সিদ্ধিদাতা গনেশ
দেবাশিস লাহা
***
বাঙালির বারো মাসে তেরো পার্বন --ইহা কাহারও অবিদিত নহে। এই সুবিশাল পার্বনের ঝুলিতে সাম্প্রতিক সংযোজন রূপে গনেশ ঠাকুরও এইবার প্যাণ্ডেলে প্যাণ্ডেলে বিরাজ করিতেছেন। বাঙালি আনন্দে ভাসিয়া যাউক, বিগলিত হউক--ইহাতে এই অধম মানবপুঙ্গবের আপত্তির কোনরূপ কারণই নাই। কেবল মাত্র একটি বিষয়ে খটকা লাগিতেছে। এই খটকা যে অদ্যই আমার মটকাবন্দী হইল, তাহা নহে। ইহা বহুকাল হইতেই আমার ক্ষুদ্র ঘিলুতে সুড়সুড়ি প্রদান করিয়া আসিতেছে। এই দামোদর [অথবা ড্রামোদর] গনেশ ঠাকুর কিরূপে সিদ্ধিদাতা হইলেন, তাহা ভাবিয়া সত্যি বিস্মিত হইয়া যাই ! সাফল্য অর্জন করিতে হইলে যে বিস্তর পরিশ্রম করিতে হয়, ইহা কে না জানে ! মাথার ঘাম পায়ে ফেলিতে হয় এমনও শুনিয়াছি। কিন্তু এই গনেশ ঠাকুর দর্শন করিয়া কি কাহারও মনে হইয়াছে যে ইনি অতীব পরিশ্রমী ? বরং একটি বিপরীত সিদ্ধান্তই আমার মগজে নৃত্য করিতে আরম্ভ করে। এই সুবিশাল ভুঁড়িদার বপুর অধিকারী দেবসন্তানটি চরম আলস্যের প্রতীক রূপেই চিহ্নিত হইতে পারেন। অলস হইলেও বুদ্ধির [প্রিয় সখা ইহাকে কূট বুদ্ধি বলিয়া অভিহিত করা যাইতেই পারে] নিরিখে এই দেবতাটি বেশ পরিপক্ক। আপনাদিগের অবশ্যই স্মরণ আছে সেই মহা প্রতিযোগিতার কথা---গনেশ ও কার্তিকের মধ্যে কে সর্বাগ্রে পৃথিবী প্রদক্ষিণ করিতে পারে ! সেই মহারণে কিন্তু ‘হ্যান্ডসাম’ এবং ‘ফিজিক্যালি ফিট’ কার্তিক মহাশয়ের করুণ পরাজয় ঘটিয়াছিল। কাউন্টডাউন আরম্ভ হইবামাত্র ময়ূরের পৃষ্ঠে আরোহণ করিয়ন’ তিনি মেদিনী প্রদক্ষিণে বাহির হইয়া পড়েন। কিন্তু গনেশ বাবাজি এক বিন্দুও না নড়িয়া মিটিমিটি হাস্য করিয়া তাঁহার ভুঁড়ি আন্দোলিত করিতে থাকেন। রেফারি নারদ তো যারপরনাই বিস্মিত হন এবং কাঁচুমাচু মুখটি কদলী না আম্র কিসে রূপান্তরিত করিবেন ভাবিয়া আকুল হইয়া ওঠেন।
“বৎস গনেশ ইহা কিরূপ লীলা তোমার ! তুমি না সিদ্ধিদাতা ! তবে পরিশ্রমে পরাঙ্মুখ কেন ? যাও বিলম্ব হইতেছে---এরূপ বসিয়া থাকিলে তোমার পরাজয় যে অবধারিত !”
তথাপি গনেশ বাবাজির কোনরূপ হেলদোল নাই। কিছু কাল অতিবাহিত হইবার পর এই ভুঁড়িদার দেবপুঙ্গব তাঁহার জননী দুর্গাকে প্রদক্ষিণ করিয়া পুনরায় নিজের আসনে উপবেশন করিলেন। বেচারা কার্তিক গলদঘর্ম হইয়া প্রত্যাবর্তন করিয়া দেখিলেন নারদ মুনি ইতোমধ্যেই গনেশ বাবাজিকে বিজয়ী ঘোষণা করিয়াছেন। কারণ ? আহা, মাতাই হইলেন বিশ্ব ব্রহ্মাণ্ড । তাঁহাকে প্রদক্ষিণ করিলেই জগত প্রদক্ষিণ করার ফললাভ হয়। অতএব দামোদর গনেশই বিজয় লাভ করিয়াছেন!
প্রিয় সখা বিনা পরিশ্রমে ঘুটুবাজি করিয়া সাফল্য অর্জনের নমুনা আর কি-ই বা হইতে পারে ! ইহাকেই বলে সাফল্য লাভের শর্টকাট টিপস। আর সাফল্য অর্জনের এই বিশেষ পথটি আর যাহাই হউক, সিংহ ভাগ বাঙালী পুঙ্গবের অতীব প্রিয়। চারি পার্শ্ব অবলোকন করিলেই তাহা অনুধাবন করিতে পারি।
গনেশ বাবাজির এই টোটকা যে এই মহান দেশবাসীদিগকে হোঁতকা বানাইয়া ছাড়িয়াছে তাহাতে সন্দেহ নাই। কলম্বাস, ভাস্কো-দা-গামা, ম্যাজেলান যখন পৃথিবী প্রদক্ষিণ করিয়াছেন, তখন আমরা নিজ নিজ মাতার আঁচল ধরিয়া ঘুরপাক খাইয়াছি এবং ক্রমে ক্রমে ভুঁড়িদার হইয়া উঠিয়াছি। আমাদেরই কেহ কেহ যাঁহারা সমুদ্র অতিক্রম করিয়া নূতন জগতে পা রাখিতে চাহিয়াছেন, কালাপানি পার করিবার অপরাধে তৎক্ষণাৎ তাঁহাদের ধোপা নাপিত বন্ধ করিয়াছি। ফলত যাহা হইবার তাহাই হইয়াছে ----এই মহাবিশ্বের কোন স্থানেই আমরা আমাদের যুদ্ধ অথবা সংস্কৃতির বিজয় রথ প্রেরণ করিতে পারি নাই। কুয়ার অভ্যন্তরে শয়ন করিয়া কেবল ধুঁয়া সেবন করিয়াছি। কিন্তু উহারা আসিয়াছে---দলে দলে একেবারে দরজা ভাঙয়া প্রবেশ করিয়াছে—তরবারি তুলিয়া এমন ছুটিয়া আসিয়াছে যে আমরা পিতার নাম পর্যন্ত ভুলিয়া গিয়াছি। তাহাতে কি ! অম্লান বদনে বলিয়াছি –আহা কী আনন্দ !----শক-হূণ দল আগল পাগল এক দেহে লীন হইয়া কী অপরূপ এক খিচুড়ি ছাগলের জন্ম দিয়াছে ! সেই অতিকায় অজটি-ই এখন সমগ্র দেশে ঘুরিয়া ফিরিয়া বিচিত্র কাঁঠাল পাতা চিবাইয়া চলিয়াছে !
কেবল গনেশকেই দোষের ভাগী করিলে ভুল হইবে। সত্য কথা বলিলে আমাদের দেবতাকুলের সামগ্রিক পারফরমেন্সই অতীব জঘন্য। জাপান, আমেরিকা, ফ্রান্স, ইংলণ্ড সরস্বতী, পূজা না করিয়াই ধরা ছোঁয়ার বাহিরে চলিয়া গিয়াছে। আর প্রযুক্তির দেবতা বিশ্বকর্মা কিম্বা সম্পদের দেবী লক্ষ্মী ? ইহাদের কথা নাই বা বলিলাম !
পরিশেষে নিবেদন করি সিদ্ধি শব্দটির অপর একটি অর্থ আছে ! সেই সিদ্ধি সেবন করিয়া অনেক বাঙালীপুঙ্গবকেই রসাতলে যাইতে দেখিয়াছি। গনেশ বাবাজি যদি সেই সিদ্ধিদাতা বলিয়া বিবেচিত হইয়া থাকেন, এই অধমের এক রত্তিও আপত্তি নাই।
খাসা রম্যরচনা👌
উত্তরমুছুন