1 / 7
2 / 7
3 / 7
4 / 7
5 / 7
6 / 7
7 / 7

প্রদীপ গুপ্তের ধারাবাহিক উপন্যাস বাউল রাজা | সাহিত্য চেতনা

ধা রা বা হি ক   উ প ন্যা স 


             বাউল রাজা

               • প্রদীপ গুপ্ত

                দ্বিতীয় খন্ড (প্রথম পর্ব) 


কটা ঝাঁকুনি দিয়ে ট্রেনটা দাঁড়িয়ে গেলো। ব্যান্ডেল জংশন ছাড়িয়ে ছুটছিলো গৌড় এক্সপ্রেস। একটা টুটিয়ার কামরায় জানালার পাশে বসে গাড়ির উল্টোদিকে আঁধারির ছুটে চলা দেখছিলাম। 

কালীপুজো হয়ে গেছে দিনকয়েক হলো। বাতাসে হাল্কা শীতের আমেজ। চাঁদটাকে দেখে মনে হচ্ছে যেন ওটা ছলাকলার মাঝামাঝি এসে পৌঁছেছে। হাল্কা নীল সরের মতো একটা কুয়াশার চাদর ঝুলে আছে সামনের মাঠে। সে কুয়াশা হয়তো দেখা যেতো না, যদিনা চাঁদ এখন যৌবনবতী হতো। সামনের নয়ানজুলি ছাড়িয়ে যেখানে দিগন্তরেখায় মিশেছে আঁধার, সেখানকার জড়াজড়ি করে একে অন্যকে জড়িয়ে রাখা গাছগুলো রাতের আঁধারকে একটা অন্যমাত্রা এনে দিয়েছে। 

প্রায় দেড় বছর পর একা একাই চলেছি অন্ধ বাউল কানাইদা আর তার সাধনসঙ্গিনী কৃষ্ণভামার ঠাঁয়ে। প্রতিটা মুহূর্ত জুড়ে রয়েছে গতবারের স্মৃতি। 

ধ্রুবদাকে সাথে নিয়েই আসবো ভেবেছিলাম। দুবছর আগে যে নির্মীয়মান বহুতল আমাদের মিলনস্থল ছিলো, এখন আর সে বহুতলে আমাদের আড্ডা মারার কোনও উপায় নেই। যতক্ষণ পর্যন্ত কোনো বাড়ি তৈরি হয় ততক্ষণ পর্যন্ত সেটা যাদের অধিকারে থাকে, কাজ শেষ হয়ে গেলেই সেখানে আর তাদের প্রবেশাধিকার থাকে না। দুঃখজনক হলেও বিষয়টা বাস্তব সত্যি। সেই কনস্ট্রাকশন কোম্পানির অন্য সাইটে মালপত্র দিচ্ছি। কিন্তু এখানে পুরোনো স্টাফেরা কেউ নেই। বিমলদা, ধ্রুবদা সবাই অন্য এক বহুতলের কাজ দেখছেন। তবুও ধ্রুবদার বাড়ি গেছিলাম। গেছিলাম যাওয়ার কথা বলতে। কিন্তু তিনি আমার সাথে একসাথে আসতে পারলেন না। হয়তো দু'একদিন বাদে রওনা দেবেন। 

ধ্রুবদার কথা মনে পড়তেই মনে পড়লো গতবারের ট্রেন ধরার কথা। কী কপালজোরেই না পেয়েছিলাম ট্রেনটা। দৌড়োতে দৌড়োতে কোনোক্রমে যখন রওনা হয়ে যাওয়া গাড়ির গেটের হাতলে হাত রেখে কামরায় সঁপে দিলাম শরীরটাকে, সেটা একটা ভেন্ডারের কামরা। একে বিনাটিকিটের যাত্রী, তায় ভেন্ডারের কামরার বাথরুমের পাশের জায়গাটুকুতে ডাঁই করে রাখা কাঁচালংকা আর সবজির বস্তায় বাথরুমের দুর্গন্ধময় মেঝেতে দ্রুবদাকে যখন নিশ্চিন্তে নাক ডাকতে শুনছিলাম, তখন সত্যিই জীবন কথাটার যে কি বিশাল ব্যাপ্তি, সেটা বুঝেছিলাম। 

ট্রেনটা ঝাঁকুনি দিয়েছিলো ঠিকই কিন্তু থেমে যায়নি। সাথে সাথেই একটা কুউউউউ ডাক ডেকে ফের চলতে শুরু করেছিলো। 

এবারের ভাদ্র মাসেও যে তারাপীঠ মন টেনেছিলো, সেকথা সত্যি। কিন্তু ভাদ্রতে যাওয়ার ইচ্ছা এজন্যই ত্যাগ করেছিলাম যে ভাদ্রর অমাবস্যার যে একটা অমোঘ টান, সে টানের হাত থেকে নিজেকে মুক্ত করার আপ্রাণ চেষ্টায় নিজেকে বুঝিয়েছিলাম যে ভাদ্র নয় অন্য কোনোদিন অন্য কোনো সময় গিয়ে দেখতে হবে যে অন্য সময়ের সাথে ভাদ্র মাসের অমাবস্যার সত্যিই কোনও পার্থক্য আছে কি না। নাকি সবটাই একটা মিথকে প্রতিষ্ঠিত করার জন্য প্রচার করা। একা একা যাওয়ার পক্ষে যতই নিজেকে নিজে সার্টিফিকেট দিই না কেন, ধ্রুবদার অনুপস্থিতি কিন্তু হাড়ে হাড়ে টের পাচ্ছি। ব্যক্তিজীবনে যতই স্বাবলম্বী বলে নিজেকে জাহির করি না কেন, আজকের এই যাত্রাপথে বারবার করে ধ্রুবদার মুখটা ভেসে উঠছে। 

কানাইদা কি ধ্রুবদাকে ছাড়া একা আমার যাওয়াটাকে স্বাভাবিকভাবে নেবেন ? যদি তিনি মনে করেন যে বাউলনি কৃষ্ণভামার টানেই বুঝি আমি একা, ধ্রুবদাকে ফেলে উপস্থিত হয়েছি তাঁর আখড়ায়? যদি কানাইদার আখড়ায় না উঠে গুরুপদবাবার আশ্রমে গিয়ে উঠি, তাহলে কি তিনি আমায় আদৌ চিনে উঠতে পারবেন? যদিওবা চেনেন, তাহলে কি ধ্রুবদাকে ছাড়া আমাকে আদৌ আশ্রয় দেবেন তার আশ্রমে? ভাবনাগুলো যেন ট্রেনের জানালা থেকে পিছলে পড়া আলোর মতোই ছুটতে থাকলো আমার সাথে সাথে। ট্রেনটাও যেন তার দৌড়ের শব্দে একটাই প্রশ্ন করে চলেছে -- তাহলে কি -- তাহলে কি -- তাহলে কি -- 


কার্তিকের অমাবস্যার থেকে চাঁদ মুক্তি পেয়েছে আজ আটদিন হলো। তার আলোর রঙ এখনও দুধসাদা হয়নি। একটু যেন ফিকে। শহর ছেড়ে বাইরে এলে বুঝি পুরোনো প্রেমিকার মতোই নিজেকে উন্মুক্ত করে দেয় আকাশ। ঝলমলে তারাদের ভীড় আর দিগন্তব্যাপী ধানখেতের ওপর ঝুলে থাকা কুয়াশার রেশমি চাদর যে মায়াজাল বুনে চলেছে, সেই মায়াজালে যেন আটকে আছে আমার চিন্তারা। সূত্রটা যখন ছিঁড়লো, তখন ট্রেনটা একটা বিশাল অজগরের মতো শরীরটাকে নিয়ে বর্ধমানে এসে হাঁফ ছাড়লো।


                       (চলবে..)

Joydeb Biswas

Poet Joydeb Biswas studied Bengali literature. In 2015, at the age of 22, he published 'Sahitya Chetona' magazine. Currently two editions of the magazine are published. One is the online version and the other is the printed version. He is the founder and editor of the two editions. facebook twitter youtube instagram whatsapp

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

নবীনতর পূর্বতন