কবি সুদীপ্ত বিশ্বাস
কবি সুদীপ্ত বিশ্বাস |
কবি সুদীপ্ত বিশ্বাস জন্মগ্রহণ করেন ১৯৭৮ সালে নদিয়ার রানাঘাটে। কবিতা লিখছেন ১৯৯২ সাল থেকে। কবির কবিতা প্রকাশিত হয়েছে শুকতারা, নবকল্লোল, উদ্বোধন, বসুমতী, কবিসম্মেলন, চির সবুজ লেখা, তথ্যকেন্দ্র, প্রসাদ, দৃষ্টান্ত, গণশক্তি ইত্যাদি বাণিজ্যিক পত্রিকা ও অজস্র লিটিল ম্যাগাজিনে। কবিতার আবৃত্তি হয়েছে আকাশবাণী কলকাতা রেডিওতে। ঝিনুক জীবন কবির প্রথম বই। ২০১০ এ প্রকাশিত হয়। এরপর মেঘের মেয়ে, ছড়ার দেশে, পানকৌড়ির ডুব, হৃদি ছুঁয়ে যায়, Oyster Life বইগুলো এক এক করে প্রকাশিত হয়েছে। দিগন্তপ্রিয় নামে একটা পত্রিকা সম্পাদনা করেন। কবি পেশাতে পশ্চিমবঙ্গ সরকারের ডেপুটি ম্যাজিস্ট্রেট। নদিয়া জেলার রানাঘাটের বাসিন্দা। শিক্ষাগত যোগ্যতা বি ই,এম বি এ, ইউ জি সি নেট। স্বরবৃত্ত, অক্ষরবৃত্ত ও মাত্রাবৃত্ত তিন ছন্দেই কবিতা লেখেন।বড়দের কবিতার পাশাপাশি ছোটদের জন্যও কবিতা লেখেন।
কবি সুদীপ্ত বিশ্বাসের একগুচ্ছ কবিতা প্রকাশিত হল:
ঈশ্বর কাঁদছে
***
পৃথিবী মারা গেছে, তার প্রাচীন খোলসে
লেগে নেই কোনো জন্মদাগ।
ধু-ধু প্রান্তরে শুধু নীরস পাথর।
নিস্তব্ধ বাজনা বাজছে ফাঁকা হাওয়ার বুকে।
একদিন নদী ছিল,পাখিদের গান ছিল,
সোনালী প্রভাত ছিল, ফুলে প্রজাপতি ছিল।
পাতায় পাতায় ছিল সবুজের ছাপ,
মানুষের ইট, কাঠ, জঙ্গলও ছিল তার বুকে।
চুপচাপ সব কিছু মুছে গেছে।
মৃত্যুর গভীর থেকে উঠে আসছে বিষাক্ত নিশ্বাস।
নক্ষত্রের ফ্যাকাশে আলোরা
শুরু করতে পারছে না নতুন কোনও গান।
প্রেতপুরীতে একলা দাঁড়িয়ে রয়েছেন ঈশ্বর।
আশেপাশে কেউ নেই যে হাত রাখবে তার কাঁধে।
ঈশ্বর কাঁদছে, তার জমাট কান্নারা সৃষ্টি করছে নতুন নদীর !
অভিলাষ
***
তুমি যখন নদী হলে
আমার চোখে আলো
সাঁতরে ভাঙি উথাল-পাথাল ঢেউ
অনভ্যস্ত গহীন গাঙে
আনাড়ি এই মাঝি
তুমিই জানো, আর কি জানে কেউ ?
ঠিক সে সময় ঝাপুর-ঝুপুর
বৃষ্টি যদি নামে
আকাশ জুড়ে গলতে থাকে মেঘ
সুখ সাঁতারে শ্রান্ত আমি
ঘুমিয়ে যদি পড়ি
জানবে আমার কেটেছে উদ্বেগ।
ঘুম-ঘুম-ঘুম ঘুমের দেশে
স্বপ্নমাখা চোখে
দু'হাত দিয়ে জাপটে ধরি নদী
বাঁচতে রাজি অযুত বছর
আলোকবর্ষ পারে
ভালবাসা, তোমায় পাই গো যদি।
সহজ তুমি সহজ হয়েই
থেক আমার পাশে
গ্রীষ্ম দিনে, দারুণ মরুঝড়ে
বুকের পাশে নরম ওমের
পালক হয়ে থেক
শীতের রাতে বরফ যদি পড়ে।
বাক্যহারা
***
রাতদুপুরে আসছে উড়ে একটা দুটো স্বপ্ন পাখি
হারানো সেই সোনালি দিন, এখন একে কোথায় রাখি!
আবছা আলোয় চমকে দেখি সেই যে তুমি মেঘের মেয়ে
কলসি নিয়ে দুপুরবেলা একটু দুলে ফিরছ নেয়ে
হাল্কা রঙা কল্কা শাড়ি, দুলছে বেণী ইচ্ছেমত
স্তব্ধ চোখে থমকে থাকি, আরে এটাই সেই ছবি তো !
সেই যে যেটা হারিয়ে গেছে একটুখানি অসাবধানে
আজ পুরোটা রাখব ধরে, আজকে লিখে রাখব প্রাণে।
গভীর রাতে আবছা আলো, হতেও পারে চোখের ভুল
বলো না তুমি সত্যি করে,তুমি কি সেই টগরফুল?
যাচ্ছে খুলে স্মৃতির পাতা,ডাগর চোখে দেখছি খালি
অরফিউস ও ইউরিডিসি, বুদ্ধদেব ও আম্রপালি...
স্বর্গ বুঝি আসল নেমে আবছা আলো ঘরের কোণে
না বলা কথা অনেক ছিল পড়ছে না যে কিছুই মনে।
হঠাৎ দেখি কাঁদছ তুমি, তোমার চোখে অশ্রুধারা
তোমার মুখে আমার ছায়া আনন্দেতে বাক্যহারা।
আগামী দিনের ধর্ম
***
এমন দিনও আসবে যখন কোনও ধর্মই থাকবে না
মানুষ তখন গড-ভগবান কাউকে মনে রাখবে না।
মানুষ হবে মুক্তমনা বুদ্ধি জ্ঞানে দীপ্ত
ধর্ম নামের খুড়োর-কলে হবে না তাই ক্ষিপ্ত।
আগামীতে সেই মানুষই বিশ্বজুড়ে বাঁচবে
তারায়-তারায়, গ্যালাক্সিতে মনের সুখে নাচবে।
স্বপ্নমাখা ডাগর চোখে করবে মানুষ কর্ম
ধর্ম হবে মানবতা,বিবেক হবে ধর্ম।
এমন দিনও আসবে যখন কোনও ধর্মই থাকবে না
ধর্ম নামের কালো চশমা অন্ধ করে রাখবে না।
ফেরা
***
বহমান স্রোতধারা পথ নেই, পরিচয় নেই
পাগলের মত শুধু ছুটে ছুটে মরে...
আমিও ছুটেছি কত শ্মশানে মশানে
মৃত্যুর গভীরে গিয়ে খুঁজেছি স্ফটিক!
বিষাদেরা জমে জমে হয়েছে পাথর
অন্ধকূপের গভীরে আজীবন...
আজীবন এক কূপের গভীরে
লোফালুফি করে গেছি একটা পাথর
জানি তুমি ফিরবে না
ফিরতে পারো না
তবুও তো মনে হয়,স্মৃতির গভীরে
অশ্বত্থের ডালে অবেলায়
প্রাচীন পেঁচার মত
কোনোদিন হাউমাউ ফিরে আসতে পারো...
ভাল না বাসলে
***
ভাল না বাসলে যা'হোক-তা'হোক
বেঁচেই যেতাম, বেঁচেই যেতাম।
জোড়াতালি আর তাপ্পি মেরে
নুনের সাথে পান্তা খেয়ে,
চিংড়ি ইলিশ না জুটলেও
যা'হোক-তা'হোক, বেঁচেই যেতাম ।
এখন দুপুর নীরস লাগে
সকাল বিকেল নিমের পাঁচন,
রাত্রিতেও ঘুম আসে না, ঘুম আসে না।
সব পেয়েছির সে দেশ ঘুরে
সর্বহারা ফকির হয়ে
ছেঁড়া মলিন হৃদয় নিয়ে
দগ্ধে দগ্ধে বাঁচার কষ্টে
ঘুম আসে না, ঘুম আসে না।
ভাল না বাসলে পাহাড়-নদী
কিংবা খুশির ঝর্ণা দেখে
ভোরবেলাতে পাখির গানে
বেঁচেই যেতাম বেঁচেই যেতাম।
এখন বড়ই একলা একা
থমকে থাকে রাত দিন সব
আর সেতারে সুর লাগে না, সুর লাগে না।
পথিক
***
পথিক আমি আপন মনে পথ চলেছি পথের টানে,
হিসেব নিকেশ সব ভুলেছি ঝর্ণা তলে পাখির গানে।
নদীর রূপে বিভোর হয়ে কলকলিয়ে চলছি ভেসে
দীপ জ্বালিয়ে আকাশটা রোজ পাগল করে এক নিমেষে ।
নীল পরি ও লাল পরিরা,তারার দেশে- অ্যান্ড্রোমিডায়,
ফিসফিসানো হাতছানিতে রোজ এসে রোজ খোঁজ নিয়ে যায়।
সে ডাক শুনে কেউ কখনো আর কি ঘরে থাকতে পারে ?
উদাস বাউল শাপলা শালুক একলা খোঁজে নদীর পাড়ে।
অনেকটা পথ পেরিয়ে তবু, ডাগর দুচোখ স্বপ্ন মাখা;
নাম না জানা ফুলের উপর প্রজাপতির রঙিন পাখা !
মাঠের পরে মাঠ পেরিয়ে সবুজ মেখে চলছে নদী,
ছলাৎ ছলাৎ ছন্দ তুলে গান ধরেছে সপ্তপদী !
বেশ তো ছিলাম, হঠাৎ কেন বাউল বাতাস লাগল প্রাণে !
পথিক আমি আপন মনে পথ চলেছি পথের টানে...
বাক্যহারা
***
অবলা কথারা আটকে রয়েছে চোখে
অবুঝ মনের বোবা কান্নার মত
আজকে এখন পাথর চোখেতে শুধু
হারানো আবেগ পুরানো দিনের ক্ষত।
বুঝলে না কিছু বুঝতে চাওনি বলে
সুরের ইশারা সুরকার শুধু জানে
দূরের বাতাস দূরে চলে যায় আরও
মন শুধু বোঝে হারানো গানের মানে।
এসেছিল যেটা একদিন নিঃশব্দে
বাতাসেও ছিল চুপিচুপি আসা যাওয়া
রূপকথা দেশে হারানো বিকেলগুলো
সবটাই যেন মিথ্যে অলীক মায়া।
জীবনের খাতা ভাসানোর পর পর
দু'চোখ ভেজায় অঝোর অশ্রুধারা
অল্প দুঃখে সশব্দে কেঁদে ওঠে
গভীর দুঃখে ঠোঁটেরা বাক্যহারা।
নগ্নতা
***
রাতের কাছে নগ্ন হতে লজ্জা তো নেই;
বরং ও রাত ঘন কালো চাদর মুড়ে
ঢেকে রাখে আমার যত নগ্নতা সব।
ওই আকাশে নগ্ন হতে লজ্জা তো নেই;
বরং আকাশ ছাতার মত মাথার উপর
মুড়ে রাখে সবকিছু তার বুকের ভিতর।
জল বাতাসে নগ্ন হতে লজ্জা তো নেই;
বরং তারা একটু বেশি খুশি হয়েই
ফিসফিসিয়ে বলে কিছু বাড়তি কথা।
নদীর কাছেও নগ্ন হতে লজ্জা তো নেই;
বরং নদী ছলাত-ছলাত ছন্দ তুলে
নগ্ন হয়েই আমায় শুধু নাইতে বলে।
বন-পাহাড়ে নগ্ন হতে লজ্জা তো নেই
বরং তারা খুব খুশিতে দুজনেই চায়
আমি যেন খালি পায়ে যাই হেঁটে যাই।
পশুপাখি ওদের কাছেও লজ্জা তো নেই;
বরং তারা বন্দুক আর চশমা-টুপি
এসব ছাড়ায়, সত্যি কোনও বন্ধুকে চায়।
এই পৃথিবীর সত্য যারা তাদের কাছে
নগ্ন হতে লজ্জা তো নেই, লজ্জা তো নেই
কারণ সত্য নগ্ন হতে লজ্জা পায় না।
মানুষ দেখে নগ্ন হতে লজ্জা করে
মানুষগুলো লুকিয়ে রাখে নিজের মুখও
তারা শুধুই মিথ্যে বলে, মুখোশ পরে।
এই সমাজে নগ্ন হতে লজ্জা করে
গোটা সমাজ মিথ্যেবাদী, ভ্রষ্টাচারী
নগ্নতা আর সরলতার সুযোগ খোঁজে।
কালবেলা
***
মুখোশের মাঝে মুখটা হারিয়ে গেলে
মানুষে-মানুষে যবনিকা নেমে আসে,
উজানের স্রোতে অনেক সাঁতারু ছিল
অকুল পাথারে একজনও নেই পাশে।
বন্ধুর বুকে বন্ধু বসালে ছুরি,
ভাইয়ের রক্তে দু'হাত রাঙালে ভাই;
মনের আগুনে প্রতিদিন পুড়ে-পুড়ে
চিতার জন্য পড়ে থাকে শুধু ছাই।
ধর্মের নামে অন্ধেরা উন্মাদ
রক্তে-রক্তে রাঙিয়ে নিচ্ছে হাত;
মৃতের মিছিলে কত অসহায় মুখ
প্রশ্ন করছে,মৃত্যুর আছে জাত ?
খুনের মিছিলে এ কেমন সভ্যতা ?
প্রতিবাদ ? তুমি প্রতিবাদী ভাষা শেখো;
ধর্মের-কল আগুনে পুড়িয়ে দিয়ে
মানুষে-মানুষে ভালবাসা লিখে রেখো।
আজকাল
***
বিপদেরা চুপচাপ ওত পেতে থাকে,
নদীর প্রতিটি বাঁকে-বাঁকে।
সাবধান ! সাবধান মাঝি
শ্বাপদের চেয়ে হিংস্র মানুষের কারসাজি।
মুখোশের আড়ালেতে ঢাকা সব মুখ
ঠকাতে শেখেনি যে,সে উজবুক।
আলো নেই,
চারিদিকে জমেছে আঁধার চাপচাপ
মানুষকে ভালবাসা ভুল নয়, পাপ।
বৃষ্টি এলে
***
বৃষ্টি এলে বুকের ভিতর গোলাপ কুঁড়ি ফোটে
বৃষ্টি এলে মনটা বড় উদাস হয়ে ওঠে।
বৃষ্টি এলে শিউলিতলায়, ছাতিমগাছের ডালে
মনটা বড় কেমন করে বৃষ্টি-ঝরা কালে।
এখন তুমি অনেকদূরে না জানি কোনখানে,
ভিজছো কিংবা গুনগুনিয়ে সুর তুলেছো গানে।
তোমার গানের সেই সুরটাই বৃষ্টি হয়ে এসে
টাপুরটুপুর পড়ছে ঝরে মেঘকে ভালবেসে।
মেঘ বিরহী,কান্নাটা তার বৃষ্টি হয়ে ঝরে
তোমার বুঝি মেঘ দেখলেই আমায় মনে পড়ে ?
পূর্বরাগ
***
যেই গিয়েছি তোমায় ছুঁতে তুমি বললে, 'না-না'
তোমার ছোঁয়ায় স্বপ্নগুলো ঝটপটাল ডানা।
ফাগুন এসে আগুন দিল কৃষ্ণচূড়ার বনে,
সেই আলোতে সুখ-পাখিটা বাঁধল বাসা মনে।
অলস দুপুর, নিঝুম বিকেল একলা বসে আছি,
স্বপ্নগুলো বাঁধ মানে না, করছে নাচানাচি।
স্তব্ধ ? হ্যাঁগো, স্তব্ধ হয়েই ছিলাম বছর-মাস;
পায়ের তলায় সরছে মাটি, চরম সর্বনাশ !
ডানায়-ডানায় উড়তে হবে পথ যে অনেক বাকি;
সেসব ভুলে অবুঝ আমি, বিভোর হয়ে থাকি !
কালচিত্র
***
দিনকে ফাঁকি দিতে পারলেও
রাতের কাছে হেরে যাই রোজ!
স্বপ্নেরা সব মুখ থুবড়ে পড়ে
চোখের জলে বালিস ভিজতে থাকে।
তারপর খুব ক্লান্ত হলে,
গভীর ঘুমে পাই মৃত্যুর স্বাদ।
সারারাত জ্বলতে-জ্বলতে
রাতের তারার সলতে ফুরিয়ে যায়।
আবার একটা দিন...
আবার ছোটা শুরু...
কিছু কথা
***
কিছু কথা না শোনাই ভাল
ভুলে যাওয়া ভাল কিছু কথা,
কিছু কথা শুধু ভেসে যায়
দাগ কাটে কিছু নিরবতা।
কিছু কথা যায় না তো ভোলা
কিছু কথা বেমালুম ভুলি,
কিছু কথা শুনে সুখ পাই
কিছু কথা বলে কান মুলি।
কিছু কথা, মানে নেই কোনও
কিছু কথা বড়ই ভাবায়,
কিছু কথা দেয় দূরে ঠেলে
কিছু কথা ডাকে, আয় আয়...
কিছু কথা, যেন পেঁজা তুলো
এদিক ওদিক যাক উড়ে,
কিছু কথা চড়ুক চিতায়
ছাই হয়ে যাক জ্বলে পুড়ে।
কিছু কথা, যাক থেমে যাক
কিছু কথা বল তুমি প্রিয়,
কিছু কথা ডাস্টবিনে রেখে
কিছু কথা বুকে তুলে নিও...
মুক্তি
***
আগুন ? হ্যাঁ গো আগুনই বেশ ভাল
আগুনেই তো পোড়ায়, করে ছাই
দুঃসহ সেই স্মৃতির দহন থেকে
মুক্তি পেতে আগুন তোকেই চাই।
একলা ঘরে ডুকরে কাঁদার পরে
বাষ্প হয়ে ওড়ে অশ্রুকণা
ভুলে যাওয়া ? সেটাই বরং ভাল
ভুলে যেতে জানে গো ক’জনা ?
একলা আমি একাই হাঁটতে পারি
চাইনা আমি চাইনা কারও ছায়া
একটুখানি ভুলে থাকতে গেলেই
আগুন না গো, পোড়ায় আমায় মায়া।