1 / 7
2 / 7
3 / 7
4 / 7
5 / 7
6 / 7
7 / 7

প্রদীপ গুপ্তের ধারাবাহিক উপন্যাস 'বাউল রাজা' | দ্বাদশ পর্ব | সাহিত্য চেতনা

    ধা রা বা হি ক     উ প ন্যা স    

বাউল রাজা 

• প্রদীপ গুপ্ত

       দ্বিতীয় খন্ড ( দ্বাদশ পর্ব )     

বাই চুপ করে বসে আছি, তুলসীতলার পিদিমের কাঁপা কাঁপা আলোয় দাওয়ার অন্ধকারটা বুঝি আরও ঘন হয়ে জমাট বেঁধেছে। কানাইদার মুখ আর দুটো স্থির আঁখিপাতা দেখে বেশ বোঝা যাচ্ছে যে, কানাইদা মাটির দাওয়ায় বসে থাকলেও অন্য কোথাও বিচরণ করছেন। বাউলনি যে কখন এসে ঘরের চৌকাঠে এসে বসেছে, কে জানে? আলো যতোদূরেই জ্বলুক না কেন শরীর পেলে ছায়া ফেলবেই। বারান্দার দেওয়ালে কানাইদার শরীরের ছায়াটাও সমানে কেঁপেই যাচ্ছে। একটা আধিভৌতিক পরিবেশ। 


--" বুজলে গো পদীপদাদা, এই মিলন কথাটা সাদারণভাবে ভাবলে একরকম, আর তলিয়ে ভাবলে এর কোনও তল খুঁজে পাওয়া যাবে নে। "


ফের একটা নীরবতা। বাটির মুড়িমাখা বাটিতেই পড়ে আছে। মুখে দিচ্ছিনা এটা ভেবে, সে মুড়ি চিবোনোর শব্দে যদি কানাইদার মার্গবিচরণে সামান্য হলেও ব্যাঘাত ঘটে। 


--" মনের মানুষ, এই কতাটার মধ্যে যে কী অনন্ত এক খোঁজ লুইকে রয়েচে, সেটা কিন্তু তুমি আমি বুজতেও পারবো না গো পদীপদা। মনের মানুষ কতাটা শুইনলে তুমি আমি ভাবতে বইসপো যে বোদয় সেই পেমাস্পদর কতা, যারে দেকলি পরে মন অপূব্ব এক আনন্দের বাজারের খপর পায়। ক'জন ভাবতে পারে যে, মানুষ আর অন্য কাউকেই না নিজেরেই নিজে সবচে বেশী ভালোবাসে। নিজের আনন্দ যকন এক সচ্চিদানন্দের খপর পায়, তোমার মন তোমার আত্মা যকন এই পিথিবি ছেইড়ে, চন্দ সূয্য, গহ তারা ছেইড়ে, মহাশূন্যে সেই আনন্দপুরুষের, পরময়াত্মার খোঁজ পায়, তকনই মনের মানুষ এসে বসত করে মনের মাজারে।"

কানাইদা যেন কথা বলছে না। শুধু ঠোঁট দুটো নড়ে যাচ্ছে, আর কোন সুদূর থেকে যেন শব্দগুলো কথার মতো ভেসে আসছে। 

--" সেটাই হলো মিলন গো পদীপদা, মনের মানুষের সাথে মিলন। সে মিলনে নোকনজ্জার অবকাশ কই গো! সে তো তোমার সাতে তোমারই মিলন। সে বড়ো অপূব্ব বিষয় গো। এক জ্যোতিম্ময় পুরুষ বা নারী মিলিত হচ্ছে নিজেরই আরেক পরমজ্যোতির সাতে। একেনে কোনও শরীর নেই গো, শুদুই মন, শুদুই আনন্দ, শুদুই আলো। এ মিলনে মেলার জন্যিই না সমস্ত সাদকেরা সাদনায় মাতেন। "

এ কি কথা কইছেন অন্ধ একজন বাউল, চক্ষুহীন একজন মানুষ আলোর দেখা পাচ্ছেন। দেখা না পান, উপলব্ধিতে, চেতনায় কোন মার্গে বিচরণ করছেন, সে কথা কে বুঝবে? আচ্ছা -- নদী কি আমায় এই মিলনের কথাই বলেছিলো? একই শরীরে পুরুষ এবং নারী?


মনের কথাটা যেন চুম্বকের মতো করে টেনে নিলো কানাই বাউল। 

--" দ্যাকো পদীপদা, তোমার মন যকন কোনো শরীল আশ্যিত পেম চাইবে, তকন সে পেমে হাজারো সমিস্যে। সবচাইতে বড় সমিস্যে হচ্চে গে তিপ্তি পাওয়া বা দেওয়া। একটা শরীল যকন তিপ্তিতে ভরপুর, তকন হয়তো অন্য শরীল মরুভূমির মতো শুইকে রয়েচে। সে পেম দু'দিনের তরে গো। কিন্তু যে পেমে শরীলের কোনো চাহিদার পয়োজন নাই, নিজের শরীলের সাতে নিজের শরীলের মিলন, আসলে সেকেনে তো কোনো শরীলই নেই গো, আনন্দের আদার। আনন্দের সাতে পরমানন্দের মিলন, আলোর সাতে আলোর, সুরের সাতে সুরের গো, সুগন্দের সাতে সুগন্দের। এটা দেকতে গেলে স্বমেহন, স্বরতি। একেনে পুরুষ অঙ্গে নারী আর নারী অঙ্গে পুরুষ একই সাতে একই অঙ্গে অঙ্গীভূত গো, একাঙ্গী। কাজেই কোনও আপশোষ বা অতিপ্তির কোনও সুযোগই নেই গো, এ মিলন যে মনের মানুষের সাতে মিলন, যে মানুষ নিজের মনেই যাপন করেন। এ পেম মনকে ভিত্তি করে গড়ে ওটে, শরীলকে ভিত্তি করে লয় গো।"


ওই আলো আঁধারিয়ায় কানাইদার মুখে যেন এক আনন্দের আভা পিছলে যাচ্ছে। রাতেরবেলায় বৃষ্টিস্নাত খেজুর পাতায় যেভাবে চাঁদের আলো পিছলে যায়, সেভাবেই। ধীরেধীরে তিনি যেন নীচে নেমে আসছেন। 

--" তুমি কি আমার কতা কিচু বুজতে পারলে গো পদীপদা? নদীও বোদয় এ কতাগুলোই তোমায় বইলেচিলো। কতা অচ্চে সরিতসাগর গো পদীপদা, একবার বাঁদ ভাইঙলে যেমন জলের তোড়কে আর রোকা যায়না, কতাও তেমনিই গো। একবার শুরু করলে আর --"

-- " বলি একটু চা কইরে দেপো? গলা ভিজোবে নাকি গো গোঁসাই? আমি তো চিন্তায় পড়ে গেচিলাম, ভাবতিচিলাম আজ না জানি নাইমতে রাত গইড়ে যায়। বুজলে গো ঠাকুর, এজন্যিই না বইলেচিলাম যে, পেরাইমারি ইস্কুলের মাস্টারের সাদ্যি কী উঁচু ইস্কুলের পড়া শেকানোর? "

--" আরে,দেকো দেকিনি, ভাইবলাম আজ সন্দেয় পদীপদাকে নিয়ে একটু দাদুর ঠাঁয়ে যাপো, কিন্তুক কোতা তেকে যে সুময় কেটে গেলো বুজতেই পারলুম না -"

--" এ সব অনত্থ হলো গে সেই গানটার জন্যি। ওরা কারা, লালন সাঁইয়ের গান গাইচিলো? "

আমার মনে তখন রবীন্দ্রনাথ গুনগুন করা শুরু করেছেন। যে কোনও সময় বিপদ ঘটতে পারে। মন ছেড়ে সুর এসে কখন যে এই দাওয়ায় আছড়ে পড়বে, বুঝতে পারছি না। 

--" তারচে' আমি একটা কতা বলি? আজ আর দাদুর আকড়ায় গে কাজ নেই। মনটা কুব ঠাকুরের গলায় গান শোনার জন্য অদীর হয়েচে গো গোঁসাই। "

-" সেই সবচে ভালো হপে গো পদীপদাদা, একটা গান ধরো কেনে গো, রাজা বাউলের গান, আমার পরাণের রবিবাউলের -- "


--" আরও আলো আরও আলো

এই নয়নে প্রভু ঢালো

সুরে সুরে বাঁশি পুরে

তুমি আরও আরও আরও দাও তান

মোরে আরও আরও আরও দাও তান। 


আরও বেদনা আরও বেদনা 

প্রভু দাও মোরে আরও চেতনা 

দ্বার ছুটায়ে বাধা টুটায়ে

মোরে করো ত্রাণ মোরে করো ত্রাণ। 


আরও প্রেমে আরও প্রেমে 

মোর আমি ডুবে যাক নেমে

সুধাধারে আপনারে

তুমি আরও আরও আরও করো দান।


প্রাণ ভরিয়ে তৃষা হরিয়ে

মোরে আরও আরও আরও দাও প্রাণ। "


--" ঠাকুর, বাউলরাজার গানেও যেন সে ইঙ্গিতই পেলাম গো। আরও পেমে আরও পেমে - মোর আমি ডুবে যাক নেমে, সুদাদারে আপনারে, তুমি আরও আরও আরও করো দান! কতাগুলোর মানে কী গো গোঁসাই? "


( চলবে )

Joydeb Biswas

Poet Joydeb Biswas studied Bengali literature. In 2015, at the age of 22, he published 'Sahitya Chetona' magazine. Currently two editions of the magazine are published. One is the online version and the other is the printed version. He is the founder and editor of the two editions. facebook twitter youtube instagram whatsapp

2 মন্তব্যসমূহ

নবীনতর পূর্বতন