ধা রা বা হি ক উ প ন্যা স
বাউল রাজা
• প্রদীপ গুপ্ত
দ্বিতীয় খন্ড ( দশম পর্ব )
আমি বাউলনির কথার উত্তর না দিয়ে চুপ করে হেঁটে চললাম। সূর্য ততোক্ষণে পথচলতি মানুষজনের শরীরের পেছনে এক সুদীর্ঘ ছায়া ফেলছে।
--" আজ তুমি মাধুকরী করতে বেরোবে না বাউলদিদি? "
--" কী পশ্নের কী উত্তর! তুমি কি কাল রাতে সত্যিই বুজতে পারোনি যে, আমি সব্বোক্ষণ তোমার সাতে সাতে চিলাম? "
বাউলনি এমনভাবে আমার দিকে তাকিয়ে আছে যে, এ যেন তার মরণবাঁচনের বিষয়। আমি পূর্ণ দৃষ্টিতে ওর দিকে চাইলাম।
--" তুমি তো একা নও, সাথে কানাইদাও তো ছিলেন। "
--" সেকানেই তো হয়েচে বিপত। গোঁসাই ভুল কইরে ক্ষণেকের তরে চিলেন বটে। কিন্তু সে তো কয়েক মুহূর্ত। তারপরই গোঁসাই আমার হাত ধইরে ছিটকে বেইরে গে আমারে বললেন -- দ্যাখ ভামী, গৌরক্ষ্যাপা যেমনি ভদ্দর তেমনি গোঁয়ারগোবিন্দ। আমি না হয় ওর সাতেই থাকি, তুই না হয় বরং --"
--" আচ্ছা,একটা কথা জিজ্ঞাসা করবো? তোমরা দু'জন যেরকমভাবে এসে আমার দু'পাশে বসেছিলে, তুমি কেন পরে এসে সেভাবে বসলে না? শুধু ছায়ার মতো ঘুরেফিরে রইলে? "
--" ঠাকুর, দ্যাকো, গোঁসাই ছাড়া আমি বা আমাকে ছাড়া গোঁসাই অনেকটা সেই টচবাতির মতো। আমি বাতি হলি গোঁসাই ব্যাটারি অতবা আমি ব্যাটারি হলি পর গোঁসাই হলো গে বাতি। দু'জনে একঠাঁই না হলি পর আলো জ্বইলবে না গো। "
এতো সুন্দর জলবৎ তরলং করে বোঝায় বাউলনি যে, বোঝার আর কিছু বাকি থাকে না।
--" দ্যাকো, এ জিনিসটা অনেকটা তোমাদের সংসারীদের মতো। কেউ কামাই করে আনলো তো অন্যজনা রান্নাগরের দায় নিলো। কিন্তু নদী আজ তোমারে ---"
বলেই কৃষ্ণভামা জিভ কাটলো।
--" এই দ্যাকো, কতায় কতায় -- তোমার সাতে কতা বলতি গেলে আমার যে কী হয়, পেটের কতা আর পেটে তাকে না। "
--" যে কথাটা পেটের আশ্রয় ছেড়ে বেরিয়ে আসতে চাইছে,তাকে মুক্তি দেওয়াই ভালো। নইলে কখনও কখনও বিপদ হয়ে যায়। "
--" দ্যাকো ঠাকুর, যে ম্যাস্টর পেরাইমারি ইস্কুলে পড়ান, তাকে দে উঁচু ইসকুলের পড়ানো হয় না। যে কতাটা,মুক ফুটে বইলতে গেচিলাম, সে বিষয়ে আমি অতটা -- গোঁসাই --"
কথা বলতে বলতে আমরা কানাইদার আখড়ায় চলে এসেছি। দেড় বছর আগে দেখা ঘরটা এতোটুকুও বদলায় নি। খড়ের চালাটা আরেকটা বর্ষা শরীর পেতে নিয়েছে, সেও বুঝি এই বাউল যুগলের প্রেমে পড়েছে। আর সে কারণেই সমস্ত ঝড়বাদলের অত্যাচার এভাবে সহ্য করে যাচ্ছে।
দাওয়ার মাথার চালাটা থেকে গোছা গোছা খড় আবর্জনার মতো ঝুলে আছে।
দাওয়ায় মাদুর বিছোতে বিছোতে বাউলনি আমাকে আমার ঝোলাটা ধরিয়ে দিয়ে গামছা বের করতে বলে কুয়োতলায় গিয়ে জল তুলতে শুরু করলো।
--" দেরি কোরো না গো ঠাকুর, হাতমুখটা ধুয়ে নাও, আমাকে আবার মাধুকরীতে বেরোতে হপে। বেলা অনেক হয়ে গেলো। "
হাতে গামছা নিয়ে কুয়োতলায় যেতেই সেই কাল রাতের গন্ধটা পেলাম। সারাটা এলাকা জুড়ে যেন সেই গতকাল রাতে পাওয়া সদ্য ছেঁড়া কাঁচা আমের বোঁটায় লেগে থাকা টাটকা কষের মতো একটা গন্ধ ছড়িয়ে আছে। বাউলনি একটু মুচকি হেসে দাওয়ার দিকে দৌড় লাগালো। বুঝলাম এ আর কিছুই নয়, এ ও এক ধরণের কুহক। কাল রাতের ট্রেনযাত্রার সময় ও যে আমার সাথে সাথেই ছিলো, তার প্রমাণ রেখে গেলো।
গা হাত পা মুছে, দাওয়ায় উঠে ঝোলা থেকে পাজামা বের করলাম। কিন্তু মুশকিল হলো পাজামাটা পড়বো কোথায়? আর একটা বিষয়, আসার সময়ে আমরা দু'জন কথাবার্তায় এতো মশগুল ছিলাম যে কানাইদা যে আমাদের সাথে একসাথে ফেরেন নি, সেটা আমার নজরেই পড়েনি।
কৃষ্ণভামা বেরিয়ে যাওয়ার মিনিট পাঁচেক বাদে কানাইদা আর ছুটকি ( ওদের কাছে ছোট্টোবেলা থেকে থাকা একটা বাচ্চা মেয়ে) একসাথে এসে হাজির হলো। কানাইদার হাতে একটা পলিব্যাগ। সেই পলিব্যাগটা ছুটকির হাতে দিয়ে কানাইদা দাওয়ায় এসে উঠলেন। কানাইদার দু'চোখে লেপ্টে থাকা আঁখি পল্লবে একটা ব্যগ্রতার ছায়া দেখলাম। আমি ইতিমধ্যেই গামছা বেড় দিয়ে পাজামাটা পরে নিয়েছি।
--" ঘরে একটুও চা চিনি চিলো না গো পদীপদা। আর ছুটকিটাকেও কাল আমাদের এক পড়শী আচ্ছমে রেকে গেচিলাম। তাই তোমাদের সাতে একসাতে ফিরতে পারিনি গো। বলি রাগ কোরোনি গো, গতবার তোমার দেওয়া টাকাটা দে চাল ছাইতে পারি নি কো। বেচারা চালাটা আমার গেলো জন্মের এক মায়ের পেটের ভাই চিলো বোদয়। তাই --"
এই বুঝি শুরু হলো ফের, মনের কথা বুঝে নেওয়ার খেলা। আমি এই দেড় বছর থট রিডিং নিয়ে বাঘা বাঘা লেখকের বই পড়েছি, কিন্তু এদের সাথে কারো বিশ্লেষণের কোনোরকম মিল আমি খুঁজে পাই নি।
- " আমি ছুটকিরে বইলে রেকেচি, কাল সারারাত ধরে তোমার খুব ধকল গেচে, ও ভেতরঘরে বিচানা পেইতে দেবে খন, তুমি একটু গইড়ে নিও।"
--" একটা কথা বলবে কানাইদা, আমি যে আসছি সেটাই বা তুমি বুঝলে কীভাবে আর আমি যে গুরুপদবাবার --"
কানাইদা হো হো করে হেসে উঠলেন, তার সারা শরীর জুড়ে, দু'টো অন্ধ চোখ জুড়ে, একটা প্রবল হাসির দমক উঠলো।
--" আচ্চা, তুমি আমায় একটা কতা কও দেকি পদীপদাদা, কোতায় কোন বনের কোণায় মদু বক্কে নে কোন পুষ্পটা পাপড়ি মেললো, মধুকর তার খোঁজ পায় কীভাবে? অতবা ধরো দিকিনি, আকাশ ঝেইপে বিষ্টি নেমে মাটির নীচে তাদের বাসা ধ্বংস কইরে দেবে, পিঁপড়েরাই বা সে খপর পায় কোত্তেকে? সবটাই অন্তরের টান গো, আত্মার পতি আত্মার ভালোবাসা। তবে একটা কতা অস্বীকার করপো না, নদী আমায় খপর দিয়েচিলো যে তুমি গুরুপদবাবার ওকেনে উটেচিলে। "
--" আচ্ছা কানাইদা, এই নদী কীভাবে --"
--" দেকো পদীপদাদা, বস্তুতে যে জিনিসটাকে ঠাহর করা যায় না, সেকেন তেকেই ভাবের উদয় হয়। ধরো তুমি কি তোমার মা বাপের স্নেহকে ছুঁয়ে দেখতি পারো? পারো না, কিন্তু অনুভব করতে পারো। তাই না? এই যে ধরো না কেনে, আজকে নদী তোমারে -- থাক সে কতা পরে হপে। তুমি আগে চা খেয়ে একটু গইড়ে নাও তো দেকি --"
ইতিমধ্যেই ছুটকি একটা এনামেলের গ্লাসের এক গ্লাস চা, একঘটি জল আর গোটাকতক বিস্কুট সামনে রেখে বলে উঠলো --
" ঘরে বিচানা কইরে দেচি গো ঠাকুর, শুয়ে নিও।"
( চলবে )