ধা রা বা হি ক উ প ন্যা স
বাউল রাজা
• প্রদীপ গুপ্ত
দ্বিতীয় খন্ড ( নবম পর্ব )
আমি কিছুক্ষণ চোখ বন্ধ করে বসে রইলাম। রিক্সাওয়ালা কী ভাবছে কে জানে। ভাবছে বুঝি আমার শরীর খারাপ করেছে। কিন্তু আমার মনে যে তখনও এক স্বর্গীয় আনন্দের রেশ বয়ে চলেছে, সেটা সে বুঝবে কী করে?
চোখ খুললে দেখি, নদী নিস্তরঙ্গ ভাবে বয়ে চলেছে। আর আমার কোলে লুটোপুটি খাচ্ছে একটা স্বর্ণচাঁপা। আমি রিক্সাচালক ভাইয়ের দিকে চাইলাম।
--" আপনার শরীলটো ঠিক আছে না বাবু? তা ইখাইনকে একলা বইস্যে আছ্যেন কেনে গ? বাউলের ঠাঁয়ে চলেন কেনে --"
আমি হাত নেড়ে ইশারায় ওকে চলে যেতে বললাম। মুখ থেকে একটা শব্দও বের করতে ইচ্ছে করছে না। মন এতোটাই আবিষ্ট হয়ে আছে। ও কী বুঝলো কে জানে, উঠে গিয়ে রিক্সার প্যাডেলে পা দিলো।
নদীর বুক ফের চঞ্চল হলো। এই চঞ্চলতা মানে প্রগলভতা নয়। যেন একটু বন্ধুসুলভ চঞ্চলতা।
--" তোমাকে একেনে বসতে বলেচিলাম কেনে জানো ঠাকুর? "
--" অন্য কোনও কারণে, তা জানি না, তবে তুমি আমায় যে শিক্ষা দিলে, সে শিক্ষা যে একজন প্রকৃত সাধন গুরু ছাড়া অন্য কেউ দিতে পারেন না, সে বিষয়ে আমি নিশ্চিত। "
--" সেটা তো কতা উটলো বইলে। আসলে বসতে বলেছিলাম এজন্য যে তকন তুমি কানাইক্ষ্যাপার ঘরে গে ওদের পেতে না বইলে। "
--" মানে? "
--" মানে ওরা সেকেনে চিলেন না গো। কাল বিকেলে দু'জন মিলে কঙ্কালিতলা গৌরক্ষ্যাপার আকরায় গেচিলেন। তুমি আসতিচো সেটা ওরা -- যাকগে,সেটা ওদের কাচ তেকেই শুনপে খন। ওই ওরা এসে পড়লো বলে। এট্টা কতা বলি ঠাকুর, তোমার কোলে যে চাঁপাফুলটা তোমার সোহাগ নিচ্চে, তার ওপরে কিন্তু আমার খুব লোভ হতিচে গো। ওটা যদি তুমি আমার চুলে পইরে দাও --"
--" তোমার চুলে পড়াবো? এ কেমন আশ্চর্য কথা কও তুমি নদী? তোমার চুল আমি পাবো কোথায়? "
--" এই নাও, আমার বেণী তোমার কোলে দিচ্চি গো, তুমি পইরে দাও -- দেরি করো না গো ঠাকুর -- দাও একুনি। "
বলতে না বলতেই বাঁধের ভেতর ঢেউ এসে ধাক্কা মারলে যেরকম জলকণিকাচূর্ণ বাঁধ অতিক্রম করে যায়, সেরকম কিছু চূর্ণিত জল অলকের রূপ ধরে আমার কোলে এসে আছড়ে পড়লো। কিছু বুঝে ওঠার আগেই আমিও কেমন যাদুআবিষ্টের মতো সেই জলচূর্ণে আমার কোলে থাকা চাঁপাফুলটাকে অঞ্জলির মতো করে দান করলাম।
--" এই দেহেতে আছে কান্ডারী
পুরুষ নারী সঙ্গে নিয়ে রিপু পার করি
আবার মায়ার তুফান -- ঝড় থামে না
নাথ বিন্দু কেন রসনা!
কেউ আমারে ভিতর থেকে
চিনতে পারল না।
আমি বাউল সেজে ছদ্মবেশে
খুঁজি মনের মানুষখানা।
ওরে মন -- কেউ আমারে ভিতর থেকে
চিনতে পারলো না। "
দূর থেকে একজোড়া মানুষ মনের আনন্দে নাচতে নাচতে এগিয়ে আসছে। ক্রমে শরীর দুটো প্রকট হলো। চোখে মুখে আনন্দের কি উজ্জ্বল দ্যুতি! সারা শরীর যেন গমকে গমকে উথলে উঠছে কোন অনির্বচনীয় ঐশ্বরিক আনন্দে। কানাইদা আর কৃষ্ণভামা আমার কাছে এসে দাঁড়িয়ে পড়লো। দু'জনেই যেন একইসাথে কথা বলবে আমার সাথে -- কানাইদা বলে উঠলেন --
--" পদীপদাদা আমি কাল রাতের বেলা --"
বাউলনি বলে উঠলো --
--" ঠাকুর কাল রাতে তো আমি তোমার --"
আমি অবাক হয়ে ওদের দিকে তাকিয়ে রইলাম। ঠিক যেন দুটো শিশু তাদের কাছের কোনো মানুষের দেখা পেয়েছে।
বাউলনির কাঁধে আমার ঝোলাটা ঝুলছে। তার মানে, ওরা গুরুপদবাবার আশ্রম থেকে আসছে, সেটা বুঝতে পারলাম। আমি নদীর পৈঠার আসন ছেড়ে উঠে দাঁড়িয়ে ওদের কাছে এগিয়ে গেলাম। ব্যাগটা নেওয়ার জন্য বাউলনির দিকে হাত বাড়াতেই বাউলনি ফোঁস করে উঠলো।
--" এ ঝোলার দিকি হাত বাইড়ো না কো ঠাকুর। এ ঝোলার ওপর তোমার কোনো অদিকার নেই। এটার মালিক একন আমি। দাদুর কাচ তেকে চেইয়ে নে এয়েচি। "
কানাইদা দেখি মুচকি মুচকি হাসি হাসছেন। আসলে এই খুনসুটিটুকু উপভোগ করছেন। আমিও তেমনি করেই উত্তর দিলাম --
-- " পরের সর্বস্বকে যারা নিজের বলে দাবী করেন, তাদের স্বভাব সুবিধের হয় না। কি বলো কানাইদা? "
কানাইদা তেমনি স্মিত হাস্যেই বলে উঠলেন -" তোমাদের দু'জনের রাগ অনুরাগের দড়ি টানাটানিতে আবার আমায় জড়ানো কেন গো পদীপদা, আমি এ ভাবনগরের বাসিন্দে হবার যোগ্য নই গো -"
--" তা হ্যাঁরে কিষ্ণভামা, নোকটাকে কি পতেই দাঁড় কইরে রাকপি, না কি ঘরের পানে নে যাবি বল দিনি? "
আমরা তিনজন হাঁটা লাগালাম। কৃষ্ণভামাকে পেয়ে নদীর কথা ভুলেই গেছিলাম। বাউলনিই সে ভুল ভাঙালো।
--" আসি লো সই। এই যে এতোক্কণ দরে মানুষটাকে সঙ্গ দিলি, সে কতা আমি ভুলবো না রে --"
আমিও নদীর দিকে তাকিয়ে হাত নেড়ে বিদায় চাইলাম। কানাইদা আগে আগে চলেছেন। আমরা পেছন পেছন। হঠাৎ বাউলনি আমার হাত ধরলো।
--" কাল সব্বোক্ষণ যে তোমার সাতে সাতে চিলাম, সেটা কী বুজেচো ঠাকুর? "
( চলবে )