সীমানা ছাড়িয়ে বাঙালি
নন্দিতা পাল
***
সেবার আমেরিকাতে দুর্গা পুজো মিস হয়ে যাবে এই রকম একটা সম্ভাবনা, কারণ আমার ছেলে তখন মাস তিনেকের তাকে নিয়ে দূরে যাওয়াটা হবে কিনা এইসব ভাবনা চলছিল। 2005 এর কথা বলছি তখন সপরিবারে আমি ইন্ডিয়ানাপলিসে থাকি। গতবছর ইন্ডিয়ানাপলিসে পুজো দেখেছিলাম, কিন্তু এবার সেই পুজোটা হবে ডেটনে, যাই হোক ঠিক হল শিকাগো যাওয়া হবে, ওখানে পুজোর সপ্তাহেই হচ্ছে পুজো, ৮ আর ৯ তারিখ অক্টোবরে। এখানে বেশ প্ল্যান করে পুজো গুলো সব শনি রবি বারে হয়, কয়েক সপ্তাহ ধরে, যাতে চাইলে সবাই যেতে পারে। সাহস করে আমরা বেরিয়ে পরলাম শনিবার একদম সকাল বেলা, দু রাত শিকাগো থাকার প্ল্যান করে। প্রায় ৩০০ কিমি মত শিকাগো, ঘন্টা সাড়ে তিনেকের মত লাগবে গাড়ীতে। একটা বেশ বড় গাড়ী ভাড়া করে নেওয়া হল, আমার স্বামী চালালেন, মাঝে সাঝে হয়ত আমি। সাথে আমার মেয়ে, ছেলে আর আমার শ্বশুড়-শ্বাশুড়ি ।
শিকাগো শহরের দুর্গা প্রতিমা |
আমার শ্বশুড়-শ্বাশুড়ি কিছুদিন আগেই কোচবিহার থেকে এসেছেন, তাই পুজোর পরার শাড়ী, জামা, সাজগোজের জিনিস সব নিয়ে এসেছেন যত্ন করে। এখানে বেশ ঠাণ্ডা এখন, ইন্ডিয়ানাপলিস গরমে বেশ ভালো গরম, তেমনি ঠাণ্ডা পড়ে শীতে, বরফে বরফ। ঝিরঝির বৃষ্টি পেলাম রাস্তায়, গাড়ীতে তখন চলছে মান্না দে, শ্রীকান্ত, ভাওইয়া আর মাঝে মাঝে বাচ্চাদের রাইমস। আমারিকা আসার আগে দেশটা কে নিয়ে যা জানতাম, এখানে এসে এ কমাসে আমার দারুণ অভিজ্ঞতা লোকজনের সাথে মিশে ও কাজ করে। তার কৃতিত্ব অনেকটাই এই ইন্ডিয়ানাপলিস শহর টা কে দিতে হয়। সবুজে সবুজ শহরটা, বেশ দূরে দূরে বাড়িঘর, শান্ত জায়গা-পড়াশুনার ভালো কেন্দ্র। আর সব চাইতে মনে রাখার মত হল, Indy 500 Race, বিশাল স্টেডিয়াম, সারা পৃথিবীর লোক দেখতে আসে এখানে গাড়ীর রেস। মে মাসে যখন রেস হয়, ঘর থেকে আওয়াজ আর স্টেডিয়ামের আলো দেখেছিলাম, কি যে সাঙ্ঘাতিক সেই আলোর রোশনাই ! শিকাগো আগে গিয়েছি ঘুরতে, বাঙালির একটা ভীষণ আবেগ জড়ানো বিবেকানন্দ'র জন্য অবশ্যই। আমরা এখন হাইওয়েতে, বেশ ফাঁকা রাস্তা। হু হু করে গাড়ী চালিয়ে আমরা সোজা পৌঁছে গেলাম যেখানে পুজো হচ্ছে সেইখানে।
শিকাগোতে স্কুলের হলঘরে দুর্গা পূজা |
শিকাগোর হফম্যান এস্টেট, ব্যারিংটন স্ট্রীটে শাম্বারগ স্কুল দু'দিন ভাড়া করে পুজোটা হচ্ছে। প্যান্ডালের কোন ব্যাপার নেই। স্কুলটার নীচের তলায় বিভিন্ন রুমে আর হলে বিশাল আয়োজন। বড় হলঘরে প্রতিমা সেখানে পুরোহিত পুজো করছেন। কোথাও খাবার ব্যবস্থা, কোথাও রিহার্সাল আর একটা হলে সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের আয়োজন। সেই অপরূপ মায়ের মূর্তি, কলকাতার কুমারটুলি থেকেই গিয়েছে। প্রায় আড়াই হাজার দর্শনার্থী সব মিলে, এনারা সারাদিন খাওয়া দাওয়া সব এখানে। এরি মধ্যে চোখে পড়ল যারা এসেছে, শাড়ি ধুতি গয়না পরে, একদম মিনি বাংলা তখন একটা। আমাদের দুই বন্ধু ও তাদের পরিবার ও এসে যাওয়ায় আনন্দ আরো বেশি, আগামী কালের প্ল্যান ও ঠিক হল। তবে সবচেয়ে যেটা ভালো লাগলো বাচ্চাদের যাতে খেলার ব্যবস্থা থাকে, একটা ঘরে অনেক রকমের খেলার আয়োজন যাতে বাইরে ঠাণ্ডায় বেরতে না হয়। তার চাইতেও মজাদার হল, বাবা মায়েরা ভীষণ আনন্দ করছেন খিচুরি ভোগ পেয়ে, আর বাচ্চাদের জন্য বিভিন্নরকম পিতজা এসেছে, তাতে বাচ্চারাও খুশি। আমরা অঞ্জলি দিয়ে সব একসাথে বসে খিচুড়ি খেলাম। আশেপাশে রুমে নাচের, নাটকের রিহার্সাল ও হচ্ছে দেখলাম। বাচ্চা একদম ছোট, আমরা রওনা দিলাম হোটেল বেটনে। সন্ধ্যের অনুষ্ঠানের আগে সেজেগুজে আসতে হবে যে।
বেটন হোটেলে দুপুরের খাবার আয়োজন |
সন্ধ্যার আগেই পৌঁছে গেলাম সেজেগুজে। মূর্তির সামনে বসলাম কিছুক্ষণ, একটাই মূর্তি সেবার দেখলাম দুর্গা পুজোয়, আর তাতেই যেন হাজার মূর্তি দেখবার সাধ মিটল। কত লোকের সাথে আলাপ হল, বিভিন্ন জায়গা থেকে আসা বাঙালি, তাঁরা কেউ আমেরিকায় কর্মসূত্রে বা পড়তে আবার কেউ পরম্পরা ধরে এদেশে। বাংলাদেশের, অনেক পরিবারের আলাপ হল। অনুষ্ঠানের পর্বে বেশ কিছু স্থানীয় লোকেদের দারুণ প্রোগ্রামের পর শ্রীরাধা ব্যানার্জীর অসম্ভব সুন্দর গানে আমরা মোহিত। সে সময় উৎপলেন্দু চৌধুরী তার লোক গীতি আর তার সাথে মন-মাতানো কথা বলা, সেই নদীর গানের সাথে, ওনার দুই মেয়ে তিস্তা আর তোরসাকে মনে করলেন। সেই শুনে আমার মন চলে গেলো আমার মায়ের কাছে। অপূর্ব সেই পুজোর অনুষ্ঠানে মন তখন আনন্দে থই থই, ভাবছিলাম এতো হাজার হাজার মাইল দূরে সীমানা ছাড়িয়ে কত দেশের থাকা বাঙালিরা এক মায়ের টানে একসাথে আর চারিদিকে তখন ‘আনন্দধারা বহিছে ভুবনে’…।।
দারুণ লিখেছিস তোর মধুর আনন্দময় অভিজ্ঞতা।সাথে ছবিদুটোও দারুণ।
উত্তরমুছুনThank you do
উত্তরমুছুনDidi khub Khushi holam
উত্তরমুছুন