1 / 7
2 / 7
3 / 7
4 / 7
5 / 7
6 / 7
7 / 7

প্রদীপ গুপ্তের ধারাবাহিক উপন্যাস 'বাউল রাজা' | একাদশ পর্ব | সাহিত্য চেতনা

    ধা রা বা হি ক     উ প ন্যা স    

 বাউল রাজা 

• প্রদীপ গুপ্ত

    দ্বিতীয় খন্ড  ( একাদশ পর্ব )    

দুপুরবেলা কি আমি কিছু খাইনি, না খেয়েছিলাম, মনে করতে পারছি না। শাঁখের ফুঁ এর আওয়াজে ঘুম ভাঙলো। কুলুঙ্গিতে একটা কেরোসিন তেলের লম্ফ, যতোটা আলো দিচ্ছে তার থেকে ধোঁয়া ছড়াচ্ছে বেশী। বাইরে, সম্ভবত বারান্দায়, একটা খমকের টুংটাং আওয়াজ কানে আসছে। তুলসিতলায় প্রদীপটাকে রেখে কৃষ্ণভামা ঘরে এসে কুলুঙ্গির সামনে দাঁড়িয়ে আঁচল গলায় দিয়ে প্রণাম করছে। 

এই সময়টাতে প্রত্যেকটি বাঙালি নারীরই একটাই রূপ। প্রণাম সেরে কৃষ্ণভামা আমার দিকে চাইলো। 

সে দৃষ্টিতে যেন বর্ষার জল থৈথৈ পুস্করিণীর গভীরতা। 

--" বাব্বাঃ, কি ঘুম কি ঘুম, এ যেন একেবারে কুম্ভকন্ন নিদ্দা গিয়েচেন। গোঁসাই কতো দাক্কাদাক্কি করলেন, তাও -- "

--" ওই জন্যই তো ভাঙেনি, "

আমি মুচকি হাসলাম। 

--" মানে বুইজে বলো। "

--" কানাইদা ধাক্কা না মেরে যদি তুমি --"

--" সন্দেবেলা বাজে কতা বলতি নেই। নাও, উটে বোসো দিকিনি, চা খাবে, নাকি ভাত? "

-- " আচ্ছা বাউলদিদি, একটা কথা বলবে? বাউলরা তো কোনো ভগবান মানে না, তাহলে তুমি কেন --"

--" সন্দেবেলা পিদিম জ্বাললাম না গড় করলাম, কোনটা? "

-- " ধরো না কেন দুটোই --"

-- " তুলসিতলায় পিদিম জ্বাললাম এজন্যি যে, তেনারা যেন এসে উপদ্দব শুরু না কইরে দেন। সন্দেবেলাতেই তো তেনাদের চারণ করার সুময়, আর গড় করি মা তারাকে আর বামদেবকে।  যার রাজত্বে বাস, তারে না মানলি পরে ঘোর সব্বনাশ।"


--" আমি তাইতে পাগল হলেম না

তেমন একজন পাগল পেলাম না

দেখি নকল পাগল সকল দেশে

আসল পাগল কয়জনা --


কেউ পাগল, পিরিতের আশে

কেউ পাগল বিষয়লালসে

কেউ ধনের - জনের - যশের - মানের

পাগল সব দেশে।

দেখি নানা রঙের নানা ঢঙের

কে করে তার ঠিকানা --

দেখি নকল পাগল সকল দেশে ---"


কানাইদা গান ধরেছেন। আমি দেখেছি, বাউলসঙ্গীত একটু আড়ালে শুনলে মিষ্টি বেশী লাগে। গায়ের কাঁথাটা আবার গায়ে জড়িয়ে নিয়ে আধশোয়া হলাম।

কার্তিক শেষ হয়ে গেছে। এখন পৌষের প্রথম দিক। কলকাতার শীতের ঠান্ডার সাথে এখানকার ঠান্ডার অনেক তারতম্য আছে। ছুটকি এসে সেই এনামেলের গ্লাস আর একটা কলাইকরা থালায়, বেশ তেল পেঁয়াজ দিয়ে মাখা মুড়ি চানাচুর রেখে দিয়ে গেলো। আমি দুটো পাত্তর নিয়েই কাঁথা মুড়ি দিয়ে বারান্দায় এসে বসলাম। 

--" কি গো পদীপদাদা, ঘুইমে তো এক্কেরে কাদা হইয়ে গেচিলে গো। তা অবিশ্যি হবে না ই বা কেন? সারারাত টেরেনে চেইপে ফের --"

আমি বেশ আমেজ করে গালভরা মুড়ি চিবোচ্ছি। এখানকার ঢেকিছাঁটা চালে ঘরে বালির খোলায় ভাজা বেশ লাল ডুমো ডুমো মুড়ির স্বাদই আলাদা।

--" আচ্ছা, তুমি যে গানটা গাইছিলে --"

--" পাণকেষ্ট বাউলের বাঁধা গান গো -- কি কতাটাই না বইলেচে বলো দিকিনি। পাগলে পাগলে ভরা দুনিয়া -- এমনকি তুমি শিবের কতাই ভাবো না কেনে, ঘরে মা অন্নপূন্না থাকতি তিনি কিনা পরের দোরে ভিক্কা কইরে -"

আমার মনে কেমন করে হঠাৎ একটা ভাব এলো। কথাটা তো একশো শতাংশ খাঁটি। কোথায় ঠিকেদারি করে ভালোই ছিলাম, কিন্তু এখন আমি নাকি নদীর সাথেও --

--" তুমি কাল শুদিয়েচিলে -- নদী কতা কয় কীভাবে? আচ্চা, ধরো পাহাড়ের থে পাতরের টুকরোগুলি, তোমরা যাকে নুড়ি বলো গো, নদীর বুকের মদ্যে দিয়ে গইড়ে গইড়ে যায়, তকন সেই গড়ানো পাতরগুলির তেকে এক অপূব্ব টুংটাং গানের মতো আওয়াজ বের হয় গো। যাদের কান আচে, তারা সেই গান শুনতি পান। "

এই দেখো, ফের মনের কথা টেনে নিয়ে -- এটাও কি সাধনালব্ধ? 

--" সে গানের কথা না হয় বুঝলাম। কিন্তু কথা? আর -- উপলব্ধি --!"

--" দেকো পদীপদাদা, এই যে দরোনা কেনে, কাল তুমি নদীর পাড়ে বসলে, এতো গল্প কইরলে, সোহাগভরে চাঁপাফুল পইরে দিলে নদীর বেণীতে, এসবই হলো গে একটা উপলব্দির ফল --"

--" কী রকম? "

--" দরো না কেনে, একজন মানুষ যিনি পালাগান  লেকেন, কী দরো গল্পই লেকেন, তিনি যতো চরিত্তিরের চালচিত্তির আঁকেন, সবাই কি তার চেনা না জানা, বলো দিকি? তার উপলব্দির গভীরে ডুব দে তিনি সেইসব মণিমুক্তা তুলে নে আসেন। ঠিক সেরকমটাই গো পদীপদা। "

একজন অজ্ঞ, মূর্খ, অশিক্ষিত মানুষ কতো সহজেই না সাঁতরে বেড়াচ্ছেন জ্ঞানসাগরে। এতো সহজ সরল ভাবে কতো গভীর ভাবনার বুদবুদগুলো উঠে আসছে তাঁর ওষ্ঠপ্রান্তে। 

--" সে নাহয় বুঝলাম গো বাউল, কিন্তু গতকাল যে গূঢ়তত্ত্বের ঝাঁপি খুলে দিলো আমার সামনে, যে তত্ত্বের কথা হয়তো অনেক বাউলই জানেন না, সেই একাঙ্গীভূত মিলনের কথাগুলোও কী --"

--" দ্যাকো পদীপদা, এ কতা হয়তো তুমি বুজলেও মানতে চাইপে না -- "


--" মেঘের বিদ্যুৎ মেঘে যেমন 

লুকালে না পায় অন্বেষণ 

কালারে হারায়ে তেমন

ঐ রূপ হেরি এ দর্পণে.. 

ও আমার মনের মানুষের সনে

আমার মনের মানুষের সনে

মিলন হবে কতদিনে... 


ওই রূপ যখন স্মরণ হয়

থাকে না লোকলজ্জার ভয়

লালন ফকির ভেবে বলে সদাই

এ প্রেম যে করে সে জানে... 

আমার মনের মানুষের সনে.. "


কে গাইছে গানটা? অন্ধকারের বুক থেকে এখনই বুঝি এ গান ভেসে আসার সময় হলো... 


( চলবে )

Joydeb Biswas

Poet Joydeb Biswas studied Bengali literature. In 2015, at the age of 22, he published 'Sahitya Chetona' magazine. Currently two editions of the magazine are published. One is the online version and the other is the printed version. He is the founder and editor of the two editions. facebook twitter youtube instagram whatsapp

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

নবীনতর পূর্বতন