ধা রা বা হি ক উ প ন্যা স
বাউল রাজা
• প্রদীপ গুপ্ত
দ্বিতীয় খন্ড ( ত্রয়োদশ পর্ব )
শুক্লা অষ্টমীর চাঁদ একটা নৌকো হয়ে যেন নোঙর ফেলেছে উঠোনের ছাতিমগাছটার ডালে। সারাটা অঞ্চল 'ম 'ম করছে ছাতিমফুলের মৌ মৌ সুবাসে।
এতোক্ষণ ধরে এই গন্ধটা নাকে আসেনি কেন? এটা তো আর ঠিক নয় যে, এই গন্ধটা হঠাৎ এসময়ই ইচ্ছে করে ছাতিম ছড়িয়ে দিলো! এরকমটা হয়। ধরো অনেকক্ষণ ধরে কোনো একটা অন্ধকার রাস্তা দিয়ে হেঁটে চলেছো, আচমকা কোনো বাঁক ঘুরতেই হয়তো একটা আঁধারভরা ঝোপে থোকা থোকা জোনাকিপোকা জ্বলছে আর নিবছে, তোমার তখন হঠাৎ করেই মনে হতে পারে -- বাপরে, কি জমাট বাঁধা অন্ধকার এখানে।
--" দ্যাকো পদীপদা, আসলে উপলব্দি লয় গো, কতাটা হচ্চে, সে উপলব্দিকে মনের অন্দরে নে সেটাকে কাটাচেঁড়া কইরে, একটা সিদ্দান্তে আসা। ঈশ্বর যেমুন আমাদের পঞ্চইন্দিয় দিয়েচেন, এমনটা আর কোনো ছিষ্টিকে দেননি গো। তারাও লিচ্চয় চামড়া দে ঠান্ডা -- গরম বুজতে পারে, নাক দে গন্দ শুঁকতে পারে, কানে শব্দ ঠাহর কত্তে পারে, জিব দে স্বাদও নিতে পারে, কিন্তু ব্যাস ওই পয্যন্তিই। সেসব ইন্দিয় দে কোনও কিচু বিচার কইরে নিজেকে উন্নত করার কাজে ব্যভার কত্তে পারে না গো। উপলব্দি আর অনুবব এ দু'শব্দের মদ্যে খুব সামান্য কিন্তু বিশাল এক পাত্থক্য আচে। এ জন্যিই মানুষ সব্ব ইন্দিয়ের উপরে গে নিজেকে বাহ্যজ্ঞানশূন্য অবস্তায় নিয়ে যেতি পারে। অন্য কোনও জীব সেটা পারে না।"
ছাতিম আর মহুয়া এ দুটো ফুলের ভেতর অনেক সাদৃশ্য থাকলেও পার্থক্যও আছে বিস্তর। দুটোর গন্ধেই মদিরতা আছে, কিন্তু মহুয়ার গন্ধে মাথা ধরিয়ে বমি করিয়ে ছাড়বে , কিন্তু ছাতিমের গন্ধে মন যেন কোথায় ভেসে চলে -- কোন দূরে যেন খুঁজে ফেরে ভালোবাসাকে। মনে যখন এসব ভাবছি, তখনই কানাইদা ফের একবার চমক লাগালো।
মন কী কথা ভাবছে সেসব যে কীভাবে পড়ে নিতে পারেন এই অন্ধ বাউল, সেটাও একটা পরম বিস্ময়।
--" রবিবাউল কি আর সাদে তার ধ্যানমন্দিরে ছাতিমগাছ বইসেচিলেন গো? এর সুবাস মনকে অনন্তের খপর দেয় গো পদীপদা। যে গানটা তুমি গাইলে, সে গানের বেতর যে অনন্তের আরাদনা আচে সে কি এতোই সাদারণ গো -- তইলে বাবতে গেলে তুমি পুরো অতলতলে তইলে যাবে গো। পেম হলো গে এক সুদার আদার। সে সুদাদারে কবি যেন ডুইবে যেতে চান। আমার আমি যদি নিজের কাচে নিজেই হাইরে যাই তাহলেই তো মিলন হপে গো, আমার আমির মদ্যেই তো লুইকে আচে মনের মানুষ! "
কোন কথাটাকে যে কোন নোঙরে বেধে অতলে ডুব দেন এনারা সে মনের সন্ধান পেতেই কি আমার উচাটন মন আমাকে টেনে এনেছে এখানে?
দাওয়ার থেকে উঠে ঘরে গিয়ে গায়ে পেঁচিয়ে রাখা কাঁথাটাকে খুলে গায়ে একটা ওভারকোট চাপিয়ে নিলাম। এই ওভারকোটটা আমার খুব প্রিয়। সি ই এস সির একজন নাইট ওয়াচম্যান জানাদা এই কোটটা আমাকে দিয়েছিলেন। ধুসর রঙের কম্বলকাপড়ে তৈরি এই কোটটা প্রায় পায়ের পাতা ছুঁয়ে ফেলে। আর অজস্র ছোটোবড়ো পকেট। পাজামার ওপর কোটটাকে গলিয়ে হাতে একটা পাঁচ সেলের টর্চ নিয়ে নিলাম। ধীর পায়ে এসে উঠোনে দাঁড়ালাম। আধো অন্ধকারে থোকা থোকা ছাতিমফুল ফুটে আছে। মনে পড়লো, কানাই বাউল কেঁদুলির মেলায় যেদিন হারিয়ে যাওয়া শিশু কৃষ্ণভামাকে পরম যত্নে বুকে ঠাঁই দিয়েছিলেন, সেই একইদিনে শান্তিনিকেতনের ছাতিমতলা থেকে কুড়িয়ে নিয়েছিলেন এক শিশু ছাতিমকে। দু'জনকেই এনে প্রতিষ্ঠা দিয়েছিলেন তার আখড়ায়। দুই শিশুই -- শিশু ছাতিম আর শিশু মানবী একইসাথে লালিত হয়েছে কানাইদার ঠাঁয়ে। একই বয়সী দুই শিশু দু'জনকে বরণ করে নিয়েছিলো মনের নিগড়ে।
ধীরে ধীরে আশ্রমের চৌহদ্দি ছাড়িয়ে পথে পা রাখলাম। বেশ লাগছে। ঠান্ডাটা বেশ জাঁকিয়েই পড়েছে। ডানহাতে ধরা টর্চের আলোয় বেশ পরিষ্কার দেখতে পাচ্ছি -- পথের দু'ধারের ঘাসে এখনই যেন রূপোলি শিশির বাসা বানাচ্ছে।
কী মনে হলো টর্চের আলোটাকে আকাশের দিকে তাক করলাম। আর তখনই একটা অপূর্ব সুন্দর জিনিস চোখে পড়লো। তীরের ফলার মতো ত্রিভুজাকৃতি দুধসাদা বলাকার সারি ঝকমক করতে করতে উড়ে যাচ্ছে। রাতেরবেলা ওদের এরকমভাবে আকাশ পাড়ি দেওয়ার দৃশ্য আমি আগে কোনও দিনও দেখিনি।
শীতের আকাশ বুঝি অন্য সময়ের থেকে বেশী নির্মল থাকে। সারাটা আকাশ জুড়ে তারারা কামিনীফুলের মতো ফুটে আছে।
---" তুমি কোনওদিনও আকাশগঙ্গা দেকেচো ঠাকুর? "
বাউলনি যে কখন আমার পাশে পাশে পথ হাঁটছে, খেয়াল করিনি। আমি একটুক্ষণ ওর দিকে তাকিয়ে রইলাম। রাত্রি এবং কৃষ্ণভামা -- দুইই কালো, কিন্তু কেউই নিকষ কালো নয়। বাউলনির সারাটা মুখ জুড়ে এখন যেন একটা খুশীমাখা শিশুর সারল্য।
আমি মাথা নেড়ে বললাম --" না তো, বইতে পড়েছি, কিন্তু চাক্ষুষ করিনি। কিন্তু তুমি কখন এলে বাউলদিদি? একা একা কিন্তু বেশ লাগছিলো হাঁটতে। "
--" ও, আমি এসে বুজি তোমায় বিরক্ত করলাম! বেশ, তুমি এগোও, আমি আসি। "
কথাটা বলেই বাউলনি পেছন ঘুরলো। আমি বাঁ হাতটা দিয়ে ওর হাতের কব্জিটাকে ধরলাম। সেও বুঝি এরকমটাই চাইছিলো। কপট রাগ দেখিয়ে বললো -- " দ্যাকো ঠাকুর, মোহিনী রাতে মোহিনী নারী সঙ্গ ভালো নয় গো। আমি না হয় বরং --"
--" কী যেন বলছিলে আকাশগঙ্গার কথা! কোথায় আছে দেখিয়ে দাও না গো বাউলদিদি --"
বাউলনি এক ঝটকায় আমার মুখটাকে ধরে ওর মুখের কাছে নিয়ে এলো, ডানহাতটাকে আকাশের দিকে তুলে বলে উঠলো --
-- " হুই যে দেকতেচো দুদসাদা রঙের একটা পতের মতো চলে গিয়েচে ওই জারুল গাচের মাতার ওপর দে --"
বাউলনির মুখনিঃসৃত বাতাস আমার নাসারন্ধ্রে এসে ঢুকছে। সেই বাতাসের বুকে যেন সেই ছাতিমফুলের মৌ মৌ মাতাল করা গন্ধ। সে অবস্থায় যে আমি কতকাল ছিলাম জানি না, সে এক লহমা ও হতে পারে, এক দন্ড, এক অনুপল, এক পল, এক মুহূর্ত অথবা এক যুগ -- সে আমি জানি না। দূর থেকে যেন একটা শব্দ ভেসে এলো -- " ঠাকুর সেই যে গানটা আচে -- আকাশভরা সূয্য তারা -- গানটা গাইবে গো ঠাকুর? "
( চলবে )