ধা রা বা হি ক উ প ন্যা স
বাউল রাজা
• প্রদীপ গুপ্ত
দ্বিতীয় খন্ড ( অষ্টাদশ পর্ব )
দু'হাত দিয়ে আমার ডান বাহুকে জাপটে ধরে আছে বাউলনি। ওর সারা শরীরের কাঁপুনি পরিষ্কার বুঝতে পারছি। বড় বড় শ্বাস বেরিয়ে আসছে ওর নাকমুখ থেকে, আর থরথর করে কাঁপছে। যে মানুষটা রাত বিরেতে নেউলের মতো নেচে নেচে পথ চলে, একটা ভুজঙ্গকে দেখে তার এতো ভয়? নাকি সেই অছিলায়...
--" তু তু তুমি --"
আমি ঘুরে ওর মুখোমুখি দাঁড়িয়ে আমার দু'হাত দিয়ে ওর কাঁধদু'টোকে শক্ত করে ধরে ঝাঁকুনি দিলাম।
--" কী হয়েছে বাউলদিদি! এতো ভয় পেলে কেন? তুমি কি রাতের বেলায় এই প্রথম.. "
--" তুমি দেকেচো ওটাকে? "
--" হ্যাঁ, দেখবো না কেন? "
--" তুমি ওদের জাত চেনো? "
আমি মাথা নাড়ি। কথা বলার পর বোধহয় একটু ধাতস্থ হয়েছে বাউলদিদি।
--" ওটা চাঁদ বোরা। ঠাকুর, আমার বেতরে কি কোনো পাপ দেকেচো তুমি? "
আমি ওর কাঁধ থেকে হাত'দুটো সরিয়ে নিই। অন্ধকারে ওর দু'চোখের দিকে তাকিয়ে মাথা নাড়ি আমি।
--" তা ওলে ও আমার সুমুকে এলো কেন? সাপ যে কামের পতিক গো ঠাকুর, সত্যি করে বলো দেকি, আমায় দেকলে কি তোমার কামবাব আসে? "
-" তোমার কি মনে হয়, বাউলদিদি? "
--" না, আসে না, যদি আসতো তালে পরে গেলোবারে.. তোমার মনে আচে ঠাকুর? সেই পদ্মফুলের কতা? "
--" মনে আছে গো, বাউলদিদি। তোমার বস্ত্রহীন শরীরটা মুহূর্তে একরাশ পদ্মফুল হয়ে ঝরে পড়েছিলো মাটিতে। কাম কখন যে পূজা হয়ে ফুলের নৈবেদ্য সাজিয়েছিলো, সে বুঝি... "
--" তোমায় আমি বালোবাসি গো ঠাকুর, সত্যি কতায় কোনও পাপ নেই, তোমায় বালোবাসার পাপের গরে আমার পুণ্যের বাস গো। গোঁসাইও সেটা জানেন, আর জানেন বলেই --"
--" কী? জানেন বলেই কী গো কৃষ্ণভামা?"
--" সাঁজবেলায় সে গানটা দইরেচিলো। গানটার পদগুলো মনে আচে তোমার --? সে গানটা দে ঠারে গোঁসাই আমায় বুইজেচিলো যে, আমার অন্তরস্ত চাওয়ার কতা তিনি জানেন। আর তাই --"
এতক্ষণে সামনের দিকে পা বাড়ালো কৃষ্ণভামা। কার্তিকের শুক্লা নবমীর চাঁদ তখন অনেকটাই দক্ষিণ আকাশের বুকে পাল তুলেছে। আধো আলোছায়ায় নারী যে কি ভীষণ মোহময়ী হয়ে উঠতে পারে, সেটা এ মুহূর্তে বুঝতে পারছি। কেন কী জানি, সন্ধ্যাবেলায় ওর থরোথরো করে কাঁপতে থাকা ঠোঁটের ছবিটা যেন ফিরে এলো।
--" আমি বুজেচি ঠাকুর, ওই চাঁদবোরা কেন এবাবে পত কাটলো। সন্দ্যের সুময় আমার শরীলে মুহূর্তের জন্যি পাপ এয়েচিলো। গোঁসাইয়ের গান আমায় সাহসী কইরে দেচিলো গো, ওই আত্মতত্ত্ব পরমতত্ত্বের উপাসনা করার কতাতেই -- "
--" পাপের ঘরে যদি পুণ্য বসত করতে পারে, তাহলে পুণ্যর ঘরে পাপ বসত করতে পারবে না কেন? এ প্রশ্নটা তো তুমিই করেছিলে গো বাউলনি, মনে পড়ে? "
-- পড়ে গো ঠাকুর, মনে পড়ে। একন এই আলোচায়ার মইদ্যে তুমি ও কতা আর মনে কইরে দিও না। মনরে বিশ্বাস নেই গো ঠাকুর, সে যে ককন শরীলরে বেবশ কইরে দেয়, সেটা বুজি গুরুবাবাও বোজেন না। "
মনরে বিশ্বাস নেই? তাহলে যে কবি বলেছেন -- " মনেরে আজ কহ যে, ভালোমন্দ যাহাই আসুক সত্যেরে লও সহজে। " মন শরীরের অনুসারী না কি শরীর মনের? কোনটা সত্য? কবি কোনটাকে সহজে নিতে বলেছেন? আমার তো মনে হয় দুটোই সমানভাবে সত্য, শরীর ঠিক না থাকলে মনও কেমন ঝিমিয়ে পড়ে, আবার মন উৎফুল্ল থাকলে বুঝি হাত পা ছাড়াও কেদারনাথ দর্শন করে আসা যায়।
-- " ঠাকুর, মন যে কি বস্তু, সে খপর মন নিজেও জানে না গো। তুমি বাবচো বুজি শরীল না চইললে মনও বুজি অচল। মনের শরীল মন নিজেই বাইনে নেয় গো, এই বাবলে বুজি একানে আমার সাতে গল্প করতিচো, দেকলে মুহূর্তে অয়তো বাড়ির কতা বাবতে শুরু কইরে দেচো। মনের খপর কে রাকতি পারে বলো দিকি? "
শুক্লা অষ্টমীর আলো আঁধারিয়ায়, কুয়াশারা মাটিতে নেমে ঘরবাড়ি বানাচ্ছে, আমাদের বাঁদিকে সদ্য কেটে নেওয়া ধানের আদিগন্ত শস্যক্ষেত্র, আর সাথে মোহময়ী বাউলানি, এরকম অবস্থায় সুর যেন বাঁধনহারা নৌকোর মতো তরতর করে এগিয়ে চলে --
মন বলে আমি মনের কথা জানিনা
তারায় তারায় উড়ে বেড়ায়, মাটিতে সে নামে না,
সাঁঝের তারা হাতছানি দেয়, ভোরের তারা টানে
সাগর ঢেউয়ে ভেসে যায় সে, কোন পাড়ে কে জানে...
দেহ আমার চলতে নারে, বইতে নারে ভারে
হালকা হাওয়ায় পালকি চড়ে, কোথাও সে যে থামেনা...
মন বলে আমি মনের কথা জানিনা.....
--" কে গো? কিষ্ণামা নাকি? তা সংগে উটি কে? "
--" আমার নাগর গো ঠাকুর, আমার পিরিতের শ্যাম --"
-- " তোমার কে হন সে আমি কি করে জাইনবো বলো কেনে, ত দু'জনকে মাইনেচে দিব্যি, যেন সত্যিকারের আধাকিষ্ণ গো। "
--" মরণ! তোমার দোকানে ডিম নিতে এয়েচিলাম গো, ঘোড়ার লয় গো দোকানী, হাঁসের। আচে? "
( চলবে৷)