কবি তিতাস বন্দ্যোপাধ্যায়
কবি তিতাস বন্দ্যোপাধ্যায় |
কবি তিতাস বন্দ্যোপাধ্যায় জন্মগ্রহণ করেন ১লা সেপেটেম্বর ১৯৯৬ সালে পূর্ব বর্ধমান জেলায়। গতবছর প্রেসিডেন্সি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্নাতকোত্তর উত্তীর্ণ হয়েছেন।
২০১৫ থেকে সক্রিয়ভাবে লেখালিখির সঙ্গে যুক্ত। বাংলাদেশ ও পশ্চিমবঙ্গের নানা ছোটোপত্রিকায় লেখালেখি করেন। ২০১৮ তে প্রকাশিত হয়েছে তাঁর প্রথম বই 'ঘুম দাও ঈশ্বর', পেয়েছেন 'সোনাঝুরি কবি সম্মান-২০১৯'।
কবি তিতাস বন্দ্যোপাধ্যায়ের একগুচ্ছ কবিতা প্রকাশ করা হল :
স্পর্ধা
***
চেয়ার ছেড়ে উঠে গেছেন আপনি,
ঋণ শোধ করার দিকে।
মুহূর্তেই, অনন্ত স্তব্ধতা মাত্র !
টেবিলের উপর সূর্যমুখী ফুল-
ফুলের পাপড়ি ও বৃন্তের যতটুকু দূরত্ব
ততটুকু মনে পড়ছে ইতিহাস !
আপনার উঠে যাওয়ার স্পর্ধায়
ছিঁড়ে ছিঁড়ে যাচ্ছে।
আকাশবাণী তরঙ্গে
***
ডুবে যাচ্ছিল মেয়েটির মুখ,
ঠোঁটের উপর এসে বসেছিল ঝরে যাওয়া পাতা !
কোনো এক বুড়ো পাতা দিয়ে বাঁশি বাজাতেন আনমনে!
মেয়েটি বলছিল-
তার শিশু বাবার কথা !
গায়ের ক্ষতে কীভাবে স্নেহ এঁকে দিত সে !
রেডিওতে কান পেতে কীভাবে শুনত ধ্রুপদী সুর বাদ্য,
জানালায় হাত বাড়িয়ে পেড়ে নিত অন্ধকার।
যৌথ সংসারের বারান্দা পেরিয়ে একদিন মেয়েটি ভুলে গিয়েছিল
কোলে ঝাঁপিয়ে পড়তে নেই, দু হাত পেতে দিতে হয় আসনের মত।
রেডিওটি টেবিলের এককোণে এখনো বেজে ওঠে !
আসনের দিকে এগিয়ে গেলে,
কত কত ছেলেখেলা ভ্রূণের মতো নড়েচড়ে ওঠে !
ভেসে উঠছিল মেয়েটির মুখ !
রেডিওর ওপারে তার বাবা একনাগাড়ে এস্রাজ বাজিয়ে চলেছেন !
অঙ্ক ভুলে যেতে যেতে মেয়েটি,
কান পেতে শুনছিল...
পাতার বাঁশি, এস্রাজ আর অন্ধকার-
রিকশায় টেনে আনছে মাসকাবারি বাজার, ওষুধ...
যে উড়তে চেয়েছিল
***
মেয়েটি যে ঘরে শুতো
বহু পুরুষের সঙ্গে,
সেই ঘরের হলুদ বাল্বটি নষ্ট হয়ে গেছে !
শিশি-বোতলওয়ালার খাঁজ কাটা ঝুড়িতে করে
কারখানার দিকে যেতে যেতে
বাল্বটির কেবল মনে পড়ছে
অন্ধ জোনাকির কথা !
একদিন যাকে দেখে,
তারও উড়তে ইচ্ছে করেছিল...
রান্নাঘর
***
কাঠের উনুনে আঁচ দিলে
ধোঁয়ার কুণ্ডলী
অভুক্ত পাকস্থলীর মত ঢুকে পড়ে প্রতিবেশীর বাড়ি !
বুড়ি ছোঁয়া খেলা ফেলে
সে ধোঁয়া আড়াল করতে চলে যায় মা ও সন্তান।
দৌড় জমানো মাঠে
ছড়িয়ে থাকে খানিকটা অদমনীয় শোক।
শুভ বিবাহ
***
ছোটবেলায় প্রায়ই ধুম জ্বরে ভুগত বোন !
মা বাটি ভর্তি জলে
সাদা কাপড় ডুবিয়ে ওর কপালে রাখত
সারারাত জেগে...
বাবা বলত -
মেয়েটা বেশিদিন বাঁঁচবে না বোধহয় !
আমি ফ্যালফ্যাল করে দেখতাম,
মায়ের চোখের জল
বাবার বুক থেকে গড়িয়ে পড়ছে আস্তে আস্তে !
স্মৃতিভ্রষ্ট সুরে একটা পাখি ডাকত !
আজকাল বোনকে ভিজতে দেখি,
ওর আর জ্বর আসে না।
ধুম জ্বরের দৈত্যের সঙ্গেই বিয়ে হয়ে গেছে কয়েক বছর হল...
অক্ষরসভায় দেখা হয়ে যায়
***
হত্যাকারীর ছবি এক হাতে,
অন্য হাতে সুপর্ণার ডানা !
বিস্তর হেঁটেছি অরণ্যে,
ঘুরেফিরে এসেছি অন্ধকারে।
যে স্বামী, স্ত্রী'র গান ভালবাসে!
ঊরুর প্রাচীরে এঁকে দেয়
মিশরীয় উল্কি-
সে স্বামীর চক্ষু গহ্বরে কালি,
ড্রয়ারে বিশ লক্ষ স্যারিডনের পাতা !
হত্যাকারীর ছবি এক হাতে,
অন্য হাতে ভাস্করের কবিতা...
( উৎসর্গ-ভাস্কর চক্রবর্তী )
পারিবারিক
***
দু'জন দুটো স্পষ্ট ধারণার ভেতর ঢুকে পড়ি !
সে ধারণার ভেতর ফুল ফোটে,
ফল ধরে।
দাদা,আমার দাদার সঙ্গে
কোনো বারান্দায় তুমুল তর্ক হলে
শেষমেশ বলে বসি -
'বন্ধ হোক ! এর চেয়ে কষা মাংস চেখে দেখি, চল...'
দু'জন দুটো স্পষ্ট ধারণা ভেতর থেকেই দেখি
বৃষ্টি নামল !
অহেতুক বৃষ্টি,
যা কিনা আমাদের দু'জনেরই প্রিয়...
কিছুটা অন্তত জানি
***
জানিনা,
প্রিয় খাতা কতগুলো বর্ণ জমালে
আকাশ হয়ে উঠবে...
একজীবনের পঞ্চম প্রেমিক যে প্রতিশ্রুতি নিয়ে আসে
তা দিয়ে ঘর বানানো যায় কিনা,
তর্ক হোক
বন্ধুমহলে !
সেই ফাঁকে প্রিয় খাতাও
বুক খুলে দেখাক,
পাটীগণিতের নিয়মে
জ্যোতিষশাস্ত্রকে বুড়ো আঙুল দেখিয়ে দিয়েছে সে।
কর্ষণ
***
অশ্রুদাগ নাও,
কপালে পরে যুদ্ধে যেও।
কেননা,
উদ্ভ্রান্ত প্রেমিকের পায়ে শিকল পরানোর চেয়ে সহজ হল যুদ্ধ।
অশ্রুদাগ দাও।
সারা গায়ে মাখি, যেন শ্মশানের ছাই !
একটু পরেই কৃষক লাঙল দিয়ে তুলে নেবে
আমাকে ও তাকে।
ধন্যবাদ
***
শহরে সেদিন নেমে এসেছিল অন্ধকার !
আপনি যে অন্ধ লোকটিকে
রাস্তা পার করে দিয়েছিলেন
তার জন্য আপনার কখনো মনখারাপ হবে না,
এমন কথা জোর দিয়ে বলতে পারেন ?
অন্ধ লোকটির হাতে কোনো লাঠি ছিল না !
মাথায় বিষণ্ণ টুপি !
রাস্তা পার করিয়ে দেওয়ার জন্য
আপনাকে সে ধন্যবাদ জানায়নি !
শহরে যেদিন আলোর অভাব থাকবে না
সেদিন ওই ধন্যবাদটুকুর কথা ভেবেই
আপনার মনখারাপ হবে না!
এমন কথা জোর দিয়ে বলতে পারেন?
অসাধারণ
উত্তরমুছুন