1 / 7
2 / 7
3 / 7
4 / 7
5 / 7
6 / 7
7 / 7

পূজা মৈত্র : সাহিত্য চেতনা



    চক্রসম্ভব   

 •  ডঃ পূজা মৈত্র


পর্ব – ০১ 


অফিসের কেবিনে চুপচাপ বসে ছিল অনিরুদ্ধ। সন্ধ্যা ছ’টা বাজে। প্রায় সবাই বাড়ি চলে গেছে। ও আছে বলেই কয়েকজন যেতে পারছে না। এবার উঠতে হবে। ওর না হয় বাড়ি যাওয়ার তাড়া নেই। কিন্তু অন্যদের আছে। সবারই বাবা,মা,স্ত্রী,সন্তান,পরিবার থাকে। মধ্য ত্রিশে থাকাটাই স্বাভাবিক। অথচ অনিরুদ্ধর নেই। মা,বাবা ওর বছর চব্বিশেই গত। তাদের ফেলে যাওয়া ব্যবসার সাম্রাজ্যের উত্তরাধিকার বহন করতে করতে অনিরুদ্ধ এখন পঁয়ত্রিশ। সাম্রাজ্য বেড়েছে বহুগুণ। বিলেত ফেরৎ এমবিএ অনিরুদ্ধ। ডিগ্রি বৃথা যায়নি। অনিরুদ্ধর চব্বিশ বছর বয়সেই একটা অ্যাকসিডেন্টে ওর বাবা-মা চলে যাওয়ার পর কাকা অনিরুদ্ধকে ছোট ভেবে ব্যবসা গ্রাস করতে চেয়েও পারেনি। কাকাদের বাড়ি অনিরুদ্ধর বাড়ির লাগোয়া। অবশ্য দুটোই ঠিক বাড়ি নয়। প্রাসাদ। ম্যানসন। মুখার্জী অ্যান্ড সন্সের তিন পুরুষের জুয়েলারি ব্যবসা। ঠাকুরদা কলকাতায় রসায়ন নিয়ে পড়ে আর গ্রামের জমিদারিতে আটকে থাকতে চাননি। এক অপুত্রক বনেদী স্বর্ণ ব্যবসায়ীর নেকনজরে পড়ে ব্যবসার হাতেখড়ি। তিনি তার মেয়ের সাথে বিয়েও দিতে চেয়েছিলেন শিক্ষিত,সুদর্শন,ব্রাহ্মণ ঠাকুরদার সাথে। গ্রামের রীতি অনুযায়ী ঠাকুরদা ষোলো বছরেই বিবাহিত ছিলেন বলে ব্যাপারটা হয়নি। কিন্তু স্বর্ণবণিক ভদ্রলোকের স্নেহ আর গাইডেন্সে ব্যবসা খুলে ফেলেন। অবশ্য ঠাকুরদা পরে ঋণ চুকিয়েছিলেন। ঐ ভদ্রলোকের মেয়ের একমাত্র মেয়ের সাথে নিজের বড়ছেলে অমিতের বিয়ে দিয়েছিলেন। অমিত অর্থাৎ অনিরুদ্ধর বাবা। আর স্বর্ণ সাম্রাজ্যের সম্রাটের নাতনি অনিরুদ্ধর মা। আদরে,বৈভবে মানুষ অনিরুদ্ধর মা। সংসারে অমনোযোগী। খামখেয়ালি,জেদিই ছিলেন। মায়ের খেয়াল আর কাকার ইচ্ছাতেই বাবা আর কাকার আমলেই ব্যবসাটা ভাগ হয়েছে। কাকা শ্বশুরবাড়ির সম্পত্তি আর এই ভাগ মিলিয়ে বেশকয়েকটা নতুন শোরুম করেছে। তাও বছর পনেরো হলো। কিন্তু জমাতে পারেনি। এখনো মূল দোকানের আর শাখাদেরই রমরমা। গড়িয়াহাটের মোড়েই অত বড় মূল শোরুমটা দেখলে অন্যত্র যাবে কি করে। নামের আগে ছোট করে একটা আদি বসিয়ে নিয়েছে অনিরুদ্ধ। ব্যাস। তাছাড়া তিন পুরুষের গুডউইল। ঠাকুরদা,বাবার সুনাম,ভদ্রতা এটাও ভাবনার বিষয়। তার ফলটা অনিরুদ্ধই পাচ্ছে। এই নিয়ে কাকার দুই ছেলে অতীন আর অনুপমের বিশেষ করে ব্যবসায়ী অতীনের যে ক্ষোভ নেই তা নয়। কাকারও আছে। সুঁচ হয়ে তাই অনিরুদ্ধকে সাপোর্ট করবে বলে এই ব্যবসায় ঢুকতে চেয়েছিলেন। সদ্য যৌবনে পড়া অনির কাছে বুদ্ধিতে হেরে চলে যেতে হবে ভাবেনি। এই নিয়ে কাকা চারিদিকে নানা কুৎসাও করে বেড়িয়েছে। তাতে অনিরুদ্ধর কিছু এসে যায়নি। সফল ব্যবসায়ীকে অন্যরা হিংসা করেই থাকে।


তবে একটা বিষয়ে অনেক পিছিয়ে গেছে অনিরুদ্ধ। হেরেই গেছে বলা যায়। খাদে পড়ে গেছে। আর ওঠার উপায় নেই। উঠতে চাইলে যে যে রাস্তা ধরতে হবে-তার একটাও অনিরুদ্ধর শিক্ষা,অনিরুদ্ধর বোধ, অনিরুদ্ধর রুচি অ্যালাউ করে না। বিগত ছ’মাসে এ নিয়ে নিজের সাথে নিজে অনেক কথা বলেছে অনিরুদ্ধ। অনেকের উপদেশ কানে এসেছে। অথচ নিজের সিদ্ধান্তে স্থির আছে। এখনও। আর থাকবেও। উৎসব চলে গেছে। দেড় বছর হল। উৎসব অনিরুদ্ধর একমাত্র সন্তান। তিনদিনের জ্বরে ভুগে-হঠাৎ। সাড়ে চার বছর বয়স ছিল তখন। মারাত্মক ডেঙ্গু জ্বর ছিলো ওটা-এখন বোঝে অনিরুদ্ধ। ডাক্তার ডেথ সার্টিফিকেটে লিখেছিল ফিভার উইথ থ্রম্বোসাইটোপেনিয়া। থ্রম্বোসাইট মানে প্লেটলেট। ওটা কমে যাওয়াতেই যত বিপ্ততি। চারিদিক থেকে ব্লিডিং শুরু হল। হঠাৎ। সমস্ত জায়গা থেকে। নাক,মুখ,স্টুল,ইউরিন। বেস্ট ডক্টর,বেস্ট নার্সিংহোম,বেস্ট ফ্যাসিলিটিও আটকাতে পারলো না। তিনদিনের লড়াই এক শ্রাবণ সন্ধ্যায় আচমকাই শেষ হয়ে গিয়েছিল। নীরা অনিরুদ্ধর স্ত্রী। তিনদিন জলটুকুও না খেয়ে ছেলের শিয়রে বসেছিলো। নীরা এই আচমকা শেষ হয়ে যাওয়াটা বোঝেনা। আজও বোঝে না বাবিন চলে গেছে,যেখানে গেছে-আর ফিরবে না। বাবিন,উৎসবের ডাকনাম। অনিরুদ্ধ অনেক বুঝিয়েছে। শুধু অনিরুদ্ধই কেন। নীরার মা,বাবা সমস্ত আত্মীয়রা। কিন্তু নীরা তার বিশ্বাস থেকে একচুলও বেরোতে রাজি নয়। তার স্থির বিশ্বাস-বাবিন কোথাও ঘুরতে গেছে। গিয়ে পথ হারিয়ে ফেলেছে। একদিন না একদিন ঠিক ফিরবে। সারাদিন বাবিনের ছবি নিয়ে বসে থাকা,ছবির সাথে কথা বলব,তাকে খাওয়ানো-এই নিয়ে দিন চলে যায় নীরার। একটা ঘরে নিজেকে বন্দী করে রেখেছে। বিছিন্ন দ্বীপের মত। অনিরুদ্ধ আর মণিপিসি ছাড়া সেখানে সবার প্রবেশ নিষেধ। মণিপিসি বাড়ির পুরনো কাজের লোক। সারা বাড়িতে কাজের লোকের অভাব নেই-দুইজন রাঁধুনি,ড্রাইভার দু’জন,চারজন সিকিউরিটি গার্ড,মালি দু’জন,কেয়ারটেকার দু’জন,ধোপা,সর্বক্ষণের কাজের নিধুকাকা-বাড়িতে গিজগিজ করছে সবাই। তাদের আলাদা সার্ভেন্ট কোয়ার্টার আছে। মূল ফটক লাগোয়া। মণিপিসি নিধু কাকা,রাধুনিরা মূল বাড়ির একতলার সিঙ্গেলরুমগুলোতে থাকে। তাও বাড়িটা ফাঁকা। বড্ড ফাঁকা লাগে অনিরুদ্ধর। ফিরতে ইচ্ছা করে না। ফিরবেই বা করে কাছে। নীরা তো নিজের জগৎ-এ ব্যস্ত। অনিরুদ্ধর সাথে কথা বলার বা ফিরে তাকাবার ফুরসৎ তার নেই। অনিরুদ্ধও এখন হতোদ্যম হয়ে পড়েছে বলা চলে। নীরার মাতৃমূর্তি’কে বিব্রত ও কখনোই করেনি। বাবিন চলে যাবার পর থেকেই ওদের স্বাভাবিক দাম্পত্য ছিন্ন হয়েছে। জোর করে নীরাকে পাওয়ার চেষ্টা বা রুচি অনিরুদ্ধর ছিলো না কখনোই। এখনো নেই। তবে এখন ওর ঘরে যাওয়াটাও কমতে কমতে দিনে একবারে এসে ঠেকেছে। ঐ শোকের আবহে যেতে ভালো লাগে না অনিরুদ্ধর। উৎসব ওরও সন্তান ছিলো। সে চলে যাওয়ায় অনিরুদ্ধর জীবনও ভীষণভাবেই ফাঁকা। তাই ঐ ঘর,ছেলের ছবি,নীরার ছেলেকে নিয়ে গল্প-এড়িয়ে চলতে শুরু করেছে ও। ওখানে গেলেই মনটা হু হু করে। নিজের এত সাফল্যের মধ্যেও সবচেয়ে বড় অসম্পূর্ণতা আয়না হয়ে ভেসে ওঠে।

অতীন ফোন করেছিলো। অনুপমের ছেলে হয়েছে। এটা দ্বিতীয়। আগেরটা উৎসবের থেকে তিন বছরের ছোট। অবিন নাম তার অতীনের দুই সন্তান। বড়টা ছেলে। অতীনের বড় জন উৎসবের থেকে বছর খানেকের ছোট ছিলো। আর ছোটটা মেয়ে। বছর তিনেক বয়স ভারী মিষ্টি। অনিরুদ্ধ ছোটটাকে পরী বলে ডাকে। ঐ বাড়িতে একমাত্র ঐ পুচকিটাই জেঠুমণির ন্যাওটা। দুটোবাড়ির দুর্গাপুজোটা এখনো একসাথেই হয়। মূলত কাকিমণির উদ্যোগেই। কাকিমণি কখনোই এই আলাদা হওয়াটা চাননি। দুর্গাপুজোটা ধরে রেখেছেন তাই। কাকিমণিও স্বর্ণব্যবসায়ীর একমাত্র মেয়ে। কত ফারাক! ওখানে চারটে দিন অনিরুদ্ধর কোলেই ছিলো পরী। অনিরুদ্ধর মনে হয়েছিল ঐ চারটে দিন যেন না কাটে। উৎসব হবার সময়েও মেয়েই চেয়েছিল অনিরুদ্ধ। পরীর মতো সুন্দর ফুটফুটে মেয়ে। সারাদিন জেঠুমণি,জেঠুমণি করে ভরিয়ে রেখেছিলো। অনিরুদ্ধ ওর চুল বেঁধে দিয়েছে। হেয়ারব্যান্ড পরিয়ে দিয়েছে। নিজের হাতে খাইয়ে দিয়েছে...নীরা কখনো মেয়ে চায়নি। বরাবরই ছেলের শখ ছিলো ওর। উৎসব হতেই নীরার আনন্দ যেন বাঁধ মানেনি। একটু বেশিই মা হয়েছিল নীরা। এখন মনে হয় অনিরুদ্ধর।


-নীরা যদি আবার কোর্টে যাতায়াত শুরু করে...


নীরার বাবা হাইকোর্টের উকিল। বড় মাপের। নীরাও ওকালতি পাশ। বিয়ের আগে প্র্যাকটিস-ও করতো। এমনকি কনসিভ করার আগে অবধি কোর্টে যেত। কনসিভ করার পর নিজে থেকেই ছেড়ে দিলো। অনিরুদ্ধ একবারো ছাড়তে বলেনি। বরং উৎসব বছর দুয়েকের হবার পর থেকে বারবার উৎসাহ দিয়েছে আবার প্র্যাকটিস শুরু করতে। নীরা চায়নি। আসলে উৎসবের বড় হবার একটা মুহূর্তও মনে হয় ও মিস্‌ করতে চায়নি। উৎসব ভীষণ চঞ্চল ছিলো। দুষ্টুই বলা যায়। একদণ্ডও স্থির থাকতে পারতো না। নীরা ছাড়া কারোর পক্ষে ওকে সামলে রাখাই মুশকিল ছিলো। অনিরুদ্ধও পারত না। বকাঝকা করে ফেলতো। দুই একবার মেরেওছে। কিন্তু নীরা কখনোই উৎসবকে বকেনি। মারাতো দূরের কথা। অনিরুদ্ধ শাসন করলে অনিরুদ্ধর সাথে কথা বন্ধ করে দিত নীরা। শেষে অনিরুদ্ধই বাধ্য হত সরি বলতে। সবারই ঠারেঠোরে একটাই বক্তব্য ছিলো উৎসব বখে যাবে-এবং নীরার প্রশ্রয়েই। অনিরুদ্ধও যে সেটা বুঝতো না,তা নয়। কিন্তু চাইতো আরো একটু বড় হোক উৎসব। তারপর নিজে হাল ধরবে। বাপিকে উৎসব সমঝে চলতো। বাপির সামনে বেলাগাম দুষ্টুমি করা যায় না,এই বোধটা ছিলো ওর।


সাইকিয়াট্রিস্ট ডক্টর চক্রবর্তী প্রায় বিগত দেড় বছর ধরে নীরাকে দেখেছেন। অনিরুদ্ধদের ফ্যামিলি ফিজিশিয়ান রুদ্রদেব ব্যানার্জী। ডক্টর ব্যানার্জীকে ছোট থেকে দেখেছে অনিরুদ্ধ। ডাক্তার কাকা বলে অভ্যস্ত। ডাক্তারকাকার পরামর্শই ডক্টর চক্রবর্ত্তীর কাছে আসা। উনি যেভাবে বলেছেন এই দেড় বছর অনিরুদ্ধ চলেছে। নীরারযত্ন,ওষুধপত্র-কোনটাতেই খামতি হয়নি। অথচ কোন লক্ষ্যণীয় উন্নতি নেই। মরবিড গ্রিফটা স্থায়ী ডিপ্রেশনে পর্যবসিত হয়েছে বলে ডাক্তারের অভিমত। তার সাথে নীরা এখন হ্যালুশিনেটও করছে। একলা দুপুরে বাবিনের ছবির সাথে কথা বলে নীরা। মণিপিসি দেখে অনিরুদ্ধকে বলেছিলেন। অনিরুদ্ধও খেয়াল করেছে। রবিবারে-হ্যাঁ,ঠিকই। অনিরুদ্ধ বোঝাতে চেয়েছে বাবিন নেই...নীরা আগে শুনত। এখন এই নেই টাকে নিতে পারে না আর। রেগে যায়। অনিরুদ্ধকে ঘর থেকে চলে যেতে বলে। অনিরুদ্ধ ঘরে এলে যেন ওর শান্তি ভঙ্গ হয়। এমতাবস্থায় অনিরুদ্ধ গতকাল নীরার বাবা-মা’কে নিয়ে এসেছিলো ডক্টর চক্রবর্ত্তীর চেম্বারে। নীরার বাবার প্রস্তাবটা শুনে ডক্টর চক্রবর্ত্তী হাসলেন,

-উকিলবাবু,আপনার মেয়ে ডিটোরিয়েট করছে। এমতাবস্থায় কোর্ট...!


-ওষুধে কী তাহলে কোন কাজই দিচ্ছে না?


নীরার বাবা নিমেষ অধৈর্য হলেন।


-ওষুধের একটা লিমিটেশন আছে। সাহেব।


ডঃচক্রবর্ত্তী হাসলেন,


-নীরার প্রয়োজন সন্তান। ওষুধ কী করবে?


নীরার মা অনিরুদ্ধর দিকে তাকালেন। জামাই-এর সামনে বলতে সংকোচ হলেও সুনয়না বলেই ফেললেন,


-বাচ্চা এলেই,মানে কনসিভ করলেই তো ভালো হয় তাহলে।


-এই শরীরে তা-ও কী সম্ভব?


ডাক্তারকাকাও ছিলেন।


-নীরা নিজে ঠিক মতো খাওয়া-দাওয়া করতে পারে না-সারাদিন বাবিন বাবিন ওর হিমোগ্লোবিন এখন সাড়ে আট। চেহারা ভাঙছে। সব কী আর ওষুধ আর সাপ্লিমেন্ট ঢাকা যায়?

-এক্সাক্টলি। তাছাড়া সাইকিয়াট্রিক মেডিসিনের সাইড এফেক্টও আছে। কনসিভ করলে বেবি কতটা সুস্থ হবে তা নিয়েও সংশয় আছে।

অনিরুদ্ধ চুপ করে ছিলো।


মা,বাবা বলে ও শ্বশুর শাশুড়িকে। তাদের সামনে কীভাবে বলবে যে কনসিভ করাটা সম্ভব নয় কারণ নীরা আর অনিরুদ্ধ গত দেড় বছর একঘরে শোয়নি। ডাক্তারকাকা জানেন। উনিই বললেন,


-তাছাড়া অনি হয়তো বলতে পারছে না-নীরা আর অনির দাম্পত্য বলেও গত দেড় বছর কিছুই নেই আদতে।


নিমেষ অবাক হলেন


-সেকি! না-না! এটা ঠিক নয়। অনিরুদ্ধ তো ভিক্টিমাইস হচ্ছে এতে। ওদের কনজুগাল লাইফ...


-বাবা,থাক সেসব।


-থাকবে কেন? এটাও পার্ট অফ লাইফ। নীরাকে নিয়ে কী তুমি অখুশি,অনি? তাহলে বলো আমরা নিয়ে যাবো। কী-বা বয়স তোমার। তুমি চাইলে ডিভোর্স দিয়ে বিয়ে করো আবার।


অনিরুদ্ধর বুকে তীরের মত লাগে কথাটা। নীরা আর অনিরুদ্ধর অ্যারেঞ্জড ম্যারেজ। সাড়ে সাত বছরের দাম্পত্য। নীরা ওর বিবাহিত স্ত্রী। ওর দায়িত্ব। অথচ কত সহজেই সবাই ভাবে অনি নীরাকে চাইলেই ছেড়ে দিতে পারে। এই পরামর্শ বন্ধুদের থেকেও পেয়েছে। কাকার থেকে তো বটেই। অথচ ছেড়ে দেওয়াটা অসম্ভব। নীরাকে ভালোবাসে অনিরুদ্ধ। ওর ব্যবহারে হয়তো বিরক্ত হয়। এড়িয়ে যায়-তবে ওকে ছেড়ে আর একটা বিয়ে...সম্ভব নয়।

-বাবা আপনার মেয়ে তো আমার বিবাহিতা স্ত্রী। তার হাত যখন বিশ্বাস করে আমাকে সঁপেচেন,তখন একটু ভরসা রাখুন। আমরা এখানে আমার কনজুগাল লাইফ নয় নীরাকে নিয়ে আলোচনা করতে এসেছি। তাই না?


অনিরুদ্ধর কথায় নিমেষ চুপ করলেন। সুনয়না বললেন,


-উপায় কী তবে?


-কনসিভ করার আরো একটা নেগেটিভ দিক আছে মা। নীরা মেয়ে চায় না। কনসিভ করে মেয়ে হলে...


-সে কি! ও নিজেও তো মেয়ে। আমাদের একমাত্র মেয়ে। এমন শিক্ষা পেলো কোত্থেকে!


সুনয়না অবাক হল।


-অনি তুমি নীরার কাছে যাওয়াটা কবে থেকে কমিয়েছো?


অনিরুদ্ধ তাকালো


-নীরা বলছে ডাক্তার কাকা?


-বলছিলো কাল। তুমি নাকি দিনে একবার আসো।


বাবিনের খোঁজ ভালো করে নাও না। ওর সারাদিনের গল্প শোনো না।


অনিরুদ্ধ হাসে,


-সেই তো এক গল্প। অফিস থেকে ফিরে...


-তবুও যেতে হবে মিস্টার মুখার্জ্জী। হাল ছাড়লে হবে না। আপনি যাচ্ছেন না এটা কিন্তু নীরা নোটিশ করেছে। গেলে খুশি হবে।


-যাবো।


-আর এবার থেকে ওর হ্যাঁ এ হ্যাঁ মেলান ক’দিন। এই যে আপনি বোঝান বাবিন কোথাও নেই-আর আসবে না। এটা নীরা মেনে নেয় না। ভাবে আপনি ওকে বাবিনের থেকে দূরে রাখতে চান।


-তবে মিথ্যা কথা বলতে বলছেন?


-মিথ্যা নয়। মন ভোলানো। কাস্টমারদেরও তো ভোলান নাকি?


অনিরুদ্ধ হাসল


-বেশ। যা চান তাই হবে। কিন্তু এটা করলেই নীরা আমাকে বলবে বাবিনকে এনে দিতে। বাবিনকে কোথা থেকে পাবো বলুন তো?


ডক্টর চক্রবর্তী বললেন,


-ভাবছি সেটা নিয়েও।


-ছোট বাচ্চাকে তো ও বাবিন মানবে না...ডাক্তারকাকা।


-দেখছি ডক্টর ব্যানার্জ্জী। আগে অনি আর নীরার মধ্যে দূরত্বটা কমুক।


গতকালের পর থেকে আজ অবধি দূরত্ব কমাতে মন যায়নি অনিরুদ্ধর কিন্তু আজ অফিস থেকে ফিরে যাবে ও। নীরার কাছে। গড়িয়াহাটে দোকানের তিনতলায় ওর অফিস। ওর সেক্রেটারী,ডিজাইনার,অ্যাকাউন্ট্যান্ট,ডাটা এন্ট্রি,ক্লার্ক-সবাই তিনতলাতেই বসে। এখন দু-তিনজন বাদে সবাই চলে গেছে। ওদের ডিউটি অফিস আওয়ার্সে। দোকান খোলা সকাল দশটা থেকে সন্ধ্যা আটটা। অনুপমের খবরটা শুনে উপরে খুশি দেখালেও মনে মনে একটা খারাপ লাগা জমেছে অনিরুদ্ধর। অনুপম বছর চারেকের ছোট ওর থেকে। ওরও দুটো সন্তান হয়ে গেল। এদিকে অনিরুদ্ধর শূন্য। এত বড় দোকান,এত বড় বিজনেস-এত টার্নওভার থেকেও...নেই কিছুই। নীরা যদি কখনোই না সারে তবে? ভেবেই কেঁপে ওঠে অনিরুদ্ধ। এসবই অতীন,অনুপমের ছেলেদের হবে। না,না। তেমন হলে পরীকেইও সব দিয়ে যাবে। পরীটাই যা ওকে একটু ভালোবাসে। নিজের চিন্তায় নিজেই অবাক হলো অনিরুদ্ধ। নীরা তো সবে বত্রিশ। ও সেরে উঠবেই। উঠতেই হবে। অনিরুদ্ধর ফোকাস সেটাই হওয়া উচিৎ। তা না ভেবে ও এসব অবান্তর! ছি ছি! হোয়াটঅ্যাপটাকে চেক করলো একবার অনিরুদ্ধ। কলেজের গ্রুপে থেকে। বার বি কিউ এ ডাকছে সবাই। গেটটুদেগারের জন্য। ওহ আজ শনিবার। সাপ্তাহিক হ্যাং আউটের ডেট। অনি আগে যেত। এখন যায়না। সবাই তাই ওকেই বেশি করে ডাকে। অনি এড়িয়ে যায়। আজ তো আরোই যাওয়া চলবে না। নীরার কাছে ফিরতে হবে ওকে। ফিরতেই হবে।


পর্ব – ০২ 


দোকান থেকে বেরোবার সময় হঠাৎ একটা চেনামুখ দেখলো অনিরুদ্ধ। ফেসবুকে দেখেছে মেয়েটাকে ওর ফ্রেন্ডলিস্টে চলে এসেছিলো কীভাবে কে জানে! অনি ভাবতে চেষ্টা করলো। বছর তেইশেকের মেয়ে দেখেই বোঝা যায় ভীষণ চঞ্চল আর চটপটে। এখানে কী জন্য? গয়না কিনতে? শাঁওলি নামটা মনে পড়লো অনিরুদ্ধর। ওর স্কুলের বন্ধু প্রতীকের খুড়তুতো বোন মনে হয়। অত খেয়াল করেনি অনিরুদ্ধ। কলেজে পড়তো জানে। এখন মনে হয় কলেজ শেষ। বিয়ে নাকি? কৌতূহলী হলো অনিরুদ্ধ। প্রতীক বলেনি তো? অনিরুদ্ধ ফেসবুক প্রোফাইলে ব্যবসার নামধাম উল্লেখ করে না। খুব লিমিটেড বন্ধু রাখে। শাঁওলি ওকে তাই দাদার বন্ধু হিসাবেই চেনে। মেসেঞ্জারে টুকটাক ফ্লার্ট মতো করতো বছর দুই তিন আগে। কিন্তু অনিরুদ্ধর পাত্তা না পেয়ে চুপ করে গেছে। ছিপছিপে চেহারা মেয়েটার। রোগাটে গড়ন। কোঁকড়ানো স্টেপ কাট চুল। গায়ের রং চাপা। দূর থেকে দেখেই অনিরুদ্ধ বুঝলো কোন জিনিস ভারী পছন্দ হয়েছে-অথচ বাজেট কম। কৌতূহলী হল। ইশারায় স্টাফকে বললো চুপ থাকতে। সবাই স্যারকে দেখে তটস্থ ছিলো।


-আটে এটা আসবে না,না?


-নো ম্যাম। এটা বারো হাজার তিনশো সাতান্ন।


আড় চোখে অনিরুদ্ধ দেখলো শাঁওলি সোনার কানের দুল দেখছে।


-ওহ। আটে কিছু...


বলেই তাকালো শাঁওলি। অবাক হল,


-আরে অনিদা-তুমি?


-তুই প্রতীকের বোন না?


-হ্যাঁ তো। ভুলেই গেছো। কত যেতে আমাদের বাড়ি।


অনিরুদ্ধ হাসলো,


-মনে থাকবে কী করে-তুই তখন কত ছোট ছিলি।


-এমা! আমি তো তোমার ফেসবুকেও আছি গো।


-তাই?


-এ বাবা! কবে থেকে। তুমি খেয়ালই করেনি।


অনিরুদ্ধ বললো,


-তা হবে। কানের দুল কিনবি?


-হ্যাঁ গো। চাকরি পেয়ে ফার্স্ট মাসের স্যালারি দিয়ে মায়ের জন্য।


অনিরুদ্ধর নিজেকে ভীষণ হতভাগ্য মনে হলো। ও তো মা’কে কিছু দিতেই পারেনি। মেয়েটাকে নিরাশ করবে না স্থির করলো।


-কিন্তু যা দেখি বাজেটেই আসছে না।


-তাই? কত বাজেট?


-আট গো।


-মাইনে বারো পাই। যাতায়াতের জন্য চার রাখতে হবে।


-কোথায় পেলি?


-একটা মিশনারী স্কুলে।


বাহ। মাস্টার্স করেছিস?


-হ্যাঁ। বি এড-ও করেছি। ডিস্ট্যান্সে।


-আপনি একটু দেখুন না-আটে ভালো কিছু নিশ্চয় আসবে। স্টাফকে চোখের ইশারা করে বললো অনিরুদ্ধ। সে হন্তদন্ত হয়ে ভিতরে গেলো। ট্যাগ চেঞ্জ করে আনবে।


-তুমিও গয়না কিনতে?


-হুঁ? হ্যাঁ রে...


-বৌদির জন্য,না?


অনিরুদ্ধ থমকালো। শেষ কবে নীরাকে গয়না নিয়ে গিয়ে উপহার দিয়েছিলো ও!


মনেই পড়ে না।


-হ্যাঁ।


-কী নেবে?


-বৌদি আসেনি?


-বৌদির শরীরটা ভালো নেই।


-এমা! কী হলো? জানো তো তোমাকে একটু আধটু অন্যরকমের টেকস্ট করে ফেলেছিলাম।


-অন্যরকমের বলতে?


-ফ্লার্টিং।


-ওহ।


-সরি। তখন তো জানতাম না বৌদি আছে। দাদার বন্ধু আর হ্যান্ডসাম দেখেই...


-বৌদি আছে কে বললো?


-কেন? আমার দাদা! তোমার তো ছেলেও আছে একটা,তাই না?


অনিরুদ্ধর চোখ পাশের কাউন্টারের স্টাফের দিকে পড়লো। সে অবাক হয়ে শুনেছিলো। চোখ নামিয়ে নিলো।


-আছে না,ছিলো।


-মানে?


-ম্যাম-এগুলো দেখুন...


শাঁওলির মন ওদিকে ঘুরলো।


পছন্দও হলো একটা।


-এটা ভালো অনি দা?


-পছন্দ তোর?


-হ্যাঁ। মা’কে মানাবে?


অনিন্দ হাসলো।


-বেশ মানাবে।


-নিই তবে?


-নে।


-ক্যাশ না কার্ড ম্যাম?


-ক্যাশ-না না কার্ড কার্ড...একাউন্টে পে ঢুকেছে তো।


অনিরুদ্ধ মুচকি হাসলো।


শাঁওলি বিল করতে গেলে অনিরুদ্ধ ম্যানেজার কাকাকে বললো


-নীরার জন্য একটা ডায়মন্ড নেকলেস দেখে দিন না কাকা।


-এখনই নিয়ে যাবে,অনি?


-হ্যাঁ।


-দাঁড়াও,দেখে দিই।


-আপনার যেটা সবচেয়ে ভালো মনে হবে দিন কাকা।


-সেতো বটেই অনি। বৌমা তো দোকানে এসে কোনদিন কিছু নেন নি। আগে বড়গিন্নী রোজই কিছু না কিছু নিতেন। ছোট গিন্নী অবশ্য তেমন আসতেন না।


-কাকিমণির অত গয়নার শখ নেই কাকা। মায়ের ছিলো। নীরারও নেই।

-তোমার বাবাও খুব পরাতে ভালোবাসতেন তোমার মা’কে। তুমি এই প্রথম নিচ্ছো।


অনিরুদ্ধ থমকালো। বাবা মা’কে খুব ভালোবাসতেন। অনিরুদ্ধও কী নীরাকে কম ভালোবাসে? অথচ প্রকাশের কতটা ভিন্নতা। নীরা তাই মনে হয় ভাবে অনি ওকে ভালোইবাসে না। ভালবাসলে বলাটা,বোঝানোটাও জরুরী। বেশ বুঝতে পারছে অনিরুদ্ধ।


-অনিদা-চলো।


-কোথায় রে?


-চলো বাইরেটায় ভালো ফুচকা বসে।


-আমাকে খাওয়াবি?


-এমা! চাকরি পেলাম। তুমি দাদার বন্ধু। খাওয়াবে না?


অনিরুদ্ধ দোকান থেকে বেরিয়ে গাড়িতে উঠতে যাচ্ছিলো,শাঁওলি পিছু টেনে ধরলো।


-আর তোমার জন্যই তো ওরা রেঞ্জের জিনিস দেখালো। নাহলে তো বারোর নীচে দেখাচ্ছিলই না। পচা দোকান।


অনিরুদ্ধ হাসলো,


তুই যা,আমি ফুচকা খাই না। খুব একটা


শাঁওলি অনিরুদ্ধর হাত ধরল,


-খাবে না মানে? চলো-খেতেই হবে। হলে তুমি বড়লোক আর আমি গরিব-তা বলে খাবে না!


অনিরুদ্ধর ড্রাইভার অবাক হচ্ছে গিয়েছিলো। সামনের ফুচকাওয়ালা অনিরুদ্ধকে চেনে। মুখটিকে হাসছিলো।


-আচ্ছা। খাবো খাওয়া।


শাঁওলিকে কষ্ট দিলো না অনিরুদ্ধ। ওর মন রাখতে পেট ভরে ফুচকা খোলা। বহুদিন পর। কলেজের পরে এই প্রথম বোধহয়।


-কত হলো?


-শো রুপিয়া।


-দেখলে-দিব্যি পঞ্চাশটাকার খেয়ে নিলে-এদিকে নাকি খাও না।


টাকা দিয়ে বলল শাঁওলি।


অনিরুদ্ধ রুমালে মুখ মুছলো।


-কোথায় যাবি?


-বাড়ি।


-চল ড্রপ করে দিই।


-তোমার কষ্ট হবে তো...


-না পথেই পড়বে।


-চলো তবে। বৌদির নেকলেসটাও দেখে নেবো যেতে যেতে।


-বেশ।


-একদিন বৌদিকে দেখাও। খুব সুন্দর না? তোমার ফেসবুকে ছবি নেই?


অনিরুদ্ধ গাড়ির দরজা খুলে ভেতরে যেতে বললো শাঁওলিকে। নিজেও ভেতরে গেলো।


-ছবি দাও না কেন?


-বৌদি পছন্দ করে না ছবিটবি দেওয়া,তাই।


-ইস! তুমি বৌকে লুকিয়ে রাখতে চাও,বুঝি। দেখাও না।


অনিরুদ্ধ মোবাইলের ওয়াল পেপারটা দেখালো। নীরার ছবি। স্ক্রিনসেভারে ছেলের ছবিও আছে।


-সুন্দর?


-খুব।


-কই-আমার তো তেমন মনে হয় না।


-হয়,হয়। না হলে অন্যকারোর মেসেঞ্জারে রিপ্লাই দাও না?


অনিরুদ্ধ হেসে ফেললো


-পাকা বুড়ি হয়ে গেছিস তো।


-হব না? এখন স্কুল মিস্ট্রেস। আর তুমি সেই গোমড়ামুখোটাই রয়ে গেছো।


-আমি গোমড়ামুখো? কে বললো?


ছোট থেকেই দেখেছি। সবাই লাফাতো ঝাঁপাত হই হই করতো। তুমি চুপচাপ।


-মনে পড়ে তোর? কতটুকু ছিলি।


-ক্রাশ হবার বয়স হয়ে গিয়েছিলো।


অনিরুদ্ধ অবাক হলো।


-ক্রাশ?


-কাউকে বলিনি অনিদা। তোমাকেই বলছি। তুমি আমার ফার্স্ট অ্যান্ড লাস্ট ক্রাশ। বুঝলে? অনিরুদ্ধ বুঝলো শৈশবের প্রীতি। সহজে ভোলার নয়।


-বয়ফ্রন্ডের নাম কী?


-ধুর,সেসব নেই।


-সেকি!


-আগে ভালো কোন জব পাই-তারপর ভাববো।


-এই তো পেয়েছিস।


-এতে কাজ চলে?


-কততে চলে?


-পঞ্চাশ কম করে।


-বেশ।


-কী বেশ? এমন ভাব করলে তুমি পঞ্চাশ হাজারের জব দিয়ে দেবে আমাকে।


অনিরুদ্ধ হাসলো


-দিতেও পারি।


-কী করে? তুমি থোড়ি শিল্পপতি।


-নই,তা জানলি কী করে?


-হলে দাদা বলতো। আর অত বড়লোক থোড়ি আমাদের বাড়ি আসে?


অনিরুদ্ধ শাঁওলির মাথায় আদরের হাত রাখলো,


-তোর যদি মনে না হয় তাহলে নই।


-ইস্‌!


-কী হলো?


-লোকের ক্রাশ প্রথম টাচ করছে তাও দাদার মতো করে... কী দুর্ভাগ্য!


-দাদার মত কান মুলে দেবো ভালো হবে?


-দারুন হবে। এই অনিদা-তুমি আমার স্কুল দেখতে আসবে একদিন?


-গেলে কী বলে পরিচয় দিবি-আমার ক্রাশ এসেছে?


শাঁওলি হাসলো


-না,না। এমনিই মনে হলো তোমাকে যেতে বলি।


-আচ্ছা যাবো একদিন।


-তোমার নম্বরটা দাও।


অনিরুদ্ধ একটুও ইতস্তত না করে নম্বরটা দিলো।


-এটাই হোয়াটঅ্যাপ?


-হ্যাঁ।


-এবার বলো তোমার ছেলের কথা কত বড় হলো।


অনিরুদ্ধ থমকালো।


আবার উৎসবের প্রসঙ্গ। আড়চোখে দেখলো ড্রাইভারেরও কান খাড়া। তাও বলতে হবে। থেমে থেমে বললো,


-আমার ছেলে দেড় বছর আগে তিনদিনের জ্বরে ভুগে মারা গেছে।


শাঁওলি ভীষণ অবাক হলো


-সে কি!


-হ্যাঁ রে।


-এমা! তিনদিনের জ্বরে...কী জ্বর?


-মনে হয় ডেঙ্গু।


-এ বাবা! সরি অনিদা। আমি জানতাম না।


-বুঝেছি।


-বৌদির খুব কষ্ট। তাই না? মা তো।


-কেন মায়েদেরই কী শুধু কষ্ট হয়? বাবাদের হতে নেই?


শাঁওলি অনিরুদ্ধর হাত ধরলো


-বাবারা যে স্ট্রং হয়। তোমার মতো বাবারা মায়েদের আগলে রাখে। যেমন তুমি বৌদিকে রাখছো।


অনিরুদ্ধ অবাক হলো। ও কী নীরাকে আগলে রাখছে,আদৌ? নাকি অবসাদের গহ্বরে একা ছেড়ে রেখেছে। আগলে রাখাটা উচিৎ এইটুকু মেয়েও বোঝে। অথচ অনিরুদ্ধ নীরার থেকে সরে এসেছে। ঠিক করেনি ও। একদমই ঠিক করেনি। সমস্ত ভুলগুলোকে শুধরে নিতে হবে এবার।




পর্ব – ৩ 


-অনিকে বললি?

বাবার কথা শুনে তাকালো অতীন।

-কী?

-অনুপমের ছেলে হলো যে।

-হ্যাঁ বললাম তো।

অনিরুদ্ধর কাকা অচ্যুত তাকালেন।

-কী বললো?

-কনগ্র্যাচুলেশন জানালো। আর কী-বা বলবে।

-ভিতরে ভিতরে যা জ্বলছে না...

অতীন বলেই ফেললো। অচ্যুত অতীনের আনন্দের কারণ বুঝলো।

-জ্বলবেই স্বাভাবিক। বংশের অভিশাপে,ও-ই নির্বংশ হয়ে মরবে,দেখিস।

বলেই থামলেন। অতীন বাবাকে কিছু জিজ্ঞাসা করার আগেই দেখতে পেলো অতীনের মা আসছে। অনিরুদ্ধর কাকিমণি। ছোট থেকে অনিকে খুব ভালোবাসতেন সুহাসিনী। এসব কথা সইবে না।

-অনুপম ফিরলো?

-না,মা-আজ সল্টলেকেই থাকবে।

-মুখুজ্জে বাড়ির ছেলেরা শ্বশুরবাড়ি থাকছেও আজকাল?

-এতদূর যে...

অচ্যুত বললেন।

-থাক। তুমি সাফাই দিও না। অনিকে দেখেছ কখনো থেকেছে?

সুহাসিনী বললেন।

-মা,তোমার এই সবেতে দাদাভাইএর সাথে তুলনা কী আর যাবে না?

-ভালো উদাহরণ দেবো না তবে?

-ভালো? এতই ভালো যে বৌকে সামলাতে পারে না। ছেলের শোকে পাগল হয়ে গেছে বৌ আর উনি পুরুষমানুষ হয়ে তাকে ভোলাতে পারছেন না।

অতীন বললো,

-জোর করা সব পুরুষমানুষের অভ্যাস হয়না অতীন।

সুহাসিনী অতীনকে থামিয়ে দিলেন।

-ছোটকর্তার তো আর একটা নাতি বাড়লো। মুখে হাসি নেই যে?

-আর হাসি। অনির প্রসঙ্গ তুলে তো মুডটাই খারাপ করে দিলে।

সুহাসিনী হাসলেন,

-ঠিক আছে। আমি উঠি। তোমরা ভালো মুডে কথা বলো বাপ-ছেলেতে।

-মনে হয় অনুপমের থেকে অনির ছেলে হলে তুমি বেশি খুশি হতে।

অচ্যুত চাপা গলায় বললেন। সুহাসিনীর কান এড়ালো না।

-বেশি,কম বুঝি না। খুশি হতুম। আর হবেও। কতই বা বয়স অনি-নীরার। ঈশ্বর চাইলে একটা কেন,দুটো হবে।

ক্ষুব্ধ অচ্যুত আর অতীনকে রেখে চলে গেলেন সুহাসিনী। গেলে অতীন বললো

-বৌদিমণি কি ঠিক হবে আর?

-ধুর কোন আশা নেই। পাগল ভালো হয় শুনেছিস। গারদে দিতে হবে।

-সেটা তো দাদাভাই দেবে না।

-জানি তো। আবার ডিভোর্স দিয়ে বিয়েও করবে না। ছেলে মেয়ে হবে কোত্থেকে?

-যদি সত্যিই না হয়? লিগ্যালি তো পুরোটাই আমরা পাবো।

-আলবাৎ। তোর ছেলে,অনুপমের ছেলেই তো পাবে সব।

-দাদাভাই কিন্তু পরীকে বেশি ভালোবাসে।

জানি তো। তোরা তো গর্দভ। সুযোগ নিতে জানিস না। পাশেরই তো বাড়ি। মেয়েটাকে অনির কাছে একটু দিয়ে আসতেও তো পারিস।

অতীন একটু ভাবলো। তারপর বললো,

-মন্দ বলোনি।

-তবে? এখন ওদের সন্তান দরকার। যদি পরীকে দত্তক নিয়ে নেয়। ক্ষতি কি?

-কী বলছো?

অতীন চমকে ওঠে।

-পরী আমার মেয়ে।

-রাখ তো। তোর মেয়ে সম্পত্তি পাবে,পুরোটা। তুই-ও ভোগ করতে পারবি। বুঝলি?

অতীন আর তর্ক করলো না। বাবা যেটা বলেছে সেটারও লজিক আছে। কিন্তু পরীর মা-মানবে কী? বলে দেখবে অতীন। জিনা প্র্যাকটিক্যাল মেয়ে। মানতেও পারে।


পর্ব – ৪ 


অনিরুদ্ধ অফিস থেকে এসে ফ্রেশ হয়েই নীরার ঘরে গেল। নীরা খাটের উপর বসেছিল। চুপচাপ। অনিরুদ্ধ এসে নীরার পাশে বসলো।

-খেয়েছ?

-ওষুধ?

-না,লাঞ্চ?

-খেয়েছি। বাবিনকে খাইয়েওছি।

-বেশ। কী বললো বাবিন?

-বললো আর অল্প কাজ আছে-চলে আসবে।

অনিরুদ্ধ নীরার পিঠে হাত রাখলো। ওর কপালের নেমে আসা চুল সরিয়ে দিয়ে বললো

-বেশ।

-বাবিন আসবে তুমিও জানো,তাই না?

-অনিরুদ্ধ হাসলো,

-জানি তো।

-তাহলে বকতে কেন আমাকে এতদিন?

-তুমি খেতে না যে।

অনিরুদ্ধ ভোলালো।

-আজ খেয়েছি বলেই বলছো?

অনিরুদ্ধ নীরার গালে চুমু খেলো।

-তুমি নিজের যত্ন নিলে বাবিন তাড়াতাড়ি চলে আসবে।

-সত্যি?

নীরার ঘোলাটে চোখ দুটোতে আলোর ঝিলিক দেখতে পেলো অনিরুদ্ধ।

-সত্যি। আজ তোমার জন্য একটা গিফট এনেছি। নীরা অবাক হলো

-গিফট!

-হুঁ। দেখবে?

-কই? চোখ বন্ধ করো।

-আমি বাবিন নাকি?

অনিরুদ্ধ হাসল,

-বাবিনের থেকেও ছোট।

-ইস্‌!

নীরা চোখ বন্ধ করলো।

-তাকাও এবার।

অনিরুদ্ধ নেকলেসের সেটটা খুলে ধরেছিলো।

-নেকলেস!

-হ্যাঁ।

-ডায়মন্ড তো।

-হ্যাঁ।

-অনেক দামী তো,অনি?

অনিরুদ্ধ হেসে ফেললো

-তাতে কী? আমার বৌটাও তো দামী।

-না অনি,এসব পাগলামো করো না। আমি কোথায় বেরোই বলো? লাগবে না এসব।

-বেরোবে নীরা।

অনিরুদ্ধ নীরাকে নেকলেসটা নিজে হাতে পরিয়ে দেয়। নীরার পিঠে চুমু খায় তারপর।

-বাবিন আসুক বেরোবো।

আবার বাবিন...অনিরুদ্ধ রাগলো না।

-তা বেশ। নীরা দেখো কী সুন্দর লাগছে তোমায়-আয়নায়...

নীরা দেখলো।

-একটু সাজগোজ করবে,বুঝলে? বাবিন তো পছন্দ করে তোমার সাজগোজ।

-হ্যাঁ-কোথাও বেরোলে ভালো করে সেজেগুজে বেরোতে হবে মামণিকে।

-তাহলে? তুমি না সাজলে হয়!

-ঠিক বলেছো?

অনিরুদ্ধ নীরাকে আবার চুমু খেলো।

-আজ রাতে এখানে থাকতে দেবে?

নীরা অবাক চোখে তাকায়,

-তোমার ঘর তুমি থাকবে।

-তোমার ডিস্টার্ব হবে না তো?

-না,না তিনজনে শুয়ে পড়বো। বাবিন মাঝে কিন্তু।

অনিরুদ্ধ মেনে নিলো

-বেশ। নীরা,বাবিনের ভাইবোন হলে কেমন হবে?

-ভাইবোন!

-হ্যাঁ। জানো আজ অনুপমের আবার ছেলে হলো। সেকেন্ড টাইম।

-তাই? বাহ,কিন্তু বাবিনের ভাইবোন হলে বাবিন যত্ন পাবে না যে...

অনিরুদ্ধ তর্ক করলো না,

-তাও ঠিক। ধরো,বাবিনই ছোট হয়ে এলো।

-ছোট্ট হয়ে...কী করে। যেমন গেছে তেমন আসবে। এখন তো ছয় বছর বয়স।

-বাবিন ফিরে এলে নেবে?

-কী?

-আর একটা?

-আসুক আগে।

-এলে কিন্তু চাইবো তোমার থেকে।

-তুমি নিয়ে এসো আগে দুষ্টুটাকে। মা’কে ফেলে কোথায় না কোথায় লুকিয়ে বসে আছে। ভাবছে খুব জব্দ করেছি মামণিকে।

-তোমার কাছে আসে তো।

-কখন?

নীরা অবাক হয়।

-কেন? দুপুরে? ওর সাথে কথা বলো,খাওয়াও।

-সেতো ছবিটাকে। ও আসে না।

নীরার মুখ ছোট হয়ে যায়।

-ছবি জেনেও খাওয়াও?

অনিরুদ্ধ জানতে চায়।

-খাওয়াবো না? বাবিন কোথায় আছে,কার কাছে আছে,কী খাচ্ছে-এসব চিন্তা সবসময় হয় যে। মুখচোরা ছেলে। মা না খাওয়ালে খায় না। ওখানে কেউ কী আছে বলো যে খাইয়ে দেবে খিদে পেয়েছে বুঝে?

অনিরুদ্ধ চশমা খুলে চোখ মুছলো।

-তাই তুমি খাইয়ে দাও?

-হ্যাঁ। ভুল করি?

-নাহ। কিন্তু নিজেও খাবে। ডাক্তারকাকা বলছিলেন তোমার হিমোগ্লোবিন খুব কম।

নীরা হাসে,

-খাই তো। ডাক্তারকাকা আর কিছু বলেননি?

অনিরুদ্ধ নীরার হাতে হাত রাখে,

-বলেছেন। বকেছেন আমাকে। কাজ কাজ করে সোনাকে সময় দিই না বলে।

-ঠিক করেছেন।

-তুমি চাও আমি সময় দিই,তাই না?

-বোঝ না?

-বুঝি তো। মাঝে কাজের জন্য কিভাবে ভুলে ছিলাম কে জানে?

-কাজের চাপ খুব,অনি?

অনিরুদ্ধ মিথ্যাই বললো,

-খু-উ-ব।

-ওহ,আমি ভাবতাম আমাকে এড়িয়ে যাচ্ছো।

-এড়াবো কেন? এই যে তোমার কথা শুনিনা। বাবিন নেই বলো তুমি,মানতে পারি না।

অনিরুদ্ধ নীরার ঠোঁটে আঙুল দিয়ে চুপ করিয়ে দিলো। ঠোঁটে ঠোঁট দিয়ে গভীর ভাবে চুমু খেলো তারপর।

-তোমাকে এড়িয়ে যাবো কোথায়?

নীরা অনিরুদ্ধকে জড়িয়ে ধরলো। বুকে মাথা রাখলো।

-রাতে থাকবো কিন্তু।

-থেকো।

-বাবিনকে মাঝে রেখেই...

-হুম। কাড়াকাড়ি কোরো তারপর। কার দিকে ঘেঁষে শোবে দুষ্টুটা।

অনিরুদ্ধ হাসলো। নীরাকে বকে নয়,ভালোবেসে সহজ করতে হবে। এটা বুঝেছে ও।

রাতে অনিরুদ্ধ শুতে এসে দেখে বিছানার মাঝে পাশবালিশ।

-বাবিন ঘুমিয়ে গেছে?

-এই ঘুমালো।

বকতে হলো?

-না,না। তুমিও শোও। ঘুমিয়ে পড়ো।

অনিরুদ্ধ শুলো। পাশবালিশটাকে একটু আদর করলো।

-বাবিনকে ওপাশে দিয়ে দিই?

-না থাক না।

-একটু দিই...

অনিরুদ্ধ পাশবালিশটাকে সরিয়ে দিল। নীরার কাছে গেলো। বহুদিন পর নীরাকে এত কাছে পেয়ে অনিরুদ্ধর শরীর জেগেছে। নীরার বুকের আঁচল সরিয়ে দিলো অনিরুদ্ধ।

-কী করছো!

-কিছু না,সোনা!

ব্লাউজের হুকগুলো খুলে দিলো অনিরুদ্ধ। নীরা রাতে অন্তর্বাস পরে না। স্তন দুটো বেরিয়ে এলো। অনিরুদ্ধ স্তন দুটোতে হাত দিলো। মুখ লাগিয়ে দিলো একটাতে।

-অনি...

অনিরুদ্ধ বললো,

-উ...

-ছাড়ো

-না ছাড়বো না।

অনিরুদ্ধ নিজের দখলদারি বাড়ালো।

-ছাড়ো বলছি। এই জন্যই এখানে শোবার ইচ্ছা না তোমার। ঠিক বুঝেছি। যত বলছি যে বাবিন আছে...তাও...সন্ধ্যা থেকে মিষ্টি মিষ্টি কথার আসল কারণ এটা।

অনিরুদ্ধ থামলো। কষ্ট হলেও ব্রেক কষলো। নীরার স্তনে দুটো চুমু খেয়ে ব্লাউজ আটকে শাড়ি ঠিক করে দিলো।

-তুমি বললে,থেমে গেলাম।

-ও ঘরে যাও।

অনিরুদ্ধ হাসলো,

-নাহ,আর অমন করবো না। একটু ঘুমাই?

-বাবিনকে মাঝে দাও।

অনিরুদ্ধ দিলো,পাশবালিশটাকে।

-হয়েছে? এবার শুতে পারি তো?

নীরা পাশবালিশটাকে আঁকড়ে ধরলো। অসংখ্য চুমু খেলো।

-হয়েছে,ছেলেকে আদর করা? এবার ঘুমাও,সোনা।

-তুমিও ঘুমাও।

অনিরুদ্ধ পাশবালিশ সমেত নীরাকে জড়িয়ে ধরলো। নীরা সহজেই ঘুমিয়ে গেলো। নীরার প্রত্যাখ্যানে অনিরুদ্ধর শরীর আর মন দুই-ই জেগে রইলো।

ঘুম ভেঙ্গে অনিরুদ্ধ অবাক হল। নীরা ওর বুকের মধ্যে রয়েছে। অনিরুদ্ধকে আঁকড়ে ধরে ঘুমোচ্ছে। অনিরুদ্ধর সব রাগ জল হয়ে গেল যেন। নাহ। দোষটা ওরই। একদিন কাছে এসেই নীরার শরীর পেতে অত তাড়াহুড়ো করা উচিৎ হয়নি। নীরা এতে ভুল বুঝবে ওকে। নীরাকে সুস্থ করতে হলে নীরার মনে কোন চাপ দেওয়া যাবে না। অনিরুদ্ধ ঘুমন্ত নীরাকে দেখলো। দিব্যি অনিরুদ্ধর বুকের মধ্যে ঘুমোচ্ছে নিশ্চিন্তে,ভরসা করে তবে। নীরার মুখটা বড্ড নিষ্পাপ লাগছে আজ। অনিরুদ্ধ নীরাকে আদর করলো। আলতো আদর। কপালে,নাকে,দুগালে-নীরা চোখ খুললো। অনিরুদ্ধ বিব্রত হলো। ওষুধ খেয়ে ঘুমোয় মেয়েটা। ঘুম ভালোভাবে না হলে বিপদ।

-সরি।

নীরা হাসলো,

-উঠে পড়েছো?

-হ্যাঁ।

-অফিস আছে?

-উঁহু। আজ সানডে।

-তাহলে আর একটু ঘুমোও।

অনিরুদ্ধ হাসলো,

-আটটা বাজে। তুমি ঘুমোও। আমি উঠি এবার।

নীরার অনিরুদ্ধর গলা জড়িয়ে ধরলো। অনিরুদ্ধ বুঝলো নীরা চায় ও থাকুক।

-থাকবো?

-হ্যাঁ।

-আচ্ছা। থাকছি তবে।

-উঠেই বা কী করবে? সানডে তো। অবশ্য তোমার যদি না ক্লাব,পার্টি,ক্লায়েন্ট ডিল থাকে।

অনিরুদ্ধ নীরার নাকে নাক ঘষলো,

-কিছু নেই ক্লাব,পার্টি,গেটটুগেদারে গত দেড় বছর যাইনি নীরা।

-বাবিন চলে যাবার পর যাওনি?

অনিরুদ্ধ নীরার মাথাটা নিজের বুকের উপর টেনে আনলো।

-যাবো কী করে? আমার কষ্টটাও তো তোমার সমান।

তাহলে কোথায় থাকতে?

নীরা অবাক হয়।

-আমার ঘরে। কখনো গার্ডেনে,গার্ডেনিং করতাম,কখনো স্টাডিতে।

-এ ঘরে আসতে না কেন?

অনিরুদ্ধ নীরার অভিমান ভাঙাতে চাইলো

-বুঝতামই না যে নীরা আমাকে এতটা কাছে চায়।

-কাছে নয়। পাশে। 

-ঐ আজ কোথাও বেরবে?

-কোথায়?

নীরা আকাশ থেকে পড়লো

-এদিক সেদিক। বিয়ের পর পর যেতাম যেমন।

-বাবিন?

-বাবিনকে নিয়ে যাবে?

-না,না,যদি বাবিন ফিরে এসে বাপিকে মামনিকে খোঁজে আর না পায়?

-তাই তো। তবে বাড়িতেই থাকি। সোনা,তুমি লাঞ্চে কী খাবে?

-মণিপিসিতো জানেই।

-আজ ভাবছি লাঞ্চটা আমি নিজে হাতে করবো,হবে?

-মানে রান্না?

-হ্যাঁ। বিলেতে করতুম যেমন।

-সে তো ন-দশ বছর আগে। এখন ভুলে গোছা নির্ঘাৎ।

-ভোলে নাকি কেউ? দেখাই না-একদিন।

-একটা শর্ত।

-বলো।

-উপরের কিচেনে ট্রাইকরবে। আর আমিও থাকবো।

অনিরুদ্ধ মনে মনে খুশি হলো। ঘরের বাইরে বেরোতে চেয়েছে নীরা। এটাই অনেক।

-তোমার কষ্ট হবে যে। ওষুধপত্র চলে। ক্লান্ত থাকো।

-তোমাকে রান্না করে খাওয়াতে কষ্ট হবে আমার,অনি?

-হবে। তুমি বসে থাকবে। আমি রান্না করবো,কেমন?

-আচ্ছা। বেশি ঝাল দেবে না,বাবিন খাবে তো।

অনিরুদ্ধর মনটা মুচড়ে উঠলো। তাও মুখে হাসি বজায় রাখলো।

-ঝাল কমই দেবো। চিন্তা করো না।

নীরা খুশি হলো। অনিরুদ্ধ লুকিয়ে একটু দীর্ঘশ্বাস ফেললো।


পর্ব – ৫ 


-দ্যাখ দাদাভাই-কেমন হয়েছে?


শাঁওলি বাড়ি গিয়ে সব্বাইকে দেখিয়ে ফেলেছিলো মায়ের জন্য কেনা কানের দুলটা। প্রতীককেই দেখাতে পারেনি কেবল। প্রতীক ফার্মা কোম্পানির রিজিওন্যাল ম্যানেজার। অফিস ট্যুরে মাসে বাইশ-চব্বিশ দিন বাইরেই থাকে। আজই ফিরেছে। আর ফিরতেই শাঁওলির হাতে পাকড়াও লাঞ্চ টেবিলে। আজ সানডে। প্রতীক-শাঁওলিদের জয়েন্ট ফ্যামিলি। প্রতীকের বাবা শাঁওলির জেঠুমণি। প্রতীকের মা,শাঁওলির মা,প্রতীকের স্ত্রী,মেয়ে সবাই একসাথেই থাকে।


-বাহ। দারুন তো,তাই না মিত্রা?

মিত্রা শাঁওলির বৌদির নাম।

-বলেছি বোনুকে কালকেই। কিন্তু তোমাকে না দেখিয়ে শান্তি পায়না,জানোই তো।

শাঁওলির মা পরিবেশন করছিলেন।

-পুরো মাইনেটা উড়িয়ে দিয়ে এসেছে,মনে হচ্ছে।

-তুমি থামো তো মা। আট হাজার টাকা লেগেছে বলছি তো।

প্রতীক অবাক হলো। আট তো মনে হচ্ছে না। বারো-তেরোর কমে তো হবেই না। বাক্সের গায়ে নাম লেখা দেখলো। মুখার্জী অ্যান্ড সন্স। অনির দোকান।

-জানো দাদাভাই ওখানে তো দামী দামী জিনিস দেখাচ্ছিলো। বাজেট আট বলছি,তাও বারো-চোদ্দর...

-তারপর?

-ভাগ্যিস অনিরুদ্ধ দার সাথে দেখা হলো।

-অনির সাথে?

-হ্যাঁ,বৌদির জন্য গয়না কিনতে এসেছিলো।

প্রতীক হেসে ফেললো,

-ধুর বোকা মেয়ে। অনির নিজের দোকান ওটা। গড়িয়াহাটে মেইন ব্রাঞ্চ। এছাড়াও সারা পশ্চিমবঙ্গে গোটা কুড়ি-বাইশ ব্রাঞ্চ আছে।

শাঁওলি থ হয়ে গেল,

-অনিদার দোকান? কই বললো না তো? আমাকে বাড়িতে ড্রপ করে দিয়ে গেলো একবারো বললো না...

প্রতীক হাসলো,

-অনি অমনই। নিজের প্রাচুর্য প্রকাশ করতে চায় না। তা তোর অনিদার বলাতে কম বাজেটর দুল দেখালো?

-হ্যাঁ তো।

প্রতীক মিত্রাকে চোখের ইশারা করলো। মিত্রাও বুঝলো। মা-কাকিমা,বাবা কারুর সামনে বললো না।

-আমার স্কুলেও যাবে একদিন। স্কুল দেখতে।

-অনি তো আগে প্রায়ই আসতো এখানে তাই না,বাবু?

প্রতীকের বাবা বললেন।

-হ্যাঁ। এখন খুব ব্যস্ত,সময় পায়না। তাছাড়া সাড়ে চার বছরের জলজ্যান্ত ছেলেটা দেড় বছর আগে...

সবাই চুপ হয়ে গেলেন।

-ও হ্যাঁ,বলেছিলি তো।

প্রতীকের বাবা আস্তে করে বললেন।


-সেই থেকে আরো চুপচাপ হয়ে গেছে। কাজ আর বাড়ি। কোনো গেটটুগেদারেও যায় না।

শাঁওলি মনে মনে কষ্ট পেলো। গোমড়ামুখোটা আরো গোমরা থোরিয়াম হয়েছে তবে। শাঁওলি ওকে হাসাবে। যা হওয়ার তা তো হয়েই গেছে-তার জন্য চুপচাপ করে বাঁচার কী দরকার? পচা লোক একটা। আজই ফোন করবে একটা লোকটাকে।





পর্ব - ০৬

অনিরুদ্ধ নীরাকে রান্নাতে হাতও দিতে দেয়নি। নিজে যত্ন করে সমস্তটাই করেছিলো। মণিপিসি জোগাড় করে দিয়েছিলেন সব। সেই যত্ন করে করা খাবার নীরা নিজে খাবার আগে প্রতিদিনের মতো বাবিনের ছবিকে খাওচ্ছিলো। ফেলছিলো চারিদিকে। অনিরুদ্ধ দরজার কাছে দাঁড়িয়ে ছিলো। দেখছিলো সব। 


-বাবিন কবে আসবি সোনা? মামণিকে ভুলেই গেছিস না... কি বললি? আসবি? কবে বাবা? আর একটু কাজ আছে? আচ্ছা,খেয়ে নাও সকাল থেকে তো কিছুই খাওনি। বাপি রান্না করেছে। দেখো...


মণিপিসি অনিরুদ্ধকে চশমা খুলে চোখ মুছতে দেখলো। 


-এটা রোজকার ঘটনা অনি 


-এতদিন শুনেছি। আজ দেখছি। এতটাও জানাতে পারনি। 


-এই করতে গিয়ে নিজে খাবে না। আমি বকে বকে খাওয়াতে গেলে অভিমান হবে। 


মণিপিসি অভিভাবকের মতো। অনিরুদ্ধ,নীরাকে বকাঝকা করেন স্বাভাবিক দরকারে। 


-তারপর সারাদুপুর ছবিটা হাতে নিয়ে বকবক,গল্প-চলবেই। 


-আমি ফেরার সময় তো ঘুমোয় দেখি। 


-হ্যাঁ,দুপুরের ওষুধের প্রভাব। পাঁচটা থেকে ঘুমিয়ে পড়ে। রাত দশটায় ঠেলেঠুলে তুলে খাওয়াতে হয়। তখনও আগে বাবিন। তারপর নিজে। 


-রাতেরটা জানি। আমি আসি তো...


-হ্যাঁ। তুমি থাকো বলেই রাতে মাত্রাটা কম হয়। কিন্তু দুপুরে মাত্রা ছাড়া। 


অনিরুদ্ধ গুম হয়ে গেল। তাহলে কী বন্ধুরাই ঠিক? কাকাও তো বলছিলেন অ্যাসাইল্যামে দিতে। ভালো কিছু হবে না এর থেকে। অনিরুদ্ধর অবাক লাগে। আগের রবিবারগুলোতে ও পাশের ঘরে বা স্টাডিতে থেকেও এই মাত্রাছাড়া ব্যাপারটা বুঝতে পারেনি। অনিরুদ্ধরও কী দোষ নেই তাহলে? নিজে চেষ্টা করে না দেখে হাল ছাড়তে চায় না অনিরুদ্ধ। 


-নীরা,বাবিন খেয়ে নিয়েছে। চলো এবার তুমি খাবে চলো। 


অনিরুদ্ধ নরম সুরে বলল। 


-আরটু খাবে যে। 


-আচ্ছা। বলছে তোমায়?


-হ্যাঁ। মুখটা দেখো,পেট ভরেনি। 


-আরটুই কিন্তু। ব্যস। এবার চলো।


-এখানেই আনো না। 


অনিরুদ্ধ বললো, 


-বাবিন খেলো,ঘুমাবে না একটুও? ও রেস্ট করুক। আমরা খেয়ে আসি। না হলে বিরক্ত হবে। 


এই কথাটা নীরার মনে ধরলো,


-চলো।


অনিরুদ্ধদের মূল ডাইনিং হল নীচতলায়। নীরাকে নীচে নামিয়ে নিয়ে আসার নাই অনিরুদ্ধ এই ট্রিকটা করলো,না হলে রোজই তো ঘরে খায়। নীরার এঁটো হাত ধুইয়ে নীচে যেতে বলতেই নীরা বলেছিলো,


-নীচে গেলে তো চেঞ্জ করতে হবে অনি। ঘরে পরার শাড়ি... 


-করে নাও।


-শাড়ি? 


-চলো,আমি খুঁজে দিচ্ছি।


অনিরুদ্ধ নীরার কাবার্ড খুলে শাড়ি,ব্লাউজ,সায়া খুঁজে দিয়েছিলো। এই শাড়ির আলমারি ভীষণ গোছানো থাকতো অথচ বছর দেড়েক কোন শাড়িতে হাত পড়েনি। 


-নাও,পরে নাও। 


-তুমি বাইরে যাও। 


অনিরুদ্ধ হেসেছিলো,


-যাচ্ছি। কিন্তু কুঁচি ধরতে হলে? 


-ডেকে নেবো। এখন যাও। কুঁচি ধরতে ডাক পড়েছিলো। অনিরুদ্ধ এটা বরাবরই করে দেয়। আজ কুঁচির সাথে সাথে চুলটাও আঁচড়ে বেঁধে দিলো নিজে হাতে। 


-এটাও পারো?


-মায়ের করে দিতাম। আর সব কিছু শিখে রাখা ভালো।


নীরা মুগ্ধ চোখে তাকিয়ে ছিলো। 


-অত কী দেখছো? সাড়ে সাত বছরের পুরনো বর তোমার। 


নীরা লজ্জা পেয়েছিলো, 


-সিঁদুরের কৌটটা দাও। 


-দাঁড়াও। 


অনিরুদ্ধ নিজের হাতে সিঁদুর পরিয়ে দিয়েছিলো। পরপর দুই বছর বাড়ির পুজোয় নীরা যায়নি। বরণ করেনি,সিঁদুর খেলেনি। অতীন অনুপমের স্ত্রীদের যখন ওরা নিজে হাতে সিঁদুর পরিয়েছে-অদ্ভুত একটা শূন্যতা ভিড় করেছিলো অনিরুদ্ধর বুকে। আজ যেনো কষ্টটা কমলো। নীরা নমস্কার করতে গেলে থামিয়ে দিলো অনিরুদ্ধ। এটা ও কোনদিনই পছন্দ করে না। বিয়ের সময় স্ত্রী আচারে বাড়ির সবার সামনে দুই একবার হয়তো নীরার প্রণাম নিয়ে ফেলেছে-কিন্তু একান্তে কখনোই নয়। নীরার কপালে চুমু খেলো অনিরুদ্ধ। 


-নেকলেসটা পরিয়ে দাও। 


নীরা আব্দার করলো। অনিরুদ্ধ খুশি হলো। নেকলেস পরিয়ে দিয়ে বললো


-দেখো,কী সুন্দর লাগছে তোমাকে।


নীরা দেখলো। আয়নায় বহুদিন দেখেনি ও নিজেকে। 


-দুজনকে একসাথে কত ভালো লাগে,তাই না নীরা? 


-আর বাবিন? 


অনিরুদ্ধ মনের কষ্টটা মুখে আনলো না।


-তাহলে পরিপূর্ণতা আসে। 


হঠাৎ পরীর গলায় জেঠুমণি ডাক শুনে চমকে তাকালো অনিরুদ্ধ। পরী এসেছে। মণিপিসির সাথে দোতলাতেও চলে এসেছে। ঢুকতে গিয়েও জেঠিমণিকে দেখে থমকে গেলো পরী। জেঠিমণি খুব রাগী আর চুপচাপ। মায়েরা বলে,ও তো তেমন করে দেখেইনি। পুজোতেও আসে না জেঠিমণি। অনিরুদ্ধ পরীকে দেখে ভীষণ খুশি হলো,


-পরী,আয় ওখান দাঁড়িয়ে কেন? 


নীরা দেখালো পরীকে। অতীনের মেয়ে,বছর তিনেকের হয়ে গেছে। মনে হয় ওকে দেখে ভয় পাচ্ছে। 


-তুমি গিয়ে কোলে করে নিয়ে এসো।


অনিরুদ্ধ তাই করলো 


-কে দিয়ে গেলো? 


মণিপিসি বললো, 


-অতীন আর বৌমা। ওরা হাসপাতালে যাচ্ছে। অনুপমের ছেলে দেখতে। এত ছোট বাচ্চা তো...


-ও। বাহ খুব ভালো করেছে। কাকিমণিও ওখানে?


-হ্যাঁ,নীরাকে নিয়ে নীচে এসো অনি। খাবে তো।


অনিরুদ্ধ কোলে করে পরীকে নিয়ে নীরার কাছে এলো।


-জেঠিমণিকে চিনিস পরী?


-জেঠিমণি তো পুজোয় যায় না। দেখিনি। 


নীরা হেসে ফেললো,


-খুব টরটরে তো? 


-একদম। সারা পুজো আমার কোলে থাকে। 


জেঠুমণি কী বলো তো পরী? 


-বেস্ট। 


অনিরুদ্ধ পরীর দু’গালে চুমু খেলো, 


-জেঠিমণির কোলে যাবে? ইচ্ছা করেই বললো অনিরুদ্ধ। পরীর অমত ছিলো না। জেঠিমণিকে দেখে মোটেও রাগী মনে হচ্ছে না। খুব সুন্দর দেখতে। 


নীরা হাত বাড়ালো,


-এসো। 


পরী নীরার কোলে চলে গেল। নীরা বললো,


-কী মিষ্টি দেখতে হয়েছে। অনি,বাবিন রাগ করবে না তো? 


পরীর মুখের অবাক ভাব দেখে অনিরুদ্ধ সামলালো, 


-বাবিনের বোন তো। রাগ করবে কেন?


পরীর মায়ের কাছ থেকে শোনা যে জেঠুমণির ছেলের নাম বাবিন,যে নাকি নেই। জেঠুমণি ঐ দাদাটার কথাটাই বলছে? 


-তাও। জানোই তো কী হিংসুটে। মামণির কোলে আর কেউ ... 


-ওসব ভেবো না। বাবিনকে আমি বুঝিয়ে দেবো। তোমার আদর করতে ইচ্ছা হচ্ছে খুব বুঝেছি,করো।


জেঠিমণি এবার সত্যিই আদর করল পরীকে। অনেক করে। কিন্তু যে নেই তাকে জেঠুমণি বোঝাবে কী করে? কথাটা জেঠুমণিকেই জিজ্ঞাসা করবে পরী,পরে।


-পরী,এবার দেখলি তো জেঠিমণি রাগী না একটুও।


অনিরুদ্ধ নীরার কোলে পরীকে দেখে খুব খুশি ছিল মনে মনে। পরী এভাবে এলে ভালোই হয়। নীরার সাথে থাকলে নীরার একাকীত্ব কমবে। 


-পরীকে মাঝে মাঝে আনতে পারো তো এখানে। 


নীরা নিজেই কথাটা তুললো।


-আচ্ছা,কাকিমণিকে বলে আনাবো। 


নীরার বেশ মনে ধরেছিল ফুটফুটে মেয়েটাকে। 


-আমি একাই আদর করবো। পরী আমাকে আদর করবে না?


নীরা পরীর চোখে চোখ রেখে বললো। পরী অনিরুদ্ধর দিকে তাকালো। অনিরুদ্ধ বললো,


-হামি চাইছে জেঠিমণি। 


পরী জেঠিমণিকে আদর করলো। তারপর জেঠুমণিকেও। নীরা হেসে ফেললো,


-দেখেছো-দুজনকেই আদর করে। বুদ্ধি আছে পরীর। 


অনিরুদ্ধ পরীকে কোলে নিলো এবার। 


-চলো,নীচে যাই-খাবে তো। 


নীরা বললো, 


-পরী খেয়ে এসেছে? 


-খেয়েছি। 


-আবার খাবি চল। 


অনিরুদ্ধ বললো, 


-আবার? মা তো নেই? খাওয়াবে কে? 


নীরা বললো,


-চলো,আমি খাওয়াচ্ছি। বাবিনদাদাকেও তো আমিই খাওয়াই। তাই না অনি?


-একদম। চলো। 


পর্ব-সাত


রাতে ঠাম্মার কাছে শুয়েছিলো পরী। ঠাকুরদাদা একই ঘরে অন্য খাটে ঘুমোয়। পরী বেশীরভাগই ঠাম্মার কাছে থাকে। ঠাম্মা পরীকে নানারকমের গল্প বলে। ও ঘরে মা,বাবা,দাদা-ওরা তেমন গল্প বলতেই চায় না। দুপুর থেকে ঠাম্মাকে একটা কথা বলবে বলে উসখুস করছিলো পরী। সুহাসিনী শুতে এলেই বললো, 


-ঠাম্মা জানো,আজ জেঠিমণির কাছে ছিলাম ক-তক্ষণ।


-তাই? জেঠিমণি ভালো?


-খু...উ...ব।


-বাহ। 


-জেঠুমণি,জেঠিমণি দুজনেই খুব ভালো। দারুন দারুন গল্প বলে। জেঠুমণি খেলেওছে আমার সাথে। জেঠিমণি বসে দেখেছে আর হেসেছে। 


সুহাসিনী বুঝলেন পরীকে অনির হাতে সঁপার জন্য অচুতের চালটা নীরার সুস্থতার জন্যও মন্দ কাজ করছে না। নীরা খুব ভালো মেয়ে। বিয়ে হয়ে এসে থেকে শাশুড়ির সবটুকু সম্মান সুহাসিনীকে দিয়েছে। কাকিশাশুড়ি যে-বুঝতে দেয়নি। 


-জেঠিমণি তাহলে রাগী না। দেখলি তো?


-একটুও না। তবে খালি বাবিনদাদার কথা বলে।


-সুহাসিনী বুঝলেন যে রটনাগুলো ঘটনা। বাবিনের শোক এখনও অতিক্রম করতে পারেনি নীরা। 


-বলবেই তো। বাবিনদা জেঠিমণির ছেলে ছিলো যে,


-কোথায় চলে গেছে, ঠাম্মা?


-অনেকদূরে,যেখান থেকে কেউ ফেরেনা।


-কিন্তু জেঠিমণি যে বললো বাবিনদাদাকে খাওয়ায়...


-পরী তুমি আমার ভালো দিদিভাই তো? 


-হ্যাঁ,ঠাম্মা। তাহলে জেঠিমণিকে বাবিনদাদা নিয়ে কিচ্ছু বলো না কেমন? 


-আচ্ছা। ঠাম্মা-ভাইটা কেমন হয়েছে গো? 


-সুন্দর হয়েছে। 


-আমার চেয়েও? 


সুহাসিনী হেসে ফেললেন,


-তা হয়? আমার দিদিভাই সবচেয়ে সুন্দর। 


-শুধু তুমিই বলো। মা,বাবা,ঠাকুরদাদা,কাকা সব্বাই দাদাভাইকে বেশি ভালোবাসে। 


সুহাসিনী বুঝলেন এইটুকু বাচ্চার নজরে কিছু এড়ায় না। 


-ঠাম্মা কাকে সবচেয়ে বেশি ভালোবাসে? 


পরী ঠাম্মার গলা জড়িয়ে ধরে, 


-পরীকে। 


-কেন?


-ঠাম্মার যে আমি একমাত্র দিদিভাই,তাই। 


সুহাসিনী নাতনির কপালে আদর করে দেন। 


-ঠিক। আর পরী একদম আমার মতো,তা-ও।


-দেখতে তো? সব্বাই বলে।


সুহাসিনী হাসল, 


-বলবেই,আমার পরী আমার ছাড়া কার মতো হবে? 


-মা?


বড় বৌমার গলা পেয়ে তাকালেন সুহাসিনী। 


-পরী ঘুমোয়নি?


-না-এই ঘুমোবে।


-এখনো গল্প? কত রাত হলো? কাল স্কুল আছে। 


পরী প্রাণপণে চোখে বন্ধ করেছিলো। সে একটা প্লে স্কুলে যায়,তা নিয়েই মা-বাবার চিন্তার অন্ত নেই। 


-ঘুমোবে,তুমি ঘুমিয়ে পড়ো। স্কুলে ঠিক পৌঁছবে। চিন্তা নেই। সুহাসিনীর গলার ভারী ভাব পরীর মা’কে ঘর থেকে চলে যেতে বাধ্য করলো। সুহাসিনী দাপুটে শাশুড়ি। বৌমারা কথা বলার সাহস পায় না। পরীর মা চলে গেলে সুহাসিনী বললেন,


-চোখ খোলো দিদিভাই। চলে গেছে। 


পরী ফিক করে হাসলো।


-যাবে না! কী বকাটাই না খেলো আমাকে বকতে এসে। 


-এমন বলে,পাকা বুড়ি? মা হয় যে।


পরী ঠাম্মাকে আঁকড়ে ধরে। বুকে মুখ গুঁজে দেয়। বলতে চায় ঠাম্মা থাকতে ও কাউকে চায় না। সুহাসিনী জানে কথাটা। সত্যি পরীটাকে হাতে করে সুহাসিনীই মানুষ করেছেন। অতীনের বৌ জিনা ছেলে নিয়েই ব্যস্ত। ছেলে আর বর। মেয়েটাকে তাই শাশুড়ির জিম্মায় দিয়ে নিশ্চিন্ত। সুহাসিনীরও মন্দ লাগে না। পরীটাকে ছেড়ে একমুহূর্ত ভালোও লাগে না ওনার। অনেকদিন বাঁচতে চান এখন। পরীটাকে মানুষ না করা অবধি মুক্তি নেই।


পর্ব-আট


-সময় নেই বললেই হবে? সময় বার করতে হবে। 


শাঁওলির কথা শুনে অনিরুদ্ধ বেশ মজা পায়। ছোট মুখে বড় কথা বলে ধমক দিতে চাইলেও,পারে না। হেসে ফেলে। 


-কিসের সময় শুনি?


-বেরোবার।


-কোথায়? 


-কোথাও। 


-আর অফিস?


-দেখো,সেদিন একে মিথ্যা বলেছো...


-মিথ্যা?


-হ্যাঁ। তুমি বললে তুমি অফিসে কাজ করো। অথচ তুমি ঐ পেল্লায় দোকানটার মালিক। এরকম নাকি আরো কুড়ি-বাইশটা আছে। 


অনিরুদ্ধ হেসে ফেলল। 


-কে বললো? প্রতীক?


-হ্যাঁ। মিথ্যা বলা মহাপাপ। জানো না।


-জানি তো। সরি।


-কমপেনসেট করো আগে। 


-বেড়িয়ে?


-নিজের জন্য। আমার জন্য থোড়ি? বৌদিকে নিয়ে গেলেও হবে। কিন্তু ঐ অফিস,মিটিং থেকে বেরোতে হবে তোমাকে। 


-বেশ, বেরবো।


-প্রমিস কিন্তু।


-প্রমিস। তোর স্কুলেই যাবো আগে। 


-এমা না,না।


-কেন রে? এই তো সেদিনই বললি আসতে। 


-তখন আমি থোড়ি জানতাম তুমি দি অনিরুদ্ধ মুখার্জ্জী? তোমার মত নামী লোক এলে হ্যাপা অনেক।


-নামী কেন তোর দাদা হয়েই আসবো তো? 


-আমার দাদা আছে।


অনিরুদ্ধ হেসে ফেলে,


-দাদা করবি না তাহলে? 


-আসবো। দাঁড়া ফোন আসছে একটা।


-ওকে টা টা।


অনিরুদ্ধ ফোনটা কাটলো। ডাক্তারকাকার ফোন। ধরলো। 


-হ্যাঁ ডাক্তারকাকা। 


-অনি নীরাকে সময় দিয়ে রেজাল্ট? 


-ভালো। তবে...


-তবে,বাবিনের ব্যাপারটায় কোন উন্নতি নেই। দুপুরে বাবিনের সাথে কথা বলা,খাওয়ানো,কান্না...


-বুঝি...। আর তোমাদের...ইউ নো


-না সেসবের ইচ্ছে নেই। আমিও জোর করিনি।


-সন্তান নেবার প্রস্তাব?


-দিয়েছি। কিন্তু তার উত্তর হলো-বাবিনকে এনে দিতে হবে,আগে। 


-জটিল ব্যাপার। যাকগে ডাক্তার চক্রবর্তী একবার ডেকেছেন তোমায়। নীরার কেসটা নিয়ে আমেরিকান মেন্টাল হেলথ অ্যাসোসিয়েশনে আলোচনা হয়েছে। সিমিলার কেস হিস্ট্রি পাওয়া গেছে। ঐ নিয়েই কথা বলতে চান। 


-বেশ,কখন? 


-সন্ধ্যা ছ’টায়। 


-আসবো।


-রাখছি? 


-রাখো।


সিমিলার কেস হিস্ট্রি! সলিউশন কী পাওয়া যাবে? অনিরুদ্ধ জানে না। জানতে চায় তবে। 


-সলিউশন আছে। ব্রাউনি দম্পতি এটা একিসকিউটও করেছেন সাকসেসফুলি।


ডক্টর চক্রবর্ত্তীর কথা শুনে কৌতুহলী হলো অনিরুদ্ধ। 


-ব্রাউনি দম্পতি?


-হ্যাঁ-ঐ সিমিলার কেস,বললাম না?


-ওদেরও কি ফার্স্ট চাইল্ড বাবিনের মতো...


-একস্যাক্টলি। সিডিতে এটাই আছে। আমি আপনাকে দেবো। বাড়িতে গিয়ে দেখবেন। তাও জিস্টটা বলছি। নীরার মতোই অবস্থা হয়েছিলো মিসেস ব্রাউনির। ওদের সাইক্রিয়াট্রিস্ট ডক্টর থমসন অ্যাসাইলামে দেওয়ারআগে একটা জুয়া খেলেন,অ্যান্ড দ্যাট পেইড অফ। 


-জুয়া?


ডাক্তারকাকা অবাক হন।


-হ্যাঁ,জুয়াই। আ বিগ গ্যাম্বেল। মি.ব্রাউনিকে বোঝান যে তার ওয়াইফের নতুন সন্তানের প্রয়োজন নেই। আগের সন্তানটিকেই প্রয়োজন। তাই যদি তার মতো কাউকে...


-তার মতো? কি করে? লুক ওয়াইজ সিমিলার। 


-পাওয়া যায়? 


-খুঁজলে বাঘের দুধ মেলে ডক্টর ব্যানার্জ্জী। তবে বয়সটাও কাছাকাছি হতে হবে। মানে বাবিনের রিপ্লেসমেন্ট যদি আমরা খুঁজি তবে সাড়ে চার প্লাস দের...ছয়ের আশপাশে খুঁজবো।


অনিরুদ্ধ আকাশ থেকে পড়লো। 


-বাবিনের রিপ্লেসমেন্ট খুঁজবো? কোথায়?


-কোন অরফ্যানেজে 


-খুঁজে? তাকে বাবিন বলে নিয়ে যেতে হবে নীরার কাছে? 


ডক্টর চক্রবর্ত্তী হাসলেন,


-একস্যাকটলি। 


-এতো মিথ্যা!


-তাই তো জুয়ো। তবে মিথ্যাটাকে সত্যি বলে প্রকাশ করতে হবে। আর মানতেও হবে।


ডাক্তারকাকা বললেন। 


-খুব শক্ত কাজ। অনি,পারবি তুই? 


অনিরুদ্ধর জন্মকালের সংস্কার ওকে দিয়ে বলিয়ে নিলো। 


-না,না-তা হয় নাকি। অরফ্যানেজের কার না কার বাচ্চা...তাকে বাবিন বলে মেনে,নীরার কাছে নিয়ে যাওয়া...অসম্ভব।


ডক্টর চক্রবর্ত্তী হাসলেন,


-জানতাম,আপনি অর্থোডক্স ফ্যামিলিতে মানুষ। কৌলীন্যবাদী। এমন চিন্তাভাবনা থাকবেই। তাহলে আর কি-নীরাকে আর একটু বেশি ওষুধ দিই-আর অপেক্ষা করি কবে অ্যাসাইলামে যাওয়ার মতো ডিটোরিয়েট করে। কারণ আমেরিকার সাইক্রিয়াট্রিস্টদেরও সেকেন্ড অপিনিয়ন এটাই। 


অনিরুদ্ধ প্রথমে উত্তেজিত হয়ে পড়েছিলো। নিজের ব্যবসায়ীক বুদ্ধি দিয়ে নিজেকে শান্ত করলো,


-আমাকে একটু ভাবতে সময় দিন। 


-ভাবুন। আপনি প্রস্তুত না থাকলে এই নাটকের অবতারণা করাই যাবে না। 


-মিসেস ব্রাউনি এখন সুস্থ?


-সম্পূর্ণ। সিডিতে দেখবেন। যাকে এডপ্ট করে এনেছিলো সে তো খুশি বটেই,পরে আবার সন্তান হয়েছিল। 


-আমি পরের ব্যাপার নিয়ে চিন্তিত নই ডাক্তারবাবু। যাকে আনবেন-তাকে আমার জেনে,মেনে,বুঝে দায়িত্ব নিতে পারলে তবেই আনবো। নীরাকে সুস্থ করতে একটা জীবনকে টোপ হিসাবে ব্যবহার করতে হবে। আমার অর্থোডক্স মেন্টালিটি এই টোপ দেওয়া ব্যাপারটাকেও ঠিক মানতে পারছে না। 


ডক্টর চক্রবর্ত্তী বললেন, 


-আগে আপনাকে তাকে সন্তান হিসাবেমানতে হবে মিস্টার মুখার্জী। এডপ্ট করতে হবে। বাকি ব্যাপার পরে হবে। 


-ঠিক আছে। কয়েকটা দিন সময় দিন আমাকে। সিডিটা দেখি। মনকে কয়েকটা প্রশ্ন করি,জানাবো। 


-নীরাকে কিন্তু এসব কিছুই বলবেন না। 


-নিশ্চিন্ত থাকুন আপনার রুগী কিছু জানবে না এসবের। 


অনিরুদ্ধ উঠে দাঁড়ালো। 


-চলি,


ডক্টর চক্রবর্ত্তী ঘাড় নাড়লেন,


-আসুন। 





পর্ব - ০৯

প্রস্তাবটার বাস্তবতা নিয়ে সন্দেহ ধীরে ধীরে কাটছিলো অনিরুদ্ধর। সিডিটা ভালো করে দেখলও। যা দেখাচ্ছে- তাতে পরিবারটা সুখেই আছে বেশ। একইরকম দেখতে বাচ্চা পাওয়া যাবে কী? পেলেও যেটা মূল সমস্যা তা হলো পরিবারকে মানানো। নীরার মা-বাবা মানলেও কাকিমণিরা... নাহ,কাকিমণি মানলেও বাকি কেউ মানবে বলে মনে হয় না। জাত,কুল,ধর্ম ইত্যাদি নানা অজুহাত তুলবে। যৌথ পুজো,পরীর আসা-যাওয়া-সবই বন্ধ হবে। অথচ এই জুয়োটা সফল হলে আবারো সব ঠিক হয়ে যাবে। 


-কী এত ভাবছো? নীরার গলা পেয়ে তাকালো অনিরুদ্ধ। নীরার ঘরেই শুয়েছিলো ও। ঘুম আসছিলো না। 


-কিছু না। তুমি ঘুমাও।


-ব্যবসার চিন্তা?


অনিরুদ্ধ ঘুরলো নীরার দিকে,


-না তো


-তবে? 


-এমনি। পরী এসেছিল আজ?


কথা খুঁজে না পেয়ে বললো অনিরুদ্ধ।


-হ্যাঁ,দুপুরে ছিল।


-একা?


-হ্যাঁ। আমার কাছেই ছিলো। 


-ঘুম? 


-এখানেই,দুজনকে দুপাশে নিয়ে ঘুমোচ্ছিলাম।


অনিরুদ্ধ খুশি হলো। 


-পরী যদি আমাদের মেয়ে হতো ভালো হতো না? 


-তোমার মেয়ের খুব শখ তাই না?


-হ্যাঁ,পরীর মতো মেয়ে,ভালোই তো।


-বাবিন আসুক।


-তারপর মেয়ে দেবে একটা?


অনিরুদ্ধ হেসে বললো,


-পরীকে রেখে দেবো না হয়,হবে? 


অনিরুদ্ধ যে মনে মনে তা চায় না তা নয়। কিন্তু ও বাড়ি থেকে ছাড়বে না। 


-এ ক’দিনেই বেশ মায়ায় জড়িয়েছে তোমায় বুঝতে পারছি। 


-ভারী মিষ্টি।


-তোমার না মেয়ে পছন্দ নয়? 


-পরীকে দেখে মনে হচ্ছে-এমন একটা মেয়ে থাকলে ভালো হয়। অবশ্য বাবিন না চাইলে...


অনিরুদ্ধ সায় দিলো,


-সেটাও কথা। আজ কথা হয়েছে দুষ্টুটার সাথে?


-হ্যাঁ...বলছিলো বাপি যে এখন এ ঘরে আসে সবাই এক খাটে ঘুমোয়-এটা ওর ভালো লাগে। 


অনিরুদ্ধ বুঝলো নিজের মনের ভাবনা বাবিনকে দিয়ে বলায় নীরা। 


-বাপিকে তো ভয় পায় বেশ। 


-হ্যাঁ-তুমি শাসন করো যে। 


-অনিরুদ্ধ হাসলো, 


-ওকে বলে দিও তো এলে আর শাসন করবো না। 


-বলবো? 


-একদম।


-তুমি ঠিক করে খুঁজছো তো অনি? 


অনিরুদ্ধ বুঝলো নীরার মন খুব ভালো এখন। নাহলে সচরাচর নাম ধরে না। 


-সবরকম ভাবে খুঁজছি। 


-তাহলে এই যে আগে বলতে ফিরবে না?


-ভুল ছিল সেসব নীরা বললাম তো।


-খুঁজে পাবে? 

-মনে হচ্ছে। পেলে তুমি নেবে তো নীরা? 

নীরা অবাক হয়,

-নেব না! আমার বাবিনকে নেবো না কেন? 

-না, কোথায় না কোথায় ছিলো-বড় হয়ে গেছে-হয়তো দেখতেও একটু বদলেছে...এই সময় মুখের পরিবর্তন হয় তো।

ডক্টর চক্রবর্ত্তীর প্ল্যানের পথ পরিষ্কার করে অনিরুদ্ধ।

-হোক না। আমি তো মা,ঠিক চিনে নেবো। 

ওটাই তো ভয়। মনে মনে বললো অনিরুদ্ধ। 



পর্ব - ১০


-পরীকে দাদাভাই-এর বাড়ি ইমপ্ল্যান্ট করার প্ল্যানটা তো ভালোই চালাচ্ছো।


অনুপমের মুখে এমন কথায় অচ্যুত,অতীন দুজনেই থমকে গেলো। অনুপম এমনই। নিজের মরজির মালিক। ব্যবসায় মন নেই। মা’কে ভয় পায় কেবল। সুহাসিনী ছোট ছেলের লাগাম ধরলেন,


-বাবার সাথে কথা বলছো,খেয়াল আছে। 


-আছে মা। বাবার শুধুই বড় ছেলে। আর দাদারও সবসময় ধান্দাবাজি


অতীন রাগ দেখলো,


-বাবা দেখেছো। কী ভাষা তোমার ছোট ছেলের। 


-ভাষা থেকে কি ভালো হবে। পরীর জন্য যেটা ভাবছো সেটা আমার ছোট ছেলেটার জন্যও তো ভাবা যেত। সদ্য হয়েছে। বৌদিমণি নিজে হাতে গড়ে নিতে পারতো। বাবিন ভেবেই গড়ে নিতো। 


অচ্যুত বললেন, 


-কী বলছিস ছোট খোকা। বাড়ির ছেলে দেওয়া যায় নাকি? পরী নেহাত...


-মেয়ে তাই তো? 


সুহাসিনী বললেন।


-তা পরীকেও যে তার ঠাম্মা কাউকে দিতে দেবে ভাবলে কী করে? 


অতীন বুঝলো এবার থামাতে হবে। 


-আঃ মা,বাবা। এত গাছে কাঁঠাল,গোঁফে তেল দিয়ে লাভ নেই। বৌদিমণি সুস্থই নয়।যদি সুস্থই না থাকে তাহলে কাউকে নেবেই বা কী করে। 


-সুস্থ হলে তো নিজেরটাই নিয়ে নেবে। গাধা।


অচ্যুত ধমকে বললেন। 


-যা করার এর মধ্যেই করতে হবে। 


-তুমি কি পরীকে পাকাপাকি ভাবে দিতে চাইছো নাকি?


সুহাসিনী বললেন।


-অনি নিতে চাইলে ক্ষতি কী? আর পরীও তো এখন জেঠিমণির সাথে ভালো মিশে গেছে। 


ওসব চিন্তা মনেও এনো না। ঘুরতে দেওয়া আর একেবারে দেওয়ার ফারাক আছে। 

-আহ! সবেতে নাক গলাও কেন বলো তো? যদি বড় খোকার আর বৌমার সমস্যা না থাকে তাহলে...? 


সুহাসিনী খাবার রেখে উঠে চলে গেলেন। অনুপম ডাকলো,


-মা...


-যেতে দে। তেজ কমলে নিজেই খাবে।


অচ্যুত খাওয়ায় মনোনিবেশ করলেন। 


সুহাসিনী রাতে শুয়ে নাতনিকে কোলের মধ্যে টেনে নিলেন। 


-ঠাম্মা...


-পরী জেগে এখনো?


-হ্যাঁ তুমি কেঁদো না। আমি তোমায় ছেড়ে কোথাও যাবো না। 


সুহাসিনী চোখের জল মুছলেন। 


-কে বললো তোকে? 


-দাদাভাই। মা বাবা এসব বলেছে,ও শুনেছে। 


সুহাসিনী নিজের অবোধ নাতনিটাকে অনেক আদর করে দিলেন। মা বাবার কাছে ও কত অবাঞ্ছিত-এখন বুঝলেও পরে বড় হয়ে বুঝতে পারবে। 


-জেঠুমণি,জেঠিমণি খুব ভালো ঠাম্মা। 


-জানি তো। 


আমাকে জেঠিমণিও সারক্ষণ যত্ন করে। মাটিতে পাই ফেলতে দেয়। আমি ওখানে যাই তো। কিন্তু ওরা যদি তোমাকেও নিয়ে যায়-তাহলেই পুরোপুরি যাবো। সুহাসিনী হেসে ফেললেন,

-কেন রে? 


-ওদের তো মা-ও নেই সুহাসিনী দীর্ঘশ্বাস ফেললেন। অনির মতো ছেলের মা হবার কপাল ওনার নেই। অথচ সবাই বলে যৌথ পরিবারে বেড়ে ওঠা অনি স্বভাবটা সুহাসিনীর মতোই পেয়েছে। শান্ত,ভদ্র-অথচ দৃঢ়। সুহাসিনী যখন বিয়ে করে এলেন অনি তখন বছরখানেক। দিদিভাই মানে অনির মা খুব সুন্দরী ছিলেন। নিজের সাজগোজ,ঘোরাফেরা,কিটিপার্টির ব্যস্ততা ওনার সবসময় থাকতো। তাছাড়া,প্রথম সন্তান মারা যাওয়ার পর সংসারের প্রতি আরো উদাসীন হয়ে যান দিদিভাই। প্রথম সন্তানও ছেলে ছিলো। অনির দাদা। সুহাসিনীর বিয়ের মাস দুয়েক আগে মারা যায়। তাই শ্বশুর-শাশুড়ি তড়িঘড়ি ছোট ছেলের বিয়ে দেন। অনিকে সামলানোর জন্যই বেশি করে। অনিকে সেই অর্থে সুহাসিনীই মানুষ করেছেন। অথচ সুহাসিনীর সে স্বীকৃতি কোথায়। 


-আমি তো বড়,আমাকে নেবে কী করে? 


-তুমি যাবে? জেঠুমণিকে বললেই নিয়ে যাবে। 


সে কথা সুহাসিনীও জানেন। দুর্গাপুজোতে যে অনি এখনও আসে কাকিমণিকে দেখতে পাবে বলেই। কাকিমণির ইচ্ছা আছে বলেই। 


-বেশ,তোর সাথে যাবো। 


-সত্যি?


-কাল যাবো। ও বাড়ি। তোকে নিয়ে।


পরী খুশি হলো খুব। ঠাম্মার সাথে ও বাড়ি বেড়াতে যাবে কাল। কী মজা! জেঠুমণি,জেঠিমণি,ঠাম্মা-তিনজনই খুব ভালো। পরীর তিনজনকেই চাই। 


পর্ব – ১১সুহাসিনী বহুদিন পর কোন কারণ ছাড়া এ বাড়িতে এলেন, শেষ এসেছিলেন বাবিনের চলে যাবার সময়। ছন্নছাড়া হয়ে পড়েছিলো সব কিছু, অতিথি, মিডিয়া, রাজনীতিবিদ, শোকের আবহে এদের আনাগোণা সামলাবার কেউ ছিলো না। নীরার মা মেয়ে সামলাতে ব্যাস্ত ছিলেন। অনি নিজেও ভেঙ্গে পড়েছিলো। তাই নীরার বাবা আর সুহাসিনীই সামাল দিয়েছিলেন বাইরের দিকটা। অথচ কাজ মিটে গেলে আর একবারও আসা হয়নি এই দেড় বছরে। নীরার খোঁজ অনির কাছে দুর্গাপুজোয় পেতেম। সংসারের শৃংখলে আষ্টেপৃষ্টে বাঁধা সুহাসিনী আর বেশি কিছু করতে পারেনি। অথচ করা উচিৎ ছিলো। আজ সারা দুপুর দেখে তাই মনে হয়েছিলো। বাবিনের ছবির সাথে গল্প করে ওকে খাইয়েই সারা দুপুর কাটিয়ে দেয়। মণি বলছিলো। আজ সুহাসিনী এসেও দেখেছেন সেসব চলছে। পরী আসতে পরীকে কোলে বসিয়ে নিয়েছিলো নীরা। বাবিনের ছবিকে খাওয়ানো বন্ধ হয়নি। সুহাসিনী হাল ধরলেন। “নীরা – -“। নীরা চমকে ওঠে, “কাকিমণি সুহাসিনী বকাবকির রাস্তায় যাননি। “শুধু ছেলেকে খাওয়ালেই হবে? নিজেও খেতে হবে ত”। “আর একটু - - “ । “না, অনেক হয়েছে। চলো, এবার খাবে”। “নীচে?” “না, এখানেই। মণি এনেছে। তুমি হাত ধুয়ে এসো”, “পরী খাবে তো”। “খাবো। ও খেয়ে এসেছে। অল্পকিছু খাবে। তুমি খাবে আগে। নীরা পরীকে বলে, “পরী একটু ওঠো, জেঠিমনি হাত ধুয়ে আসুক”। পরী উঠে পড়ে। নীরা হাত ধুয়ে আসে। “বসো”। নীরাকে বলেন সুহাসিনী। নীরা পরীকে কোলে বসায়। সুহাসিনী মণির থেকে থালা নিয়ে নেন নিজের হাতে। সামনের টেবিলে রাখেন। “এবার ভালো মেয়ের মতো পুরোটা খেয়ে নেবে”। “কাকিমণি. . আমি খেয়ে নিচ্ছি”। সুহাসিনী কড়া চোখে তাকিয়ে ছিলেন নীরার দিকে। নীরা আর কিছু বলেনি। সুহাসিনী নিজে হাতে করে খাইয়ে দিয়েছিলেন নীরাকে। পরিপাটি করে। “মণি – খাবার নাকি নষ্ট করে – এই ত দিব্যি খেয়ে নিলো সব”। “সে তো তোমার ভয়ে ছোটবৌদি”। সুহাসিনী মনে মনে হেসে ফেললেও মুখেগাম্ভীর্যধরে রাখেন। “ভয় না, মেয়ে মা’কে ভয় পাবে কেন? ব্লো যত্ন করে খাওয়ালে ঠিক খেয়ে নেয়”। “তমার এত বড় মেয়েকে যত্ন করে তুমি খাইয়ে যেও তবে এবার থেকে রোজ”। সুহাসিনী হাসেন। “রোজ না হলেও যাবো, আর বাকি দিন খোঁজ নেবো, পরীতো আসেই। “ঠাম্মা – জেঠুমণি খাইয়ে দিলেও জেঠুমণি খোঁজ নেয় ঠিকঠাক”। ণিরা মুখ লজ্জায় লাল হয়ে জেলো। “চুপ, পাকা বুড়ি। না, না কাকিমনী ..? সুহাসিনী হাসলেন, অনি খাইয়ে দিলে খুব ভালো করে। আমি বলে দেব যাতে রোজ খাইয়ে দেয়। কিন্তু ণিরা তোমাকেও নিজের যত্ন নিতে হবে ভালো করে। মা নিজে ভালো না থাকলে ছেলেমেয়েকে কী করে ভালো রাখবে?” নীরা কথা দিয়েছিলো, রাখবে। পরীর সাথে নীরাকে দেখে খুশি হয়ে ছিলেন সুহাসিনী। নিজে অযত্নে থাকলেও পরীর কোন অযত্ন করে না নীরা। দুপুরে ওষুধের জন্য যখন ঘুম আসে একপাশে পাশবালিশ মাঝে বাবিন, অন্যপাশে পরীকে নিয়ে শুয়ে পড়ে। পরী দিব্যি নীরাকে জড়িয়ে ধরে শোয়, ঘুমোয়। ঘুম থেকে উঠে পরীকে হাত মুখ ধুইয়ে, চুল বেঁধে, সাজিয়ে দেয় নীরা। পরী নীচের লনে খেলতে যায়। নীরা দক্ষিণ দোতলায় বারান্দায় বসে নজরদারি করে। সুহাসিনী পাশে বসেছিলেন, “পরীটা খুব টরটরে”। “হ্যাঁ, কাকিমণি, তবেবাবিনেরথেকেকমদূরন্ত। বাবিন তো এক জায়গায় স্থির হয়ে বসতেই পারে না, সবসময় ছুটছে”। “বাবিনকে তো তুমি বকোই না”। সুহাসিনী ইচ্ছা করেই বর্তমানে ছিলেন। বাবিনকে আপনার ছেলে শাসন করে। বাপিকে ভয় পায় খুব”। “অনিদের ছেলে বেলাতেও ওদের তিনভাইকে আমিই শাসন করতাম। তোমার শাশুড়ী মায়ের ত সংসারে খুব একটা মন – কোন বলেই ছিলো না”। “হ্যাঁ, গল্প করেছে অনি”। বলেই নীরা বুঝলো কাকিমণির সামনে নাম করে ফেলেছে, “মানে আপনার ছেলে”। “অনি-ই ঠিক আছে। তোমরা আধুনিক মেয়ে। কী বলে যে, ছেলে বেলা নিয়ে?” “সবই বলেছে, আপনার কড়া অনুশাসন, নিয়ম না থাকলে এত ভালো রেজাল্ট হতো না বা মরাল ক্যারাক্টারটাও এভাবে তৈরী হতো না – বলে সবসময়। “অনি পড়াশুনায় বেশ ভালো ছিলো”। এর জন্য শুরুতেই ব্যাবসা আমি চাইনি, ছট দুটোতো কোন ক্রমে গ্রাজুয়েশন – তার পরপরই ব্যাবসা – কিন্তু অনি যখন বিলেতে পড়তে যেতে চাইলো ওর বাবা মায়ের অমত থাকলেও আমি বলেছিলাম পড়ে আসুক। ব্যাবসা নিয়েই তো পড়া। পড়ে এলে বাবসাটা আরো ভালো বুঝবে। ফলতো দেখতেই পাচ্ছো”। “আপনাকে খুব মানে”। “জানি, ছট থেকেই ওর মা, বাবা, কাকা সবাই অনি যা কিছুই করুক কাকিমণিকে বলে দেব বলে বড় করেছে তো, নাচাবেন ওনারা, ছেলেকে স্কুল কামাই করে ঘুরতে নিয়ে যেবেন অনারা, পড়াশুনার খেয়াল রাখবেন না ওনারা – এদিকে ছেলের রেজেল্ট একটু খারাপ হলেই ছোট কি ছট বৌমা কি ছোট গিন্নি – অনিটার এমন হলো কেন দেখোতো। ছেলেকে পাহাড় থেকে ঘুরিয়ে এনে নিউমোনিয়া করলো তোমার শাশুড়ী সেটাও ওর কাকার বাবার আর মায়ের মতে সুহাসিনীর দেখার বিষয়। নীরা হেসে ফেললো, সুহাসিনীর কথা বলার ভঙ্গিতে। “আপনার কথার বাইরে যেতই না সে – বলেছে আমায়”। “এখনো বাইরে যায় না। ওর কাকার আর ব্যাবসায় নজরদারিটা অনি আতকেছে – কার কথাতে এটা নিশ্চয় বলেছে তোমায়”। “হ্যাঁ, কাকিমণি। আমাকে পছন্দটাও ত আপনি ই করেছিলেন”। “অথচ গত পাঁচ সাত বছরে ওদিকের করে এদিক নজরটাই দেওয়া হয়নি আমার, নিরা, এত মানা, এত নিষেধ, এত কর্তব্যের বাঁধন। আজ এসে দেখলাম। দেরি করে ফেললেও খুব দেরি হয়নি মনে হয়”। পরী এরই মধ্যে মাঠে পড়ে গেলো একবার। “নিধুকাকা,পড়েগেলোযে ...” নীরা বারান্দা থেকে চেঁচিয়ে উঠলো, “নীরা, বাচ্চারা একটু পড়েই। খেলে আসুক। কাটলে ছিঁড়লে ডেটল লাগিয়ে দিব। এখানে তো তাও খেলতে পারছে। ও বাড়িতে পায় না”। “কেন? মাঠ আছে তো”। “থাকলেও স্কুল, পড়া, আঁকা – এখন আবার তার মা নাচেও দিয়েছে .... চলছে সারাদিন”। “এইটুকু বাচ্চার উপর এত চাপ?” “তাহলেই বোঝ” “বাবিনকে তো পড়াশুনার বাইরে এখনো কিছুই দেওয়া হয়নি। ওর বাপি বলে অ নিজে বুঝুক কন্টা ভালো লাগে, তাহলে সেটাতেই দেব”। সুহাসিনী বুঝলেন বাবিন প্রসঙ্গ আসতেই থাকবে। “পরী এখানে থাকলে, ভালো থাকে”। “তাই, কাকিমণি? আমিও খুব ভাল থাকি ও এলে। অনি বলছিলো এই তো মেয়ে চাইতে না – আমি বললাম এমন মিষ্টি মেয়ে হলে মুখ ফিরিয়ে থাকা যায়? পরীকে রেখে দেবো এমনও বলেছি ওকে। আনিও রাজি। বাবিন এলেই বাবিন চাইলে পরীকে রেখে দেব, বলেছে অনি”। সুহাসিনী বুখলেন অচ্যুত, অতীনের পরিকল্পনার একমাত্র বাঁধা বাবিন এলে – এই শব্দটা। “তবে অতীনরা ছাড়ায় কিনা ...” “অতীনবাজিনাকেউইপরীকেমানুষ করেনি নীরা। আটকালে আমিই আটকাবো। তবে তোমাকে আর পড়িকে ভালোরাখার জন্য এইটুকু আমি করতেই পারি”। “পরি ঠাম্মার কথা খুব বলে”। “এখানে থাকলে অল্পতেই ছুতে আসতে হবে – সবসময়, ওর ধ্যান”। “শুধু ওর টানে কাকিমণি? আর আপনার এখানকার ছেলে মেয়ের? “সুহাসিনী নীরার হাতে হাত রাখলেন, “সেই টান মানলে তো আমাকে চলে আসতে হয়”। নীরা খুশি হলো, “আসবেন? শাশুড়ি থাকলে কত ভালো হয় আর না থাকলে কত কষ্ট আমি বুঝি”। “এই যে বললে মেয়ে আমার – তাহলে শাশুড়ি কেন?” নীরা আর সুহাসিনী একসাথে হেসে ফেললেন সুহাসিনীর কথায়। পর্ব-১২“ডাক্তারকাকা”অনিরুদ্ধ ডাক্তার ব্যানার্জিকে ডাকল।“হ্যাঁঅনি,এসো এসো”“কাকিমণি এসেছেন”ডাক্তার ব্যানার্জি আস্ফুটে বললেন।“সুহাসিনী!এখানে?” সুহাসিনী ঢুকে এসেছিল ততক্ষনে।“বসতে পারি,রুদ্র?”কাকিমণি আর ডাক্তারকাকা স্কুলের বন্ধু।একসাথে পড়েছেন।আর এর বাইরেও কানাঘুষোশুনেছে কাকিমণি আর ডাক্তারকাকার কৈশোরের প্রেম আর কাকিমণির বাড়ির অমতের জন্য তড়িঘড়ি কাকার সাথে বিয়ে হয়ে যাবার গল্প। তারপরেও বহুবার অনিদের বাড়িতেই একে অপরকে মুখোমুখি দেখেছেন ওনারা।ডাক্তারকাকার বাবা মুখার্জিদের ফ্যামিলি ফিজিসিয়ান ছিলেন। ওনার পর ডাক্তার কাকা হয়েছেন। কাকিমণির মুখোমুখি হলে ডাক্তারকাকা অস্বস্তিতে পড়েন এটা বোঝে অনিরুদ্ধ। কাকিমণির জন্য বিয়েও করেননি। ডাক্তারকাকার চেম্বারে কাকিমণিকে আনবে বলে অনিরুদ্ধ নিজেই ইতস্তত করছিল।সুহাসিনিই প্রশ্ন করেছেম।সো, প্রশ্ন করছ কেন?কি নেবে বল, ব্ল্যাক কফি এখনঅ চামচ চিনি?সুহাসিনী মুগ্ধ চোখেতাকালেন-মনে রেখেছ?রাখব না বলছ? এই রে তোমার ছেলের সামনে এসব-সুহাসিনী হাসলেন- অনি সব জানে- অকে গাড়িতে আসতে আসতে বলেছি সবটা। কার না কার থেকে কি না কি শুনে রেখেছিলো। তার থেকে নিজে বলে দেওয়া ভালো ।রুদ্র মাথা নাড়লেন- তা ঠিক, অচ্যুত আসতে দিচ্ছে তোমাকে? আনিদের গাড়ি, আনির সাথে বাইরে—দিচ্ছে আর কই, আমিই শুনছি না-চারটে নাতি নাতনী হয়ে সাহস জন্মেছে তবে-সাহস নয়-ইচ্ছা, আর চার নয় পাঁচ, বাবিন আমার সবচেয়ে বড় নাতি ছিলজানি-বস।আমাদের বহুদিন পর এভাবে একান্তে মুখোমুখি দেখা।তাই আর কি-অনিরদ্ধ বসল ।খুব যাচ্ছে- নীরার কাছে শুনেছি- মুখার্জি বাড়ীর সব খবরই পৌঁছায় তোমার কাছে দেখছি—পৌঁছবে না? খোঁজ তো রাখতেই হবে সুহাসিনি। তুমি আছো যে, আর অনিটাও, বড়দার সন্তান। দেবতুল্য মানুষটার আনেক উপকার আছে তো—তোমার দয়িতাকে নিজের ভাইয়ের সাথে বিয়ে দেওয়াটাকে উপকার বল?

অনিরুদ্ধ চমকাল। বাবাও ছিলেন এর মধ্যে? তাহলে তো কাকিমণির বাবার প্রতি যথেসট ক্ষোভ আছে আথচ আনিকে সেসব সত্বেও কীভাবে যত্ন করেছেন, মানুষ করেছেন। বড়দা সুহাসিনী।অচ্যুতের লোভ, ইচ্ছা, জেদ, অবসেসন তোমার প্রতি- তোমার মা বাবার বোকামো। তোমাদের দুই পরিবারের বানিজ্যিক সম্পর্ক আর অনির ঠাকুমা ঠাকুরদার সাম্রাজ্য বাড়াবার লোভ। তোমার মা বাবার একমাত্র মেয়ে তুমি। শিক্ষিতা, সুন্দরী এটাই স্বাভাবিক। আর ডাক্তারি করে ক পয়সাই বা হয় বল? তোমায় এতো সুখ স্বাচ্ছন্দ্য দিতে দিতে পারতাম না। একদিক থেকে ভালোই হয়েছে। সুখ-স্বাচ্ছন্দ্যের আমি প্রত্যাশী। মনে হয় তোমার? সুহাসিনীর কথায় ক্ষোভ ঝরে পড়ে। রুদ্রদেব হাসেন।ভালো হয়েছে এ জন্য বলিনি। তুমি ও বাড়ি গেছো বলেই বাবিনটা বেঁচেছে। নাহলে অর আগের বাচ্চাটার মত—অনিরুদ্ধ চমকা্ল। সুহাসিনী চোখের ইশারায় থামতে বললেন। অনিরুদ্ধ এসবের কিছুই জানে না। আগের বাচ্চাটা বলতে কাকিমণি?কিছু না অনি-পরে বলবো তোকে। তোর ডাক্তার কাকাও কি না কি বলে ফেলে, বুড়ো হয়েছে তো। এবার বলতো বাবিনকে আনার কি প্লান তোমার?রুদ্র মুখ ফসকেই সামলে নিয়েছিলেন। আগে বল নাতনীটাকে অনিকে দেবে অচ্যুত?অনিরা চাইলে তার কোন অমত নেই।আর তোমার?ছিল—কিন্তু পরীকে অনির সাথে নীরার সাথে দেখে আর নেই।তাহলে তো হয়েই গেলোকিছু হয়নি রুদ্র, বাবিনকে ফেরত চাই নীরার। সেটা না হলে সব শেষ।তাহলে ডাক্তার চক্রবর্তির প্ল্যানটাই কাজে লাগাতে হবে।একরকম দেখতে বাচ্চা?বয়সটাও এক হতে হবে।পাবো কোথায়?খুঁজতে হবে,অবিকল এক না হলেও ধরনটা—বুঝলাম, নীরা মানবে?আগে বল তুমি মানবে তো? অনি তোমাকে যখন নিয়ে এসেছে আর কাউকে না এনে- তোমার মানাটা সবচাইতে জরুরী।প্রশ্নের পিঠে প্রশ্ন করার অভ্যাস তোমার গেলো না রুদ্র। আমি অনি,নীরার ভালোর জন্য সবই মানবো। মানবো বলেই সবটুকু জানার জন্য এখানে এসেছি। কিন্ত আমার শর্ত হল যে বাচ্চাটাকে আনা হবে তার সাথে যেন অন্যায় করা না হয় কোনোমতেই । নীরা না মানলেও অনিকে তার দায় নিতে হবে।

নীরা মানা না মানাটা আমরা কতোটা ভালো অভিনয় করব তার উপর নির্ভর করছে। আর বাচ্চাটা এলে তোমারও দায়িত্ব বাড়বে সুহাসিনী। অনিকে যেভাবে আগলে রাখতে সেভাবেই আগলে রাখবে ওকে।নীরাকে ওর মা হয়ে ওঠাতে হবে রুদ্র—তাহলেই হবে।হবে। নীরা তোমারই মতো অনেকটা। ঠিক পারবে। তুমি ওকে শেখাবে মা হওয়াটা। বিয়ে করেই যেমন শিখে নিয়েছিলে- পায়ের আলতা শুখাতে না শুখাতে অনির মা হয়ে গিয়েছিলে ।সুহাসিনী অনির দিকে তাকালেন।শিখতে হয়েছিল। বড় গিন্নী তো নিজেকে নিয়েই ব্যস্ত ছিল। নিজের সাজগোজ, বাণ্ঢবীড়া, ঘোড়াফেড়া, নিজের জগত। শ্বাশুরির বয়স হয়েছিলো। অযত্ন দেখে কি করব বল?অনি, মনে পরে সেসব?ডাক্তার কাকার কথায় অনিরুদ্ধ হাসল।পরবে না? বাড়ি ব্যবসা ভাগ হবার আগে অব্দি তো সবসময় কাকিমণির কাছেই থাকতাম। ভাগ হবার বছর খানেকের মধ্যেই বিলেতে চলে গেলাম। ফিরে এসে...কাকিমণি কিন্তু পরীকে নীরার কাছে যেতে দিচ্ছে তোমাকে ভরসা করেই।

জানি ডাক্তার কাকা। তাছাড়া নীরা আর পরীও মিলেছে ভালোই।তোমরা যাকে আনতে চাইছ সে এলে পরীর কদর কমে যাবে না তো?সুহাসিনী শঙ্কিত হলেন।বাড়তেও পারে, নীরার মনটা তো স্থির নয়, কেমন রি-অ্যাক্ট করে দেখি আগেবাবিনের জায়গায় যাকে আনবে, তাকে আইনত যেন আনা হয় রুদ্রসুহাসিনীর কথায় রুদ্রদেব উঠে দাঁড়ালেন-স্মোক করতে পারি?এসি ঘর- একদম না-অনি শুধু তোকেই না তোর ডাক্তার কাকাকেও কেমন শাসন করে দেখেছিস?অনিরুদ্ধ লজ্জা পেল মাঝে ক’বছর করেনি । এটা আমার দুর্ভাগ্যসুহাসিনী অনিরুদ্ধর পিঠে নিজের হাত রাখলেনকরার উপায় ছিল না । আমি দুরত্ব চেয়েছিলাম। কারন চাইনি তোমার ঐ কাঁচা বয়সে তোমার কাকা তোমার ব্যবসায় ঢুকুক- আর ঠকিয়ে দিক। এখন আর সে ভয় নেই। তাই কাছে আসছি আবার।বাবিনকে আনলে এই আসাটাতে ছেদ পরতে পারে সুহাসিনী । জাত, কুল, ধর্মের দোহাই দিয়ে অচ্যুত তোমায় আটকাবে-

শুধু সে কেন? ছেলে-বউমারাও । কেবল ছোট- বৌ ছাড়া, ওর মনটা সরল, প্যাঁচ নেই। কিন্তু ওরা আটকালেই বা- শুনবে কে? পরীকে দেখতে ওর ঠাম্মা আসতেই পারে।অনিরুদ্ধ বললপরীকে এতো সহজে দেবে? আর দিলেও তখন নিয়ে যাবে না তো?সুহাসিনী সত্যিটা লুকোলেননেবে না- তবে পরীকে তাড়াতাড়ি নিয়ে নিতে হবে তোমাকে – অনিঅনিরুদ্ধ বুঝলকাকিমণি চান পরী এ বাড়ীতে মানুষ হোক- নীরার অসুস্থতা দেখেও চান, কেন? অযত্ন শব্দ টা কানে বাজলো অনিরুদ্ধর । পরীরও তা হয় না ত ওখানে ?আচ্ছা কাকিমণি , আমি আজই অতীন কে বলছি ।বাবিন যতদিন না আসে ততদিন পরীটা থাকলে নীরার অবসাদ কম থাকবে।রুদ্রদেব বললেন।পরী তারপরেও থাকবে –ডাক্তার কাকা থাকবে তো, আর তুমি পরীকে খুব ভালবেসে ফেলেছ বুঝি তো, আমিও তো এভাবে কাউকে সন্তানের মতোই ভালবাসি ।কে?অনিরুদ্ধ প্রশ্নটা করেই বসলো ।সুহাসিনী – তোমার অনি এই বুদ্ধি নিয়ে এতোগুলো দোকান চালায় ?সুহাসিনী হাসলেনঅত ঘোরপ্যাঁচ বোঝে না আমার অনিতা ঠিক, বুঝলে অতীন অনুপমের ছেলেবেলার দোষ গুলো ঘাড়ে পড়ে যেতো ওর রোজ রোজঅনিরুদ্ধ বুঝল ডাক্তার কাকা তার ছেলেবেলার কথা বলছেওরা মিথ্যা কথা বলত ঠাকুমাকে মাকে- আমি পারতাম নাতোর কাকিমণি অবশ্য বুঝে যেতো কোনটা সত্যি কোনটা মিথ্যাসুহাসিনী হাসলঅনিকে একলা ঘরে নিয়ে গিয়ে জিগ্যাস করলেই স-ব বলে দিতো ।অথচ ঠাকুমা মা বাবাকে বলতো না কিছুই।ওরা শুনতে চাইত? তুমিই তো শুনতে। আর তখন যার দোষ তাকে শাসন করতে। ওরা তো খালি অনি বড়- অনি দেখে রাখেনি- অনি এটা- অনি সেটা---অনিরুদ্ধ ছেলেবেলার কথা ওঠায় প্রগলভ হয়ে উঠেছিলোরুদ্রদেব সুহাসিনী হেসে ফেললেন ।তবে আমিও অনেক মার খেয়েছি- তোমার কাছেতিন ভাইয়ের মধ্যে সবচেয়ে কম- সেটা বলরুদ্রদেব বললেনতা ঠিক, তবে আমাকে যেদিন ধরত কাকিমণি – সেদিন শেষ। যারা নালিশ করে করে কাকিমণিকে রাগিয়ে দিত সেই মা, বাবা, কাকা-ই শেষে কাকিমণির হাতে পায়ে ধরে নাক কান মুলে ছাড়াত।নিজেরা কোনোদিন আদর করেছে যে শাসন করবে? তাই দুটো ব্যাপারেই সুহাসিনী ভরসা ।সুহাসিনী বললেন—ভাগ্যিস তুমি শাসন করেছিলে । নাহলে আমি মানুষ হতাম নাকি?তোকেই তো পেরেছি অনি । বাকি দুজনকে পারলাম কই? তাদের একজন বাপের ধাত পেয়ে গেল । আর বড়জন শুধু ব্যবসা আর ব্যবসা ।অনিরুদ্ধ কাকিমণির হাত ধরল।একজন তো একদম তোমার মতই হয়েছে ।তাই না, ডাক্তার কাকা ?কোন উত্তর পেল না ।সুহাসিনী আর রুদ্রদেব দুজনের চোখেই জল দেখল । আনন্দের অশ্রু। অনিরুদ্ধ বুঝল।পর্ব- ১৩অনি এসেছে।বাড়ির ড্রয়িং রুমে ঢুকতে ঢুকতেই সুহাসিনী কথাটা বললেন । অচ্যুত তাকালেন ।অনির সাথেই ছিলে এতক্ষণ?হ্যাঁ, অন্যরকম কিছু কি মনে হচ্ছে তোমার, এই বয়সেও?সুহাসিনীর কথার দৃঢ়তায় অচ্যুত আর কথা বাড়ালেন না।অনি, আয় বাবু-বস ।অনিরুদ্ধ অবাক হল । বিস্মৃত কাল পরে কাকা তাকে বাবু বলে ডাকল। তাহলে কাকিমণির কথাই সত্যি । খুব একটা কাঠ খড় পোড়াতে হবে না পরীকে পেতে , মনে হচ্ছে ।অতিন কই?বড় খোকা এই ফিরল ।কেন, ওর সাথে দরকার ?পরীর ব্যাপারে কথা তো—তাতে কি? আমি আছি । তোর কাকিমণি আছে। পরী তো আমাদের কাছেই মানুষ । রাতে তো আমাদের সাথেই ঘুমায় সে । তোর ছেলেবেলার মতোই ।তাই না ছোট গিন্নী ?অনিরুদ্ধ রাতে কাকিমণির কাছেই ঘুমাত । কাকা একই ঘরে অন্য খাটে । অতিন অনুপম হলে তিন ভাইয়েই কাকিমণির কাছে ঘুমিয়েছে । অনেক বড় অব্দি । কাকিমণি অনিরুদ্ধকে একলা শোয়াত না ।ঠাম্মা মা বললেও এড়িয়ে গেছে । কাকিমণি কি অনিরুদ্ধর সুরক্ষা নিয়ে ভয় পেত? তাই নিজের কাছে রাখতে চাইত সবসময় ?ছোটো, এত বড় ছেলে—এখনও আঁচলে বেঁধে রাখবি ?মায়ের বলা কথা মনে পড়ে অনিরুদ্ধর । কাকিমণি এড়িয়ে যেত ।বড় কোথায় ? বড় হলে নিজেই শুতে চাইবে না এখানে । আলাদা ঘর চাইবে ।

অনিরুদ্ধ আগে অতিন অনুপমরা আলাদা ঘরের জন্য ছটপট করেছে। সব ভাইরা বড় হলে তবেই কাকিমণি আলাদা ঘরে যেতে দিয়েছিল অনিরুদ্ধকে । এতদিন ব্যাপারটাকে স্নেহ মনে করত অনিরুদ্ধ । আজ ডাক্তার কাকার মুখ ফস্কে বলা কথাটা শুনে মনে হচ্ছে—সতর্কতা।কাকিমণিকে জানতে চাওয়া হল না তার আগের বাচ্চাটার গল্প । কে ছিল সে, ছেলে না মেয়ে, কি হল তার—অনি, কি এত ভাবছিস?ছোটবেলার কথা কাকা-অচ্যুত হাসলেনসে একদিন ছিল। তোর কাকিমণি তো তোকে চোখে হারাত। কারোর কোলে চাপতে দিত না। বিশেষত বাবা, কাকার কলে। মা তো নিতই না। কিন্তু ওদের কোলে অনি গেলেই কাকিমণি নিয়ে নিত। ভয় পেত যদি ফেলে দেয় ওরা।পরীকে নিয়ে কি ভাবনা বল। নীরা আর পরীর ভালোই মিলেছে ।বাহ- আর তোর তো খুব ন্যাওটা মেয়েটা ।ছোট্ট থেকেই। তাই ভাবছি নীরার ফাঁকা কোলে যদি পরীকে তোমরা দাও—বলেই কাকিমণির দিকে তাকাল অনি। চোখের ইশারায় জানালেন বলাটা ঠিক হয়েছে।নিবি ? ওর ঠাম্মা থাকতে পারবে তো ?কাকিমণির তো ওটাও বাড়ি কাকা।কাকিমণিও যাবে, থাকবে। অচ্যুত মাথা নাড়লেনতা বেশ। নীরার বর্তমান পরিস্থিতির কথা যা শুনলাম বেয়াইএর কাছে এটা ভালো সমাধান। কি বল ছোটো গিন্নি ?হ্যাঁ, নীরা পরীকে পেয়ে জীবনে ফিরতে পারছে যখন—ঠিক- আর নীরাকে বাদ দিয়ে তুই যখন ভাববি না—মানে আর একটা বিয়ে—না না কাকা সেটা সম্ভব নয় ।অতিন আর বৌমাকে বলি তাহলে ।আজই বলে যাই ?বেশ, লিখে পড়ে নিবি তো? নাহলে নীরা জীবনে ফিরে এসে আর একটা বাচ্চাকাচ্চা নিয়ে এলে পরীকে ফেরত দিয়ে যাবি? বলেই হেসে উঠলেন অচ্যুত। অনিরুদ্ধর কান লাল হয়ে গিয়েছিল। কাকা এরকম বাজে ইয়ার্কি করেন। কিন্তু অনিরদ্ধ এসবে অভস্ত্য নয়। আহ- কি সব বলছ- ছেলের সামনে ।তাও ঠিক। তবে পরীর সাথে অন্যায় যেন না হয় অনি ।পরীকে আমি খুব ভালোবাসি কাকা । কোন অন্যায় হবে না—নিস্তিন্ত থেকো ।বেশ- আমরাও যেন মেয়েটাকে দেখতে টেকতে পাই—তোর কাকিমণি তো না দেখে থাকতে পারবে না মনে হয় । কাকিমণি যাবে রোজ ।ওটাও কাকিমণিরই বাড়ি।বেশ- অতিনকে ডাকছি তাহলে ।ডাকো ।অচ্যুত ভিতরে যেতেই অনিরুদ্ধ চাপা গলায় বলল—কাকা তো সহজেই রাজি হয়ে গেল কাকিমণি?জানতাম হবে ।পরীর কি অযত্ন হয় এখানে , তাই তুমিও চাইছ—তোদের কাছে বেশি ভালো থাকবে – জানি ।মেয়ে বলেই কি –সুহাসিনী হাসলেনসব প্রশ্নের জবাব হয় ?অনি ?তোমার আগের বাচ্চাটা কি ছিল কাকিমণি ? ছেলে না মেয়ে ? কি হল তার? এর কথা আগে বলোনি তো আমাকে !!সুহাসিনী ভীষণ চমকে উঠলেন ।থাক ওসব ।না বল ।পরে বলব ।তোমার বিয়ের আগেই ?অনি- পরে বলব বললাম তো ।সুহাসিনী থামালেন ।অতীনকে নিয়ে অচ্যুত চলে এসেছিলেন ।তোর দাদাভাই বলছে পরীকে নেবে।অচ্যুত কথাটা তোলার ভান করলেন ।দাদাভাই নেবে ? তা বেশ তো । বৌদিমনির মনটা ভালো যদি থাকে এতে আমার কোন আপত্তি নেই ।এত সহজে অতীনের রাজি হওয়াতে অনিরুদ্ধ সারকথাটি বুঝল । ছেলেবেলায় নিজের পছন্দের খেলনা অব্দি নিতে দিত না যে ছেলে—এত সহজে নিজের সন্তান দিয়ে দিচ্ছে মানে সম্পত্তির হিসাব মাথায় রয়েছে । বৌমার মত কি রে বল তোমার বউমা যথেষ্ট সমজদার ।তোমাদের কষ্টটা বোঝে। অরাজি হবে না ।অনিরুদ্ধ বুঝল এরা রাজিই ।দেরি করা আর উচিত হবে বলে মনে হল না ।পর্ব – ১৪নীরার দিনগুলো এখন আগের থেকে ভালো কাটে । কয়েকদিন হল পরীকে এনেছে অনি । নীরা আপত্তি করেনি । বাবিনকে তো খুঁজে আনবেই বলেছে লোকটা । চেষ্টাও করে । দেখেই বোঝা যায় । পরী এখন নীরাদের কাছেই থাকে । ভারী শান্ত মেয়ে । বাবিন দাদার সব গল্প চুপটি করে শোনে । সকালে প্লে-স্কুলে যায় দশটাতে । আবার দুটো নাগাদ ফিরেও আসে । পরীর জন্য কাকিমণি রোজ আসছেন । পরীর মা জিনাও আসে মাঝে মধ্যেই । অতীন ঠাকুরপোও এসেছিল উইক এন্ডে । পরীর ডাক বদলায়নি অনি-নীরা । জেঠুমনি-জেঠিমনিই থাক । বদলানোর দরকার নেই । পরীকে স্নান করানো , খাওয়ানো সব ঝক্কি কাকিমণিই নেন ।নীরার কাজ কেবল বাবিনকে খাওয়ানো আর নিজে খাওয়া । ও হ্যাঁ , পরীকে পাশে নিয়ে ঘুমানোও কাজের মধ্যে পরে ওর । পরীর পড়াশুনা সব অনি দেখে । অফিস থেকে ফিরে । নীরা তখন বাবিনের সাথে একান্তে থাকে । গল্প করে । রাতে বাবিন আর পরী দুজনকে দুদিকে নিয়ে ঘুমিয়ে পরে নীরা । অনি কোন কোন দিন আসে । পরীর পাশে শোয় । বাবিনকে সরিয়ে নীরার পাশেও । পরীকে পেয়ে ভীষণ খুশী – দেখেই বোঝা যায় । এতে আবার বাবিনকে আনতে ভুলে যাবে না তো? নীরা পাশ ফেরে ।জেগে ?অনিরুদ্ধ তাকায়হ্যাঁ বল ।বাবিনকে পেলে ?খুঁজছি সোনা ।আর কতদিন ?অল্প কিছুদিন ।সত্যি ?হ্যাঁ , তুমি ওষুধ খেয়েছ তো ? রাতের ?হ্যাঁ খেয়েছি ।তবে ভালো মেয়ের মতো ঘুমাও ।নীরা ওপাশে ফিরে পরীকে জড়িয়ে ধরে ।মাঝে নেব ? পরীকে?হ্যাঁ বাবিনটা ওদিকে ঘুমাচ্ছে । ঘুমোক ।অনিরুদ্ধ খুশী হয় ।নাও ।নীরা সন্তপর্নে পরীকে মাঝে নেয় ।পড়ে কেমন ?বেশ ভালো । শান্ত হবার জন্য আর সুবিধা ।বাবিনটা যা ছটফটে –ঐ জন্যই বকুনি খায় ।অনিরুদ্ধ পরীকে জড়িয়ে ধরে ।পরী ঘুমের ঘোরে নীরার গলা দুহাতে জড়িয়ে ধরে । নীরা হাসে।ঠাম্মার মতো করে জড়িয়ে ধরেছে ।ঠাম্মার কাছেই তো ঘুমাত ।কাকিমণি আমাকে সব বলেছেন ।অনি , বাবিনের জায়গায় মেয়ে হলে তুমি তো নয়ই আমিও কি অযত্ন করতাম – বল ?অনিরুদ্ধ মাথা নাড়ে –একদম না ।অথচ--বাদ দাও । এখন তো অযত্ন হচ্ছে না ।বাবিন এলেও হবে না । কথা দিলাম ।অনিরুদ্ধ চুমু খায় নীরাকে ।জানি – নীরা যে পরীরও মা । নামেই জেঠিমনি ।যেমন কাকিমণি তোমার ।অনিরুদ্ধ হেসে ফেলে ।আমি তবে দুটো মা ফিরে পেয়েছি একসাথে – কি বলো ?ঠিক , আর কাকিমণিও তোমাকে ফিরে পেয়ে খুব খুশি অনি ।অনি জানে । কিন্তু তবুও কাকিমণিকে প্রশ্নটা করতেই হবে ।ওর আগে এ বাড়িতে কোন বাচ্চা ছিল । আর তার কি হয়েছিল ?কেন সে জিনিষটা লুকানো হয়েছে এই প্রজন্মের থেকে ? জানতেই হবে ।বিকালে তাড়াতাড়ি অফিস থেকে ফিরেছিল অনিরুদ্ধ । কাকিমণির সাথে দেখা করবে বলে । এসে দেখে ডাক্তার কাকাও এসেছেন ।

পরী নীচের মাঠে খেলছিল । অনিরুদ্ধ আসবার সময় কলে করে নিয়ে এসেছে উপরে ।খেলা শেষ ?সুহাসিনী বললেন ।জেঠুমনি নিয়ে এল যে ।অনেক খেলেছ পরী । এবার হাত মুখ ধুয়ে পড়তে বসব আমরা ।আচ্ছা – জেঠিমনির কাছে যাও তবে ।পরী ছুটে চলে গেল ।কি খাবি ?সুহাসিনী বললেন ।মনি পিসিকে বলে দিচ্ছি । তুমি ব্যস্ত হয়ো না ।রুদ্রদেব বললেনতুই বস আগে , খেটেখুটে এলি ।অনিরুদ্ধ বসলো । দুজনেই আছে । কথাটা পারার এর থেকে ভালো সময় হয় না ।ডাক্তার কাকা আমার আগের বাচ্চাটার কথা বললেন না তো ।সুহাসিনী ধমকালেনআবার এক কথা !জানতে হবে তো ,কাকিমণি ।সুহাসিনী বলে দাও । লুকিয়ে কেনইবা রাখবে ?এত পুরানো কথা –তাও জানতে হবে কাকিমণি । আমার দাদা না দিদি ?দাদা --রুদ্রদেব বললেন ।মারা গেছে ?হ্যাঁ –এমা ! কবে কিকরে ? মা বাবা কেউ বলেনি তো আমায় !সুহাসিনী অনিরুদ্ধর অস্থিরতা বুঝলেন ।তর তখন মাস দ’শেক । যখন সে মারা যায় । আমার বিয়ের দু মাস আগে ।তারপরই বড় গিন্নী আরও সংসার বিমুখ হয়ে যায় । মারা গেল কি করে ?যতদূর শুনেছি ভেদবমি –রুদ্রদেব মাথা নাড়লেননা , রক্তবমি – শুধু রক্তবমিই নয় – চারিদিক থেকে রক্ত—অনিরুদ্ধ স্তব্ধ হয়ে গিয়েছিলবাবিন –বাবিন ও তো –হ্যাঁ , দুটো কেসে আনফানি সিমিলারিটী আছে , অতা আমার বাবার কাছ থেকে শোনা । তার বয়সও চার – সাড়ে চার ছিল তখন ।কি ? তার কোনও ছবি নেই ?আমি এসে থেকে ছবি দেখিনি । দু মাসেই সব সরানো হয়ে গিয়েছিলো । এক গুরুদেবের আদেশে । তোর ঠাকুরদা ঠাকুমা খুব মানতেন ওনাকে ।তন্ত্র মন্ত্রের জেরে কারো শত্রুতায় এই অপমৃত্যু এতা মানতেন ওঁরা ।সে কি ? ঠাকুরদা তো শিক্ষিত মুক্তমনা ছিলেন জানি ।বাবিনের মৃত্যুটাকেও হয়তো এখন ওনারা থাকলে সেভাবেই মানতে হতো । তন্ত্র মন্ত্রে খুব বিশ্বাসী ছিলেন দুজনেই তো । গুণিন ডাকা হতো । ঝাড় ফুঁক করা হতো ।রুদ্রদেব হাসলেন ।তবে সুহাসিনী বিয়ে করে এসে সবটুকু জানে এবং জেনেই জানিনা হয়ত সংস্কারবশত তোকে এক মুহূর্ত চোখের আড়াল করত না ।সংস্কার কিনা জানি না । তবে ওকে কাছ ছাড়া করতে ভয় হতো আমার । মনে হতো আবার কিছু খারাপ ঘটবে । রুদ্রদেব বললেনহয়ত পুরোটাই সমাপতন । তবুও দুই জেনারেশনেই ফার্স্ট বর্ণ মেল চাইল্ড – অবাক লাগে –অনিরুদ্ধ চিন্তিত হলকিসের জন্যসুহাসিনী চুপ করে থাকলেন । তারপর বললেন –অনেক স্পে্কুলেশনই তো করা যায় অনি ।রক্তবমি বিষ প্রয়োগেও তো হতে পারে ডাক্তার কাকা !পারে । সুহাসিনী তাই মনে হয় নিজে না চেখে তোকে কিছুই খাওয়াত না ।নিজের রান্না ছাড়াও খাওয়াতাম না । বাবিন ও কি তবে এভাবেই—না না --- ওর তো ডেঙ্গু ছিল ।সুহাসিনী ইশারায় ওকে থামিয়ে দিলেন ।কে ? কে ওখানে ?পর্দার ওপাশ থেকে ছায়াটা সরে গেল যেন ।অনিরুদ্ধ ছুটে গিয়ে দেখতে গেল । কিন্তু কেউ নেই ।কে ছিল ?কাকিমণি মুখটা কঠিন করলেন ।জানি না । তবে যা জানলে সেটা আর কাউকে বলবে না , অনি।ভাইদের নয়, নীরাকেও নয়।অনিরুদ্ধ চুপ করে থাকল । ও যা ভাবছে তা যদি সত্যি হয় তবে এ তো মস্ত ষড়যন্ত্র ! এই জাল ওকে কাটতে হবে । কাটতেই হবে ।পর্ব – ১৫আজ টাইম হবে ?শাঁওল এর ফোন পেয়ে ঘড়ি দেখল অনিরুদ্ধ।আজ অফিসে কোন মীটিং নেই বা কোন শ-রুম ভিজিটে যাওয়ারও নেই ।হতে পারে । তোর স্কুলে ঢুঁ মারব একবার ।কখন আসবে ?ফোন করব ।টিফিনে এলে ভালোভাবে কথা হবে ।আচ্ছা ।অনিরুদ্ধ ভাবল পরীকে নিয়ে যাবে । ওকে তো তেমন ঘুরতেও নিয়ে যাওয়া হয় নি । ওখানেও ছোট বাচ্চারা আছে । ওর ভালো লাগবে ।পরীকে নিয়ে যাবে ?হ্যাঁ , একটা বাচ্চাদের স্কুল দেখতে যাচ্ছি , গেস্ট হিসাবে – ভালো লাগবে ওর ।সে তো লাগবেই । তবে বেশী দেরী করো না ।নীরা বলল ।পরীকে চোখে হারাচ্ছে জেঠীমনি ।অনিরুদ্ধ ইচ্ছা করেই বলল ।নীরা পরীকে আদর করলো ।হারাবে না ? আমার সোনা মেয়ে বলে কথা ।তাহলে আজ স্কুল যাবো না জেঠিমনি । বেড়াতে যাবো ?অনিরুদ্ধ পরীকে কোলে নিলো ।একদিন বেড়াতে যাই ? পরীমনি কি বলছে ?ইসস – পরীমনি কে ?পরীমনি মানে পরী । এই যে জেঠুমনি জেঠিমনি – তাই পরীমনি পরী কি বলছে – স্কুল যাবে ? কামাই করবে না? পরী একটু ভাবল । কামাই করা খারাপ । কিন্তু বেরুও ভাল । জেঠিমনি যাবে না ?নীরা অবাক হল । জেঠিমনির এত খেয়াল মেয়ের ?অনিরুদ্ধ বললচলো নীরা , তুমিও চলো ।না, সবাই গেলে হবে অনি ? বাবিন এলে ?অনিরুদ্ধ কথা বাড়াল না ।আচ্ছা আমরাই যাই তবে । জেঠূমনি আর পরী । মেয়েকে রেডি করিয়ে দেবে?পরীর চোখের অবাক ভাব ঢাকতেই বলল অনিরুদ্ধ ।দিচ্ছি । পরী – চল মা । স্নান করিয়ে , খাইয়ে রেডি করিয়ে দিই ।তোমার কষ্ট হবে জেঠিমনি । ঠাম্মাকে ডাকো।নীরা হেসে ফেলে । পরীকে কোলে নেয় ।কিছু কষ্ট হবে না । বাবিন দাদাকে সব কে করায় ? জেঠিমনিই তো ।পরী কিছু বলে না আর । জেঠিমনিকে বাবিন দাদা নিয়ে কিছু বলতে মানা করেছে ঠাম্মা ।

গাড়িতে যেতে যেতে জেঠুমনিকে প্রশ্নটা করেই ফেলল পরী । জেঠুমনি বাবিন দাদা তো নেইই । তাহলে জেঠিমনি কেন এখনো –অনিরুদ্ধ প্রশ্নটা বোঝে ।জেঠীমনি বাবিন দাদাকে খোঁজে আজ—তাই ।বাবিন দাদা ফিরবে আবার ?অনিরুদ্ধ ঘুরিয়েই উত্তর দিল ।খুঁজে দেখি –বাবিন দাদা ফিরলে খুব ভাল হবে জেঠুমনি ।অনিরুদ্ধ পরীকে কোলে নেয় । দুগালে চুমু খায় ।কেন , পরী ?ও বাড়িতে দুটো দাদা ছিল তো । খেলা যেত । এখানে শুধু একা একা খেলা ।বাবিন দাদাকে মনে আছে তোর ?পরী ঘাড় নাড়ায় ।হ্যাঁ ।অমনি হ্যাঁ ? কতোটুকু ছিলি সে সময় ?বাবিন দাদা সবসময় ছুটে বেড়াত । বসত না কোথাও । সবসময় সবাই ছুটছে ওর পিছনে ।এগুলো তো গল্প শুনেছিস ।না না – মনে আছে ।অনিরুদ্ধ হাসল ।বাবিন দাদাকে দেখলে চিনতে পারবি ?হ্যাঁ – আমাকেও নাও তোমার সাথে । বাবিন দাদাকে খুঁজবো ।টরটরে মেয়ে আমার ।অনিরুদ্ধ পরীকে আরও আদর করে দিলো ।জেঠিমনিও এটা বলে যখন আদর করে ।আমাদেরই তো মেয়ে ।ওখানে ঠাম্মা ছাড়া কেউ আদর করত না ।বলেই চুপ করে যায় পরী ।বাবা-মা এলে বলে দিও না যেন ।কাকিমণির তাড়ার কারণ বুঝতে পারল অনিরুদ্ধ ।বলবো না , পরী এখানে এসে খুশী ?খু-উ-ব , জেঠিমনি বাবিন দাদাকে পেলেই হাসি খুশি থাকবে সবসময় । তখন আরও ভালো হবে ।জেঠিমনির দিকে খুব নজর পরীর ?কোলের মধ্যে নিয়ে ঘুমায় যে ।অনিরুদ্ধ হেসে ফেলল।চল – চলে এসেছে স্কুল ।শাঁওল খুব খুশি ছিল অনিদাকে দেখে । কোলে পরীকে দেখে বলল –কে গো অনিদা ?আমার মেয়ে ।মেয়ে আছে তোমার ? দাদাভাই বলেনি তো ।আরে প্রতীক জানে না ।তবে পোশাকি ভাবে ভাইঝি ।কাজিনের মেয়ে । কিন্তু এখন আমাদের কাছেই থাকে ।ওমা ! কি মিষ্টি ! কি নাম তোমার ?পরী ।পরী বলে উঠলো । স্কুল যায় ?প্লে – স্কুল ।সামনের বার এখানেই দিয়ে দাও ।দেবো । তুই আছিস যখন ।তুমি কে ?শাঁওল হেসে ফেলে ।আমি একটা আনটি । অনি দাদার বন্ধুর বোন ।ও – তাহলে পিসি । তাই না জেঠুমনি ?অনিরুদ্ধ দুষ্টু হাসি হেসে ফেলে ।পিসি – তাই তো হয় হিসাব মতো ।একদম নয় , আনটি । শাঁওল চোখ মারে ।চলো , ফাদারের ঘরে বসবে ।অনিরুদ্ধ বলল চল—ফাদার আগাস্তিনের ঘরে বসে কথা বলছিল অনিরুদ্ধ । মুখার্জি অ্যান্ড সন্স এর মালিক – এটা ফাদার শাঁওলের থেকে আগেই জেনে গেছেন । তাই আলাদা খাতির পাচ্ছিল অনিরুদ্ধ । শুধু স্কুল নয় এটা ।সাথে একটা বয়েজ অরফ্যানেজ ও আছে ।অরফ্যান ছেলেরাও এই স্কুলে পড়ার সুযোগ পায় । প্রতি ক্লাসে পাঁচজন । ওয়ান থেকে টুয়েলভ । নার্সারি থেকে কেজি আরফ্যানেজেই পড়ান হয় । সেখান থেকে প্রথম পাঁচজন এই স্কুলে পড়ে । আর বাকিরা একটু দুরের আর একটা স্কুলে । সেটা বেশ কম এক্সপেন্সিভ আর কম দামীও । আরফ্যানেজ পুরোটাই চ্যারিটি বেসড । এই স্কুলের স্টুডেন্টদের ডোনেসনের উপর ।কিছু এনজিও ট্রাষ্টের সরকারের এবং ব্যাক্তিগত ডোনেসনের উপর চলে । বিদেশ থেকেও কিছু ফান্ড আসে ।অনিরুদ্ধ মুখার্জির কাছ থেকেও কিছু আশা করেন – সেটা বিনম্র ভাবে জানিয়ে দিলেন ফাদার আগাস্তিন ।অনিরুদ্ধর না দেবার কিছু নেই । বিশেষত আরফ্যানেজের জন্য ও দেবে । মা – বাবা হারা ছোট ছোট ছেলেরা থাকে ওখানে । বাবিনের বয়সী ছেলেরাও থাকে । পকেট থেকে চেক – বুক বার করতে যাচ্ছিলো অনিরুদ্ধ । হঠাৎই—মে আই কাম ইন , ফাদার ?ছোট্ট বাচ্চার গলা শুনে ও তাকাল ।এমন অবাক ও জীবনে হয়নি ।কাকে দেখছে ও সামনে ?কাকে ! অনিরুদ্ধ কিছু বলার আগেই পরী বলে উঠলো –জেঠুমনি ! বাবিন দাদা !শাঁওল অবাক হল –বাবিন কে ? ও তো অনিকেত । ওয়ানে পড়ে । আরফ্যানেজের বাচ্চা ।ফাদার আগাস্তিন পরীকে প্রশ্ন করলেনবাবিন দাদা ? তুমি চেনো একে ?বাবিন দাদা ! বাবিন দাদা ! জেঠুমনির ছেলে , জ্জেঠূমনি –অনিরুদ্ধ নিজেকে সামলে নিয়েছিলো ততক্ষণে । বাবিনের মতই দেখতে । খুব খুঁটিয়ে দেখলে ফারাক করা সম্ভবনয় । বছর ছয়েক বয়স ।অনিকেত এস – কি বলবে ?অনিকেত এসব কথায় ঘাবড়ে গিয়েছিল ।ফাদার , পরে আসব ?না , না , এসো ।ফাদার বলেন ।অনিরুদ্ধ বাবু , অনিকেত কিন্তু খুব ইনটেলিজেন্ট । ওই স্কুল থেকে এই স্কুল এ এসেও কিন্তু ফার্স্টই হয় ।বাহ , খুব দুষ্টু , তাই না ? অনিকেত খেলতে চায় ?শাঁওল হাসে ।না না , ক্লাসের সবচেয়ে শান্ত ছেলে । মনিটর ও , ওর ক্লাসের ।অনিরুদ্ধ বুঝল দেখতে সদৃশ হলেও স্বভাবে অনেক ফারাক তবে ।বাবিন দাদা শান্ত হয়ে গেছে জেঠুমনি – জেঠিমনিকে বল –অনিরুদ্ধ পরীকে থামাল ।বলবো পরী , একটু দাঁড়াও ।কাকিমণিকে ডাকতে হবে এখানে । এখনই । ডাক্তার কাকাকেও ।ফাদার , হি রিসাম্বলস মাই সন ।রিয়েলি ! আপনার ছেলে –অনিরুদ্ধ চাপা দিয়ে বলেহি ইজ ন মোর ।ওহ –আমি কি বাড়ির বড়দের ডাকতে পারি ?এখানে ? ডাকুন না । অনিকেতকে দেখাবেন তো ?হ্যাঁ—ডাকুন ।অনিকেত বুঝতে পারছিল না এটা কি হচ্ছে ? ওকে ফাদারের ঘরের পাশের ঘরে বসিয়ে রেখেছে । ওই স্যুটেট বুটেট লোকটা কে ? আর বাচ্চা মেয়েটাই বা কে ? এর মধ্যেই বার কয়েক এসে দেখে গেছে অনিকেতকে ।বাবিন দাদা – আমি পরী – তোমার বোন ।পরীকে কোনোদিন দেখেনি অনিকেত । কিন্তু পরী তাকে দেখেছে ।ওর বোন বলছে । তাহলে কি পরী জানে ওর মা বাবা কোথায় ? নাকি ওই মস্ত বড় লোকটা জানে ? অনিকেত দেখেছে অনেক বন্ধু ওর চেয়ে ছোট এমনকি বড়দেরও তাদের মা বাবা এসে নিয়ে যায় । অথচ অনিকেতকে কেউ নিয়ে যায়নি কোনোদিন । তাহলে কি ওরও মা বাবা আসবে ? নিয়ে যাবে ? আরও দুজন এসেছে ।গ্র্যান্ডপা গ্র্যান্ডমার মত বয়সের । তারাও দেখেছে অনিকেতকে । সবাই অবাক । এত অবাকই বা হচ্ছে কেন ? সবাই তাকে বাবিন বলছে । বাবিন কে সে তো নিজেই জানে না । তাহলে ও বাবিন হবে কি করে ? কথায় ধাঁধা লাগছে অনিকেতের । ছোট মাথাটায় কিছু ঢুকছিল না ।ফাদার – ছেলেটি সত্যিই আমার নাতি বাবিনের মত দেখতে । সুহাসিনী বললেন ।অনিরুদ্ধ পরীকে নিয়ে বাইরে বারান্দায় দাঁড়িয়ে ছিল ।শাঁওলও ।সে তো বুঝলাম । অবাকও হলাম ।বাবিন তো দেড় বছর আগে –হ্যাঁ , তাই তো শুনছি । সত্যিই ব্যাপারটা স্ট্রেঞ্জ ।অনিকেত কি জন্ম থেকেই এখানে ?হ্যাঁ –ঠিক জন্ম থেকে না হলেও জন্মের দিন দু তিনেকের মধ্যেই – কেউ ফেলে গিয়েছিল । আরফ্যানেজের বারান্দার দোলনায় ।রুদ্রদেব বললেনদেখে তো ভালো ঘরেরই মনে হচ্ছে ।আমরা ঘর দেখি না , ডাক্তার বাবু ।ছেলে দেখি । ছেলেটি খুব ভালো । ক্লাসে প্রথম হয় ।রুদ্রদেব মাথা নাড়লেন ।আমরা যদি ওকে নিতে চাই – আই মিন – আডপ্সন ?হ্যাঁ--অনিরুদ্ধ বাবু নেবেন ?হ্যাঁ , অনিই ।তা বেশ । ওনার স্ত্রীকে নিয়ে আসুন ।কথা বলি আমরা ।সুহাসিনী বুঝলেন এভাবে হবে না ।ফাদার , নীরা অসুস্থ । পুত্রশোক সামলাতে পারেনি । ওকে আনাটা –কিন্তু তার মতামত ?বাবিনকে না পেলে সে মতামত জানাতে পারবে না ফাদার ।রুদ্রদেব বললেন ।ওহ । এই মানসিক অবস্থায় অনিকেতকে সামলাবেন কি করে ?বাবিন ফিরে এলেই তো সম্পূর্ণ সুস্থ হয়ে যাবে নীরা ।অনিকেত তো বাবিন নয় । এটা অন্য যে কারোর থেকে নীরা দেবী ভালো বুঝবেন । মানবেন কি ?আমরা আছি তো । আমরা মানাবো ।চাপিয়ে দেবেন ?তা কেন ? বোঝাবো ।সুহাসিনী বললেন ।যদি না মানে তবে অনিকেতের ভবিষ্যৎ ?না , না , এভাবে হয় না ।অনিরুদ্ধ পরীকে বাইরে রেখে ঘরে এল তখনি ।ভবিষ্যৎ ভাবনা আমার , ফাদার । ওকে নিজের বাবিন হিসেবেই নিয়ে যাবো । সেভাবেই যাতে বড় হয় , মানুষ হয় –সবটা আমিই দেখবো ।তাছাড়া পরীকেও তো নীরা মানুষ করছে এখন ।সুহাসিনী জোর দিলেন ।লিগ্যাল প্রসিডিওর কিন্তু বজায় রাখতে হবে ।অবশ্যই –রুদ্রদেব বললেন । এই জুয়াটা ওদের খেলতেই হবে ।প্রথম দু – মাস আমরা নজর রাখবো ।শাঁওল যাবে আসবে নিয়মিত । তেমন দেখলে –রাজি আমরা –সুহাসিনী বললেন । এই সুযোগটা হাতছাড়া করা যাবে না ।না খুঁজতেই বাবিনের মত বাচ্চার খোঁজ পাওয়া গেছে ।নীরাকে অবসাদ থেকে তুলে আনার শেষ খড়তকুটো ।একে ঈশ্বরের ইচ্ছা মনে করছেন সুহাসিনী । অদ্ভুত সমাপতন । একে আঁকড়ে রাখতে চান সুহাসিনী ।ছাড়তে চান না ।মুখার্জিরা আপনাদের আরফ্যানেজটা ভবিষ্যৎ এ নিয়মিত দেখভাল ও করতে পারে ফাদার ।

অনিরুদ্ধ ব্যবসার লাইন এ খেলল ।ফাদার এবার নরম হলেন ।বলছেন ?সুহাসিনী অনির বুদ্ধিতে খুশী হলেন ।হ্যাঁ অনির তাতে কন আপত্তি নেই । আমাদেরও ।বেশ যাকে নিয়ে যাবেন --- তাকে কি বলবেন ?সে চিন্তাটাও আমাদের ফাদার । সে যে বাবিন সেটাই বলা হবে তাকে । আপনারা কেউ দ্বিমত করবেন না – তাহলেই হবে ।রুদ্রদেব বললেন ।ভালো , তবে অনিকেত বুদ্ধিমান আর সেনসিটিভ ছেলে । অভিনয়ে যেন ফাঁক না পড়ে ।পড়বে না । শুধু অনিই নয় , আমরাও আছি তো ।সুহাসিনী বললেন ।হ্যাঁ আপনারা গ্র্যান্ডফাদার গ্র্যান্ডমাদার , দুজনেই এসেছেন । আপনাদের বিচক্ষণতার উপর ভরসা আছে ।রুদ্রদেব ভুলটা শুধরাতে যাচ্ছিলেন । সুহাসিনী আটকে দিলেন । অভিজ্ঞ চোখ ভুল করে না।যে ভুলটা ঠিক – পৃথিবীর সবথেকে ঠিক—তাকে অন্য কেউ চিনে না নিলেও ফাদার নিতে পেরেছেন ।সুহাসিনী সেই ঠিকটাকে ভুল করবেন না আবার ।পর্ব – ১৬অনিদা এটা ঠিক করছ তো ?শাঁওলের কথায় তাকায় অনিরুদ্ধ ।ভুল করছি কেন মনে হল তোর ?অনিকেত তো বাবিন নয় , বৌদি যদি না মানে ?আমি মানাবো । আর আমরা সবাই তো মানছি ।তাও – অ্যাডপ্সনটা –অনিরুদ্ধ হাসল ।এখানকার অরফ্যানেজ খারাপ বলছিস ?তা কেন?আর ও তো তোর সবথেকে ব্রিলিয়ান্ট ছাত্র—ফাদার বললেন ।আরফ্যান তো –ওহ , তাই বল । এই ট্যাবু নিয়ে তুই স্কুল এ পড়াস , পাগলি ?স্কুলে পড়ান আলাদা আর বাড়িতে নিয়ে যাওয়া আলাদা - অনিদা ।আমি মন থেকে মেনেই নিয়ে যাচ্ছি ।শাঁওলের হাত ধরল অনিরুদ্ধ ।তোর খারাপ লাগাটা বুঝছি ।তোর এখানে এসেছি ।তোর স্কুলেই অনিকেতকে পেলাম । দায়টা তোর উপর না পড়ে । এটাই ভাবনা । তাই তো ?শাঁওল মাথা নিচু করল ।কেউ দায় দেবে না ।ও বাড়ি যেতেও তো আমাকে—তোর বৌদিকে বুঝতে দিবি না কেন এসেছিস ।তাহলেই হবে । বাবিন পরীর টিউটর হয়ে আসবি না হয় ।শাঁওলের চোখে জল দেখল অনিরুদ্ধ । ওর হাতে হাত রাখল । শাঁওল হঠাত জড়িয়ে ধরল অনিরুদ্ধকে , জোরে । অনিরুদ্ধ আটকাল না । গায়ে মাথায় হাত বুলিয়ে দিল আস্তে আস্তে । শান্ত করল ওকে ।সই সাবুদে নীরার সই লাগবে না তো ?সুহাসিনী বললেন ।না , আপাতত সুপারভাইজারি আডপ্সন হচ্ছে ।ফাদার নিজের দায়িত্বে ছাড়ছেন অনিকেতকে ।আমাদের সাথে ।অনিরুদ্ধ চশমা ঠিক করল ।ট্রাস্টিদের বলে নিলেন – কিছুক্ষণ আগে ।দু মাস তাহলে নজরদারি সত্যিই চলবে ?হ্যাঁ , শাঁওলই যাবে ।ও যদি নেগেটিভ রিপোর্ট দেয় ।দেবে না । ও আমার খুব কাছের বন্ধুর বোন ।আর আমরা সবাই আছি কাকিমণি ।নেগেটিভ রিপোর্ট হবে কেন ?নীরাকে নিয়েই চিন্তা আমার অনি ।তুমি দেখে রাখবে ।এই আনাটা নিয়ে তোর কাকা ও চুপ করে থাকবেন না ।আটকে দেবে তোমাকে ?সুহাসিনী অনির হাত ধরলেন ।আটকাতে পারবেন না ।ঝগড়া আশান্তি ?সে ভয় করেছি কোনোদিন ? কেবল আলাদা হওয়াটাই ঠেকাতে পারলাম না ।বাকি তিনজনই এত চাইছিল । তোমার আলাদা হবার একটুও ইচ্ছা ছিল না – বল ।একেবারেই না । তোর কাকা চাইল । আমার বাপের বাড়িরও যে মদত ছিল না তা নয় । তারা বলল আলাদা হলে ব্যবসা জমবে । এখন তো আমার বাবার অ্যাকসিডেন্টটাকেও প্লানড মনে হয় আমার ।অনিরুদ্ধ স্পষ্ট করল ।বিশেষত আমার আগের বাচ্চাটার কথা জেনে –সুহাসিনী চুপ করে থাকলেন ।তোমার এ ব্যাপারে কি মনে হয় কাকিমণি ?অনিরুদ্ধ জিগ্যাসা করে আবার ।আমার মনে হওয়াতে কি কিছু বদলাবে ?তাহলেও –দেখো অনি – আমি এই মুহূর্তে নীরার সুস্থতা আর পরীর সুরক্ষা চাই ।সাথে এই বাচ্চাটারও সুস্থভাবে বেড়ে ওঠা । এটা তুমিই আমাকে দিতে পারো । কারণ তুমি যোগ্য ।যোগ্য আর কই? বাবিনকে তো হারিয়ে ফেললাম কাকিমণি ।একে যাতে না হারাও তার জন্য সব সময় সতর্ক থাকবে ।কিভাবে ?নিজের ছোটবেলা মনে কর অনি । আমি যেভাবে সতর্ক থাকতাম ।অনিরুদ্ধ বুঝল ।চোখের আড়াল করবো না ওকে । অথচ আমি তো অফিসে থাকবো ।সেইসময়টার অনেকটা অবশ্য অনিকেতও স্কুলে থাকবে । ও স্কুল থেকে ফিরলে তুমি না আসা অব্দি আমি থাকব ।এতো ভয় কেন কাকিমণি ?জানি না , জানতেও চাই না । বিশ্বাস অবিশ্বাস সব নিজের ব্যাপার । কিন্তু আমি যা বলছি সব মেনে চলবে । বিশেষত বাবিনের অমনটা হবার পর থেকে আমার বিশ্বাস দৃঢ় হয়েছে ।কারোর সাথে ছাড়ব না বলছ ?ঠিক , আর কারো হাতে খাওয়াবেও না । নীরা , তুমি , আমি – এ বাদে আর কেউ না ।বাবিনকে মনিপিসিও খাওয়াত ।কাকিমণি কি তবে মনিপিসিকেও – প্রশ্ন করার আগেই ডাক্তার কাকা এলেন । হল , মায়ে – পোয়ে কথা ?হল –তাহলে চলো – নাতিকে নিয়ে বাড়ি যাই ?তোমরা যাও – আমি পরে যাবো , একা ।অচ্যুতকে কোথায় আছো বলেছ ?হিন্দুস্থান পার্ক , রুমেলিদের বাড়ি ।ওখানে গোয়েন্দাগিরি করবে না তো ?রুমেলিকে বলা আছে । আমার থেকে তোমার ভয় বেশি দেখছি , রুদ্র ।রুদ্রদেব অপ্রস্তুত হলেন ।জানলে তোমার বিপদ হবে যে ।আমার বিপদের চিন্তা তুমি কর ?রুদ্রদেব আহত হলেন ।এতদিন পর সেটা মনে হয় তোমার , যে করিনা ?করলে চৌত্রিশ বছর আগের বিপদটা থেকে বাঁচাতে আমায় রুদ্র ।ডাক্তার কাকা চুপ করে গেলেন ।একটা তেইশ বছরের ডাক্তারি পড়ুয়া ছেলের কতটা ক্ষমতা থাকে সুহাসিনী ?তোমার ক্ষমতা না থাকলেও তোমার বাবাকে বুঝিয়ে---সুহাসিনীর গলায় উষ্মা ঝরে পড়ে ।অবশ্য তার তখন অনেক স্বপ্ন । ছেলে বড়ো ডাক্তার হবে । বিলাতে যাবে ।হয়েছেন বড়ো ডাক্তার ।বিলাত ফেরত ডাক্তার রুদ্রদেব ব্যানার্জি । এম ডি , এম আর সি পি । কলকাতার সেরা তিনজনের একজন । কত ফিজ যেন রুদ্র , দুই না তিন হাজার ?রুদ্রদেব সুহাসিনীর হাত চেপে ধরেন ।সু , থাক না । বাদ দাও । ছেলে শুনছে সব । তোমার যা আভিমান আমাকে একান্তে বোলো শুনবো ।অনিরুদ্ধ উঠতে গেলো । সুহাসিনী ওকে হাত ধরে বসালেন ।ছেলে বড় হয়েছে । সব জানুক । আর বাদ ? দেবো তো বটেই । বাদ তো আমিই পড়ে গেছি তোমার জীবন থেকে । সেই কবেই ।কাকিমণি শান্ত হও । ডাক্তার কাকার কষ্ট হচ্ছে ।উনি তো আজও তোমাকে ভালোবেসেই বেঁচে আছেন ।আর কাউকে আনেননি ।কেন আনল না ? আনত তাহলে আমি বেঁচে যেতাম এত লোকের এত কথা এত সন্দেহের হাত থেকে ।রুদ্রদেব এগিয়ে এলেন । সুহাসিনীর মাথায় , গায়ে , পিঠে হাত রাখলেন ।সু , ছেলে সব দেখলে সমস্যা নেই তো ? আমি আর কাউকে আনলে আমার আটকে না রাখতে পারার অক্ষমতার প্রায়শ্চিত্তটা পূর্ণ হোতো সুহাসিনী ? এই যে চৌত্রিশ বছর পরেও তোমার এত কাছে মাথা উঁচু করে আসতে পারছি , সেটাও পারতাম ?সুহাসিনী অবাক চোখে তাকালেন ।রুদ্রদেব সুহাসিনীর কপালে চুমু খেলেন । অনিরুদ্ধর চোখে অজান্তেই জল এলো । নিজের সবচেয়ে প্রিয় দুজন মানুষকে পূর্ণ হতে দেখলে চোখে জল আসাটাই স্বাভাবিক । সুহাসিনী কেঁপে উঠলেন যেন ।ভুল করলাম ?রুদ্রদেব আশঙ্কিত হলেন ।একদম না । বিস্মৃতকাল পরে কেউ ভালবাসল তো –রুদ্রদেব আর অনিরুদ্ধর চোখ চাওয়া চাওয়ি হোল । এতোটা অসুখ পূর্ণ রাখো কাকিমণি ?অনিরুদ্ধ সুহাসিনীকে এক হাতে জড়িয়ে ধরল ।কি করবো তবে ?চলে যাও কাকাবাবুর সাথে –অনিরুদ্ধ মন থেকেই বলল ।ধুর পাগল ছেলে । তা হয় ? সংসার আছে না ? আর এখন তো বাবিনের দায়িত্বও নিতে হবে।সুহাসিনী আসবে অনি । আমার কাছে একদিন না একদিন আসতেই হবে ।রুদ্রদেব হাসলেন ।এই বিশ্বাসেই তো বাঁচছি ।সু , তোমার ছেলে কাকাবাবু বলেছে আমায় , শুনলে ? অচ্যুতকে কিন্তু বলে না ।রুদ্রদেবের চোখের খুশী পড়তে পারল অনিরুদ্ধ ।তুমিই কাকিমণির যোগ্য যে । তাই বাবুটারও যোগ্য । সুহাসিনীর চোখেও একই খুশির ঝলক দেখতে পেল অনিরুদ্ধ ।


পর্ব - ১৭


অনিকেত বুঝতে পারছিলো না – কী চলেছে। ওকে ঐ পাশের ঘরেই বসিয়ে রেখেছে। শাঁওলি মিস পরী বলে মেয়েটাকে নিয়ে এসে গল্প করে অনিকেতকে টিফিন খাইয়ে দিয়ে চলে গেলো। অনিকেত খেয়েও নিয়েছে। কিন্তু ফাদার এখনো ডাকছেন না কেন? ভাবতে ভাবতেই ফাদার এলেন। সাথে ঐ মস্ত বড় লোকটা।“ফাদার – “উঠে দাঁড়ালো অনিকেত। “ক্লাসে যাবে, অনিকেত?” “হ্যাঁ – ক্লাস শুরু হয়ে গেছে তো”। “দেখলেন অনিরুদ্ধবাবু। কতটা সিনসিয়ার আপনার বাবিন”। অনিকেত অবাক হয়, ফাদার ও ওকে বাবিন-বাবিন বলছে? লোকটা অনিকেতের পাশে বসে। ওর পিঠে একটা হাত রাখে। “তাই তো দেখছি। বাবিন অবশ্য ছোট থেকেই শান্ত ছিলো খুব”। অনিকেত অবাক চোখে তাকায়। “আপনি আমাকে ছোট বেলায় দেখেছেন?” ফাদার অগাস্টিন অনিকেতের সামনের চেয়ারে বসেন। মুখার্জীদের হয়ে গল্পটা এস্টাব্লিশ ওনাকেই করতে হবে। “দেখবেন না? উনিতো তোমার বাপি, ইওর ফাদার”। চমকে ওঠে অনিকেত। ফাদার বলছেন যখন তখন কথাটা তো সত্যি। ফাদার তো মিথ্যা বলেন না। “নিতে এসেছেন তোমায়। আজই নিয়ে যাবেন। সাথে গ্রান্ডপা, গ্রান্ডমা ও এসেছেন”। “আজই?” অনিরুদ্ধ ছেলেটার চোখে চোখে রেখে ভরসা দিলো, “হ্যাঁ, আজই”। “এখানে আপনারাই রেখে গিয়েছিলেন?” অনিরুদ্ধ চমকালো, ফাদার সামলালেন। “হ্যাঁ, আসলে তোমার দাদার খুব শরীর খারাপ ছিলো। দাদাকে নিয়ে বাপি মামণি খুব ব্যাস্ত ছিলো। তাই আমাদের কাছে রেখে গিয়েছিলেন”। অনিরুদ্ধ দেখল অনিকেতের চোখে অভিমান জমলো না। শুধু চোখটা ছলছল করে উঠলো। “এখন নিয়ে যাবেন? দাদা ভাল আছে?” “তোমার দাদা আর নেই। গডের কাছে চলে গেছে অনিকেত”। অনিকেত চুপ হয়ে গেলো। অনিরুদ্ধ ওকে কাছে টেনে নিলো, “তোমার মামণির খুব মন খারাপ তাই। সবসময় বাবিন, বাবিন করছে”। “বাবিন মানে আমি?” “হ্যাঁ”, “আমি তো অনিকেত”। “উঁহু, বাবিন”, “ওটা আমার বোন?” অনিরুদ্ধ বুঝল পরীর কথা বলছে। “হ্যাঁ, ছোট্ট বোন”, “তাই ও বাবিন দাদা বলছে?” “হ্যাঁ, তোমার নাম বাবিন, তুমি জানতে না?” “না তো!”, “ভুলে গেছ তবে। আমি তোমার বাপি সেটা মনে নেই?” অনিকেত মনে করার চেষ্টা করে,”না তো!”অনিরুদ্ধ অনিকেতকে কোলে বসায়, “আমি অনিরুদ্ধ মুখার্জী, তোমার বাপি। আর তোমার মামণি হলো নীরা মুখার্জী, আর বোন পরী মুখার্জী”। “তাহলে আমি অনিকেত মুখার্জী?” ফাদার হেসে ফেললেন, “ঠিক ধরে নিয়েছে”। “চলো, বাড়ি যাই তবে”, “এখনি?” “হ্যাঁ,” “ওখানে মামণি আছে?” “আছে। তবে মামণির শরীর তো ভালো না, মামণিকে একটু বুঝে চলবে”। “মামণি রাগী?” অনিরুদ্ধ জানে না। উৎসার সাথে কখনোই রাগ দেখায়নি নীরা। অনিকেতের সাথে কি দেখাবে? “রাগী না। দাদার জন্য মন ভালো থাকে না, তাই। তুমি গেলে মামণির ভাল লাগবে”, “যাবো ফাদার?” ফাদার অগাস্টিন হাসেন, “যাও। বাপিকে মামণিকে, বোনকে, ঠাম্মাকে, দাদুভাইকে খুব ভাল বাসবে। শাঁওলি মিস যাবে ওখানেও। তোমাকে পড়াবে”। “আর স্কুল?” “স্কুলেও আসবে, তাই না অনিরুদ্ধবাবু?” “একদম, স্কুলেও আগের মতোই আসবে বাবিন”, “আমার সব বন্ধুদের বলবো বাপি-মামণির কথা?” “আজ না অনিকেত, কাল স্কুলে এসে, বলবে”। “ওকে ফাদার”।


গাড়িতে রুদ্রদেবও ফিরছিলেন। সামনের সিটে বসেছিলেন। পিছনে অনিরুদ্ধ, কোলে পরী, অনিরুদ্ধর পাশে অনিকেত। অনিরুদ্ধ খুঁটিয়ে দেখে অনিকেতকে। এতটা সাদৃশ্য – ও নিজেই আশা করেনি। মনে হচ্ছে বাবিনকেই ফিরে পেয়েছে, দেড় বছর পর। শুধু মনে হলেই হবে না। এটাকেই বিশ্বাস করতে হবে অনিরুদ্ধকে। অনিকেতকে ভালোবাসতে হবে, উৎসবের মতো করেই। নীরাকে জীবনে ফেরাবার এটাই শেষ সুযোগ। একে হাতছাড়া হতে দেবে না অনিরুদ্ধ। 


“বাবিনদাদা বাড়ি গিয়ে খেলবে তো জেঠুমণি?” পরী ছটফট করে। “বাবিনদাদাকেই জিজ্ঞাসা কর। বাবিন – খেলবি বোনের সাথে”? অনিকেত ঘাড় নাড়ে। ওর আপত্তি নেই। তবে বোন তো ছোট, খেলায় পারবে? “বোন তো ছোট”। অনিরুদ্ধ তাকায়, “তাতে কী?" “যদি বোনের লেগে যায়?" অনিরুদ্ধ খুশি হয়। মনে পড়ে কাকিমণির কথা। কাকিমণি ওকে বলতো, “খেলতে গিয়ে সাবধানে খেলবি। ভাইদের দেখে রাখবি। ওরা ছোট, ওদের আগলে রাখা তোর কাজ”। “কথা না শুনলে?” “কথা শোনাতে হবে। যদি কারোর লাগে আমি কিন্তু যে বড় তাকেই শাসন করবো”। অনিরুদ্ধ কাকিমণির কথার মানে বুঝতো। অতীন আর অনুপমকে আগলে রাখতো মাঠে। ওরাও দাদাভাই এর কথার অবাধ্য হবার সাহস করতো না তেমন। পরে বড় হয়ে দুষ্টু হয়। নিজেরা দুষ্টুমি করে অনিরুদ্ধকে কেস খাওয়াতে চাইত। কিন্তু ধরা পড়ে যেতো। কাকিমণির হাতে মারও খেতো তেমন। অনিকেতের মধ্যে বোনের লেগে যাবে এই চিন্তা দেখে নিজের ছোট বেলার কথা মনে পড়লো। “তুই দেখে রাখবি বোনকে, হবে না?” অনিকেত খুশি হয়,“আচ্ছা”। “তুই তো দাদা – তোর দায়িত্ব”। “আচ্ছা। এই গাড়িটা আপনার”? অনিরুদ্ধ বলার আগেই রুদ্রদেব বললেন, “বাপিকে তুমি করে বলতে হয় দাদুভাই”। অনিকেত চুপ করে থাকে। “শুধু এটা কেন আরো অনেক গাড়ি আছে তোমার বাপির”। “পরী বলে ওঠে, “আমি জানি ডাক্তার দাদু। ন’টা গাড়ি আছে আমাদের। বাড়িতেই থাকে, গ্যারেজে।” অনিরুদ্ধ পরীকে চুমু খায়, “পরী তো মা সব জানে”। চুমু খেয়েই তাকিয়ে দেখে অনিকেতের দিকে। ওর চোখে আদরের প্রত্যাশা দেখে কী? না বুঝলেও ঝুঁকে অনিকেতকে চুমু খায়। বাবিনকেই চুমু খাচ্ছে মনে হয় ওর। বহুদিন পর। “অনি, বাবিন পড়াশুনাতেও ভালো শুনেছ তো”? “হ্যাঁ, কাকাবাবু”। “তোমার মতোই হয়েছে”। অনিরুদ্ধ খুশি হয়। শান্ত ছেলে অনিকেত। ভালো হওয়াটাই স্বাভাবিক। উৎসব আর অনিকেতের চরিত্রগত এই ফারাকটাও নীরার চোখে বাঁধবে, বাঁধবেই। কী প্রতিক্রিয়া দেবে, তা নিয়ে যথেষ্ট আশঙ্কিত অনিরুদ্ধ।


পর্ব – ১৮


গাড়ি থেকে নামতেই মালির চোখের বিস্ময় দেখলো অনিরুদ্ধ। নিধুকাকা, রাধুনী ঠাকুর, মণিপিসি, ড্রাইভার, মালি- বিস্ময় মাখা চোখ টপকে যাওয়া দুষ্কর ছিলো। সবার চোখেই প্রশ্ন লেগে ছিলো যেন। “নিধুকাকা, মণিপিসি – বাবিনকে নিয়ে এলাম”। অনিরুদ্ধই বললো। “বাবিন!” সবার গলায় সম্মিলিত বিস্ময় ঝরে পড়লো যেন। “হ্যাঁ, বাবিন”। রুদ্রদেব বললেন। কড়া গলায়। “নীরার বাবিনকে অবশেষ খুঁজে পাওয়া গেছে, মনে রাখবে”। সবার মুখ বন্ধ হয়ে গেলো যেনো। পরী জেঠুমণির কোলে ছিলো। “জেঠুমণি, সিঁড়ি দিয়ে উঠবে তো। নামিয়ে দাও”। অনিরুদ্ধ মাথা নাড়লো, “না, কোলেই চল। বাবিন – চল”। অনিকেতের হাত ধরে টানলো ও। অনিকেত ভাবলো স্বপ্ন দেখছে ও, না সত্যি।অনিকেত অবাক হয়ে দেখছিলো।এত বড় বাড়ি কখনো দেখেনি ও।ঢুকেই সামনে কত্ত বড় মাঠ,মাঠের বামদিকে ছোট ছোট ঘর,ডানদিকে গাড়ির গ্যারেজ।মাঠের মাঝে ফোয়ারা,দোলনা,স্লিপ রয়েছে খেলার জন্য।বাড়িটাও কত্ত বড়।ভিতরে ঢুকতে ঢুকতে দেখলো বড় হল।ডাইনিং হল মনে হয়।পাশে কিচেন।হলের দুদিক দিয়েও ঘর,অনেক।মাঝে সিঁড়ি।সিঁড়ি দিয়ে উঠে দোতলায় পৌঁছলো ওরা।দোতলাতেও অনেক ঘর রয়েছে।ঢুকেই ডাইনিং কাম ড্রয়িং রয়েছে।এর মধ্যে মামণির ঘর কোনটা?


“মামণির কাছে যাবো এখন বাবিন”। অনিরুদ্ধ অনিকেতকে বললো। “মামণি কোথায়?” “জেঠিমণি, জেঠিমণির ঘরে বাবিনদাদা। তুমি স-ব ভুলে গেছো”। “পরী – তুই একটু ডাক্তারদাদুর সাথে বস – আমি জেঠিমণির কাছে বাবিনদাদাকে নিয়ে যাই?” “বাবিনদাদা বললে জেঠিমণি বকা দেবে, জেঠুমণি। দাদাভাই বলো”। অনিরুদ্ধ হাসলো। “হ্যাঁ তোর দাদাভাই। দাদাভাইকে একটু নিয়ে যাই ওর মামণির কাছে?” “আচ্ছা”। পরীর সামনে নীরার কোন আউটবার্স্ট হোক – এটা চায় না অনিরুদ্ধ। “চলো, বাবিন”। অনিরুদ্ধ অনিকেতকে বলে।


নীরার ঘরে ঢুকতে গিয়েও থমকায় অনিরুদ্ধ। সেই এক কান্ড করে চলেছে নীরা। বাবিনের ছবির সাথে কথা বলে চলেছে। এমন অবস্থায় অনিকেতকে নিয়ে যাবে? কাকিমণি থাকলে ভালো হতো। নীরা কাকিমণিকে মান্য করে, ভয় পায়। কিন্তু কাকিমণিও তো এখন আসতে পারবে না। ভাবতে ভাবতেই অনিরুদ্ধ দেখলো অনিকেত বিস্ফরিত চোখে নীরার উৎসবের ছবির সাথে কথা বলা দেখছে। বুদ্ধিমান ছেলে, কিছু বুঝে না ফেলে। “নীরা –“নীরা ঘুরে তাকালো, “অনি – এত দেরী হলো? পরী কই?” “দেখো কাকে এনেছি”। “কাকে?” চমকালো নীরা। অনিকেত অনিরুদ্ধর আড়ালে লুকিয়ে ছিলো। অনিরুদ্ধ হাত ধরে সামনে টেনে আনলো। “তোমার বাবিন”, আধো অন্ধকার ঘরে এহেন কথা শুনে নীরার আবেগ বাঁধ মানলো না। ছুটে গিয়ে হাঁটু গেড়ে বসলো বাবিনের সামনে। হ্যাঁ – অনি ঠিকই তো বলছে। বাবিন – বাবিনই তো। একটু বড় হয়েছে, হবেই তো। দেড়টা বছর কম সময় নয়। “বাবিন! কোথায় ছিলি বাবা? এ-তদিন মা’কে ছেড়ে থাকলি কী করে? মামণির কত কষ্ট হয়েছে বলতো ...”। অনিকেত কাঠ হয়ে দাঁড়িয়েছিলো। ও বুঝতে পারছে না মামণি কী বলছে। ও কি যেতে চেয়েছিলো নাকি! ওকে তো রেখেই আসা হয়েছিলো। “কী হলো? কী ভাবছিস? ওহ! বকবো ভাবছিস, তাই না? এতদিন না বলে দূরে ছিলি তাই।বকবো। তবে এখন না, আগে আদর করে নিই”। অনিরুদ্ধর চোখে জল চলে এসেছিলো। সন্তানের প্রতি অনিরুদ্ধর ভালোবাসা নীরার থেকে কম না হলেও প্রকাশের কত ফারাক দুজনের। নীরা সত্যিই বাবিনকে না পেযে কষ্ট পেয়েছে - খুব কষ্ট পেয়েছে। "বাবিন - মামণির কাছে যাও, বকবে না"। অনিকেতকে সহজ করতে চায় অনিরুদ্ধ। "তুমি বকোনি তো?" "নাহ, একটুও বকিনি"। অনিকেত এমন আদর জীবনে কোনোদিন পাবে ভাবেনি। মায়েরা তাহলে এভাবে আদর করে? অনেকক্ষণ আদরের ঝড় চলার পর শান্ত হয় নীরা, অনিকেতকে কোলে তুলে নেয়। কোলে করে খাটে বসে, "পরী কই? সে দেখেছে তার দাদাভাইকে?" অনিরুদ্ধর মনটা খুশিতে ভরে যায়। বাবিন এলেও নীরা পরীকে ভোলেনি। "দেখেছে, খুব খুশি সে"। "আমার পরী খুব লক্ষ্মীমন্ত,অনি। ও এলো সাথে বাবিনকেও নিয়ে এলো।" "ভালোই হল এখন নীরার দুই ছেলেমেয়ে, খাটের দু’দিক ভরে থাকবে”। নীরা আরো চুমু খেলো অনিকেতকে, “অনি – একটু লাইটটা জ্বালাও। ভালো করে দেখি বাবিনকে, কতদিন পর দেখলাম বলোতো”।


অনিরুদ্ধ প্রমাদ গুনলো, লাইট জ্বালালেই তো নীরা বুঝে যাবে। অথচ না জ্বালিয়েও উপায় নেই। হঠাৎই কাকিমণির গলা পেলো। “বাবিন চলে এসেছে, অনি?” ধড়ে প্রাণ এলো অনিরুদ্ধর। নীরার রিঅ্যাকশনটার তীব্রতা কমবে এতে। “হ্যাঁ, কাকিমণি”, “কই, দেখি আমার বড় নাতিটাকে”। সুহাসিনী অনিকেতের পাশে গিয়ে বসলেন। “নীরা, খুশি তো এবার? তোমার সাতরাজার ধন এক মাণিক খুঁজে পেলে”। “খুব খুশি কাকিমণি, বাবিন – ঠাম্মা এসেছে দেখেছো?” অনিকেত কিছু বললো না। ঠাম্মাকে ও আগেই দেখেছে, মামণি জানে না। সুহাসিনী অনিকেতকে কোলে নিলেন। আদর করে দিলেন অনেক করে। “তাহলে নীরা, এখন দুই ছেলেমেয়ের মা। একা সামলাতে পারবে তো?” “একা সামলাবো না তো কাকিমণি, আপনি তো আছেন”। “তাই বুঝি? অনি, শুনলি? আমার ও বাড়িতে কাজ নেই?” “ওরা তো আপনার বৌমা, কাকিমণি, মেয়ের কাছে মা বেশি থাকে”। অনিরুদ্ধ নীরার কথায় খুব খুশি হলো। নীরার পাশে গেলো। মাথায় হাত রাখলো। “কী গো, লাইটটা জ্বালাও”। সুহাসিনী অনিরুদ্ধকে চোখের ইশারায় লাইট জ্বালাতে বললেন।


লাইট জ্বালাতেই যা হবে ভেবেছিলো ঠিক তাই হলো। নীরা চমকে উঠলো, ছিটকে খাট থেকে উঠে এলো। “অনি – এ কে? কাকে এনেছো? এ আমার বাবিন না”। অনিরুদ্ধ প্রস্তুত ছিলো। ঠান্ডা মাথায় উত্তর দিলো, “নীরা, ভালো করে দেখো। এ আমাদের বাবিন”। “না, হতে পারে না, কাকিমণি –“ “এ বাবিনই নীরা, বড় হয়েছে, বদলেছে একটু। এমন সামান্য পরিবর্তন হয়”। নীরা অনিরুদ্ধর কলার চেপে ধরলো। “কী ভেবেছ অনি? যাকে তাকে বাবিন বলে নিয়ে আসবে কোথা না কোথা থেকে আর আমি মেনে নেব?” কলার ধরে ঝাঁকাচ্ছিলো নীরা। অনিরুদ্ধ আড়চোখে দেখলো নীরার এই রূপ দেখে কাকিমণি অবাক হয়ে গেছে। কাকিমণির কোলে অনিকেত ভয়ে কাঁপছে। অনিরুদ্ধ নীরার হাত চেপে ধরে কলার ছাড়ালো। “ও যাকে তাকে নয় নীরা! কোথা থেকে না কোথা থেকেও আনিনি। ও বাবিন”। “আমি মানি না।তুমি বাবিনকে চেনাবে আমায়?” নীরা উৎসবের ফটো দৌড়ে নিয়ে আসে, “এ আমার বাবিন”। অনিকেত অবাক হয়। মামণি দাদার ছবিকে বাবিন বলছে কেন? “ভুল করছো তুমি, ও উৎসব। দেড় বছর আগে আমাদের ছেড়ে চলে গেছে। এ, বাবিন”। নীরা রেগে ওঠে, “বাবিন আর উৎসব আলাদা নাকি! তুমি এসব জঞ্জাল যেখান থেকে নিয়ে এসেছো, ফেলে এসো”। “নীরা!” “সুহাসিনী আর না পেরে ধমকে ওঠেন। “কথা বলার সহবত শেখোনি মনে হছে! অনি বলেছে এ বাবিন। আমিও বলছি। আমরা মিথ্যা বলবো?” এক ধমকেই চমকে ওঠে নীরা। ঝরঝর করে কেঁদে ফেলে। “কাঁদবে না, কেঁদে লাভ হবে না। ছোট থেকে মা শাসন করেনি এক মেয়ে বলে তাই এমনতর হয়েছো”। নীরা সুহাসিনীর পা চেপে ধরে। “কাকিমণি – ও বাবিন না। আপনি একবার বলুন”। সুহাসিনী অসহায় কন্যাসমা মেয়েটির মাথায় হাত রাখেন। “ও – ই বাবিন। নীরা”। নীরা অসহায় চোখে তাকায়। “আমি তোমার মা হয়ে, মিথ্যা বলবো?” নীরা সুহাসিনীর পা জড়িয়ে কাঁদতে থাকে। সুহাসিনী অনিরুদ্ধকে ইশারা করেন। অনিকেতকে ওর কোলে দেন। “বাবিনকে নিয়ে ও ঘরে মা, অনি”। নীরাকে খাটে তুলে নেন। “পা ধরে কাঁদে? বোকা মেয়ে”। বুকের মধ্যে টেনে নেন সুহাসিনী। নীরা ওনাকে জড়িয়ে ধরে। ওহ কান্নায় ভেসে যেতে থাকেন সুহাসিনী।


“ঐ ছবির ছেলেটা বাবিন?” অনিকেত অনিরুদ্ধর ঘরে গিয়েই প্রথম প্রশ্ন করে। “না, ও উৎসব। তোর দাদা”। “কিন্তু মামণি তো ওকেই –“ অনিরুদ্ধ অনিকেতকে কোলে নিলো। খাটে বসালো। “মামণি কষ্টে আছে। দাদা নেই বলে। তাই বলছে অমন”। “মামণি আমাকে চায়না, তাড়িয়ে দিলো –“ অনিকেতের চোখে জল দেখলো অনিরুদ্ধ। “কে বললো চায় না? খুব চায়”। “আমি বুঝি, মামণি দাদাকে আর পরীকে ভালোবাসে। আমাকে না”। অনিরুদ্ধর মনটা মোচড় দিয়ে উঠলো। “আর বাপি যে তোকে ভালোবাসে?” অনিকেতের চোখের জল মোছাতে মোছাতে বললো অনিরুদ্ধ। “অল্প”। অনিরুদ্ধ গভীর শ্বাস নিলো। উৎসবের থেকে কী কাউকে ভালোবাসা সম্ভব ওর পক্ষেও, অথচ মিথ্যা বলতে হবে। “উঁহু, সবচেয়ে বেশি”। “পরীর থেকেও?” “হ্যাঁ, একটু বেশি”, “দাদার থেকেও?” “হ্যাঁ, অ-নেক বেশি”। বলেই বুকের মধ্যের একটা পাথর সরে যাওয়া টের পেলো অনিরুদ্ধ। অনিকেতকে ভালোবাসে ও। স্বীকারোক্তিটা করে নিজের কাছেই ভালো লাগছে। যে নেই তাকে আঁকড়ে না ধরে যে আছে – তাকে ভালোবাসাটাই সঠিক কাজ। সেটাই করবে অনিরুদ্ধ। “সত্যি?” “হ্যাঁ – আমি বাবিনকেই সবচেয়ে বেশি ভালোবাসি”। অনিকেত নিজের চোখ নিজে মুছলো। “আমাকে আবার রেখে দিয়ে আসবে না তো?” “না, কক্ষনো না”। “মামণি বললেও?” অনিরুদ্ধ অনিকেতের হাত ধরলো। “নিজের ছেলেকে রেখে আসবো কেন? যখন দাদা অসুস্থ ছিলো – তাই রেখেছিলাম”। “স্কুলের জামা ছাড়বো না?” অনিরুদ্ধ লজ্জিত হলো। ছাড়বি তো বাবা। ব্যাগে করে জামাকাপড় এনেছিস – নিয়ে আসি?” “নীচে?” “হ্যাঁ,” “আমিও যাবো”। অনিরুদ্ধ বুঝলো বাপিকে ছাড়া থাকবে না বাবিন। “চলো”।অনিকেতকে কোলে নিতে গেলো অনিরুদ্ধ। “কোলে তো ছোটরা ওঠে, বাপি। বোন ওঠে”। অনিকেতের মুখে প্রথমবার বাপি ডাক শুনলো অনিরুদ্ধ। ভীষণ আনন্দ পেলো। “তুই এমন কিছু বড় হোসনি কোলে না ওঠার মতো”। অনিকেতকে কোলে নিয়ে বললো অনিরুদ্ধ। “আমি তো বড়ই। বোন ছোট। আমি একা শুই। একা একা খাই। একা পড়ি। একা স্নান করি, একা ড্রেস আপ করি – -“ “এখানে এগুলো সব বাপি করাবে। আর মামণি, ঠাম্মাও করাবে”। “এমা!” “কোন এমা নয়, চল তো ব্যাগ নিয়ে আসি”। “চলো”।


পর্ব - ১৯


"পরীকে তাহলে মফেরৎ দিয়ে দেবে, তাই তো?" অচ্যুতের কথায় সুহাসিনী তাকালেন, "ফেরৎ কেন দেবে? আইনত নিয়েছে তো"। "ওদের বাবিন চলে এসেছে যে, যত্তসব! কোথাকার না কোথাকার আবর্জনা তুলে এনেছে!" "তুমি গিয়ে দেখো কাল, বাবিন কিনা"। অচ্যুত থমকান,"বাবিনই এসেছে? কিন্তু তা কী করে হয়?" "কেন? না হবার কী আছে? বাবিনের চলে যাওয়াটাই তো অবাক করার মতো ছিলো"। "সুহাসিনী মশারি খাটাতে খাটাতে বলেন। "কী উল্টোপাল্টা বকছো, মরা ছেলে ফিরে আসে, নাকি?" অচ্যুত আশ্চর্য হন। "জ্যান্ত ছেলেও তো মাত্র তিন দিনের জ্বরে এভাবে মারা যায় না - অচ্যুত"। সুহাসিনী অচ্যুতের চোখে চোখ রাখেন। "মনে? ডেঙ্গু হলে মরে না? কি বলতে চাইছো?" "ডাক্তার রিপোর্টে ডেঙ্গু লেখেনি কোথাও"। "এসব কথা আমাকে কেন বলছো? আমি কী জানি এসবের?" অচ্যুতকে ঘামতে খেয়াল করেন সুহাসিনী। "এমনিই বলছি"। "সুহাসিনী হাসেন।"ববিনকে অনি নিজে হাতে পুড়িয়ে এসেছিলো, না?" অচ্যুত প্রশ্নটা করেই ফেলেন। "কে জানে? অনিও তো বলছে এ-ই বাবিন"। "আশ্চর্য!""খুবই, তুমি তার জন্য রাতের ঘুম কেন খারাপ করছো। অনির ছেলে ফিরেছে এতো আনন্দের কথা"। অচ্যুত নিজেকে সামলালেন। "কাল যাবে?" অচ্যুত মাথা নাড়লেন, "হ্যাঁ"। "পরীকে নিয়ে চিন্তা করো না। সে খুব ভালো আছে ওখানে"। "সম্পত্তি?" সুহাসিনী হাসলেন, "এইতো ঠিক জায়গায় চলে এসেছো,দুজনে সমানই পাবে, অনি বলেছে"। "সত্যি?" "অনিকে জিজ্ঞাসা করো নিজে"।অচ্যুত খাটে পা তুলে বসলেন। "ছোটগিন্নি - রুদ্র এসেছিলো, না,আজ?" সুহাসিনী অপ্রস্তুত হলেন না। "হ্যাঁ, কেন বলতো?" "না, এমনি"। "বাবিনকে দেখতে এসেছিলো"। "শুধু বাবিনকে"? অচ্যুত হাসলেন, সুহাসিনী ইঙ্গিতটা বুঝলেন। "তোমার সেই সন্দেহ আজও যায়নি না?" "যাবে কী করে বলো? কোনদিন মনটা পেলামই না যে"। "চেষ্টা করেছো? শরীর নিয়েই তো খুশি ছিলে যে ক'বছর ছিলে"। "শরীরটাও তো অনিচ্ছার"।সুহাসিনী এই কথাটা আশা করেননি।এটা অচ্যুত বোঝেন উনি জানতেন না।"থমকালে? আমি শুরু থেকেই জানতাম, গা করিনি। পাচ্ছি তো,যখনই চাইছি - খুশি ছিলাম। এখন মনে হয় - ইচ্ছা না থাকার সাথে সাথে ঘেন্নাটাও ছিলো। আমি তো আর ডাক্তার না। তাও আবার বিলেত ফেরৎ। মেয়েদের মন ভোলানো কথা বলতে পারি না। হ্যাঁ - গয়না এনে দিতে পারি - কিন্তু কাকে দেবো? সে তো পরেই না"। সুহাসিনী বুঝলেন এটাই উচিত সময়, "তোমার বাইরের সংসারের মেয়েমানুষটাও গয়না নেয় না তবে?" অচ্যুতকে কেউ যেন স্থানু করে দিয়েছিলো। "কে বললো এসব?" "বলতে হবে? কেন পাতলেই শোনা যায়।কে সে? কোথায় থাকে?" অচ্যুত চুপ করে থাকলেন। "এখনো যাও?" অচ্যুত মাথা নাড়লেন, "নাহ"। "মিথ্যা বলছো?" "যাই না বৌ, তোমার দিব্যি"। অচ্যুতের মুখে বৌ শব্দটা বহুবছর পর শুনলেন সুহাসিনী। ছোটগিন্নিই বলেন বরাবর, যখন খুব আদরের ইচ্ছা হতো বৌ বলতেন। "শুয়ে পড়ো", সুহাসিনী বললেন। "সব জেনেও ছেড়ে যাওনি কেন?" অচ্যুত প্রশ্নটা করেই বসলেন। "ছেলেপিলে ফেলে কোথায় যেতাম?" "কেন? নিয়ে যেতে ওদের। তোমার বাপের বাড়ি"। "ডিভোর্স? ভালো বলেছো তো। আমার মা বাবা, তাদের মানসম্মান?" "ওহ, মানসম্মানের জন্যেই রয়ে গেল?" "তা কেন? তিনটে ছেলে - বাড়িঘর, পরিবার, শ্বশুর, শাশুড়ি, ভাসুর, জা - কম কী"। "আমি কোথাও ছিলাম-ই না, তাই তো?" "সবই তো বোঝো, তাও প্রশ্ন করো খামোখা"। অচ্যুত উঠে দাঁড়ালেন, ঘরের মাঝে রাখা তিনপায়া টেবিলের উপর থেকে তামার ঘটিতে রাখা জল নিয়ে ঢকঢক করে খেলেন। তারপর বললেন, "পরী নেই, ফাঁকা লাগে না?" "লাগে"। "পরীর ঠাকুরদাকে নেবে?" "ইশ! একদম না, নাক ডাকবে"। অচ্যুত কাছে এলেন। সুহাসিনীর কোমর জড়িয়ে ধরলেন। "আজ থাকি", "কেন?" "তোমাকে কাছে থেকে দেখবো বলে"। "চৌত্রিশ বছর দেখোনি?" "সে দেখার থেকে এ দেখা আলাদা"। "কিভাবে?" "সব জেনেও আমাকে মেনে নেয় যে মেয়ে তাকে দেখবো না?" "তোমাকে মানিনি। মেনেছি পরিস্থিতিকে"। "ঐ হলো"। অচ্যুত হাসেন। "চৌত্রিশ বছর আগে ফিরবে?" "আবার!" "কেন? তোমাকে জ্বালাতাম একটুও?" "একদম জ্বালাতে না"!"অনিটাকে একা তুমি বুকে করে বড় করেছো বুঝি? তার এই বোকা কাকার একটুও অবদান নেই?" সুহাসিনী চুপ করে গেলেন। এটা অস্বীকার করতে পারবেন না কখনো। নতুন দাম্পত্যেও ছোট্ট অনিকে রাতের পর রাত কাছে রাখা নিয়ে সুহাসিনীকে কখনো বিব্রত হতে হয়নি। অচ্যুত কখনো উত্যক্ত করেননি। ছেলে ঘুমোলে অচ্যুত আসতেন, পাশের খাটে ডাকতেন। কিন্তু তাও সুহাসিনীর ক্লান্তি, বুঝে। ছেলে জেগে কেঁদে উঠলেই সুহাসিনী ছুটতেন, অচ্যুতও। "দাদাভাই দিদিভাইকে অনিকে নিয়ে হ্যাপা করতেই হয়নি", সুহাসিনী বললেন। "আমরাও কী হ্যাপা করেছি বৌ? ছোট্ট প্রাণটাকে মাঝে রেখে এগোতে তো হ্যাপা লাগেনি আমার কোনদিন"। "অনির আগের বাচ্চাটার ঠিক কী হয়েছিলো অচ্যুত? বাবিনের মতোই নাকি ..."। সুহাসিনী বহুদিন পর স্বামীর নাম ধরলেন। অচ্যুত সুহাসিনীর মুখে হাত চাপা দিলেন, "চুপ, এসব বলবে না"। "কেন?" "বলেছি বলবে না, বলবে না"। "কেন বলবে তো", "এটা অভিশাপ। পাপের ফল"। "পাপ! অভিশাপ! করে?" "কাল বলবো, আলো ফুটলে"। "ভয় পাচ্ছো?" "পাচ্ছি। কারণ আছে"। সুহাসিনী জোর করলো না। " শুয়ে পড়ো।", "ওই খাটে না"। "বেশ, এখানেই শোও"। অচ্যুত সত্যি সত্যিই সুহাসিনীর পাশে শুয়ে পড়লেন। সুহাসিনীর বুকে মুখ ডুবিয়ে দিলেন। আঁকড়ে ধরলেন তারপর। "একি! এভাবে তো-", "পরী শোয়, আমিও এভাবেই শোবো"। "বেশ, ভয় পেয়ো না, ঘুমাও"। "বৌ -""বলো"। "আমি খারাপ, না?" "কই,না তো"। "তাহলে আমাকে ছেড়ে যাবে না তো কখনো?" "মরতেও দেবে না বলছো?" অচ্যুত সুহাসিনীর বুকে মুখ ঘষেন, "মরবে না, কোথাও যাবে না আমাকে ছেড়ে"। "আচ্ছা"। "আমি ভালো হয়ে যাবো"। "আচ্ছা"। "অনিকে নীরাকে, বাবিনকেও খুব ভালোবাসবো, ছোট্ট অনিকে যেমন বাসতাম বাবিনকে তেমন ভালোবাসবো"। "বাহ"। সুহাসিনী বুঝলেন ধরা পড়ে গিয়ে অনুতপ্ত অচ্যুত আজ। "বাবিনের জন্য কী নিয়ে যাবো কাল?" "গয়না - ওটাই তো তুমি দাও"। "তোমার মা বাবাও তো গয়না দিয়েছেন আমায়"। "কই? গলার হার, পাঞ্জাবির বোতাম আর আংটি ..." "উঁহু, তুমি, বাঁদরের গলায় মুক্তোর মালা"। অচ্যুত বলেই হেসে উঠলেন। সুহাসিনী মুখে হাত চাপা দিলেন। "এমন বলতে নেই, আর রাত দুপুরে হেসো না, ছেলেদের ঘরে আওয়াজ যাবে"। অচ্যুত মুখে আঙ্গুল দিলেন। "ঘুমাও"। সুহাসিনী বললেন। "আচ্ছা", ঘুমিয়ে পড়লেন অচ্যুত।


পর্ব – ২০ 


“নীরা – শুয়ে পড়ি চলো”, অনিকেতকে কোলে নিয়ে নীরার ঘরে এসেছিলো অনিরুদ্ধ। পরী ততক্ষণে জেঠিমণির পাশে শুয়ে পরেছে। “ওকে রেখে এসো। পরী ঘুমিয়েছে। “নীরা স্পষ্ট করে বললো। বিকাল থেকে পরী জেঠুমণির কাছে ছিলো। পড়িও বাবিন ভাবছে ছেলেটাকে। দাদাভাই বলছে। মাঠে বিকালে খেলেওছে দুজনে। ফিরে এসে জেঠিমণিকে কত গল্প। ওর দাদাভাই খুব ভালো, আর দুষ্টু নেই। পড়ে গেলে ছুটে গিয়ে তুলে আনে। জেঠুমণিকে ডেকে আনে। নীরা অবোধ মন্টাতে কোন কালির দাগ লাগায়নি। রুচিতে বেধেছিলো। দোষ তো বড়দের। ও বাবিনকে যেটুকু চিনতো ছেলেটাকে বাবিন ভাবতে অসুবিধা হবার কথা নয়। নীরাও দেখেছে। অনেকটাই মিল, পরী সন্ধ্যাবেলা জেঠিমণির কাছে বই নিয়ে বসে আজকাল।বসেছিলো, পড়তে পড়তেও সারাক্ষণ দাদাভাই।


“পড়ায় মন নেই, পরী ?” “পড়ছি তো জেঠিমণি”, “কই? শুধু গল্প তোর”, “ও তো আজ এও খুশি বলে”। “কেন?” পরী জেঠিমণির গলা জড়িয়ে ধরে, “দাদাভাই এলো যে”, “খুব মজা?” “খু-উ-ব, সারাদিন তো কেউ ছিলো না। এখন দাদাভাই থাকবে, খেলা যাবে”। “ও বাড়িতে তো দুটো দাদা তোর”। “হ্যাঁ, খেলতাম তো, সারাদিন। তারপর সন্ধ্যায় পড়তে বসে ঘুম ঘুম। মায়ের হাতে দুম দুম কিল খেতাম”। নীরা আঁতকে ওঠে। এটা কী করতো ওর মা। এইটুকু দুধের বাচ্চাকে কেউ মারে? নীরা তো কখনো বাবিনকে মারেনি। অনির হাতে মার খেয়েছে বাবিন। কিন্তু সেগুলো তো খুব দুষ্টুমি করলে তবেই। নীরা পরীকে চুমু খেয়েছিলো। “পড়ো এবার”। “এমা, তুমি বকবে না? মন নেই যে”, “না, আমি বোঝাবো যে পড়তে হয়। আমি বকাঝকা করার মতো মা না – পরী”। “পরী জেঠিমণির গালে চুমু খায়”, “তুমি ভালো মা”। নীরা খুশি হয়েছিলো, “তাহলে ডাকিস না যে – খালি জেঠিমণি - - -“ পরী জেঠিমণির বুকে মাথা রাখে। বোঝায় ও ডাকবে। নীরা ভোরে করেনি। পরীটার মা হতে ভালোই লাগবে ওর। কিন্তু পরী যাকে দাদাভাই বলছে, ভাবছে, মাঞ্ছে – তার মা হতে পারবে না নীরা। কখনোই না। এটা সব্বার ওকে বাবিনের কাজ থেকে আলাদা করার জন্য করছে। ও ওর বাবিনকে ভুলবে কী করে, ছাড়বে কী করে।


সন্ধ্যায় মা, বাবা এসেছিলেন। নীরার মা, বাবা, খুব একটা আসেন না। অনি-ই নিশ্চয় খবর দিয়েছে। বাবা মা এসে নীরার ঘরের সোফাতেই বসেছিলো। অনি ঐ ছেলেটাকে সাথে করে এসেছিলো তারপর। বাবা মা – ও বাবিন ভেবেছে। বাবাতো খুশিতে লাফিয়ে উঠেছিলো। ওকে কোলে টোলে নিয়ে - - আর মা কাঁদছিলো, অঝোরে। ওরাও কী ঠকছে? নাকি সবাই মিলে নীরাকে ঠকাছে। ছেলেটা দাদুভাই, দিদুন বলছিলো – দিব্যি। প্রণাম করেছিলো ঘরে এসেই। যেমন বাবিন করতো, এই সহবত গুলো তো নীরার শেখানো। এ শিখল কী করে, নিশ্চয় অনিই শিখিয়েছে। নীরাকে বাবিনের দেখভাল ঠিক করে করতে বলে গেছে মা – বাবা, এর মানে ও এখানেই থাকবে। 


মনিপিসি আর নিধু কাকাকে বলে বাবিনের ঘর পরিস্কার করিয়েছে নীরা। বাবা-মা যাওয়ার পর। খাকবে যখন ওখানে শোবে। বাবিন যদিও ওখানে ক’দিন ঘুমিয়েছে যাতে গুণে বলা যাবে। রোজ দিনই সে জেদ করতো বাপি মামণির মাঝে ঘুমাবে। বড় হলে রোজ জেদ রাখবো না অনি। সেপারেশন অভ্যাস করছিলো। নীরার ইচ্ছা না থাকলেও বাবিনের ভালোর জন্য সায় দিতো। শুতে গিয়েই আবার ফিরে চলে আসতো কোন কোনদিন। ভয় লাগছে বলে অনি আর গম্ভীর মুখ করে থাকতে পারতো না। বাহানা জেনেও হেসে ফেলত। দুজনের মাঝে নিয়ে নিতো। বাবিন যাওয়ার পর অনি তো আর এ ঘরে শুতোই না। নিজের বেডরুমে আলাদা শুতো, হালে তো আবার শুতো, পরীকে মাঝে রেখে।


“বাবিনকে কোথায় রেখে আসবো?” “ওর জন্য ঘর পরিষ্কার করিয়েছি”। “একা শোবে, এতদিন পর এলো?” অনিরুদ্ধ নিজের কাঁধে অনিকেতের হাতের চাপটের #### “হ্যাঁ, বড় হয়েছে। তুমিই তো সেপারেশন অভ্যাস করাতে চাইতে, আর অনি – ও আমায় বাবিন নয়। তাই ওকে এই বিছানায় আমি মানবোও না – বাবিনের জায়গাতেও মানবো না”। নীরা চাপা গলায় বললো, “নীরা! সবাই মানছে তোমার সমস্যা কোথায় শুনি?” একটু বেশি বাড়াবাবি করে ফেলছো না?” অনিরুদ্ধ ধমকে ওঠে, নীরা কিছু বলার আগেই অনিকেত বলে, “বাপি, মামণিকে বকো না। মামণির কষ্ট হবে, কাঁদবে, আমি একা শুতে পারবো। আমাকে রেখে এসো”। অনিরুদ্ধ নীরার দিকে তাকালো, “দেখেছো, কত ভালোবাসে তোমায়? নিজের পার্টটা ভাবছে না – তোমার পার্ট ভাবছে। না বাবিন – একা কেন? তুমি বাপির সাথে শোবে”। “তুমি আসবে না?” নীরা বলে, “না, আমি আমার বাবিনের সাথে থাকবো, ছেলেটা এতদিন পর এসেছে। ওকে ছেরে থাকতে পারবো না”। বলেই চলে গিয়েছিলো অনি। নীরা অবাক হয়েছিলো, ঐ ছেলেটাকে এত ভালোবাসছে অনি? বাবিনের মতো করেই তো। নাকি তার থেকেও বেশি! ভালবাসলে কেন ভালোবাসছে এভাবে! নীরার মনে একটা অদ্ভুত কষ্ট শুরু হলো, রাগও। বুকের ভেতরটা জ্বলছে যেন, একেই কী ঈর্ষা বলে? কিন্তু ঈর্ষাটা কাকে, ঐটুকু ছেলে? কেন? নিজেই বুঝলো না নীরা।


পর্ব – ২১


"স্কুল থেকে ফিরে টিউশন! কোথায়? প্রতীক - দেখো তোমার বোন কী বলছে"। শাঁওলি স্কুলে বেড়োবার আগে বৌদিকে বলেছিলো টিউশন করতে যাবে। যেতে তো হবে অনিদার ওখানে, ফাদারের নির্দেশে, অনিকেত কেমন আছে, দেখতে, "টিউশন? না, না, ওসবের দরকার নেই, মিত্রা - তোমার আদরের বোনকে না করে দাও। নেট টা দিক এক মন দিয়ে, "প্রতীক সাফ বলে দেয়, "যেতে হবে, দাদাভাই। ফাদার অগাস্টিন পাঠাচ্ছেন। "ফাদার! নিয়ে পাঠাচ্ছেন। তাও টিউশন করতো কোথায়?" মিত্রা শাঁওলিকে চেপে ধরলেন। "ওহ, বৌদিমনি, তোমার পুলিশি জেরা সবসময়। "দেখেছো? কেমন কথা হয়েছে?"মিত্রা ননদকে খুব ভালোবাসে, বিয়ে হয়ে আসার সময় শাঁওলি বছর বারোর ছিলো। সেই থেকে শাঁওলি মিত্রার আদরে, শাসনে বড় হয়েছে। বৌদি ননদে খুব বন্ধুত্বো আছে – আবার ভয়টাও বৌদিকেই পায়। দাদাভাই – এর কাছ থেকে কিছু আদায় করতে হলে বা পারমিশন নিতে হলেও বৌদিমণিই ভরসা। “দাও, দু-চার ঘা, ঠিক হয়ে যাবে”। প্রতীক হেসে বলে, শাঁওলি বৌদিমণিকে জড়িয়ে ধরে, “যেতে হবে, তুমি পারমিশন দাও”। “আমি তো জেরা করি! পারমিশন কাকুর থেকে নে”। “ইস! না, না, দাও না পারমিশন”। “কথায় যাবি ঠিক করে বল আগে”, “অনিদার বাড়ি”, প্রতীক অবাক হয়, “অনির বাড়ি কেন রে?” “অনিদা কাল আমাদের অরফ্যানেজ থেকে একটা বাচ্চা আডপ্ট করেছে”। “বাচ্চা! কতটুকু? অনি আডপ্ট করলো? ওরা তো খুব অর্থাডকস”। “ছয় বছর বয়স, অনিকেত ওরনাম, খুব ভালো ছেলে, ওকে নাকি অনিদার বাবিনের মতোই দেখতে,” প্রতীক এবার বুঝলো, “আচ্ছা, বাবিনের মতো দেখতে টাই আনল তবে, তা তো কি কাজ সেখানে?” “দু’মাস অব্জার ভেটরি যোদু চলতে দাদাভাই, আমাকে গিয়ে দেখতে হবে অনিকেত ঠিক আছে কিনা”। মিত্রা অবাক হলো, “তুই কেন? তুই তো ছোটো”। “জানি না বৌদিমণি, ফাদারের নির্দেশ”, “হয়তো অনির সাথে ওর পূর্ব পরিচয় আছে বলেই ফাদার ওকে বোঝাছেন”। প্রতীক বললো, “হয়তো, ঠিক আছে মা, সাবধানে থাকবি, তাড়াতাড়ি ফিরবি। আর ওরা তো ভীষণ বড়লোক। বুঝে শুনে কথা বলবি, চলবিত্ত, “ভীষণ বড়লোক! অনিদাকে দেখে তো বোঝাই যায় না সেসব। “আচ্ছা”, “কীভাবে যাবি?” “গাড়িতে, অনিদাদেরই গাড়ি। অনিকেতকে নিতে স্কুলে আসবে তো। ওর আগে ## হলেও পরে আমাকে নিয়ে যাবে, বাড়ি দিয়ে যাবে”। “অনিকেত তোদের স্কুলেই পড়বে?” “হ্যাঁ, মিড সেশনে কোথায় যাবে? আমি তো বলেছি পরীকেও আমাদের স্কুলে দিতে”। “পরী?” মিত্রা অবাক হয়, “অনিদার ভাইঝি, অনিদাদের সাথেই থাকে। খুব মিষ্টি আর টরটরে”। মিত্রা শাঁওলির জন্য টিফিন প্যাক করতে থাকে। “তোর মতোই তবে”। “এত টিফিন! দিওনা! নষ্ট হবে!” মিত্রা চোখ বড় করে”। “পুরোটা খেয়ে, আসবি”। “দেখেছ দাদাভাই, খালি বকে”। পরতীক জানে এগুলো খুনসুটি। মুচকি হাসে, মিত্রা বলে, “যখন ফিরবি, দাদাভাই থাকবে তো?” শাঁওলি জিভ কাটে। “অইতো! দাদাভাই তো পাটনা যাচ্ছে! ভুলেই গিয়েছিলাম। না, না বৌদিমণি – তুমিতো বকবেই। তুমি ছাড়া কে বকবে বলো?” মিত্রা বলে, “না খেয়ে বাড়ি এলে তোমার হবে”। শাঁওলি বৌদির থেকে টিফিন বক্স নেয়। জুতো পরে, “আসি, দাদাভাই, আসি, বৌদিমণি”। শাঁওলি গেলে ঘড়ি দেখে মিত্রা, সাড়ে ছটা, মেয়েকে তুলতে হবে, স্কুলে যাবে। ওর স্কুল কাছেই। শাঁওলির স্কুল দূরে অনেক শ্বশুর – শাশুড়ীরা ঘমোছেন। ওদের দাকে না মিত্রা, বয়স হয়েছে, নিজে উঠেই দুজঙ্কে স্কুলে পাঠায়, রোজ। তারপর কাকিমা উঠে চাক্রে, মিত্রা জলখাবার করে স্নানে যায়, ন’টায় ওকেও বেরোতে হয়। সরকারী অফিসে কাজ করে মিত্রা, ইন্ডিয়া পোষ্টে। “ছেলেমানুষই রয়ে গেলো”। বোনকে উদ্দেশ্য করে বলে প্রতীক। “থাকুক, পি এইচ ডি টা করে নিক, তারপর বিয়ে থার কথা ভাববে”। “আমি তো ভাবছিই না”। “মা-বাবা, কাকা-কাকিমা - -“ “আমি বোঝাবো, সবে তেইশ তো, এখনি কি”। “চাকরিটা ছাড়াও নেটের জন্য পড়ুক, “আমরা থাকতে চাকরির কি দরকার এখনি”। স্কুলটা মনে হয় ও এনজয় করে, মিরা”। “আর এই যে অতিরিক্ত হাঙ্গামা গুলো”। “অনিদের বাড়ি যাওয়ার কথা বলছো?” “ব্যাপারটা আমার ভালো ঠেকছে না”। “দেখোই না ক’দিন, না হলে আটকাবে”। “তোমার বন্ধুর বাড়ি – তুমি ভালো বুঝবে”। “অনি খুব ভালো ছেলে, মিত্রা। খুব ডাউন টু আর্থ”। “আর ওর ওয়াইফ?” “জানি নয়া, এডভোকেট শুনেছি। বিয়েতে বলেছিলো আমায়, রেসেপশনে দেখেছি, খুব সুন্দরী”। তেইশ তো বিপদ”। প্রতীক হাসলো, “হ্যাঁ – একটা অহংকার থাকে সৌন্দর্যের, কিন্তু মনে হয় তেমন নয়। নাহলে অনির সাথে মানাতে পারতো না”। “লাভ ম্যারেজ?” “না, না, আরেজ্ঞড, অনির কাকিমণি দেখে শুনেই দিয়েছেন”। “অনিরুদ্ধবাবুর মা-বাবা নেই, তাই না?” “না, আমাদের বিয়ের সময় নাগাদই মারা যান, আয়াক্সিডেন্টে”। ঐ জন্যি অনি আমাদের বিয়েতে আসতে পারেনি”। “আমাদের বিয়ে তো ওঠছুড়ি। তার বিয়ে ...” মিত্রা মুচকি হাসে, “নাহলে যদি ফস্কে যেতে?” প্রতীক চোখ মারে, “সরকারী চাকরি পাওয়া মেয়ে – যদি বাড়ি থেকে অন্যত্র দিয়ে দেয়? তাই আর দেরী করিনি। চটপট একটা চাকরি জুটিয়ে, বিয়ে”। “এখন মনে হয় – ভালোই করেছি। না হলে এত তাড়াতাড়ি সব দিকে এগোতাম না”। মিত্রার চোখে খুশির ঝলক দেখে প্রতীক, “বিয়ের তাড়া না থাকলে আগে দু-চার বছর বাবার হোটেলে চালাতাম বলছো?” মিত্রা মুচকি হাসে, “রিজিওনাল ম্যানেজার তো হতে না – পঁয়ত্রিশেই”। প্রতীক মিত্রার হাত ধরলো। “সব তোমার জন্য”। মিত্রা কিছু বললো না আর। 


পর্ব – ২২


স্কুল থেকে ফিরে গাড়ি থেকে নামতে যাবে, অনিকেতকে ঘিরে ধরলো দু-তিনজন। এরা এ বাড়িতে কাজ করে। একজনকে চেনে অনিকেত, নিধুকাকা বলে বাপি। নিধু দাদু বললো, “ব্যাগটা নিয়ে দাও খোকাবাবু”। “কেন?” “ভারী না? ও নিয়ে যাবে, একটা ছেলেকে দেখালো”। “না, না, থাক নিধুদাদু, তুমি খেয়েছো?” নিধুদাদু অবাক হয়ে তাকিয়ে ছিলো। ওকে কি কেউ জিজ্ঞাসা করে না খেয়েছে কিনা, “খেয়ে নাও সবাই। আমি সিঁড়ি দিয়ে চলে যাবো”। অনিকেত নিজের ব্যাগ লোককে দিয়ে বওয়াবি কেন? ও তো নিজেই পারে। আজ ওর আগে আগে ছুটি হয়েছে। শাঁওলি মিস বলেছিলো একসাথে আসবে। কিন্তু মিসের তো অনেক দেরি হবে – তাই বাপিকে বলে ও একাই ফিরে এসেছে। ওকে দিয়ে গাড়িটা সবসময় স্কুলের সামনেই পার্ক করা থাকে। বাপি শাঁওলি মিসকে দিয়ে গাড়িতে তুলিয়ে ড্রাইভার কাকুর সাথে কথা বলে তবে ছেড়েছে। 


ক’টা বাজে?বারোটা কুড়ি! এ মা, বোনও ফেরেনি তাহলে! বোন ফেরে দুটোয়। অনিকেত ফেরে চারটেয়। বোন পুচকি, ওর ছোট্ট স্কুল। তার মানে ঠাম্মাও আসেনি। ঠাম্মা আসবে দেড়টায়। বোনকে স্নান করাবে, খাওয়াবে – মামণিকে খাওয়াবে – বোন, মামণি ঘুমোলে নিজেও বাপির ঘরে শোবে একটু। অনিকেত এলেই আবার অনিকেতে নিয়ে, পড়বে।খাওয়ানো, ড্রেস চেঞ্জ করানো – অনিকেত যত বলে পারবে, ঠাম্মা ছাড়বেই না। মিসের কাছে পড়তে বসার আগে দুইভাই বোনকে একটুক্ষণ মাঠে ছাড়ে ঠাম্মা। খেলে এসে পাঁচটা থেকে মিসের কাছে পড়ে আবার বাপি এলে বাপির কাছে পড়তে হয় অনিকেতকে। গত দুদিনে এই রুটিনটাই দেখেছে অনিকেত। কিন্তু আজ কী হবে, আজতো ও আর মানণিই শুধু – উপরে।


মামণি কোথায়? দেখতে ইচ্ছা করে অনিকেতের। মামণির ঘরে উঁকি মারে।স্কুল থেকে এসে পিঠের ব্যাগ রাখেনি জুতোটাও খোলেনি। মামণি এমন সময় নাকি ঘরে থেকে দাদার ছবির সাথে কথা বলে। বোন বলেছে। এখনো কি তাই বলছে? এই দেখার কৌতুহলে উঁকি দিয়ে ফেলে অনিকেত, আর ধরা পড়ে যায়। নীরা বলে, “কে ওখানে?” নীরা পরী আসার আগে নিয়ে স্নান করবে বলে রেডি হচ্ছিলো। হটাৎ উঁকিটা ওর নজর এড়ায় না। ঐ বাচ্চাটা না? এখন? ওর তো স্কুলে থাকার কথা। চারটেয় ফেরে, ফিরে একটু খেয়ে খেলে পড়তে বসে, এখন কী করছে? অনিকেত বোঝে না উত্তর দেবে কি দেবে না। লুকিয়ে যাবে? কোথায় লুকোবে? বাপির ঘরে? বাপির ঘরেও যদি মামণি চলে আসে খুঁজতে খুঁজতে। ভয়ে জড়োসড়ো হয়ে যায় অনিকেত। নীরা ঘর থেকে বেরিয়ে আসে। কাঁচুমাচু মুখে দাঁড়ানো অনিকেতকে দেখে। হঠাৎ-ই রেগে যায়, “উঁকি দিচ্ছিলিস?” “না, মামণি”। “আমি দেখলাম তো, আবার মিথ্যাও বলতে জানিস?” নীরা কান ধরে অনিকেতের, “কারোর ঘরে উঁকি দিতে নেই – জানা নেই?” অনিকেতের চোখ ছলছল করে।নীরা দেখে। নিজের রাগটা কমায়। কান ধরে টেনে নিয়ে টুলে বসায়। পিঠের ব্যাগটা খোলায়। পাশের চেয়ারে রাখে। “এখন ফিরলি?” “আজ একটা পেপের ছিলো জাস্ট”।অনিকেতের চোখ দিয়ে জল পড়ে। নীরা মুখটা তুলে ধরে, “চোখ মোছ, অনিকে বলে এসেছিস?” “বাপিই তো গাড়ির ড্রাইভার কাকুকে বলে দিলো ----“ নীরা নিশ্চিত হলো। অনি জানে তবে। মণি পিসি এসে পড়ে ছিলেন ততক্ষণে। “বৌমা- আমি চেঞ্জ করিয়ে দিচ্ছি ----“নীরা ভাবলো একটু, বাবিনকে তো মণিপিসি চেঞ্জ করিয়ে খাইয়ে দিতেন। একেও -- হঠাৎ ছেলেটার মুখের স্বস্তির ভাব দেখে মত বদলায় নীরা। ও নিজেই করাবে, ভয়টা বজায় রাখতে চায় নীরা। “না মনিপিসি, আপনি যান। আমি করাচ্ছি”। “তুমি পারবে? বাবিনকে তো আমিই –“ নীরা আড়চোখে দেখে মুখটা ফ্যাকাশে হয়ে গেছে ছেলেটার, “পরীকেও তো করাই। কাকিমণির আসতে দেরি হলে – কে করায় তখন? আপনি যান।" মনিপিসি চলে গেলে নীরা জুতো খোলাতে যায়। “আমি পারি মামণি”। “আবার কথা?” নীরা জুতো মোজা খুলিয়ে দেয়, “কী পেপার ছিলো তোর?” “ইংলিশ”। “কোয়েশ্চেন পেপার কোথায়?” “খাতায় কোয়েশ্চেন লিখে এক সাথে তো খাতা জমা নিয়েছে। দিলে, দেখাবো, তুমি দেখবে?” নীরা বলে, “হ্যাঁ, স্কুল থেকে এসে, আগে দেখাবি”। “আচ্ছা, মামণি ----“ মামণি ডাকটাকে নীরা না করতে পারেনি। এই ছেলেটাও বাবিনের মতোই। মা হারা, কোথায় না কোথায় মা’কে হারিয়ে ফেলে এসেছে— যদি নীরাকে মামণি বলে আনন্দ পায়, পাক, “বল, “ “আমি চেঞ্জ করে নিচ্ছি। পারি সব। ওখানে তো একাই করতাম”। “ওখানে?” “যেখানে রেখে এসেছিলে আমায়। স্কুলের পাশে। অনেক ছেলেরা থাকতো”। “হোস্টেল?” “হোস্টেলই, কী একটা বলে – হ্যাঁ – অরফ্যানেজ”। নীরা বুঝলো স্কুলের লাগোয়া অরফ্যানেজের বাচ্চা। অনি আনার সময় বলেছে যে ওরাই রেখে এসেছিলো। “অত পারতে হবে না। জামা কাপড় কোথায়?” “বাপির ঘরে”। নীরা ইচ্ছা করেই ভাঙ্গলো না কিছুই। বাচ্চাটার মনে আঘাত দিতে ওর বাঁধে। অথচ বাবিনের জায়গায় বসাতেও আটকায়।


নীরা ঘরে ঢুকে দরজা ভেজায়। অনির কাবার্ড খোলে। ছেলেটার জামাও এখানে!ওর ঘরে রাখলেই তো পারে। অনির বড্ড প্রশ্রয়। রাতে নিয়ে ঘুমোনো, বাবিনকে তো আলাদা করতে ব্যস্ত হতো। নাকি নতুন জায়গায় যাতে ভয় না পায় তার জন্যই এমন করে। অনিকে বলবে আজই – একা শোওয়াতে। না হলে অভ্যাস হবে না। অনি একে বাবাই-এর থেকেও বেশি ভালোবাসে? তা কি করে হয়? পরীক্ষা নেবে নীরা, আজই নেবে। অনিকেতের জামা খোলায় নীরা। ভিতরে গেঞ্জিও পরিয়েছে অনি। বুদ্ধি করে। গেঞ্জিটা ভিজে জল হয়ে গেছে। অক্টোবর মাস – এত ঘাম তো উচিৎ নয়। ভয়ে, নাকি? কে জানে! স্নান করিয়ে দেবে আবার, ঠিক করলো নীরা, “এত ঘেমেছিস কেন?” নীরা টাওয়েল দিয়ে ঘাম মুছিয়ে দেয়, “এটা ধরে থাক, পরে বাথরুমে যাবি”। টাওয়েলটা অনিকেতের হাতে দেয় নীরা। প্যান্ট খুলিয়ে দেয়। দিয়েই থমকায় ডান থায়ের বাইরের উপরের দিকে ভিতর ঘেঁষা তিলটাতে চোখ আটকায়। হাত দিয়ে ডলে দেখে। না – তিলই। “এই তিলটা তো ছোট্ট থেকেই, মামণি”। নীরা গম্ভীর হয়। ও বুঝতে পারে না এটা কী করে হলো? বাবিনেরও এখানেই তিল আছে। “তুমি জানো না?” “জানি, ঐ জন্যই দেখলাম”। নীরা টাওয়েল পরায়। “চল”, “কোথায়?” “স্নানে”। “সকালে করেছি তো মামণি”। নীরা কান ধরে আবারো। “ঘাম গা সপসপ করছে এর মধ্যে জামা পরে খাবি? চল, স্নানে চল আগে। "অনিকেত বোঝে মামণি খুব রাগী। মুখে মুখে কথা বললেই রেগে যাবে। চুপ হয়ে যায় ও। নীরা কান ধরেই নিয়ে যায় বাথ্রুমে। অনি নীরাকে শাসন না করার জন্য দোষ দিতো আগে। এবার আর দোষ দিতে পারবে না।


বাথরুমের দরজায় নক শুনে শাওয়ার অফ করে নীরা। “নীরা – ভেতরে বাবিন আছে?” কাকিমণির গলা। চিন্তিত লাগছে। “স্নান করাচ্ছি কাকিমণি”। নীরার জবাব শুনে সুহাসিনীর বুকের ধড় ফড়ানি কমে। অনি যেই বলেছে বাবিন আগে ভাগে চলে এসেছে সুহাসিনী হুটোপাটা করে চলে এসেছেন। নীরা যদি বাবিনকে অন্য কারোর হাতে খাওয়াতে ছেড়ে দেয় – আর আগেই পৌঁছতে হবে। “আচ্ছা – করিয়ে নাও। এখন স্নান, নীরা?” “ঘেমে গিয়েছিলো খুব।"একটু পরেই টাওয়েল পরা বাবিনকে নিয়ে বেরিয়ে আসে নিরা। “খাবার গরম করছি, ছেলেকে চেঞ্জ করিয়ে নিয়ে এসো”। “আচ্ছা”। “বাবিন – পেপার কেমন গেল?” “ভালো, ঠাম্মা”। সব পেরেছো?” “হ্যাঁ”, নীরা অবাক হয়, “স-ব পারলি?” “নীরা, তোমার বাবিন বড় হয়ে যেমন শান্ত হয়েছে – তেমনি পড়া শুনাতেও ভালো হয়েছে। ক্লাসে ফার্স্ট হয়”। নীরা মুচকি হাসলো। ঐ জন্যই অনির এত পছন্দ এই বাচ্চাটাকে। শান্ত, ভদ্র, ফার্স্ট হয় – যেমন অনি চেয়েছিলো – তেমনি। 


“তোমার কাকা এসেছিলেন কাল?” অনিকেতকে খাওয়াতে খাওয়াতে নীরাকে প্রশ্ন করলেন সুহাসিনী। নীরা স্নান করে এসে চুল মুছছিলো। “হ্যাঁ, সন্ধ্যা বেলা এসেছিলেন, কাকিমণি”। “কিছু বললেন?” “না, না, বাচ্চাদের নিয়েই ব্যস্ত ছিলেন সারাক্ষণ, ওদের জন্য কত কী নিয়ে এসেছেন”। “কত কী?” “অনেক কিছু ঠাম্মা। বোনের জামা, আমার জামা, খেলনা গাড়ি, ব্যাট, বল, ফুটবল ----“ “বাব্বাঃ!অনেক কিছু তো”। সুহাসিনী হাসলেন। “বাবিন ফিরে আসায় খুব খুশি উনি”। নীরা কাকিমণির মুখে কাকার প্রশংসা শুনে অবাক হলেও মুখে কিছু বললো না। কাল যেমন অনিও চুপ করেই ছিলো। “ঠাম্মা, এই দাদুভাই তোমার হাসব্যান্ড?” সুহাসিনী অনিকেতের গালে আদর করেন। “হ্যাঁ ঠাকুরদাদা হয়, বাবিন”। “তাহলে – ঐ দাদুভাই?” সুহাসিনী চমকে ওঠেন। নীরা, বোঝে ডাক্তার কাকার কথা বলছে ছেলেটা। “কাকিমণি – আমাকে প্লেটটা দিন তো, খাওয়ার নাম নেই শুধু গল্প!” অনিকেত ভয় পায়। “নীরা, বকো না। দেখো, কেমন ভয়ে কাঁপছে ছেলে। ঐ দাদুভাই আমার বেস্ট ফ্রেন্ড, বাবিন। আবার মস্ত ডাক্তার”। “ওহ।” সুহাসিনী অনিকেতের পিঠে হাত বুলিয়ে দিতে থাকেন, “খেতে খেতে বাচ্চাকে বকতে নেই”। সুহাসিনী নীরাকে বলে। পরী স্কুল থেকে ফেরে তখনি। “দাদাভাই!” ছুটে চলে আসে ও। ওর ব্যাগ হাতে নিধুকাকা এসেছিলেন। “ব্যাগ রেখে দিন, কাকা”। নীরা বলে। “তুমি চলে এসেছো, স্কুল থেকে – দাদাভাই?” “হ্যাঁ – জাস্ট একটা পেপার ছিলো তো”। “কী মজা!” নীরা পরীর কাছে যায়। কোলে নেয় ওকে, দুগালে চুমু খায়। “মজা কেন?” অনিকেত অবাক হয়ে দেখে মামণি বোনের মামণিও না। জেঠিমণি, তাও বোনকে কত ভালোবাসে আর ওকে একটুও ভালোবাসে না। নাকি মায়েরা ওমনই হয়। বাপি বলছিলো ঠাম্মাও নাকি বাপিকে খুব শাসন করতো। মামণিও ওকে শাসন করে। “স্নান করবো, খাবো – খেলবো”। নীরা মানা করে, “একদম না! ঘুমোবে, খেলা পরে”। “ঘুমোতে হবে?” পরী কাঁচুমাচু মুখ করে, “হবেই তো”। “দাদাভাই-ও ঘুমোবে তবে”। অনিকেতের মুখ শুকিয়ে যায়। মামণি তো ওকে ও ঘরে শুতে দেয় না, বোন ঘুমোলে বাপি নিয়ে আসে – তাও একদিনও শুতে দেয়নি। “আমি মিসের হোমওয়ার্ক করবো বোন, তুই ঘুমো”। অনিকেত কথা ঘোরায়। “তাহলে আমিও হোমওয়ার্ক করবো”। “পরী!” পরী নীরার গলা জড়িয়ে দুগালে দুটো চুমু খায়, “প্লিজ জেঠিমণি। দাদাভাইকেও বলো ঘুমাতে”। নীরা পরীর কথা ফেলতে পারে না, “ঠিক আছে, আগে তুই চল স্নান করবি, খেয়ে নিয়ে তারপর ঘুম”।সুহাসিনী খুশি হন। নীরা পরীকে নিয়ে চলে গেলে অনিকেতকে বলে, “চটপট খেয়ে নাও বাবিন। তারপর ঘুমোবে”। অনিকেতের মনে খুব আনন্দ হচ্ছিল। বোনের জন্য আজ মামণির কাছে শুতে পারছে।


নীরা খেয়ে,ওষুধ খেয়ে শুতে এসে দেখলো দুইভাইবোনেই শুয়ে পড়েছে। ছেলেটার পাশেই শুয়ে পড়লো নীরা। “ঘুম না গল্প?” পরী লাফিয়ে উঠলো। “গল্প বলো জেঠিমণি”। “না, বোন-ঘুমা। উঠে মিসের পড়া করতে হবে। তারপর খেলতে যাবি”। অনিকেত বলে ওঠে। পরী নীরাকে অবাক করে ওর দাদাভাই এর কথা শোনে। দাদাভাইকে জড়িয়ে ঘুমিয়ে পড়ে। অনিকেত আসতে করে পাশ ফেরে। দেখে মামণি জেগে। বোন যে বলে মামণি দুপুরে ওষুধ খেলেই ঘুমিয়ে পড়ে! এমা! আবার বকুনি দেবে! “ঘুম আসছে না?” অনিকেত চুপ করে থাকলো। “অনির কাছে তো দিব্যি ঘুমাস”। “বাপি তো গল্প বলে, কোলের মধ্যে নেয়”। নীরা হাসলো, “ওখানে তো একাই ঘুমোতিস, তাহলে?” “সরি মামণি, ঘুমোচ্ছি। “নীরা বলে। “বাপি পড়ায়?” “রোজ”। “বকে?” “না, না, আমার তো রেডি থাকে সব”। “মিস কেমন?” “ভালো”।“মিস বকে না?” “না, কেউ বকে না। “বলেই থমকে তাকালো অনিকেত। নীরা বললো, “ঘুম না এলে পড় ও ঘরে গিয়ে”, অনিকেত সাহস করে নীরার কোল ঘেঁষে এলো। “পড়া রেডি”।“দেখতে হবে বলছিলি যে?” “ওটা বোনকে বললাম। তুমি এঘরে শুলে বকো তো, ও তো জানে না”। নীরা বোঝে ওকে ঢাকতে গিয়ে এটা করেছে ছেলেটা। নীরা হাসে, “চোখ বন্ধ কর তবে”। “মিস এলে তুলে দিও। “ অনিকেত বলে, “চুপ করে না ঘুমালে, এখনি তুলে কান ধরে দাঁড় করিয়ে দেবো ঘরের কোণে”। অনিকেত চটজলদি চোখ বুঁজলো। নীরা ওর গায়ে একটা হাত রাখলো। অনিকেত এটাই চাইছিলো, নীরা জানে। “ঘুমো।বড্ড বেশি কথা হয়েছে তোর, পাকাপাকা। আমাকেই এবার সব ঠিক করতে হবে”। নীরা ইচ্ছা করেই বলল। ভয় থাকা ভালো। তাহলে বাবিনের মতো অবাধ্য হয়ে পালাতে সাহস করবে না। এই ছেলেটাকে ছেড়ে অনি থাকতে পারবে না তিনদিনেই বুঝেছে নীরা, তাই অনির জন্যই ওকে হারাতে চায় না। বাবিনের মতো একই জায়গায় তিল ছেলেটার। এই কথাটা কাকে বলবে নীরা? কাকিমণিকে – নাকি অনিকেই, ভেবে কূল পেলো না নীরা।


পর্ব – ২৩


পরীদের মিস এসেছিলো। ওরা পড়তে বসলে কাকিমণি চলে গেলেন। নীরা এই মিসকে দেখেনি এখনো। আজ দেখবে, বাবিনকেও কেবল নিজেই পড়িয়েছে। আর অল্পস্বল্প অনি। মিস লাগেনি। অনির মাথায় মিসের ভুত চাপলো কেন হঠাৎ নীরা বুঝছে না। ছেলেটার স্কুলের মিস নাকি? স্কুলের হলেই কী বাড়িতে রাখতে হবে? নীরা পরীকে পড়ায়, ওকেও পড়িয়ে দেবে। নাকি নীরা ওকে পড়াবে না ভেবেই - - তাই হবে হয়তো। তবে এই মিস কেমন পড়ায় – দেখবে নীরা, পছন্দ না হলে অনিকে বলে, তাড়াবে।


“পরী –“ দরজার কাছে থেকে গলাটা পেয়ে তাকালো শাঁওলি, বৌদিই নিশ্চয়, এত সুন্দর যখন। হ্যাঁ – অনিদার মোবাইলের ছবির সাথে মেলে, শাঁওলি দেখলো পরী লাফিয়ে উঠেছে, “জেঠিমণি!” অনিকেতকে দেখলো শাঁওলি। চুপ করে গেছে, ভয় পায় কী বৌদিকে? “বৌদি – আসুন না, বসুন”। বৌদি শুনে একটু অবাক হলেও মুখে প্রকাশ করলো না নীরা। পরীকে কোলে নিয়ে বসলো। বৌদিকে খুঁটিয়ে দেখছিলো শাঁওলি। অনিদা বললো অসুস্থ, কই – মনে হয় না তো। “পরী পড়ছে ঠিক করে?” “হ্যাঁ – প্লে স্কুলের অল্প স্বল্প পড়া, কিন্তু পড়ে”। “আর বড়টা?” অনিকেত মামণির দিকে তাকালো। মামণি তাও বাবিন বললো না। “অনিকেত – মানে বাবিন তো ফার্ষ্ট বয়। ওর সব ছড়া তৈরীই থাকে”। অনিকেত নাম তবে ছেলেটার। “আপনাদের স্কুলে পড়তো তো আগে থেকে?” “এমা! আমাকে আপনি বলবেন না বৌদি, আমি অনেক ছোট, অনিদা তুই বলে”। নীরার খটকা লাগলো আবারো। “অনিদা মানে অনিরুদ্ধ? তুমি চেন?” “চিনবো না? আমার দাদার ছোট বেলার বন্ধু তো, কত গেছে আমাদের বাড়ি”। নীরা ক্ষুন্ন হলো। অনিরুদ্ধ ওকে এসব বলেনি তো, মেয়েটার বয়স বাইশ – তেইশ হবে। বেশি কথা বলে, ছটফটে, এ কী পড়াবে কে জানে! “হয়ে গেছে, মিস”। অনিকেত মিসকে খাতা দিলো। শাঁওলি সব চেক করে ফেরৎ দিলো অনিকেতকে, “বাহ, অল রাইট”, “ছুটি তাহলে?” অনিকেত বললো, শাঁওলি ছুটি দিতেই যাচ্ছিলো নীরা বললো, “একদম না, পরের চ্যাপ্টারটা খোল”। “হোমওয়ার্ক, ক্লাসওয়ার্ক, মিসের পড়া – সব কমপ্লিট, মামণি”। “কমপ্লিট বলে কিছু হয় না। ক্লাসের বইটা পুরো কমপ্লিট হলে, তবে কমপ্লিট হবে।তোমার নাম কী যেন?” “শাঁওলি চুপ করে বৌদির বকুনি শুনছিলো, “শাঁওলি, শাঁওলি রায়”। “বেশ ভালো ছাত্র পেয়েছো – সিলেবাস যত তাড়াতাড়ি পারো শেষ করাও। যত রিভিশন দেবে, ভালো হবে”। “আচ্ছা”, শাঁওলি তর্কে গেলো না। বৌদি রাগী খুব তবে।অনিদাকে বলতে হবে। “বেশি করে কাজ দাও বড়টাকে। না করে রাখলে আমাকে বলবে”। পরীকে কোলে করে উঠে দাঁড়ালো নীরা। “মিস গেলে আমাকে দেখাবি কতটা কী পড়লি”। অনিকেত বলে চলে গেলো নীরা, শাঁওলি বললো, “পরের চ্যাপ্টার তবে”। “হ্যাঁ, পড়িয়ে দাও মিস”। “মামণি বললো বলে?” “না, না, মামণি তো ঠিকই বলেছে, ঐটুকু পড়া আমার রোজ জলদি হয়ে যায়। বেশি করে পড়ে নিলে সিলেবাস তাড়াতাড়ি শেষ হয়ে যাবে”। “ভয় লাগে, মামণিকে?” “না, না, মা-তো, আজ মামণির পাশে শুয়েওছি”। শাঁওলি খুশি হয়, “খুব ভালো”, “মামণি স্নানও করিয়ে দিয়েছে, চেঞ্জও, ঠাম্মা খাইয়েছে”। “গুড, ওখানকার কথা মনে পড়েনা?” “পড়ে, কিন্তু বাপি – মামণি – বোন – ঠাম্মা – দাদুভাই --- এদের কাছেই তো সবাই থাকে, বলো?” শাঁওলি হাসে, “বেশ, কাল তোর এত্ত বড় ফ্যামিলির একটা ছবি এঁকে নিয়ে ক্লাসে আসবি”। অনিকেত বেজায় খুশি হয়, “আসবো” বলে ওঠে ও।


অনিরুদ্ধ বাড়ি ফিরে দেখে বাবিন তখনো পড়ছে। নীরা অনিরুদ্ধকে দেখে ঘর থেকে বেরিয়ে আসে। “চা খাবে?’ “করবে তুমি?” “খেলে করবো”। “বেশ, বাবিন পড়ছে এখনো?"”"হ্যাঁ, ওর মিসকে বলেছি ওকে পরের চ্যাপ্টার টাও পড়িয়ে তবে যেতে। অত অল্প পড়াতে ওর হচ্ছে না”। “ওহ, এখন ছুটি দিই একটু?” “পরে, আমি ডেকে নেবো”। অনিরুদ্ধ খুশি হলো, “আগে তো আমি যেদিন পড়াতাম আর তুমি বলতে এত পড়াচ্ছো কেন – ব্রেক দাও”। নীরা চা করছিলো, “বলতাম, সবার ক্ষমতা সমান হয় না। বাবিন এরকমের, এ আর একরকমের। কী যেন নাম – অনিকেত, তাই তো?” অনিরুদ্ধ বুঝলো নীরা জেনেছে নামটা। “কে বললো?” “তোমার বন্ধুর বোন, শাঁওলি। ওহ – এটাও তো বলোনি আমাকে”। “কী বলবো?” “শাঁওলি কে, কেমন মিস সেটা?” “বাবিনকে আনার পর থেকে তুমি কিছু শোনার মুডে ছিলে দুদিন যে বলবো? রাতে শুতে গেলেও তো তাড়াচ্ছও”। “তাড়াবো না? একা শোওয়াবে ওকে। বাবিনকে তো শোওয়াতে, সেপারেশন দরকার – মনে নেই?” “ভুল করতাম, বাবিনের সেপারেশন না – মা’কে দরকার”, নীরা তাকালো, “মোটেও না। তোমাকে জড়িয়েই তো দিব্যি ঘুমোয়”। অনিরুদ্ধ জানে এবার কী করতে হবে, নীরাকে পিছন থেকে জড়িয়ে ধরে, পিঠ থেকে চুপ সরিয়ে পিঠে, ঘাড়ে, গলায় চুমু খায়। “আমাকে জড়িয়ে ধরে বলে হিংসা? বাবিনকে বলবো মামণিকে জড়িয়ে ঘুমোতে”। “ছাড়ো”। নীরা নিজেকে ছাড়ায়, “বাচ্চা কাচ্চা ভরা বাড়ি। লজ্জা করে না”। “লজ্জা কিসের? বাচ্চারা যদি দেখে তাদের মা’কে আদর করছি মন্দ কী?” অনিরুদ্ধ হাসে। “ওরও ওখানে তিল আছে –“ চমকে ওঠে অনিরুদ্ধ, “কার কোথায় তিল আছে?” “তুমি খেয়াল করোনি চেঞ্জ করাতে গিয়ে?” “বাবিনের?” “ডান থাইয়ের ভিতর দিকে, একই জায়গায়”। “তুমি কী করে দেখলে?” “চেঞ্জ করিয়েছি আজ আমি, স্নানও করিয়েছি। দুপুরে আমার পাশেই ঘুমিয়েছে”। অনিরুদ্ধ খুশি হলো খুব, এইতো বরফ গলছে। খুশিটা প্রকাশ করলো না। “একই জায়গায় তিল?” “হ্যাঁ”, “সেটাই তো থাকবে নীরা, ওতো বাবিনই”। নীরার মুখটা বিস্বাদ হলো, “মিথ্যা বলোনা অনি, কত মিথ্যা বলবে? জানি ওকে খুব ভালোবাসো। জানি ও শান্ত, ভদ্র, ক্লাসে ফার্ষ্ট হয় – এসব তোমার চাওয়ার ছিলো খুব। আমি ওকে যেতে বলবো না। কিন্তু ওকে বাবিন মানবো না, জোর করো না আমাকে”। অনিরুদ্ধ কথা বাড়ালো না। “এবার তো ছুটি দাও - - সাতটা বাজে”। নীরা দেওয়াল ঘড়ি দেখলো, “দেবো, আমি গিয়ে কাজ গুলো দেখে নিই, তারপর। আর আমি থাকতে আবার মিস টিস কেন অনি?” “তুমি চাও না?” “একদমই না, বাচাল মেয়ে একটা, সবসময় অনিদা অনিদা, ক্লাস নেই”। “এমন বলে না নীরা, বন্ধুর বোন আমার”। “সে হোক”। “ফাদার চান যে ও আসুক”। “ফাদার মানে?” “অগাষ্টিন, বাবিনের স্কুলের –“ ওহ, কেন? নজরদারি?” “প্লিজ নীরা – এভাবে বোলো না”। “কতদিন চলবে?” “দু’মাস”। “বেশ, তারপর যেন একদিনও না দেখি”। অনিরুদ্ধ বুঝলো নীরা কিছু একটা সেন্স করেছে শাঁওলির কথা থেকে, নাহলে এত কড়াভাবে বলার মেয়ে ও না। নিজে আর কথা বাড়ালো না।


পর্ব – ২৪


সুহাসিনী রুদ্রদেবের সাথে দেখা করতে বেড়িয়ে ছিলেন। ক্যাফেতে বসেছেন দুজনে। রুদ্রদেবেরই জরুরি তলব ছিলো। “বলো, রুদ্র, হঠাৎ ডাকলে?” “হ্যাঁ, জরুরি কথা আছে”। “বলো”,।“এতো তাড়া কেন? আগে ভাবো আমরা এভাবে মুখোমুখি একলা –“ “চৌত্রিশ বছর পাঁচ মাস বারো দিন পর”। রুদ্রদেব অবাক হলেন, “এক্স্যাক্ট ডেট মনে আছে?” “মেয়েদের মনে থাকে”। রুদ্রদেব সুহাসিনীর হাতে হাত রাখলেন। “আমারো মনে আছে।সু, তোমাকে খুব সুন্দর লাগছে, আজ”। “জরুরি তলব কী এটা বলবে বলে?” “উঁহু, দাঁড়াও আগে অর্ডার দিই”। অর্ডার দিয়ে রুদ্রদেব বললেন, “অচ্যুত কাল অনির কাছে গিয়েছিলো?” “তোমার ও বাড়িতে স্পাইটাকে, বলো তো?”


“স্পাই না।এটা অনি বলেছে। ও তো বেশ অবাক হয়েছে, এত ভালো ব্যবহারে”।" আমার সাথেও হঠাৎ-ই খুব ভালো ব্যবহার করছে”। “যেমন?” “ওর বাইরের অ্যাফেয়ারটা জানতাম বলায় জোঁকের মুখে নুন পড়ার মতো করছে”। “বলে দিয়েছো?” “আর কতদিন চেপে রাখবো?” “এখনো আছে?” “বললো তো নেই, ওর কথা কি বিশ্বাস করা যায়?” “আর কী চেঞ্জ?” “কাছে আসতে চাইছে ...।“ রুদ্রদেব ভ্রু কুচকালেন। “কাছে?” “সেভাবে নয়।অনিকে আগের মতো করে ভালোবাসবে বললো। পুরনো সব কথা মনে করালো..”। “বিশ্বাস করলে?” “নাহ, অবিশ্বাসও করিনি। কাল গিয়ে বাবিনকে অনেক কিছু দিয়েও এসেছে”। “নতুন কোন ফন্দী আছে কী?” “হতে পারে,সতর্ক আছি”। “নীরা ঠিক আছে?” “অনেকটাই, আজ বাবিনকে নিজে হাতে স্নান করিয়েছে,চেঞ্জ করিয়েছে, ঘুম পাড়িয়েছে”। “বাহ, ডক্টর চক্রবর্তীকে ও বাড়ি নিয়ে যাবো একদিন -এর মধ্যেই”। “এগুলোই জিজ্ঞাসা করার ছিলো তো?” রুদ্রদেব হাসেন, “হ্যাঁ, তবে এই বাহানায় এত বছর পর একটা ডেট - এই বা কম কী”।সুহাসিনী রুদ্রদেবের হাতে হাত রাখলেন, “অচ্যুত সেদিন বলছিলো ওকে ছেড়ে যাবো না কথা দিতে”। রুদ্রদেব চমকালেন “হঠাৎ?” “ওর অ্যাফেয়ার জেনে গেছি শুনে ....।“ “কি বললে? যাবে না?” “যাবো আর কোথায়?” “কেন? জায়গার অভাব?” “খুব”, “আমার মনের ভিতর অনেক বড় ঘর আছে সু, আসবে?” সুহাসিনী রুদ্রদেবের হাত চেপে ধরলেন, “নতুন করে আসতে হবে বলছো?” “পাকাপাকি, এবার ,অনেক তো হলো সুহাসিনী, আর লোক সমাজ সংসারের ভয় করলে হবে?” “ভেবে বলছো?” “সারাদিন এই নিয়েই ভাবছি”। “ঘর সংসার, ছেলেপুলে বিশেষত নীরা,অনি, বাবিনকে ছেড়ে, পরীকে ছেড়ে ....”"ওরা একটু সামালে নিক। তারপর না হয়, আসবে।” “যদি অচ্যুত কিছু করে বসে, রুদ্র?” রুদ্রদেব হেসে ফেললেন, “করতে পারে।সুইসাইডাল এটেম্পট বা সে জাতীয় কিছু। তবে সেটা নাটকই হবে, তার বেশি কিছু নয়”। “ওদের পরিবারের কোন একটা পাপ আর অভিশাপের কথা বলছিলো আমায়। ওর বিশ্বাস এর জন্যই অনির আগের দাদাভাইদের বাচ্চাটা মারা যায়, আর বাবিনও”। “অভিশাপ! স্ট্রেঞ্জ! আমার তো মনে হয় কেস দুটোই মার্ডার।স্লো পয়জনিং-এর মাধ্যমে কাছেরই কেউ একজন করেছে”। “দাদা আর দিদিভাই-এর অ্যাক্সিডেন্টটা ভাবো - -“ “হ্যাঁ, ওটাও অবাক করার মতো।তবে ওটা অ্যাক্সিডেন্টই মনে হয়। অভিশটা কী নিয়ে কিছু বলেছে?” “নাহ, রাতে বলেছিলো বলবে, সকালে। আর বলে নি”। “রাতে বলতে কি দোষ?” “অন্ধকারে নাকি বলা যাবে না”। রুদ্রদেব হো গো করে হেসে ফেলেন। “কুসংস্কার যতো”। “জানি, তবে অনিকে আগলে রাখার সিদ্ধান্তটা আমার ঠিক ছিলো – রুদ্র”। “হ্যাঁ, আর অচ্যুত সেখানে বাঁধা দেয়নি – এটাই অবাক করার মতো কথা”। “সাহায্য করেছে – সবসময়। ওর এই একটা বিষয়ে আমি কৃতজ্ঞ”। “আর আমি অবাক, যার ক্ষতি করলে লাভ – তাকে বাঁচাবো, কেন?” সুহাসিনী চমকান, “অচ্যুত এসব করিয়েছে বলে বিশ্বাস তোমার?” “সবচেয়ে বেশি লাভও তো ওর”। “অংক কষে সম্পর্কের সব বিচার হয়, রুদ্র? ও খারাপ, লোভী, দুশ্চরিত্রও বলতে পারো,কিন্তু কাউকে মেরে ফেলার মতো খতরনাক নয়”। “তাহলে আর কে তবে? নাকি এক্সিডেন্ট – আমরাই বেশি ভাবছি”। “অভিশাপটা কী জানতে হবে আমায়”। “বিশ্বাস করো এসবে?” “জানি না, তবে সবসময় কেউ না কেউ দেখছে আমায় – এমন ফিল করতাম”। “তোমাকে?” “হ্যাঁ, বিশেষত অনিকে যখন অতবড় বাড়িতে খুঁজে পেতাম না, এদিক ওদিক পাগলের মতো ছুটতাম – মনে হত পিছন থেকে কেউ দেখছে”। “স্ট্রেঞ্জ”। “একেবারেই। ঐ জন্যই কাছছাড়া করতাম না। তখন আমরা পুরনোবাড়িতে, মানে এখন যেটা অনিদের বাড়ি।একবার সন্ধ্যার পর পাতকুয়োর পাড়ে গিয়ে বল খুঁজছিলো সে। বীরপুরুষ তো জানেই। ভাইদের সামনের মাঠে বসিয়ে রেখে – একাই। বাড়ির পিছনের দিকে পাতকুয়ো।ওখানে যেতে হয়, পিছনের মাঠ পেরিয়ে।পাঁচিল ধারে দুপাশে কয়েকটা ঘর আছে। তখন ব্যবহার হতো, চাকর বাকররা থাকতো। সামনের নতুন সার্ভেন্টস কোয়ার্টার হয়নি তখনও।" “এখন তো ঘর গুলো ভাঙ্গা চোরা কনডেমড।""দীর্ঘদিনের অব্যবহারে।তখন লোক থাকতো।সামনের মাঠ থেকে পিছনের মাঠের ঐ দিকটা নজরে পরে না।দোতলা থেকে অনিকে সামনের মাঠে দেখতে না পেয়ে ছুটে মাঠে যাই।অতীন আর ছোটন ছিলো।দাদাভাই কই,ওরা তো বলবেই না প্রথমে।জানে,মা দাদাভাইকে পিছনের মাঠে ধরতে পারলে শেষ।আমি ধমক দিতেই বললো অতীন,নিজের পিঠে পড়বে ভয়ে।আমি ছুটে গিয়ে দেখি পাতকুয়োর মধ্যে শরীরের সত্তর ভাগ ঝুঁকে আছে – আর ত্রিশ ভাগ বাইরে। আমার মনে হলো কেউ ওকে ধাক্কা দেবে বলে তৈরি। একটুও অপেক্ষা না করে এক ঝটকায় টেনে আনলাম।মনে হলো এতে কেউ খুব অখুশি হয়ে দীর্ঘশ্বাস ফেললো।যদিও আশেপাশে কেউ ছিলো না”। “ওগুলো তোমার মনের ভয়, সু”। “হয়তো, তবে আমি বোঝাতে পারবো না কেমন গা ছমছম করতো”। “এখন করে?” “নাহ, এ বাড়িটাতে আসার পর – আর গা ছমছম করেন। তবে অচ্যুত এখানেও ভয় পায়”। “ওই ঘটনার সময়,অনি কত বড় তখন?” “আট – কী নয় – ফোরে পড়ে মনে হয়।তবে,অনির পৈতে হতে আর কিন্তু গা ছমছম করতো না”। রুদ্রদেব হাসলেন, “দ্বিজত্বপ্রাপ্তি একেই বলে। তা সেদিন ঐ ভাবে উদ্ধার করে তোমার ছেলেকে ছেড়ে দিয়েছিলে? মনে তো হয় না”। রুদ্রদেব কথা ঘোরালেন। “খুব মেরেছিলাম। হুঁশ ছিলো না আমার। কুয়োরপাড় থেকে কান ধরে টানতে টানতে বাড়ি। বাড়ির বৈঠকখানাতে এসেই মার শুরু হয়েছিলো, শেষ হয়েছিলো আমার ঘরে। সারা বাড়ি, সারা ঘর, সিঁড়ি,সব্বার সামনে মার খেতে খেতে ঘুরেছিলেন বাঁদর”। “কে ঠেকালো?” “ওর কাকা, দোকান থেকে জলদি ফিরেছিলো সেদিন। এসেই ছোটগিন্নী – দরজা খোলো – মরে যাবে যে – এত কেউ মারে ....।“ রুদ্রদেব হাসলেন, “ওর কথায় দরজা খুলতে?” “খোলাতে না পেরে শেষে অনির দিব্যি দিতো।ঘরে ঢুকেই অনিকে কোলে তুলে নিতো, নিজে পিঠ পেতে দিতো”। “পতিদেবতাকেও দু’চার ঘা দিতে তখন, নাকি?” “হ্যাঁ, তাও খেয়েছে, তিনজনকে বাঁচাতে গিয়েই খেয়েছে। শাশুড়ি একবার দেখে ফেলেছিলেন ছোটছেলের পিঠে লাঠির দাগ – খুব বকেছিলেন আমাকে”। “তোমার আমাকে মারতে সাধ যায় না?” সুহাসিনী লজ্জা পেলেন, “এ কেমন কথা”, “যদি বলি – আমিও তোমার হাতে দু’চার ঘা খেতে চাই?” “তোমাকে মারবো কেন? তুমি তো ভালো”। রুদ্রদেব সুহাসিনীর হাতে চুমু খান। “জানো, ইংল্যান্ড সেটল হবার অফার আছে। তোমাকে নিয়ে যাবো ভাবছি একেবারে”। “সেটল! ওখানে?” “হ্যাঁ, অনিরা না হয় যাবে। মাঝে মধ্যে। একেবারে যেতে চাইলেও যাবে।আমার ছেলে পরিচয়ে।ওকে তো আমি নিজের ছেলেই ভেবেছি আজীবন, তোমার বাকি দুজন তো ত্যাজ্যমাতা করতে সময় নেবে না”। “ডিভোর্স?” “যদি না দেয় বলছো?” “হ্যাঁ”। “তোমাদের বিয়ের রেজিস্ট্রির কাগজ আছে?’ “নাহ”। “আমাদের থাকবে, চিন্তা কী”। “তা দিয়ে হবে?” “খুব হবে, ওসব ভাবনা ভেবনা, ওগুলো আমার ভাববার বিষয়, তুমি কেবল হ্যাঁ বলো”। সুহাসিনি একটু ভেবে বললেন, “সব ঠিক থাকলে – যাবো”। সুহাসিনী রুদ্রকে আর ফেরাতে চান না। “ঠিক থাকবে।সু – তুমি অভিশাপটা জেনো”। “বললে জানবো”। “চেষ্টা করো, বলবে”। “আচ্ছা”। “এর মধ্যেই আগের সমস্ত রহস্য লুকিয়ে আছে – আমার স্থির বিশ্বাস”। রুদ্রদেব স্পষ্ট করলেন। সুহাসিনী সম্মত হলো, সত্যিটা ওকে জানতে হবে, জানতেই হবে।


পর্ব – ২৫


রাতে নিজের ঘরে ঘুমিয়ে ছিলো অনিকেত। একরকম জোর করেই, বাপি কিছুতেই চায়নি ও একা ঘুমোক। অথচ মামণি চায় ও একা ঘুমোক। মামণি তো ঠিকই বলেছে। বড় হয়ে গেছে অনিকেত। ওখানেও তো একাই ঘুমোতো। অনিকেতের জন্য বাপিকে ও ঘরে শুতে দিচ্ছে না মামণি। বাপিরা তো মামণিদের সাথেই থাকে, ও শুনেছে স্কুলের বন্ধুদের থেকে ,তাহলে ওর জন্য বাপি শুতে না পারলে ওদের দু’জনেরই খারাপ লাগবে, বোনেরও, তাই জেদ করেই একা শুয়ে অনিকেত। 


আজ দিনটা খুব ভালো গেছে। মামণির কাছে সন্ধ্যা বেলাতেও পড়েছে অনিকেত। বাপি এলে একটুক্ষণ ছুটি দিয়েছিলো মামণি। তারপর নিজে পড়াতে বসেছিল। মামণি খুব ভালো পড়ায়, বাপির থেকেও। মিসের থেকে তো বটেই।  তবে ভীষন স্ট্রিকট। অনিকেতের ক্লাসওয়ার্কের খাতায় স্পেলিং মিসটেক পেয়ে কানমলা দিয়েছে। সহজ বানান ভুল করে ফেলেছিলো অনিকেত, মামণি তো বকবেই। কাল থেকে স-ব খাতা বাড়ি এসে আগে মামণিকে দেখাতে হবে, তারপর অন্য কথা হবে, মামণি বলেই দিয়েছে। তবে মামণির কাছে পড়লে সেই চ্যাপ্টার নিজে আর না পড়লেও চলে। এত উদাহরণ দিয়ে সহজ করে বোঝায় – মুখস্ত হয়ে যায়। এবার থেকে মামনির কাছেই পড়বে অনিকেত। বকলে বকবে। কিন্তু পড়াবে দারুণ।


ভাবতে ভাবতেই ঘুম এসে গিয়েছিলো অনিকেতের ঘুমিয়েও পড়েছিলো ও। হটাৎ গায়ে কারো একটা নিঃশ্বাস পেয়ে ঘুম ভেঙ্গে গেলো। চোখ খুলতে খুলতে দেখলো যে ঝুঁকে আছে তার মাথায় একরাশ চুল, খোলা। অনিকেতকে খুব কাছ থেকে দেখছে। মুখ দিয়ে কেমন একটা আওয়াজ করছে। টেনে টেনে শ্বাস নিচ্ছে যেন। কী করবে অনিকেত!চিৎকার করে উঠবে? কিন্তু ও বুঝে গেলে যদি গলা টিপে ধরে? দম বন্ধ করে শুয়ে থাকলো অনিকেত, বেশ কিছুক্ষণ এই পর্যবেক্ষণ চললো। অনিকেতের দুইবন্ধু আর ভাল্লুকের গল্প গুলোর কথা মনে ছিলো। গল্পে চালাক বন্ধুটাও এভাবে বেঁচেছিলো। মিনিট পাঁচেক পর শ্বাসের শব্দ বন্ধ হলো, পা টেনে টেনে চলে গেলো সে, একচোখ খুলে দেখলো অনিকেত। আবছা অন্ধকারে দেখলো গায়ে সাদা শাড়ি, খোলা চুল, পা টেনে হাঁটে, কে এ? অনিকেত তো এ বাড়িতে দেখেনি ওকে আগে? পেত্নী? গল্পে পড়েছে অনিকেত। বড় বড় বাড়িতে ভুত প্রেত পেত্নীরা থাকে। এ তেমন নয় তো? অনিকেত একবার ভাবলো স্বপ্ন দেখছে। নিজের গায়ে নিজে চিমটি কাটলোও, না- স্বপ্ন তো নয়, বেশ লাগছে। কী করবে অনিকেত? চেঁচিয়ে উঠলে যদি ও ফিরে আসে? মামণির কাছে যেতে হবে,গেলে যদি বকে? বকুক, মারুক – তাও যাবে অনিকেত।

“মামণি ....” নীরা খাটের দরজার দিকের পাশটাতেই ঘুমোছিল। মাঝে পরী ওপাশে অনিরুদ্ধ, হঠাৎ মামনি ডাকটা শুনে চমকে উঠলো। পাশ ফিরে উঠেই দেখে অনিকেত। “কী হয়েছে?” বলেই নীরা দেখল ছেলেটা দরদর করে ঘামছে। শ্বাস নিচ্ছে বড় বড় করে, “ভয় পেয়েছিস?” “একটা এভিল এসেছিলো”। অনিরুদ্ধরও ঘুম ভেঙে যায় অনিকেতের কথায়। “বাবিন – কী হয়েছে?” “একটা এভিল এসেছিল বাপি”। নীরার দিকে তাকায় অনিরুদ্ধ। খাট থেকে নেমে আসে, সোফায় বসে। বাবিনের গায়ে হাত রাখে “স্বপ্ন দেখেছে মনে হয়”। “স্বপ্ন না, বাপি – চিমটি কাটলে লাগছিলো।অনিরুদ্ধ হাসে, “বাবিন, ছোট বেলার বাহানা এখনো চালাচ্ছিস?” নীরার মনে পড়ে আলাদা শোওয়ালেই বাবিন শুতে চাইত না। অনি জোর করে শুইয়ে দিলে কিছুক্ষণ পরে “বাপি! মামণি” বলে চেঁচিয়ে দৌড়ে চলে আসতো, ভয় করতো নাকি। ওর জ্বরটা যেদিন এলো – তার আগের রাতেও ও নিজের ঘরেই শুয়েছিলো। ছুটে চলে যখন আসে তখন ধুম জ্বর গায়ে। ভয়ে এমন হয়েছিলো তবে? অনি আর নীরা দুজনেই দুষ্টু ছেলের বাহানা ভাবতো, বাপি- মামণির কাছে শোবার জন্য অজুহাত ভাবতো। খুব কম দিনই একা শুয়েছে বাবিন। কিন্তু তার মধ্যে ছুটে চলে আসেনি এমন দিন হাতে গোনা।ভয় কী নিয়ে পেতো এটা কখনো বলেনি বাবিন। অথচ এ তো বলছে। “অনি, মনে হয় না বাহানা”। “নীরা – ওতো ছোট্ট ছেলে, একা একটা ঘরে প্রথম শুলে ভয় লাগে”। নীরা বলে, “লাইটটা জ্বালাও, দরজা ভেজিয়ে দিও”। অনিরুদ্ধ তাই করলো। নীরা খুঁটিয়ে দেখলো অনিকেতকে, সত্যিই ভয় পেয়েছে। কাছে টেনে নিলো। জামাটা খুলিয়ে দিলো। ঘামে ভিজে গেছে। “অনি, টাওয়েল দাও”। “ঘেমে গেছিস খুব, বাবিন”। টাওয়েল দিয়ে বললো অনিরুদ্ধ, নীরা গা মোছালো। প্যান্টে হাত দিলো। অনিকেত বুঝল ও প্যান্টে হিসি করে ফেলেছে ভয়ে  মামণি বুঝে যাবে তো ... “প্যান্টে হিসি করে ফেলেছে”। অনিরুদ্ধ অবাক হয়, “কেন, বাবিন? ভয়ে? এমনিতে রাতে তো বিছানা ভেজাস না?” “ভয় করছিলো, ও খুব কাছে চলে এসেছিলো। ঝুঁকে দেখছিলো আমাকে। ওর গরম শ্বাস আমার গায়ে পড়ছিলো”। নীরা প্যান্টটা খুলিয়ে দে, অনিরুদ্ধর চোখ পরে তিলটার দিকে, নীরা ঠিকই বলেছে। একই জায়গায় তিল, “ও কে?” “জানি না, ওই তো এভিল  লম্বা চুল, শ্বাস টানছিলো কেমন একটা করে, আওয়াজ হচ্ছিল”। নীরা আর অনি মুখ চাওয়া চাওয়ি করে, অনিরুদ্ধ বলে “তুই দেখেছিস?” “হ্যাঁ, অল্প করে চোখ খুলে, পুরো খুলিনি, জেগে গেলে যদি মেরে ফেলে? ভাল্লুকের গল্পটা জানি তো”। “ভাল্লুক?”অনিরুদ্ধ অবাক চোখে তাকায়। “দুইবন্ধু আর ভাল্লুকের গল্প”। নীরা বলে, “ওহ "।“আমাকে পাঁচ মিনিট ধরে দেখলো, খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে। শ্বাস পড়া থামলে বুঝলাম চলে যাচ্ছে”। “চলে কোথায় গেল?” “পা টেনে টেনে চলে গেল, সাদা শাড়ি পরা ছিলো ... নীচের দিকে চলে গেল”। “নীচে মানে নীচের তলায়?” নীরা জিজ্ঞাসা করে। “হ্যাঁ, সিঁড়ির দিকে, লেডি ছিলো পেত্নী ....” “এসব গল্পের বই পড়ে জেনেছিস?” “হ্যাঁ, মামণি।" অনিরুদ্ধ বললো, “বই পড়েই মনে হয় কল্পনা হয়েছে”। “না, অনি, ভয়টা সত্যিই পেয়েছে”। “আমি নীচে গিয়ে দেখবো?” “নিধু কাকাকে ডাকো, একসাথে খোঁজো”। “আচ্ছা, তুমি একটু বাবিনকে দেখো”। “দেখছি!” অনিরুদ্ধ ছুটে চলে গেলো। নীরা টাওয়েল পরালো অনিকেতকে, “জামা?” “বাপির ঘরে তো – এনে দিচ্ছি? “অনিকেত নীরার হাত চেপে ধরলো, “না মামণি, তুমি থাকো, আমি টাওয়েল পরেই থাকবো”। নীরা অনিকেতকে কোলে বসালো। প্রথমবার। জড়িয়ে ধরলো। “ভয় নেই, আমি আছি, কিন্তু জামা প্যান্ট তো পরতে হবে, বোন আছে না? জেগে গেলে?” অনিকেত লজ্জা পেলো, “তাই তো! পরিয়ে দাও তবে”। "তোর বাপি আসুক, বাপিকে দিয়ে আনাচ্ছি”। “আমি ও ঘরে শোব না মামণি। আমি এখানে সোফায় শোবো, কি মেঝেতে শোবো।" নীরা দেখলো ভয়ে কাঁপছে এখন ছেলেটা। “সোফায় না, খাটেই শুবি”। “বাপির ঘরে?” “না, এঘরে, আমার পাশে”। নীরা একা ছাড়বে না বাচ্চাটাকে, কোন মতেই।


পর্ব – ২৬


“তুমি বললে নাতো অভিশাপ তাকে নিয়ে?” সুহাসিনী সকালে চায়ের কাপে চিনি মেশাতে মেশাতে অচ্যুতকে বলেন। নিজেদের ঘরেই চা খাচ্ছিলেন ওরা। দুজনে। অচ্যুত তাকালেন, “জানতে চাও?”


“যে বাড়ির বউ হয়ে আছি এতগুলো বছর - জানবো না? যদি জানার যোগ্য না মনে করো তো”....


“না, না ছোটগিন্নী, যোগ্য কেন হবে না। তোমাকে বলিনি - কারণ যদি ভয় পাও”। “ভয়ানক কিছু?”


“হ্যাঁ, আমাদের বিয়ের মাস দুয়েক আগেই তো অভিশাপ টা ফলেছিলো আবার…”।


“অনির দাদা?” “হ্যাঁ।" "বাবিনও কী?”


“ঠিক তাই। বংশের প্রতি প্রজন্মের প্রথম ছেলে বাচ্চা - ঐ তোমরা যাকে পুত্র সন্তান বলো-তাকে নিয়েই অভিশাপ”।


“পুত্রসন্তানকে নিয়ে অভিশাপ? কী এমন?”


“আমাদের জমিদারী ছিল জানো তো? ছিলো কেন বলছি, এখনো কিছু জমি জিরেত আছে, বীরভূমে”।


“বাগদেবীপুর গ্রাম, জানি”। “যাওনি তো কখনো”। 


“তুমি গেছো?’ “নাহ, বাবা গ্রামে আমাদের নিয়ে যেতে চাইতেন না। মা বারবার বললেও এড়িয়ে যেতেন। সেই যে দাদা হবার মাস ছয়েকের মধ্যে কলকাতা চলে এসেছিলেন বাবা - আর নিয়ে যান নি”।


“ব্যবসার চাপ?” “বলা যায়। এসেছিলেন যখন তখন তো সদ্য ব্যবসা জমেছে তবে এড়ানোটাও ছিলো। জানিনা কেন। আসলে বাবা শহরের ইংরেজি শিক্ষায় শিক্ষিত ছিলেন। জেঠা নন। তাই হয়তো ঐ পরিবেশে আমাদের মানুষ করতে চাননি”।


“নিজের অংশ?” “বেশিটা বসত বাড়ি সহ জেঠাদের বেচে দিয়েছিলেন। কিছু জমি আছে। ঐ যে, মনির ভাই আছে জানো তো? বিপ্লব?”,


“শুনেছি তার নাম মনিদির কাছে”। “ও থাকে বউ ছেলে মেয়ে নিয়ে ঐ গ্রামেই, ও-ই চাষবাস করে, দেখাশোনা করে”।


“ও।ওরা কি বংশপরম্পরায় তোমাদের জমিদারিতে কাজ করে?”


“হ্যাঁ, মনির মা, বাবা দুজনেই কাজ করতো জানি। ওর বাবা পুরোহিত ছিলো। মা রাধুনী বামনী”।


“তারপর?” “বাবা না নিয়ে যেতে চাইলেও গ্রামের কথা টুকটাক কানে আসতো। নিধু, মনি এরা গ্রামেরই। মা-ও কখনো-সখনো বলে ফেলতেন ওখান থেকেই শোনা আমার”।


“বাড়ির প্রথম পুত্রসন্তান?”


“প্রজন্মের প্রথম, রক্তপাত হয়ে মারা যাবে। মুখে রক্ত উঠে,বলা হতো”।


“তোমাদের আগের জেনারেশন হয়েছিলো?”


“হ্যাঁ, জেঠার বড়ছেলে… বাবা তো দাদা হবার ছয় মাস পরেই এইজন্যই চলে আসে”।


সুহাসিনী মাথা নাড়লেন, “স্ট্রেঞ্জ!” 


“হ্যাঁ খুবই রহস্যজনক”। “অভিশাপটা কার ছিলো?”


“একজন তান্ত্রিকের।কালীর উপাসক ছিলেন। গ্রামের মধ্যেই সাধনাপীঠ বানিয়ে ফেলেছিলেন নাকি। মরা টরা আনা যখন শুরু করলেন তখন আমার ঠাকুরদার বাবা নাকি উৎখাত করে নদীর অন্যপাড়ের শ্মশানে পাঠিয়ে দেন। লোকটা এটাকে ভালোভাবে নেয়নি। যেতে যেতে অভিশাপ দিয়ে যায়”।


“উচ্ছেদের জন্য এত বড় অভিশাপ!”


“হবেই, এপারে শিষ্য সম্প্রদায় হয়েছিলো। তারা দক্ষিণা দিতো বেশ পেট চালাতো। ওপারের শ্মশানে ভুতের কারবার। কেউ সাহস করে যেত না। ঠাকুরদার বাবা ওটাই বলেছিলেন। তন্ত্র সাধনার জন্য নির্জন জায়গা দরকার। সেখানেই যান।কিন্তু ইনি তো সাধনা নয় ধান্দায় এসেছিলেন। ওপারে নাকি তিনদিনও টেকেনি। উধাও হয়ে যান”।


“ওনার অভিশাপেরই এত জোর?”


“হ্যাঁ, তারপর থেকে হচ্ছে তো। প্রতি প্রজন্মে, দেখছ না?”


“তুমিও মানো তবে”!


“মানি, তাই অনিকে নিয়েও ভয়ে থাকতাম”।


“অনিতো ফার্ষ্ট বর্ণ মানে প্রথম জন্মানো নয়”।


“আমি ইংরেজি বুঝি, বৌ। রুদ্রর মত না হলেও একই স্কুলে পড়েছি তিনজন, মনে নেই?”


সুহাসিনী অচ্যুতের মুখে হাসি দেখলেন।“এ কেমন মস্করা”।


“বউয়ের সাথে মস্করা করা যাবেনা? সারাজীবন পারলাম কই? বাচ্চা কাচ্চা নাতি পুতি নিয়েই তো কেটে গেলো। এবার অতীন আর অনুপমকে ব্যবসা ছেড়ে ভাবছি বিরাম নেবো। সারাদিন মস্করা করবো তোমার সাথে”।


“যাঃ!” “কী যাঃ”।


প্রায় ষাট হলো, রিটায়ার করতে হবে, প্ল্যান করছি কত জানো? তোমাকে নিয়ে এবার ঘুরবো - সারা পৃথিবী”।


“সকাল সকাল বাই উঠেছে তোমার”।


“ঐ দেখো, বিশ্বাস হয় না?” “আচ্ছা বাপু, হয়েছে বিশ্বাস। এবার উঠে রেডি হয়ে নাও”।


“অনিকে নিয়ে তুমি ভয়ে থাকতে কেন বৌ? তুমি তো অভিশাপের কিছু জানতে না”।


“জানিনা - কেমন যেন গা ছমছম করতো”। “ও বাড়িতে?"


“হ্যাঁ, খালি মনে হতো কেউ অনির ক্ষতি চায়। আর সে খুব কাছেই আছে”।


“তোমার এই অপছন্দের ঘেন্নার বরকে সন্দেহ করতে, তাইনা?” অচ্যুত মুচকি হেসে কথাটা বললেন। সুহাসিনী মাথা নাড়লেন, “না, এই একটা ব্যাপারে কোনদিন সন্দেহ করিনি”।


“সত্যি বলছো?” “মিথ্যা বলে লাভ?” “তাও ঠিক, ভাগ হয়ে যখন চলে এলুম এ বাড়ি, কষ্ট হয়েছিলো, না?”


“খুব, কিন্তু বলিনি”। “আটকালে না তো?”


“দাদা ভাই, দিদিভাই ও তো চাইলো। তোমরা সবাই একদিকে আর আমি একা”।


“তোমার বাড়ির লোকেরাও।তারা বললে তাদের সম্পত্তি আর আমার ভাগ নিয়ে একটা নতুন দোকান খুলতে”। “জানি”।“ভাগটা না হলে ভালো হতো বউ”।


সুহাসিনী চমকালো “কেন?” “তোমাকে দু'বাড়ি ছোটাছুটি করতে হতো না। মনটা তো বড় জনের কাছেই পড়ে থাকে?”


“বোঝো তুমি?” সুহাসিনী অবাক হন।


“বুঝি, আসলে আমি তোমাকেই সাজা দিতে চেয়েছিলাম”।


“সাজা!” “সারাজীবন ভালোবাসা না দেওয়ার সাজা। ভালোবাসারজনেদের থেকে আলাদা করে”।


সুহাসিনী চমকে উঠলেন, “এখন এসব বলছো?”


“ভালো লাগছে, নিজের মনের সব কথা তোমাকে বলতে ভালো লাগছে। আমার সবচেয়ে বড় অপরাধ টা যখন জেনেই গেছো”।


“এখন যাও না তার কাছে আর তো?”


“অনির দিব্যি”।বলেই হেসে উঠলেন অচ্যুত,“তোমার এটা মনে আছে?”


‘থাকবে না!” “আর গেলে আমাকে মেরে ফেলো”। "ছি! এ কেমন কথা তোমার”।


“পাগলামো”। “কোথাকার মেয়ে ছিলো?”


“কী হবে জেনে?” “বাচ্চা কাচ্চা নেই তো?”


“নাহ”। “আমার দিব্যি, বলো?” অচ্যুত উঠে দাঁড়ালেন।


সুহাসিনীর মাথায় হাত রাখলেন," না,তার আর আমার কোন সন্তান নেই।তার সাথে তার স্বামীর আছে।""ঘরের বউ তবে!ছি!"অচ্যুত সুহাসিনীর চোখে চোখ রাখলেন, “তুমি একটু ভালো বাসলেই হতো না, বৌ”।


সুহাসিনী জানেন কথাটা সত্যি। অচ্যুতকে উনি ভালোবাসলেন আর কবে! “এবার থেকে বাসবে তো?” 


সুহাসিনী উঠে দাঁড়ালেন, “আগে ভালো হও”। “হচ্ছি তো”।


“আরো ভালো হতে হবে”। অচ্যুত সুহাসিনীর কোমর জড়িয়ে ধরেন।


“একি …… সাতসকালে …”। “ভালো হওয়া”। 


“ছাড়ো”। অচ্যুত মাথা নাড়েন, “না”।


“ছেলে বৌ-রা চলে আসবে”।


“দরজা বন্ধ আছে – খেয়াল করোনি”।


“দাবী কি তোমার?” 


অচ্যুত সুহাসিনীর দু গালে আদর করে দিলেন।


“এটুকুই”। সুহাসিনী জীবনে কোনদিন অচ্যুতকে এভাবে আদর করতে দেখেনি। “ব্যাস?”


“হ্যাঁ”, অচ্যুত সুহাসিনীর কপালে চুমু খেলেন,“আমার বৌ”।


অচ্যুতের চোখে একটা আলোর ঝলকানি দেখলো সুহাসিনী। যেটা আগে কখনো দেখেনি। 


“হঠাৎ তোমার, এটা বললে যে?”


“আমার সাতজন্মের ভাগ্য – বলবো না?”


“মানো তুমি?” “আলবাৎ মানি”। “ভালো না বাসলেও মানো?”


“হ্যাঁ, ভালো তো বাসাবই একদিন। আর না বাসলেও এই যে আমার মা, বাবা, দাদা, বৌদিকে সম্মান, শ্রদ্ধা দিয়েছ – তিনটে ছেলেকে ভালোবাসা দাও, নাতি নাতনিদের আদর দাও – এটাই কম কি?”


“এক থাকলে আরো ভালো হতো। অতীন, অনুপম – ওরা মানুষ হতো”।


“হিংসার বীজটা ঢুকে গিয়েছিলো যে। বৌদি খুব করে আলাদা হতে চাইছিলো। তোমার মা, বাবারও সায় ছিলো এতে, আমারও। দাদা, বৌদি চলে গেলে আমি অনিকে সাহায্যই করতে চেয়েছিলাম। সম্পত্তি আত্মসাৎ নয়। কিন্তু সে তো ঢুকতেই দিলো না ব্যবসায়। বিশ্বাস কর,তাতেই আরো কষ্ট পায় আমি”।


“পরীকে দেওয়াটা?” “পরীর ভালোর জন্য। জানি তুমি ভাবো,এটা আমার স্বার্থ, সম্পত্তির লোভ … আমিও অতীন, অনুগমের সামনে এমনি বলেছি তোমায়। অথচ পরী ওখানে বেশি ভালো থাকবে জেনেই দিয়েছি। অনি, অতীনের থেকে মেয়েটার অনেক ভালো বাবা হতে পারবে”। 


“তোমার ছোটছেলে ফিরলো?” “না”। “সদ্য ছেলে হলো – এখনি বাইরে?” "


থাক না, কোম্পানির ট্রিপ তো। বৌ বাপের বাড়ি যখন। ঘুরে আসুক”।


“ব্যাঙ্কক?” “হ্যাঁ”। “আবার?” “ফিরবে, তিন দিন পর”। “অনুপম তোমার ধাত পাচ্ছে না তো?”


অচ্যুত জানেন না, পাচ্ছে কি পাচ্ছে না। কিন্তু কানাঘুঁষো শুনেছেন। এক্সট্রা ম্যারিটাল আছে নাকি। এদিকে ছোট বৌমার ও তো বাচ্চা হলো আবার, “জানি না”।


“রাশ টানো”। “তুমি মা”। “তুমিও যাবা, এসব ব্যাপারে মায়ের থেকে বাবা বললেই কাজ হয়। কড়া হও, একটু”। অচ্যুত বুঝলেন সুহাসিনী কী বলতে চায়, উনি কড়া হবেন, এবার।


পর্ব – ২৭


“মামণি-“ স্কুল থেকে ফিরেই ডাক দেয় অনিকেত। নীরা ঘড়ি দেখলো। তিনটে বাজে, আজকেও একটু আগে ছুটি হয়েছে তবে। ভালো হয়েছে, ওই মেয়েটা সাথে আসেনি। নীরা পরীকে ঘুম পাড়িয়ে দিয়েছিলো। বাবিনের ছবিটার সাথে কথা বলাটা এখন অনেক কমেছে ওর। তবে খাওয়ায় এখনো। পরী ফেরার আগেই । ঘর থেকে বেরিয়ে দেখে অনিকেত ব্যাগ কাঁধে চেয়ারে বসে আছে। নীরা ব্যাগটা পিঠ থেকে খোলায়, জুতো মোজা খুলে দেয়।


"তাড়াতাড়ি ছুটি?”


“হ্যাঁ, টিফিনের পর ছুটি হয়ে গেলো”।


“কেনো?”


”এক্সাম ছিলো দুটো”। 


“ক্লাস টেষ্ট?”


“হ্যাঁ, মামণি – আগের খাতা বেরিয়েছে, দেখবে?” 


“দেখবো, আগে খেয়ে নে”।


“পরে খাবো, এই তো টিফিন খেলাম। মিসও কেক খাওয়ালো”।


“মিস!”


“হ্যাঁ – এটা ওটা খেতে দেয় তো”।


নীরা চোখ বড় করে তাকালো, “তোকে টিফিন কম দিই?” 


“না, মামণি”।


“তাহলে লোকের থেকে নিবি না”।


“দেয় যে”।


“নিবি না, কানে গেছে কথাটা!"


নীরা ধমক দিলো। অনিকেত চুপ করে গেলো। “মিস তো। কী করে না করবে স্কুলের মধ্যে!” নীরা বললো।


‘চল! চেঞ্জ করবি”।


শাঁওলির পড়ানোতে ভরসা পায়না নীরা। ও পড়িয়ে গেলে নিজে আবার সমস্ত চেক করে, ভুলও পায়। শাওলিকে গত কাল এই নিয়ে দু-চার কথা শুনিয়েও দিয়েছে। আজ অনিকেতের পরীক্ষার খাতা দেখে খুশি হয়েছে নীরা। যেমন শিখিয়েছিলো – তেমন লিখে এসেছে। ফুল মার্কস পেয়েছে। নীরার কোলের কাছে শুয়ে ঘুমোচ্ছিলো অনিকেত। নীরা ঝুঁকে একটু আদর করলো। মামণির খুব বাধ্য ও। মামণি যা বলে তা অক্ষরে অক্ষরে মেনে চলে। বাবিনটা যদি এমন হতো তাহলে হারিয়ে যেত না। নীরা শুয়ে পড়ে ঘুরলো অনিকেতের দিকে। কাছে টেনে নিলো। সেদিন রাতের পর থেকে নিজের কাছে শোওয়ায় নীরা। কাছ ছাড়া করে না। অনি বিশ্বাস না করলেও নীরা বিশ্বাস করে – অনিকেত যেটা দেখেছে – সত্যিই দেখেছে। কথাটা কাকিমণিকে বলতে ভীষণ বকুনি খেয়েছিলো নীরা। ছেলেকে একা শোওয়াবার জন্য। কারোর হাতে যেন ছেলে না খায় – বলে দিয়েছেন কাকিমণি। নীরাও চায় না অন্য কারোর হাতে থাক ও। অনি, নীরা, কাকিমণি – ব্যাস। আর কাউকে ভরসা করতে মানা করেছেন কাকিমণি, ডাক্তার কাকা। ঠিকই করেছেন মনে হয়। সেদিন যে এসেছিলো – সে কে? ভুত প্রেত – নাকি মানুষ। দ্বিতীয়টার সম্ভবনাই বেশি মানে নীরা। মানুষ হলে গেলো কোথায় – উবে গেলো? নাকি বাড়ির পিছন দিকের ভাঙা ঘরগুলোতে – অনি এলে একবার দেখতে বলবে নীরা। আজই। বাড়ির সামনে যতটা মাঠ পিছনেও প্রায় ততোটাই। পিছনের পাঁচিলের গা ঘেঁষে কয়েকটা ভাঙা ঘর আছে, পাতকুয়ো আছে একটা। পাঁচিলের ধারে জঙ্গল হয়ে গেছে। ঘরগুলো অব্যবহারে ভেঙে পড়ছে। কেউই যায়না। সামনে থেকে ঐ ঘর গুলোতে চট করে নজর পড়বে না। গেট থেকে তো নয়ই, সার্ভেন্ট কোয়াটার থেকেও না। লুকনোর ভালো জায়গা ওঠা। যে এসেছিলো সে এই পরিবারের ক্ষতি চায় – এতে কোন সন্দেহ নেই। কিন্তু তার মোটিভ কী – এটাই জানতে চায় নীরা।


অতীন ঠাকুরপো,বড় জা জিনা এসেছিলো কাল। পরীকে দেখতে। অনিকেত আসায় পরীর কদর কমলো কিনা – দেখতে এসেছিলো, আসলে। অনিকেতকে দেখে তারাও ভারী অবাক। বাবিনই ভেবেছে। সাথে কাকাও ছিলেন। তিনি বলছিলেন অনিকেতকে নিয়ে যাবেন মাঝে মাঝে। কাকিমণি নাকি পরী ছাড়া রাতে ঘুমোতে কষ্ট পান। কাকার যেন অনেকটা পরিবর্তন হয়েছে এই ক’দিনে। সত্যি এই পরিবর্তন,নাকি লোক দেখানো। কোন ক্ষতি করার ইচ্ছা নেই তো? নীরা এই ব্যাপারে অনেক ভেবেও কূল পাচ্ছে না।


অনিকেত ঘুমের মধ্যে জড়িয়ে ধরেছিলো নীরাকে। এরকম প্রায়ই ধরে। বেশ জোরে, ভয় পায় মনে হয়। নীরা ছাড়ায় না। গায়ে মাথায় হাত বুলিয়ে শান্ত করে। সেদিনের ভয়টাকে মনে ছাপ ফেলতে দেওয়া যাবে না। ঘরে অ্যাটাচড বাথ আছে। অনিকেত রাতে উঠে হিসি পেলে একা যেতে চায় – কিন্তু নীরা নিজে ওঠে। হিসি করিয়ে আনে। বাথরুমেও একা ছাড়ে না। বাবিনও কি এইরকমই কোন ভয় পেয়ে জ্বরে পড়েছিলো?আর জ্বরে ভুগেই... একভুল দু’বার রিপিট করতে চায় না নীরা। যদি বাবিন এইরকম কারোর জন্যই চলে গিয়ে থাকে – তাকে খুঁজে বার করে শাস্তি দেবে নীরা, দেবেই।


কে হতে পারে এমন? কাকিমণিকে প্রশ্নটা করেছিলো নীরা। কাকিমণি বলেছিলেন পুরনো শত্রু। একটা অভিশাপের গল্প আছে মুখার্জী পরিবারের সেটাও বলতে যাচ্ছিলেন – নীরা শোনেনি। নীরা যুক্তিবাদী মেয়ে। যুক্তিতে এসব অভিশাপের জায়গা নেই। মানুষের লোভের জায়গা আছে, সেই লোভবশত যদি অনির দাদা, অনির বড় ঠাকুরদার ছেলে,এমনকি বাবিনও চলে গিয়ে থাকে – তবে সেটা ঠান্ডা মাথার খুনীর কাজ। যে অনিকেতকেও সরাতে চাইবে পথ থেকে, যে কোন মূল্যে।


শাঁওলি মেয়েটাকে খুব অপছন্দ নীরার। অনিকে বলতে না পারলেও ঠারেঠোরে বুঝিয়েছে। দু’মাস আসবেই নাকি। তারপর না আসা-ই ভালো। ওর মধ্যে একটা ইতস্তত বোধ দেখে নীরা। নীরার চোখে চোখ রেখে কথা বলে না। কোথাও একটা কিছু লুকায়, কী সেটা? জানতে চায় নীরা। অথচ জানতে পারছে না। কোথাও না কোথাও একটা অপরাধ বোধ আছে ওর। সেটা কী নিয়ে জানা নেই। তাই এই মেয়েটাকে তাড়াতে পারলে বাঁচে, নীরা।


কপালে কারোর হাত পেয়ে চমকে তাকায় নীরা, অনি, আগে ফিরে এসেছে। “এখন?” “মিটিং করে চলে এলাম, ঠিক করিনি?” “দোকান?” “আজ আর গেলাম না সেকেন্ড হাফে। স্টাফরা সামলে নেবে। ভুল করেছি?” নীরা হাসে, “না। খাবে তো?” “ব্যস্ত হয়ো না, কাকিমণি খেতে দিচ্ছে”। “এমা, আমি উঠে দিই?” “না, নীরা, তুমি বাবিনকে পরীকে নিয়ে রেস্ট করো, খুব ঘুমোচ্ছে দুষ্টু দুটো”। “বড়জন দুষ্টু না, অনি, তোমার মনের মতো”। অনিরুদ্ধ অনিকেতের গায়ে হাত বোলায়। 


“কখন এলো?” “ঘন্টা খানেক”।


“খেয়েছে?” “হ্যাঁ, অনি – তুমি পিছন দিকের ঘরগুলো একটু সার্চ করো তো”। “ভাঙা ঘর গুলো?” 


“হ্যাঁ, পিছন পাঁচিলের দিকের” “কেন?” “যদি কোন সূত্র পাওয়া যায়”।


“বাবিনের মনগড়া না বলছো?” “একেবারেই না”। “তাহলে? ভৌতিক?”


“মানুষেরই কাজ, মানুষটাকেই খুঁজছি”। “কাল দেখি?” “হ্যাঁ, ভোরে। আর উপরের ঘরগুলোতে সার্ভেন্টদের একসেস কমাতে চাইছি আমি”। “এতটা ভাবছো?” “এতটাই। বাবিনের জ্বর আসার আগের দিন ও একা শুয়ে ছিলো,অনি। ছুটে চলে এসেছিলো। আমরা বাহানা ভেবেছিলাম,মনে আছে?"


“কী বলতে চাইছো?” “ভয় থেকেও তো জ্বর আসতে পারে?” “তা পারে, কিন্তু ব্লিডিং?”


“জানি না, তবে কিছু একটা গড়বড় আছে। আমাদের আরো সতর্ক থাকাতে হবে। এক ভুল দু’বার যাতে না হয়”। “কাকিমণি অভিশাপের গল্প করলেন, মানো?” “নাহ, আমি মানুষের হিংসা,ক্ষতি করার চেষ্টাকে মানি,অনি। এটাও তো মানুষেরই কাজ”। 


“ভয় দেখানো?” “হ্যাঁ,” “কী চায় সে?” 


“ক্ষতি”। “বংশের প্রতি শত্রুতা?” “মনে হয়। কেউ তো আছে যে প্রতিশোধ নিতে চায়। যে কিনা কোন কারণে আহত”। “আজ ওষুধ খেয়েছো?”


অনির কথায় থামে নীরা, “তোমার মনে হছে – ওষুধ খাইনি বলে ভুলভাল বকছি?”


“ধুর! এমনিই বললাম, আমি খেয়ে আসি?”


“এসো, পিছনের ঘর গুলো দেখতে হবে অনি। আমার কথা শোনো”।


অনিরুদ্ধ ঝুঁকে নীরাকে চুমু খেলো। “দেখবো”। “একা আমাকে?” অনিরুদ্ধ হাসলো। “না, দুটো ছেলে মেয়েকেও আদর করবো। খেয়ে আসি”।


“বড়টা ক্লাসে হায়েস্ট পেয়েছে, ম্যাথ টেষ্টে”। “কত?” “ফুল মার্কস”। অনিরুদ্ধ খুশি হয়, “সোনা ছেলে তো!" “শাওলি করালে হতো না, সব অঙ্ক আমার করানো”।


“বাহ”। “এমন টিউটর রেখে কী লাভ”। “দু’মাস, বলেছি তো –” “দু’মাস পেরেলো একদিনও নয়।""আচ্ছা।এত অপছন্দ? " "অপছন্দের মতোই।" “খেয়ে আসি?” “এসো”।


“নীরা খুব চিন্তিত ব্যাপারটা নিয়ে“। খেতে খেতে কাকিমণিকে কথাটা বললো অনিরুদ্ধ।


“চিন্তিত হবারই কথা, আমি যেন আর কোনদিন না শুনি বাবিন একা হয়েছে”।


“অভিশাপের ভয়?” “কিছু একটার ভয়। 


সেই কিছুটাকে আমি ব্যাখ্যা করতে পারবো না, তবে কিছু”।


“যে ভয়ে আমাকে সবসময় আগলে রাখতে?” “বলতে পারিস”


আমিতো ফার্স্ট বর্ন নই”। “তবুও, কেউ তোর ক্ষতি চাইতো – আমার মনে হতো”। 


“বাবিনের ব্যাপারে আরো সর্তক থাকা উচিৎ ছিলো তবে।"


সুহাসিনী মাথা নাড়লেন,


“আমি আগে অভিশাপটা জানলে, সতর্ক হতাম”। “এসব মানো?” “না মেনে উপায়?”


“নীরা মানে না। ওর মতে মানুষের কাজ”। “মানুষ! মানুষ হলে বাবিন দেখার পর তাকে সারা বাড়ি খুঁজে পাওয়াই যেতো না!”


“পিছনের ঘরগুলো দেখতে বলছে নীরা”। “দ্যাখ তাহলে”। 


“কাল দেখবো, ভোরে”।“একা নয়”। 


“তুমি থাকো রাতে, দুজনে দেখবো।” সুহাসিনী হাসলেন, “তা আমাকে যে রাখবি – শুতে দিবি কোথায়?”


“কেন? ওরা মা, ছেলে মেয়ে একঘরে, আমি আর আমার মা সেই ছোট্ট বেলার মতো একঘরে”।


সুহাসিনী চমকে উঠলেন, “কী বললি অনি? মা?” অনিরুদ্ধ হাসলো, 


“কেন – ভুল বললাম? আর কাউকে বলা উচিৎ? ছোট থেকে যে বড় করেছে আদর শাসন সেই তো মা”। আর জন্ম?” “পরের বার দেবে। কী, দেবে তো?” 


সুহাসিনী অনিরুদ্ধর দিকে সজল চোখে তাকালেন, “ মাঝে এতগুলো বছর দেখিনি যে –“ 


“সেটাও হয়তো আমার ভালোর জন্যই। আর দেখতে কী তুমি চাওনি? সবাই আলাদা হতে চাইলো – বিশেষ করে মা আর কাকা। তুমি একা.... একটা কথা বলবে? আলাদা হবার আগে মায়ের সাথে তোমার কোন সমস্যা হয়েছিলো?” “কেন আবার সেসব টানা অনি? সে তো নেই”। “তাতে কী? জানতে হবে না আমায়? তোমায় কষ্ট দিয়েছিলো খুব, না?” 


“দিদিভাই তো আবেগে চলতো অনি। জেদী ছিলো, কেউ মনে কোন কিছু একটা ঢুকিয়ে দিলেই ----” "সে তো তুমিও বাবার এক মেয়ে,আদুরে মেয়ে।" "সবাই সমান হয়?" "না,হয়না।তা কোন কিছুটা কী,বলবে?" "অনি,থাক না।" "আমি জানি।" সুহাসিনী চমকালেন,"কী?" "মা'কে কেউ বুঝিয়েছিলো আমাকে তুমি মায়ের কাছ থেকে কেড়ে নিয়েছো,তাই না?" সুহাসিনীর চোখে জল দেখলো অনিরুদ্ধ, " তোমাকে আমাকে আলাদা করার জন্য এই আয়োজন, তাই না,মা?" সুহাসিনী কেঁদে ফেললেন এবার,অঝোরে।"পনেরোটা বছর নিজের অনির কাছ থেকে এটা লুকিয়েছো! কার সম্মান রাখতে এই আত্মত্যাগ, বলো?" সুহাসিনী অনিরুদ্ধর হাত চেপে ধরলেন,"আর তো লুকাচ্ছি না অনি।ছাড় ওসব।"


“বেশ তাই হোক, ওসব ছাড়ো, থাকবে কিনা বলো”। নীরা উঠে এসেছিলো। “কাকিমণিকে থাকতে বলেছো?”


“দেখো না নীরা, পাগলের কীর্তি”। নীরা হাসলো, “থাকুন না কাকিমণি, আপনার ছেলে খুব খুশি হবে তাতে,মেয়েও”। 


“দেখলে, ছেলের সাথে মেয়ের ও আবদার।থাকবে না কী করে?" সুহাসিনী হাসলেন, “বেশ, থাকবো”।


অনিরুদ্ধের মুখ অনাবিল হাসিতে ভরে গেলো। কাকিমণির ওকে এই বারো তেরো বছর কর্তব্য বাদে এড়িয়ে চলার কারণ আজ ওর কাছে স্পষ্ট। অনিরুদ্ধর মায়ের মিথ্যা অভিযোগে আঘাত পেয়েছিলো কাকিমণি, অভিমান হয়েছিল খুব আর অভিমানটা বাড়তে দেবে না অনিরুদ্ধ।


পর্ব – ২৮


ফোনে সুহাসিনীর জরুরি তলব পেয়ে মুখার্জী বাড়িতে এসেছিলেন রুদ্রদেব। এত ভোরে তলবের কারণ বুঝতে না পারলেও, গুরুতর কিছু – বুঝেছিলেন, পৌঁছে শুনলেন সুহাসিনী আর অনি পিছনের ভাঙা ঘরগুলোর দিকে আছে – নিধু খবর দিলো। প্রায় ছুটতে ছুটতেই পিছনের মাঠ পেরিয়ে ওখানে গেলেন রুদ্রদেব।


“কী ব্যাপার?” “ঘরের ভিতরটা দেখো, রুদ্র”। 


রুদ্রদেব দেখলেন, অবাক হলেন, “স্ট্রেঞ্জ!” “কী বুঝলে?”


“কেউ এখানে তন্ত্রমন্ত্র সাধনা করে, নাকি?” “তাই তো মনে হচ্ছে। কিন্তু কে?”


অনিরুদ্ধ জানলায় ঝোলা সাদা শাড়ি দেখালো,


। “কোন মহিলা?”


“মনে তো তাই হচ্ছে”। “বাইরের কেউ তো নয়”।


“সম্ভবই নয়”। “তবে? বাড়ির মেইডদের কেউ?”


“সবাই তো যার যার ঘরে থাকে, তাহলে?”


“মানুষের মাথায় খুলি– যে-ই করুক, সে বড় মাপের সাধিকা,” রুদ্রদেব বললেন।


“ঘরটা এর মধ্যেই ব্যবহৃত হয়েছে। ঐ দেখো – ধুপের ছাই,কাঠের পোড়া টুকরো পড়ে আছে”।


“শাড়িটা চোখে ধুলো দিতে নয় তো, অনেক সময় শুনেছি শাড়ি পরেও তান্ত্রিকরা সাধনা করেন”।


সুহাসিনী যোগ করলেন, “বড় রকমের কালীসাধক – গল্পে পরেছি”। “একটা ম্যাল প্র্যাকটিস চলছে – এটাই সোজা কথা”।


রুদ্রদেব বললেন। “এখনতো বাবিনের ভয় পাওয়াটাকেও গল্প নয় – সত্যি মনে হচ্ছে”,


অনিরুদ্ধ যোগ করলো। “ঠিক। বাবিনও তো সাদা শাড়ি – লম্বা চুল দেখেছিলো”। “আর শ্বাসের আওয়াজ কাকিমণি? পা টেনে হাঁটা –“


“এমন তো কেউ নেই – অনি – কারোর হাঁপানি আছে এদের মধ্যে জানিস?”


“না,কাকাবাবু। বড় কথা পা টেনে কেউ হাঁটে না”। “পা, টেনে হাঁটছিলো – সদ্য কোন চোট পেয়েছিলো হয়তো—“ সুহাসিনী বললেন। রুদ্রদেব একটু ভাবলেন, “সবাই আছে বাড়িতে?” “হ্যাঁ, মণিপিসি গ্রামে গেছে, ভাইয়ের অসুখ”।


“হ্যাঁ সে তো বাবিন ভয় পাওয়ার আগের বিকালেই। ওকে বাদ দিলেই হয়”। সুহাসিনী বললেন।


“বাকিদের খেয়াল করো। সুহাসিনী, অনি –এখন কী দেখলে কাউকে বলবে না”। “সবে তো সাড়ে পাঁচটা, সবার ঘুমই ভাঙ্গেনি। দারোয়ান আর নিধুকাকাই দেখেছে কেবল।" "একটু দাঁড়াও,সু।" রুদ্রদেব পিছন পাঁচিলের দিকটা গেলেন,একাই।জংগল আছে ওদিকে,কাঁটাঝোপ।ঝোপ সরিয়ে একটু দেখেই ফিরে এলেন। "কী দেখলে?" "ঝোপে কেউ লুকিয়েছে কিনা।চলো,ফিরি।" "ঝোপে কেউ লুকিয়ে থাকবে!এই ভোরে!তুমি পারোও।"সুহাসিনীর কথার জবাবে রুদ্রদেব বললেন," তাও বটে।আমার বিলেত ফেরত বুদ্ধি তো!"


“রুদ্র তুমি ব্রেকফার্ষ্ট করে নেবে, এখানেই”। সুহাসিনী বললেন।


“কাল তুমি ছেলের কাছে ছিলে?” সুহাসিনী হাসলেন।


"ঐ জন্যই সু, এত খুশি”। রুদ্রদেব অনির পিঠে হাত রাখলেন।


“রেখে দিবি – যে দিনই পারবি”। “আমি তো চাই, সবসময় থাকুক”। “অনিরুদ্ধ বললো।


“তোর কাকা ছাড়বে?” রুদ্রদেব হাসলেন।


“আমি হলে ছাড়তাম।" "এসব মস্করা ছাড়ো। ঘরের শত্রু বিভীষণের কী হাল করবে দেখো”। সুহাসিনী বললেন। 


“কে বিভীষণ ধরা পড়ুক আগে, সু। তবে তোমাকে বলছিলাম অভিশাপ নয় – মানুষের হাত আছে এতে”।


“বাবিনের যাওয়াটাও কি …”। অনিরুদ্ধ বলে। “এখন তো মনে হচ্ছে তা-ই”। 


সুহাসিনী অবাক হলেন, “ব্ল্যাক ম্যাজিক করে মেরে দিলো! তা হয়!” রুদ্র বলেন, 


“আমার পয়জনিং থিওরি থেকে আমি সরছি না। অনিকেত কারোর হাতে খায় না তো?”


“না।” “একদমই যেন না খায় সু, দেখো”। রুদ্রদেবের যুক্তি বোঝেন সুহাসিনী।


“আমি সবসময় খেয়াল রাখছি। অনিও রাখে। নীরাকেও বলেছি এটা মানতে”।


“নীরা এখন এটা নিইয়ে আমাদের থেকেও কনশার্নড, কাকাবাবু। ওরই দৃঢ় ধারণা – এর পিছনে মানুষের হাত আছে”।


“মানুষটা কে? সেটা ধরলেই তো মিটে যায়! আর তার মোটিভ কি? খামাখা তন্ত্রমন্ত্র আর পয়জনিং করে মেরে ফেলতে যাবে কেন?” সুহাসিনী যুক্তিগ্রাহ্য ব্যাখ্যা চাইলেন। 


“যাবে – কারণ সে অনিকেত একা শুয়েছে খবর পেয়েই খুঁটিয়ে দেখতে গিয়েছিলো যে সে আদৌ বাবিন কিনা”।


“যে গেছিলো সে-ই বাবিনের – আই মিন ……”। অনিরুদ্ধ পুরোটা বলতে পারে না।


“মোস্ট প্রোব্যাবলি ইন মাই ভিউ”। রুদ্রদেব বলেন। 


“তার শিকার বেঁচে ফিরে এলো কি করে সেটা দেখার জন্য এসেছিলো – এবং ঐ আলো আধারিতে কতটা সার্টেন হয়েছে কে জানে”!


“তার মানে অনিকেতের কী …?” রুদ্রদেব মাথা নাড়েন।


“হ্যাঁ – ফাঁড়া আছে, অনি – রাতে দোতলার এন্ট্রান্স খোলা রাখবে না, প্রয়োজনে কোলাপসিল লাগাও, যাতে সার্ভেন্টস কোয়ার্টার থেকে বা একতলার সার্ভেন্টস রুম গুলো থেকে দোতলা একেবারেই একসেসিবল না হয়, রাতে”।


“আচ্ছা, কাকাবাবু”। “রাতে শোবার আগে তুমি, নীরা প্রতিটা ঘর চেক করে নেবে, বাথরুমও। দেন কোলাপসিবেলে তালা দেবে”।


“বেশ”। “প্রয়োজনে আমি আর সুহাসিনী অল্টারনেটিভ করে থাকবো”।


সুহাসিনী তাকান, “তোমার ব্যস্ত প্র্যাকটিস – তুমি পারবে?” “বাবিন কি তোমার একার নাতি?”


“এর থেকে সবাইকে বাদ দিয়ে নতুন লোক নিলে?” সুহাসিনীর কথায় রুদ্রদেব হাসলেন।


“তাহলে ধরা পড়বে না সে কোনদিনই। আর সে বাইরে গিয়ে নতুন রূপে বিপদ আনবে, তাই ঘরের শত্রুকে ঘরেই ফাঁদ পেতে ধরতে হবে। সে যেটা করতে চাইছে, সেটা করতে না পারার ফ্রাষ্ট্রেশন তাকে দিয়ে ভুল করিয়ে নেবে – আমি নিশ্চিত”।


“দেখো – যেটা ভাল বোঝো”। “অচ্যুতকে এসবের কিছু বলো না”। “তুমি কি ওকে …”। “কাউকেই বিশ্বাস করা ঠিক হবে না। আমরা চারজন ছাড়া”।


“ঠিক আছে, তাই হবে”। “তুমি থাকতে না পারলে বলো – আমিই রোজ থাকবো”।


“থাকবো, বাবিন, পরীর বাহানায়। কঠিন হবে না জিনিসটা। ছেলেরা বা ওর কাকাও আপত্তি করবে না”। "


বেশ, তবে তাই হোক”।


লনে বসে চা খাচ্ছিলেন রুদ্রদেব, সুহাসিনী। অনি উপরে গেছে। 


“সকালের চা আমার সাথে – ভাবতে পারো?” “স্বপ্ন মনে হচ্ছে”। সুহাসিনী হাসেন। “অচ্যুত জানলে?”


“জানবে”, “আলাদা খাটে শোয়?” “সে তো বিয়ের পর থেকেই”। “সেকি, তাহলে অতীন- অনুপম ……”। “চলে এসেছে বলা যায়”।


“কবে থেকে একেবারেই … ইউনো …”। সুহাসিনী তাকান, “অনুপম পেটে আসার পর থেকেই ……”। “কী বলো! একত্রিশ বছর!”


“হ্যাঁ – বাইরে ও ছিলো তো মেয়ে মানুষ”। “সেই।তোমার সমস্যা হয়নি?” “মন থেকে না চাইলে শরীর জাগে?”


“তাও ঠিক, এখন তো ওসব মেয়েমানুষ নেই বললে – এখন যদি চায়?” “ধুর! কী যে বলো!”


“কেন? এখন চাইতে নেই? বয়স – টয়স মানো তুমিও?” "


তোমার চাওয়ার অধিকার থাকলে – চাইতে?” রুদ্রদেব সুহাসিনীর হাত ধরেন, “আমি হলে, চাইতে হতো?” সুহাসিনী জবাব দিলেন না।


চোখের ইশারায় দেখালেন পরীকে কোলে করে নীরা আসছে, এক হাতে বাবিনকে ধরে রেখেছে।


“ঠাম্মা ………” পরী লাফিয়ে উঠলো। সুহাসিনীর কোলে চেপে বসলো। নীরা সামনের চেয়ারে বসলো। অনিকেত পাশে দাঁড়িয়ে ছিলো। নীরা ওকে টেনে নিয়ে কোলে বসালো।


“নীরা – বাবিন তো সেই আগের মতোই মা ন্যাওটা, দেখছি”। রুদ্রদেব হাসলেন। নীরা অনিকেতের দিকে তাকায়। কাল রাতে বকুনি খেয়েছে ছেলেটা। ওর ঠাম্মা না থাকলে নীরা আরো একটু শাসন করতো। ক্লাসওয়ার্কের খাতায় হোমওয়ার্ক করে ফেলেছিলো। ওর মিস সেটাও দেখেনি। নীরা পড়াতে বসে হোমওয়ার্ক মেলাতে গিয়ে দেখে। বকুনি দিতেই নিঃশব্দে কান্না। অনি এসে বাঁচিয়েছে। তবে অনির আসাটাও কাকিমণির কথাতেই হয়েছে – নীরা বোঝে। কালরাতে ওখানে ওরা মা, ছেলে আর পরী শুয়েছে। নীরার ঘরে নীরা আর অনিকেত। নীরা ঘরে ঢুকে যখন লক করছিলো দরজাটা ছেলেটা বলে, “মামণি লক করে দিলে?”


নীরা মুচকি হেসেছিলো, “হ্যাঁ যাতে ঠাম্মা , বাপি কেউ বাঁচাতে না পারে তোকে ধরলে”। অনিকেত সেটাই সত্যি ভেবেছিলো। মাথা নীচু করে ভয়ে কাঁপছিলো। নীরা পাশে বসে গায়ে মাথায় হাত বুলিয়ে দেয়। “দেখে হোম ওয়ার্ক করবি পরের দিন থেকে”। “বাপি খাতাটা ঠিক করে দিয়েছে তো”। অনিরুদ্ধ পেজ দুটো রিমুভ করে হোম ওয়ার্কের খাতায় লাগিয়ে দিয়েছিলো। “জানি, তাই বকছি না আর”।"বাপি না এলে মারতে”। নীরা চোখ মোছায়, “হ্যাঁ।কেউ মারেনি তোকে কখনো?” “না তো, আমি তো সবসময়ই ফার্ষ্ট হই মামণি। ওখানে স্যাররা, মিসরা, ফাদাররা, ব্রাদাররা যা বলতো শুনতাম – মারবে কেন?” “তাও ঠিক। পানিশমেন্ট?”


“তাও কোনদিন না”। “তাহলে মনে হয় মামণিই খারাপ, বকে, কানমলা দেয়, পড়া একটু না পারলেই উঠবোস করায়। আজ মারতোও …”।


অনিকেত আকুল চোখে তাকায়, “না, না মামণি, তা কেন? ওখানে সবাইতো এত খুঁটিয়ে দেখতো না – আর মা সবারই শাসন করে, বাপিও গল্প করেছে ঠাম্মার কাছে কত্ত মার খেয়েছে –“ নীরা হাসে।


“আমিও খেয়েছি, দিদুনের কাছে”। নীরা অনিকেতকে শাসন করে। কারণ বাবিনকে শাসন না করে যে ভুল করেছে সেটার পুনরাবৃত্তি চায় না। ছেলেটা একটা কিছু করতে গেলেও ভয়ে থাকুক। মামণি কী বলবে, ভাবুক। এটাই নীরার চাওয়া। 


“বোন আসবে না?” “বোন ঠাম্মার কাছে শোবে। বাপি আর ঠাম্মার মাঝে”। “ও”। “তুই যাবি? বাপি বলছিলো”। নীরা উত্তরটা শুনতে চায়। “না, না মামণি তুমি একা শোবে নাকি। তুমি শোও। আমিও শুয়ে পড়ছি”। নীরা খুশি হয়, বাবিন মা ন্যাওটা ছিলো খুব। অনিকেত কতটা – সেটা দেখার জন্যই ওকে বাপির কাছে যেতে বলেছিলো।


“আমি একা শোব বলে, নাকি তুই মামণির কাছে ঘুমোতে চাস বলে?” অনিকেত শুয়ে পড়েছিলো, তারপর বলেছিলো, “আমি তো চাইবই মামণি। কিন্তু বোন তো ছোটো। বোনের তোমাকে ছাড়া কষ্ট হবে কিনা তাই ……”।


নীরা বুঝেছিলো নিজের চাওয়ার কথা মুখ ফুটে বলতে শেখেনি এই ছেলে। 


“নিজেরটা ভাব আগে, বোকাটা”।


নীরা ওর দিকে কাত হয়ে শুয়েছিলো। অনিকেত ভয়ে ভয়ে কোল ঘেঁষে এসেছিলো। 


“কী হলো?” “কিছু না”। নীরা বুঝে কোলের মধ্যে টেনে নিয়েছিলো। 


“রোজই তো কোলের মধ্যেই ঘুমোস আজকাল”।


“যদি বকো”। নীরা হেসে ফেলেছিলো, “বকছি না”। অনিকেতের কপালে চুমু খেয়েছিলো।


“মামণি –“। “বলো”। “তুমি সবেচেয়ে ভালো”। নীরা অনিকেতের দুগালে চুমু খেয়েছিলো। “জানি”।


“তোমার কাছে থাকতে সবচেয়ে ভালো লাগে আমার”।


“সেটাও জানি, কিন্তু সেটা বলতে গেলেই চুপ হয়ে যাস – কেন?”


অনিকেত উত্তর দেয় না। মামণি তো ওকে বাবিন বলে না। বাকি সবাই বলে। ও তো সেটা নিয়ে প্রশ্ন করছে না মামণিকে।


“ঘুমো”। অনিকেত নীরাকে জড়িয়ে ধরেছিলো দু’হাতে। বাবিনও এভাবেই ঘুমোতো। অনেক ক্ষেত্রেই অদ্ভূত মিল খুঁজে পায় নীরা। দু’জনের মধ্যে। 


“একটা কথা, প্লিজ”। “বল”।


“আর এভিলটা আসবে না তো?” নীরা বোঝে ভয়টা ছেলেটার মনের মধ্যে গেঁথে গেছে। 


“সবসময় আমার, বাপির, ঠাম্মার কথা শুনে চলবি, আসবে না”


“সেদিন যখন এসেছিলো খুব ভয় লাগছিলো। মনে হচ্ছিলো – তোমাকে ডাকতে পারলে, তুমি তাড়িয়ে দেবে”।


নীরা বোঝে, মামণিকে ভয় পেলেও ভরসা করে খুব। অনিকেতকে খুঁটিয়ে অনেকবারই দেখেছে নীরা। সত্যিই মিল আছে। এত মিলের তল খুঁজে পায় না ও – বাবিনের ছবি হাতে করেও একদিন মিলিয়ে দেখেছে, অনিকেতের ঘুমের মধ্যে। 


“আমার কাছেই ঘুমোবি সবসময় – কেউ ভয় দেখাতে পারবে না”।"


আচ্ছা। জানো মামণি ………”। “আবার? স্কুল আছে কাল”।


“লাষ্ট কথা …”। নীরা আটকায় না, “শুনি”। 


“ক্লাসের ছেলেরা সবাই খুব মায়ের গল্প করতো – আমি তো আগে শুনতাম শুধু – বলতে পারতাম না। এখন বলি”।


“কী বলিস শুনি?” “এই যে তুমি কত্ত ভালো, আমাকে কত ভালোবাসো, বোনকে কত ভালোবাসো – আমাকে পড়াও, খাওয়াও, ঘুম পাড়াও ……”।


“বুঝছি, সবার কাছে ভালো টাই শুধু বলা হয় তাই তো?”


“উঠবোস খেয়েছি – বলিনি”। অনিকেত হেসে বলে। 


“ওরা বলে তোর মামণি বকে না? শুধু আদরই করে? আমি বলেছি – হ্যাঁ।”


এই হ্যাঁ-টা একজনের ক্ষেত্রে সত্যি ছিলো। নীরার চোখে জল আসে। খাটের মাথার কাছের টেবিলে রাখা তার হাসিমুখের ছবিতে চোখ পড়ে। চোখ থেকে জল পড়ে।


“মামণি, কাঁদছো? আমি ভুল বললাম?”


নীরা চোখ মছে, “যেটা সত্যি, সেটাই বলবি। মা'কে মিথ্যা ভালো করতে হবে না”।


অনিকেত মামণির বুকের মধ্যে মুখে গোঁজে। 


“না, থাক। মামণি, তুমি দাদাকে বকতে না। বাপি বলেছে। কিন্তু আমাকে বকো। আমি গল্পে পড়েছি মা যে বাচ্চাটাকে বেশি ভালোবাসে তাকেই বকে”।


নীরা জানে গল্পের কথাটা এক্ষেত্রে অক্ষরে অক্ষরে মিথ্যা। তবুও ভুলটা ভাঙ্গায় না। “গল্পের বই পড়িস?"


“ওখানে লাইব্রেরী থেকে নিয়ে নিয়ে পড়েছি – ছোটদের বই”।


“বেশ, আমি কিনে দেবো আরো বই তোকে”। নীরাও ছোট বেলায় খুব বই পড়তো। অনিকেত খুশি হয়।


“আচ্ছা, আমার স্কুলে যাবে?” “যাবো”, “কবে?”


“আর একটু সেরে নিই। তোর ডাক্তারদাদু বললেই যাবো”।


“ডাক্তারদাদু ভাই খুব ভালো। ঠাম্মার হাজব্যান্ড দাদুভাই – ও ভালো। তোমার বাবা দাদুভাই – ও”।


“সবচেয়ে ভালো ঠাম্মা, তাই তো?” “হ্যাঁ, ঠাম্মা বেষ্ট”।


“বাঁচায় তো সবসময়!” নীরা মুচকি হাসে। 


“হ্যাঁ, ঠাম্মা না থাকলে আরো বকুনি খেতাম রোজ”।


“এবার কি কট কট করা বন্ধ হবে – নাকি কালকের মতো উঠবোস করাতে হবে?” নীরা ভয় দেখালো।


“ঘুমোচ্ছি, ঘুমোচ্ছি। বোনের সামনেও উঠবোস খেয়েছি কাল”।


নীরা দুটোকে নিয়ে একসাথেই পড়তে বসায়। “তাতে কী, বোন তো”। “ইস!” 


“লজ্জা? লজ্জা হলে তবেই শিক্ষা হবে”। “একটু ভুলে গিয়েছিলাম তো ……”


“একটুও ভুললে ফার্ষ্ট হওয়া যাবে?”


অনিকেত বোঝে মামণিই ঠিক। আরো জোরে জড়িয়ে ধরে, নীরা বলে, “ঘুমো”।


“নীরা, কী ভাবছো অত?” “কই, কিছু না তো কাকাবাবু”।


রুদ্রদেব বুঝলেন নীরা বলতে চায় না। “বাবিন, ভালো ঘুম হয়েছে কাল?”


“হ্যাঁ দাদুভাই। ভোরে বোনকে দিয়ে গেলো বাপি। বোনের ঘুম ভেঙে গেছিলো।"


“বোনের দুষ্টুমিতে ভোরের পর আর ঘুম হয়নি বলতে চাইছে”। নীরা বোঝালো।


“বাহ, বলার ভঙ্গিটা ভালো তো বাবিনের। সুহাসিনী, তোমার বড় নাতি বেশ বুদ্ধিমান। নীরা – এখন মন ভালো তো , মা?”


“হ্যাঁ, কাকাবাবু”। “সত্যি বলছো?” “হ্যাঁ, ফাঁকা ভাবটা কমেছে অনেক”। “ওষুধ?” 


“খাচ্ছি, কিন্তু কমাতে চাইছি”।


“ডাক্তার দাদুভাই – তুমি দাদাভাইকে বলো না, একটু খেলি। কাল বিকালেও খেলেনি”। “দাদাভাই খেলেনি বিকালে? ভারী অন্যায়। বাবিন যাও বোনের সাথে খেলো একটু”।


“যাবো, মামণি?” নীরা হাসলো। “যা – তবে চোখের আড়াল হবি না”।


“এই তো তোমাদের সামনেই মাঠে খেলবো”। “যা-“।


অনিকেত আর পরী গেলে সুহাসিনী বললো, “বাবিনের স্কুল নেই আজ?”


“আছে, ভোরে একটু গা গরম গরম দেখলাম। কাশিও হচ্ছিলো। আজ থাক পাঠাবো না”।


“ভাল ডিসিশন নিয়েছো, খেলে ফিরুক। আমিও দেখে দেবো, নীরা – বাবিন মনে হয় সেদিন রাতে যাকে দেখেছিলো সেটা কল্পনা নয়”।


“জানি, ও মিথ্যা বলার ছেলে না, কোন মানুষেরই কাজ এটা, আর সে এই বাড়িতে আক্সেস পায় সহজেই”।


“তুমি কাউকে সন্দেহ করো?” সুহাসিনী বললেন।


“না, আবার সবাইকেই করি। মোটিভটা বুঝতে পারিনা। পিছনের ঘরে কিছু পেলেন?” 


“হ্যাঁ, তন্ত্র সাধনার চিহ্ন”। নীরা ভাবলো একটু, “কোন অন্য চিহ্ন?”


“একটা সাদা শাড়ি, ধুপের ছাই পোড়াকাঠ। এর মধ্যেই কোন রাতে সাধনা হয়েছে”।


“আচ্ছা, এইসব সাধনার উদ্দেশ্য মুখার্জীদের ক্ষতি, তাই তো?”


“অভিশাপের লেজেন্ডটাকে বাঁচিয়ে রাখার তাড়না বলতে পারো”। রুদ্রদেব বললেন,


“অনিকেত এসে ওর বা ওদের হিসাবটা ঘেঁটে গেছে। যাকে সরিয়ে দিলো, সে আবার ফিরে এসেছে কী করে …”। “বুঝেছি”।“তুমি বুঝবেই। তুমি ল’ইয়ার, তাও ক্রিমিনাল ল নিয়ে পড়েছো”। নীরা অদ্ভুত ভাবে হাসলো।


“বাবিনকে কেউ আমায় চোখের সামনে মেরে ফেললো আর আমি বুঝতে পারলাম না – কিসের আর লইয়ার আমি কাকাবাবু। মা-ই হতে পারিনি ঠিক করে”। সুহাসিনী রুদ্রদেবের দিকে তাকালেন। এই মেরে ফেললো শব্দটা অর্থবহ খুব, অর্থাৎ বাবিন মারা গেছে – এটা নীরা মানতে শুরু করেছে। পুরোটাই অনিকেত আসার সুফল। 


“তন্ত্র মন্ত্রে এসব হয় না কাকিমণি। অভিশাপেও না। হয় শত্রুতায় বিষ দিয়ে। সম্পত্তির লোভে বিষ দেওয়া বা দেওয়ানোর উদাহরণ তো কম নেই পৃথিবীতে”।


“যাকে সামনে দেখছি সে – “ বোড়ে হতে পারে। মন্ত্রী, রাজা অন্য – বাদ দিন সেসব। এবার কী করবেন ভাবলেন? যে করেছে তাকে ধরতে কিন্তু হবেই”। রুদ্রদেব সংক্ষেপে বললেন। 


ওদের তিনজনের আলোচনার সারাংশ, “রাজি তুমি?” “রাজি, তবে খুব সতর্ক থাকতে হবে, সবাইকেই”।


“ওরা বাবিনের ফেরাটাকে না মেনে নিতে পেরে খুব শীঘ্রই আক্রমণ করতে পারে। এটাই আমাদের সুযোগ, ওদের ধরার”। সুহাসিনীর কথায় নীরা অমত করলো না। নীরা নিজেও জানে ওদের ধরার – এর থেকে ভালো সুযোগ আর পাবে না।


পর্ব – ২৯


বাবার আর দাদার কাছ থেকে ডিনার টেবিলে কথাটা শুনলো অনুপম। ব্যাঙ্কক থেকে ফিরে এসেছে ও, আজ দুপুরে।


“মা, ও বাড়িতে শুচ্ছে, কেন?”


“বাবিন আর পরীকে দেখবে বলে”। “থামো বাবা, পরী না হয় বুঝলাম – পরীকে তোমরা দিয়েছো, কিন্তু বাবিন?” 


“বাবিন ফিরে এসেছে”, অতীন বললো। অনুপম হো হো করে হাসলো।


“ফিরে এসেছে! মানে! মারা গেছে ও। দাদাভাই পোড়াতে গিয়েছিলো – আমি গিয়েছিলাম সাথে। ফিরে এসেছে মানে কি!”


অচ্যুত অতীনের দিকে তাকালেন। তারপর বললেন, “এতে হাসির কিছু নেই ছোট খোকা, বাবিনের মত একটা ছেলেকে এনেছে অনি”। “একটা ছেলেকে এনেছে? তাও বাবিনের মত! কোথা থেকে!”


অতীন বোঝাতে চাইলো, “ভাই – আমি নিজে চোখে দেখেছি, সত্যিই অবিকল বাবিন, কেবল শান্ত বেশ এই যা।"


“আবারো গল্প ফাঁদছ তোমরা। একরকম দেখতে হয় নাকি?” 


“হ্যাঁ ভাই, একইরকম”, অতীন বললো। “বয়স?” “ওয়ানে পড়ে, বছর ছয়েক”।


“কোত্থেকে আনলো?” “কোনো অরফ্যানেজ, দাদাভাই ডিটেলটা বলেনি”।


“বাব্বাঃ! অনেক খোঁজ লাগিয়েছিলো তাহলে! বুদ্ধিটা কার? দাদাভাই – এর নাকি মায়ের বয়ফ্রেন্ডর?” চোখ মারলো অনুপম। অচ্যুতের কান গরম হলো।


“তোদের মা সামনে নেই বলে এসব কথাও বলছিস?” 


“বলবো না? তুমি মা’কে একা ছাড়ছো কেন? ওখানে?” 


“বাবিনের দেখভালের জন্য”। “যাহ বাবা! দাদাভাই আছে, বৌদিমণি আছে, সে তো ছেলেকে ফিরে পেয়েছে। এখন আমাদের মা’কে কি দরকার”।


অচ্যুত উঠে পড়লেন। অতীন বললো, “বাবা, খাবার ছেড়ে উঠো না”।


“এসব শোনার পর থাকা যায়? তোদের মায়ের নামে কী বললো ও ……”। অচ্যুত হাত ধুলেন। 


“এসব লোকের মুখের কথা শুনিস না, ছোট খোকা। সে আমার এতগুলো বছরের বিয়ে করা বৌ। আমার সব দোষ ত্রুটি জেনেও ছেড়ে যায়নি কখনো। তাকে অন্য কারোর সাথে এভাবে ……”।


অনুপম হাসলো, “খেয়ে নাও, বৌ নিয়ে এতো ইমোশনাল হতে নেই। নাকি রাগটা পরীর পাওনা অর্ধেক হয়ে গেল তাই!” "তোরা খা।"অচ্যুত চলে গেলেন।অতীন রেগে গেলো এবার," মাকে নিয়ে এগুলো কেমন কথা,ভাই?" "মায়ের বাড়াবাড়িটাও কম কী?সারাজীবন তো দাদাভাইকেই প্রায়োরিটি দিলো, যাদের জন্ম দিয়েছে তাদের চেয়ে।সেই নিয়ে জেঠিমণির ক্ষোভ ছিলো।সেই ক্ষোভেই তো সংসারটা ভাঙলো।" “বাবিনটা এসেছে – “, “আরে রাখো তোমার বাবিন,গাল গল্প যতো”।


অনুপম বিরক্ত হয়।অতীন কথা বাড়ায় না।ওর ছোটভাই বদমেজাজি, রাগী। ব্যবসায় মন কোনদিনই ছিলো না। মদ, গাঁজা, নারী সঙ্গ বরাবরই ছিলো – এখনো আছে। আবার বৌ পেয়েছে খুব ভালো। পরমা অশান্তি করে না খুব একটা। মেনে নেয়। বংশের মধ্যে এই নেশা ভাঙের দোষ কেবল অনুপমেরই আছে। নারীসঙ্গ বাবারও ছিলো – কানাঘুঁষো শোনা যায়। জেঠার তেমন কিছু শোনেনি অতীন। তবে চাকর বাকর মহলের গসিপে একবার ওদের ঠাকুরদার গ্রাম ছাড়ার পিছনে অবৈধ সম্পর্কের জের ছিলো, শুনেছিলো অতীন। কাউকে বলেনি। নিধুকাকার ছেলে তখন বেড়াতে আসতো মাঝে মাঝে। অতীনের বয়সী। অতীনের সাথেই খেলতো। ওর মুখেই শুনেছিলো জমিদারীর মধ্যেই কোন এক মেয়ের সাথে নাকি …… ঠাকুমা ঠারেঠোরে সবসময় বলতেন অনুপম ঠাকুদার মতো হয়েছে। ঠাকুরদা মারা যাবার মাস দশেক পরে অনুপমের জন্ম। ঠাকুরদা পুর্ণজন্ম মানতেন ঠাকুমা, বাড়ির অন্যরা সংস্কার ভাবলেও ঠাকুমার কাছে স্থির বিশ্বাস ছিলো। গ্রামে ঠাকুরদার করে আসা সব কুকীর্তি ঠাকুমা হয়তো জানতেন, হয়তো না। ঠাকুরমা গ্রাম যেতে চাইলেও ঠাকুরদা কোনদিন নিয়ে যাননি। পরে বাবা জেঠারাও গ্রাম নিয়ে গা করেননি আর। তবে ঠাকুমা মৃত্যু শয্যাতেও বারবার গ্রামের কথা বলতেন। স্পষ্ট মনে পরে অতীনের। নাতিদের মধ্যে অনুপমকে পছন্দ করতেন না একেবারেই। ঠাকুরদার মতো দেখতে বলে – নাকি অতিরিক্ত দুষ্টু বলে – নাকি ডাকাবুকো বলে – জানে না অতীন। তবে অনুপমের দু’চারটে অ্যাফেয়ার্স, কলেজে ইয়ার ড্রপ, মদ খেয়ে বাড়ি ফেরা ঠাকুমাও দেখে গেছেন। ঠাকুমার মারা যাবার পরেই যখন সম্পত্তি দুভাগ হয়ে গেলো – ঠাকুমার স্ত্রীধন অনুপমকে বঞ্চিত করে কেবল অনিরুদ্ধ আর অতীনকে লিখে গেছেন ঠাকুমা – দেখা যায়। তখন আঠারো বছরের অনুপম কিছুই পায়নি। এই নিয়ে অনুপমের কম ক্ষোভ নেই। ঠাকুমার কোন কাজই করতো না – নেহাত মায়ের ভয়ে করেছে। আজ মা থাকলে এত বড় কথা বলতে পারতো না অনুপম। অতীন জানে না কেন মায়ের হঠাৎ এত আগলানোর প্রয়োজন বাবিনকে – কিন্তু অনুপমকে আগলানোর প্রয়োজনও ও অস্বীকার করতে পারে না। মায়ের শাসনের জন্যই ও এখনো সংসার করছে। দুই বাচ্চার বাবা হয়েছে। না হলে কবেই চুলোর দুয়োরে যেতো।


“দাদাভাই-“ অতীন ফোন করে অনিরুদ্ধকে। 


“অতীন,এতরাতে? সব ঠিক আছে তো,ভাই?”


অতীন বারান্দায় পায়চারি করছিলো, বাবা নিজের ঘরে ঘুমিয়ে পড়েছেন। পরীর মাও ছেলেকে নিয়ে ঘুমে কাদা।


“ঠিক আছে।অনুপম ফিরেছে আজ। মা অখানে শুনে বাবার সাথে অশান্তি করলো একপ্রস্থ”।


“ওহ”, “মা’কে বলতে হবে না”। “বেশ, বলবো না”।


“মা ঘুমিয়ে পড়েছে?” “না, সবে খাওয়া হলো”।


“বাবিন, পরী?” “দাদা, বোন মিলে খেলা চলছে”।


“ভালো মিলে গেছে না?” “খুব, বাবিন খুব কেয়ারিং বোনের প্রতি। পরীও দাদাভাই কে খুব ভালোবাসে”।


অতীন মনে মনে ভাবলো এ বাড়ি থাকতে নিজের দাদা বোনেও এমন ভাব দেখেনি। বুবলাই পরীকে হিংসাই করতো বেশ। মা – বাবার আদর ভাগ হয়ে যাবে বলে। 


“পরী আমাদের কথা বলে তোমাদের কাছে?” সঙ্গীন প্রশ্নটা করেই বসলো অতীন। অনিরুদ্ধ মিথ্যাটাই বললো, 


“বলে তো, এখন ঠাম্মা আছে বলে খুব খুশি”।


“বৌদিমণি এখনো সামলাতে পারছে না দুজনকে বলো, মা তাই থাকছে?”


অনিরুদ্ধ সত্যিটা লুকালো, “হ্যাঁ রে, নীরা আর একটু সুস্থ হোক। তোদের অসুবিধা হচ্ছে খুব, না?”


“আমার ঠিক নয়, তবে অনুপম খুশি নয় এতে। ওকে সামলাবার জন্যও তো মা’কে লাগে এখনো জানোই তো”।


“আর কয়েকটা দিন, অতীন, প্লিজ”।


অতীন হাসে, “দাদাভাই, ওভাবে বলছো কেন? মা তোমাকে আমাদের সাথে আলাদা করেছে কখনো?”


“তাও-“ “তাও আমার অনুমদি লাগবে? একেবারেই লাগবে না। মা যা বলবে তাই হবে”।


অনিরুদ্ধ খুশি হলো, “বড় হয়ে গেছিস অনেক”।


“তা হয়েছি বটে। বেশ বড় ব্যবসা সামলাচ্ছি যখন। দাদাভাই – একটা কথা জিজ্ঞাসা করবো? বাবিনকে নিয়ে”।


“কোথায় পেলাম ওকে তাই তো?”


অতীন হাসলো, “তোমার ইন্টেলিজেন্স একটা আলাদা লেভেলেরই”।


“পেয়েছি অতীন, কপালে ছিলো। পেয়ে গেছি। উপরি পাওনা ছোট্ট মেয়েটা। বেশ পরিপূর্ণ লাগে এখন, জানিস?”


“বুঝি।পরী জেঠুমণিই বলে?” 


“হ্যাঁ, ডাক বদলাইনি। নীরার খুব ন্যাওটা, নীরাও কোল থেকে নামায় না”।


“বাবিনও তো বৌদিমণির চোখের মণি ছিলো বলতে পারো”।


“এখন বড়টা শান্ত অনেক। তাই ছোটটার প্রতি নজর বেশি”।


“পরী বলছিলো ওর দাদাভাই পড়াশুনাতেও ভালো?”


“হ্যাঁ, ফার্ষ্ট হয়”। “স্বভাবে মিলটা নেই তবে” অনিরুদ্ধ বললো।


“বড় হলে বদলায়ও, তাই না?” “তা বটে”।


“ওর স্কুলেরই একটা অরফ্যানেজে থাকতো এতদিন”। “মিশনারী?”


“হ্যাঁ, শিয়ালদহের কাছে”। “আচ্ছা, সেদিন ওর জন্য চকোলেট ছাড়া কিছু নেওয়া হয়নি আমার”। 


“ওসব আবার কেন?” 


“তাও, বড় কাকামণি বলে কথা”।


“বই আনিস আনলে, গল্পের বই পড়ে খুব”।


“তাই আনবো তবে। বাবা সেদিন বলছিলো বাবিনকে এ বাড়িতে এনে রাখবে কদিন”।


“নীরা ঠিক হোক আগে ছাড়বো”।


ফোন রাখলো অতীন। পরী কি দাদাভাইকে বাবা বলবে, কখনো? নাকি জেঠুমণি বলেই ভালোবাসবে,অতীনের থেকে অনেক বেশি করে। লাভক্ষতির হিসাবে মেয়েটাকে দিয়েছে অতীন। ওখানকার অর্ধেক পেলেও যে অনেক। কিন্তু আজ কেমন যেন ফাঁকাফাঁকা লাগছে। সব থেকেও কী যনেই মনে হচ্ছে, হঠাৎ। বিস্বাদ লাগছে অতীনের সব। হেমন্তের রাত, শিশিরের শব্দ, শিরশিরে হাওয়ার সাথে বুকে বিঁধছে যেন।


পর্ব – ৩০


সকাল সকাল অনুপমকে এ বাড়ি দেখে অবাক হলেন সুহাসিনী। এত সকালে তো ওঠে না সে। আজ রবিবার। আজ তো আরো দেরী হবার কথা। 


“কী ব্যাপার? এত সকালে?”


নীচের তলার ডাইনিং হলে ব্রেকফাস্টের আয়োজন করছিলেন সুহাসিনী। অনিরুদ্ধও ছিলো। পরী, বাবিন, নীরাও আজ উপরে ব্রেকফাষ্ট না করে নিচে এসে খাবে। 


"দেখতে এলাম, কী করছো”।


সুহাসিনী কিছু বলতে যাচ্ছিলেন, অনিরুদ্ধ কথা ঘোরালো।


“বস, ব্রেকফাষ্ট হয়ে গেছে”। “মণিপিসির কাজটা, কী মা করছে আজকাল?” সুহাসিনী চমকে উঠলেন।


“কী বলছিস এসব, অনুপম!”অনিরুদ্ধ বললো। 


“তাইতো দেখছি, কোথায় সে, মণিপিসি?”


“অনি- তোমার ছোটভাইকে বলো বাড়ি যেতে”।


“কাকিমণি – রাগ কোরো না”। “দাদাভাই – ছোটবেলার নাটক এখনো চালাচ্ছ? মাকে তুমি থামাতে যাতে আমাদের না বকে। উল্টে মা বেশি করে আমাদের মারতো। কার কথায় জানি না ভাবছো?”


“ছোটোখোকা!” সুহাসিনী ধমকে উঠলেন। “খুব ভয় পেলাম”। অনুপম হাসলো।


“মণিপিসি কোথায় বললে না?” “গ্রামে গেছে”। “ওহ, সেই মুখার্জীদের বাগদেবীপুরের জমিদারী। বাপের জন্মেও যা দেখলাম না। ঠাকুরদা লোকটা সেই যে চলে এলো গ্রাম থেকে আর গেলই না ফিরে – আর সেই রাগে বুড়ি মরার সময়ও তার গয়না দিলো না আমায়”। 


অনিরুদ্ধ আড়চোখে কাকিমণিকে দেখছিল। রাগে কাঁপছেন। যদি কিছু হয়ে যায়? ” অনুপম, ঠাকুমা ছিলেন উনি, আমাদের। কোনো বুড়ি নয়। আর তোর ব্যবহারে এখন দেখছি উনি যা করেছেন ঠিকই করেছেন”। অনুপম থমকালো, দাদাভাই এত কড়া ভাবে বলবে ভাবেনি। 


“ছোটবৌমা তো মা লক্ষ্মী। দুই ছেলের বাবাও হয়েছিস। তাও এসব কেন? ব্যবসা তো দেখিস না, জানি। বয়ে গেছিস শুনেছি।তবে এতোটা – ভাবিনি”। “দাদাভাই-“ “নে, চা-টা খা। উনি তোর মা আর আমার কাকিমণি হলেও তার সম্মানহানিকর কোন কথা যেন তোর মুখে না শুনি আর”। অনিরুদ্ধর গলায় শাসনের সুর ছিলো। এভাবে বহুদিন পর শাসন করলো দাদাভাই ওকে। অধিকার নিয়ে, ছোটবেলার মতো। অনুপম আর কিছু বললো না।একটু পর বললো, 


“বাবিন এসেছে শুনলাম”। “হ্যাঁ, তবে এমন অভদ্র ব্যবহার করলে দেখা করাবো না। কাকা এমন উচ্ছন্ন দেখলে কি শিখবে!”


“আমি তো খারাপই। মুখার্জী পরিবারের ব্ল্যাকশিপ”। “ভালো হতে কে মানা করেছে শুনি?”


অনুপম চুপ করে থাকলো। “কাকিমণি বেশি করে খেতে দাও তোমার ছোটখোকাকে। কাল শনিবার রাত ছিলো, ছাইপাঁশ গিলেছে বাইরে নিশ্চয়”।


অনুপম মায়ের দিকে তাকালো, মা ভীষণ রেগে আছে। “সঙ্গদোষ”। সুহাসিনী বললেন।


“সঙ্গটা ঠিক করতে হবে এবার। কাকাকে বলবো আমি”। “তোমাদের আলাদা আলাদা খেলার পর কি এটা এক এক খেলা চলছে?”


অনিরুদ্ধ এবার হেসে ফেললো। “কাকিমণি দেখলে তো কেমন ছেলে মানুষ? কেন, এক হওয়া ভালো না?” "সেটা যারা আলাদা হতে চেয়েছিলো – তারা বলবে”। বলেই অনুপম থমকে গেলো। বৌদিমণি আসছে। পরীকে কোলে নিয়ে। সাথের বাচ্চাটা সত্যিই অবিকল বাবিন। এটা কী করে হয়! বাবিনকে তো পুড়িয়ে এসেছে ওরা সাবাই। ও নিজে ছিলো সেখানে। 


“এটা কে বাবিন, জানিস?” অনিরুদ্ধ ইচ্ছা করেই বললো। অনিকেত তাকালো। ঠাম্মাকে মা বলতে শুনেছে একবার। বড় কাকামণিকে চেনে ও। তাহলে ছোট কাকামণিই হবে। 


“ছোট কাকামনি, বাপি”। অনুপম অবাক হলো। 


“চিনিস”? নীরা বললো, “হি ইজ ইন্টেলিজেন্ট, ক্যাল্কুলেট করেছে”।


“বাহ, বৌদিমণি – শান্তও তো, বেশ”।


“হ্যাঁ, মামণির চোখের সামনে একটু বেশিই শান্ত। পিছন ফিরলেই বোনের সাথে হুটোপুটি ”। 


অনুপম কাছে ডাকলো, “এদিকে আয়”। অনিকেত মামণির দিকে তাকালো, “যাও, কাকামণি তো”। 


অনুপম কোলে বসালো, খুঁটিয়ে দেখলো ওকে। “দাদাভাই, অবিকল …”। অনিরুদ্ধ চোখের ইশারা করলো। অনুপম বুঝলো বাচ্চাটাকে বোঝানো হয়েছে ও-ই বাবিন। 


“বাবিন কোন স্কুলে পড়ে?” অনিকেত নামটা বললো।


“পার্কষ্ট্রিটে?” “না – শিয়ালদহরটা” অনুপম থমকালো। “বেশ বড় স্কুল তো …” অনিরুদ্ধ বললো। 


“হ্যাঁ, তা বড়ো”। “ওদের একটা অরফ্যানেজ আছে না?” অনিরুদ্ধ মাথা নাড়লো। “হ্যাঁ, তুই চিনিস?” "না, ওই রাস্তায় যেতে আসতে দেখেছি”। “ওহ!” “ছোট কাকামণি-“ অনিকেতের ডাকে তালালো অনুপম, “হ্যাঁ, বাবিন?” অনিরুদ্ধ, সুহাসিনী, নীরা খুশি হলো। অনুপম ভুল করেনি তবে, মুখ ফস্কায়নি। 


“বোন গল্প করেছিলো – তুমি নাকি ওদের সাথে খেলোও বাড়িতে!”


অনুপম মাথা নাড়লো, “হ্যাঁ, তা খেলি, আমার তো আর তেমন কাজ নেই”।


পরী বলে উঠলো, “সানডেতে মাস্ট খেলে”।


“পাকা বুড়ি আমার”। অনুপম হাসে, “পরী,এখানে ঠাম্মা, জেঠুমণি জেঠিমণি খুব মজা না?”


“দাদাভাইও”। পরী মাথা নাড়ায়। “ওখানেও তো তোর দুটো দাদা আছে”। অনুপম জানতে চায়। 


“ছোট কাকামনি – তুমি জানোই না কিছু।আমার দাদাভাই বেষ্ট”।


“বাবিন দাদা?” “নাম ধরে বলতে নেই। জেঠিমণি বলেছে”। নীরা হেসে ফেলে, “দাদা বোনে খুব মিল।"অনুপম অনিকেতের মাথায় হাত রাখে, “বোন ভালো?” “বোন তো বোনই ছোটকাকামণি, ভালো আর মন্দ কি?” অনুপম হেসে ফেলে, “কথার মার প্যাঁচ আছে। মায়ের মতো উকিল হবি?”


“না, ডাক্তার। ডাক্তারদাদুর মতো”। অনুপম থমকায়, বাকিরা হাসে।


ডাক্তারকাকা তার মানে প্রায়ই আসেন, এখানে। “ছোট কাকামণি – চলো না, খেলবে”।


পরী বলে, অনুপম খারাপ লাগাটাকে গিলে নেয়। ওকে সত্যি গুলো জানতে হবে, হবেই।


পর্ব – ৩ ১


“কেমন বুঝলেন?” ডক্টর চক্রবর্ত্তীর চেম্বার থেকে বেরোবার আগে প্রশ্ন করে অনিরুদ্ধ৷।কাকিমণি নীরাকে নিয়ে বেরিয়েছেন চেম্বার থেকে। বাইরে নীরার মা, বাবার কাছে বাচ্চারা রয়েছে। এখন চেম্বারে শুধু অনিরুদ্ধ আর রুদ্রদেব।


“কাজ করেছে ওষুধ”। “ওষুধ ?” রুদ্রদেব বললেন।


“প্ল্যানটার কথা বলছি। এখন মেডিসিনের ডোজ কমানো যায়”।


“বন্ধ করা যাবে না?” অনিরুদ্ধ হতাশ হয়।


“ডোন্ট জাম্প দ্যা গান, ট্যাপার করে বোধ করতে হয়। নাহলে সমস্যা।আই মিন, ডোজ আসতে আসতে কমাতে হবে”।


“ওহ”। “তবে, এখনো কিন্তু বাবিন বলে মানে না”। ডক্টর চক্রবর্ত্তী বললেন। অনিরুদ্ধ অবাক হলো, “বললো?”


“হ্যাঁ, সবই জানে, ওর নাম অনিকেত, অরফ্যানেজ থেকে এসেছে। তবে বাবিন যে আর ফিরবে না এটা মানতে শুরু করেছে”।


“এতো যত্ন করে – বাবিন নয় জেনেই!” রুদ্রদেব নিশ্চিত হতে চাইলেন। 


“হ্যাঁ, সবার খুশির কথা ভেবে, তবে একটা ভালো ব্যাপার যে – হারাতে চায় না। আগলাতে চায়”।


“ওষুধ কতদিনে পুরো বন্ধ করা যাবে?” “মাস তিনেক”। “বেশ”, রুদ্রদেব বললেন।


“মিষ্টার মুখার্জী – ঐ এভিলের ব্যাপারটায় কিন্তু খুব চিন্তিত রয়েছেন ম্যাডাম”।


“আমরা সবাই – ই, ডক্টর”। “অনিকেত?” “ভয় পেয়েছিলো খুব”। “ওকে একা শোওয়াবেননা আর। কল্পনা হলেও ……”


“না, শোওয়াবো না। নীরা এ ব্যাপারে খুব কনশ্যার্নড”।


“নীরা আপনাকে সহ্য করছে, আইমিন ………”। রুদ্রদেব বুঝলেন। 


“অনি, তুই কথা বল, আমি দেখি তোর কাকিমণি কি করছে”।


রুদ্রদেব গেলে অনিরুদ্ধ বললো, “কোয়াইট নর্মাল এখন”।


“সেক্সুয়ালি?” অনিরুদ্ধ মাথা নাড়লো। “আমিই এগোইনি।” “সে কি! প্ল্যনডওয়েতে এগোন।ডেফিনিটলি উইথ কন্ট্রাসেপশন। প্রত্যাখ্যান করবে না”। অনিরুদ্ধ কিছু বললো না।


ফেরার পথে অনিরুদ্ধ, নীরা বাচ্চাদের নিয়ে একগাড়িতে উঠেছিলো। নীরার মা,বাবা বেরিয়ে গেছেন। কাকাবাবু আর কাকিমণিকে অন্য একটা গাড়িতে তুলেছে ওরা। স্পেস দেবার জন্য। অনিকেত গাড়িতে উঠেই ভাবছিলো মামণি কি বোনকে কোলে নিয়ে বসবে – অমনি ডাক শুনলো।


“এই বাঁদর, সামনে নয়, পিছনে অ্যায়”। অনিরুদ্ধ হাসলো।


“বাঁদর আর কোথায়? শান্ত ছেলে তো তোমার নীরা”।


“তুমি জানো না অনি, বাড়িতে থাকো কতটুকু? বাঁদরটাকে চেনো?উপরে ভালোমানুষি,ভিতরে দুষ্টুমি ভর্তি।”


অনিকেত মনে মনে খুশি হলো। মামণির কাছে ও বসবে তবে। বাপি বোনকে কোলে নিয়ে বসলো। অনিকেত বাপি আর মায়ের মাঝে। 


“নীরা, একটু দুষ্টু হওয়া তো ভালো”। নীরা হাসলো, “আগে উল্টোটা বলতে”। 


অনিরুদ্ধ থমকালো, অনিকেতকে ঝুঁকে চুমু খেলো। 


“মামণির কোলে চড়ে বস, জানলা পাবি না নাহলে”। “মামণি ডাকেনি যে বাপি”।


“নীরা – ডাকোনি বাবিনকে? ভারী অন্যায়” । নীরা কোলে নিলো। “কট কট করে কথা খুব, না?”


অনিকেত ঘাড় নাড়লো। “না তো, মামণি”। নীরা চুমু খেলো ওকে।


“অনি, চলো না – একটু বাইরে কোথাও বসি”। অনিরুদ্ধ অবাক হলো, “যাবে তুমি?”


“হ্যাঁ, বাচ্চারা প্রথম এসেছে তো আমাদের সাথে বাইরে, চলো না”। “কিন্তু বাড়ি?” “কাকিমণিরা যাচ্ছে তো”।


অনিরুদ্ধ নীরা কে বাঁ হাতে জড়িয়ে ধরলো। ঝুঁকে চুমু খেতে যাচ্ছিলো নীরার কটমট করে তাকানো দেখে সামলে নিলো। ছেলেটাকে চুমু খেলো তার বদলে”।


“জেঠুমণি –আমরা ডাইন আউটে যাবো?”। “হ্যাঁ পরী, ডাইন আউট করা হবে আজ”।


“কী মজা!” পরী লাফিয়ে ওঠে। অনিকেত চুপ করে থাকে, ও এসবের কিছু বোঝে না। ডাইন আউট মানে কি …। "আমরা বাইরে খেতে যাচ্ছি ডিনার”। নীরা বুঝতে পেরেই কানে কানে বলে।


“কোথায় মামণি?” “দেখি, বাপি আমাদের কোথায় নিয়ে যায়”।


অনিকেত চুপ করে থাকে, বড় হোটেলে যাবে ওরা? হোটেলেই তো খাবার পাওয়া যায়। নাকি কী বলে একটা – রেস্টুরেন্ট। 


“নীরা তোমার মেডিসিনের ডোজ অনেক কমেছে, জানো?”


“জানতাম, ওসব এখন থাক অনি, বাচ্চা দুটোকে একটু ঘুরিয়ে নিই”।


অনিরুদ্ধ বুঝলো নীরার মাতৃত্বভাব ফিরে এসেছে, আবারো, ও এটাই সবচেয়ে বেশি করে চেয়েছিলো।


পর্ব – ৩২


“এই অঙ্কটা ভুল হলো কী করে?” নীরা ম্যাথ টেষ্টের খাতা দেখছিলো। 


“ব্র্যাকেটের কাজটা আগে, হবে, জানিস না?”


অনিকেত স্কুল থেকে ফিরেছে সবে। মামণি জানতো আজ ম্যাথ টেস্টের রেজাল্ট দেবে। চেঞ্জ করাবার আগেই তাই খাতাটা নিয়ে বসেছে। বোন ঘুমোচ্ছে, ঠাম্মাও নেই। ও বাড়ি গেছে।বাপির ঘরে ওদের পড়ার টেবিল চেয়ার রাখা। ওখানে বসেই খাতা চেক করছে মামণি। অনিকেত ভয়ে কাঁপছিল।


“কী রে, বল?” “করেছি তো মামণি” “তাহলে?”


“টুকতে ভুল হয়েছে, মামণি। গুণ টুকেছি, ভাগ ছিলো”।


নীরা দেখে এবার। তাই তো! মাল্টিপ্লিকেশন টুকেছে, ডিভাইডেড বাই – এর জায়গায়। 


“মন কোথায় থাকে?” অনিকেত চুপ করে থাকে। 


“ক্লাস টেস্টে দুটো নম্বর, গেলো তো?” অনিকেত কিছু বলে না।


“আমি কোয়েশ্চেন টুকে মিসকেও দেখিয়ে ছিলাম মামণি – মিস কিছু বললো না …”।


একটু পরে কথা বলে অনিকেত। নীরার গা জ্বলে ওঠে। ঐ অসভ্য মেয়েটা কী-ই বা বলবে, সে আসুক আজ। ধরবে। নীরা অনিকেতের কান ধরলো। ভালো করে কানমলা দিলো।


“নিজে নেলাবি এবার তেকে”। “হ্যাঁ, মামণি”। অনিকেত বললো।


নীরা একবার ভাবলো ছেড়ে দেবে, পরক্ষনেই ভাবলো অমনোযোগের জন্য শাস্তিটা দেওয়া উচিৎ।


“এত কেয়ার লেস হয়েছিস যখন পানিশমেন্ট পাবি। কান ধর”।


অনিকেতের চোখ থেকে টপটপ করে জল পড়ছিলো, তাও কান ধরালো।


“উঠবোস কর”। অনিকেত করুণ চোখে তাকালো।


“নিজে দেখে টুকিসনি যেমন, মেলাসনি যেমন – উঠবোস কর – এর পর থেকে মেলাতে মনে থাকবে”।


অনিকেত উঠবোস করতে শুরু করলো। খাতা পেয়েই ও জানতো বাড়ি এসে মামনির কাছে উঠবোস খাবে। ওর নিজেরই খারাপ লাগছিলো, দুটো নম্বর, ইস! বোনের সামনে খাচ্ছে না – এটাই ভালো। 


“বৌমা –“, মণিদিদার গলা শুনে তাকালো অনিকেত। “হ্যাঁ মণিপিসি-“ 


অনিকেত থেমে গিয়েছিলো।


“তুই থামলি কেন বাঁদর ছেলে? তোকে থামতে বলেছি?” “বাবিন – খাবে না?”


“খাবে, চেঞ্জ করিয়েই খাইয়ে দেবো”।


“ছোট বৌদি আসতে দেরি হবে?” 


“হ্যাঁ মনে হয়। চিন্তা করবেন না। আমি খাইয়ে দেবো”।


“আচ্ছা, বলছি – অনেক বকেছো। ছেড়ে দাও। তুমি তো বকোই না ওকে। দেখো, মুখটা শুকিয়ে গেছে বাচ্চার” । 


“দেবো, এখন বড় হয়েছে তো পিসি, বকতে হচ্ছে, না হলে বাঁদর হয়ে যাবে। আপনি বিশ্রাম করুন”।


মণিদিদা গেলে মামণি আবার অনিকেতকে ধরলো। “থেমে এখনো?”


অনিকেতের চোখ দিয়ে জল পড়ছিলো, মণিদিদাও দেখে ফেললো। লজ্জা লাগছিলো ওর। নীরা সেটা বুঝে ওকে কাছে ডাকলো।


“ঠিক করে টুকবি তো এবার থেকে, মিলিয়ে?”


“হ্যাঁ, মামণি”।


নীরা কানটা আবার মুলে দিলো ভালো করে। চোখ মোছালো তারপর।


“আর করব না”। অনিকেত ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদছিল, নীরার মায়া করলো। কোলে তুলে বসালো।


“বেশ, করলে এবার মার লাগাবে মামণি।”


অনিকেত মামণির বকুনি খেয়ে মামণিকেই আঁকড়ে ধরলো। “আর হবে না”।


নীরা গায়ে মাথায় হাত বুলিয়ে চুমু খেলো। “চেঞ্জ করে, খাবি চ”।


“দুটো নাম্বার বাদ যাওয়ার মানে জানা আছে?” শাওলিকে কড়া ভাবে বললো নীরা। 


“আমি খেয়াল করিনি, বৌদি”।


“খেয়াল করোনি, বাহ। কী জন্য গুচ্ছের টাকা দিয়ে রাখা হয়েছে তোমায় যদি এমন রেজাল্ট হয়?”


শাঁওলি অনিকেত পরীকে পড়িয়ে বেড়িয়ে যাচ্ছিলো, বেরোবার মুখে বৌদির প্রশ্নের মুখে পড়তে হয়েছে। কান গরম হয়ে যাচ্ছে ওর। খুব খারাপ লাগছে। ফাদার না বললে আর অনিদা না থাকলে ও আসে এখানে? অনিদার বৌ – এই মহিলা অত্যন্ত অহংকারী, পয়সার ভীষণ গরম।


“তোমার এই না দেখতে পাওয়ার জন্য যদি র্যা ঙ্ক পিছিয়ে যায় – তোমাকে দেখে নেবো আমি”।


নীরা ইচ্ছা করেই বললো, মেয়েটা অপমানিত হয়ে যদি কাল থেকে না আসে, তাহলে বাঁচবে। 


“সরি, বৌদি ……”।


“আর এত লোয়ার ক্লাসের মতো বৌদি বলো কেন? ম্যাডাম বলবে, অনিদা – বৌদি … এসব কী? প্রফেশনালিজম – এর পি – ও নেই”।


শাঁওলির চোখ ফেটে জল আসছিল। এতটা অপমানিত ও জীবনেও হয়নি। 


“আসছি ……”।


“অনিরুদ্ধই ভুল আসলে, বন্ধুর বোনকে দেখতে গিয়ে ক্লাসটা বজায় রাখতে পারেনি”।


শাঁওলি ছুটে বেড়িয়ে চলে গেলো। আর কিছু শুনবে না ও। শোনার ইচ্ছা নেই, একেবারেই নেই।


অনিরুদ্ধর ফিরতে রাত হয়েছিলো আজ। প্রায় সাড়ে ন’টায় ফিরেছে। সারাদিন মিটিং ছিলো, ক্লান্ত ছিলো খুব তার মধ্যে শাঁওলির টেক্সট, সেই সুত্রে ফাদার অগাষ্টিনের ফোন – মেজাজটাও ঠিক ছিলো না, নীরা আজ যা নয় তাই বলেছে নাকি শাঁওলিকে। অভিমানী মেয়েটা কেঁদেকেটে একশা। বাবিন একটা অঙ্ক ভুল টুকেছে বলে ওকে বকার কী আছে কে জানে। ফাদার শাঁওলির কমপ্লেন পেয়ে নীরার মানসিক সুস্থতার প্রশ্ন তুলে ফোন করেছিলেন একটু আগে। এমন হলে তো অনিকেতকে রাখাটাই সম্ভব হবে না। এখনো পেপার ওয়ার্কস হয়নি – সবে মাস খানেক হলো ছেলেটা এসেছে – চেঞ্জ করে দোতলায় ডাইনিং – এ গিয়ে অবাক হলো। কাকাবাবু চলে এসেছেন। চেম্বার তাড়াতাড়িই শেষ হয়ে গেছে, নাকি?


“অনি – চলে এলাম, তাড়াতাড়ি”।


অনিরুদ্ধ হাসলো, “ভালো করেছো। চেম্বার?” কাকাবাবু হাসলেন। 


“একটু ফাঁকি দিলাম আর কি। তোর কাকিমণি তো বলেই চলেছে – ছেলেটা ফেরেনি – তুমি যাও – নীরা একা ……”। “ফোনে?” “নাহ, হোয়াটস্যাপ”।


অনিরুদ্ধ মুচকি হাসলো। “বাহ”।


“নীরা আমি এসেছি দেখেই রান্নাঘরে ব্যস্ত। বললাম কত করে …”।


“ঠিকই তো করেছে। বাচ্চারা কোথায়?” 


“তারা মা’কে ছাড়ে? সারাক্ষণ মায়ের আগুপিছু ঘুরছে। ঐতো এসে গেছে সব-“


নীরা এলো, সাথে বাবিন আর পরীও। 


“ডিনার রেডি, অনি খাবেতো?”


অনিরুদ্ধ নীরাকে এখন কিছুই বলবে না, আলাদা ভাবে বলবে। “দাও”।


“পরীকে খাওয়াতে পারবে তো?”


“দুটোকেই খাইয়ে দেবো”।


বলেই বাবিনের দিকে তাকালো অনিরুদ্ধ। বুঝলো তার মামণির হাতে খাবার ইচ্ছা। নীরা সেটা বুঝে বললো, “না – বড়টাকে আমি খাওয়াচ্ছি”।


“নীরা – একা সার্ভ করবে – খাওয়াবে - - আমি হেল্প করি?”


“এমা! কাকাবাবু, একদম না, আমি পারবো, এখন তো অনেক সুস্থ, শুনলেন না?” 


অনিরুদ্ধ বললো, “কাকাবাবু, আমি হেল্প করছি নীরাকে”।


“থাক, সারাদিন খেঁটে খুটে এলে …”।


“তাতে কী? অনি যা হেল্প কর”। রুদ্রদেব বললেন।


খেতে খেতে রুদ্রদেব কথাটা তুললেন, “অনি, তোরা গ্রামে যাসনি কখনো, তোর বাবা কাকা ও না, তাই তো?”


“নাহ, ঠাকুমা চাইতেন খুব ঠাকুরদা নিয়ে যেতেন না”।


“হুম, নিজেও যেতেন?”


“মনে হয় না, আর গেলেও খুব কম। বাবা কাকাও তো শহরেই মানুষ”।


“অন্য শরিকরা আছে ওখানে?” “হ্যাঁ, ঠাকুরদার দাদার বংশ”। “যোগাযোগ?”


“নেই বললেই চলে। কেন বলো তো? অভিশাপের ইতিবৃত্ত খুজছো?”, রুদ্রদেব বললেন।


“খোঁজা তো উচিৎ, না হলে দোষী ধরা পড়বে কী করে। গ্রামের সাথে যোগাযোগ আছে এমন কেউ আছে?”


নীরা বললো, “মণিপিসি, নিধু কাকা-ই তো গ্রামের”।


“ও হ্যাঁ, তাই তো, ওদের থেকে জানতে হবে গ্রামের ব্যাপারে, ডিটেলে”।


“নিধুকাকার ছেলেরাও তো গ্রামেই থাকে। 


মণিপিসির ভাই বিপ্লবও”। “তাই? মণি ক’দিন আগেই গ্রামে গিয়েছিলো না?” 


নীরা বললো, “হ্যাঁ, পরশু এসেছেন”।


“এই তো, ওর থেকেই পুরোটা জানা যাবে, এখন গ্রামটা কেমন, কে কে থাকে – অনি, এই যে কোলাপসিবল বন্ধ হচ্ছে রাত দশটা বাজলেই – এটা নিয়ে চাকর বাকরদের কোন রিএকশন?” 


“অবাক বুঝছি, কিন্তু কেউ কিছু বলছে না”।


“পিছনের ঐ ঘরটা পরিষ্কার করিয়ে ছিলি?”


“হ্যাঁ, জমাদার করছে, ভয় পাচ্ছিলো সব আয়োজন দেখে, করতে রাজি হচ্ছিলো না। শেষে হাতে শ পাঁচেক গুঁজে –“


“যার সাধনা ক্ষেত্র ঘরটা সে চটে থাকবে এতে”।


“এভিল, দাদুভাই?” অনিকেতের কথায় থমকালো সবাই। নীরা জড়িয়ে ধরলো, 


“না, এভিল নয়, তুই খা, শুবি তারপর”।


“আজ ডাক্তার দাদুভাই – এর সাথে শোব, জেঠিমণি?”


“একদম!” রুদ্রদেব হাসলেন, “দাদুভাই আর পরী শোবে, অনিকে নেবো আমরা?” “জেঠুমণিও শোবে।“


“আর দাদাভাই?” “এই দাদাভাই- শুবি?” অনিকেত মামণির দিকে তাকালো। 


“না, পরী, দাদাভাই আরটু পড়বে, তুই শুয়ে পড়”।


রুদ্রদেব বুঝলেন নীরা অনিকেতকে কোলছাড়া করবে না। 


“দাদাভাই এর খালি পড়া”। “তুই বড় হ- তোর ও হবে”। অনিরুদ্ধ বললো।


“হলেও। জেঠিমণি তো আমাকে বকেই না। উঠবোস তো আর খাবো না।“ বলেই দুষ্টু হাসলো পরী।


অনিকেত লজ্জা পেল। নীরা পরীকে বললো, “জলদি খেয়ে নে। না হলে এখনি বকবো”।


অনিকেত মামণিকে জড়িয়ে ধরলো দুহাতে। রুদ্রদেব আর অনির চোখ চাওয়া চাওয়ি হলো, অনিকেত আর ওর মামণির ভালোবাসার বাঁধন জোরালো হচ্ছে, তবে। 


“বাবিন ঘুমোলো?” অনিরুদ্ধ এসেছিলো নীরাদের ঘরে। কাকাবাবু আর পরী ঘুমিয়ে গেছে। “সহজে ঘুমোয়? গল্প বলে বলে”।


“বকেছো, আজ?” “কই, না তো?” “বিকালে?”


“ওহ, সে স্কুল থেকে ফিরতেই। অঙ্ক পরীক্ষায় কম পেয়েছে। দু নম্বর। প্রশ্ন থেকে টুকতে ভুল”।


“আগে তো কতই করতো”, অনিরুদ্ধ বলে। 


“সে আগে, এখন করুক চাই না, র্যা ঙ্কটা যাবে”।


অনিরুদ্ধ সোফায় বসলো, “ফাদার ফোন করেছিলেন”।


“ফাদার?” “যেখানে বাবিনকে রেখে ছিলাম”। “ওহ, যেখান থেকে নজরদারি করতে ঐ মেয়েটাকে পাঠায়”। 


অনিরুদ্ধ বুঝলো শাঁওলিকে নীরা ভীষণ অপছন্দ করে। “ও প্রতীকের বোন”। “হোক। দু’মাসের পর আসবে না”।


“হয়তো কাল থেকেই আসাবে না – তুমি যেমন ভাবে বলেছো”।


“সেটা বলেও দিয়েছে তোমাকে? বাহ”।


“ও কেন বলবে? ফাদার বলেছেন। দেখো নীরা- বাবিনকে ওরা নিয়ে যাক এটা আমি চাই না যেহেতু কাগজ হয়নি কোনো।“


“বেশ, তার জন্য কী করতে হবে? ক্ষমা চাইতে হবে মেয়েটার কাছে?”


“নীরা – এভাবে বলছো কেন? শান্ত হয়ে শোনো”।


“কী শুনবো অনি, কি শোনার আছে?” 


“উত্তেজিত হত না, ষ্ট্রেস ভালো নয় তোমার জন্য”।


“হচ্ছি না অনি, শুধু জবাব চাইছি, তোমার তো কত বন্ধু। তাদেরও বোন আছে। তাদের মধ্যে এর সাথে এত ঘনিষ্টতা কেন?”


নীরার কথায় আহত হলো অনিরুদ্ধ। “কী বলতে চাইছো?”“তুমি বুঝতে পারছো না?” 


“না, খোলাখুলি বলো”। “মুখার্জী বাড়ির ছেলেদের বাড়ির বাইরে মন বেশি থাকে। 


এটা আমার মা’কে বিয়ের আগে সবাই বলেছিলো। বিয়ে হয়ে এসে থেকে অনুপমকে দেখছি। শুনেছি কাকাও নাকি এমনই ছিলেন। তুমি তো তেমন ছিলেনা। নাকি দেড় বছর আমাকে না পেয়ে –“ অনিরুদ্ধর বুকে তীরের মতো বিধলো কথাগুলো, 


“নীরা – সবাই ঠিকই বলে। ইউ আর সিক। নিজের স্বামীকে চেনোনি এত বছরেও। যে অভিযোগ করলে তার কোনো সারবত্তা নেই। তবে কোন সাফাই আমি দেবো না, ঘুমাও”।


অনিরুদ্ধ উঠে দাঁড়ালো, নীরা ওর হাত টেনে ধরলো। “কী হলো?”


নীরা উঠে দাঁড়ালো, অনিরুদ্ধর মাথাটাকে টেনে নামিয়ে আনলো নিজের দিকে। অনিরুদ্ধর ঠোঁটে ঠোঁট রাখলো। 


“নীরা ……”। “কোন কিন্তু নয় –“ গভীরভাবে অনিরুদ্ধকে চুমু খেলো নীরা, অনিরুদ্ধ বুঝলো এটা বিশ্বস্ততার পরীক্ষা। “কী হলো – এসো – দেড় বছর – অনেক বড় সময় অনি। আমি জানি এর মধ্যে বহু কষ্ট পেয়েছো তুমি, বলতে পারোনি”। নীরা অনিরুদ্ধকে চুমু খেতে খেতে বলতে থাকে কথা গুলো। অনিরুদ্ধ জানে নীরাকে থামাতে হবে। কিন্তু উপায় খুঁজে পাচ্ছে না। নীরার মাথায় হাত রাখলো। 


“পেরেছি, তবে তার জন্য অন্য কারোর দিকে যাবো, এমন ভাবলে কী করে?” 


“ওসব ছাড়ো, তোমার পাওনা – নেবে না?” “পাওনা?”


“ও এলে নেবে বলেছিলে?” অনিরুদ্ধ বুঝলো বাবিন ফিরে আসার কথা বলছে নীরা।


“নেবো, তুমি আর একটু সুস্থ হও। ওষুধটা বন্ধ হোক। এখন পারবে না।" নীরা অভিমানী চোখে তাকালো, “খুব পারবো, তুমি এড়াচ্ছো অনি, এসব করে আমাকে কষ্ট দিচ্ছো খুব”।


অনিরুদ্ধ নীরার সারা মুখে চুমু খেলো, “এড়াচ্ছি না”।


“তাহলে?” নীরা আবারো অনিরুদ্ধকে আদর করতে শুরু করলো, ঘাড়ে, গলায়, বুকে …… অনিরুদ্ধ বুঝলো এবার ওর শরীরও জাগছে । বহুদিনের না পাওয়া পেতে ইচ্ছা করছে। কিন্তু এই ওষুধগুলো চলাকালীন – কোনো প্রোটেকশন নেওয়া নেই – নীরা কনসিভ করে গেলে …… নানা কথা মাথায় ভিড় করছে।নীরার কোমর জোরে জড়িয়ে ধরলো অনিরুদ্ধ, আগে সন্দেহটা মেটাতে হবে। শাঁওলিকে নিয়ে নীরা ইনসিকিওরড বলেই এমন বিহেভ করে শাঁওলির সাথে। নীরা অনিরুদ্ধর এগিয়ে আসায় ভীষণ খুশি হচ্ছিলো মনে মনে। তার মানে ও যা ভেবেছে ভুল। অনি ওরই। নীরার প্রতি , নীরার অসুস্থতার প্রতি কোন বিতৃষনা নেই ওর।


“মামণি!” অনিকেতের ডাকে চমকে উঠলো অনিরুদ্ধ।ছেলে জেগে গেছে? নীরার দিকে তাকালো, ওর রিয়াকশনটা দেখা জরুরী। আগে এমন হলে অনিরুদ্ধ বিরক্ত হলেও নীরা ছেলের কাছে তৎক্ষণাৎ চলে যেতো, কিন্তু এখন কি করবে? নীরা অনিরুদ্ধর বাহুবন্ধন এক ঝটকায় সরালো। খাটের দিকে গেলো। বসলো। 


“এই তো আমি”। “কই?” অনিরুদ্ধ চুপ করে দাঁড়িয়ে দেখছিলো নীরা কী করে। 


“এই যে, ঘুম ভেঙে গেলো?” অনিকেত উঠে বসলো।


“বাপি?” অনিরুদ্ধ মনে মনে ভাবলো বাবিন জেগে উঠে ভালোই হয়েছে। 


“হ্যাঁ, বাবিন। আমি।” “এখানে শোবে?” অনিরুদ্ধ বললো, “হ্যাঁ, আজ শোব”।


নীরা ছেলেকে কোলে নিলো। “ভয় পাচ্ছিস?” “না তো”। “তবে?” 


“তোমাকে খাটে পেলাম না যে”। নীরা হেসে বললো, “বাপির সাথে কথা বলছিলাম। চল, হিসি করে শুয়ে পড়বি”।


অনিরুদ্ধ হাত বাড়ালো, “দাও, আমাকে দাও, হিসি করিয়ে আনি”। অনিরুদ্ধ কোলে নিলো অনিকেতকে। বাথরুম থেকে ঘুরিয়ে এনে খাটে শোয়ালো।


“আজ বাবিন,বাপি-মামণির মাঝে, একা। তাই না নীরা?” 


নীরা নিজেকে সামলে নিয়েছিলো, অনির ব্যাপারে কিছু জানার বাকি নেই ওর। শুয়ে পড়লো।


“তাই তো, অন্যদিন তো বোন থাকে”।


“বোনকেও আনো”।


অনিরুদ্ধ হাসলো, “না, আজ কেবল বাবিন, মামণি আর বাপি”।


নীরা ছেলেকে বললো, “আয়”, অনিকেত নীরার কোলের মধ্যে গিয়ে জড়িয়ে ধরে ঘুমিয়ে পড়লো নিমেষে। অনিরুদ্ধ ঘুমন্ত অনিকেতকে আদর করলো।


“এভাবে ঘুমায়? জড়িয়ে ধরে?”


“হ্যাঁ, রাতে মামণির কোল না হলে চলে না।অনি-“, বলো”। “তোমার খারাপ লাগলো?”


অনিরুদ্ধ অবাক হলো, “কেন?” “জেগে গেলো যে-“ “না তো”।


“আগে তো বিরক্ত হতে”, “সে আগে, এখন আমারও বাবা হিসাবে বয়স, ম্যাচিওরিটি দুটোই বাড়ছে, না?”


“সরি”। “কেন, সোনা?” “ওভাবে বললাম”।


“ঠিক আছে, আমি কিছু মনে করিনি। আমি কেমন – তুমি তো জানো, বোঝো। শাওলিকে নিয়ে বৃথা সন্দেহ করো না, ওর আসাটা একটা কমপালসন, এর বেশি নয়। প্লিজ আর একটা মাস কাটিয়ে দাও – প্লিজ। বাবিনকে হারাতে চাই না আমি আর”। নীরার হাত ধরে বললো অনিরুদ্ধ। নীরা বুঝলো, 


“খুব ভালোবাসো?” “বাসবো না?” অনিরুদ্ধ চোখ মুছলো,“তুমি বাসো না?”


“না বাসলে এভাবে আগলাই?” অনিরুদ্ধ ছেলেকে জড়িয়ে ধরলো। 


“ওর তোমাকে পেলে আর কাউকে চাই না”।


“শাসন করি বলে রাগ করো না তো?” 


“না, না, রাগের কী আছে?”


“আগের বার করিনি বলেই তো পালিয়ে গেলো ও, অনি, এবার তাই-“ অনিরুদ্ধ নীরার কপালে চুমু খেলো।


“বেশ, তবে খুব ভালো ছেলে ও। বেশি বকতে হবে না, দেখো”।


“অনিকেত, নামটা ভারী পছন্দের আমার। তোমার সাথে মেলেও”। অনিরুদ্ধ চুপ করে শোনে।


“কোন প্রাণে যে এমন ফুটফুটে ছেলে ফেলে যায় লোকে, অনি”। “আমারা নিয়ে নিলাম যে?”


“ঠিক, কেউ না ফেলে গেলে আমরা পেতাম কী করে”। নীরা চুমু খায়।আবারো অপলকে তাকিয়ে থাকে।


“কী এত দেখছো?”


“এত মিল অনি – এত – কী করে!! আমি তো সারাদিন সেটাই দেখি”। অনিরুদ্ধ নীরার কপালে,মাথায় হাত বোলায়।


“সবই তার ইচ্ছা, আমিতো ভাবিইনি – এমনটাও হতে পারে”।


“মিরাক্যল!ও এসেই কেমন বদলে দিয়েছে সব বলো? বাড়িতে সবসময় হৈ চৈ – লোকজন – আনন্দ – এ বাড়ি ওবাড়ির মিল – যাতায়াত”।


“ভালো লাগছে তোমার?”


“খুব, বাঁচতে ইচ্ছা করছে আবার, মাঝের দেড় বছর করতো না”।


“সবচেয়ে কখন ভালো লাগে?”


“যখন কানমলা খেয়ে, উঠবোস খেয়ে, বকুনি খেয়েও একবার ডাকলেই কোলে উঠে যে মা ওকে এতক্ষণ শাস্তি দিলো তাকে জড়িয়েই কাঁদে - মামণি বলে যখন আধো, আধো গলায় ডাকে – তখন”।


অনিরুদ্ধ বললো, “কী সুন্দর করে বললে সোনা। নীরা – এবার তো সেরে উঠছো, কোর্টে যাওয়া শুরু করো”।


“যাবো, ফাঁড়াটা কাটুক”।


“ধরা পড়বে সে, মনে হয়?”


“পড়তে হবেই, অনি, না হলে বিপদ”।


“চেষ্টা তো করছি সবাই”।


“ঠিক সে কোন একটা ভুল করবে, একদিন”।


“লেটস হোপ ফর দ্যাট, নীরা, পরীটা মা বলুক চাও, তাই না?”


“চাই, তবে জোর করে না, নিজে থেকে”।


“আমিও চাই, বাপি বলুক, তবে দাদা বোনে খুব মিল”।


“খুব, তবে বড়টা একটু মায়েরর কোল বেশি চায়”।


“চাইবেই নীরা। ওরই মা”।


নীরা কিছু বললো না। অনিকেতের মামণি হতে পেয়ে খুশি ও। খুবই খুশি।


ভালো করে মানুষ করতে চায় ওকে। এবার, ফাঁক রাখতে চায় না কিছু তেই। ভালো মা ওকে হতেই হবে কাকিমণির মতো, নিজের মায়ের মতো।


পর্ব – ৩৩


“ছোট কাকামণি ---“ অনিকেত স্কুল ছুটি হতেই বেরিয়ে এসেছিলো ফাদারকে বলে, বাপিকে বলিয়ে। তাড়াতাড়ি বাড়ি যাবে। বেরিয়েই দেখে, ছোট কাকামণি দাঁড়িয়ে আছে। অনুপম অনিকেতের সামনে উবু হয়ে বসলো, “ক্লাস শেষ, বাবু?”


“হ্যাঁ, তো।এক পিরিয়ড আগে, বাড়ি যাবো, ড্রাইভার কাকু আছে। ঐ তো।"অনুপম অনিকেতের চুলগুলো ঘেঁটে দিলো। কোলে নিলো তারপর। 


“তুমি এখানে?” “বাবিনকে দেখতে মন করলো। বাড়িতে গিয়েও দেখতে পারলাম ভাবলাম একবার স্কুলে গিয়েই দেখি”।


অনুপম চুমু খেলো অনিকেতের দু’গালে। ওর ঘ্রাণ নিলো ।


“বাড়ি যাবো আমরা, তাই তো, বাবিন?” “হ্যাঁ”,


গাড়িতে উঠে বললো অনুপম। “বাড়ি গিয়ে কিন্তু খেলা হবে আজ”।


“গিয়ে আগে চেঞ্জ, তারপর খাওয়া ---“ “তারপর খেলা”।


অনুপম হাসলো।“তোমার অফিস?” “নেই”।


“ছুটি?” “একদম, আমার তো রোজ ছুটি”। “এমা! ছুটি রোজ? ভালো না”।


“তাহলে কোনটা ভালো?”


“বাপির মতো অফিস, রোজ।উইকে একদিন ছুটি”। অনুপম হাসে।


“বেশ, আমিও তাই করবো। বাবিন চায় যখন”।


“কাকামণি- তোমার দুই ছেলে?” অনুপম থমকায়, আসতে আসতে বলে, “তোর দুটো ভাই আছে”।


“বোন?” “ঐ যে – পরী?”


“একটাই বোন সবার”।


“ঠিক, হ্যাঁ রে – এখানে অরফ্যানেজটায় থাকতিস?”


“হ্যাঁ, বাপি রেখে গিয়েছিলো যে”। অনুপম কোলের কাছে টেনে নিলো।


“ঠিক, কেউ দেখা করতে আসতো,কখনো?”


“না তো, বাপিই প্রথম এলো”। “ওহ”।


“ভাই দুটো কোথায়, কাকামণি?” অনুপম অনিকেতকে কোলে বসায়।


“ছোট ভাইটা সবে হয়েছে, দুই মাস। ওদের মামা বাড়িতে আছে ওরা”।


“কাকিমণি ও আছে?” “হ্যাঁ,তোর কাকিমণি ওখানেই আছে। যাবি তোর ভাইদের দেখতে,কাকিমণিকে বলবো?”


“না, না কাকামণি, এখন বাড়ি যেতে হবে। মামণির পড়া করতে হবে – একটু বাকি আছে”।


“বৌদিমমণি বকে তোকে?”অনুপম অবাক হয়। বাবিনকে তো বকতেই না। প্রশ্রয় ছিলো খুব, “মামণি খুব স্ট্রিক্ট”।


“আর বাপি?” “বাপি একদম বকে না। বন্ধুর মতো, বিহেভ করে।তুমি ভাইদের বকো?”


অনুপম চুপ করে থাকে কিছুক্ষণ। ছোটটা সদ্য হয়েছে। বড়টা বছর সাড়ে তিন। অনুপম তাকে কখনো আদর করেছে – মনে পড়ে না। পরীকে, পরীর দাদা বুবলাইকে আদর করেছে অনেক, অথচ নিজের ছেলেকে বকাঝকা, শাসনই করেছে সবসময়। ছেলেটা ভয় পায় ওকে। তটস্থ হয়ে থাকে,বাবা ফিরলে। তার উপর অনুপমের মদ খাওয়া, বোহেমিয়ান জীবনযাত্রা তা নিয়ে ওর মার সাথে ঘরের মধ্যেই ঝগড়া,অশান্তি।


এসবের জেরও ওর উপর দিয়ে গেছে অনেক। আর নয়। দাদাভাই ঠিকই বলেছে। এবার জীবনটাকে গোছাতে হবে। ব্যবসা দেখতে হবে, ছেলেদের মানুষ করতে হবে।


“ছোটজন তো ছোট্ট, বাবিন। কী আর বকবো, তবে বড়জন, মানে অবিন ভালোই বকুনি খায়”।


“বাপি বলে বকাঝকা ভালো না”। অনিকেতের কথায় অনুপম মুচকি হাসে।


“বাপি ঠিকই বলে। দেখ, বলতে বলতেই তোর বাপির ফোন এসেছে”।


অনিরুদ্ধ ফোন করেছিলো অনুপম বাবিনকে ঠিক মতো কালেক্ট করলো কিনা, জানতে।


“দাদাভাই, বাবিন গাড়িতে। ফিরছে বাড়ি”।


“বাহ, তুই ওদিকে হঠাৎ গিয়েছিলি?”


“না, একটা বন্ধুর বাড়ি। ফেরার পথেহ মনে হলো বাবিনের স্কুল এদিকেই। আমাদের গাড়ি দাঁড়ানো দেখলাম – মানে তোমার গাড়ি … ফোন করলাম তোমায়”। অনিরুদ্ধ খুশি হলো।


“আমাদেরই গাড়ি ওটা। বাড়ি, ব্যবসা আলাদা হোক আমি চাইনি কখনো”।


“আমিও না। বাবা, জেঠুমণি, জেঠিমণি,আমার মামা বাড়ি – আর তোমার বড়ভাই, অতীনবাবু”।


“ছোটন,অতীন তোর দাদা হয়, অমন বলে না”।


“তোমার রামচন্দ্র অবতারটা এখনো ভালোই আপ আন্ড রানিং”।অনিরুদ্ধ হেসে ফেললো, অনুপমের মানুষ না হওয়াটা কাকিমণির কষ্টের একটা বড় কারণ। এটাই দূর করতে চায় অনিরুদ্ধ, তাই বললো, 


“তুই আমার একটা দোকান দেখ তাহলে। দেখবি? কাজে মন দে একটু”।


“দেবো, বাবিনও বকলো আমায় এটা নিয়ে। বললো রোজ ছুটি ভালো না”।


হাসতে হাসতে বললো অনুপম।“কোন দোকানটা দেখবি,ছোটন?”


“যেটা বলবে”। “বেশ, একটা কথা বলি ভাই?”


“বুঝেছি, ওসব ছাইপাঁশ আর খাচ্ছি না”।


“না, সেটা না, কাকিমণিকে ওভাবে কথা বলবি না আর”।


অনুপম চুপ করে থাকলো কিছুক্ষণ। তারপর বললো, “মা ভালোবাসেনি যে কোনদিন”।


“ধুর বোকা, কে বললো তোকে? খুব ভালোবাসে। মা তো, ভালোবাসবে না?”


“বুঝিনি কখনো।না, মা, না ঠাকুমা। বাবাও বড়ছেলেকেই বেশি,আর তোমাকে। তবে জেঠিমণি আমাকে ভালোবাসতো খুব, মনে আছে?”


“হ্যাঁ, আমার মায়ের ছটফটে দুরন্ত বাচ্চা পছন্দের ছিলো”।


“তোমার আর আমার মা যেন পাল্টাপাল্টি হয়ে গিয়েছিলো, না – দাদাভাই?”


অনিরুদ্ধ চুপ করে থাকে। বড্ড সত্যি কথা এটা। অনুপম পরিবেশ হালকা করার জন্য বললো।


“তোমার কাকিমণিকে হার্ট করে কিছু বলবো না আর”।


অনিরুদ্ধ বললো, “বাবিনকে নিয়ে বাড়ি যা, আমার কাকিমণি বসে আছে”।


“ছোট ঠাকুরপো – তোমার সাথে খেলবে বলে তো বাচ্চারা ঘুমচ্ছেই না’।


নীরার গলা পেয়ে তাকায় অনুপম। দাদাভাই – এর ষ্টাডিতে বসেছিলো ও। তাক থেক পেড়ে বই পড়ছিলো। দেওয়াল ঘড়ি দেখলো।


“চারটে তো বাজতেই যায় বৌদিমণি। তুমি ছেড়েই দাও এবার”।


নীরা বলে, “তাই ছাড়তে হবে দেখছি। কী বই পড়ছো?”


অনুপম দেখালো।“দ্যা কাইট রানার? বাহ”।


“এককালে খুব পড়ার শখ ছিলো, স্কুলের বই টই না। গল্পের বই, তারপর সেসব শখও গেলো”।


“ল নিয়ে পড়াটা শেষ করতে পারতে”।


অনুপম হাসলো, “কী হতো? সেই তো ব্যবসা। ওটাই ভবিতব্য। দাদাভাই বিলেত থেকে এম.বি.এ করেও সোনার দাম, খাদের হিসাব করছে”।


নীরা অনুপমের পাশের চেয়ারে বসলো। এই দেওরটি ওর থেকে বয়সে ছোট। বিয়ের পরে সংসার আলাদা হবার জন্য সেভাবে কথা হয়নি কখনোই। বাড়ির সবার থেকে অনুপম আলাদা, অনি বারবার বলে। দূর্গাপুজোতেও তাই কোণ ঘেঁষেই থাকতো।


“তোমার ব্যবসা অপছন্দ?” “কী আছে ওতে?” নীরা হাসলো, “অর্থ”।


“অনর্থের মূল”। “তবে কী চাও?” “কী যে চাই – জানি না। তবে, জানতে হবে এবার। ছেলেরা আছে। ওদের জন্য”।


নীরা হাসলো, “তা বেশ”। “বৌদিমণি, হাসলে তোমায় বেশ লাগে, হাসো না কেন বলতো?”


“এটা ফ্লার্টিং?” অনুপম মাথা নাড়লো, “জানি,আমার চরিত্র নিয়ে তোমাকে মুখার্জী বাড়ির স্তম্ভরা আপডেট দিয়ে রেখেছেন,তবে ফ্লার্টিং নয় এটা। প্রশংসা। তুমি সুন্দর, সত্যিই”।


“তাই? ভাগ্যিস তুমি বললে, তোমার দাদাভাই তো বলেই না” নীরা মজাটা চালিয়ে গেলো।


“বলতে বলবো?” “তুমি বলবে, তবে বলবে সে? এ কেমন কথা?” অনুপম হেসে ফেললো।


“তুমি সত্যিই উকিল হবার যোগ্য। বৌদিমণি, একটা প্রশ্ন করবো? বাবিন এসে তুমি খুব খুশি এখন, তাই না?”


নীরা অস্বীকার করলো না, “খুব”। “ফিরে পেয়েছো বলে?”


“না, যে গেছিলো আর যে এসেছে তারা অনেক আলাদা। তবুও – যে এসেছে সেও তো মা হারিয়েই এসেছে”।


নীরা অনুপমের চোখে জল দেখলো। “ছোট ঠাকুরপো, এমন খারাপটাই তো সবার লাগা উচিৎ, তাই না?”


অনুপম চোখ মুছলো, “বাবিনকে দেখে অদ্ভুত মায়া হয় বৌদিমণি। সবসময় মনে হয় আগের ছ’টা বছর – কত কষ্টে কাটিয়েছে। ওকে ভালবাসতে, আগলে রাখতে ইচ্ছা হয়, তাই”।


“বেশ তো, তুমি তো ওর কাকামণি। তুমি আগলে রাখবে তো বটেই”।


পরী ছুটতে ছুটতে এলো তখনি, পিছনে অনিকেত। 


“কাকামণি – চারটে বাজে”। অনুপম হেসে ফেললো।


“ঘুমোসনি নিশ্চয়, দাদাভাই কেও ঘুমোতে দিসনি দুষ্টু মেয়ে”। অনুপম কোলে নিলো পরীকে। 


“বোন দুষ্টু না কাকামণি। খেলবো বলে আমিই ঘুমাইনি”।


নীরা বলে, “দেখলে? বোনকে কিছু বলা যাবে না”। অনুপম খুশি হয়, “চল, খেলবি চল”।


“জেঠিমণি তুমিও চলো”।


“তোরা খেল। আমি উপরের বারান্দা থেকে দেখছি”।


“চলো না – বৌদিমণি, লনে বসে দেখবে”, অনুপম বলে। 


সুহাসিনী শুয়ে ছিলেন অনির ঘরে। বাচ্চাদের গলা পেয়ে উঠে এসেছেন। নীরা ঘুরে তাকালো, 


“দেখেছেন কাকিমণি – ছোট ঠাকুরপো আমাকেও বলছে লনে বসে খেলা দেখতে”।


অনুপম চুপ করে গেলো। মা বৌদিমণিকে না বকে দেয়। “বেশ তো, চলো, আমিও গিয়ে দেখছি”, সুহাসিনী হেসে বললেন।


অনুপম অবিশ্বাসের চোখে মায়ের দিকে তাকালো।


“নীরা – বাবিন, পরীর মতো তাদের ছোট কাকামণিটিও ছোটই আছে এখনো। আমি তো ত্রিশ -একত্রিশ বছরে পারলাম না। তুমি ওর বৌদিমণি, দেখো হাল ধরতে পারো কিনা”।


নীরা হেসে ফেলল, “ছোট ঠাকুরপো, কাকিমণি কী বলছেন? হাল ধরবো?”


“যে বললো তাকে বলো তার বর আর বড়ছেলেকে বোঝাতে যে আলাদা আলাদা খেলাটা বহুদিন হলো – এবার এক হতে”।


“দেখলে তো নীরা? বর, বড়ছেলে – এসব ………”।


নীরা থামালো, “ঠিক বলেছো ছোট ঠাকুরপো, আমি নিজেই বলবো কাকাকে। তোমার সাথে একসাথে, হবে?”


অনুপম খুশি হলো খুব, “কবে?”


“যত তাড়াতাড়ি পারি”। সুহাসিনী খুশি হলেন খুব। ওনার এক হবার ইচ্ছাটা যে এই প্রজন্মেও চারিত হয়েছে সেটা দেখে – ওনার থেকে খুশি আর কে হবে?


পর্ব – ৩৪


অচ্যুতের আবদারে সুহাসিনী অবাক হলেন। “কী বলছো!” “কি এমন বলছি!”


সুহাসিনীকে ফোন করেছিলেন অচ্যুত। বারাসাতের দোকান ভিজিট থেকে ফেরার পথে, গাড়িতে। 


“তুমি এখানে থাকবে, আজ রাতে?” “হ্যাঁ – তাতে কী!”


“তাতে কী মানে?” “আমার বৌ রাতের পর রাত থাকছে – আমি একরাত থাকবো না?”


“বুড়ো বয়সে ভীমরতি হলো?” “কেন?”


“ছেলে বৌমা ভর্তি সংসার। মুখ টিপে হাসবে ওরা। একদিন অন্তরই তো ও বাড়ি থাকছি”।


অচ্যুত হাসলেন, “ওহ, সেই ভয় তোমার! ভয় না, লজ্জা। কিন্তু এই অন্তরটা আমাকে কষ্ট দিচ্ছে যে!একা একা ঘুম আসছে না ফাঁকা ঘরে”।


“মরণ! সারাজীবন আলাদা খাটেই তো ঘুমোলে”।


“বাকি জীবনটা এক খাটে ছাড়া ঘুমোবোই না”।


“দেখো, কালই তো যাবো”।


“বড্ড নিষ্টুর তুমি। আজ থাকতে দাও না, বৌ। কষ্ট হবে না হলে। আমি কিছুটি করবো না। জ্বালাবো না, পরীটাকে মাঝে নিয়ে ঘুমোবো কেবল –“ সুহাসিনী বললেন, “বেশ। সন্দেহবশত করছো না তো?”


“কী সন্দেহ? রুদ্রকে নিয়ে?” “আর কি”।


“ও অন্য দিনগুলো থাকে, জানি। ঐ দিনগুলো বৌ আমার কাছেই থাকে”। দুষ্টু হেসে বললেন অচ্যুত।


“ছোটগিন্নী – রুদ্রটাকে ডেকো একদিন। বন্ধু ছিলো একসময়। ভুল বোঝে আমাকে, তখন তোমাকে না পেয়ে থাকতে পারিনি। ঠিক বেঠিক ভুলে গিয়েছিলাম। ব্যাটাকে বলে দেবো – এবারটা ছেড়ে দে, পরের বার,তোর”। 


সুহাসিনী চুপ করে থাকলেন।“সাত জন্মের জন্য বুক করে নিয়েছি, ভাবছো?”


“না, সেসব ভাববো কেন?”


“যদি করে নিই – এভাবেই না ভালোবেসে থেকে যাবে?”


“লাঞ্চ খেয়েছিলে?” “কথা ঘুরিয়ো না। এই ধরো যদি মরে যাই আমি। এখনি। এই জন্মেই … রুদ্রকে বিয়ে করে নিও। শোধ হয়ে যাবে পাপের ঋণ”।


“বাড়ি এসো”। সুহাসিনী বললেন, “আসছি”।অচ্যুত বুঝলেন আর কথা বাড়ানো ঠিক নয়।


“অনি, শরীরটা ভালো না, বুঝলি – বুকটা ব্যথা, ব্যথা”।


অনিরুদ্ধ কাকার দিকে তাকালো, “সে কি! ডাক্তার ডাকি? কাকাবাবুকে ফোন করি?”


“না, গ্যাসের ব্যথা হয়তো’।


অনিরুদ্ধ বললো, “না, না। এত কেয়ারলেসনেস ঠিক না। নীরা – ডাকো কাকাবাবুকে আর কাকা এই ব্যথা ট্যাথা নিয়ে একা একা শোবে – একদম না। কাকিমণি – কাকাকে থাকতে বলো এখানে”। অচ্যুত সুহাসিনীর দিকে তাকালেন। এখনো রেগে আছে। 


“না থাক, চলেই যাই। তোদের অসুবিধা,খামোখা”।


নীরা বললো, “না, না। এতে আবার কি অসুবিধা? আপনি থাকবেন, একদম যাবেন না। আমি কাকাবাবু কে ডাকছি”।


“রুদ্র ব্যস্ত মানুষ, আবার তাকে জ্বালাবে-“। 


সুহাসিনী বললেন, “না, আসুক, দেখুক কতটা অসুখ। শরীরের উপর অত্যাচার তো কম নয়। ঠিক মতো সময় খাওয়া নেই, দাওয়া নেই…”।


“ঠিক বলেছো কাকিমণি, নীরা – কাকাকে বলো একদম ওজর আপত্তি যেন না করে। তেমন হলে সব কাজ বন্ধ। এখানেই থাকবে, ক’দিন”।


অচ্যুত অনিরুদ্ধর উদ্বেগ দেখে খুশি হলেন। এতো দিনের দূরত্ব, টানাপোড়ন ওর মূল্যবোধকে বদলাতে পারেনি। 


“কাকিমণি, কাকাকে ঘরে নিয়ে যান। কাকা অনির জামা কাপড় ফিট করে যাবেন, চেঞ্জ করে বিশ্রাম নিন”। নীরা বললো।


অচ্যুত সুহাসিনীর দিকে তাকিয়ে দুষ্টু হাসলেন। সুহাসিনী বললেন, “চলো”।


“বি পি এত বেশি – জানতিস না?” রুদ্রদেব গম্ভীর গলায় বললেন। 


সুহাসিনী বললেন, “প্রেসারের ওষুধ খেয়েছিলে, আজ?”


অচ্যুত ভাবলেন, “এই যাঃ, ভুলেই গেছি”।


“একটা কিছু মনে রাখতে পারো না!”


সুহাসিনী গজগজ করলেন। “বুকে ব্যথাটা কদিন থেকে?”


অচ্যুত আড়চোখে সুহাসিনীর দিকে তাকালেন।


“মাসখানেক। একা একা রাতে শুলে বেড়ে যাচ্ছে, অভ্যাস নেই তো”। 


রুদ্রদেব অবাক হন, “কেন? ভয় পাস, নাকি?”


“না, ঐ এনক্সাইটি, বয়স হচ্ছে তো”।


“কাকাবাবু – এনিথিং সিরিয়াস? ই সি জি করতে হবে?”


“ক’দিন রেষ্টে থাকবে, ইসিজি আর সমস্ত ইনভেষ্টিগেশন কাল করিয়ে নেবো”।


“টেষ্টে ফেষ্টের কী দরকার আবার!” অচ্যুত বললেন।


“তুই ডাক্তার, না আমি?” অচ্যুত হাসলেন।


“আমি ডাক্তারের বন্ধু। হাফ ডাক্তার তো বটেই”। “অতীনদের জানিয়েছিস?”


“না, খামোখা চিন্তা করবে, কাল টেষ্ট করি – দেখি কী হয়”।


“সুহাসিনী – ক’দিন অফিস যাওয়াটা বন্ধ করে দাও”। “বেশ”।


“সারাদিন ঘরে! রুদ্র! এতো বড় সাজা দিয়ে দিলি!”


সুহাসিনী মুচকি হাসলেন, রুদ্রদেবকে আগেই টেক্সট করে অচ্যুতের ছেলেমানুষি জানিয়ে ছিলেন সুহাসিনী। তাই এই ব্যবস্থা।


“না বেরোলে হাঁফিয়ে যাবো যে”।


“সারবি তাড়াতাড়ি। আর এখানেই থাকবি। সুহাসিনীর টানাপোড়েন কমবে”।


“ঠিক বলেছো কাকাবাবু। কাকা – এখানেই থাকবে না সারা অবধি”। অচ্যুত বুঝলেন এসবের পেছনে কে রয়েছে। খুব মজা তার। একদিন থাকতে চেয়েছিলেন বলে এঘরে আটকেই দিলো, আসুক শুতে। মজা দেখাচ্ছেন অচ্যুত।


“কিছু খেতে দিলে না আমায়! ট্যালটেলে মাছের ঝোল!”


সুহাসিনী ঘরে ঢুকতেই বললেন অচ্যুত।


“বিপি বেশি। তো কি খাবে?” “সব তোমার কীর্তি”।


“এমা, আমি কি করলাম, তোমারই তো বুকে ব্যথা। একা ঘুম হচ্ছে না, কদিন বিশ্রামে থাকো। এংক্সাইটি কমবে”।


“রুদ্র তো জানে সব নাটক, তবে কাল দিলে এত্তো টেস্ট ?”


“করাও না, বয়স তো হলো। এই তো মরে যাবে বলছিলে”।


“মরলে ভালো, বৌ?”


“এসব কথা বলছো যখন, ভাবছোও। ভেবো না, বিপি বাড়বে”।


“তখন কী সহজে বলে দিলুম – মরলে বিয়ে করো। এখন ভাবছি – মরেও শান্তি পাবো না তবে”।


সুহাসিনী অচ্যুতকে রাতের ওষুধ দিলেন। প্রেসারের, কোলেষ্টেরলের।


“জানি আমি সেটা, যেটা চাওনা, বলো কেন?” “কষ্ট হয়, তাই”।


“কী নিয়ে?’ “তুমি জানো”।


“অবিশ্বাস – এখনো?” 


অচ্যুত সুহাসিনীর কোমর জড়িয়ে ধরলেন।


“নাহ, ইনসিকিওরিটি, রুদ্র বেশি যোগ্য, জানি তো”।


“এখন এই বয়সে আর সেসবের প্রশ্ন আসে?” অচ্যুতকে ভোলাতে চাইলেন সুহাসিনী।


“তাও বটে”।“আজ তো সরে জমিনে দেখলে, এবার শান্ত হও”।


সুহাসিনী কোমর ছাড়াতে গেলেন, অচ্যুত কাছে টেনে নিলেন, বুকে মুখ রাখলেন। 


"কী করছো, ছাড়ো ……”


“পরী কই?’ বুক থেকে মুখ তুললেন অচ্যুত, “ও ঘরে ঘুমিয়ে গেছে,জেঠিমণির কাছে”।


“দরজা লক করেছো?” 


“হ্যাঁ, ছাড়ো – এবার শুয়ে পড়ি”।


“নীরা, অনি এরা কিছু ভাবলো?”


“ওদের দুজনের এত জটিলতা আসে না। নাটক করবে বুড়ো কাকা – বৌয়ের কাছে থাকবে বলে – ভাববে কী করো”। সুহাসিনী ঠেস দিলেন।


“বুড়ো কিনা দেখবে?”


“না, খুব জোয়ান, জানি”।


“এত ভয়?” “ভয় কেন? দূরত্ব। ত্রিশ বছরের”।


অচ্যুত বললেন, “শোও”।


“অনুপম পেটে থাকতেই অ্যাফেয়ারটার শুরু, তাই না?”


অচ্যুত চমকালেন, “আবার সে কথা কেন?” 


“আবার! এই কথাটা তো সারাজীবনই থাকবে, ছোটকর্তা”।


“কষ্ট পেতে, তাও বলোনি। সেটা কেন? ভাঙবে তবু মচকাবে না, না? তোমাকে কষ্ট দিতেই তো ……”।


“বললে কী হতো? ছাড়তে?”


“তোমার জন্য সব ছাড়তে পারি”।


সুহাসিনী শুয়ে পড়লেন। অচ্যুতও পাশে শুলেন। 


“ভারী জেদ তোমার, বৌ”। “আর তোমার?”


“অভিমান।নিজের স্বামীর উপর জোর খাটাতেই জানলে না তুমি কোনদিন”।


সুহাসিনী চুপ করে থাকেন। অচ্যুত কাছে আসেন। 


“একটাবার ডাকতে। আমি তোমাকে ছাড়া ভালোবাসিনি যে কাউকেই”।


সুহাসিনীর কপালে চুমু খেলন অচ্যুত। 


সুহাসিনী বললেন, “ভালোবাসতে এই চুমুটারই প্রয়োজন। অথচ আমাদের মধ্যে মাঝরাতে উঠে শরীরের প্রয়োজন বিনিময় ছাড়া আর কি কিছু হতো?”


“হতো না, বোকা ছিলাম।তেইশ চব্বিশে কী বোঝে মানুষ। বুঝতাম না তুমি কী চাও, এখন বুঝছি”।


আরো দুটো চুমু খেলেন অচ্যুত। 


“আমার বৌ”।অস্ফুটে বললেন আর একবার।


রাতে ঘুম ভেঙ্গে গিয়েছিলো অচ্যুতের। টয়লেটে যেতে হবে। অ্যাটাচড বাথরুম, এ ঘরেও। বাইরে বৃষ্টি হচ্ছে। মেঘ ডাকছে। বিদ্যুত-ও চমকাচ্ছে মাঝে মাঝেই। অচ্যুতের চোখে পড়লো পায়ের দিকের একটা জানলা খোলা। ঝোড়ো হাওয়া ঢুকছে। সুহাসিনীর ঠান্ডার ধাত। জানলা বন্ধ করে দেওয়া প্রয়োজন। উঠে জানলা বন্ধ করতে করতেই বিদ্যুৎ চমকালো। পিছনের মাঠের দিকে চোখ পড়লো, সাদা শাড়ি, খোলা চুল কেউ একজন পিছনের ঘরের দিকে যাচ্ছে, পা টেনে টেনে। কে এ! পিছনের ভাঙ্গা ঘর গুলোতে ধিকিধিকি আগুনের আঁচ দেখলেন অচ্যুত। কেউ ওখানে আলো জ্বালিয়েছে। কে সে? নাকি কারা? অচ্যুত ছুটে এসে সুহাসিনীকে জানালেন। 


“বৌ – ওঠো … ছোটগিন্নী ……” সুহাসিনী ধড়মাড়িয়ে উঠে বসলেন। 


“কী হলো! বুকে ব্যথা? জল খাবে?”


অচ্যুত হাত ধরে টানলেন। “এদিকে এসো”। জানালার দিকে ইশারা করলেন। সুহাসিনী ছুটে গেলেন।


“কে ওখানে?’ বলতে যাচ্ছিলেন, অচ্যুত মুখ চেপে ধরলেন। সুহাসিনী স্পষ্ট দেখলেন অনিকেত ঠিক যেমনটা বলেছে তেমন কেউ একজন ঝড় বৃষ্টির মধ্যে জলে ভিজে ভিজে পিছনের ঘরে যাছে। 


“কে ও?” গলার আওয়াজ নামালেন সুহাসিনী।


“সেটাই তো ভাবছি”। “অনিকে ডাকো”।


অচ্যুত ভাবলেন সেটাই ঠিক। “ডাকছি”।


“জানলা লাগাচ্ছো কেন?”


“আমি অনির সাথে নীচে যাবো, খুঁজতে। তুমি একা থাকবে, তাই”।


জানলা লাগিয়ে বেরোতে গেলেন অচ্যুত, সুহাসিনী হাত ধরলেন।


“একদম না। আমিও যাবো”। “বেশ, চলো”।


অনিরুদ্ধ, অচ্যুত আর সুহাসিনী মাঠ পেরিয়ে ভিজতে ভিজতে পিছনের ঘরের সামনে যখন এলো – ওখানে কেউ নেই। অনিরুদ্ধ টর্চ জ্বালালো। পাঁচ ব্যাটারির বড় টর্চ। চারিদিকে ফেললো।


“নাহ, কোথাও কেউ নেই। অথচ আগুন জ্বলছিলো কিছুক্ষণ আগেই। এখনো ধোঁয়া আছে। 


“স্ট্রেঞ্জ! গেল কোথায়?” অচ্যুত বললেন, “পালিয়েছে, পাঁচিল টপকে”।


“আমরা আসতে না আসতেই?”


“হ্যাঁ, কোলাপ্সিবল খোলা বন্ধ, সিঁড়ি দিয়ে নামা, মেনগেট খোলা, এতটা আসা – ছোটগিন্নী – পাঁচিলের দিকটা দেখতে হবে, চলো”।


পাঁচিলের দিকে টর্চ ফেলেও কারোর চিহ্ন মাত্র পাওয়া গেলো না। 


“এত উঁচু পাঁচিল টপকে গেলো?” সুহাসিনী অবাক হন। 


“প্রেতাত্মা হলে যেতেই পারে”। অচ্যুত বললেন। “না, না – মানুষ”। 


অনিরুদ্ধ বললো।“কী করে জানলি?”


“বলছি – একে পাওয়া মুশকিল। চলো উপরে যাই”।


“ডাকিনি বিদ্যা এটা”। অচ্যুত সব শুনে বললেন। উপরে উঠে এসেছেন ওনারা, ডাইনিং রুমে বাস কথা হচ্ছিলো। 


“আমাকে বলোনি তো – বাবিনকে ভয় দেখিছে – আর সেই জন্য তুমি থাকছো”।


সুহাসিনীর দিকে কড়া চোখে তাকালেন অচ্যুত। 


“বললে কী হতো?” 


“আমি অনেক আগে থেকে থাকতাম এখানে তবে।অনি একা, তোমরা সবাই মেয়ে মানুষ, ছোট বাচ্চা রেয়েছে দুটো ……”


“ডাকিনী বিদ্যা তুমি নিশ্চিত?”


অনিরুদ্ধ বললো। “হ্যাঁ, প্রেতাত্মা ভাবছিলাম। কিন্তু এসব ঘরে টরে আসা শুনে মত বদলাতে হলো”।


“তুমি এত নিশ্চিত হচ্ছো কী করে?” অচ্যুত হাসলেন,


“মায়ের থেকে শুনেছি এসবের কথা অনেক। বাগদেবীপুরে আগে নাকি এসব জলভাত ছিলো। তন্ত্র মন্ত্র, ডাকিনী বিদ্যা – সমস্ত ম্যাল প্রাকটিস হতো ওখানে। তোমাকে সেই অভিশাপ দেওয়া তান্ত্রিকের কথা বলেছিলাম না? তার আমল থেকেই এসব ঢুকে গেছিলো গ্রামে”।


“তোমার মা তো আমাদের বলেননি এসব কখনো?”


“তোমরা যখন এলে তখন ধীরে ধীরে গ্রামের কথা এড়াতে শুরু করেছিলেন মা। শেষ শয্যায় আবার শুরু করেছিলেন – দেখোনি?”


“সে তো দেখেছি।অনি, সার্ভেন্টস কোয়াটারের দিকটা বড্ড চুপচাপ। আমরা তিনজন বেরোলাম, ঢুকলাম – কেউ জাগলো না! এমনকি নীচতলায় যে ক’জন থাকে তারাও ……”


“সর্ষের মধ্যেই ভূত, থুড়ি ডাকিনী আছে”।


অচ্যুত বললেন, “সব কটাকে কুলোর বাতাস দে, অনি”।


“কিন্তু কাকা – তাহলে তো ধরা পড়বে না। বাইরে বেরিয়ে যদি বাবিনের আরো ক্ষতি করে?”


“তুই -ওতো মায়ের মতো বলছিস। মা বলতেন ডাইনিবিদ্যাতেই জেঠার বড়ছেলেটা মরেছে। বাবা ঐ জন্যই নাকি পালিয়ে এসেছিলেন,দাদা ছয় মাসের হতেই। ওসব অভিশাপ- টাপ কিছু না। সব ডাইনির কাজ।


তুই-ও সেটা মানিস?” অনিরুদ্ধ চশমা ঠিক করলো, 


“অভিশাপ, ডাইনি দুটোর একটাও মানার মতো নয়। আমি মানুষের লোভকে ভয় পাই কাকা – খুন মানি এগুলোকে”।


অচ্যুত চুপ করে থাকলেন। তারপর বললেন, “বাবিন মানে উৎসবেরটাও? ডাক্তার তো ডেঙ্গু বলেইছিলো”।


সুহাসিনী বললেন, “তুমি কি বলে মানো এগুলোকে?”


“ভাগ্য, সমাপতন”। “এত বার?”


“তবে অনিকেতের ডাইনি দেখাটা আর আজ নিজের চোখে তাকে লক্ষ্য করাটা মত বদল করাচ্ছে আমাকে”।


“মোটিভ কি?” সুহাসিনী বলে।


“এদের আবার মোটিভ! সিদ্ধিলাভ-টাভ এসবের জন্যও করতে পারে। মানুষের বাচ্চা মারলে মনে হয় সাধনার সিদ্ধি বাড়ে। অনিকেতকে নিয়ে খুব সতর্ক থাকতে হবে, আমাদের। তবে, আমার মতে সবকটা তাড়িয়ে দেওয়াই ভালো”।


“বাইরে এতো সার্ভিলেন্স সম্ভব না ছেলের উপর, কাকা”।


“আর মোটিভটা এত সরলও নয়, আমার যা মনে হয়, পুরনো শত্রুতা নির্ঘাত থাকবে। থাকতেই হবে”।সুহাসিনী বললেন। 


“নীরা ঘুমোচ্ছে?” অচ্যুত বললেন, 


“না, আমি উঠে আসতেই জেগে গেছে, বাবিনও। পরীটা ঘুমোচ্ছে।ও বাবিনের জন্যই যাওয়ার ইচ্ছা থাকলেও গেলো না আমাদের সাথে। এখনো ছেলেকে ফেলে বেরোচ্ছে না”।


“তুইও ঘুমোতে যা তবে, পরে এসব আলোচনা হবে,কাল একবার নিধুকে মণিকে ডেকে বসবো আমি। গ্রামের এখনকার খবর নিতে হবে”।


“কাকাবাবু, মানে ডাক্তারকাকাও সেটাই বলছিলেন, গ্রামেই এর লিংক কোথাও আছে”।


“রুদ্রও! দেখলে ছোটগিন্নি – ওর আমার এক লাইনে ভাবার স্বভাবটা গেলো না”। সুহাসিনী চোখ বড় করলেন।


অনিরুদ্ধ লজ্জা পেলো। উঠে পড়লো, “কাকা,গুডনাইট। কাকিমণি শুয়ে পড়ো। কাকা, বুকে ব্যথা করছিলো তখন – রাত জেগো না আর”। 


অনিরুদ্ধ গেলে অচ্যুত বললেন, “কতটুকু ছিলো, মনে পড়ে? এখন এটা করো না, ওটা খেয়ো না, অফিসে যাবে না, রেস্ট নাও …”।


“জীবন তো এমনই”।


“ঐ জন্যই জীবন সুন্দর”।


“মরার কথা আর বলবে না, কখনো, মনে থাকবে?”


সুহাসিনীর হাত ধরেন অচ্যুত, “থাকবে, বৌ – ভালোবাসো তো, আমায়?”


সুহাসিনী বললেন, “ছেলে কি বললো শুনলে না? বুকে ব্যথা নিয়ে রাত জাগা ঠিক নয়”। অচ্যুত হেসে ফেললেন।


“ঘুমোবে চলো”, সুহাসিনী বললেন। 


“এখনো ঘুমোয় নি?” অনিরুদ্ধ ঘরে ঢুকে দেখলো নীরা বাবিনকে কোলে নিয়ে বসে আছে।পরী পাশে ঘুমোচ্ছে।


“অনি, জোরে কথা বলো না। ভয় পেয়ে আছে”।


নীরার গলার স্বর ভারী হলো। অনিরুদ্ধ বুঝলো।


“বেশ, দাও-আমাকে কোলে দাও”।


“ভেজা জামা – বদলে নাও আগে”।


অনিরুদ্ধ ওয়াশরুমে গিয়ে চেঞ্জ করে এলো। 


অনিকেত বললো, “বাপি, এভিলকে পেলে?”


“না বাবিন, দাদুভাই কি দেখতে কি দেখেছিলো”।


“না, বাপি, এভিল আছে। দাদুভাই ঠিকই দেখেছে”।


নীরা ছেলেকে অনিরুদ্ধর কোলে দিলো, “বাপির কোলে যা, বাপি কতো স্ট্রং জানিস? এভিল এলেও তোকে ধরবে কি করে?”


অনিকেতকে কোলে নিলো অনিরুদ্ধ। জোরে জড়িয়ে ধরলো।


“আমি আছি তো বাবিন, ভয় কী?” অনিকেত চুপ করে থাকলো।


“কেঁদেছে?” “ফুঁপিয়েছে। চিৎকার করে কাঁদে তো না, সারাক্ষণ ফোপাছিলো”, নীরা বললো।


“ওকে বলো যে বাপি আছে মামণি আছে ওর কোনো ভয় নেই”।অনিরুদ্ধ বললো। 


“কাল বাবিনকে ছুটি দেবে একটু?”


“তুমি নিয়ে বেরোবে? বেশ তো।বাবিন,বাপির সাথে ঘুরতে যাবি?” “তুমি?”


“দাদুভাই অসুস্থ তো। তুই আর বাপি ঘুরে আয়”।


এই বাড়ির বাইরে একটু ছেলেকে ঘোরাতে চাইছে অনিরুদ্ধ। ভয়ের চিন্তা মাথা থেকে কাটবে।


“বাপির অফিস, আমার স্কুল?”


নীরা আর অনিরুদ্ধ হেসে ফেলে, “একদম সেলফ ডিসিপ্লিনড বাচ্চা জন্মেও দেখিনি অনি”। “আমিও”।


অনিরুদ্ধ সোফায় দাঁড় করায় অনিকেতকে, “পিঠে চাপ”।


“পিঠে?” নীরা ভাবে বাবিন হলে লাফিয়ে উঠে পড়তো। “গলা জড়িয়ে পিঠে”। অনিকেত ওঠে।


“এইভাবে ঘুরবো আমরা কাল, পিঠে চেপে?” “মজা না?”


“হ্যাঁ।একটা কথা বলবো, বাপি?”


“বলো”, অনিরুদ্ধ ঘুরে চুমু খায় অনিকেতকে।


“তোমার অফিসে নিয়ে যাবে? বোন দেখেছে, আমি তো দেখিইনি”।


নীরা হাত বাড়িয়ে কোলে নিয়ে নিলো অনিকেতকে। 


“অফিসে যেতে হবে বাবিন?” অনিরুদ্ধ বললো।


“হ্যাঁ, যাই নি তো”।


“বেশ, তাও নিয়ে যাবো, কিন্তু কাল একদম পড়ায় ছুটি। দুপুরে স্কুল করে এসেই বাপি নিয়ে বেরিয়ে যাবে, সকালে দাদুভাইকে টেস্ট গুলো করিয়ে দেবো, হবে?”


অনিকেত মামণিকে বললো, “ফিরে এসে পড়া নেবে, মামণি?”


নীরা ওর নাকে নাক ঘষলো। “না, কাল না”।


“তবে যাবো”। অনিরুদ্ধ নীরা হাঁফ ছেড়ে বাঁচলো।


“বাপরে অনি, তোমার ছেলেকে বেড়াতে যেতে রাজি করাতে এতো হ্যাপা?” নীরা বলেই ফেললো।


“দেখছি তো তাই”।


“পড়া দেওয়া থাকলে যাবো কি করে মামণি? দেখলে না, আজও তো উঠবোস খেলাম”। নীরা হাসলো, 


“তিন লাইনে চারটে শেখানো বানান ভুল করলে আদর তো খাবি না”।


অনিরুদ্ধ বললো, “বাবিন এক কাজ কর, আমার কাছে পড়িস, অফিস থেকে ফিরে পড়িয়ে দেবো। মামণি রাগী, বকে খালি, বাপি তো রাগেই না”।


নীরা বললো, “তাই কর তবে”।


অনিকেত মামণিকে জড়িয়ে ধরলো। 


“কী হলো?” “তোমার কাছেই পড়বো মামণি”।


“বকি যে”। “সে হোক, তুমি বকলেও পরে কত আদরও তো করে দাও। আর তোমার মতো ভালো করে কেউ বোঝাতে পারে না”। 


অনিরুদ্ধ বললো, “নীরা – প্রশ্রয় দিলেও মা-ই ভালো হয়, আবার শাসন করলেও – দেখছো তো? বেচারা বাবারা কখনোই জিততে পারে না। বকে বকে তো নয়ই প্রশ্রয় দিয়েও না”।


নীরা খুশি হয়, যে ফিরে এসেছে সে নীরার হয়েই ফিরে এসেছে।


পর্ব – ৩৫ 

মিত্রা বেশ কিছু দিন থেকে খেয়াল করছে শাঁওলি মন মরা হয়ে আছে। বাড়ির কারোর সাথে কোন কথা বলছে না। কেউ কিছু জিজ্ঞাসা করলেই রেগে যাচ্ছে। প্রতীক আসামে কোম্পানির কাজে গেছে। শাঁওলির কি হয়েছে – এটা জানতে মিত্রাই পারে। অথচ অফিসের চাপে সময় হচ্ছে না। রবিবার ননদকে ধরলো মিত্রা। 

“বোনু, এত চুপচাপ?”

শাঁওলি নিজের বিছানায় শুয়ে ছিলো। ফোন নিয়ে খুট খুট করছে।

“তুমিও এলে অবশেষে, প্রশ্ন বিচিত্রা নিয়ে”। 

মিত্রা দরজা ভেজালো, “কী হয়েছে?”

“কিছু না”। মিত্রা পাশে শুয়ে পড়লো”। “প্রেম ট্রেম করছিস?”

“কাজ নেই তোমার? রান্না হয়ে গেছে?”

“করেই এলাম, তুই-ওতো একটু শিখতে পারিস”। 

শাঁওলি বৌদিমণির দিকে ঘুরলো, “ওহ, আমাকে তোমার এখন অকর্মণ্য, বোঝা মনে হচ্ছে?”

মিত্রা অবাক হলো, “ সেটা কখন বললাম? বড় হচ্ছিস – কদিন পর বিয়ে হবে…”। 

“হবে না ওসব বিয়ে টিয়ে”।

“বেশ। কিন্তু পি এইচ ডি করতেও তো বাইরে যেতে হতে পারে?”

“সে দেখা যাবে”। 

“যাক। ভাবলাম বলবি পি এইচ ডি – ও করবো না”।

“নাহ, করতে হবে, এই চাকরিটা ভালো লাগছে না। ছেড়ে দেবো”।

মিত্রা ননদের গায়ে হাত রাখলো।

“স্কুলে ঝামেলা হয়েছে কোন?” “নাহ”। “তবে?”

“বললে রাগ করবে”। 

“আমি? কেন রে?”

“মানা করেছিলে শুনিনি”। 

মিত্রা ভাবলো, “অনিরুদ্ধদের বাড়ি যাওয়া নিয়ে কিছু হয়েছে?’

“জানোনা বৌদিমণি, কী ভয়ংকর বাজে অনিদার বৌ। সাইকিয়াস্ট্রিক পেশেন্ট, আর কী অহংকার পয়সার, রূপের, ক্লাসের ……”।

“কিছু বলেছে তোকে?”

“যা নয় তাই। ঐটুকু বাচ্চা ছেলে একটা অঙ্ক টুকতে ভুল করেছে – তার দোষ টিউটরের! ক্লাসে র‍্যাঙ্ক নাকি দুই নাম্বারের জন্য কমে যাবে। অদ্ভূত”।

“যাস না আর”।

“সে উপায়ও নেই। ফাদার অগাস্টিনের অনুরোধে যেতে হচ্ছে”।

“অনিরুদ্ধকে জানিয়েছিস?”

“হ্যাঁ, অনিদাকে জানাবার পর, আর হয়নি এমন। আর মাসখানেকেরও কম যেতে হবে। তাহলেই শেষ”।

“মিটে গেলো, তাহলে মন খারাপ?”

“অপমানিত হবার জ্বালা বলতে পারো”।

“ছাড়, নিজেই তো বললি সাইকিয়াট্রিক পেশেন্ট”।

“ক্লাস নিয়ে, ফ্যামিলি নিয়ে কথা মানা যায়, বলো?”

“বুঝেছি, তাই বলি ওসব ছাড়, পড়ায় মন দে”।

মিত্রা উঠে পড়লেন। 

“নেটটা কোয়ালিফাই কর এবারই। চাকরিটা ছাড়। দাদাভাই, আমার দুজনেরই অমত”।

“বৌদিমণি – রাগ করেছো?”

“না তো, তোর মুড খারাপ। এমন সবারই হয়”।  

“না, চাকরি পেয়ে মা’কে কানের দুল দিলাম। তোমাকে কিছু দিইনি এখনো, তাই”।

“ধুর বোকা মেয়ে, আগে প্রফেসর হ, তারপর দেখা যাবে”।

মিত্রা মিষ্টি করে হাসলো।

“তাও, কিছু নাও”।

“নেবো, নেটের রেজাল্ট। ওটার ভাগ কিন্তু কাউকে দেবোনা”।

শাঁওলি হেসে ফেলে। বৌদিমণির মত করে ওকে কেউ বোঝে না।


অনিদা আজকাল এড়িয়ে যায়। বেশ বোঝে শাঁওলি। ঐ অসভ্য মহিলার চাপে পড়ে হয়তো। অনিদা কে নিয়ে যত ভাববে না ভাবে – ততই মনে পড়ে যায়। ক’দিন পর থেকে ও বাড়ি যাওয়া বন্ধ। আর দেখাটুকুও হবে না। শাঁওলির কি কষ্ট হবে? খুব,খুব কষ্ট হবে। অনিদা কি বোঝে না, শাঁওলি ওকে কতো ভালোবাসে? নাকি এখনো সেই ছোট্টটি ভাবে। কী আছে ঐ মহিলার, রূপ! রূপে কী সব হয়? মানসিক স্থিরতাই তো নেই। কী সুখ দেবে সে অনিদাকে? অনিকেত এখন খুব মামণি মামণি করে। ঐ রগচটা বাজে মহিলা রেগে গেলে অনিকেতের সাথে কী করবে ভেবেও মাঝে মাঝে ভয় পায় শাঁওলি। পরে ভাবে – করলে করবে। তার ছেলে যখন।অনিকেতও এখন মিসকে কিছু বলে না, বাড়ির ব্যাপারে। মা-বাবা কেমন, কী করছে না করছে, কেমন ব্যভার – সেসব নিয়ে মুখ খোলে না। হয়তো অনিকেতকেও মানা করে দিয়েছে অনিদার বৌ। অনিকেত খুব ইনটেলিজেন্ট। শাঁওলি ওকে ভালো করে মানুষ করতে পারতো। ঐ মহিলা পারবে না। যদি ওর জায়গাটা শাঁওলি পেতো! ভেবেই থমকে যায় শাঁওলি ওর জায়গায় মানে অনিদার বৌ হতে হতো শাঁওলিকে। সব পয়সা, সব গয়না, সব ক্লাস মুঠোর মধ্যে থাকতো তাহলে। ঐ মহিলাকেও তখন আঙ্গুল নাচিয়ে চোখ রাঙ্গাতে পারতো শাঁওলি। অনিদাও কিছু বলতো না। যদি এমনটা হতো কী ভালোই না হতো। অসুস্থ মহিলা! পাগল, মরেও তো যেতে পারে, এমন তো কতই হয়। তাহলে আর শাঁওলির পথের কাঁটা সরে যায়। ভেবেই নিজের ভাবনাতেই চমকালো শাঁওলি। এসব কী ভাবছে ও! নিজেকেও ধমকালো। কারোর মৃত্যু কামনা কী উচিৎ? না, না, একদম নয়। কিন্তু এমনটা ও ভাবলো কেন? নিজের মনের তল খুঁজে পায়না শাঁওলি। বই বন্ধ করে বসে থাকে। অদ্ভুত লাগে ওর। ভীষণ অদ্ভুত। গাছমছম করে।




পর্বঃ- ৩৬

অচ্যুত সন্ধ্যা নাগাদও লনে বসে ছিলেন। অক্টোবরের শেষের দিক, সন্ধ্যার সময়, ঠান্ডা ভাব টের পাওয়া যায়। সুহাসিনী একটা পাতলা শাল নিয়ে এলেন।

“এটা গায়ে দাও”। অচ্যুত তাকালেন, “রুদ্র কখন আসবে?”

“আসবে বলেছে এর মধ্যেই – ছটা বেজেছে?”

অচ্যুত ঘড়ি দেখলেন, “বাজতে যায়। দু মিনিট বাকি”।

অচ্যুত গায়ে শাল জড়ালেন।"

রিপোর্ট করবে না বলছিলে – দেখলে তো?” “হুম”।

“কী হুম? সব বেড়ে গেছে। ইসিজি খারাপ। টি এম টি -ও”।

“স্মোকিং করছি না তো আর”।

“সে তো সবে দু’দিন হলো। অফিস যাও একবার – আবার স্ট্রেস শুরু করে দেবে”।

অচ্যুত হাসলেন, "এই বকুনি গুলো দিলে তবেই না বৌ, বৌ লাগে?”

“যত্তসব! চা খাবে?”

“এই তো খেলাম, একটু বসো, জিরোও, সারাদিন কাজ আর কাজ”।

“ভারী চিন্তা আমার দেখছি। ছোটখোকা কোথায় গেলো?”

“ভাইপো ভাইঝিদের সাথে খেলেধুলে দোকান ছুটলো দেখলাম”।

“দোকান যাচ্ছে? বাহ!”

“তুমি যে দোকানগুলোর কথা ভাবছো সেগুলোর একটাতেও নয়। অনির দোকানে বসছে অনুপম,শিয়ালদারটায়”।

“তাই নাকি!”

“হ্যাঁ, ওর দাদাভাই ওকে বলেছে বসতে। খুব খুশি”।

“ছোটখোকা চায় আমরা সবাই এক হই – আবারো”।

“আমিও চাই, অতীনকে বোঝাও, তুমি, তোমার কথা শুনবে”।

বলতে বলতেই সামনের গেটে গাড়ির আলো দেখলেন অচ্যুত। গেটম্যান দরজা টেনে খুলে দিলো, “রুদ্র”।

“ছটা বাজে, তবে”।

সুহাসিনী ঘড়ি না দেখেই বললেন। অচ্যুত হাসলেন, “অপেক্ষা করায়নি কোনদিন, দেখা করতে গিয়ে না?”

সুহাসিনী বললেন, “না, তবে অন্য একজন অপেক্ষা করিয়েছে রাতের পর রাত। দুটো,তিনটে – কোনদিন না ফিরেও – তার বৌ এদিকে সারারাত জাগা। কোলে তিনটে বাচ্চা, খায়নি সারারাত ঘরবার করেছে, অথচ যারজন্য, সে জানতেই চায়নি”।

অচ্যুত অবাক হলেন, “খেতে না?”

“না, না, ভর পেট খেতাম। মিথ্যা বলছি এখন”।

অচ্যুত মাথা নীচু করলেন। রুদ্রদেব এসে বসলেন, “অচ্যুত,শরীর কেমন এখন?”

“অনেকটা বেটার। ওষুধ খাচ্ছি তো”।

“সুহাসিনী, সবটা নাটক ছিলো না, দেখলে তো?” রুদ্রদেব হেসে বললেন।

“চা খাবে?” সুহাসিনী বললেন।

“না, বসো দু’দন্ড। তিনজনে মুখোমুখি কতদিন পর বসছি বলো তো?”

অচ্যুত তাকালেন, “বিয়ের পর প্রথম। তাই তো?”

“হ্যাঁ, তারপর তো আমি বিলেত গেলাম”।

“পরে ফিরলেও কী আর সহজ হয়েছিলো সম্পর্কটা, রুদ্র?” অচ্যুত বললেন।

“অবশ্য হওয়াটা স্বাভাবিকও নয়। আমি জেদের বশে, জোর করে যেটা করেছি সেটা দুটো জীবন নষ্ট করে দেবার জন্য যথেষ্ট। অবশ্য নিজেও কী সুখী হতে পেরেছি?”

“ওসব ছাড়, স্মোকিংটা বাদ দিয়েছিস তো?”

“পুরোপরি। ওষুধও খাচ্ছি ঘড়ি ধরে, ছোটগিন্নি, নীরা – কেউ একমিনিট এদিক ওদিক হতে দিচ্ছে না”।

“বেশ। ডাকলি কেন, বল”।

“আমি খুব চিন্তায় আছি, রুদ্র”।

রুদ্রদেব অবাক হলেন, “চিন্তায়? কী নিয়ে রে?”

“সেদিন রাতে যা দেখলাম, নিজে চোখে”।

সুহাসিনী বললেন, “রাতে ঠিক মতো ঘুমোচ্ছেও না। সব সময় চিন্তা কে কোথা থেকে কী করেছিলো, কী করতে চাইছে, কী করবে ……”।

“এটা তো আমারও চিন্তা হয়, সুহাসিনী। যদি আমি যা ভাবছি তা ঠিক হয় - তবে মারাত্মক অপরাধী সে। অথচ আমাদের সামনেই ঘুরছে”।

“সবক’টাই খুন?”

অচ্যুত বলেন, “যুক্তি তো তাই বলে”। 

“গ্রামের ব্যাপারে কী জানলে তোমরা? মণিদির, নিধুদার থেকে?” 

রুদ্র বললেন, “নিধু যেটা বলছে একটা ম্যালপ্র্যাক্টিসের চল গ্রামে ছিলো। কিন্তু সে আগে। এখন কেউ তেমন করে না – তাই তো?”

“হ্যাঁ, আর করলেও খুব গোপনে, নদীর ওপারের শ্মশানে গিয়ে করে”।

“নিধুদার বাড়িতে কে কে আছে”। 

“নিধুর তো দুই ছেলে এক মেয়ে। সবার বিয়ে হয়ে গেছে। বৌ-ও আছে”। 

অচ্যুত বললেন।“মণিদির?”

“মণির তো বিয়ে থাওয়া হয়নি, ওর ভাই আছে, বিবাহিত। ভাই,ভাই বৌ ভাইপো ভাইঝি সব আমার জেঠাদের বাড়িরই একটা অংশে থাকে”।

“তোমাদের জেঠাদের অবস্থা কেমন এখন?”

“পড়তি, কেন?”

“না – এতগুলো আশ্রিত তো-“

“না – ও মনে হয় একটা মুদির দোকান দিয়েছে”।

“কে?”

“মণির ভাই, জেঠাদের অংশ দখল করে থাকে”।

রুদ্রদেব বললেন, “বাব্বাঃ, সরেস তো তবে। তোর জেঠার তরফে কে কে থাকে?”

“জেঠা, জেঠি মারা গেছেন অনেকদিন আগেই। তিনছেলে – একজন তো ভিক্টিম - বাকি দুজন গ্রামেই ছিলো, তেমন পড়াশোনাও করেনি। দুজনেরই তিনটে করে ছেলে মেয়ে”।

“বুঝলাম”।

“গ্রামে যদি এই প্র্যাকটিসটাই না থাকে – তবে এখানে কে করছে? যে করছে তার সাথে গ্রামের যোগ নেই ধরতে হয় তাহলে”।সুহাসিনী বললেন।

অচ্যুত বললেন, “মণি সদ্য গ্রাম থেকে ঘুরে এলো, ওকেও প্রশ্ন করেছি আমি, বললো ও ছোট বেলায় শুনেছিলো এমন কিছু হয়। এমনকী একজনকে পিটিয়ে মেরে ছিলো জেঠারা – ডাইন সন্দেহে – কিন্তু ও যখন থেকে এখানে চলে এসেছে, তারপর গ্রামে গিয়ে দেখেছে সেসব কিছু নেই”।

“পিটিয়ে মেরেছিলো! কেন! থানা পুলিশ হয়নি!”

চমকে উঠলেন সুহাসিনী। “বছর পঞ্চান্ন আগের কথা – গ্রামে জমিদারীর প্রভাবটা ছিলো তখনো”।

“কাকে মেরেছিলো – জানতে পারলি?”

“মণি তো বললো একটা চাকরকে। ঐ বাড়িরই কাজের লোক ছিলো। গুনিন গিরি করছিলো শুরুতে, পরে তন্রমন্ত্র ধরে। জেঠাদের সন্দেহ হয় সে-ই নাকি জেঠাদের বড় ছেলেটাকে ……”। 

“আচ্ছা! এবার বুঝলাম। তখন তোরা চলে এসেছিস?”

“হ্যাঁ, দাদার জন্মের মাস ছয়েকের মধ্যেই চলে আসি। তখন আবার আমি নাকি মায়ের পেটে। মণির থেকে শুনেছি মণিও নাকি তখন ওর মায়ের পেটে ছিলো”।

“মণিদি তোমার সমবয়সী তবে?”

“হ্যাঁ, মাস দুয়েকের এদিক ওদিক হবে। মা বলতেন মণির মা খুব ভালো রাঁধুনি ছিলেন, সুন্দরীও”।

“রাঁধুনি? ওর ব্রাহ্মণ?” রুদ্রদেব বলেন।

“ব্রাহ্মণ জমিদার বাড়িতে তো ……”। 

“হ্যাঁ ঠিকই ধরেছিস। ব্রাহ্মণ মণিরা। ওর বাবা পুরোহিত ছিলেন আমাদের মন্দিরেরই। একটু আলাভোলা মতন ছিলেন শুনেছি। বইপত্র নিয়ে থাকতেন সারাক্ষণ। মাঝে মধ্যেই উধাও হয়ে যেতেন সংসার ধর্মে মতি ছিলো না। আবার যখন পূজো করতেন খুব ভালো পূজো করতেন”।

“বেঁচে নেই?”

“নাহ, একবার উধাও হয়ে আর ফেরেননি। মণি বলে মণি তখন খুব ছোট আর মণির ভাই পেটে”।

“ওহ”।

“সেই জন্যই কি মণিদিকে ফাইফরমাশ খাটতে পাঠিয়ে দেয় ওনার মা?”

“মনে হয়, বাবা নিয়ে এসেছিল – এটা মনে আছে। কতই বা বয়স ওর তখন, বছর এগারো, সেই থেকে আছে”।

“বিয়ের চেষ্টা করেনি কেউ কখনো? দেখতে শুনতে তো ভালোই”, সুহাসিনী বললেন।

“মা বলতো বাবাকে। তবে ওদের বাড়ি থেকে গা করেনি। মাসে মাসে একটা মোটা টাকা গ্রামে পাঠায় মণি। বিয়ে হলে তো সেটা পাবে না। আর ওর ভাইটাও মানুষ হতো না তাহলে”।

“নিধুদাও কি ঐ সময় থেকেই আছে?”

“নিধু বছর দুয়েক পর থেকে”।

রুদ্রদেব কিছু একটা ভাবছিলেন। 

“কী ভাবছিস, রুদ্র?”

“কিছু না। অঙ্কটা জটিল হয়ে গেলো। তোদের গ্রামে একবার যেতে হবে মনে হয় – গোপনে”।

“কেনরে?”

“আমরা যাদের ইন্টারভিউ করছি – তারাও কি সন্দেহের উর্ধে? আর পিটিয়ে মারার গল্পটা আমাকে ভাবাচ্ছে। একটা মানুষকে বেমালুম পিটিয়ে মেরে দিলো – তার বংশধরাও তো প্রতিশোধ নিতে পারে। অচ্যুত, তোর জ্যাঠাদের বাড়ির কারোর ফোন নাম্বার আছে তোর কাছে?”

“উঁহু”।

“তাহলে তো যেতেই হবে”।

“কবে যাবি?”

“যাবি মানে? তুই যাবি নাকি এই শরীরে, অনিকে নেব”।

“আমি যাবো”।সুহাসিনী বললেন। 

“না, না, অচ্যুতকে দেখবে কে? নীরা একা পারবে না”।

“একদিনের তো ব্যাপার”।

“রুদ্র, বৌ ঠিক বলেছে। ওকে নিয়ে যা, সবসময় পুরুষ মানুষের বুদ্ধিতে সব হয় না। মেয়ে মানুষের চোখ লাগে”।

“আমার সাথে ছেড়ে শান্তিতে ঘুমোতে পারবি?”

রুদ্রদেব রসিকতা করলেন। অচ্যুত সুহাসিনীর দিকে তাকালেন।

“তুলে নিয়ে চলে যাবি? বেশ তো, যা। তবে ফিরে চলে আসবে”।

“তোমাদের এটা ফালতু মস্করা করার সময়?”

সুহাসিনী রেগে গেলেন, “না, না। ঘাট হয়েছে। বলছি ছোট গিন্নী, চা হবে – এবার?”

“চিনিছাড়া, দুধছাড়া – হবে”।

অচ্যুত মুখটা পাংশুটে করলেন। “থাক”।

“দেখেছো, রুদ্র?”

“না,না– তাই আনো। বাপরে একে বৌ – এর বকুনি, তারপর ডাক্তারের – বাপরে! জল গরম করে দুটো চা দানা ফেলে আনো তাও হবে”।

সুহাসিনী হেসে চলে গেলেন।

“বাড়িতে থেকে মন ভালো লাগছে?”

রুদ্রদেব বললেন।“খুব, এতদিন থাকিনি, আফশোস হচ্ছে”।

“বৌ ডাকটা বেশ, ছোট গিন্নীটা সেকেলে”।

"ওটা আদরের ডাক, তোর যেমন সু”।

রুদ্রদেব চমকালেন, “জানিস?”

“জানি, এটাও জানি তোকে এখনো খুব ভালোবাসে, আর তুই ও”।

“কষ্ট পাস?”

“আগে পেতাম, এখন পাই না। দোষ তো আমারও। ওকে ঠিক মতো বৌ করে নেবার চেষ্টাটাই তো করিনি”।

“এখন করছিস?”

“বলতে পারিস।সময় দিচ্ছি। এক খাটে ঘুমোচ্ছি.. চৌত্রিশ বছর খাট আলাদা ছিলো”।

“বাহ”।

“গল্প করছি – এক তরফা হলেও, শুনছে, বিরক্ত হচ্ছে না। কাছে আসতে দিচ্ছে না – কিন্তু পাশে থাকতে দিচ্ছে”।

“কসবার বৌদিবাজিটা বন্ধ করেছিস তো?”রুদ্র চোখ মারলেন।

“ওরে শ্লা! এত নামী ডাক্তার হয়েও বদলাসনি?”

“তুইও তো বিজনেস ম্যান – তাও এত বড়ো – বদলেছিস? কী নাম ছিলো তার?”

“নামে কী এসে যায়, ভাই। ছেড়ে দিয়েছি, যাই না আর। বিশ্বাস কর।”

“করলাম”। 

সুহাসিনী চা নিয়ে এলেন, সাথে নিধুকাকা। অনিকেতও এসেছে ঠাম্মা পায়ে পায়ে।

“আরে বাবিন যে ……”।

রুদ্রদেব হাত বাড়িয়ে ডাকলেন। কোলে বসিয়ে নিলেন।

“পড়া হয়ে গেছে?”

“হ্যাঁ, মিস চলে গেলো। এখন অল্প ছুটি”।

“বাহ”।

“দাদুভাই, মামণি ডাকছে। তুমি বাইরে – ঠান্ডা লেগে যাবে”।

অচ্যুত হাসলেন, এই একটা নাতিই ওনাকে ঠাকুরদাদা নয়, দাদুভাই বলে। শুনতে ভালোলাগে অচ্যুতের।

“তোর মামণির সব দিকে নজর”।

“সুহাসিনী একটা কাজ ঠিক করেছে। অনির জন্য নীরাকে বেছে”।

“মাত্র একটা কাজই ঠিক করেছি জীবনে রুদ্র - এমন মনে হলো?”

সুহাসিনী রুদ্রদেবের পাশে বসতে বসতে বললেন। 

“তা বলছে না রুদ্র, এই কাজটা খুব ভালো করেছো সেটা বলছে”।

“থাক, শুঁড়ির সাক্ষী মাতাল”।

“শুঁড়ি কে ঠাম্মা?”

সুহাসিনী হেসে ফেললেন, “পাকা ছেলে, মামণি এমনি বকে না”।

রুদ্রদেব বললেন, “সুহাসিনী, জানার আগ্রহ ভালো, শুঁড়ি মানে যে মদ বেঁচে। আর মাতাল মানে ………”।

“যে মদ খায়?”

“এইতো, জানিস”।

“বড় হয়ে ডাক্তার হবে বলেছে, তোর মতো”।অচ্যুত বলেন। 

“হবেই তো, দাদুভাই – এর নাতি বলে কথা”।

“চলো, চলো, দাদুভাই – মামণি বকবে”।

অচ্যুত বললেন, “দাঁড়াও দাদুভাই, চা টা খেয়ে নিই। যাচ্ছি”।

“তারপর বকুনি খেলে আমাকে বলো না”।

“বলবো না, ছোটগিন্নী – অনির ছেলে বেলার মতোই না, অনেকটা?”

“একদম, তবে দুরন্তপনাটা এর একটু কম”।

নীরা দেরি দেখে নীচে চলে এসেছিলো, 

“তোকে দাদুভাইকে ডাকতে বললাম – তুই বসে গল্প করছি?”

অনিকেত কাঁচুমাচু হয়ে গেলো।

“নীরা, বকোনা বুড়োটারই দোষ। তোমার কাকাই যেতে চাইছেন না – চা না খেয়ে”।

নীরা বুঝলো গল্প জমেছে তিন বন্ধুতে। নীরা বললেন,

“কাকার ঠান্ডা লাগলে – অনি বকবে আমায়”। 

অচ্যুত বললেন, “নীরা, তুমিও পাশে বসো মা, চা খেয়েই যাচ্ছি”।

নীরা বসতে গিয়েও চমকে উঠলো।

“কাকিমণি, আমি গেলাম। আমার পরীটা একা উপরে”। বলেই দৌড়লো উর্দ্ধশ্বাসে।সুহাসিনী, রুদ্রদেব মুখ চাওয়াচাওয়ি করলেন।অচ্যুত বললেন,"পরীকে ভালোবাসে খুব মেয়েটা।"

সুহাসিনী বললেন, “বসবে না? ওরই তো মেয়ে”।

অনিকেত শুনেও কিছু বললো না। মামণি তো একা ওর মামণি। বোনের তো জেঠিমণি, তাও মা? মামণিকে জিজ্ঞাসা করবে এটা? যদি বকে? তাও জিজ্ঞাসা করাই উচিৎ।

“মামণি ………”।নীরা

শোবার আগে চুল আঁচড়িয়ে ড্রেসিং টেবিলের সামনে বসে। বহুদিন পর আয়নায় নিজেকে ভালো করে দেখছিলো আজ। অনেক রোগা হয়ে গেছে। এটা না খাওয়ার ফল। দিনের পর দিন না খেয়েই থাকতো। মাথায় চুল পাতলা হয়েছে কিছুটা। গায়ের রং – ও চেপে গেছে। তাতে বিন্দুমাত্র ক্ষোভ নেই নীরার, কষ্ট নেই। ছেলে মেয়ে দুটো মানুষ হলেই হবে। অনিরুদ্ধ এখন ষ্টাডিতে, কাজ করছে। পরী ঠাম্মা দাদুভাই এর সাথে শুয়ে পড়েছে। অনিকেতের ডাক শুনে তাকালো নীরা।

“বল”।

“বড় কাকামণি বোনের বাপি?”

নীরা এবার ঘুরে তাকালো, “বোন বললো?”

“না, না, বাপিকে জেঠুমণি বলে তো। আর ছোট কাকামণিকে কাকামণি”।

“হ্যাঁ, বোনের বাপি বড় কাকামণি”।

“বড় কাকিমণি তবে মামণি?”

নীরা ছেলের প্রশ্নটা আন্দাজ করতে পেরেছে এতক্ষণে। ওর পাশে খাটে বসলো।

“হ্যাঁ”। নীরা লুকাতে চায় না কিছু। জানাতেই চায় সব। 

“তুমি তাহলে বোনের জেঠিমণি”।

নীরা বললো, “ঠিক”।

“তাহলে বোনকে যে তোমার মেয়ে বললো দাদুভাই?”

নীরা অনিকেতকে কাছে টেনে নিলো।

“মেয়েই তো, বোন কী তোর বোন নয়?”

অনিকেত মাথা নাড়লো, “হ্যাঁ তো”।

“আমার তো মেয়ে নেই। বাপিরও মেয়ে নেই। তাই বোনই আমাদের মেয়ে।

“ওহ, আচ্ছা, তুমি শুধু আমার ;মামণি, তাই না?”

নীরা বুঝলো মা’কে নিয়ে পজেসিভলেস এসেছে ছেলের মনে।

“না, দাদারও মামণি ছিলে, বলো?”

নীরার কষ্ট হলেও উফ করলো না।

“হ্যাঁ, ছিলাম, এখন শুধু তোরই মামণি। তবে বোনও আমার মেয়ে। মামণি ডাকলেই তো মা হয় না শুধু। যেমন ধর বাপি ঠাম্মাকে কাকিমণি বলে – কিন্ত বাপির মা তো কাকিমণিই। ভালোবাসাটাই আসল”।

নীরার কথায় খুশি হয় অনিকেত।

“বোনকে আমি নিজের বোনই ভাবি মামণি। হিংসে করিনা”।

“জানি তো, এরকমভাবেই বোনকে সবসময় ভালোবাসবে আগলে রাখবে”।

নীরা অনিকেতকে আদর করে।

“মামণি – তুমি কাঁদছো?”

“না তো”। নীরা চোখ মোছে। “চোখে কিছু একটা পড়েছিলো”।

“ও”।

অনিরুদ্ধ আসে তখনই, “বাবিন, জেগে এখনো? কাল স্কুল যে বাবা”।

“ঘুমোচ্ছি বাপি”।

“নীরা কী হয়েছে চোখে জল কেন?”

“কিছু না”।

“বাবিন – মা’কে কাঁদিয়েছো?”

“না, বাপি, এমনি। দাদার কথা বলে ফেলেছিলাম”। 

অনিরুদ্ধ নীরার দিকে তাকায়। বোঝে ওর কতটা কষ্ট হচ্ছে। 

“থাক, বাবিন, যে নেই তার কথা বলতে হবে না”।

অনিরুদ্ধ অনিকেতকে শুইয়ে দেয়। নীরাও শুয়ে পড়ে। অনিকেত ঘুমোলে অনিরুদ্ধ বলে।

“সরি”।

“কেন?”

“ছেলে পুরনো কথা বলে ফেলেছে”।

“তাতে তুমি সরি কেন? ও কি তোমার একার?”

“নীরা – মানো তো ওকে?”

“মানি, কারোর জায়গায় নয়, নিজের জায়গাতে রেখেই মানি, ও আমারই”।

“ও এসে তোমার কষ্ট কমেছে অনেক, তাই না?”

"তোমারও তো”। 

“অনুপমের মধ্যেও একটা চেঞ্জ এসেছে, দেখেছো?”

“দোকানে যাচ্ছে?”

“হ্যাঁ, মন দিয়ে কাজও করছে”।

“ছোট ঠাকুরপোর খুব একসাথে থাকার ইচ্ছে”।

“অতীনের সেটা নেই, নীরা”।

“তবুও সবাই তো চাইছে, তুমি একবার কাকা কাকিমণিকে বলো”।

“তুমিও চাও?”

“কেন নয়? তুমি?”

“চাই, আবার ঠিক চাই ও না”।

“কেন?”

“আবার কম্পিটিশন ঘটি বাটি ঠোকাঠুকি ………”।

“বুঝলাম, ভাইয়ে ভাইয়ে?”

“না, বৌয়ে বৌয়ে। অতীনের বৌ তেমন ভালো নয় জানোই তো, আর তোমার উপর কোন ষ্ট্রেস কোন চাপ, চাই না। তার থেকে এভাবেই ভালো। কাকা, কাকিমণি এখানেই থাকুক। ওদের তাতে মাথাব্যথা হবে না”।

নীরা হেসে ফেলে।

“ধুর বোকা, ওদের মা – বাবা – ওদের চিন্তা হবে না? নিজের পছন্দ মতো সব সাজিয়ে নিলেই হবে অনি?”

“হতে হবে”।

“তুমি তোমার বাঁদরটার মতো পজেসিভ। মা’কে নিয়ে”।

“কেন, কী বলে সে?”

“একা ওরই মামণি তো আমি? বোনের জেঠিমণিই তো?”

অনিরুদ্ধ হেসে ফেলে, “বোনকে হিংসে!”

“না.পরে বলে যে বোনকে খুব ভালোবাসে, হিংসে করে না। কিন্তু আমি কেবল ওর মমণি”।

“বেশ, আমার পাওনাটা মনে আছে তো?”

“আছে, তবে সব ঠিক হোক আগে তারপর। আর তোমার ছেলে ঘুম যা পাতলা ………”।

“ঠাম্মা দাদুভাই এর ঘর আছে তো!”

অনিরুদ্ধ মজা করে বললো। নীরা মাথা নাড়লো।

“কোথাও না, শুধু আমার কাছে, আমার চোখের বাইরে একদম না”। 

অনিরুদ্ধ কিছু বললো না। এরকম আর একজনকে চেনে ও।

ষ্পষ্ট শুনতে পেলো।

“অনি – কোথায় চললি?”

“ঠাম্মা ডাকছে কাকিমণি – ঠাম্মার ঘরে শোব?”

“একদম না, যেখানে শোও সেখানেই শোবে”।

“ভাই গেলো তো”।

“ভাই যাক, ছোটন তো শুয়েছে এখানে, একদিনের সোহাগ।শোবার দরকার নেই”।

ঠাম্মা গল্প বলার লোভ দেখিয়েই ডাকতো ওকে আর অতীনকে। ভালো গল্প বলতো ঠাম্মা। কিন্তু এখানে শুলে গল্প দূরে থাক শুয়ে ঘুমোতে দেরি হলেও দু চার ঘা জুটে যেতো।

“কি রে? কথা কানে গেলো না? নাকি সেদিনের মতো গরুপেটা করতে হবে রাত দুপুরে?”

অনিরুদ্ধর আর কিছু বলার সাহস হতো না। গরুপেটার মর্ম ও হাড়ে হাড়ে বোঝে। যেদিন গরুপেটা হয় তারপর দিন পনেরো ব্যথা থাকে সারা গায়ে। ছলছল চোখ নিয়ে শুয়ে পড়ে তো ছোটনের পাশে। কাকিমণি ওর পাশেই শুত।

কাকা সব দেখে ওই খাট থেকে বলতো।

“ছোটগিন্নী – গল্প শুনতে মন হচ্ছে বাবুর, যাক না”।

কাকিমণি চোখ মুছিয়ে দিতো ওর।

“গল্প আমিও বলতে পারি। তুমি ঘুমোও, এর মধ্যে পড়ো না। তোমার বাবুকে আর লাই দিতে হবে না”।

কাকিমণি শুয়ে বলতো, “আয় – গল্প বলছি”।

“ঘুমোবো”।

“অভিমান?”

“না কাকিমণি, ঘুমাই, স্কুল আছে”।

“বেশ, ঘুমো”।

অনিরুদ্ধ শুয়ে শুয়ে ফোঁপাতো। কাকিমণি কানে কানে বলতো,

“বেশ, এবার থেকে তাহলে ঠাম্মার সাথেই শুবি। ভাইরা আমার কাছে”।

ফোঁপাতে থাকা ছোট্ট অনিরুদ্ধ ঘরে আঁকড়ে ধরতো কাকিমণিকে।

“কী হলো?”

“রোজ বলেছি? আজ বলেছিলুম তো”।

“আমার যে অনিকে পাশে না পেলে ঘুমই আসবে না – তার বেলা?”

“কষ্ট হবে তোমার?”

“খু-ব”।

“আচ্ছা, গল্প বলো, ঘুমিয়ে যাই”। 

কাকিমণি চুমু খেতো দুগালে ঘুম আসতে আসতে শুনতো,

কাকা জল খেতে উঠে বলছে, “ঘুমিয়েছে তোমার ছেলে?”

“হ্যাঁ”। 

“একটু তো ছাড়তে হয়”।

“জানোইতো – ছাড়তে ভয় পাই”।

কাকা আর কিছু বলতো না। নিজের খাটে শুয়ে পড়তো। নীরার মধ্যে কাকিমণিকেই দেখলো অনিরুদ্ধ, আবারো।




পর্ব – ৩৭


ফাদার অগাষ্টিনের রুমে বসে থাকা অনুপমকে দেখে শাঁওলি বললো, “আপনাকে কোথায় দেখেছি বলুন তো?”

অনুপম বাবিনকে নিতে এসেছিলো, দাদাভাই পাঠিয়েছে। বাবিনকে নিয়ে বৌদিমণির কাছে দিয়ে আসবে ও – তারপর দোকান যাবে। 

আজ বাবিনদের লাঞ্চে ছুটি।

“মুখার্জী বাড়িতে”।

অনুপম চিনেছে। বাবিনের মিস।

“ও, হ্যাঁ, আপনি অনিকেতের …”।

“ছোটকাকা”।

“ওহ”।

শাঁওলি বসে।

“আমি অনিকেতকে পড়াতে যাই।

“জানি”

ঘড়ি দেখে অনুপম, বিরক্ত লাগছে। বড্ড গায়ে পড়া মেয়ে।

“আচ্ছা একটা কথা বলুন – অনিকেত ওখানে প্রপার কেয়ার পাচ্ছে তো?”

“মানে?”

“মানে এখনো অ্যাডপশন লিগালি কমপ্লিট হয়নি। অবজারভেশন চলছে দু’মাসের। যদি প্রপার কেয়ার না পায় তবে ………”।

“আপনি তো যান – বোঝেন না?”

“আমি তো দু’ঘন্টার অতিথি। আপনার বৌদি ঠিকঠাক বিহেভ করেন তো? উনি তো আবার সাইকিয়াট্রিক পেশেন্ট ………”।

“কেন করবে না? বাবিনের তো মা, বৌদিমণি”।

শাঁওলি বুঝলো কোন খবর বা বেফাস কথা এখান থেকে পাওয়া যাবে না।

“আজ ওদের লাঞ্চে ছুটি। ওয়েট করুন আর পাঁচ মিনিট”।

অনুপম ঘড়ি দেখলো। পাঁচ মিনিট তাড়াতাড়ি কাটলে বাঁচে ও ।


“ছোটকাকামণির সাথে চলে এলি?”

নীরা অনুপমের কোল থেকে বাবিনকে কোলে নিলো।

“বাবিনের লাঞ্চে ছুটি, দাদাভাই বললো আনতে যেতে – চলে গেলাম”।

“বাহ। লাঞ্চ করবে তো ঠাকুরপো?”

“না, দোকান যেতে হবে”। 

নীরা ছেলেকে চেয়ারে বসালো। পিঠের ব্যাগ খুলে জুতো মোজা খুলে দিলো।

“একটু খেয়ে যাও”।

“বেশ, তুমি বাবিনকে তো খাওয়াবেই। আমাকেও দিও – অল্প করে”।

নীরা ছেলেকে চেঞ্জ করাতে ঘরে ঢুকলো, অনুপমও গেলো পিছন পিছন সোফায় বসালো। 

“বৌদিমণি, বাবিনের মিসটা ঠিকঠাক নয়”।

নীরা থমকালো, “কেন?”

“বড্ড কৌতুহলী। গোয়েন্দাগিরি করে একেবারে”।

“ওকে ঐ জন্যই রেখেছেন ফাদার, আর দিন পনেরো আসবে”।

“তারপর মিস আর আসবে না মামণি?”

নীরা বলে, “না, আমাদের কাছে পড়বি, তাহলেই হবে”।

“আচ্ছা”।

“কটকটে কথা সবসময় বাঁদরটার, নে চেঞ্জ করাবো”।

“কাকামণি ………”।

অনিকেত ইশারা করে।

“তাতে কী? কাকামণিই তো, এইটুকু পুঁচকের লজ্জা আবার”।

“মেয়েটা গায়ে পড়া বড্ড বুঝলে? খুব আনইউজুয়ালি ভিতরে ঢুকতে চায়, সবকিছুর”।

“আমারো অপছন্দ, নেহাৎ তোমার দাদাভাই এর কথায় ……”।

“নিছক গোয়েন্দাগিরি নাকি আর কিছু কে জানে। দেখে মনে হয় টিপিক্যাল গোল্ডডিগার, খুব উচ্চাকাঙ্খী, কিন্তু সোজা পথে না”।

নীরা অনিকেতকে জামা প্যান্ট চেঞ্জ করাতে থাকে। টাওয়াল ধরায় ছেলের হাতে।

“বাবিনের ডান থাইয়ের উপরের দিকে তিল?” অনুপম বলে।

“হ্যাঁ”।

তোয়ালে পরিয়ে দেয় নীরা।

“স্নান করবি?”

“না”।

“বেশ। দাঁড়া ভালো জামা পরিয়ে দিই”।

অনুপম বলে, “বৌদিমণি, আমাকে একটু যেতে হবে গো”।

“কেন?”

“একটা কাজ মনে পড়ে গেলো”।

“খাবে না?”

“না, থাক, আসছি”।

নীরা অবাক হলেও মুখে কিছু বললো না।

“কিরে ভাই, সবাই চলে গেলো – তুই ফিরবি না?

অনুপমকে দোকানের ব্যাক অফিসে দেখে বলে অনিরুদ্ধ।

“হ্যাঁ, যাবো ……”।

“মেশিন বন্ধ কর, অনেক কাজ করেছিস, চল”।

অনুপম কম্পিউটার শাটডাউন করে কেবিন লক করে এগোলো।

“চুপচাপ কেন ছোটন?”

“কিছু না দাদাভাই”।

“কোথায় যাবি এখন?”

“একটু সল্টলেক যাবো ভাবছিলাম। অবিনটাকে অনেকদিন দেখিনি। ছোটটাও তো বড় হলো ক’দিনে”।

“সেকি! যাস না! কেন রে? ঝগড়া করেছিস বৌমার সাথে?”

“নাহ, এমনিই যেতাম না। আজ থেকে রোজ যাবো”।

“বাহ, এক কাজ কর। তুই অডিটা নিয়ে চলে যা”।

“আচ্ছা, দাদাভাই। দাদাভাই – আমাদের ফ্যামিলির সবকটা বাচ্চার মধ্যে বাবিন কিন্তু সবার বেশি ভালোবাসা ডিজার্ভ করে, তাই না? এতদিন পায়নি যে …”।

“পাচ্ছে তো, আজীবন পাবেও”।

“তোমার আর বৌদিমণির উপর ভরসা আছে আমার”।

“নিজের উপর নেই? তুই-ও তো ওর নিকটজন, কাকামণি”।

অনুপম হাসে, “আমার নিজের উপর নিজেরই ভরসা কোথায় দাদাভাই। ভরসার যোগ্য আর আমি? না গো, বরং সবার সব লজ্জা সব কষ্ট – আমার জন্য”।

“তাই! কার কার শুনি?”

“মায়ের, তোমার বৌমার, বাচ্চাদের ……”।

“ধুর বোকা, তুই তো এখন বদলাচ্ছিস”।

“চেষ্টা করছিলাম দাদাভাই। কিন্তু যত উঠতে চাই – পারিনা। নিজের চোখে নিজেই নেমে যাই”।

“বাজে না বকে সল্টলেক যা। ড্রাইভার দিচ্ছি, ট্র্যাক করবো, কোন বারে নামবি না মাঝপথে”।

অনুপম দাদাভাইকে জড়িয়ে ধরে। 

“কী হলো?”

“আমাকে বাড়ি নিয়ে চলো,দাদাভাই, মন ভালো নেই”।

অনিরুদ্ধ হাসে, “চল। আমার সাথে যাবি, একগাড়িতে”।


“কাল? নারে কাল হবে না”।

অনিরুদ্ধকে টেক্সট করেছিলো শাঁওলি। কাল মিট করার জন্য।

“কেন?”

“মিটিং”।

“একদিন বাদ দাও”।

“কী বলছিস!”

“হ্যাঁ, আমার জন্য এটুকু পারবে না?”

“এ আবার কেমন কথা?”

“বাব্বাঃ অনিদা, তুমি এই ক’দিনেই এত বদলে গেছো! তোমার মনেই পড়ে না আমাকে। এদিকে অনিকেতকে পেয়েছো – সেটাও আমার জন্য”।

অনিরুদ্ধ বুঝলো এড়াতে গেলে অভিমান হবে। তার ফল ভালো নাও হতে পারে।

“কাল কী আছে?”

“ফেসবুকে নোটিফিকেশন আসবে, দেখে নিও”।

“ওহ, তোর জন্মদিন”।

“এভাবে শুকনো মুখে বললে হবে? জন্মদিনের লাঞ্চ তোমার সাথে করবো”।

“বেশ, ঘন্টা খানেক কিন্তু। মিটিং – এর আগে”।

“হবে, তাই হবে”।

“কোথায় আসবো বল”।

“বাড়ি থেকে তুলে নিও। কাল স্কুল যাবো না”।

অনিরুদ্ধ উত্তর দিলো না কোন। শাঁওলি বেশ জোর খাটাচ্ছে, অনিকেতকে ওর মাধ্যমে পেয়েছে বলেই ওর এই জোর যতদিন কাগজে কলমে অ্যাডপশন না হয় – সমস্যাটা থেকেই যাবে। শাঁওলি এই জোর দেখানো কি নিছক ছেলেমানুষি? নাকি ওর ক্রাশ শব্দটা অতটাও হাল্কা নয়। গভীর ভাবে ভাবলে অন্য রকম কিছুর সম্ভবনাই মনে হচ্ছে অনিরুদ্ধর। নীরা অপছন্দ করে। এই ব্যাপারে সন্দেহও করে। কিন্তু অনিরুদ্ধ শাঁওলিকে ছোট্ট বাচ্চা মেয়ে ভেবে সেসব ধর্তব্যের মধ্যে আনেনি। এখন মনে হচ্ছে না এনে ভুল করেছে। আনতে হতো। কাল দেখা হলে শাঁওলিকে স্পষ্ট ভাবে বুঝিয়ে দেবে অনিরুদ্ধ, শাঁওলির প্রতি কোন সফট কর্নার নেই ওর। তাতে একদিন দুদিন কষ্ট পাবে। কিন্তু পরে ঠিক হয়ে যাবে। কিন্তু এখনই না আটকালে ভুল ধারণা মনের মধ্যে বসে গেলে সমস্যা। এটাকে মেটাতে হবে। কালই।


পর্ব – ৩৮

“গ্রামে যেতে বলছো?”

রুদ্রদেবের কথায় অবাক হয় অনিরুদ্ধ।

“হ্যাঁ, সত্যিটা খুঁজতে যেতে হবে”।

“কে কে?”

“আমি, তুই, তোর কাকিমণি”। 

“নীরা, বাচ্চারা?”

“এখানে থাকবে, অচ্যুত থাকবে তো”।

“তাও – আমরা তিনজন চলে গেলে ………”।

রুদ্র আর অনিরুদ্ধ লনে বসেছিলেন। সকালে এখন। রুদ্রদেব সকাল সকালই এসেছেন, কথাটা বলতে,  দেরি করতে চান না উনি।

“চিন্তা করিস না। ভোরে বেরোবো, রাতে ফিরে যাবো”।

“কবে? আর এতে লাভ হবে কিছু?”

“এই ডাকিনী বিদ্যা চর্চার কোন উৎস সন্ধান তো করা যেতেই পারে”।

“দেখো – যা ভালো বোঝ!”।

“তোর মা ঘুমোচ্ছে?”

রুদ্রদেব ইচ্ছা করেই বললেন। অনিরুদ্ধ বুঝেই বললো,

“মা?মা উঠে গেছে। বাবিনকে স্কুলের জন্য রেডি করছে”।

“আর বাবিনের মা?”

“সে খাবার তৈরী করছে। ব্রেকফাস্ট”।

“তুই দিয়ে আসবি?”

“অনুপম আসছে, ওই দেওয়া নেওয়া করছে এখন”।

“দুইভাই বোনকেই?”

“না, বাবিনকে।পরীকে আমি স্কুলে দিয়ে অফিসে যাই। ফেরে গাড়িতে”।

“অনুপম তাহলে শুধরাচ্ছে?”

“বলতে পারো”।

“আমাকে অপছন্দ করে, তাই না?”

“ও ছেলেমানুষ এখনো কাকাবাবু, ওর কথা ধরলে হবে না”।

“ছেলে মানুষ আর কোথায় – দুই ছেলের বাবা”।

অনিরুদ্ধ ইশারা করলো, অনুপম আসছে।


“হাত কেটেছে কী করে?”

সুহাসিনী লনে চা দিয়ে এসে অনুপমের হাত খেয়াল করলেন।

“ও কিছু না”, অনিরুদ্ধ বলল।

“কিছু না, মানে?”

মণিপিসি ব্রেকফাস্ট ট্রলি নিয়ে এলো। নিধু কাকা সার্ভ করছিলো।

“এমনি কেটে গেছে”।

“কোথায় মারামারি করেছিস?”

“ওহ দাদাভাই, বাদ দাও না”।

“বাদ মানে? হাত ওভাবে কেটেছে মানে কোথাও গিয়ে ঝগড়া ঝামেলা করেছিলি আবার”।

অনুপম চায়ে চুমুক দিলো।

“বলবো, বাইরের লোকেদের সামনে নয়”।

রুদ্রদেব অপ্রস্তুত হলেন।

“অনি, উঠিরে, চেম্বার আছে”।

“কাকাবাবু, ব্রেকফাস্ট করে যাও। আর ছোটন, এখানে বাইরের কেউ নেই। বল এবার”।

সুহাসিনী বললেন, “ও আর কী বলবে, পেপারে দেখো”।

“পেপারে”!

অনিরুদ্ধ পেপার নিলো।

“ছোটন – মুখার্জী বাড়ির ছেলে হয়ে এভাবে লোকের বাড়ি চড়াও হয়ে মারপিট, থানা পুলিশ! কে ছাড়ালো?”

“তোমার ভাই”।

“অতীন! আমাদের ডাকেওনি তো! কিন্তু এসব কী!”

“মেরে ফেলিনি এই অনেক”।

অনুপম ভাবলেশহীন গলায় বলে।

সুহাসিনী বলেন, “শুনলি অনি, কোন আপ উত্তাপই নেই”।

রুদ্রদেব না বলে পারলেন না,

“এই মেয়েটি কে? একে মেরেছ – এর স্বামীকেও …… কারা এরা?”

“মিথ্যা কথা বলেছিলো মেরেছি”।

“মিথ্যা, কিসের মিথ্যা?” অনিরুদ্ধ বলে।

“অনেক গভীর মিথ্যা।

ষড়যন্ত্র বলা যায় বা পাপ। ছাড়ো – বাবিন রেডি? ওকে দিয়ে আসি”।

“এই হাত নিয়ে ড্রাইভ করতে হবে না, আমি দিয়ে আসছি”।

“চলো, আমিও যাবো”।

দুই ভাইয়ে ব্রেকফ্রাস্ট করে উঠে গেলে রুদ্রদেব বললেন, “বুঝলে কিছু!”

সুহাসিনি দীর্ঘশ্বাস ফেললেন,

“নির্ঘাৎ প্রাক্তন প্রেমিকা”।

“সে তো বটেই, তবে মিথ্যাটা কি আঁচ করলে?”

“কী করে করবো বলো”।

“মেয়েটা বলেছে বহুকাল আগে সম্পর্ক ছিলো বছর সাতেক আগে, এবার?”

“সাত বছর আগের কথা এখন হঠাৎ করে উঠছেই বা কেন?”

রুদ্রদেব হাসলেন, “গভীর ষড়যন্ত্র – শুনলে না?”

“মানে?”

“না।কিছু না।পরে বলবো।যদি আমার অঙ্ক ঠিক হয় তবে তকটা মিরাক্যাল অন্তত বাধলো হিসাবের খাতা থেকে”।

“কী যে বলো তুমি,বুঝি না”। সুহাসিনী রাগ দেখালেন।

“অচ্যুতের সাথে যে মেয়ে মানুষটার সম্পর্ক ছিলো – চেনো তাকে?”

“কী করে চিনবো? দেখেছি নাকি?”

“কসবায় বাড়ি, চিনি আমি, বিবাহিত”।

“ছেলে মেয়ে?”

"এক ছেলে এক মেয়ে”।

“অচ্যুতের কী কেউ আছে?”

“না মনে হয়। ও স্বীকার করেছে?”

“না, বলেতো নেই”।

“কে জানে, তবে মুখার্জীদের মেয়েদের ব্যাপারে বদনাম – প্রজন্ম ধরেই চলে আসছে। তোমার শ্বশুরেরও কিন্তু কলকাতার বাজারে সুনাম ছিলো না”।

“এ প্রজন্মে অনুপম হলো”।

“দেখছি তো, তবে অনি, অতীন ভালো। ওয়ান উওম্যান ম্যান। লাইক মি। অমিতদাও তেমনি ছিলেন”।

সুহাসিনী প্রসঙ্গ ঘোরালেন, “অনিকে বলছো, গ্রামে যাবে?”

“বললাম”।

“কী বলল?”

“যাবে, তবে গিয়ে কতটা লাভ হবে, কনফিডেন্ট নয়”।

“তুমি কনফিডেন্ট তো!”

“আমার মন বলছে – ওখানেই সূত্র আছে”।

“চলো তবে”।

“যাবো,

তবে কবে সেটা কাউকে বলবে না, হুট করেই যেতে হবে”।

“বেশ”। সুহাসিনী অমত করেন না।


“রুদ্র –“

অচ্যুত খবরের কাগজটা পড়েই রুদ্রদেবকেই ফোন করলেন। “বল”।

“চেম্বারে, ভাই?”

“হ্যাঁ, বল, শুনছি”।

“কাগজ পড়েছিস?”

“অনুপমের খবরটা তো?”

“হ্যাঁ”।

“পড়েছি, বুঝেওছি। অনুপমের মুখ থেকেও শুনলাম”।

“কী বললো?”

“মেয়েটি মিথ্যা বলেছে তাই মেরেছে নাকি, মেয়েটির গোপন গভীর ষড়যন্ত্র এটা, পাপ”।

অচ্যুত চুপ করে থাকলেন।

“বছর সতেক আগে সম্পর্ক ছিলো, তাই না?”

কিছুক্ষণ পর বললেন অচ্যুত, “হ্যাঁ”।

“মানেটা ছোটগিন্নী বুঝেছে?”

“এটা সুহাসিনী বুঝবে বলে মনে হয় তোর? আমি বুঝেছি। তুইও বুঝেছিস, জানি”।

“ছোট বৌমা এত ভালো, এত ভদ্র-“

“এটা বিয়ের আগের ঘটনা। অনুপম বংশের ধারা রাখলো তবে”।

“ঠুকলি ভালোই, সুযোগ পেয়ে”।

“হ্যাঁ, ঠুকলাম! লজ্জা করেনা তোর? ঘরে অমন বৌ থাকতে কসবার মেয়ে মানুষটার সাথে – ছি!”

“বৌ – এর মন তো পাইনি কোনদিন রুদ্র, বৌ তো –“, অচ্যুত কোন ক্রমে বলেন।

“চেষ্টা করেছিস কখনো? আর বৌ তো – কী? আমাকে ভালোবাসে?”

“হ্যাঁ”। 

“বাসলেও কোনদিন তার পদস্খলন হয়েছে – নাকি আমার? ত্রিশ বছর তাকে ছুঁয়ে দেখিসনা – একদিনও আমার হাত ধরেছে? অথচ সুযোগ তো কম ছিলো না”।

“তোরা সৎ, ভালো – আমি মন্দ”।

“ভালো হ – কে মানা করেছে? থাক – বাদ দে”। 

“আজকাল ভালোলাগে খুব, জানিস?”

“কেন?”

“তুই আবার সেই আগের মতো খেয়াল রাখিস – ভুল ধরিয়ে দিস – বকাবকি করিস”।

রুদ্রদেব বন্ধুর কথায় হেসে ফেললেন।

“বেশ, দোষটা তবে আমারই। মাঝের বছর গুলো এগুলো করিনি বলে আমার প্রিয় বন্ধুটি বিগড়ে গেছিলো”।

অচ্যুতও হেসে ফেলেন এবার।

“তুই বিলাতে গিয়েও কোন মেমসাহেব পেলি না! কেমন বোকা ভাব”।

“সেই তো, আমি বোকা, ধজ – আর কি?”

“ধজ? মনে হয় না”।

“শালা! এই ব্যাপারেও সন্দেহ করিস?”

অচ্যুত বলেন, “ইয়ার্কি করলাম রে, রুদ্র।  ছোটগিন্নীকে বলিস না অনুপমের কথাটা, মরমে মরে যাবে”।

“সে জ্ঞান বুদ্ধি আমার আছে। তুই পেট পাতলা – তুই চেপে রাখিস”।

“ঐ জন্যই এত মিল, রুদ্র?”

“থাক, এ নিয়ে আর কথা না বলাই ভালো। যেটুকু জানলাম, বুঝলাম – থাক সেটুকুই। একটা সত্যি অনেকগুলো জীবনের সুখ শান্তি নষ্ট করতে পারে, মনে রাখিস”।

অচ্যুত বুঝলেন, “আমার এই বন্দী দশা, আর ক’দিন?”

“সবটা মিটুক, তুই বাড়ি থাকলে ভরসা পাই। নীরা, পরী, বাবিন – সবাইকে রেখেও যেতে পারি তাহলে”।

“পাহারাদার?”

“একদম, বাড়ির কর্তা সবচেয়ে বড় পাহারাদার, জানিস না?”

“বেশ, এই রুদ্র, বৌ আসছে – রাখি”।

“ভয় পাস?”

“তুই পাস না?”

রুদ্রদেব ভাবলেন একটু, “পাই না বললে ভুল হবে”।

“তাহলে?”

“ফোনটা রাখ, বকুনি যাবি এবার”।

অচ্যুত ফোন রেখে দিলেন।

শাওলিকে বড্ড কড়া ভাষায় কথাগুলো বলা হয়ে গেল কি? বাড়ি ফিরতে ফিরতে ফাবছিলো অনিরুদ্ধ। ও-ই ফাইনাল রিপোর্ট দেবে ফাদার অগাস্টিনকে। যদি নাকচ করে দেন ফাদার – ওর নেগেটিভ রিপোর্টের উপর ভিত্তি করে? বুঝতে পারছে না অনিরুদ্ধ। তবে না বলেও উপায় ছিলো না। নীরাকে নিয়ে আপত্তিকর কথা গুলো যখন বলে ফেললো শাঁওলি হিসাবি অনিরুদ্ধও রাগ ধরে রাখতে পারে। নীরা মানসিক রোগী। নীরা নর্মাল লাইফ লিড করার জন্য ফিট নয়। নীরার জন্য অনিরুদ্ধ বাবিন দুজনেই সাফায় করবে – এতটুকু পুচকে মেয়ের এসব বলার সাহস হয় কী করে! প্রতীকের বোন, বাচ্চা মেয়ে বলে অনিরুদ্ধ স্নেহ করতো, প্রশয় দিতো – তা বলে এরকম ভাবে ইন্টারফেয়ার করার সাহস হয় কী করে কে জানে! নীরাই ঠিক বলেছিল, মেয়েটা ঠিক নয়। নীরার মেয়েলি ঈর্ষা ভেবে গুরুত্ব দেয়নি অনিরুদ্ধ কিন্তু ভুল করেছিলো – এখন মনে হচ্ছে। ফাদারকে কি একবার বলবে এ ব্যাপারে, নাকি প্রতীককে? নাহ রাগের মাথায় কিছু করাটা ঠিক হবে না। বাড়ি পৌঁছে – ঠান্ডা মাথায় যা ডিসিশন নেবার, নিয়ে হবে।


পর্ব – ৩৯

আজ স্কুলেও বকুনি খেয়েছে অনিকেত, মিসের কাছে। ওর খাতা দেখে সিদ্ধার্থ লিখছিলো। মিস ওকেই বকে কমপ্লেন ডায়েরিতে কত কী লিখে দিলো। মিস অন্যদিন কত ভালো করে কথা বলে। টিফিনে বিস্কিট, চকোলেট, কেক দেয় – আজ কিছু দেয়ওনি। মামণিকে লুকিয়ে  অনিকেত খায় সেসব। মিস কষ্ট পাবে নইলে। অনিকেত জানে না মিস এত রেগে আছে কেন? আজ পড়াতে এসে মামণিকে সব বলে দেবে? তাহলে তো বিপদ। অবশ্য স্কুল থেকে ফিরেই কমপ্লেন ডায়েরিটা দেখাতে হবে। ছোট কাকামণির সাথে ফিরছিলো অনিকেত। কাকামণি আজ চুপচাপ ছিলো, মন ভালো নয় যেন।

“কাকামণি?”

“হ্যাঁ, বাবিন”।

“তুমি ভাইদের দেখালেই না”।

অনুপম বাঁ হাতে জড়িয়ে ধরলো অনিকেতকে, ডান হাতে ব্যথা এখন। 

“দেখাবো। ওরা বাড়ি ফিরুক”।

“তোমার হাতে লেগেছে?’

অনুপম থমকালো, “হ্যাঁ”।

“মারামারি করেছো?”

অনুপম চুপ করে থাকলো।

“কাকে মারলে?”

অনুপম দীর্ঘশ্বাস ফেললো। এর উত্তর ওর কাছে নেই।

“মারামারি করা ভালো না”।

“করব না, আর”।

“তুমি খাচ্ছো কী করে? ডান হাত ব্যথা”।

“বাঁ হাতে”।

“এমা! দাঁড়াও – তুমি বাড়ি চলো – আমি খাইয়ে দেবো তোমায়”।

অনুপমের চোখে জল চলে আসে,

“দিবি বাবা, সত্যি?”

“দেবো তো, বাড়ি চলো”

অনুপম চুমু খায় অনিকেতকে। একসাথে অনেকগুলো।

“তুমি কাঁদছো, কাকামণি?”

অনুপম চোখ মুছলো, “একটু”।

“কেন?”

“কেউ আমাকে কখনো খাইয়ে দেবে বলেনি যে”।

“ঠাম্মা?”

“ঠাম্মা দিতো, খুব ছোট বেলায়। তারপর থেকে নিজে। কেউ খাইয়ে দিক পছন্দ ছিলো না। সব কাজ নিজে করে চটপট বড় হতে চাইতাম”।

“এমা, বাপিকে তো ঠাম্মা কত্ত বড় অবদি খাইয়ে দিতো শুনেছি”।

“দাদাভাই যে তোর ঠাম্মার সবচেয়ে ভালো, সবচেয়ে আদরের ছেলে”।

“বাপিও ভালো, তুমিও ভালো”।

অনুপম অনিকেতকে কোলে তুলে নিলো, এক হাতেই, “সত্যি?”

“কত্ত খেলো, কত্ত ঘোরাও …”।

অনুপম বললো, “আমাকে কেউ এই প্রথম ভালোও বললো”।

“তুমি তো ভালোই, আমার ভালো কাকামণি”।

অনিকেত কাকামণির গলা জড়িয়ে ধরলো। অনুপমের মন কানায় কানায় ভরে গেলো যেন।


“কমপ্লেন ডায়েরিতে কী লেখা এটা?” 

নীরা ডায়েরিটা পেয়েই রেগে গেলো।

“আমি দেখিনি কারোর থেকে মামণি – ওরা দেখছিলো ……”।

“ওরা?”

“সিদ্ধার্থরা …”।

নীরা, অনিকেত স্কুল থেকে ফিরলেই কমপ্লেন ডায়েরি, হোমওয়ার্কের খাতা, টেস্টের রেজাল্ট দেখে নেয়।

“তুই ঢেকে লিখতে পারিস না?’

“লিখেছি …… ওরা উঁকি মারে”।

“কেয়ারলেস, আনটাইডি – বাহ। কত ভালো ভালো এডজেকটিভ।"নীরা ছেলের কান ভালো করে মুলে দিলো।

“কমপ্লেন ডায়েরিতে আর কোনদিন কিছু লেখা এলে তোর কী হয়, দেখিস”।

নীরা কড়া চোখে তাকিয়ে বললো, অনিকেত চুপ করে ছিলো। চোখ দিয়ে জল পড়ছিলো শুধু। 

নীরা বলল, “আবার কান্না! চোখ মোছ! মার খেতে যদি না চাস”।

অনিকেত চোখ মুছে ফেললো। নীরা কান ধরে ডাইনিং থেকে টানতে টানতে ঘরে আনলো, চেঞ্জ করাবে।

“অসভ্য, বাঁদর ছেলে হচ্ছিস দিনে দিনে। ক্লাসে প্রপারলি বিহেভ করছিস না”।

নীরা রাগে গজগজ করছিলো। 

“ওষুধটা বন্ধ হোক, তোর স্কুলে যাবো আমি। সবটা আমাকেই দেখতে হবে”।

অনিকেত ভয় পাচ্ছিলো খুব। নীরা চেঞ্জ করালো। তারপর বলল, “খাবি চল”।

অনিকেত চুপ করে থাকলো, “কী হলো?”

“আমাকে এট্টু কোলে নেবে, মামণি?”

নীরার মন এই একটা কথাতেই ভিজে গেলো। ছেলেটা এমন আবদার তো কোনদিন করেনি। এক মুহুর্ত দেরি না করেই কাছে নিলো।

“মন খারাপ?”

“মিস খুব বকেছে স্কুলে তুমিও ………”

নীরা কোলে তুলে নিলো। চুমু খেলো দুগালে।

“আর বকছি না”।

অনিকেত মামণিকে জড়িয়ে ধরলো। শাসনের সাথে সাথে কখনো আদরেরও প্রয়োজন থাকে। নীরা ভালোই বোঝে সেটা এখন। একতরফা কোন কিছুই ভালো নয়।


“কাকামণিকে বাবিন খাইয়ে দেবে?”

সুহাসিনী অনিকেতের কথা শুনে হেসে ফেললেন।

নীরা বললো, “ঠাকুরপো, হাতে লাগিয়ে ভালোই হয়েছে তাহলে। এমন সুন্দর প্রস্তাব পেলে”।অনুপম হাসলো,"ভাবো তো,

ও কতটা ভেবেছে ব্যাপারটা নিয়ে ভেবেছো! ডানহাতে ব্যথা – কী করে খাবে – ঐটুকু ছেলে এতটা ভেবেছে এই অনেক”।

“বাবিন- খাইয়ে দে তবে কাকামণিকে”।

পরীরও ঘুম ভেঙ্গে পিয়েছিলো।

“আমিও দেব, জেঠিমণি”।

সুহাসিনী বললেন, “বাবার সাথে সাথে মা-ও চলে এসেছে খাওয়াতে”।

অনুপম হাসলো, “তাই তো দেখছি। পরী, আয় কোলে বস কাকামণির”।

মণিপিসি এলেন, “মণি, ছোটখোকা খাবে”।

“খাবার আনবো, ছোটবৌদি?”

“আনো, ছোটখোকা – তুই তোর ছোট্ট মা-বাবা দুজনকেই কোলে নিয়ে বস। আমি খাইয়ে দিচ্ছি”।

“তুমি!” অনুপম অবাক হয়।

“কেন? ছোটবেলায় খাওয়াতো কে?”

“বেশ, খাওয়াও, হাতে চোট লেগে ভালোই হয়েছে তবে”।

“তুই তো নিজেই ছোট থেকে খেতে চাইতিস না। জানো নীরা,ছোট থেকেই সব একা করবেন উনি। দাদাভাই, দাদা-এরা সব আমার হাতে ছাড়া খেতো না – উনি ছোট থেকেই একা”।

“ঠাকুরপো, কী শুনছি সব?”

“বৌদিমণি, আমি একটু অদ্ভুত, এই নিয়ে মায়ের চিন্তার অন্ত ছিলো না – এখনো নেই। তবে এখন বদলাতে চাইছি। সেটা বুঝেই মনে হয় খাইয়ে দিচ্ছে”।

মণিপিসি খাবার প্লেটে সাজিয়ে নিয়ে এলে সুহাসিনী খাওয়াতে শুরু করলেন।

“ছোট ছেলেটা হয়ে দায়িত্ববোধটা এসেছে, বুঝলে নীরা?”

অনুপম বললো, “নাহ, দাদাভাইকে দেখে। দাদাভাই সবার দায়িত্ব কেমন নিজের কাঁধে নিয়ে চলেছে দেখছি। তাই ভাই হয়ে এটুকু সাহায্য করতে চাইছি”।

সুহাসিনী কিছু বললেন না আর।ওনার অনির মতোই বাকি ছেলেরাও হোক,এটাই চেয়েছেন বরাবর।নীরা মনে মনে খুব খুশি হলো।


পর্ব – ৪০


ভোরে উঠেই নীরা জানলো  আজ অনিরা গ্রামে যাচ্ছে। অনি, ডাক্তারকাকা, কাকিমণি। কাকাও উঠে পড়েছেন। উনি বাড়িতেই থাকবেন। ছোট ঠাকুরপো কাল রাতে এখানেই ছিলো। ঠাকুরপোও সবসময় বাড়িতে থাকবে। পরীকে,অনিকেতকে নীরাকে পাহারা দিতে। হঠাৎ বেড়িয়ে যাচ্ছে জরুরি  কাজে এমন ভাব করেই বেরোচ্ছে সবাই। অনিকেত, পরী যেমন স্কুলে যায় – যাবে। কোন অস্বাভাবিকতা, উদ্বেগ আচরণে প্রকাশ পেলে চলবে না। কোথায় গেছে অনিরা, সেটা জানানো যাবে না – কাউকেই। নীরার একটু ভয় করলেও মনকে শক্ত করলো। এতে যদি বাবিনের খুনি ধরা পড়ে তাহলে তার থেকে ভালো কোন কিছুই হবে না। ডাক্তারকাকা বুদ্ধিমান মানুষ উনি যদি মনে করেন – রহস্যর উৎসস্থল গ্রাম – তবে তাই হবে। অনিরুদ্ধ যাবার আগে পই পই করে বলে গেছে – যদি কিছু মাত্র সন্দেহ হয় কারোর চলচলনে, সাথে সাথে ফোন করে জানাতে। ওরা রাত সাতটা থেকে আটটায় মধ্যে চলে আসবে তার বেশি দেরি করবে না।


অনিকেত স্কুলে যাবার সময় রেডি হতে হতে মামণিকে বললো।

“মামণি -বাপি, ঠাম্মা কই?”

“একটু বাইরে গেছে”।

“বাইরে কোথায়?”

ব্রেকফার্স্ট টেবিলে সার্ভ করেছিলো নীরা। কাকা, ছোট ঠাকুরপো খাচ্ছেন। পরী ঘুমচ্ছে এখন, ছেলেকে নিয়ে ব্রেকফাস্ট টেবিলে বসালো নীরা। মণি পিসি চা করবেন, রান্নাঘরে।

“কোথায় গেছে?”

“ঠাম্মার বাপের বাড়ি”।

নীরা কিছু বলার আগেই অচ্যুত বললেন।

“কোথায় সেটা?”

“নর্থে, ঠাম্মার খুড়তুতো ভাই খুব অসুস্থ তো, দাদুভাই, তাই গেছে”।

“আচ্ছা, দাদুভাই, তুমি গেলে না? তুমি অসুস্থ, তাই?"

“ঠিক বলেছিস, তুই স্কুল থেকে ঘুরে আয়। আমি গল্প বলবো তখন – ঠাম্মার বাপের বাড়ির”।

“ঠাম্মার বাপের বাড়ি মানে তোমার শ্বশুর বাড়ি?”

অনুপম হেসে ফেললো। নীরা বললো, “ঠাকুরপো – দেখলে তো কেমন পাকা?”

“দেখছি তো তাই বৌদিমণি”।

অচ্যুত বললেন, “সমঝদার ছেলে আমার দাদুভাই। অনিও এমন ছিলো ছোট বেলায়”।

“বৌদিমণি – এটা মা, বাবার পছন্দের টপিক, তাদের অনি। আর তার ছোটবেলা, মাঝে যে বারো-তেরো বছর আলাদা ছিলাম – তখনও কথায় কথায় এই কথাটা শুনতেই হতো”। 

অচ্যুত বললেন, “সে তো শুনতেই হবে, যে ভালো তার কথা মনে থাকে সবসময়। সে কাছে থাকুক আর দূরে থাকুক। বিলেতে গেছে পড়তে আমাদের বাবু, সে নিয়েও তোর মা কম চিন্তা করতো?”

“সত্যি, জেঠিমণিকে কোনদিন এত চিন্তা করতে দেখিনি, দাদাভাইকে নিয়ে”।

বলেই অনুপম বৌদিমণির দিকে তাকালো। কথাটা বৌদিমণি কীভাবে নেবে ……।

“ছোটখোকা, বৌদির আর ছোটগিন্নীর ব্যাপারটা পুরোই আলাদা। এই তো – মণিই দেখেছে ওর দুই বৌদিকে। মণি বল?”

মণিপিসি বললেন, “হ্যাঁ, তাছাড়া বড়বৌদি খোকন মারা যাবার পর থেকেই একটু কেমনতর হয়ে গিয়েছিলেন। সবসময় বাইরে বাইরে মন। অনিরও যত্ন নিতেন না। সব মা ঠাকুরুণ এর উপর ছিলো। ছোটবৌদি বিয়ে হয়ে না এলে অনিটার যে কী হতো ………”। 

অচ্যুত মুচকি হাসলেন, “শুনলে, নীরা?”

“জানি তো, অনি এটা সবসময়ই বলে”।

অচ্যুত বললেন, “বিয়ের পরেই মা তোমার কাকিমণির কোলে অনিকে দিলেন। ব্যাস, ওখানেই অনির মা হয়ে গেল সে”।

অনুপম বললো, “দাদাভাইকে তুমিও কম ভালোবাসো না, বাবা। কেও না জানুক, আমি জানি”।

অচ্যুত হেসে উঠলেন, “সে বাসলেও – বাপেরা কবে নাম পেয়েছে? যত সুনাম তো মায়ে রাই নিয়ে নেয়”।

নীরা অনিকেতকে বললো, “ব্যাগ ঠিকঠাক গুছিয়েছিস তো?”

“হ্যাঁ, মামণি”

“চল, খাওয়া শেষ। কাকামণির সাথে স্কুল যা। আমি বোনকে তুলে পড়িয়ে নিই। তারপর রেডি করে স্কুলে পাঠাই”।

অনিকেত উঠে হঠাৎ অচ্যুতকে প্রণাম করলো, তারপর মামণিকে, কাকামণিকে করতে যাবে – 

অনুপম বলল, “প্রণাম কেন বাবু?”

“মর‍্যাল সায়েন্স বলেছে বড়দের প্রণাম করতে হয় সকালে উঠে”।

“বড়দের?”

“না – গুরুজনদের”।

অনুপম বলল, “বৌদিমণি , তোমার এই ছেলে একদিন বাড়ির সবচেয়ে ভালো ছেলে হবে, দেখো, দাদাভাই – এর মতো ওরও উদাহরণ দেবে – সবাই”।

নীরা বলল, “তাই যেন হয়, ঠাকুরপো”।

নীরার বুক গর্বে ভরে গেলো।



পর্ব – ৪১


পরশু বিকাল থেকে অনেক ভেবেছে শাঁওলি। অনিদার কথাগুলো নিয়ে। এখনো কথা গুলো কানে বাজছে। ঐ বৌকে নিয়ে এত সেন্সিটিভ অনিদা! বাপরে! কী এমন খারাপ বলেছে শাঁওলি! মানসিক রগীকে মানসিক রুগী বলবে না তো কী বলবে? যে মহিলার নিজের আচরণ সংযত নয় সে অনিকেতকে মানুষ করবে কী করে? ফাদারকে একবার পুরো বিষয়টা আবার জানাবে ভেবেছিলো শাঁওলি। কিন্তু যদি অনিদা ফাদারকে অন্যভাবে ব্যাপারটা জানিয়ে রাখে! পরশু থেকে তো অনিদার কাছে স্পষ্ট শাঁওলির দুর্বলতা। এসব নিয়েই ফাদারকে যদি কিছু বলে রাখে তবে এখন মুখ খুলতে গেলেই শাঁওলির বিপদ।অ্যাডপশন তো ক্যানসেল হবেই না – বরং শাঁওলির চাকরি যেতে পারে। অনিদা দাদাভাইকে বলবে ভেবেছিলো শাঁওলি। সেটাও বলেনি। তবে কি উপরে উপরে রাগ দেখাচ্ছে আর তলায় তলায় অনুরাগ? পুরুষ মানুষ নারকেলের মতো নয়। মা,বড়মা, বৌদিমণি সবাই বলে, উপরটা কঠিন-ভিতর নরম। অনিদার মনে ঠিক কি আছে। জানতে গেলে আরো কাছে যেতে হবে শাঁওলিকে। আর সেটা তখনই সম্ভব যখন নীরা নামের ভদ্র মহিলা চিরতরে সরে যাবে। কিন্তু কী করে?


ভাবতেই চিঠিটার কথা মনে পড়ে শাঁওলির। দিন পনেরো আগেই অনিকেতকে পড়িয়ে ফিরে একটা চিঠি পেয়েছিলো শাঁওলি। ওর ব্যাগে ঢোকানো। সাথে একটা প্যাকেট, আগাছালো হাতের লেখায় চিঠিতে লেখা আছে – “অনিরুদ্ধ পেতে গেলে নীরাকে সরাতে হবে। নীরা তখনি সরবে যখন বাবিনের ক্ষতি হবে আর নীরা হবে খারাপ। ক্ষতি করতে প্যাকেট দেখো। বাবিনকে খাওয়াবে। বড় ক্ষতি হবে না। কিন্তু নীরার এ বাড়িতে থাকা শেষ হয়ে যাবে”। প্যাকেট খুলে দুটো লজেন্স পেয়েছিল নীরা মোড়কে মোড়া। তার মধ্যে কী আছে তা নিয়ে তখন মাথা ঘামায়নি। কারোর মস্করা ভেবেছিলো এটাকে। অথচ কাউকে বলেওনি। আজ ভাবছে শাঁওলি। মন দিয়েই ভাবছে। যে লিখেছে তার যুক্তির অভাব নেই। অনিদার আগের বাচ্চাটা মারা গেছিলো বলে নীরার এই অবস্থা, এবার তাই অনিকেতকে কারোর কাছে ঘেষতেই দে না। সর্বক্ষণ আড়াল করে রাখে। তার মধ্যেই যদি অনিকেতের কিছু হয় – তবে নীরার নজরদারিরই দোষ হবে। মহিলার অহংকার, দম্ভ ভাঙ্গবে, পাগল মহিলা তবে মানসিক স্থিরতা হারিয়ে আসবে এসাইল্যামই যাবে। শাঁওলি সেই জায়গায় নিজেকে বসাতে পারবে, সহজেই।


লজেন্স দুটো স্কুলে আজ নিয়ে এসেছে শাঁওলি। টিফিনে অনিকেতকে পেস্ট্রি, চকোলেট, কেক খাওয়ায় ও। শুধু কালকেই রাগ করে খাওয়ায় নি। বকেওছে। আজো তাই মিসকে দেখে জড়োসড়ো হতে নিয়ে দেখলো শাঁওলি। বড়ো কোন ক্ষতি হবে না লিখছে, যদি মরে যায়? না, না, সেরকম কিছু হবে না। তবে কি একটা লজেন্স খাওয়াবে? অনিকেতকে শাঁওলিও ভালোবাসে। বড় ক্ষতি হোক চায় না। শুধু এটা চায় ঐ মহিলার অপদার্থতা ধরা পড়ুক। ছেলে মাত্র দুনম্বর কম পাওয়াতে ঐরকম অপমান করেছিলো মহিলা। এবার নিজে অপমানিত হোক। আগলে, দেখে না রাখতে পারার অপরাধে।অনিদার কলজের টুকরো এই ছেলে। এর কিছু হলে অনিদা কাউকে ছাড়বে না কাউকে না। সেই সুযোগে সুহানুভুতি দেখিয়ে মুখার্জী বাড়িতে ঢুকবে শাঁওলি, বৌ হয়েই ঢুকবে, এতো কোটি কোটি টাকার সম্পত্তি সামনে পড়ে থাকতে নেট দিয়ে প্রফেসর হবে শাঁওলি। হা!হা! বৌদিমণি ও ভালো বলে। প্রফেসরির সামান্য টাকায় শাঁওলির উচ্চাকাঙ্খা মেটার নয়। ও যা চায় তা একমাত্র হতে পারে মিসেস শাঁওলি অনিরুদ্ধ মুখার্জী হলে, তবেই। মোবাইলে অনিদার ছবির ফোল্ডারটা খুললো শাঁওলি। চুমু খেলো ছবিতে অনেক করে, অদ্ভুত ভালো লাগছিলো ওর, অদ্ভুত।


“কাল টিফিনে ডাকোনি”।

অনিকেত এসে প্রথমেই এই কথাটি বললো। শাঁওলি কান ধরলো।

“সরি”।

“এমা! তুমি তো বড় – মিস”।

“বড়রাও ভুল করে, তো”।

“কী এনেছো আজ?”

“আজ – কেক, লজেন্স দুটোই আছে। কোনটা আগে খাবি”।

“কেক”।

“তোর টিফিন?”

“ক্লাসে ভাগ করে খেয়ে নিয়েছি”।

“গুড বয়, এখন কেকটা খেয়ে না দেখি”।

অনিকেত খেয়ে নিলো।

“কাল ডায়েরির লেখা দেখে বাড়িতে কি বললো?”

“মামণি কানমলা দিয়েছে। বলেছে আর এমন হলে মারবে”।

শাঁওলি হাসলো।“তোমার জন্য কানমলা খেলাম আর তুমি হাসছো?”

শাঁওলি অনিকেতকে চুমু খেলো, দুগালে। 

“লজেন্স?”

“দিচ্ছি”। শাঁওলি একটা লজেন্স দিলো, অনিকেত খেয়ে নিলো। 

“কেমন খেতে?”

“ভালোই তো অন্যরকম। আর আছে গো?”

শাঁওলি একবার দেবে ভাবলো – তারপর বললো। “না, কাল দেবো”।

“আচ্ছা”। “ক্লাসে যা”

“ওকে মিস”। “বাই”। “বাই”।


পর্ব – ৪২


বাগদেবীপুর গ্রামে এসে রুদ্র, অনি, সুহাসিনি বুঝেছিলেন – খবর একদমই সঠিক। মুখার্জীদের বড় তরফের অবস্থা পড়তির দিকেই। ভাঙাচোরা পলেস্তরা খসা বাড়িতেই থাকে সবাই – অচ্যুতের জেঠার দুই ছেলে, সুপরিবারে। দুই জনেরই দুটো করে ছেলে,একটা করে মেয়ে। মেয়েদের বিয়ে হয়ে গেছে। ছেলেদেরও। পরের প্রজন্মের চারছেলের মধ্যে বড় তরফের দুজনের মেয়ে, একটা করে, ছোট তরফের একজনের মেয়ে, ছোট জনের ছেলে। মাস সাতেকের। বাড়িতে দূর্গা দালান আছে। অনিদের বিক্রি করে যাওয়া অংশটা জরাজীর্ণ। জঙ্গল গজিয়ে গেছে। বহুদিন এরা হাত দেয় না। ভিতরে সাপখোপ থাকবেই। সদর ফটকের ডান ধারেই চাকরবাকরদের ঘর ছিল।এখন সেখানকার পুরোটাই দখল করে থাকে মণিপিসির ভাই বিপ্লব আর বৌ ছেলে মেয়ে। গ্রামের বাজারে মুদির দোকানও করেছে সে। গ্রামের বাজার থেকে বাড়ি অবধি পথ দেখিয়ে সে-ই নিয়ে এলো। অনিদের এই গ্রামে যা কিছু জমি এই বিপ্লবই দেখে রাখে।


অনিদের হঠাৎ আসতে দেখে ওরা অবাক। তবুও আপ্যায়ন করেছে।সকালে জলখাবার, দুপুরে মাছ ভাত, গ্রাম ঘুরিয়ে দেখালো, নদীর ধার, পুকুর পাড়, জমিজমা – সবই ঘুরিয়েছে বড়তরফের ছোট ছেলে অসীম। অনিদের জমি জিরেতও দেখিয়েছে। বিপ্লব ওখানে চাষ করে। অসীমেরর দাদা অসিত গ্রামের স্কুলেই প্যারাটিচার। তাকে স্কুলে যেতে হলো। ছোট তরফের দুই জনের বড় একজন মালদা থাকে। ওখানে বিডিও অফিসে কাজ করে। আর ছোটজনের চানাচুর কারখানা। সদ্য শুরু করেছে। ওরই যা দুপয়সা হচ্ছে। সংসার এখনো যৌথ। অসীমই জমি জিয়েত, পুকুর দেখাশোনা করে, বাকি অসিত, অভিজিৎ, অনিল নিজের নিজের কাজে ব্যস্ত থাকে। বৌ, ঝিরা সবাই বাড়িতেই থাকে। তারা গ্রাম্য, শহুরে সুহাসিনীকে দেখে তাদের পলক পড়ছিলো না। অসিত, অসীমের বাবা অক্ষয় অচ্যুতেরই বয়সী। ছোটজন অবিনাশ বছর দুয়েকের ছোট। অক্ষয় তো বলেই ফেললেন, 

“তোমরা এখানে এসেছ, একসাথে বসে গল্প করছো, খাচ্ছো – ভাবতেই পারছি না। মায়ের মুখে শুনেছি আমাদের ছোটকাকা অমিতদা ছোট থাকতেই সেই যে চলে গেলেন ………”। 

অমিত অনিরুদ্ধর বাবার নাম। 

“হ্যাঁ, কলকাতায় ব্যবসা জমে গেলো ঠাকুরদার … আর বসবাস করতে এখানে ফেরেননি”।

“শুধু ব্যবসা নয় – অভিশাপের ভয়ও। শুনেছি আমাদের বড়দার মারা যাওয়াটা কাকাকে খুব ভয় পাইয়ে দিয়েছিলো। অভিশাপটার সামনে নিজের সন্তানদের ফেলতে চাননি”।

“অভিশাপ? কিসের অভিশাপ?”

রুদ্রদেব জেনেও না জানার ভান করলেন। 

“ঐ একটা গ্রাম্য বিশ্বাস, এক তান্ত্রিক নাকি আমার ঠাকুরদার বাবাকে অভিশাপ দিয়েছিলেন – প্রজন্মের প্রথম পুত্র সন্তান – মারা যাবে, কিছুটা বড় হয়েই। মুখে রক্ত উঠে নাকি সেই মৃত্যু হবে। দাদার পর যদিও এমন মৃত্যু আর হয়নি এখানে – তার না?”

অবিনাশ বললেন, “না, তা হয়নি”।

সুহাসিনী বললেন, “শুধু কী অভিশাপ, নাকি তন্ত্রমন্ত্র এসবও?”

“তখন এরকম একটা কানাঘুঁষো ছিলো যে ডাইনে মেরেছে। এই গ্রামে ডাইন চর্চাও হতো তখন,কিন্তু …”, বলেই থমকালেন অক্ষয়।

দরজার দিকে দেখলেন।

“কিন্তু?”

“মন্দিরের পুরোহিত মানে বিপ্লবের বাবা উধাও হয়ে যেতেই তন্ত্র চর্চার আর প্রমাণ পাওয়া যায় না গ্রামে”।

অনিরুদ্ধ বললো, “মানে মণিপিসির বাবা? উনি তন্ত্র করতেন নাকি?”

“ঠিক ঠিক। মণির বাবা। মণি তো সেই ছোট থেকেই তোমাদের ওখানে থাকে। মাঝে মাঝে এখানে আসে ন মাসে ছ মাসে”।

“উনি তন্ত্র করতেন?”

“শোনা কথা, তন্ত্র না, ডাইন চার্চা, তোমার ডাকিনী বিদ্যা বল যাকে। সেই পাগল পুরোহিত উধাও হয়ে যাবার পর – আর ডাইন চর্চা হয় না এখানে”।

সুহাসিনী বললেন, “কাউকে পিটিয়ে মেরে ফেলা হয়েছিল কি – ডাইন সন্দেহে?”

অক্ষয় অবিনাশ দুজনেরই মুখের রং বদলে গেল।

“কে বলেছে?”

“আমরাও শুনেছি – শাশুড়ির মুখেই”।

ইচ্ছা করেই মণির কথাটা বললো না সুহাসিনী। 

“না, না – অপবাদ ওটা”, অক্ষয় বললেন।

“ওহ”।

“মণির মা রাধুনী বামণী ওর বাবাকে খুঁজে না পেয়ে রটিয়েছিলো যে পুরোহিতকে আমার বাবা লেঠেল দিয়ে মেরে দিয়েছেন – ডাইন অপবাদ দিয়ে। দাদাকে ওর বাবাই তন্ত্র করে মেরেছিলো এটা আমার বাবা সন্দেহ করেছিলেন বটে, তবে আমরা সেসব মানি না। পরে কোন প্রমাণ উদ্ধারও হয়নি। পুরোহিত এখনো পুলিশের খাতায় নিখোঁজ”। "বাবা তো বটেই আমরাও এখন মানি পুরোহিতের সাথে সেই তান্ত্রিকের শিষ্যপরম্পরায় কোন যোগ ছিল নিশ্চয়। ওই তান্ত্রিকের ডাকেই চলে গেছে”।

সুহাসিনী কিছু বলতে যাচ্ছিলেন, রুদ্রদেব থামালেন।

“থাক। অত পুরনো কথা ঘেঁটে কী হবে”।

“ঠিক তাই, বরং অসীমের সাথে নদীর ধারটা ঘুরে এসো। থাকবে তো আজ সবাই?”

“না, না, ফিরতে হবে”।

“আচ্ছা, তা হলে বিকাল বিকাল রওনা দেওয়াই ভালো”।

“একদম”। অনি উঠে দাঁড়ালো।

“আচ্ছা কাকা, আমার ঠাকুরদা কি কখনোই ফেরেননি এখানে?”

“এক দুবার এসেছিলো। মণিকে নিতে একবার, মনে আছে”।

“ঠাকুমা আস্তে চাইতেন – ঠাকুরদা আসতেন না। আমাদের বাবা, কাকাকে, আমাকে আসতে দেননি ………”। 

অবিনাশ বললেন, “লোকে বলে,কাকার নাকি মেয়ে ছেলে নিয়ে সমস্যা হয়ে ছিলো একটা, গ্রামেই। অভিশাপের ভয়ে না – কোন মেয়ে মানুষের পেট বেঁধে গেছলো বলেই ………”।

অনিরুদ্ধর কান লাল হয়ে গেলো।

“মেয়ে মানুষ কে? কোন গ্রামের মেয়ে,নাকি চাকরানী?” রুদ্রদেব জিজ্ঞাসা করলেন। 

“অমূল্য মুখার্জীর কেচ্ছা তো পুরো বাগদেবীপুর নয়, পুরো বীরভূম জানে”।

অক্ষয় বললেন, “তোমার ঠাকুরদা, কি আর বলি। তবে শুনেছি মেয়ে মানুষ পটাতে সময় লাগতো না একদমই”।

সুহাসিনী বুঝলেন কেন শাশুড়ীমা অনুপমকে অপছন্দ করতেন। ঠাকুরদার মতো দেখতে আর স্বাভাব – প্রায়ই বলতেন।

“দশ বিশ গ্রামে এমন কোন সুন্দরী মেয়ে ছিলো না যাকে অমূল্য পেয়ে ছাড়েননি”। অক্ষয় হাসলেন।

“আমার বাবা অখিল মুখার্জী অবশ্য অন্য ধরণের ছিলেন। মেয়েছেলেতে ……”। 

“তোমার বাবারও তো শুনেছি রাঁধুনি বামণির সাথে……”।

অক্ষয়ের বৌ মুখ খুললেন।

“আঃ ওসব রটনা, ঘর দখলের জন্য। রাঁধুনি বামনি তো এই করেই পুরো চাকর মহলটা দখল করে নিলে! ”।

“রাঁধুনি বামনি মানে মণিপিসির মা?”

“হ্যাঁ – বর নিরুদ্দেশ, দুশ্চরিত্র মেয়েছেলে আমার বাবার নামে অপবাদ দিয়ে ………”।

রুদ্র বুঝলেন আর কথা বাড়ানো ঠিক নয়।

“তাহলে নদীর ধারেই যাই, নাকি”।

“একদম”।


চারটে নাগাদ নীরার ফোন পেয়ে অস্থির হলো অনিরুদ্ধ, বাবিনের পেট খারাপ? জ্বর এসেছে? বার বার পায়খানা করছে? পেট ব্যথাও ……”।

রুদ্র ফোনটা চাইলেন, “নীরা – কী হয়েছে?”

“কাকাবাবু স্কুল থেকে এসেই ছেলেটা পেট ব্যথা বলছিলো, এখন তিনবার পটি গেলো। খুব গন্ধ, জ্বরও এসেছে। মাথাব্যথা নাকি”।

রুদ্র বললেন, “নীরা – যা বলছি শোনো, এক্ষুনি আমি একটা নাম্বার দিচ্ছি। আমার বন্ধু প্রদীপ্তর। নামী পিডায়াট্রিশিয়ান। ওর ঠিকানাটাও আমি তোমাকে দিচ্ছি। ফোন করে চলে যাও বাবিনকে নিয়ে এখনি”।

“এখনি?”

“হ্যাঁ এখনি, একমুহুর্তও দেরি করবে না। আমি ফোন করে দিচ্ছি”।

ফোন কেটে ফোনটা অনিরুদ্ধকে দিয়ে নিজের ফোন থেকে ডায়াল করা শুরু করলেন। 

“রুদ্র, কী হয়েছে। বাবিনের কি হয়েছে?” সুহাসিনী অস্থির হলেন।

“হ্যালো, প্রদীপ্ত, তুই ক্লিনিকে তো? ওকে, আমার নাতিকে নিয়ে যাছে আমার বৌমা – হ্যাঁ অ্যাবডোমিন্যাল ক্র্যাম্প, ডায়েরিয়া, হেড এক – হুম …… তোকে তো বলে রেখেছি আমার সন্দেহটা – হ্যাঁ – ইমিডিয়েটলি ল্যাভাজ করে অ্যান্টিডোট দে ………। হ্যাঁ আমি শিওর – তাও তুই দেখে নে”।

“কাকাবাবু – কী হলো ………।“

“অনি, যেতে যেতে বলছি – ফিরতে হবে আমাদের, এখনি”।

অসীম অবাক হচ্ছিলো, “চা না খেয়েই”।

“হ্যাঁ, অসীম তুমি ছুটে গিয়ে ড্রাইভারকে ডেকে দাও”।


গাড়িতে উঠে কিছুটা গেছে ওরা, হঠাৎ সামনে বিপ্লব পড়ল। সাইকেলে আছে সে। অনিরুদ্ধ খেয়াল করলো ও হাত নেড়ে জানলা নামতে বলছে”।

“বলো……”।

“চলে যাচ্ছেন?”

“হ্যাঁ”।

“কী বললো ওনারা?”

“কীসের কী?”

“ওদের বাপ সাধুপুরুষ তাই না? আর আমার মা বেবুশ্যে। তাই তো?”

“কী বলতে চান?”

“বলতে চাই – ওদের বাপ আর আমার বাপ এক – তাই থাকতে দিয়েছে – অংশও দিয়েছে”।

চমকে ওঠে অনিরুদ্ধ, খেয়াল করে বিপ্লবের শার্টের ফাঁক দিয়ে গলার রুদ্রাক্ষর মালা দেখা যাচ্ছে। চোখ দুটো টকটকে লাল, মদ খেয়েছে? নাকি ও – ও কি তন্ত্র সাধনা করে!

“মণিপিসির বাবা তবে হারিয়ে যায়নি ?”

বিপ্লব হো হো করে হাসে। 

“মণিপিসির বাবা! ভালো বললেন তো! মণিপিসির বাবা কে? যাক গে – আমার মায়ের বর – রাধুনী বামনীর বর হারিয়ে যায়নি। পিটিয়ে মেরে দিয়েছিলো এরা, ডাইন অপবাদে। বড় কর্তার বড় ছেলেকে মেরে ফেলার অপবাদে। অথচ রাগটার কারণ অন্য ছিলো। পুরোহিত লোকটা আলা ভোলা হলেও জেনে গেয়েছিল বড়কর্তা আমার মা’কে জোর করে ভোগ করার ফল আমি – আর পোয়াতি মা’কে সে জমিদারের অপরাধের প্রমাণ হিসাবে গ্রামের লোকের সামনে নিয়ে যাবে ঠিক করেছিল – আর আগের তিনমাস তো লোকটা বাড়িই ছিলো না – উধাও ছিলো – আর মা তিনমাসেরই পোয়াতি ……… জমিদারবাবু এক মানসম্মানের ভয়েই পিটিয়ে মেরে দেয় লোকটাকে, লেঠেল দিয়ে। আর রটিয়ে দেয় যে লোকটা হঠাৎ  উধাও হয়ে গেছে”।

“তোমাদের মারলো না কেন? বাঁচিয়ে রাখলো যে?” রুদ্রদেব বলেন।

“রাধুনি বামনীর রুপের জোলুস বড়কর্তার চোখে লেগেছিল যে”।

বিপ্লব অদ্ভুতভাবে হাসলো। 

“পিটিয়ে মেরেছিলো? ঠিক জানো?”

বিপ্লব কাশলো, “আমি তো পেটে তখন তবে সাক্ষী আছে, নিজে চোখে দেখা সাক্ষী। সে জীবিত আছে। আমার মা নয়, সে মরেছে, আরো একজন আছে”।

“কে সে?” 

বিপ্লব হাসলো, “সব আমি বলে দিলে আপনারা কী খুঁজবেন – ডাক্তারবাবু? বাড়ি যান। যত তাড়াতাড়ি পারেন – যান। এখানে আর ফিরবেন না কোনদিন। চেষ্টাও করবেন না”।

বিপ্লবের কথায় এমন কিছু ছিলো গাড়ির সবাই চুপ হয়ে গেলো।



পর্ব – ৪৩


নীরা নার্সিংহোমে নিয়ে পৌছলো অনিকেতকে। ডাক্তার প্রদীপ্ত ভর্তি হতে বলেছে। ইমিডিয়েটলি। অনিদের ফিরতে ঘন্টা তিনেক এখনো। ছেলের পেট ব্যথা, পায়খানা থামছেই না। অনুপম গাড়ি চালিয়ে নিয়ে এসেছে। চালিয়ে না – উড়িয়েই বলা যায়। সাথে কাকাও আছেন। পরীকে কাকা কোলে করে রেখেছেন। বাড়ির দোতলার কোলাপসিবল লক করে এসেছে সবাই। এতো জল বেরিয়ে যেতে নেতিয়ে পড়েছে ছেলেটা। কষ্ট পাচ্ছে। ভর্তি হয়ে গেলো অনিকেত।  ডাক্তার কাকার রেকমেন্ডম্পন ছিলো। কেবিনে দিয়ে দিলো। নীরা জুনিয়র  রেসিডেন্ট ডাক্তারবাবুকে বললো,“কী হয়েছে – ডাক্তারবাবু? ওষুধে থামছে না কেন?”

“দেখছি”।

“প্লিজ দেখুন”।

“চিন্তা করবেন না মিসেস মুখার্জী। সবরকম চিকিৎসা শুরু করে দিয়েছি আমরা”।

“আমি থাকবো তো? ওর পাশে?”

“হ্যাঁ – অবশ্যই, আপনি তো মা – থাকবেন তো বটেই”।

“ডাক্তারবাবু – আমি একটা ছেলেকে হারিয়েছি। হারিয়ে ওকে পেয়েছি। ওকে হারাতে চাই না। কোন মুল্যেই নয়”। নীরা বললো।

অনুপম বৌদিমণিকে দেখছিলো। বৌদিমণি বাবিনের সময় কান্নাকাটি করছিলো খুব। সামলানো যাচ্ছিলো না। আজ বৌদিমণিকে খুব শান্ত মনে হচ্ছে। খুব ঠান্ডা মাথায় পরিস্থিতি সামলাচ্ছে। অনুপম এতো ঠাণ্ডা থাকতে পারছে না। যদি কিছু হয়ে যায় ছেলেটার নিজেকে কী করে ক্ষমা করবে অনুপম? ওর অপরাধ কী ক্ষমা করার মতো?

“কী নাম আপনার ছেলের?" ডাক্তার বললেন। 

অনুপম তাকালো নীরার দিকে। বৌদিমণিই একমাত্র যে অনিকেত বলে। বাবিন শব্দটা ব্যবহার করে না,এখনো। এখন কী বলে সেটা শুনতে চায়।

“মামণি………।“। অনিকেত ক্ষীন কন্ঠে ডাকলো। 

নীরা ওদিকে ঝুকলো,

“হ্যাঁ, বাবিন, বলো। পেট ব্যথা করছে বাবা?”

“বাবিন বলল, মামণি?”

অনুপম ছেলেটার চোখে এতো কষ্টের মধ্যেও আনন্দ দেখে। 

“তুই-ই তো বাবিন, আর কেউ না তো”।

“বৌদিমণি”! অনুপম অবাক হয়। অনিকেত কষ্টের গলায় বলে, “দাদা…”।

“না, তুই-ই বাবিন, আমার সোনা, আমার সব ………”।

“টয়লেট ……”।

নীরা বললো, “ডক্তারবাবু?”

“নিয়ে যান …………”। 

টয়লেটে নিয়ে গিয়েই চিৎকার করে উঠলো নীরা।

“ঠাকুরপো!”

অনুপম ছুটে গেলো। “কী হয়েছে বৌদিমণি?”

“রক্ত – রক্ত বেরোচ্ছে ……….।। আবার রক্ত বেরোচ্ছে ………”।

নীরা আর পারলো না, কেঁদে ফেললো এবার। আর পারলো না ও।অনুপম দেখলো, হ্যাঁ, ইউরিনের সাথে রক্ত বেরোচ্ছে। বাবিন – বাবিনেরও তো – পড়ে যেতে যাওয়া নীরাকে একহাতে আঁকড়ে ধরলো অনুপম …… আর ভাবতে পারলো না।


“আর কতক্ষণ?”, অনিরুদ্ধ ড্রাইভারকে বললো। 

“জ্যাম না থাকলে মিনিট চল্লিশ স্যার”।

“কাকাবাবু ………”।

“বল”।

“খোঁজ নিলে?”

“হ্যাঁ, ভর্তি হয়েছে, স্যালাইন চলছে। স্টমাক ওয়াশ হয়েছে ওষধ চলছে। আন্টিডোট – ও পড়েছে বিষের”।

“বিষ!”। সুহাসিনী বললেন।

“হ্যাঁ, আর্সেনিক, যাকে তোমরা সেঁকো বিষ বলো”।

“কী বলছো – রুদ্র?”

সুহাসিনি রুদ্রদেবের হাত আঁকড়ে ধরলেন।

“উতলা হয়ো না, আমি জানতাম – এটাই দেবে – এবারো”।

“কে দেবে? এবারো মানে?”

“মানে আগের দুবারো এই বিষই দিয়েছে খুনী”।

“অনির দাদা আর বাবিন?”

“হ্যাঁ’। 

“কে দিলো?”

“দেয়নি, তার এবার দেবার উপায় নেই। দিইয়েছে কাউকে দিয়ে”।

“উপায় নেই? কেন?”

“কারণ সে বাড়িতে, বাড়িতে বাবিন নীরার হাতেই খেয়েছে। আর কারোর হাতে নয়”।

“তাহলে?”

“যাতায়াতের পথে বা স্কুল”।

“অনুপম ছিলো যাতায়াতের পথে”।

অনিরুদ্ধ বললো, “ঠিক। তাই যাতাযাতের পথ বাদ”।

“অনুপমকে সন্দেহ করছো না?”, সুহাসিনী বললেন। সুহাসিনির কথায় রুদ্রদেব মাথা নাড়লেন।

“নাহ, ও দুষ্টু।খুনী নয়। আর বাবিনের কোন ক্ষতিও করবে না, নিশ্চিত থাকো”।

“নীরা ফোন করছে কাকাবাবু একটু দাঁড়াও”।

“কথা বলে নে”।

“বলো – ব্লাড আসছে না আর ইউরিনে? আচ্ছা। পায়খানাও একটু ধরেছে? নাকে নল দিয়ে ওয়াশ করেছে এসেই – আর সেটা টেষ্টে পাঠিয়েছে?ব্লাড স্যাম্পেলও নিয়েছে?  ওহ, বাবিন কষ্ট পেয়েছে ওয়াশ করতে গিয়ে?  কেঁদো না নীরা …… এটা ওর ভালোর জন্যই। ওষুধ পড়েছে। আমরা আসছি সোনা, তুমি ছেলের কাছে থাকো। তোমার বাবিন ক্লান্ত খুব? ঘুমোচ্ছে? আচ্ছা – তুমি বাবিনের পাশে বসো। আমি আসছি। কিছু হবে না আমাদের বাবিনের। আসছি আমি”।

অনিরুদ্ধ ফোন রেখে চোখ মুছলো।

“অনি – শক্ত হ বাবা”।

“কাকিমণি – একজনকে হারিয়েছি, এই ছেলেটাকে নিজেদের সুবিধার জন্য তুলে নিয়ে এসেছি।নিরাপদে আশ্রয় দেওয়া আমার দায়।আমার উপর রাগের জন্য,মুখার্জী বংশের উপর রাগের জন্য যদি এই নিরপরাধ ছেলেটা বলি হয় ……………”।

“ও মুখার্জী বাড়ির ছেলে, অনি। তোর ছেলে। অন্যরকম কিছু ভাবিস না। দায় দিস না নিজেকে। ওকে অপরের ভাবিস না”। রুদ্রদেব বললেন।

“আমি ওভাবে বলত চাইনি কাকাবাবু। যা অভিশাপ, যা পাপ আমার উপর দিয়েই যাক না । উৎসবের উপর একবার – অনিকেতের উপর একবার”।

“উৎসবকে এই অভিশাপের হাত থেকে বাঁচাতেই অচ্যুত নামের আদ্যাক্ষর পাল্টেছিলো মনে হয়”। রুদ্রদেব বলেন।

সুহাসিনী বললেন, “হতে পারে। গ্রামে গিয়ে যা দেখলাম – শুনলাম ………”।

ইশারায় ড্রাইভারকে দেখালেন রুদ্রদেব। সুহাসিনী থামলেন।

“তখন থেকে ছেলেকে লুকিইয়ে চোখের জল ফেলছ। এসো – একটু কাঁধে মাথা রেখে শোও। ল্যাভাজ, আই মিন ওয়াশ হয়ে গেছে। ব্লিডিং থেকেছে – চিন্তা নেই আর”।

সুহাসিনী রুদ্রদেবের শার্ট দুহাতে আঁকড়ে ধরলেন।

“ঠিক বলেছো তো , রুদ্র?”

“হ্যাঁ, ভরসা করো তো আমায়? তাহলে চুপ করে বিশ্রাম নাও। কাঁধে মাথা রাখো”। সুহাসিনী রাখলেন।

“অনি…”।

“হ্যাঁ, কাকাবাবু?”

“কিছু হবে না, কাঁদিস না বাবা, ধৈর্য্য রাখ”।

অনিরুদ্ধ চুপ করে থাকলো। তারপর বললো,

“মা – তুমি কেঁদো না। শুয়ে পড়ো”। 

সুহাসিনী রুদ্রদেবের বুকের মধ্যে কেঁপে উঠলেন।


পর্ব – ৪৪

ঘুম ভেঙ্গে, চোখে খুলে তাকাতেই অনিকেত দেখলো, মামণি ওর মাথার কাছে বসে আছে। বাপি ঘরে কোণায় সোফায় মাথায় হাত দিয়ে বসে আছে। পাশে ঠাম্মা। ডাক্তার দাদুভাই ঘরে পায়চারি করছে। আর ছোট কাকামণি দরজার পাশে মাথা নীচু করে দাঁড়িয়ে আছে। কটা বাজে, ঘড়ি দেখতে চাইলো অনিকেত – বাইরে রোদ, নাকি? সকাল হয়ে গেছে – নাকি বিকাল ………”।

“মামণি……”। কোন ক্রমে বলে উঠলো অনিকেত ।

“বাবিন ……… অনি, কাকিমণি, কাকাবাবু ……… জ্ঞান এসেছে …………”।

“ক’টা বাজে?”

“বিকাল চারটে ………”, রুদ্রদেব বললেন।

“বাবিন – তুই অত ভাবিস না সোনা ……… ডাক্তারকাকা, ও কিছু খাবে এখন?”

“এখন না নীরা, ডাক্তার দেখুক, তারপর”।

“আউট অফ ডেঞ্জার তো?”

অনিরুদ্ধ বললো, “মনে হয়। দাঁড়া, ডাক্তার ডেকে আনি”।


ডাক্তার প্রদীপ্তর কেবিনে ছিলেন সুহাসিনী,অনিরুদ্ধ, অনুপম। রুদ্রদেব আছেন। অচ্যুত গেলেন। অতীন এসেছে। অতীন আর অতীনের বৌ জিনা পরীকে নিয়ে নীরার কাছে আছে।

“তুই ঠিক ছিলি রুদ্র। আর্সেনিক পয়জনিং”।

“রিপোর্ট এসেছে?”

“হ্যাঁ, এই দেখ। খাবারের সাথেই”।

“স্ট্রেঞ্জ”!অনুপম বললো”।

“কাল সকালে বাবিন বৌদিমণির নিজের হাতের রান্না বৌদিমণির হাতে খেয়েই স্কুলে গেছে”।

“অত সকালে নয়, ইনজেশন হয়েছে সকাল দশটা নাগাদ”।

অনিরুদ্ধ বললো, “মাই গুডনেস!স্কুলে তাহলে। স্কুলে পয়জনিং?”

“টিফিন?”

“টিফিনও নীরার আই মিন ওর মামণিরই বানানো ছিলো – তাই তো অনুপম?”

“হ্যাঁ, স্কুলে আর কিছু খায়নি তো? কারোর থেকে?”

সুহাসিনী বললো, “ওর মামণির তো মানা করা আছে – কারোর থেকে কিছু না খেতে”।

“তাও তো, বাচ্চা ছেলে – খেয়ে ফেলতেই পারে”।

“আগেও সুস্থ হোক, রুদ্র, তারপর জিজ্ঞাসা করা যাবে”, সুহাসিননী বললেন।


এখন আর পেট ব্যথা নেই, পটিও হচ্ছে না তেমন। সন্ধ্যা থেকে দু’বার গেছে অনিকেত। পুরো সেরে গেলে তবেই নাকি খেতে দেবে। নতুন ডক্তার দাদুটা বলেছে।মামণি ঠায় বসে আছে, কিছু খাচ্ছে না। ও খেলে তবেই খাবে, ঠাম্মা বলে বলেও খাওয়াতে পারেনি। বাপি সোফায় বসে আছে। চুপচাপ।

বোনটা ঠাম্মার কোলে ঘুমোচ্ছে। ওর মা বাবা ওকে নিয়ে যাবে বলছিলো কত করে! গেলই না। সারাক্ষণ দাদাভাই, দাদাভাই করে ফোঁপাচ্ছে। দাদাভাইকে ছেড়ে কোথাও যাবে না। বোনটার খুব কষ্ট হচ্ছে। সেরে উঠে বোনকে অনেক করে আদর করে দেবে অনিকেত। দাদুভাইওকে নিয়ে ডাক্তারদাদু বাড়ি গেলো। দাদুভাই অসুস্থ তো তাই। ডাক্তারদাদুর বাড়ি, কাছেই ওটা। দাদুভাইকে রেখে নাকি আবার আসবে ডাক্তারদাদু। কাকামণিও সেই থেকে অন্য একটা সোফায় বসে কী সব ভাবছে। ওর ফামিলিতে সবাই খুব ভালো। ওকে কত ভালোবাসে। মামণিও ওকে বাবিন বলেছে। কাল থেকে বলছে। এত কষ্টের মধ্যেও অনিকেতের আর কোন কষ্ট নেই তাই।


“বাবিন…”। মামণির ডাকে ঘুম ভাঙ্গলো অনিকেতের।

“সোনা – ডাবের জল এনেছে বাপি – খাও”।

“খাওয়া যাবে?”

“যাবে, ডাক্তারদাদুই বলল খেতে”।

অনিকেতকে উঠে বসতে সাহায্য করে নীরা।

“মামণি – তুমি খাও আগে”।

“কেন, পাগল?”

“তুমিও তো না খেয়ে আছে, আমার জন্য”।

নীরা ঝরঝর করে কেঁদে ফেলে। অনিরুদ্ধ নীরার মাথায় হাত দেয়।

“কেঁদো না। তোমার বাবিন তোমায় কত ভালোবাসে দেখেছো?তুমি একটু খাও। ও পুরোটা খেয়ে নেবে”।

“আমি অন্যায় করেছি অনি ………… এতদিন ……… ওকে বাবিন না মেনে ………”।

“ওসব থাক। বাবিন – এইতো, মামণি খেলো ……… এবার তুই -ও যা”।

ডাবের জল খেতে থাকলো অনিকেত।

“সেদিন টিফিনে কী খেয়েছিলি সোনা?, নীরা বললো?

“টিফিনটাই তো, মামণি”।

“আর?”

অনিকেত ভাবলো “আর …… ও হ্যাঁ-মিস কেক দিলো ………”।

“কেক?”

অনিরুদ্ধ বলে। “সে ও আগেও খেয়েছে শাঁওলির থেকে “।

নীরা বললো, “আর কিছু, বাবিন?”

“হ্যাঁ, মামণি, লজেন্স একটা। ভারী অন্য রকম খেতে”।

নীরা অনিরুদ্ধ মুখ চাওয়া চাওয়ি করলো। “অন্যরকম – কেমন?”

“জানি না, দুটো ছিলো। আর একটা পরদিন দেবে বলেছিলো”।

অনিরুদ্ধর বোঝা হয়ে গিয়েছিলো যা বোঝার। শাঁওলির হাত দিয়েই বিষটা দেওয়া হয়েছে – কিন্তু কে দিয়েছে? কাকাবাবু বলতে হবে, কথাটা।



“এত জটিলতা!” অচ্যুত মাথা ধরে বসে থাকলেন কিছুক্ষণ।

“হ্যাঁ, তোর জেঠার অবৈধ সন্তান বিপ্লব। আর তার মায়ের স্বামীই হল সেই ডাইন অপবাদ প্রাপ্ত পুরোহিত। যে তোর জেঠার ছেলেদের ভাষায় নিখোঁজ। বা বিপ্লবের মতে যাকে পিটিয়ে মারা হয়েছে”।

“সাক্ষী?”

“জীবিত সাক্ষী আছে – বললো তো”।

“কে?”

রুদ্রদেব হাসলেন, “কার মুখে প্রথম এই ডাইন সন্দেহে পিটিয়ে চাকর মারার কথা শুনিস?”

“মণি”।

“হ্যাঁ, তার তিন-চার বছর বয়স তখন। কিন্তু আস্ত মানুষকে পিটিয়ে মারার মত বীভৎসতা দেখলে মনে থাকার কথা”।

“তাহলে বাবা না বলে চাকর বললো যে!”।

“কারণ ওর বাবা ডাইন ছিলো সেটা জানতে দিতে চায়নি”।

“কেন?”

“তাতে ওর ডাইন বিদ্যার উত্তরাধিকারটা প্রকাশ পেয়ে যেতো অচ্যুত”।

“কী বলছিস!! মণি!”

“হ্যাঁ, তুই জানলা দিয়ে রাতে যাকে দেখেছিলি – সে মণিই”।

“বাবিন যাকে দেখে ভয় পেয়েছিলো সে-ও?”

“হ্যাঁ”।

“কিন্তু কাকাবাবু, কোথাও একটা ভুল হচ্ছে। বাবিন যেদিন এভিল দেখে মণিপিসি সেদিন বিকালেই গ্রামে যায়”।

রুদ্রদেব হাসেন, “অনি-বিকালে যায়নি। আমি গ্রামে গিয়ে বিপ্লবের বৌ – এর থেকে জেনে নিয়েছি তার ননদ শেষ কবে এসেছিলো – সে বলেছে মাস দেড়েক আগে। সন্ধ্যাবেলায় কিনা জিজ্ঞাসা করলে বলেছিলো না – সকাল বেলায়।যাওয়াটা চোখে ধুলো ছিলো। বিকালে বেরিয়ে রাতে পিছনের পাঁচিলের ঝোপের পিছনে ডেকে রাখা ভাঙা অংশ দিয়ে ঢোকে, মণি।এই ঢুকতে গিয়েই ওর পায়ে কাঁটা ফোটে। যার ফলে পা টেনে টেনে হেঁটে ছিলো সেদিন। ভেবেছিলো সেদিন ওর ঐ রূপ দেখে ভয়েই বাচ্চাটা মরে যাবে বা না মরলেও ও নিশ্চিত হবে যে বাচ্চাটা আদৌ বাবিন কিনা। দুটোর একটাও হয়নি। সম্ভবত পরদিন ও গ্রামে চলে যায়। বাবিন ফিরে এসেছে ধরেই বিষ জোগাড় করে আবার গ্রামে থেকে ফিরে এসে ও দেখে একা সুহাসিনী নয় নীরা, তুই, আমি, অচ্যুত, অনুপম সবাই বাবিনকে পাহারা দিচ্ছি। বাবিনকে ও একদমই খাওয়াতে পারছে না”।

“আবার চেঞ্জ করাবার বাহানায় থাইয়ের তিলটা দেখে নিশ্চিতও হতে পারছে না যে সেই বাবিনই ফিরেছে কিনা – তাইতো কাকাবাবু?”, অনি যোগ করে। 

“দুজনের এক জায়গাতেই তিল?” রুদ্রদেব অবাক হন।

“হ্যাঁ, এটাও সমাপতন”।

“এটা সমাপতন নাও হতে পারে। ছাড় ওসব। তবে ওর সন্দেহ ঘনায় যে এই বাবিনই সেই বাবিন, এবং একে মারার জন্য দূঢ়চিত্ত হয়, যদি আলাদাও হয় – তবুও বংশের প্রথম সন্তানের নাম নেবে – তাই তাকে মারাও ওর কর্তব্য”।

“এই কর্তব্যটা কেন রুদ্র! নেহাৎ ডাইনি বিদ্যার প্রয়োগ?”

“কোনো বিদ্যা টিদ্যা নয়। দিচ্ছে তো বিষ। এটা শুধু প্রতিশোধের খেলা। আর কিছু নয়”।

“প্রতিশোধ কিসের? প্রতিশোধ হলে তো বড় তরফকে নিতে হতো। ওরা ওর বাবাকে পিটিয়ে মেরেছে”। অচ্যুত বললেন।

রুদ্রদেব হাসলেন, “রাঁধুনী বামনী ছিল রানী মৌমাছি, অচ্যুত।অখিল মুখার্জী ওর ছেলের বাবা ঠিকই। সেটা ভাঙ্গিয়েই বসত ভিটে জোগাড় করেছে। অমূল্য মুখার্জী ওর মেয়ের বাবা”।

“কী!”

চমকে উঠলো অচ্যুত। 

“কী যা তা বলছিস!”

“অনি নিজে কানে শুনে এসেছে। অমূল্য মুখার্জি গ্রামেরই কোন মেয়ে মানুষের সাথে অবৈধ সম্পর্কে লিপ্ত হয় আর সে প্রেগনেন্ট হলে গ্রাম থেকে চলে যায়, সেই মেয়ে মানুষ কে এমন হতে পারে যে গর্ভবতী হলে গ্রাম থেকে চলেই যেতে  হবে! বড়তরফের ছেলে মরার পরও এতো ভয় কিসের যে, ডাইন আবার এসে ওনার ক্ষতি করবে?”

“প্রেগনেন্ট ছিলো রাঁধুনি বামনী? মণি তাহলে ………”।

“হ্যাঁ, মণি তোর বোন। না হলে অমূল্যবাবু গ্রামে এক দুবারই গেছিলেন পরে – তার একবার মণিকে আনতে কেন? কেননা রাঁধুনি বামনির ছেলের ভার অখিল নিয়ে ছিলেন, ছেলে অখিলের।  মেয়ে যার তার হাত দিয়ে শহরে পাঠিয়ে দিয়েছিলেন। তোদের গ্রামে এখন বেশ কিছুটা জমি আছে। সব মণির বকলমে বিপ্লবের ভোগে লাগছে”।

“মণি জানে এসব?”

“আলবাৎ জানে। তোর বাবার উপর রাগেই ও দুটো খুন করেছে আর তৃতীয়টা করাতে যাচ্ছিলো”।

“একটা প্রশ্ন আছে”, অনিরুদ্ধ বললো। 

“বল”।

“পায়ে কাঁটার চোট তো গ্রাম থেকে ফিরে আসার সময় সেরে যাবার কথা – দিন সাতেকের ব্যবধান – তাহলে কাকাও যে দেখল পা টেনে টেনে চলতে?”

“বৃষ্টি হচ্ছিলো তো সেদিন। মনে হয় পড়ে গিয়ে পায়ে চোট পেয়েছিল আবার। ওটা নতুন পা টানা।আমি অনিকেত আর অচ্যুত দুজনের থেকেই হাঁটার অনুকরণ দেখেছি।দুজনে দুই পায়ে দেখিয়েছে।”

“আর শ্বাসের শব্দ? মণিপিসির তো হাঁফানি নেই?”

রুদ্রদেব হাসলেন, “ওটা ডাইন চর্চার ঘোর। ভর, বলে যাকে”।

“মণির মাত্র তিন বছরে তো পুরোহিত মারাই গেলো। তাহলে ডাইন বিদ্যা ও শিখলো কোথায়!"

“বিপ্লবকে তুই দেখিসনি অচ্যুত। ও তো পুরোহিতকে দেখেইনি। তাও ওকে দেখলেই বোঝা যায় ডাইন চর্চার করে। মনে হয় রাঁধুনি বামনীও এসব চর্চা করতো। অক্ষয় তো বললো পুরোহিত নাকি ঐ তান্ত্রিকের শিষ্যত্ব গ্রহণ  করে ছিলো। পুঁথিপত্রও থাকতে পারে এসবের ওদের কাছে”।

“তাহলে কর্তব্য?” অচ্যুত বললেন।

“পুলিশে জানা, তবে পুলিশ তাকে আর তোদের বাড়িতে পাবে না। সে জেনে গেছে বাবিন বেঁচে – আর অপেক্ষা করবে না বাড়িতে। সাথে নিধুকেও পাবি না"।

“নিধু কাকা!”

“হ্যাঁ, মণি বাড়ির পিছনের ভাঙা ঘরে ডাইন চর্চা করতো, সেটা বাড়ির সামনের দিকের সার্ভেন্টস কোয়ার্টার থেকে দেখা যায় না, ঠিকই, কিন্তু একতলার মাঠের দিককার ঘর থেকে দেখতে পাবার কথা। আর ওদিকেই মণির ঘর,নিধুরও ঘর। নিধুর মাধ্যমেই মণি অনিকেতের সেই রাতে একা শোবার খবর পায় আর ডাইন মুর্তিতে নিধুর সাহায্যেই দোতালায় ওঠে”।

অনিরুদ্ধ কপালে হাত দেয়। "নিধুকাকা এমন করবে কেন? মোটিভ?”

রুদ্রদেব হাসলেন, “মণি বিয়ে করেনি কেন?”

“নিধু আর মণি!!!! দেখে তো বোঝা যেতো না?”

“দেখে অনেক কিছুই বোঝা যায় না। মণি, নিধুকেও আর বাড়িতে পাবিনা তোরা। সেদিন অনি আর নিধুর ঘর সার্চের সময় নিধুর ঘরেই ডাইনি লুকিয়ে ছিলো”। 

“ওরা তবে গ্রামে?”

“হ্যাঁ, অনি – এতে তোর বন্ধুর বোন শাঁওলিও ধরা পড়বে – কিন্তু”।

“কাকাবাবু, তুমি জানলে কী করে – আমি তো এটা বলতেই এখানে এলাম!! ”।

“বিলেত ফেরৎ ডাক্তার বলে তোর কাকা সবসময়। একটু মান রাখলাম। স্কুলে আর কে খাওয়াবে বিষ বল? শাঁওলি ছাড়া কার মোটিভ আছে? শাঁওলির তোর প্রতি ক্রাশ নয়, অবসেশন আছে – তার সাথে নীরার কড়া ব্যবহার। ভেবেছিলো বাবিনের কিছু হলে নীরা ফ্যাসাদে পড়বে আর তুই ওর হবি”।

“একি ছেলে মানুষি?”

“ভুল গুলো তো এভাবেই হয়, অনি”।

“রুদ্র, ক্রাশ না কি – ওসব তুই জানলি কি করে?”

“তুই ফেসবুক করিস, গাধা? অনির প্রোফাইলে আমিও আছি। শাঁওলির সব কমেন্ট দেখেছি ……”।

“ওহ, ফেসবুক, তাই না? ছোটগিন্নী আছে, তোর প্রোফাইলে?”

অচ্যুতের কথায় রুদ্রদেব হেসে ফেললেন হো হো করে।

“তোর এই মুহুর্তেও ঐ একই চিন্তা! হ্যাঁ রে, গাধা?”” অনিরুদ্ধ কিছু বললো না। দুই বন্ধুর রসিকতা চলতে থাকলো।



পর্ব – ৪৫

দিন সাতেক পর ছেলেকে সম্পূর্ণ সুস্থ করে বাড়ি ফিরেছিলো নীরা। ভাবতে পারেনি এই সৌভাগ্য ওর হবে। বাবিনকে একবার হারিয়ে ছিলো আর একবারও হারাতে বসেছিলো। নেহাৎ কাকাবাবুর বিচক্ষণতা ওদের বাঁচিয়েছে। মণিপিসি! যে মণিপিসির হাতে নির্দ্বিধায় ওর বাবিনকে ছেড়েছিলো নীরা,  দিনের পর দিন খাইয়েছে বাবিনকে,  স্নান করিয়েছে - সেই! ভাবতেও শিউরে উঠলো নীরা। ভাগ্যিস কাকিমণি এবার প্রথম থেকেই আটকে ছিলেন এগুলো না হলে তো ঐ শয়তান মেয়ে শাঁওলি অবধি যেতে হতো না। মণিপিসি নিজেই হাতের নাগালে পেয়ে যেত বাবিনকে। আর দোষ হতো অভিশাপের।


শাঁওলি গ্রেপ্তার হয়েছে। ওর কাছে আরো একটা লজেন্স ছিলো। ওকে দুটো একসাথেই দিতে বলেছিলো মণিপিসি, চিঠিতে। ও কোন কারণে সেটার সাহস পায়নি। ও বাবিনকে মারতে চায়নি। অল্প অসুস্থ করে নীরা সরাতে চেয়েছিলো। ভাগ্যিস দুটো লজেন্স দেয়নি। না হলে কী হতো ভাবতেই কেঁপে ওঠে নীরা। শাঁওলির দাদা, বৌদি অনিকে অনেক করে রিকোয়েষ্ট করেছিলো – ছাড়াবার জন্য। কিন্তু না, অনি গলেনি। ওর শান্তি ওকে পেতেই হবে।


মণিপিসিকে পুলিশ গ্রামেই পেয়েছিলো। ঠিক গ্রামে নয়। গ্রামের নদীর অন্য পারে। শ্মশানে, ডাকিনী চর্চারত অবস্থায়। সাথে বিপ্লবও ছিলো। বাবিনকে বিষ দিয়ে মারতে না পেরে বাণ মেরে মারার যজ্ঞ চলছিল তখন। মণিপিসি গ্রেপ্তার হয়, বিপ্লবও। সেঁকো বিষ ও-ই জোগাড় করে দিতো ওর দিদিকে। দুই ভাইবোনই মানসিক ভাবে অসুস্থ। এমনটা বলেছে মিডিয়া। নিধুকাকার কোন খোঁজ মেলেনি। এখনো চ্যানেলে চ্যানেলে এই ঘটনাটা নিয়ে চর্চা হচ্ছে। নীরা কোথাও সাক্ষাৎকার দেয়নি। ও প্রচার নয়, শান্তি চায়।


কাকা এখন অনেকটা সুস্থ। এই বাড়িতেই আছে। কাকিমণি একা হাতেই বাড়ির কাজ করে যাচ্ছেন। নীরা সারাক্ষণ ছেলেকে নিয়ে ব্যস্ত। পরীটা বুঝদার খুব। জেঠিমণি দাদাভাইকে নিয়ে ব্যস্ত দেখেও কোন অভিমান নেই। ঠাম্মা, দাদুভাই, কাকামণি, জেঠুমণির কাছেই থাকছে। ডাক্তারকাকাও পরীর মন ভুলিয়ে রাখছে। পরীকে নিজের গার্লফ্রেন্ড বলে ডাকছেন। মজা পাচ্ছে পরী। নীরা বোঝে এটা কেন বলছেন কাকাবাবু। পরীকে অনেকটাই কাকিমণির মতো দেখতে। কাকাবাবু আর কাকিমণির গল্প প্রমাণ করে ভালোবাসায় কোন ক্ষয় হয় না। 


অনি রাতে শুতে এলো। 

“বাবিন ঘুমিয়ে গেছে?”

“হ্যাঁ, পরী?”

“ঘুম পাড়িয়ে এলাম”।

“অতীনরা আর নিতে চাইছে না তো!”

অনিরুদ্ধ ঝুঁকে নীরাকে চুমু খেলো, “কেউ নেবে না তোমার মেয়ে কে। আর পরী যেতে চাইলে তো!”

“ছোট ঠাকুরপো কোথায়?”

“ওঘ রে ঘুমোচ্ছে। অনুপমটাও কিন্তু খুব খাটল এই ক’দিন আমাদের সাথে”।

“হ্যাঁ, তুমি শুয়ে পরো”।

“এখনি?”

“কেন?”

“আমার পাওনাটা? বাবিন ফিরে এলে দেবে বলেছিলে?”।

নীরা হাসলো, “ছেলে জেগে যাবে”। 

“ওহ, তাহলে?”

“কাগজ সই হোক – তারপরে”।

“অ্যাডপশন পেপারস এর মধ্যেই সই হয়ে যাবে”।

“বললাম তো, তারপরে”।

অনিরুদ্ধ নীরাকে আদর করে, “বেশ, ছেলের পাশে শুতে দাও তবে”।

“যাও না – তোমারই তো ছেলে”।

অনিরুদ্ধ গিয়ে শুয়ে পড়লো। নীরাও শুলো, অন্যপাশে”।

“আমার বাবিন”। নীরা বললো।

“ফিরিয়ে আনতে পারলাম তো, সোনা?”

“পেরেছো”।

“তোমার বাবিন তোমাকে ফিরিয়ে দিতে পারে আমার কত আনন্দ – বুঝতে পারবো না”।

নীরা অনিকেতকে আরো আদর করলো। 

“সরি ……”।

“কেন?”

“প্রথমে বুঝিনি যে?”

“এখন তো বুঝছো”।

“খুব করে বুঝছি। অনি,ছেলে সারুক,তারপর আমি কোর্টে যাবো”।

“যেও”।

“ওষুধ বন্ধ করে দেবো”।

“দিও”।

“কাকিমণি, কাকা, কাকাবাবু ঠাকুরপো সব্বাইকে নিয়ে থাকবো”।

“অবশ্যই। আর কিছু?”

“যদি আর কোন জন্ম থাকে তুমি আমারই হয়ো, হবে তো”?

অনিরুদ্ধর চোখে জল চলে এলো, নীরারও। অনিকেতকে মাঝে রেখে আদর করতে করতে ওরা রাত কাটিয়ে দিলো।


-----“সমাপ্ত”-----






Joydeb Biswas

Poet Joydeb Biswas studied Bengali literature. In 2015, at the age of 22, he published 'Sahitya Chetona' magazine. Currently two editions of the magazine are published. One is the online version and the other is the printed version. He is the founder and editor of the two editions. facebook twitter youtube instagram whatsapp

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

নবীনতর পূর্বতন