ধা রা বা হি ক উ প ন্যা স
বাউল রাজা
• প্রদীপ গুপ্ত
দ্বিতীয় খন্ড ( ষোড়শ পর্ব )
ঘড়ির হিসেবে রাত সবে সন্ধ্যা পেরিয়েছে। এটাকেই বোধহয় প্রথম যাম বলে। আমরা খুব সম্ভবত নদী যে দিকে, তার উল্টোদিকে হাঁটছি। গ্রামের পথ। অধিকাংশ বাড়িই খড়ের চালা আর মাটির দেওয়াল। বেশীরভাগ বাড়িতেই সীমানা নির্ধারণে কোনও রকম দেওয়াল বা, এমনকি বাঁশের কঞ্চি দিয়ে ঘেরা বেড়াও নেই।
শীতেরও একটা নিজস্ব সুগন্ধ আছে। এই সুগন্ধ শুধুই যে ছাতিমের, সেটা নয়। পথের দু'পাশে ফুটে থাকা অজস্র নাম না জানা ফুলেরা বাতাসের বুকে তাদের সুগন্ধ অকৃপণ ভাবে ঢেলে দিচ্ছে। প্রত্যেকটা বাড়ির উঠোনেই অল্প কিছু হলেও গাঁদাফুলের গাছ দেশী মোরগের মতো মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে আছে।কাঁকর বিছোনো পথ ধরে দু'জনে হেঁটে চলেছি।
--" কি ভুলটাই না কইরে ফেললাম, ছিঃ, নজ্জায় মাতা কাটা যাচ্চে গো। "
---" কেন? কী ভুল করলে আবার? "
--" ওই যে, করিম শায়ের গানটারে লালনের গান বইলে ফেললাম! "
--" ওই গানটা তো করিম শাহের নয়। "
--" মানে? গানটা যে আব্দুল করিমের গান, সে তো গানের মদ্যিই বলা আচে। "
--" ফকির সাহেব কী কথা বললেন, শোনো নি? "
--" কী কতা? "
--" গান যখন সৃষ্টির পর্যায়ে থাকবে, ততোক্ষণ পর্যন্ত সেটার মালিক স্রষ্টা। সৃষ্টি সম্পূর্ণ হলেই সেটা আর,--- "
--" দেকো ঠাকুর, উনি মহাজন মানুষ, ওনার কতা নে বিতন্ডায় জড়ানো ঠিক না। তবে একটা কতা না বইললে অন্যায় হপে গো। "
--" কী কথা? "
--" মায়ের তেকে সন্তানেরে ককনও আলাদা করা যায়! বলো দিকি? গভ্যের থে বেইরে এলেই কি --"
এটুকু বলেই কথা হারিয়ে ফেললো বাউলনি, মনের ভেতর কথা খুঁজতে খুঁজতে অধৈর্য হয়ে বলে উঠলো --
--" তুমি কী বলো ঠাকুর? তোমার নিজের কী মনে লয়, বলো দেকি --"
পৃথিবীতে যতো সমস্যা আছে, তার ভেতর সবচাইতে বড় সমস্যা হলো -- মন রেখে কথা বলার সমস্যা। আর এ মুহূর্তে, যখন কৃষ্ণভামার হারিয়ে যাওয়া কথাকে খুঁজে দেওয়ার দায় বর্তেছে। কিছু একটা বলতে যাবো, ঠিক তখনই যেন দুষ্টু সরস্বতী এসে জিভের ডগায় ভর করলেন।
--" দেখো, মা যতই সন্তানকে গর্ভে ধারণ করুন না কেন, ভূমিষ্ঠ হওয়ার পর কিন্তু সত্যিই সেই সন্তান আর মায়ের পরিচয়ে পরিচিত হয় না। তখন পরিচয়ের সমস্ত ভারটাই এসে বাবার ওপর বর্তায়। সমাজ মাতৃপরিচয় খুঁজতে যায় না, খোঁজ করে পিতৃপরিচয়ের। একইরকমভাবে ধরিত্রীর বুকে বেড়ে ওঠা ফসল গোলাজাত হয়ে গেলে আর ধরিত্রীর থাকে না। কৃষকের হয়ে যায়।"
বাউলনি চুপ করে শুনছে কথাগুলো, অন্ধকারের মধ্যেও এটা দিব্যি বোঝা যাচ্ছে যে, অন্ধকার শুধু পৃথিবীর বুকে না ওর মুখেও জমে উঠেছে।
--" দেকো ঠাকুর, তোমাদের সমাজের সাতে বাউল সমাজের একেনেই পভেদ। এ জন্যিই বাউলঘরে সন্তান জন্ম নেয় না। তোমাদের পুরুষপধান সমাজের নিয়মকে বাউলসমাজ গহণ করেনি। তার বুজি একটাই কারণ, একজন পকিত মানুষ সে তার নিজের পরিচয়ে মানুষ অবে, না বাবার পরিচয়ে না মায়ের। "
বাউলসংসারে সন্তান জন্ম নেয় না, এ সংবাদ আমার কাছে ছিলো না। আমি আদৌ জানতামই না। অবাক হয়ে বাউলনির দিকে চাইলাম।
--" হ্যাঁ গো ঠাকুর, এ জন্যিই বুজি বাউলদের কোনও সংসার নিই, তারা যতোটা না শরীলের মদ্যে মন কে খোঁজে, তার চাইতে অনেক বেশী মনের ভেতর শরীলের খোঁজ করে গো।বাউলরাও কামুক, কিন্তু সে কাম শরীলকে ভর কইরে গইড়ে ওটে না গো, মনের ভেতর মনের মানুষের সাতে মিলনের আকাংকায় গইড়ে ওটে।"
হারিয়ে যাওয়া কথা অনেক সময় এমন কথার জন্ম দেয়, যে কথারা হয়তো কথা হারিয়ে না গেলে কখনোই বুদবুদের মতো গভীর ভাবনার তলদেশ থেকে উঠে আসতো না। কথা বলতে বলতে আমরা যে কখন কানাইদার আখড়ার সামনে এসে উপস্থিত হয়েছি, সেটা খেয়ালেই আসেনি।
-- " আচ্ছা বাউলদিদি, তাহলে যে তোমরা কন্ঠিবদল করো, সেটা কি জন্য? "
-- " আবার সেই পেরাইমারি ইস্কুলের টিচারের কাচে হাই ইস্কুলের পশ্ন শুদোচ্চো গো ঠাকুর? গোঁসাইকে শুদিও, এ পশ্নের উত্তর ওর কাচেই জমা আচে। "
বারান্দার মেঝেতে রাখা লম্ফের আলোয় কানাইদার শরীরের ছায়া কাঁপতে কাঁপতে রাস্তায় এসে পড়েছে। মাটির দেওয়ালে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে ছুটকি।
কানাইদা গান গাইছেন। হাতে খমক আর পায়ের গোড়ালিতে ঘুঙুর নিয়ে গানের সুরে হারিয়ে গেছেন।
( চলবে )