বাউল রাজা
• প্রদীপ গুপ্ত
দ্বিতীয় খন্ড ( সপ্তদশ পর্ব )
–"মন পাখি বিবাগী হয়ে ঘুরে মরো না
ভবে আসা যাওয়ার কি যন্ত্রণা
তাও কি জানো না। "
কৃষ্ণভামা ত্বরিতগতিতে আমার দিকে ফিরে দাঁড়ালো। ওর ঠোঁটের ওপর তর্জনীটাকে রেখে আমার পথ আটকে দাঁড়ালো। আমি বুঝলাম, আমাকে চুপ করে দাঁড়িয়ে থাকতে হুকুম জারি করলো বাউলনি । দাওয়া ছাড়িয়ে উঠোনে, উঠোন পেরিয়ে সীমানার গেট পেরিয়ে একটা শরীরসৃষ্ট অশরীরী ছায়া কাঁপতে কাঁপতে এসে আমাদের শরীর ছুঁয়েছে। আমি মনে করলাম ইঙ্গিতেই না হয় জিজ্ঞাসা করি
-- " কী হলো হঠাৎ? "
কিন্তু সেই ছায়া শরীর স্পর্শ করতেই আমার ইঙ্গিতের ভঙ্গিকে কে যেন বাঁধন পরিয়ে দিলো। আমি স্থাণুবৎ দাঁড়িয়ে রইলাম।
--" পাখির আছে দশ ইন্দ্রিয়
রিপু আছে ছয়জনা
খুশিতে রেখো তাদের
কথার কথায় ভুলো না
তারা কুহক দিয়ে হৃদয়ে বসে
লুটবে বলে ষোল আনা।"
বাউলনি কেমন যেন মোহাবিষ্টের মতো আমার দিকে এগিয়ে আসছে। আমার থুতনির নীচে ওর নিশিরঙা কেশদাম। মহিলাদের চুলেরও যে একটা মাতাল করা গন্ধ আছে, সেটা এই প্রথম উপলব্ধি করলাম। আমার মুখের দিকে মুখ তুলে দাঁড়ালো বাউলনি, সেই আধো আলো আঁধারে আমি দেখতে পেলাম, কৃষ্ণভামার দু'ঠোঁটে যেন হেমন্তের হিমেল কুয়াশা বাসা বেঁধেছে। আর একটা তিতিরশাবকের ডানার মতো ওর ঠোঁট দুটো তিরতির করে কাঁপছে।
--" আমার সুখের পাখি
সুখের ঘর কর না,
নূতন ঘর বাঁধিয়া তাতে
বসত করলি না,
ভবে আত্মতত্ত্ব পরমতত্ত্ব
সার করো উপাসনা --
ও আমার মনপাখি, বিবাগী হয়ে
ঘুরে মরো না --"
হঠাৎ করে কে যেন আমার কন্ঠ থেকে বলে উঠলো --" ঘরে চলো বাউলদিদি, ভীষণ চা পিপাসা পেয়েছে।"
--" কে গো পদীপদা এলে? "
আমি এতোদিনে জেনে গেছি, আমি কিছু বলি বা না বলি, কানাইদা ঠিক জেনে যান আমি কী বলতে চাইছি।
--" বলি, আব্দুল ফকিরের গান শুনলে? বড়ো তন্নিষ্ট সাদক গো, বড্ড অন্তরের বেতরে বইসে সঙ্গীত সাদনা করেন মানুষটা।"
আমি আর কীই-বা বলবো। সত্যিই তো ফকিরসাহেবের গানের কোনো তুলনা হয় না। তবে আমার কেমন যেন মনে হলো, তিনি শুধু সঙ্গীতসাধনাই করেন। কানাই দা বা এনাদের মতো তত্ত্বকথার গভীরে গিয়ে জীবনকে খোঁজার যে আকুলতা, সে আকুলতা বুঝি ফকিরসাহেবের নেই।
--" দেকো পদীপদা, আসল ব্যাপারটা হলো গরে পৌঁচোনো। তুমি বাবো দেকি, তোমার শোবার গরে, বা পুজোর গরে যাবার জন্যিও কতোগুলো পত রইয়েচে! তোমার লক্ক্য যদি শোয়ার গরে পৌঁচোনো অয়, অয়তো সে গরে তোমার বাবা, মা, ভাই, দিদি বা এরকম আরও পাঁচজনেরও সেই একই লক্ক্য, কেউ অয়তো উটোন তেকে, কেউ বা রান্নাগর তেকে, তো কেউ পুজোর গর তেকে শোবার গরে যেতে চাইচে। কি গো, পারেন তো? "
কানাইদার মুখমন্ডলে সামান্য একটু গোলাপি আভা, কথাটাকে যে শেষ পর্যন্ত কোথায় নিয়ে ফেলছেন সেটা ধরবার জন্য ছটফট করছি। আঁখিকোটরের ভেতর লেপ্টে থাকা দুটো আঁখি পল্লবও যে কতটা বাঙ্ময় হয়ে উঠতে পারে, আমি সেটাই লক্ষ্য করছি।
--" বিষয়টা কি জানো গো পদীপদা, একটা পদীপ, তার বুকে তেল বরা আচে, পলতে দেওয়া আচে, কিন্তু পদীপটা জ্বইলচে না, কেনে বলো দেকি? "
নাঃ, এরা আমাকে নিয়ে একটা শিশুর মতো খেলা করছে। মা যেরকমভাবে শিশুর সামনে মুঠি ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে বলেন - " হাত ঘুরোলে নাড়ু দেবো, নইলে নাড়ু কোথায় পাবো --" অনেকটা সেরকমই।
--" একটা দেশলাই কাটি গো, ফস কইরে জ্বেইলে তুমি সেই পলতেতে ছুঁইয়ে দাও, দেকবে ওমনি পলতের ওপর আলোর শিকা লকলক কইরে উটবে গো। তুমিও ঠিক তেমনি, তোমার বেতরেও -- থাকগে সে কতা, আব্দুল ফকিরও সাদক আমিও সাদক, কেউ বা ভুগোল নে সাদনা করতিচি, কেউ বা ইতিহাস নে। "
উফফ্, কোন কথাটাকে বোঝানোর জন্য, আমার অহংকে আহত না করেও, তিনি আমার ভুলটাকে ঠিক খাতে বইয়ে দিলেন, সেটাই দেখলাম।
এর ভেতর ছুটকি ফের তিন কাপ ( গ্লাস) চা এনে দাঁড়ালো।
-- " হ্যাঁ গো গোঁসাই, আজ কি খিচুড়ি হপে? আজ মাদুকরীতে দত্ত গিন্নি নতুন চাল আর খেসারি দেচেন। আলো চালের যে কি সুবাস... আঁচলে বেঁদে এনেচি বইলে সারা শাড়ি গন্দে ম' ম করতিচে। "
খিচুড়ির কথা শুনে কানাইদার মুখটা চকচক করে উঠলো।
--" আহা -- শীতটাও বেশ নুচির ময়দায় মেশানো ময়মের মতো পইড়েচে। খিচুড়ি আর তার সাতে আলু ভাজা -- আহা -- "
--" গরে বেগুনও আচে। দত্তগিন্নির বাগানের বেগুন গো --"
--" তালি পরে দত্তবৌ তো পুরো সাইজে দেচে রে ভামী -- এই মহিলার কোনো তুলনা নেই রে --"
--" তোমায় পেন্নাম জাইনেচে গো গোঁসাই, একদিন তোমারে গান শোনাতে হপে। "
আমি অবাক হয়ে ভাবছিলাম, কতো অল্পেই না মানুষগুলোকে আনন্দে ভরিয়ে তোলা যায় ! এখন রাত সাড়ে সাতটা বাজে। আজই গ্রামে একটা মুদি দোকান দেখেছি। সেখানে নিশ্চয়ই হাঁসের ডিম পাওয়া যাবে।
-- " একটা কথা বলি কানাইদা? "
-- " এ আবার কীরকম কতা পদীপদা! কিচু বইলতে গেলে আমায় শুদোতে হপে? "
--" পাড়ার ভেতর যে মুদি দোকান দেখেছি সেখানে হাঁসের ডিম পাওয়া যাবে গো? খিচুড়ির সাথে --"
--" আরে আজ তো দেকচি রাজভোজ অপেক্কা করতিচে গো! অ ভামী, পদীপদাদা কি বইলতিচে, শুইনেচিস! তা তুই সাতে গিয়ে নে আয়! আমার যে আর তর সইচে না রে --"
অন্ধকার যত ঘন হয়, তার বুকে জমে থাকা আলোগুলোও বুঝি ততই প্রকট হয়ে ওঠে।
নইলে সরীসৃপেরা ঘন কালো অন্ধকারে এতো দ্রুত চলাফেরা করে কীভাবে? রাস্তার বাঁদিক থেকে ডানদিকে একটা " তিনি " সরসর করে পার হলেন।
বাউলনি আমার ডানহাতটাকে জাপটে ধরলো।
--" কানাইদার শরীরের ছায়া আমাকে কীভাবে ছুঁতে পারে বাউলদিদি? গান গাইবার সময় ওর শরীরের ছায়া যেন একটা শরীর হয়ে আমার শরীরকে --"
-- "ছায়া লয় গো ঠাকুর, গান। গানের কতা আর সুর -- গানের পদগুলো মনে আচে তোমার? "
( চলবে )