ রক্তপাত

    তারই চোখের সম্মুখে মেলে ধরে রূপান্তর খবরের কাগজ

    কিছু ত্রাণ আর তার উপর বসে থাকে প্রজাপতির লোভ" বারবার পড়তে ইচ্ছা হয়।

    উত্তরমুছুন
    উত্তরগুলি
    1. শ্রদ্ধা নিরন্তর ৷ আপনার আলোচনায় বারবার প্রানিত হই। ভালো থাকবেন ।

      মুছুন
নবীনতর পূর্বতন