কবি সৌভিক বন্দ্যোপাধ্যায়
কবি সৌভিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের একগুচ্ছ কবিতা প্রকাশ করা হল :
বহুদিন পর আজ
***
বহুদিন পর আজ জিনিয়ার নম্বর ডায়াল করি
ভেবেছিলাম অপর দিক থেকে শোনা যাবে -
" প্লিজ চেক দা নাম্বার ইউ হ্যাভ ডায়ালড "
অথবা " আপনি যে নম্বরটি ডায়াল করেছেন , তা এখন ব্যস্ত আছে ..."
কিংবা " দা নাম্বার ইউ হ্যাভ ডায়ালড ইজ সুইচড অফ "
কিন্তু সেসব কিছুই ঘটলোনা
জিনিয়া ফোন তুলে বলে উঠলো -
" জিনিয়া সেনগুপ্ত | কে বলছেন ?"
আজ এত বছর পর জিনিয়ার কণ্ঠস্বর শুনে
আমার কেমন লাগলো, তা বড় কথা নয়
জিনিয়ার গলায় কি ক্লান্তি ছিল ? বিষণ্নতা ?
পৃথিবী , ওলটপালট হয়ে গেছে, বদলে গেছে সব
যে কফিশপে আমি আর জিনিয়া প্রায়ই যেতাম
মুখোমুখি বসে ছুঁয়ে নিতে চাইতাম নদীতীর, সূর্যাস্ত, নক্ষত্রমায়া
সেদিন দেখলাম সেখানে উঠে গেছে নির্লিপ্ত বহুতল
আজ এত বছর পর আমি কি চাইছিলাম
জিনিয়ার কণ্ঠস্বর থেকে উপচে পড়ুক খুশি ?
সেটাও বড় কথা নয়
কলকাতার হিজিবিজি স্কাইলাইনের দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে মনে হলো
জিনিয়া আমাকে কোনোখানে রাখেনি
নিজের ফোন থেকেও মুছে দিয়েছে আমার নম্বর
তাই বুঝতে পারেনি কে তাকে ফোন করেছে -
এটাই একমাত্র সত্য , আর বাকি কিছু জরুরি নয়
এত নিশ্চিন্ত , আমি বহুকাল বোধ করিনি...
মেঘজন্ম থেকে
***
করোনেশন ব্রিজ থেকে শিমুলবাড়ি টি-এস্টেটের দিকেছুটে গেল যে আনমনা রোদআমি তার পিছু নি, আমি তাকে ফলো করি বিষণ্ন গোয়েন্দার মতোএই চা-পাতা রঙের উদাসীন মার্চের দিনেচুলকাঁটা বাঁক পেরিয়ে পেরিয়ে উঠে যেতে থাকিকত নাম না-জানা অর্কিড বিছানো এই পথ ম্লান সূর্য ঢলে পড়ছে এখন পাহাড়ি উপত্যকায় মনে হয়, এ এক চিরকালীন প্রতিধ্বনির মরসুমবহু ওপরে , মেঘজন্ম থেকে হাত নেড়ে ওঠো তুমি চোখে ঘোর লেগে যায় ...
অশালীন
***
ইলামবাজারের রাস্তায় তখন ঘন মেঘ, হঠাৎ বৃষ্টি
দু'ধারের জঙ্গলে ঝুঁকে পড়া গাছেদের চুম্বন
প্রথমদিকের আলাপ , তাই তুমি আশা করেছিলে শালীনতা , তাই স্বাভাবিক
অথচ , সেই নির্জন, নিবিড় , বৃষ্টিস্নাত রাস্তায়
বেপরোয়া ঝড় ওঠার কথা ছিল
ইলামবাজারের ঘনঘোর মায়া-বিকেলে শালীনতা, তোমার জন্যেই
আমি লুকিয়ে ফেলেছিলাম আমার বিদ্যুৎ
গাড়ি থেকে নেমে ফাঁকা রাস্তায় ভিজিয়ে নিয়েছিলাম নিজেকে
অথচ শালীনতা , তুমি তারপর আর চিঠি দাওনি আমাকে
বন্ধ দরজার সামনে
হাজার বছর ধরে দাঁড়িয়ে আছে অন্ধ বেড়াল -
বল, এ দৃশ্য অশালীন নয় ?
অবকাশ
***
লোহার গেটের বাইরে বাড়িটির নাম লেখা -
'অবকাশ'
'অবকাশ' বাড়িটির সামনে এসে দাঁড়াই
বাগানে মেঘলা ফুল, ছাদে তার দিগন্তের ঘোর লাগা রং
দূর দেশ থেকে কারা যেন বারান্দায় এসে নামে
শীত করে ওঠে খুব , ঠোঁট ফাটে অভিমানে
পুরোনো হলুদ ঘাস
দৃশ্য থেকে দৃশ্যান্তরে যায় -
যে কাঠের সিঁড়ি উঠে গেছে দোতলায়
সে জানে, মহান অবজ্ঞার কথা ...
চলে যাওয়াগুলো দেবদারু গাছের মাথায় স্থির হয়ে আছে
'অবকাশ' বাড়িটির সামনে অনন্ত দাঁড়িয়ে থাকি
লালমাটি পথ বেয়ে দূরে মিলিয়ে যায় রিকশা
লরেটো হাউজের মেয়েটিকে
এখনো সাওঁতাল গ্রাম ঘুরিয়ে দেখাচ্ছে হাওয়া
পুরোনো হলুদ ঘাসে ডেকে ওঠে সোনালি তক্ষক
'অবকাশ' বাড়িটির সামনে দাঁড়িয়ে বুঝি
বন্দর পাল্টে ফেলা ছাড়া আর কোনো ধর্ম নেই
ফিরে আসার সামান্য অবকাশ মুছে গেছে ভ্রমে
বাগানে মেঘলা ফুল , বারান্দায় খুন হওয়া আলো ...
নীল খাতা
***
তোমায় আমি ভুলতে চেয়ে রঞ্জিনী
বাজার থেকে হিসেব করে ছাই কিনি
উড়িয়ে দেওয়া মেঘের মতো এক সফর
পুড়িয়ে দেওয়া হাসির মতো খন্ডহর –
এ সব নিয়েই হাঁটতে বেরোয় কলকাতা
ক্যাকোফোনির মধ্যে ভাসে নীল খাতা
তোমায় আমি মারতে চেয়ে রঞ্জিনী
ব্যাকপকেটে মেশিন রাখি, রাগ কিনি
বুলেটপ্রবণ গুপ্তখুনের এই দিনে
আমার কফিন ধুলোয় বসে গান শোনে...
রুহ
***
হাওয়াজ্যোৎস্নার রাতে উঁচু বহুতলের মাথা ছাড়িয়ে উড়ে যায় পালক
নীচে নক্ষত্রধুলোয় ঢেকে যায় শহর , আমাদের সামান্য ভেসে থাকাটুকু
" রুহ " নামের সেই মেয়েটি , যে আচমকা কথা বন্ধ করে দিয়েছিল একদিন
তাকে আর ফোন করা হয়ে ওঠেনি কখনো
আলো নিভে যায় কলকাতায়
কিছুদূরে জানলায় উড়ে এসে বসে সাদা প্যাঁচা
দীপ্তি নাভালের ইংরেজি কবিতার বই হাতে শুনতে পাই
ঘরে ঘরে ঘর ভেঙে যাবার শব্দ
মনে হয়, হাওয়াজ্যোৎস্নার রাতে উড়ে যাওয়া পালকই আমাদের একমাত্র ভবিষ্যৎ
" রুহ" নামের কেউ দুলে ওঠে বারান্দায়
ময়দান এলাকা থেকে কালো গাড়ি চাঁদ তুলে
কিছু পরে কলঙ্ক নামিয়ে যায় অন্ধকার গাছের তলায়
ভিক্টোরিয়ার পরী দুঃখিত হয়
পালকে পালকে ছেয়ে যায় রাতের আকাশ ...
হাত
***
অনেক তদন্ত ও জিজ্ঞাসাবাদের পরে
প্রমাণিত হল চুরিটা ক্যাশিয়ার পবিত্র পাল করেননি।
সেই একদিন খুব ঝোড়ো হাওয়ায়
অফিসের দরজা , জানলা তছনছ ,
তুমুল বৃষ্টিতে নিভে গিয়েছিল ল্যাম্পপোস্ট ,
মিডলটন স্ট্রিটের হাঁটুজল পেরিয়ে
কাউকে না পেয়ে বাড়ি ফিরে গিয়েছিল পথনায়িকা সাবরিনা ,
সেদিন সূরজমল আগরওয়ালের গদিতে
ক্যাশ-বাক্স ভেঙে চুরি করা হয় -
বন্ধ অফিসঘরে ভেসে এসেছিল
হাজার হাজার মুষ্টিবদ্ধ হাত।
পালবাবুর মেয়ের বিয়ে হচ্ছেনা ,
তাঁর কলুটোলা স্ট্রিটের পুরোনো বাড়ির ভাড়া বাকি আজ তিন মাস ,
কিন্তু চুরি পালবাবু করেননি ,
যদিও সেই হাজার হাজার মুষ্টিবদ্ধ হাতের মধ্যে
একটা হাত তাঁর হলেও হতে পারে।
সেই কবে একদিন সূরজমল আগরওয়ালের গদিতে
অনেকে এসেছিল ঝোড়ো হাওয়ার মত ,
যারা টাকা চুরি করতে নয় ,
ফিরিয়ে নিয়ে যেতে এসেছিল চুরি যাওয়া টাকা ....
পূর্ণিমা
***
গহীন জঙ্গলের ভেতর অচেনা বনদেবীর ছোট্ট মন্দির , ভেতরে একটা ঘন্টা , শোনা যায় ঘোর অমাবস্যার রাতে এখানে এসে ঘন্টা বাজালে , জীবনে পূর্ণিমা নেমে আসে … গাইড শিবেশ্বর ওয়াদেকার বললো - " একবার এরকমই এক অমাবস্যার রাতে, ঘণ্টা বাজাতে এসে দেখি , পাশে করজোড়ে বাঘ বসে আছে , আসলে বাঘ বা মানুষ , সকলেই পূর্ণিমা চায় ..."
শিকারির চোখ
***
চৈত্রের বাতাসে যেন কেঁপে ওঠে এই বনপথ
যে গাছের শরীরে লেখা হয়েছিল -
"অপরাজিতা , মনে রেখো ...."
সেই গাছ হারিয়ে গিয়েছে জঙ্গলে
আচমকা ছায়া সরে যায় ...
আগাছায় ভরে গেছে পরিত্যক্ত বাড়ি
দরজা ঠেলে কারা যেন বেরিয়ে আসে আজ
বারান্দায় আলোছায়া রোদ , ছেঁড়াখোঁড়া গানের কোলাজ
দূরবর্তী ঝর্ণায় বয়ে যায় সাদাকালো ছবি
নেটওয়ার্কবিহীন এই অঞ্চলে কোথা থেকে ডোরাকাটা ফোন আসে
কেউ বলে - "ফিরে যাও , উপকথা ভুলে যাও , দুঃখ নিষেধ..."
চেক-পোস্ট পেরিয়ে যাই , টিলার ওপর থেকে হা হা হেসে ওঠে হাওয়া
চৈত্রের জঙ্গলে জ্বলে ওঠে শিকারির চোখ ....
প্রতিধ্বনির দিনে
***
এমনও তো হতে পারে , আনমনা ফাল্গুনে
কেউ এসেছিল, বাগানের ঘাসে তার চিঠি পড়ে আছে
এমনও তো হতে পারে, পুরোনো কাঠের সিঁড়ি
উঠে গেছে ধুলোপড়া ছবিদের দেশে
কেউ এসেছিল, বারান্দায় হেসেছিল সাদাকালো রোদের টি- পট
হাওয়া এসে খুলেছিল দরজা , দূর থেকে অভিমান এঁকেছিল ছায়া
প্রতিধ্বনির দিনে বহু পথ পেরিয়ে যে এসেছিল
আলোময়ী ফিরবেনা , এই কথা জেনে
এলোমেলো ফাল্গুনে ফিরে চলে গেছে ...