কবি সুবীর ঘোষ
কবি সুবীর ঘোষ |
কবি সুবীর ঘোষ জন্মগ্রহণ করেন ১৯৫৩ সালের ৩ সেপেটেম্বর বর্ধমানের কুলটিতে । পিতা–স্বর্গত প্রফুল্লকুমার ঘোষ ও মাতা–বীণা ঘোষ । বিশ্বভারতী থেকে অর্থনীতিতে স্নাতকোত্তর । এআইএমএ, নিউ দিল্লি থেকে ম্যানেজমেন্ট ডিপ্লোমা । দুর্গাপুর মিশ্র ইস্পাতশিল্পের বরিষ্ঠ আধিকারিক পদ থেকে অবসরপ্রাপ্ত । তার সম্পাদনায় উজ্জ্বল একঝাঁক পত্রিকা ১৯৮৭ সাল থেকে প্রকাশিত হচ্ছে । কবির সম্পাদিত কাব্যসংকলন—শান্তিনিকেতন (১৯৯৩) ।
এখনো পর্যন্ত কবির কাব্যগ্রন্থ প্রকাশ হয়েছে –
স্বনির্বাচিত কবিতা, রোদ্দুরে তোমার স্বস্ত্যয়ন, কবে চলে যাবো কোনো ঠিক নেই, জ্যোৎস্নায় না আঁধারে না, এবার অনেকদিন পর, স্বনির্বাচিত কবিতা, ঢেউমাদল, ৭ জন কবি, রোদবসতির উঠোন, আমাদের সময়ের মেয়েরা কোথায়, স্তব্ধচোখে চিহ্নতারা, আমি মফসসলের কবি, শরীর কী কথা শোনে, নদীদীন সম্মুখীন, টরে টক্কা ছড়ে ছক্কা ।
এছাড়াও ২টি গল্পগ্রন্থ ও ৪টি উপন্যাস প্রকাশ হয়েছে ।
সুবীর ঘোষের একগুচ্ছ কবিতা প্রকাশ করা হল :
প্রথম দেখা
***
১
প্রথম দেখা বালিভাঙার সমুদ্রে
হিম ছিল না , নিদ্রা মেশা অরুদ্রে ।
আসতে চাওয়ার ইচ্ছে ছিল অনন্ত
মন চেয়েছে গাঢ়গভীর তদন্ত ।
রাতের পাখি চোরা ডাকের চর্যাতে
আলোর কাঁপন খিল ভেঙেছে দরজাতে ।
আমরা তখন এক দুই তিন ঘর কাটি
ভরা বীজের মাতন লাগা গুপ্ত মাটি ।
তোমায় আমায় প্রথম দেখা
গানের প্রথম কলিতে
আকাশ ভরা সূর্য তারায়
ইমন বিভাস ললিতে ।
২
তোমায় আমায় যখন প্রথম দেখা তখন তুমি উৎসাহের সঙ্গে উড়িয়ে দিচ্ছিলে সোনালি সূর্যকণাগুলোকে । আদরের বাতাস বয়ে ভেসে আসছিল অনন্ত রঙ্গনের প্রবাহমুদ্রা । আমি জেনে নিচ্ছিলাম তোমার ব্যথাখাঁজের ভেতর থেকে কীভাবে বেরিয়ে আসে কবিতার ঘুমপাড়ানি গান । তুমি আমায় এ বিশ্বনিখিলের ইজারা দেবে বলেছিলে । সন্ধ্যার অন্ধকারে ঘরে ফেরার সময় কোনো এক ভিনদেশি পাখি দু’দন্ড এসে বসেছিল আমাদের কাছে । হয়তো আমাদেরকে ওর বড়ো চেনা লেগেছিল । দূরে মেলা ভাঙ্গার গান বেয়ে সুসজ্জিত অশ্বারোহীর নিঃশ্বাসের দম্ভ টের পাওয়া যাচ্ছিল । আর তখনই তুমি বটগাছের দীর্ঘ দীর্ঘ ঝুরি থেকে বানিয়ে ফেললে মায়াডোর ।
স্বপ্নাচার
***
সত্যি কথা বলতে বলে কোথায় নিয়ে এলে ?
আসার তেমন মন ছিল না মেজাজ এলেবেলে ।
এলেও নয় বেলেও নয় এ যে মোহরকুচি ;
এখন বুঝি আবদাল্লার কেমন ছিল রুচি ।
যতই হাতে পাথর কুড়োই পায়ে নূপুরনাচ,
পদক্ষেপের খুশবুতে পাই গন্ধে কত আঁচ !
আকাশমণি গাছের তলে শুয়ে থাকব বলে
চশমা খুলে চাদর পাতি—দূরে আগুন জ্বলে ।
তোমার শাখা প্রশাখায় কী এত ফিকির ছিল ?
তার চাইতে উদোম তুমি আকাশ আঁকলে নীলও ।
পেটের ভেতর সাধুসঙ্গ পরম ব্রহ্ম নাম ,
জল কিশোরী কিশোরী জল সুযোগ অবিরাম ।
দূরে আমার স্বপ্নে দেখা বালিহাঁসের নৌকো ;
তোমার কাছে ত্রিভুজ এবং আমার হাতে চৌকো ।
সত্যি কথা শোনাবে বলে এখানে যদি এলে
দেখ কেমন পাখির ডানা মন দিয়েছে মেলে ।
দূরে আকাশ তারও দূরে সিঁড়ি ওঠার হিসেব
ক্যালেন্ডারের পৃষ্ঠা জুড়ে কিন্তু অতএব ।
ও-সব এখন ভুলেই গেছি—আমিও বালিহাঁস ;
পেট ভরানো মাটির গন্ধে জলের প্রাতরাশ ।
খুনি ট্রাম অনুতাপে ভোগে না
***
‘ধানসিঁড়ি নদীটির তীরে’ আর কবে উঁকি দেবে একফালি মেঘের আকাশ ?
কাশবনে যন্ত্রণায় বৃদ্ধের কাশির মতো শব্দ করে উড়ে যাবে টাকসোনা পাখি ।
এ পৃথিবীকে সোনা দিয়ে মুড়ে দেবে বলে ঝাঁকে ঝাঁকে নেমে আসবে পরি ।
অবিরাম দ্বন্দ্বযন্ত্রণা থেকে রেহাই পেতে মর্মান্তিক কবির কলমে
শুকিয়ে যাবে শব্দের ঝর্নাস্রোত ।
খুনি ট্রাম অনুতাপে ভোগে না , শাস্তি পায় না—তাই আজও ছাড়পত্র তার চলবার ।
কী বিচিত্র এই দেশ ! এখানে সবাই শুধু পাকা ধানে মই দিতে জানে –
এখন শকুন ওড়ে মাঠে ঘাটে আকাশের এদিক ওদিক—
ঘাসের ঝাড়বংশ নির্বংশ হয়েছে কতকাল । বেজন্মা জমির দখল নিয়েছে পার্থেনিয়াম ।
সর্ষেতে আর্গিমন । মানুষ - পাশার ঘুঁটি দুর্বিনীত শকুনির হাতে ।
যারা যায় যন্ত্রণা ভোগ করে যায় । পূর্ণচ্ছেদ পড়ে তবু ।
যারা থাকে তাদের দুর্ভোগ বাড়ে চতুর্গুণ । বেঁচে থাকা কেটে যাওয়া ঘুড়ির মতোই অনিশ্চিত ।
আনবিক প্রগতির যুগে শোনা যায় প্লাজমা স্তরে চলে যাওয়া অনেক সহজ ।
মানুষের দুর্বুদ্ধিতা কোনোদিন সূর্যকে এনে দিতে পারে জামার পকেটে ।
এল্ নীনো খেপে গেলে শীতকালে বৃষ্টি হয় । পাকা ধানে মই পড়ে ।
অথবা দুঃসহ তাপে শরীর জলশূন্য পুকুরে মাছের মতো কাঠ হয়ে ওঠে ।
ভুলে গেছি কতকাল আগে দেখা ‘অরুণিমা সান্যালের মুখ’ যে মুখে শীতের ধোঁয়া
মনে হত পঞ্চাশের চিনেম্যানের থেকেও বেশি দুর্জ্ঞেয় । ভুলে গেছি হিজলের শান্ত তলে এসে
‘লোকেন বোসের জার্নাল’ খুলে দেখা ।
সুরঞ্জনা কতকাল আগে চলে গেছে নিষিদ্ধ যুবকের সাথে সহবাঁচনের অসংগত অভিলাষে ।
যারা তবু জিজ্ঞেস করে –‘এতদিন কোথায় ছিলেন’ তাদের বলি ,
‘পৃথিবীতে নেই কোনো বিশুদ্ধ চাকরি’ আর তাই এই অশুদ্ধ গন্ধময়
চাকরির ভেতরেই ছিলাম এতদিন—যেখান থেকে কিছু পাবার নেই ।
যারা কেউ প্রস্তুত নয় কিছু নেবার তাদের নিয়েই সাতকাহন লেখাজোকা ঘরবার ।
এ ভাবেই পঞ্চাশের ঘন্টা বাজে দেহের দরজায় । যে সকল যুবতির চোখের তারায় ছিল
নিষ্পেষণ শব্দের বিজ্ঞাপন তারা আজ অনেক তফাতে বসে থাকে ।
আজ শুধু ‘মিহি কেরানির মতো’ হিসেব মিলিয়ে যাওয়া --–
জীবনভোর আয় ও ব্যয়ের হিসেব নিয়ে তৈরি হয় মানসিক ব্যালান্সশীট ।
ক’মেয়ের বিয়ে হল –কতজন আর বাকি—ছেলেরা কোথায় –কার মাইনে কত
এ সবই এখন গল্পের বিষয় । ইচ্ছে কি জাগে না তবু ঘুরে আসি রহস্যের
বিদিশার প্রান্তিক প্রান্তরে । কতদিন বসা হয় না জলঝিরি নদীটির তীরে ।
পাশে থাক অন্ধকার । ‘মুখোমুখি বসিবার’... ।
রাক্ষসের স্বাক্ষর
***
রাক্ষসের স্বাক্ষর নিতে গিয়ে
পৌছে গেছি পূতিবন্দরে;
নদী তরঙ্গের আয়না ভেঙ্গে ভেঙ্গে
পুলটিস বানাচ্ছে ।
নদী কারোর কথা শোনে না–
পাথর বা পাষন্ড
কেউই মুখ তুলে কথা বলতে পারে না ।
রাক্ষস একমাত্র সেখানেই সভা ডাকে ।
দুর্বত্ত কুঠার দেগে দেবার আগেই
পাখিরা ভেসে যায় ।
গামছাবোনা রং নিয়ে বিকেল আসে ।
মানুষজনের চিৎকারে
এদিকের ঘরবাড়ি বন্দরের ওপারে চলে যায় ।
আনন্দমেলা
***
দূরে থাকি ঐ আনন্দমেলা থেকে --
অভিমানে যদি উৎসব কালো হয় !
হে দেবলজাতা কেন কর এত শোক ?
ঐ ভরাঘাটে উজান তো বইবেই ।
এ জন্মে যদি ধূপ হয় প্রেম কেঁদে
যুগান্তর তো অনুকূল হতে পারে ।
বিপঋত
***
আমি রাত চাইলে তুমি দিন চাও
আমি সুখের কথা বললে তোমার দুঃখ দুঃখ ভাব
খেলাটা এবার তাহলে ভাঙুক ।
তুমি পরিতৃপ্তি বলার পরেই
আমি বলে উঠলাম---বেগুনচারা ।
তোমার কাছে তখন এসে দাঁড়ায় যৌনাবর্তের ধোঁয়াভূত
আমি নদীকে বলি---
আমার ড্রইংরুমের ভেতর দিয়ে গিয়ে
জানলা দিয়ে বেরিয়ে যাও ।
স্বর্গে যখন প্রবল অনুপস্থিতির হার
এবং সে কারণেই সংখ্যাগরিষ্ঠতা বিপন্ন
তখন কাউকে কাউকে তুলোধোনা করার মোক্ষম সুযোগে
বালাপোশে ভরে যাচ্ছে বার-বারান্দা ।
চিলের পাখায় ভর করে ঝড় এসে
খেয়ে গেল ছাদের কার্নিশ ।
গাবতলা থেকে তুলে আনা শূন্যতা
ফিতে দিয়ে মেপে দেখছে এক কাজের মানুষ ।
এবং দৈর্ঘ্যৈ মাপে মাপে তার কামাঙ্গের সমান ।
উন্মোচন ততক্ষণ
***
ফিরে আসে চাকা । চাকা ফেরে ? ফিরে আসে ? আসে ।
আসে বলে সংসারে হীরামন সেজে শুধু পায়চারি করা ।
যে চাকায় স্মৃতি নেই পিছুটান নেই রিভার্স গিয়ার নেই
অস্বীকৃত একলব্যের মতো তারা গুরু মানে নদীকেই ।
গাড়ির বাঁধন ছিঁড়ে তবু চাকা ফিরে আসে হৃদয় ফাটাতে ।
তার চেয়ে তুমি এসো । তুমি তো ফিরতে পারো । কোনো বাধা নেই ।
আতঙ্ক ছড়িয়ে রাখো দুই পাশে
নগ্ন হবে, হবে হবে বলে ।
প্রচুর নগ্ন হলে । প্রবলভাবেই হলে ।
আর কত হতে চাও রভসসুন্দরী !
ফেটে যায় ফুল যদি পাপড়িদল সমস্তই খোলে ।
কোথাও তো থামা থাকে ।
কারোর তো ক্লান্তি প্রয়োজন ।
অনিশ্চয় সুখ থাকে আরামঝর্নার থেকে আগে ।
স্বাচ্ছন্দ্য পাবার আগে অর্জন ।
ব্যাকরণ বুঝে নিতে হয় ।
উন্মোচন ততক্ষণ যতক্ষণ ডানার ঝাপট ।
নিঃশ্বাস
***
সেই উন্মুক্ত স্টেশনে সেদিন
আমরা দুজনই মাত্র ট্রেন ফেল করেছিলাম
কোনো হতাশা দেখিনি বনকুলের ঝোপে
দুশ্চিন্তা ছিল না তোমার সোনালি লেডিজ ঘড়িতেও ।
অম্লানবদনে বললে- হেঁটেই চলে যাবো ।
হেঁটে হেঁটে সাঁইত্রিশ কিলোমিটার !
--- কেন, রাস্তায় কোনো না কোনো ট্রেন পেয়ে যাবো ।
--ট্রেন কী বাস যে হাত দেখালে দাঁড়াবে ?
এ সব তর্কের কোনো মীমাংসা হয়নি সে দিন ।
আমরা অন্ধকার গাছের ডালে উঠে ঘুমিয়েছিলাম সারা রাত ।
কেউ টের পায়নি । না - কেউ না --
না ডাকাত না সাপ না প্যাঁচা না বৃষ্টি ।
সেই বাহুসন্ধির খোঁজ পেতে গিয়ে
আমাকে গ্রাম থেকে শহরে আসতে হয়েছে
হাট ছেড়ে বাজারের পথ ধরতে হয়েছে
তুমি কোথায় ও কেন যে আমার হাত ছেড়ে দিলে জানি না ।
কত বাসের জানলায় আমার নিঃশ্বাসের বাষ্প লেগে আছে
আমি অনেক ঘুরেছি এই ঠিকানাবিহীন পৃথিবীতে
কেউ তোমাকে দেখেনি তা কী হয় !
কত বাসের জানলায় এসে বসেই নেমে গেছি
তোমার নিঃশ্বাসের বায়োমেট্রিক মেলেনি ।
ব্যথার কথা
***
কাল শনিবার । শনিবার এলেই আমার মনে পড়ে
গম ভাঙানোর কথা । সপ্তাহে একদিন কুয়োর ভেতর জল ঢালা ।
আমাদের চোখ হাত থাকার কথা নয় এতদিন
তবু সব বাতাস সহ্য করে তারা আছে
বেল্টের শেষ ঘরে পৌঁছে গিয়েছে কোমর
এখন প্রলোভন ছড়ায় শুধু রাজমাতা– অন্তঃপুরে টেনে নিয়ে যায়
আমার গোপন সব কথা দোহন করে বের করে নেয়
খিড়কিদুয়োর দেখিয়ে দেবার আগে বলে –
দূর্বাঘাস খেয়ে নিও
ব্যথা চলে যাবে । এ সব ব্যথার কথা
বলা যায় না কারো কাছে -- কবিতাতেও লেখা যায় না
শুধু একটা একলা পাশবালিশ কেঁদে কেটে বিছানা ভেজায় ।
পীড়নকাহিনি
***
প্রদীপশেষের তেলে
আলো খোঁজো কেন ?
আজ যা অল্প মেঘ
অল্প অল্প বৃষ্টির বন্দিশে
স্বীকারোক্তি সঠিক পথ ।
আত্মসমর্পণে দায় নেই
বহুদিন পর এসে
শিল্পী যেমন খোলে
জটাজুট পীড়নকাহিনি ।
আমি কী করতে পারি ?
আমি যেন পালংয়ের ডালে বসা
বগেরি পাখিটি ।
লংকাঝাঁঝে ভরে আছে রান্নাঘর
যেদিকেই যাও কেন
মধ্যিখানে চিন্তার খালবিল ।
এসে যেও সন্তর্পণে
যখন দু’হাতে কিছু সতর্কতা পাবে ।